(১)
ডাক্তার
পদবী নিয়ে চাকরি করতে আজকাল কেউ গ্রামে আসতে চান না। এর পেছনের কারন বলতে গেলে
-এটা সুস্পষ্ট যে, এত্ত শত পড়ালেখা আর শহরের চাকচিক্য জীবন কেউ ছেড়ে অজপাড়া গাঁয়ে
কোন নব্য ডাক্তার চাকরি করতে আসতে; কখনও মন থেকে চান না।
তবে
এক্ষেত্রে সবার থেকে কেন জানি আমি আলাদা! চিন্তাভাবনার স্বাভাবিক ঠোক্কর হয়ত সবার
সাথে আমার সেখানেই।
যাক সে
কথা;
চাকরিতে
নিয়োগ পেয়েছি, সরকারি ডাক্তার। তাই আজ সকালেই আমার ব্যাগ, কাপড় ভর্তি লাগেজ গুছিয়ে
পা রেখেছি সিরাজগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামের উদ্দেশ্য। সোজা বলতে একদম অজঁপাড়া
গাঁ।
আগে
থেকে যদিও কোন পরিচিতি নেই কিন্তু তার বদলে ক্ষুদে টোটকা আছে, ইংরেজীতে যাকে বলে
টিপস।
আমার এক
সিনিয়র ভাইয়ের দেয়া, তার ব্যাস্ত সময় থেকে মিনিট পাঁচেকের ফোনালাপ।
খুব
সহজে যা ছোট্ট কয়েক লাইনে বলা যায়।
ও
গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। সে কারণে পানির জন্য নলকূপ আর গায়ে বাতাসের জন্য
হাতপাখা-ই ভরসা।
মেম্বার
ই গ্রামে সব, চেয়ারম্যান আছেন তবে অতটা প্রতাপশালী নন। গ্রামে লোকজন হাতে গোনা,
শতেক বাড়ি ধরতে গেলে; মুখচেনা প্রায় সবাই।
সমস্যা
হচ্ছে, ব্রান্ডের কোন দামী জিনিস খুব মেলে
না। ওগুলো গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে পাওয়া যায়। আমার জন্য থাকার ঘর আছে, শুধু সেটার
নাকি চালা টিনের।
গাঁয়ে
যাবার জন্য রিকসা নেই ভ্যান আছে, লোকাল ভাড়া পনেরো টাকা। পথ চার কিলো।
ছ'ঘন্টার
হাড় ম্যাড়মেড়ে এক জার্নি শেষ করে গ্রামে যখন পা রেখেছি তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে
গেছে, এদিক সেদিকে দু এক বাতি আলো দেখতে পাচ্ছি। আমার রেডিয়াম জ্বলা ঘড়ির কাটায়
তখন সন্ধ্যে ৬ টা ছুঁয়েছে।
ভ্যানে
এসে যেখানে থেমেছে- সেটা মনে হচ্ছে গ্রামের বাজার; হ্যাজাক আলোতে দোকান চলছে।
গানের পাশাপাশি চা চামচের টুং টাং চলছে চীনা মাটির কাপে। লোকজনের গমগমে আওয়াজ।
গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা ধরে মাঝে মাঝে মাঝারি সাইজের দু-একটা ভ্যান বেল বাজিয়ে চলে
যাচ্ছে।
মনে মনে
বললাম, নাহ! সাইফুল ভাই যতটা বলেছিলেন ঠিক ততটা অবশ্য নেগেটিভ লাগছে না। এতক্ষন
ভ্যানে বসেই আশেপাশের সব চুপচাপ দেখছিলাম।
এবার
ভ্যান থেকে নামতেই চা দোকানে আর তার পাশের
বসে থাকা বৃদ্ধ এবং জোয়ান মুখগুলো আমাকে
দেখতে আর নিজেদের মাঝে মৃদ্যু গুনগুন করতে
লাগল।
হঠাৎ
সবার মাঝ থেকে কালো করে লুংগি পড়া, গেঞ্জি গায়ে একটা লোক এগিয়ে এসেই আমাকে লম্বা
সালাম দিল, "আসসালামু আলাইকুম, আপনে কি ঢাকার হেই ডাক্তার সাব?"
মাথা
নাড়িয়ে বুঝালাম, আমি ই সে।
চকচকে
সাদা দাঁতের হাসি দিয়ে বলল, "আপনের লাইগা বইয়া রইছি হেই দুপুর থেইকা "
লোকটি
তার কোমড়ে গামছা টা বেঁধে, তার হাত দু'খানা এগিয়ে দিল আমার হাতের দিকে।
"দেন
আমারে দেন ব্যাগ "
ততক্ষণে
ভ্যান থেকে ব্যাগ মাটিতে নামিয়ে আমি নিজেই নিয়েছি।
আমার হাতে ঝুলে থাকা ব্যাগ আর লাগেজ নিজের মাথায়
তুলে নিয়ে বলল, "আসেন স্যার! আমার সাথে আসেন "
উৎসুক
হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কতটা পথ ভাই?"
সে বলল,
"বেশী না! দশ মিনিটের রাস্তা "
বলেই ওর
ডান হাতে থাকা টর্চের আলো ফেলে গাঁয়ের মেঠো পথে আমরা দুজন পথ চলতে শুরু করলাম।
ঝোপঝাড়
থেকে ভেসে আসা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক মন দিয়ে শুনছি আমি, ব্যাঙের ডাকাডাকিও চলছে সমান
তালে। বৃষ্টি হয়েছিল হয়ত, রাস্তাটা বেজায় পিচ্ছিল।
পথে যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল, "স্যার,
একটু দেইখা আইসেন, ম্যালা গর্ত। পোলাপান মার্বেল খেইলা এই কাম করছে!
আমি
পাল্টা জবাব দিলাম না।
সে আবার
বলল, "স্যার, আসতে সমস্যা হয় নাই তো? "
না। (
এবার ধীর স্বরে বললাম)
সে
অবশ্য রীতিমত খুশী মনেই জবাব দিল,
"আইচ্ছা
আইচ্ছা "
এক দু
মিনিট পর আমিই এবার জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার নাম টা তো জানা হলো না?"
জবাব
দিল হাসিমুখে,
হে হে
আমি -"ইদ্রিস! পুরা নাম মোঃ ইদ্রিস মিয়াঁ "
পড়ালেখা?
করি
নাই, এখন ক্ষ্যাতে কাম করি আরর বাড়ি দেখাশুনা করি।
আর কথা
হলো না। বাকী পথটা আমার কাটল গাঁয়ের শুনশান নীরবতায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক পথের সারি
ধরে গড়ে উঠা বাড়ির ভেতর মানুষের অস্ফুট আলাপন শুনে।
আমার
থাকার জন্য দেয়া ঘরটায় টিনের চালা দেয়া সে তো আগেই জেনেছি, এখন দেখছি তাতে টিনের
বেড়াও দেয়া আছে। সেই সাথে ঘরে একটা হলদে লাইট আছে চালার ঠিক কাছে এবং একটা ফ্যানও
অবশ্য দেখতে পাচ্ছি। বিদ্যুৎ নেই তাই দুটোই
ব্যাটারি তে চলে।
মন মনে
সাইফুল ভাইয়ের প্রতি একটা মোক্ষম রাগ জন্মাল, কিছুই মিলছে না। বলেছিলেন শুদু টিনের
চালা, এখন তো তাতে টিনের বেড়াও দেখতে পাচ্ছি। পুরোনো কথা মনে পড়ল-' খাবার এবং মুভি
দুটোই নিজ থেকে চেখে দেখার আগে অন্যের কথায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায় না!'
রাতেও
এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, বেশ ঠান্ডা লাগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম রাতে ফ্যান ছেড়ে ঘুমাতে
হবে কিন্তু এখন দেখছি ফ্যান না হলেও চলে যাবে।
ঘরের সামনে ছাউনি ঘেরা একটা ছোট্ট বারান্দা আছে।
তার পাশে সরু মতন হাসনাহেনা ফুলের গাছ। এত্ত রাতে গাছের আকার বুঝতে না পারলেও
ফুলের ঘ্রাণ একেবারে নাক হয়ে এসে সরাসরি কলিজায় এসে ঘা দিচ্ছে, বেশী অসাধারণ সে
ফুলের গন্ধ!
খাবার
শেষ করতে করতে ইদ্রিসের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম বেচারা বার চা'রেক হাই তুলে ফেলেছে,
জলদি জলদি ঘুমানোর অভ্যেস এদের। আমার মত ইনসোমেনিক নয় এরা।
তাই
বললাম, "ইদ্রিস? বাকী কিছু যদি বলার থাকে তাহলে সেটা বলে তুমি ঘুমাতে চলে
যাও। "
ইদ্রিস
ফ্যানের সুইচ টা দেখিয়ে দিয়ে গেল; আর বলে গেল ব্যাটারি দিয়ে পাক্কা চার ঘন্টা
ব্যাকআপ পাবেন। তবে যদি লাইট জ্বালাই, তাহলে আরো কম পাবো।
জিজ্ঞেস
করলাম, রাতে মোবাইল চার্জ?
হাসি
মুখে বলল, বাজারে সন্ধ্যায় পাইবেন। এক ঘন্টা চার্জ দিলে ১০ টাকা।
ওরে
ব্বাস! মুখ খানা কুঁচকে গেল! সাথে পাওয়ার ব্যাংক আছে সাথে, এ দিয়ে আজ রাত চলে
যাবে। চিন্তা নেই।
ইদ্রিস
চলে গেল। বাড়িতে আমি একা। এখন কেন জানি সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত এ গাঁয়ে এসে ঢাকা
শহরটাকে খুব বেশী বেশী মনে পড়ছে। সীমাহীন শুন্যতায় ডুবে আছি এ মুহূর্তে। জীবনে ক্যান্সারের ভয়ে কাটাতে পেরেছি হয়ত জানি
মৃত্যু একদিন হবে তাই পকেটে থাকা মার্লব্রো থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ওটা
বারান্দার চেয়ারে বসে টানতে লাগলাম।
ভালোরকম
ঘুম পাচ্ছিল, জার্নির ধকল আছে। ঘড়িতে হাতের রেডিয়াম কাটায় সোজা রাত ১১ টা
ছুঁইছুঁই। ঘরে এসেসে বারান্দার দরজায় খিল দিলাম। এরপর লাইট না জ্বালিয়ে একেবারে
মোবাইল টা হাতের কাছাকাছি আর মাথাটা বালিশে রেখে চোখ বুজলাম। চোখ বুজে এল খুব
শীঘ্রই।
(২)
ঘুম কখন
ভাঙল জানি না, কিন্তু আধবোজা চোখে স্পট শুনতে পাচ্ছি ঘরের বাইরে থেকে কেউ বেজায়
ডাকাডাকি করছে। কান খাড়া করে আরেকবার
শুনতে চাইলাম,
ডাক্তার!!
ও ডাক্তার!!
ডেকেই
যাচ্ছে কেউ......
পা ঝাড়া
দিয়ে মাথার কাছে বালিশে হাতরে মোবাইল টা খুঁজে নিলাম, দেখলাম ভোর রাত, সময় ৪ টা
১৫।
আমি
আবার ডাক শুনতে পেলাম, তবে যিনি ডাকছেন তিনি দরজায় কড়া নাড়ছেন না। শুধু ডেকে
চলেছেন।
এ গাঁয়ে
আমার আজ প্রথমদিন তবুও ইচ্ছে করছিল না বাইরে যেতে। বেজায় ঘুম কাতুরে আমি। কিন্তু
প্রথম দিনেই ডাক্তারের অবহেলা, নিউজে গেলেই আবার নিজের চাকরী নিয়ে টানাটানি!
বিছানা
ছেড়ে উঠতেই হলো এবার।
ইতস্তত
ভেবে দরজা খুললাম; দেখি, মাথায় চাদর টানা এক লোক। যদিও আধাঁরে চেহারা বোঝা যাচ্ছিল
না তবে কন্ঠ শুনে দিব্যি বুঝতে পারছি যে লোকটি মাঝ বয়েসি হবে। বাইরে ভোরের আলো
এখনো ফোটেনি তেমন। ঈষৎ অন্ধকার। আমাকে দরজা খুলতে দেখেই লোকটি আমায় কাঁপা গলায়
বলল, "বাবু আমার লগে আহেন, আমার মাইয়ার খুব জ্বর! "
কম্পিত
গলায় বললাম, আমি আসছি! একটু দাঁড়ান।
ভেতরে
এসেই স্টেথোস্কোপ আর ফার্স্ট এইডের ব্যাগ টা দ্রুত হাতে নিয়ে বাইরে এসে বললাম,
"আপনার সাথে লাইট আছে, আমি তো পথ চিনি না! "
সে
শান্ত গলায় বলল, "আমি চিনি, আমার লগে আহেন বাবু "
বাগানের
পথ পেড়িয়ে আমরা দুজন সোজা হেটে চলেছি, আমার পথ চেনার বিন্দুমাত্র কথা নেই। আমি
শুধু লোকটিকে ফলো করছি।
বিশ
মিনিটের পথ হেটেছি আশাকরি, এখনো পথের পরে কোন বাড়ি দেখছি না। হেটেছি গাঁয়ের সে
মেঠোপথ ধরেই।
অনেকটা
পথ যেতেই চোখে এল একটা জীর্ণ কুটির। একপাশ প্রায় ধসে গেছে বলতে হয়, একটা শীর্ণ
গোয়াল আছে কিন্তু গরু নেই। তবুও সেখানে কয়েক কুটো খড় পড়ে আছে। বাড়ির উঠোনে ছোট বড়
গর্ত। হয়ত গাঁয়ের বাচ্চারা খেলে এখানে। ঘরের আশেপাশে আর কোন বাড়ি নেই, একটা মাত্র
ছোট উঠোন।
আমি
এদিক-ওদিক দেখছি দেখেই লোকটা বলল, "আসেন বাবু, ভেতরে আসেন "
নীচু
ঘরটায় মাথা বাঁচিয়ে ঢুকে দেখি। আধাভাঙা চৌকিতে একটা ছ' কি সাত বছরের মেয়ে জ্বরে
কাতরাচ্ছে।
আমি
দেখেই ঘরের এক কোণে বসা লম্বা ঘোমটা টানা একজন মহিলা -একটা বসবার পিড়ি এগিয়ে দিলেন
আমার দিকে।
পিড়িতে
বসে আমি মেয়েটির কপালে হাত রাখলাম, বেশ জ্বর। কপাল অতটা গরম নয় কিন্তু জ্বর খুব
কমও না!
মেয়েটার
চোখ, পালস, জিহ্বা দেখে-টেখে কয়েকটা ওষুধ আমার ব্যাগ থেকেই বের করে দিলাম।
বললাম,
"এগুলো খাওয়ান আর কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করুন নয়ত শরীর দূর্বল হয়ে যাবে "
আমার
কথায় সায় দিয়ে ম্যানমেনে স্বরে মহিলা বললেন, "সকাল থেইকা কিচ্ছু খায় নাই
"
বললাম,
"আপনারা খাবার আর ওষুধ খাওয়ান আমি পরে এসে দেখে যাবো। "
লোকটি
আমাকে আবার আমার ঘর পথ পর্যন্ত নিজে এসে এগিয়ে দিয়ে গেল। সেইসাথে দিয়ে গেল অফুরন্ত
ধন্যবাদ, বলল, আমার মত নাকি মানুষ হয় না!
আমি
লজ্জিত বোধ করলাম এত প্রশংসায়।
ঘরে এসে
আর ঘুম আসছিল না, একটা মার্লব্রো হাতে নিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে গেলাম। হঠাৎ কি
মনে করে মোবাইলে হাত দিলাম, কেউ ফোন করেনি তো এর মাঝে। নাহ! নোটিফিকেশন নেই।
নেটওয়ার্ক
সিগন্যালও একদম খারাপ! একটা বার আসে কি আসে না। তবে সব ছাপিয়ে অবাক হলাম, যখন আমার
টাইমে চোখ পড়ল। দেখলাম রাত ৪ টা ১৫ মিনিট।
হাতের
সিগারেট টা মুখে নিয়ে জলদি ঘরে এলাম, এসে হাতঘড়ি টা ভালোকরে দেখলাম এখানে ৪টা ১৬
কিন্তু সে তো এক মিনিটের হেরফের! বাকী বিশ মিনিটের পথ হাটা, রোগী দেখা! কিচ্ছু
মিলছে না! ঘুম থেকে উঠে কি ভুল দেখেছি!
সকাল
ছ'টায় ইদ্রিস এসেছে, জিজ্ঞেস করল "বাবু, রাতে ঘুম কেমন হইছে? গিরামে আইসা কি
ভাল্লাগতাসেনা? " হাসি দিয়েই শেষ করল কথাটা।
আমতা
আমতা করে বললাম, না না! ঘুমে সমস্যা হয় নি
(তারপর
ভোররাতের ঘটনা চেপে গেলাম)
তুমি কই
ছিলা? এত দেরী?
ওই যে
কইছিলাম না। ক্ষ্যাতের কাম! তাই দেরী হইছে। কোন সমস্যা হইছে স্যার?
না বলে
চেপে গেলাম। "না, সমস্যা না চল নাস্তা সেরে হাসপাতালে যাই "
আইচ্ছা,
আমি এহনি নাস্তার ব্যাবস্থা করতাছি। (ইদ্রিস চলে গেল)
দিনের
বেলা অনেক রোগী আসে, সরকারি হেলথ কমপ্লেক্সে। এটা বুঝলাম এরা কেন সহজে সেবা পান
না, যারা এখানে এ পর্যন্ত বদলী হয়ে এসেছেন তারা কেউ-ই এখানে ডিউটি করেননি ঠিকমত।
যা করেছেন ওই এক- দু দিন। বাকীদিন
পড়াশোনা, নয়ত টাকা পেছনে ছুটেছেন। এ কারনে কিছু লোক আমাকেও ভাল মন্দ কথা শুনিয়ে গেলেন।
আমার
প্রথম দিন কাটল ভাল-মন্দ অভিজ্ঞতায়।
(৩)
রাতে
খাবার পর ইদ্রিস আমাকে জিজ্ঞেস করল পাহারা লাগবে কি না? আমি সোজা না করে দিলাম।
অন্যের ঘুম নষ্ট করে দেয়ার পক্ষপাতী আমি নই।
তবে এ
ঠিক, গতরাতের কথা টা এখনো মেলাতে পারছি না।
ঘুমিয়ে
গেছিলাম, হাসনাহেনা ফুলগাছ টা থেকে আজ বেশী করে গন্ধ ছড়াচ্ছে, আজ রাতে কেউ ডাকে নি
তবুও ঘুম ভেঙেছে। ঘড়িতে দেখলাম ভোররাত ৪
টা ২০ মিনিট। যাক কুফা সময়ে তো ঘুম ভাঙল না!
আর ঘুম
আসছিল না, ফ্যান সিলিঙে চলছে ঘরঘর শব্দে। এপাশ-ওপাশ করে শেষমেষ আর বিছানায় থাকা
গেল না।
সিগারেট
আঙুলে গুজে বারান্দায় এলাম। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে, শহরে বাতাসে এই গ্রাম্য মায়ার
অনেক অভাব।
লাইটার
দিয়ে সিগারেট জ্বালাতে যাবো ঠিক তখনি ছপ শব্দে কেউ একজন বাগানের ডালিম গাছটার
আড়ালে চলে গেল।
আচমকা
মনে হলো, চোর নয়ত!
কে? কে ওখানে? (বেশ জোর গলায় বললাম)
কিন্তু
উত্তর এল শান্ত গলায়, চাপা স্বরে।
ধীর
পায়ে এক লোক এগিয়ে এল, আমি ডাক্তারবাবু।
কন্ঠ টা
চেনা মনে হলো, একি? আপনি?
জ্বী।
আপনার সাথে দেখা করতে আসছিলাম।
লোকটির
চেহারা আজো দেখতে পাচ্ছি না, চাদরে চাপানো মুখ। সোজা কথা, লোকটার সাথে কথা বলছি গত
দু'দিন থেকে একদম না দেখে।
জিজ্ঞেস
করলাম, "আপনার মেয়ের জ্বর কমেছে? "
মাথা
নাড়িয়ে বুঝাল, কমেছে।
আমি
বললাম, দাঁড়ান এক মিনিট!
ভেতরে
এসে আমার ব্যাগে থাকা কয়েক প্যাকেট বিস্কিট আর ওষুধ নিয়ে ফিরলাম বারান্দায়। সেগুলো
তার দিকে বাড়িয়ে বললাম, আপনার মেয়েকে দেবেন।
না না
বলে শেষে,
লোকটি
ইতস্তত করে তার হাত দুটো আমার দেয়া জিনিস গুলোর দিকে বাড়াতেই অল্প আলোতে যা দেখলাম
তাতে গলা থেকে পা ঠান্ডা হয়ে এল আমার, ওগুলো হাত হয়ত ঠিকি কিন্তু তাতে কোন মাংস
নেই, সোজা কংকাল!
একজোড়া
কংকাল হাত আমার হাতের জিনিস নিচ্ছে!
আমার
নার্ভ যথেষ্ট শক্ত ছিল, মেডিকেল লাইফে অনেক আর টি এ (রোড ট্রাফিক এক্সিডেন্ট),
বিকৃত লাশ দেখেছি কিন্তু কাউকে এভাবে কথা বলতে দেখিনি! নার্ভাস ব্রেক ডাউন হল,
এরপর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান
ফিরে আসায় চোখ খুললাম, সিলিঙে ফ্যান ঘুড়ছে কড়কড় করে। ফ্যানটা আমার চেনা, ঘরের ভেতর
আমি। আমার পালস দেখছেন সদর থেকে আসা মাহবুব ভাই। উনি আমাকে চেনেন। আমার
ইন্টার্নশিপ এর সময় সি এ ছিলেন।
বললেন,
কি? সব ঠিক?
মাথা
নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
ইদ্রিস
দাঁড়িয়ে আছে পাশেই, সব আছে ঠিকি কিন্তু চাকরী টা হয়ত আর এখানে করার ইচ্ছে টা আর
নেই!
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন