রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭

গল্পঃ অনভিপ্রেত




লেখেন-টেখেন?
প্রশ্নটা যে আমাকেই করা হয়েছে এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। গাঁয়ের পথ ধরে মৃদুমন্দ গতিতে চলতে থাকা রংচটা ভ্যানে আমরা যাত্রী তিনজন। এর মাঝে তৃতীয়জন হচ্ছে ভ্যান চালক। পড়নে লুঙ্গী, গায়ে বার্সেলোনার জার্সি কিন্তু সেটা বোধহয় আসল নয়, লোকাল পণ্য। তার চোখ কাঁচা রাস্তা ধরে সামনের দিকে। ভ্যানের প্যাডেলে পা ফেলে সে চলেছে আমাদের দুজন কে পৌঁছে দিতে। রেলস্টেশন থেকে উঠেছি কেবল আমরা দুজন। ঘড়ি ধরে তখন বিকেল চারটে। এখন চারটে বারো। এর মাঝে আমরা তিনজনের কেউ ই কোন কথা বলিনি। আমি ব্যস্ত আমার ট্যাবে। পাশের ভদ্রলোক আজকের পেপারে চোখ রেখেছিলেন। হয়ত সেটাও ট্রেনে কেনা।
এই যে ভাই? শুনছেন? (লোকটি আমাকে আবার ডাক দিল)
জ্বী বলুন! সরি, আমি শুনতে পাই নি।
লেখালেখি করেন মনে হচ্ছে?
না না। ওসবে ধারণা নেই। অনলাইনে নিউজ পরছিলাম।
আচ্ছা। (বলে ভদ্রলোক চুপ হয়ে গেলেন)
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। অযথা গায়ে পড়ে কথা বলা আমার স্বভাবের কোনদিকে ই পড়ে না। আবার মন দিলাম হাতের ট্যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওয়েব পেইজ লোড নিতে দেরী হচ্ছিল দেখে ট্যাবের বারে তাকিয়ে দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই। অজগাঁয়ের যত ভেতরে যাচ্ছি নেটওয়ার্ক তত কানামাছি খেলছে। বার দুয়েক এসেও চলে গেল দুটো নেট বার। বিরক্ত হয়ে বললাম, "ধ্যাত! শহর আর গ্রাম! সব জায়গাতে ই একই দশা। নেটওয়ার্ক থাকে না।"
আবার অভিব্যক্তি দেখে পাশের যাত্রী ভদ্রলোক তার ব্যাগের সাইড পকেটে পেপার টা পুরে চেইন লাগাতে লাগাতে বললেন, "এই চলে বুঝলেন। আমি তো বিরক্ত হয়ে বাড়ির চালে এন্টেনা লাগিয়েছি। বড় ভাই বাইরে থাকে। মাঝেমাঝে ফোনে কথা বলা দরকার হয়। আর বোঝেন! ঠিক ওই সময়ে ই ফোনের টাওয়ার থাকে না। কি মুসিবত! "
আমি সায় না দিয়ে শুধু মুখ দিয়ে ' চুকচুক ' করে একটা আফসোস হাঁক ছাড়লাম।
ভ্যানের চালক ও দেখি বলে উঠল, " আর কইয়েন না কাকা! ফোন আছে বাড়িত কিন্তু কল ই যায় না"
আমি মাঝ থেকে গলা খাকড়ি দিয়ে ভ্যান চালককে বললাম, "আর কতদূর?"
ভ্যান চালক এবার একটু নিঃশব্দ হাসি দিয়ে বলল, " আরো আধাঘণ্টা ভাই! চার মাইলের বেশী রাস্তা। "
ওহ! তাহলে তো আরো পথ।
জ্বে।
শেষবিকেলে সূর্যের আলো লালচে হয় দূরের অদৃশ্য গ্রামের গাছপালা ছুঁয়ে দেবে আরেকটুপর। এখনো রাস্তার পাশে মাঠে লোকজন কাজ করছে। যে মাঠে ফসল আছে তাতে চলছে শেষবেলায় সেচের কাজ। শীত এখনো পড়েনি। তবুও গ্রামে শীতের হাওয়া টা ভাল টের পেলাম।
শীত পড়েছে মনে হচ্ছে?
ভ্যান চালক বলল, " হে হে আর শীত। শীতের দিন আর গরমের দিন আর আলাদা না! দিনে ঠাটা পড়া রৌইদ, আর রাইতে ঠান্ডা। শীত না গরম কিছুই বুঝি না। "
পাশে বসা ভদ্রলোক দেখলাম পকেটে থেকে ফোন বের করে কাকে কাকে যেন বারবার কল করে যাচ্ছেন কিন্তু নেটওয়ার্ক না থাকায় মনে হয় ধরতে পারছেন না ফোনে।
আপনি কি করেন? (যেচে কথা বলতে ই হলো আমাকে)
ফোন ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আমার দিকে একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আমার জন্মস্থান। মাঝে ছিলাম না বছর ছয় তারপর আবার আসা, আবার থাকা।
ছিলেন না মানে? কিন্তু কেন? (আমি বলছি অথচ ভদ্রলোক ফোন ঝাঁকিয়ে ই চলেছেন)
পড়াশোনা, গ্রাজুয়েশন ঐ করে গেল। আহা! একটা টাওয়ার বোধহয় পাওয়া গেল।
হ্যালো! হা আমি, শোনো বাইরে মতিন কে থাকতে বলো। আমি ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়া আসতাছি। (ফোন কেটে গেল)
এরপর ভদ্রলোক বললেন, " আমার স্ত্রী, এই গ্রামের মেয়ে না। বছর দুই হলো বিয়ে। আমার চাকরীর সুবাদে এখানে দুজনের থাকা"
আপনি কি করেন? প্রশ্নটা করলাম
"এখানে সরকারি কলেজের প্রভাষক। ম্যাথ পড়াচ্ছি। "
বললাম, "আচ্ছা। "
এরপর দুজনে চুপচাপ, ভদ্রলোক আর কোন প্রশ্ন আমাকে করলেন না। আমিও আর কথা বলছি না কিন্তু নীরবতা বোধহয় ভদ্রলোকের পছন্দ হলো না। আমাকে পুরনো প্রশ্নটা আবার করলেন।
আপনি কি করছেন ভাই?
আমি একটু শুকনো হেসে বললাম, আপনাদের গ্রামে আমি সরকারি ডাক্তার। বিসিএস হবার পর এই প্রথম এলাম।
ভদ্রলোক এবার বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন। আরে!  তাই নাকি? আপনিও ডাক্তার?
আপনিও ডাক্তার! মানে বুঝলাম না!
ভদ্রলোক বললেন, আমার স্ত্রীও ডাক্তার। সেই কবে থেকে বলছি বিসিএস টাও দাও। জানেন, দিচ্ছে ই না। জোর করে বললাম, শহরে থাকো আমার না হয় গাঁয়ের চাকরী। সেও সরকারি কলেজ। এখানে আমার নিজের ই থাকতে কষ্ট! সেখানে তুমি কি করে থাকবে?
তারপর?
বলল, " নাহ! এখানেও থাকা সম্ভব। এটা ওটা আরো দশটা যুক্তি দেখাল। বুঝুন, ওমেন পাওয়ার! হাহা.. হেরে যেতে হলো। শুনেছি, ছাত্রী থাকা অবস্থায় ও ডিবেট করত কলেজে। ভাল প্রতিভা, গানের গলাও ভাল।
আচ্ছা।
ভদ্রলোক কে প্রথমে ভেবেছিলাম লোকটা অতিরিক্ত কথা বলে। এবার বুঝলাম, নাহ! উনি বেশ প্রাণখোলা টাইপ। নয়ত, কেউ এভাবে অচেনা লোকের কাছে মনখুলে ঘরের গল্প করতে পারে না।
ভদ্রলোক মনে হয় আরো কথা বলতে চলেছেন, এবার শুরু করলেন।
জানেন? আমরা দুই ভাই। একই ক্লাসে একসাথে। সেই প্রাইমারি থেকে পড়াশোনা। ভাই আর আমি দেখতেও যমজ। তাই বড় ভাই গোঁফ রাখল। সেও আমার বিয়ের পর। বৌ যাতে গণ্ডগোল করে না ফেলে। হাহাহা.. বুঝুন ব্যাপার!
আমিও এবার না হেসে পারলাম না। আপনার ভাই?
উনি এখন থাকেন কাতারে। একটা ওয়েল কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার। বছর পাঁচ আগে গেছেন। যা কথা হয় ওই ভিডিও কল, নয়ত ফোন কল। বুঝলেন! হাহা..
ঘড়িতে চারটে পঁচিশ। সূর্য মনে হয় মেঘের আড়ালে চলে গেল। অন্ধকার না হলেও ভালরকম কালো হয়ে গেল আশেপাশে। আমি একঘেয়েমি কাটাতে ম্যাচ জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট ধরাতে দেখে ভদ্রলোক মনে হয় একটু বিরক্ত হলেন। তবে আমার থোড়াই দেখার আছে। সিগারেট খাবার সময় পণ্ডিতি আমার পছন্দ নয়।
আমার সিগারেট জ্বালানো দেখে ভ্যানগাড়ি থামাল ভ্যানচালক। কোমর থেকে গামছা খুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, " ভাই! একটা সিগারেট হইব?"
হবে। (একটা সিগারেট হাতে দিতে সে নিজের কাছে থাকা লাইটার দিয়ে সিগারেট টা জ্বালিয়ে নিল। সেইসাথে ভ্যানের নীচের হ্যারিকেন টা ধরাল)
অন্ধকার হইতাছে। রাস্তায় লাগবো। সামনে বাঁশবন। আন্ধার আর আন্ধার! ঘুঁটঘুইট্টা আন্ধার।
ভ্যান আবার চলতে শুরু করল। মেঘের আড়ালে থাকা সূর্য আর ফেরত এলো না। আধাঁর ঘনাতে লাগল।
ভদ্রলোক দেখলাম আবার ফোনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠলেন। হ্যালো...হ্যালো...
সিগারেট শেষ হতে আবার আমাদের কথা শুরু হয়। ভদ্রলোক নিজে থেকে প্রশ্নটা করলেন, " বিয়ে করেছেন?"
নাহ!
কেন জানতে পারি? যদি আপত্তি না থাকে। তবে আমাদের গ্রামে পাত্রী পাবেন। সব ঘরের মেয়েই শিক্ষিতা গ্রাজুয়েট। আমার কলিগ ই আছেন।
না, ধন্যবাদ। আসলে, কলেজ লাইফে একজন মেয়ের সাথে ভালোলাগা, প্রেম ছিল। ওটাই প্রথম আর সেই শেষ।
স্কুলকলেজ?
নাহ! মেডিকেল লাইফে।
আচ্ছা, তাহলে হলো না কেন?
ধর্মের বাঁধা!
মানে?
আমার ধর্ম ছিল আলাদা। আর প্রেম তো আর ধর্ম মেনে হয় না, ওই হুট করে ভালোলাগা থেকে প্রেম। শেষ টা ওই শেষে গিয়ে। আমিও শেষ বর্ষে প্রবলভাবে ভেঙে পড়ি।
আহা! ভদ্রলোক এই প্রথম আফসোস করলেন। বললেন, " তাহলে সে মেয়ে?"
আমার সাথে বিয়ে দিতে ওর পরিবার রাজী ছিলনা। ও যদিও প্রথমদিকে রাজী ছিল কিন্তু পরিবারের বাইরে আর পা ফেলতে চাইল না। আমিও তখন একেবারে ভেঙে পড়ি। টাইফয়েড হয় ঠিক আমার ফাইনাল প্রফের আগে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!
আচ্ছা। তারপর?
আর হলো না। ওর পরিবার ফাইনাল প্রফের আগে ওর এনগেজমেন্ট করাল কোন এক ছেলের সাথে। এ কথা আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে জেনেছি। হাতের কাছে ফোন থাকলেও ক্ষোভে, রাগে ফোন করিনি একবারেও! কেন করবো বলুন? এভাবে হুট করে না বলে দেয়ার ক্ষমতা কি করে রাখে সে!
"আপনি কোন মেডিকেলে ছিলেন?" ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
রংপুর মেডিকেল। ব্যাচ নম্বর বলার পর তার মুখের উজ্বলতা ঠিক সন্ধ্যায় ঠিক এখনকার আকাশের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
আমিও নিজেকে সামলে নিলাম। খুব বেশী ইমোশনাল করে ফেলেছি মনে হয়।
ভ্যানচালক বলে উঠল, " আইসা পড়ছি কাছাকাছি! "
আমি ট্যাব খুলে দেখলাম তাতে একটা টাওয়ার এসেছে। আমার থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। গ্রামের মেম্বার আমাকে ঠিকানা আগেভাগে দিয়ে রেখেছিলেন।
তবে খেয়াল করলাম। আমার মেডিকেলের নাম শোনার পর ভদ্রলোক সেই যে চুপ করেছেন আর কোন কথাও বলেননি একটি বারের জন্য।
কিন্তু এবার দেখলাম ফোন হাতে নিয়ে কাউকে আবার ট্রাই করছেন তিনি।
হ্যালো..হ্যালো.. লীলা, আমি বাড়ির কাছাকাছি। তুমি এসো তো। মতিন কে দরকার নেই!
লীলা!
নাম শুনে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাতে ই উনি একটু আক্ষেপের সুরে বললেন, " আমার স্ত্রী, লীলা। রংপুর মেডিকেল থেকে এম বি বি এস করেছে। আপনার ই ব্যাচ! "
শুকনো হাসি দিয়ে কথাটা শেষ করলেন তিনি।
ভ্যান একটা বাড়ির পাশে এসে থামল। বাড়ির পেছনের এই দিকটা রাস্তার সাথে লাগোয়া। আলো হাতে এক রমণী নেমে এলেন উঁচু রাস্তা ধরে ঠিক নীচে, ভ্যানের কাছে। আমাদের দূরত্ব এখন খুব বেশী নয়। যেটুকু চেনা গেল এতে আমার আঁতকে উঠতে হলো। এই সেই লীলা! আমার লীলা!
ভদ্রলোক বললেন, আপনার নামটা বললেন না তো?
আমি বললাম, " রুদ্র"
লীলা এবং তার স্বামী আমার দিকে একসাথে তাকাল। লীলার হাতে সলতে দেয়া কূপী আমার থেকে অনেক দূরে হলেও আমাকে পোড়াল লীলার ক্ষণিক দৃষ্টি।
আমার ভ্যান আবার চলল।
(সমাপ্ত)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...