রবিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৯

জুজু

" আমি আজ ভেঙ্গে দেবো জোড়া ফুলদানি বড়দের
টিভি খুলে খিলতি জওয়ানি
ছুঁচোবাজি ছেড়ে দেবো ঠাকুমার ঘরে একটাই ডেঞ্জার
জুজু যদি ধরে
জুজু যদি থাবড়ায় ল্যাম্পপোস্ট কানা লরি হয়ে যাবে
মারুতির ছানা
ন্যাজ তুলে হুড়ো দিলে জানোনা কি চিজ হাতজোড়
করে বল প্লিজ প্লিজ প্লিজ
জুজু জুজু আমাকে থাবা দিওনা জুজু জুজু তুমি তো জুজু
সোনা "
চন্দ্রবিন্দু'র গানটি হয়তো অনেকের শোনা, গানটি শুনে যেমন মজা লাগে ঠিক তেমনি মজারু বিষয় এই জুজু! অনেক মা তাদের বাচ্চাদের জোর করে খাওয়াতে গেলে বলেন, খেয়ে নাও নয়ত জুজু আসবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি যখন কেমিস্ট্রি পড়তাম কলেজে ঠিক ক্লাসে আমার স্যার বলতেন, পড়া করে আসবে! নয়ত জুজুরভয় দেখাবো! জুজুর ভয় টা সত্যিকারে ছিল ক্লাসের এক্সামে মার্কস কম পাওয়া। কম বেশী কি পেতাম সেটা নিয়ে আজ কোন গল্প নয় আজকের গল্পটা " জুজু "।
জুজু আসলে কি? কেউ কি আদৌ দেখেছে? আসলে এরা কি নর কঙ্কাল?  না অন্যকিছু? কোথায় মেলে তাদের কে? দেখতে কেমন?
জুজুর গল্প শোনা যায় বাংলাদেশের চা বাগানে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সিলেটে। তবে কাউকে প্রশ্ন করলে সে হয়ত মুচকি হেসে বলবে, না নাই!
বাংলাদেশের এই পূণ্যভূমিতে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ১৫০ টিরও বেশী। এইসব বাগানের ফাঁকফোকরে এত এত ঘটনা রয়েছে চা বাগানকে কেন্দ্র করে যে বলে শেষ করা যাবে না। যারা ঐসব চা বাগানে বাস করেন, তারা তো এসব ঘটনা জানেন ই, যারা বিভিন্ন জেলা হতে চা-বাগানে চাকুরীর সুবাদে যান, তারাও এসব ঘটনা শুনে থাকেন, অনেক অভিজ্ঞতাও হয় তাদের সাথে। বলা হয়ে থাকে যে, চা বাগানে চাকুরী করলে এসব ঘটনার সাথে এডজাষ্ট করে নিতে না পারলে হয় আপনি পাগল হয়ে যাবেন, আর নয়তো আপনাকে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে হবে।
যেমন, এক চা বাগানে প্রায়শই রাতের বেলা একটা মেয়েকে একাকী চা পাতা তুলতে দেখা যায়। মেয়েটা অল্প বয়সী, সুন্দরী এবং মায়াবী চেহারার। ঐ চা বাগানে যারা কাজ করে, তারা প্রায় সবাই মেয়েটাকে দেখে। কিন্তু মেয়েটার কাছে যাওয়ার সাহস কারোরই হয় না। চা বাগানে যারা পাহারা দেয়, তাদেরকে চৌকিদার বলে।
তো এক নতুন চৌকিদারের দায়িত্ব পড়লো ঐ চাবাগানে এক রাতে পাহারা দেয়ার
জন্য। গভীর রাতে টর্চের আলোয় চৌকিদার দেখলো, মেয়েটা চা পাতা তুলছে। চৌকিদার এগিয়ে গেলো মেয়েটার কাছে।
ধমক দিয়ে বললো, “এই, এত রাতে এইখানে কি ?” মেয়েটার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল।
হিসহিস কন্ঠে চৌকিদারকে বললো , ”এটা আমার চা বাগান। এখানে আমার যা খুশি, তাই করবো। কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবেনা।”
এরপর মেয়েটার চেহারা বদলাতে লাগলো। কিশোরী মেয়ে থেকে সে একটা
বিকৃত চেহারার বৃদ্ধাতে পরিনত হলো।তার গালে বসন্তের দাগ। মুখ থেকে লালা পড়ছে। চৌকিদার এইরূপ দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো। কিছুদিন পর প্রচন্ড কষ্ট ভোগ করে চৌকিদারটা মারা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব গালগল্প অবিশ্বাস্য এবং বানোয়াট? আপনি দেখেছেন?  লিখতে গিয়ে আমারো হাসি পাচ্ছে। যদিও হাস্যকর কিছু পাচ্ছি না এখানে। হাসির কারণ গল্প টা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমি নিজেও দেখি নি! শোনা কথায় আমার বিজ্ঞানসম্মত কারণ ব্যতীত বিশ্বাস জন্মায় না। তবে এটা ঠিক গল্পটা মুখরোচক এবং একাকী অনেকে পড়ে আশেপাশে একবার তাকাবেন যদি অশরীরী কিছুর উপর ভয় থেকে থাকে।
আরেকটি ঘটনায় আসা যাক এবার,
এক ছেলে রাতেরবেলা একা চা বাগানের ভিতর দিয়ে আসছিলো। হঠাৎ সে লক্ষ্য
করেযে, একটা কালো কুকুর বাম পাশ থেকে তাকে পাশ কাটাতে চাইছে। ছেলেটা এই ব্যাপার টা জানতো যে, সে যদি এটাকে বাম পাশ থেকে যেতে দেয়, তাহলে
তার ভয়াবহ বিপদ হতে পারে। সে এটাও বুঝতে পেরেছিলো যে এটি মোটেও কোন কুকুর নয়। তাই সে কিছুতেই ওটাকে যেতে দিলো না। বাড়ির কাছাকাছি
আসার পর একটা ভয়ানক গোঙানির শব্দ পেয়ে ছেলেটা পিছনে তাকিয়ে দেখলো, কুকুরটা দুই পায়ে ভর দিয়ে দাড়িয়ে ঐ গোঙানির শব্দ করছে। যেন ব্যর্থ আক্রোশে
ফুঁসছিলো। ছেলেটার চোখের সামনে ঐটা হঠাৎ মিলিয়ে যায় এবং ছেলেটাও এই ব্যাপার দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর টানা ১৫দিন ছেলেটা কালাজ্বরে ভুগেছিলো। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। কুকুরটা কে পাশ কাটাতে না দেয়ার অপরাধে !
এই ঘটনা আজকাল হরহামেশাই রেডিও স্টেশনে শোনা যায়। গল্পটা এত্ত কমন যে শেষের অজ্ঞান হওয়া এবং জ্বর আসা শুনে হো হো করে হেসে উঠেছেন।

এবার একটু সিরিয়াস গল্পে আসি,
চা বাগানের
আশেপাশে অনেক ছোট ছোট ঝর্ণা আছে। স্থানীয় ভাষায় ওগুলোকে ছরা বলে। অনেকেই নাকি রাতের বেলা দেখেছে যে, এক হিন্দু বউ, কপালে সিঁদুর, লাল
পাড় দেয়া সাদা শাড়ী পড়ে ছরার একপাশ থেকে অন্যপাশে পার হয় এবং তারপর সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায় ! চা বাগানে রাতের বেলা কারো হেটে বেড়ানোর শব্দ পাওয়া যায়। অনেকেই কোন নির্দিষ্ট আকৃতি নেই, এমন ধরনের ছায়াকে চা বাগানে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। অন্ধকারে তাদের দেখা যায় না। চাঁদের আলো থাকলে মাটিতে এসব ছায়া কে দেখা যায়। প্রায়ই গভীর রাতে চা বাগান থেকে চিত্কার ভেসে আসে, ”সাবধান !!”
কাকে সাবধান করে দেয়া হয়, কি জন্য? কেউ জানে না।

এবার আসি মূল গল্পে।
ভৌতিকতার দিক থেকে সিলেট যে কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে, সেকথায় আসছি এখন। ভারতের বর্ডারের কাছে একটা ঘটনা ঘটেছিল।  কি একটা অদ্ভূত জন্তু এসে নাকি ছোট বাচ্চাদের মাথা, গলা, পেট পর্যন্ত খেয়ে ফেলে!!! সিলেটে এটা নাকি নৈর্মিত্তিক ব্যাপার!!! সিলেটের চা বাগানের লোকেদের কাছে যদি এই ব্যাপারে জানতে চান, তো তারা আপনাকে একটা নামই বলবে। আর সেটা হলো ”জুজু!” এই জুজু ওইজা বোর্ডের ডেভিল জোজো নয়। এটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। ওইজা বোর্ডের জোজোর কথা না অনেক মানুষ চেনে অথবা জানে। কিন্তু সিলেটের চা বাগান গুলোতে জুজুর জনপ্রিয়তা দেখার মত!!! জুজু লোমশ একটা জীব। এর চোখ লাল টকটকে। ছোট বাচ্চাদের দিকেই এর নজর বেশী।
একটা ঘটনা জেনে নেয়া যাক তাহলে, এটাও শোনা গল্প সুতরাং বিশ্বাস একান্ত ব্যক্তিগত!
 এক মহিলা তার বাচ্চা কে ঘুম পাড়িয়ে আরেক রূমে টিভি দেখতে চলে গেল। বাড়ির কাজের মেয়েটা বাচ্চার রূমে এসেই গলা ফাটিয়ে একটা চিত্কার দিল। বাচ্চার মা সেই মহিলা দৌড়ে রূমে এসে দেখলেন কাজের মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আর লোমশ একটা জীব বাচ্চাটাকে জানালা দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। বাচ্চাটা হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করছিল। হঠাৎ মহিলাকে দেখেই জীবটা
বাচ্চাটাকে ফেলে লাফ দিয়ে চা বাগানের ভিতর হারিয়ে যায়।
আরেকটি ঘটনা,
এক বাচ্চা কোন কারণে খাবার খেতে চাইছিলনা। তার মা তাকে জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করছিলেন। এক পর্যায়ে মহিলা বললেন, "তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও না হলে জুজু আসবে " - কাছেই একটা চা বাগান থেকে একটা শব্দ মহিলা শুনতে পেলেন, কেউ বলল " জুজু আসবে! ”
বলাবাহুল্য, ভদ্রমহিলা এটাকে পাত্তা দিলেন না। ভাবলেন যে মনের ভুল। খানিক পর বাচ্চাটা আবার বাহানা শুরু করলে মহিলা বিরক্ত হয়ে বললেন, "এই খাও
বলছি। জুজু আসবে কিন্তু বলে দিলাম।"
এবার মহিলা আগের বারের মতই কিন্তু অনেক কাছে শব্দ শুনলেন যে, "জুজু আসছে !”
 মহিলা ভয় পেয়ে গেলেন। ব্যাপারটা তার স্বামীকে বলার জন্য বাচ্চাটাকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে অন্য রুমে গেলেন। তিনি যখনই তার স্বামীকে এই শব্দের ব্যাপারটা বলছিলেন, হঠাৎ তারা দুজনই শেষ বারের মত শব্দটা শুনলেন। এইবার শব্দটা ছিল এরকম :
“জুজু খাচ্ছে !” “জুজু খাচ্ছে!”
তারা দৌড়ে ডাইনিং রুমে গেলেন। গিয়ে দেখলেন, কালো লোমশ একটা প্রাণী জানালা দিয়ে পালাচ্ছে। আর তাদের বাচ্চা? বাচ্চাটাকে অর্ধেক খেয়ে ফেলা হয়েছে !
জুজু নিয়ে চা বাগানের এটাই সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা। চা বাগানে প্রায়ই কাজ করার সময় ছোট ছোট বাচ্চা নিখোঁজ হয়। পরে তাদের মাথা কাটা লাশ পাওয়া যায়। কার কাজ? কেউই জানে না!!
সুতরাং চা বাগানে বেড়াতে যাবেন, সেখানে ঘুরবেন অবশ্যই তবে " জুজুরভয়" পাবেন না তা কি করে হয়?
সাবধানী হওয়া টা অন্যায় নয়। বিশ্বাস- অবিশ্বাস একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। লেখার ছলে ভয় দেখিয়েছি বলে আবার আঙুল তুলবেন না। আমি ভয় পাবো তাহলে।
প্রবাদ টা বলে শেষ করতে হয়, " ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন "।


বিভিন্ন ফিকশন সুত্রঃ ডিওন টি গার্ডেন , লাক্ষাণপাড়া টি গার্ডেন, রঘুনন্দন টি গার্ডেন, অনলাইন, ধন্যবাদ চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ড (জুজু গানের জন্য)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...