ব্ল্যাক
হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর আসলে কীঃ
আমাদের চোখে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে (The
observable universe) ছড়িয়ে আছে কমপক্ষে ১০০ বিলিওন ছায়াপথ।
আবার,
প্রতিটা ছায়াপথে রয়েছে ১০০ বিলিওন থেকে ১০০ ট্রিলিওন Star বা নক্ষত্র। সৃষ্টির
শুরু থেকেই এই তারাগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে একের পর এক ভয়ানক বিস্ফোরণ। এর
বিক্রিয়ার নাম নিউক্লিয়ার ফিউশন বা সংযুক্তি বিক্রিয়া।
একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়াম
তৈরি করে আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে শক্তি হিসাবে নির্গত করে আলো,
তাপ,তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি।
কিন্তু
তারকা সমূহের এই জ্বালানি (হাইড্রোজেন)
একটা সময় শেষ হয়ে যায়। তখন বিস্ফোরণ, আলো, তাপ কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা থাকে
না। সূর্যের চেয়ে ১০-১২ গুণ বা আরও বেশি ভরবিশিষ্ট নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণের
সাথে নিভে যায়। এই নিভে যাওয়া নক্ষত্রগুলোকেই ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর বলা হয়।
কৃষ্ণগহ্বরের
শুরু কিভাবেঃ
নক্ষত্রগুলোর
মধ্যে সর্বদাই নিউক্লিয়ার সংযুক্তি বিক্রিয়ার বিস্ফোরণ চলতে থাকে এবং সেই কারণেই
একটা শক্তিশালী বহির্মুখী চাপ (radiation) সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট
বস্তুগুলোকে (particles) নক্ষত্রের বাহিরের দিকে ঠেলতে থাকে। আবার নক্ষত্রে অধিক
শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে, যা ওই বস্তুগুলোকে ভিতরের দিকে টানতে থাকে।
এই দুই বলের কারণে তৈরি হয় একটা সুষম ভারসাম্য
(সমতা) যা চলতে থাকে বিলিওন বছর ধরে কিন্তু মূল জ্বালানি হাইড্রোজেন হিলিয়ামে
রুপান্তরিত হতে হতে এক সময় একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়, বাকি থাকে শুধুই হিলিয়াম। তখন
পর্যায়ক্রমে
কার্বন আর অক্সিজেন সংশ্লেষণ তৈরি করে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালু থাকে।
সূর্যের মত ছোট তারকা গুলো মোটামুটি এখানেই থেমে
যায়। আর যথেষ্ট ভর না থাকায় এরা কোনো বিক্রিয়া চালাতে সক্ষম হয় না ঠিক তখনই মৃত্যু
ঘটে এই তারকার। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় White Dwarf. বাংলায় শ্বেত বামন।
তব্ব
নিউক্লিয়ার সংযুক্তি বিক্রিয়া না চললেও
অত্যাধিক
তাপমাত্রার কারণে এরা জ্বলজ্বল করে। বিলিওন বিলিওন বছর পরে এগুলো নীরবে ঠাণ্ডা হয়ে
অন্য অবস্থায় রুপান্তরিত হয় যাকে বলা হয়
Planetary
Nebula বা নীহারিকা। পরবর্তীতে এসব নীহারিকা থেকেই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন গ্রহ
নক্ষত্রের।
সূর্যের
চেয়ে সামান্য বড় বা কয়েক গুণ বড় তারকা গুলো আরও কয়েক ধাপে ফিউশন বিক্রিয়া চালিয়ে
যেতে সক্ষম হয়। এদের মাধ্যাকর্ষণ বল যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে যায় ইলেক্ট্রন আর
প্রোটনকে প্রচণ্ড চাপে নিউট্রন আর নিউট্রিনোতে পরিণত করার জন্য। নিউট্রিনো অন্যন্ত
গতিশীল হওয়ার কারণে এরা শূন্যে হারিয়ে যায়, রয়ে যায় শুধু নিউট্রন।
নিউট্রনকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করার মত যথেষ্ট
শক্তি না থাকায় এই তারকাগুলো এখানেই থেমে যায়। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় Neutron
Star.
এদের
ঘনত্ব এত বেশি হয় যে এক চা চামচ নিউট্রন নক্ষত্রের ভর পুরো মাউন্ট এভারেস্টের ভরের
সমান।
নিউট্রন স্টারের ভিতরে কিছু কিছু প্রোটন আর ইলেক্ট্রন
তখনো পর্যন্ত অবশিষ্ট থেকে
যায় যা
এর মধ্যে একটা শক্তিশালী Magnetic field বা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। নিউট্রন
নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকে, এটা নিজ অক্ষে মিনিটে
৪০
হাজার বার পর্যন্ত হতে পারে।
প্রচণ্ড ঘূর্ণন গতি আর শক্তিশালী চৌম্বক
ক্ষেত্রের (Magnetic field) কারণে নিউট্রন নক্ষত্র থেকে শক্তিশালী আলোক রশ্মি
নির্গত হয় যা অনেকটা লাইট হাউজের আলোর মত।
দেখে মনে হয় জ্বলছে আর। এই ধরনের নিউট্রন স্টারকে বলা হয় Pulsar.
কিন্তু
সূর্যের চেয়ে ১০-১২ গুণ বা তারও বেশি ভর বিশিষ্ট তারকাগুলো তখন পর্যন্ত সংযুক্তি বিক্রিয়া
চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরা নিউট্রনকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে বিক্রিয়া চালু রাখে।
এভাবে পর্যায়ক্রমে পর্যায় সারণির সিলিকন, অ্যলুমিনিয়াম, পটাসিয়াম তৈরি করতে করতে
এক সময় লোহায় এসে থামে।
এরপরে
আর শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না তাই মুহূর্তেই ওই তারকার বহির্মুখী চাপ
উৎপাদনকারী প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায় আররয়ে যায় শুধু মধ্যাকর্ষণ শক্তি।
যেহেতু
অন্তর্মুখী বল (মাধ্যাকর্ষণ শক্তি) ছাড়া অন্য কোনো শক্তি তখন আর কার্যকর থাকে না
তাই নক্ষত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আর এক সেকেন্ডের মিলিওন ভাগের এক ভাগ
সময়ের
মধ্যে গোটা নক্ষত্রটা তার নিজের ভিতরেই collapse করে।
collapse করার আগ মুহূর্তে তার
বহির্ভাগে
এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় যাকে বলা হয় Super Nova. আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি বড়
নক্ষত্র (Super massive Stars) গুলোর ক্ষেত্রে এই
বিষ্ফোরণকে
বলা হয় Hyper Nova.
এই
বিস্ফোরণগুলো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের
সবচেয়ে
বড় ও উজ্জ্বলতম বিস্ফোরণ, যার প্রথম ১ সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা
আমাদের সূর্যের সারা জীবনে (নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত)
নির্গত
সব শক্তির চেয়ে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে।
অন্য
দিকে ভয়াবহ মধ্যাকর্ষণ বলের চাপে তারকাটা ছোট হতে হতে তার নিজের আয়তনের ট্রিলিওন
ট্রিলিওন ভাগের এক ভাগের সমান আকৃতি ধারণ করে যার ফলে এর ভিতরের ঘনত্ব আর
মাধ্যাকর্ষণ বল অসীম আকার ধারণ করে আর সৃষ্টি হয় এক নতুন কৃষ্ণগহ্বর।
বিজ্ঞানীরা
এই অবস্থাকে বলে Singularity যেখানে স্থান এবং কাল হয়ে পড়ে অর্থহীন। আর চিরাচরিত
পদার্থবিজ্ঞানের
সব সূত্র অকেজো হয়ে যায়। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই নব্য সৃষ্ট এই কৃষ্ণগহ্বরের দুই
পাশ দিয়ে অত্যাধিক উত্তপ্ত কণার দুটো ফোয়ারা (Super heated Particles) দুই দিকে
ছুটে যেতে
থাকে
আলোর গতিতে। চলার পথে এদের সংস্পর্শে আসা সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এটাকে বলা হয়
Gamma ray burst.
কৃষ্ণগহ্বরের
ভিতরে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই বেশি থাকে যে এর সীমানার (Event Horizon) মধ্যে যা
কিছু আসে তার সবই এর ভিতরে হারিয়ে যায়। এমনকি আলোও এর আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে
পারে না যার কারণে কৃষ্ণগহ্বর কখনো দেখাও যায় না, এজন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে
ব্ল্যাক
হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর।
তাছাড়া,
প্রায় প্রত্যেকটা ছায়াপথের কেন্দ্রে অত্যন্ত বিশাল আকৃতির শক্তিশালী একটা করে
কৃষ্ণগহ্বর থাকে, যেগুলো সৃষ্টি হয়েছে Big Bang এর সাথে সাথেই। কেন্দ্রের এই Super
Massive Black Hole গুলো পরবর্তীতে নতুন ছায়াপথ তৈরিতে সাহায্য করে। ক্ষেত্র
বিশেষে এরা এত বড় হয় যে এ যাবত আবিষ্কৃত সকল ব্ল্যাক হোলের মধ্যে
সবচেয়ে
বেশি ভরের কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে আমাদের সূর্যের চেয়ে ৪০ বিলিওন বা ৪০০ কোটি গুণ ভারী
আমাদের
নিজস্ব ছায়াপথের কেন্দ্রেও রয়েছে একটি
অতিকায়
কৃষ্ণগহ্বর যা আমাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় ২৬ হাজার আলোক বর্ষ (light years) দূরে
যার আকৃতি সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০ লক্ষ গুণ ভারী।
শক্তিশালী
চৌম্বক আবেশের কারণে এই কৃষ্ণগহ্বরগুলোর চারপাশে জমে থাকা ধুলোকণার মেঘ, গ্যাস
ইত্যাদি প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে শক্তিশালী x-ray আর radio wave তৈরি করে যা এর দুই
পাশ দিয়ে
প্রচণ্ড
গতিতে রশ্মির মত বিকিরিত হতে থাকে। এই রশ্মিগুলো পার্শ্ববর্তী ছায়াপথের ধুলিকণার
মেঘ, গ্যাস ইত্যাদিকে অত্যাধিক চাপ ও তাপে উত্তপ্ত করে, যার ফলে পরবর্তীতে ওই
ছায়াপথে নতুন নতুন তারকারাজির সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় AGN বা Active Galactic
Nucleus. সব ছায়াপথে AGN থাকে না, যেমন আমাদের কেন্দ্রীয়
কৃষ্ণগহ্বরের
কোনো AGN নেই। আমরা যখন আমাদের অবস্থান থেকে এই বিকিরিতরশ্মিগুলোকে উল্লম্বভাবে
দেখি তখন
একে বলা
হয় Radio Galaxy. যখন কোনো কোণ থেকে দেখি, তখন একে বলা হয় Quasar বা কোয়েইজার। আর
যখন আমরা সরাসরি আলোর উৎস বরাবর রশ্মির কেন্দ্রের দিকে দেখি, তখন একে বলা হয়
Blazar. মূলত একই জিনিসকে ভিন্ন ভিন্ন
দৃষ্টিভঙ্গি
আর অবস্থানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়ে থাকে।
কৃষ্ণগহ্বরের
মৃত্যুঃ
ব্ল্যাক
হোল নিজেই একটা মৃত তারকা, তারও আবার মৃত্যু আছে? উত্তর, হ্যাঁ! আছে। যে জিনিষের শুরু আছে তার অবশ্যই একটা শেষ
আছে। কৃষ্ণগহ্বরেরও মৃত্যু হয়। কৃষ্ণগহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ বল এতই শক্তিশালী যে এর
ভেতর থেকে কোনো কিছুই (এমনকি আলোও)
বেরিয়ে
আসতে পারে না। যত বেশি বস্তু কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে হারিয়ে যাবে, কৃষ্ণগহ্বরের আকৃতি
দিনে দিনে ততই বড় হবে। তবে স্টিফেন হকিং এর মতে, কৃষ্ণগহ্বরও কিছু জিনিস নির্গত
করে, আর তা হচ্ছে রেডিয়েশন বা বিকিরণ। তার
মতে,
কৃষ্ণগহ্বর থেকে প্রতিনিয়ত রেডিয়েশন বিকিরিত হতে হতে এক সময় (বিলিওন ট্রিলিওন বছর
পর) কৃষ্ণগহ্বর শূন্যে মিলিয়ে (Evaporate) যাবে। মহাশূন্যের প্রতিটা জায়গায়
মূহূর্তে মূহূর্তে স্বল্প সময়ের জন্য ধনাত্মক ও ঋণাত্মক ভর যুক্ত subatomic
particles তৈরি এবং ধ্বংস হচ্ছে।
এই
প্রক্রিয়া যখন কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের আশেপাশে হয়, তখন ধনাত্মক ভরবিশিষ্ট
কণাগুলো অত্যাধিক শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিকিরিত
হয়ে
যায়। বিকিরণের এই তত্ত্বকে বলা হয় Hawking Radiation. অন্যদিকে, ঋণাত্মক ভরবিশিষ্ট
কণাগুলো কৃষ্ণগহ্বরের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণের কারণে এর ভিতরে পড়ে হারিয়ে যায়।
ঋণাত্মক ভরবিশিষ্ট হওয়ার কারণে এরা কৃষ্ণগহ্বরের ভর খানিকটা কমিয়ে দেয়।
এভাবে
বিলিওন ট্রিলিওন বছর ধরে একই প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক সময় কৃষ্ণগহ্বরের ভরও শূন্য
হয়ে যাবে, আর কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যু হবে।
কিন্তু
হকিং এর সমাধান বিজ্ঞানীদের বড় এক প্রশ্নের সম্মুখীন করে। কৃষ্ণগহ্বর যদি এভাবে
একদিন শূন্যে
মিলিয়ে
যায়, তাহলে এর ভিতরের সব তথ্যও এর সাথে চিরতরে হারিয়ে যাবে, যা চিরাচরিত কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের মৌলিক বিধানের
সম্পূর্ণ
পরিপন্থী। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিধান মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শক্তি সবসময় সমান
থাকবে। একে কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যাবে না। আর এজন্যই হকিং এর থিওরি নতুন এক
প্রশ্নের সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় Black Hole Information Paradox.
তাহলে
সমাধান কীঃ
এই
সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হকিং নতুন এক তত্ত্ব প্রদান করেন। তার মতে,
যেসব তথ্য কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে হারিয়ে যায় তার কোনোকিছুই এর কেন্দ্রে অবস্থান করে
না, বরং অবস্থান
করে তার
ঘটনা দিগন্তের মধ্যে। তার মতে, এই তথ্যগুলো সংরক্ষিত হয় হলোগ্রামের আকারে। একে বলা
হয় Holographic Principle. এই তত্ত্ব মতে,
ত্রিমাত্রিক
কোনো বস্তুর ভিতরের প্রত্যেকটা তথ্য, দ্বিমাত্রিক তথ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব,
যার মানে হচ্ছে – তথ্যগুলো হারিয়ে যাছে না,
বরং
অন্য অবস্থায় রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজে বের করতে পারেননি
যে
কিভাবে
ওই তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
হাইলি
জটিল!!
ক্রেডিটঃ
অনলাইন এবং মাথার ঘাম :/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন