মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬

গল্পঃ মেসবাড়িটা এবং অসমাপ্ত একটি গল্প





-হ্যালো! মুখর ভাই? ( ভাইব্রেশন তুলে ফোনকল টা এসেছে কামাল ভাইয়ের দৈনিক কাগজের অফিস থেকে)
কানে চেপে উত্তর দিলাম, 'বলছি!'
' বুঝেছেন ভাই, কালকের মাঝেই আপনার লেখাটা চাই, কাল না পেলে কিন্তু প্রেসে যাবে না আপনার লেখা'
'আরে ধুর! শান্ত ভাই, মিছে চিন্তা নিচ্ছেন। আজ রাতেই আবার বসছি লেখাটা নিয়ে। শেষ করেই এনেছি প্রায় '
ওকে, লেখা শেষ করে-ই আমাকে জলদি মেইল করে দেবেন প্লিজ!
আচ্ছা ভাই।
মুখর, ফোন ডিসকানেক্ট করেই  এক বুক জমানো নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল বন্ধ ঘরের ভেতর। পকেটে শুন্যতা চলছে, সোজা কথায় ক্যারিকেচার করা কার্টুনের মত পকেটে মাছি উড়া ভনভনে দশা। এই চাপ না হয় ধার কর্যে চালিয়ে দিলাম কিন্তু আগামী সপ্তাহে শুরু হচ্ছে সেমেস্টার এক্সাম, তারপর আবার প্রকাশকের লেখার তাগাদা! হা-পিত্তেশ ছাড়া দ্বিতীয় কোন অপশন আর নেই।
মেসের ঘরটায় ধূলোতে ঠাসা। মাকড়সা উঁকি দেয় যখন তখন। একটি মাত্র জানালা, সেটাও উত্তরদিকে। ওয়াল অনেক পুরোনো ক্যালেন্ডারে ঠাসা। একের পর এক ক্যালেন্ডার বসেছে অথচ পুরোনো টা না সরিয়ে।
ঘরের ঝুল পড়া দেয়ালে মিকি মাউসের ছবিটা কে এঁকেছিল কেউ জানে না। তবে গত কুঁড়ি বছরে মেসের দেয়ালে রঙের কোন ছোঁয়া লাগে নি। দেয়ালের পূর্ব কোণে বাংলায় গোটা অক্ষরে একটি নাম লেখা। হয়ত, বিদায় নেয়া এক মেস সিনিয়র তার ভালোবাসাযুক্ত আবেগে এক থোকা পানের পেঁচকি দিয়ে নিজের নাম লিখে রেখে গেছে। তাই লিখা 'আখতার ' ১৯৮৯ নাম এখনো দৃশ্যমান। এদিক সেদিকে দৃশ্যমান মেসের জরাজীর্ণতা।

 মুখর  মনোবিজ্ঞানের ছাত্র, জগন্নাথে তার সেভেন সেমেস্টার চলছে; পাশাপাশি লেখালেখি। ভার্সিটির হলে থাকার বিন্দুমাত্র জো নেই, যদিও সে সিনিয়র তবুও নাক টেপা চেহারায় ছোট্টখাট্ট প্রথম বর্ষের রাজনীতি করা বাচ্চা ছেলেটির ক্ষমতা অন্ততপক্ষে মুখরের চেয়ে ঢের বেশী। তাই হলের সিট অতি সসম্মানে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন গ্যাঁটের টাকা খরচ করে জায়গা হয়েছে পুরোনো ঢাকার চিপা গলিতে লেনের পাশে বেঁচে থাকা পুরোনো দালানের এই ব্যাচেলর মেসে।
এক রুমে গাদাগাদি করে তিনজন, কপাল ভাল রুমে একজন কমেছে। গত মাসেই একজনের চাকরি জুটেছে তাই তিনি মেস ছেড়েছেন। দম ফেলার জায়গা হয়েছে, তাও বেশীদিনের জন্য নয়। আজ সকালেই  পান চিবাতে চিবাতে মেসের কেয়ারটেকার অবশ্য  নতুন কোন মেস মেইট খোঁজার তাগাদা দিয়ে গেছে। আরো বলে গেছে, 'না পেলে গলির মাথায় মাংস বিক্রেতা আমাদের সাথে সামনের মাসে মেস মেইট হবে।' অপেন থ্রেট!

  মুখর সহ আরো দুজন মিলে মোট তিনজন। বাকী দুজনের মাঝে একজন আরিব্বাই, মানে ভার্সিটির আরিফ ভাই গত দু'বছর ধরে বিসিএস দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এবারে তিনি নিশ্চিত তার বিসিএস গেঁড়ো কাটলো বলে। আরেকজন, শিমুল। প্রচন্ড মাত্রায় হতাশ, তাকে দেখে পৃথিবীর সর্বশেষ হতাশাগ্রস্ত মানুষটি খিলখিল করে হেসে ফেলবে এটা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। আমি তার নাম দিয়েছি শিমুলাতাশ! আরিব্বাই নামটাও আমার দেয়া।
শিমুলাতাশ ভাই নিয়ম করে প্রতিদিন দুটো সিগারেট খায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর মধ্যরাতে শোবার আগে। পিকুলিয়ার টাইপের ছেলে। মাথায় লম্বা চুল, মুখে লম্বা দাড়ি। লালন ফকিরের ভীষন ভক্ত। চাঁদনী রাতে গলা ছেড়ে গানও গায়। তখন ঢাকায় বিদ্যুৎ থাকে না। বৃষ্টির দিনে রবীন্দ্রসংগীত। ভাইয়ের গলা মাশাল্লাহ ভাল। ঢাকা, অদ্ভুতুড়ে শহর আমার, গরমে লোডশেডিং হয় তুঙ্গে আর বৃষ্টির দিনে রাস্তাঘাট হয়ে যায় খাল। যাক সে কথা, বলছি শিমুল ভাইয়ের কথা। শিমুল ভাই লোক ভাল। ভাল লোকের নাকি দুঃখ্য বেশী।
এইত সেদিনের ঘটনা, সকালে ক্লাস ছিল বলে টেবিল ল্যাম্পের আলো নিভিয়ে সবে ঘুম দেব বলে বিছানায় শুতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বলা কওয়া নেই, বাইরে থেকে এসেই কান্নাকাটি জুড়ে দিল শিমুল ভাই। বেকার মানুষ সারাদিন পথে পথে ঘুরে, রাস্তায় এক ছেলেকে কাঁদতে দেখে পকেট চালানোর দুশো টাকা দিয়ে এসেছেন ছেলেটিকে। এখন তিনি অতিমাত্রায় কেঁদে যাচ্ছেন। ঘুমের বদলে তাকে দিতে হলো শান্তনা, কারন এই মাসে তার মেসের বিল মেটাতে হবে আমাকে-ই।
এক গ্লাস পানি ঢোক ঢোক শব্দে গিলেই বসে গেলাম টেবিলে। প্রেসের গল্পটা আজ শেষ করতেই হবে। ঘড়িতে বাজে রাত প্রায় সোয়া ১১ টা।
কাগজ কলম নিয়ে গল্পের প্লট ভাবছি হঠাৎ পেছন থেকে আরিব্বাই এসে কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, 'কি রে? কাগজ নিয়ে বসে গেলি? '
'হ্যাঁ ভাই, '
'তুই পারিস ও বটে '
এইত ভাই!
মৃদ্যু একটা 'হুম' বলে মশারির নীচে চলে গেলেন চুপচাপ। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, শিমুল ভাই তার বিছানায় নেই, উঠোনে বসে তিনি রুটিনবাঁধা দ্বিতীয় সিগারেটের নেশায় ডুবে আছেন, তার পোড়া গন্ধ নাকে আসছে। সস্তা বিড়ির গন্ধ, আজো হয়ত কাউকে পকেটের সব দিয়ে এসেছেন ভালোবেসে।

প্রায় মিনিটের ত্রিশেক ধরে বসে আছি কিন্তু কোন আইডিয়া কাজ করছে না। ঘড়িতে দুটোর কাটা ছুঁইছুঁই, আরিফ ভাই নাক ডাকছেন, শিমুল ভাইও আধা ঘন্টা আগে দরজা ভিজিয়ে চলে গেছেন  গভীর ঘুমে। ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন সেপ্টেম্বর মাস, হালকা শীতের হাওয়া গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল মেসের উত্তরদিকের খোলা জানালা ভেসে। আমার সামনে-ই জানালা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে মাঝে মাঝেই। লেখালেখির চল্লিশা চলে।

'কি? ঘুমাচ্ছেন? '
আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেছে, ঘুমে চোখ ধরে এসেছিল হয়ত। বুঝলাম, চেয়ারে ঘাড় কাত করে অবচেতনে পড়ে ছিলাম। সারাদিন গেছে দৌড়ের উপর; ক্লাস, এসাইনমেন্ট, টিউশানি ব্লা ব্লা। তবে যে কন্ঠটা শুনে ঘুম ভেঙেছে তাতে জানলা ভেদ করে গায়ে লাগা মৃদ্যু ঠান্ডা বাতাস আরো ঠান্ডা ঠেকল।
সে কি! নারী কন্ঠ? ভুল শুনছি! কই না তো!
আমার সামনের জানালার বাইরে এক নারীমুখ দাঁড়িয়ে। স্বপ্নটপ্ন দেখছি না তো!
বিষ্ময় কাটল দ্বিতীয় ডাকে,
'ঘুমাচ্ছিলেন বুঝি?' কন্ঠটা আবার জিজ্ঞেস করল।
এবার ভয়ে গা শিউরে গেল, লালদেয়াল ঘেরা মেসখানা অনেক পুরোনো। উত্তর দিকের জানালা ঘেরা দিকটা ফাঁকা বটে তবে ওদিকে কেউ যায় না। কিন্তু এত রাত্রে এই নারী সেখানে কি ই বা করছে?
আশ্রয় না পেয়ে অনেকেই এমন থাকতে পারে তবে সেটা নিতান্ত অমূলক!
তবে কি ভূতের পাল্লায় পড়লাম?
সে হতে পারে কিন্তু তাই বলে মেসে ভূত কিংবা ভৌতিক কিছু ঘটেছে এর আগে তেমন শুনিনি। ভৌতিক ব্যাপার নাও তো হতে পারে! একে একে দুই মেলালাম আমি।
'শুনছেন? ' (আবার ডাক দিল অচেনা গলা)
চেয়ারের হাতল চেপে সোজা হয়ে বসলাম, চোখ গেল লোহার শিকের উপারে জানালার বাইরে। সেখানে দেখলাম আবছা আলোয় একজন নারী দাঁড়িয়ে, ভালোভাবে বলতে গেলে বয়েস আন্দাজ তরুণী-ই হবে। চেহারা সম্ভ্রান্ত, আধাঁরে বোঝা না গেলেও এটি সুস্পষ্ট মেয়েটি ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
'আমাকে বলল, একগ্লাস জল হবে? ভীষন তেষ্টা পেয়েছে '
পুরুষ মেসে নারী! কেলেংকারি!
 তাও আবার এত্ত রাত্রে? মারাত্বক স্ক্যান্ডেল হয়ে যাবে! কি করব তাই ভেবে পাচ্ছি না এখন।
আরিফ ভাই আর শিমুল ভাইকে ডাকার সাহস পেলাম না। পিছন ফিরে দেখলাম দুজন-ই অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তার মানে, আমি ছাড়া মেয়েটির গলা কেউ তাহলে আর কেউ শোনেনি! জল খাইয়ে মানে মানে বিদেয় করি তবে।
  জানালার বাইরে আগন্তুক মেয়েটি হিন্দু ঘরের সেটা বুঝতে আমার ভুল হয়নি। মেয়েটি 'জল খেতে' চাইছে বলল যখন!
জল আনছি বলেই,
 আমি চেয়ার ঠেলে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যতটা দেখছিলাম তাতেই সোজা দেখতে দেখতে চুপিচুপি বিড়ালের মত পা ফেলে এগিয়ে গেলাম মেঝেতে রাখা পানির জগের দিকে। এক গ্লাস পানি ঢেলে গ্লাস হাতে ফিরে এলাম আবার টেবিলের কাছে জানালায়, যেখানে জানালার বাইরে মেয়েটি তখনো দাঁড়িয়ে।
পানির গ্লাস হাতে নিয়েই এক ঢোকে গ্লাস খালি করতে সময় নিল না অচেনা মেয়েটি। খালি গ্লাসটা এগিয়ে দিল এবার আমার দিকে, মেয়েটির হাতে চোখ গেল এবার। নতুন সাদা রঙের শাঁখা, সেটা আবছা আধাঁরেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আঙুলে লাল আলতা দেয়া মনে হয়, তবে আলতা এভাবে পুরো হাতে কেউ দেয় আগে দেখিনি।
জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কে? এখানে কি করছেন? কি হয়েছে আপনার? এখানে এত রাতে? জানেন তো এটা ছেলেদের মেস কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! '
মেয়েটি উত্তরে তার নাম বলল না, শুধু বলল, 'এটা (মেসবাড়িটা) আমার স্বামীর বাড়ি। আমি তার স্ত্রী, গতকাল রাতে বরিশালের বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছি কিন্তু আপনারা এখানে কি করছেন? '
মেয়েটি পাশাপাশি শাসানোর ভংগিতে ওর হাতের আঙুল জানালা গলিয়ে ভেতরকার আরিফ এবং শিমুল ভাই দুজন কে দেখিয়ে বলল, 'এরা কারা? আমি ক'দিন নেই তাই জবরদখল! '
আমি কি বলব, তখনো বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড মাত্রায় কপাল বেয়ে ঘাম দরদরিয়ে ঝড়ছে, আমার জানামতে এই বাড়ি প্রায় শ'বছরের পুরোনো। আগে কোন এক জমিদারের ছিল বলে শুনেছি, তবে এ বাড়ি স্বাধীনতার পরপর বর্তমান মালিক তার নিজের নামে করে আছেন প্রায় চল্লিশ বছরের বেশী। তবে ইনি কে? নিজের স্বামীর বাড়ি বলে দাবী করছেন?
ঘুমন্ত ভাই ব্রাদারহুড কে চেঁচিয়ে ডাকার মত গলায় আওয়াজ পাচ্ছি না। যদিও আরিফ ভাই.. আরিফ ভাই..... বলে দু'বার ডেকেছি কিন্তু নিজের গলা নিজেই শুনি নি।
মেয়েটি তখনো জানালার বাইরে, বুঝে গেছে আমি ভয় পেয়েছি।
শান্ত গলায় বলল, 'ভয় পাচ্ছেন কেন? '
নিজেকে শান্ত রাখার কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না একটি বারও।
মেয়েটি বলে চলল, পরশু গিয়েছিলাম বাপের বাড়ি। উনি টেলিগ্রাম করলেন।
(আমিও কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলাম, টে.. টে.. টেলিগ্রাম?)
'হ্যাঁ। লিখেছেন, দেশের অবস্থা ভালো না জলদি ফিরে আসো। আমিও আর দেরি করতে পারলাম না বাড়িতে সোজা লঞ্চে চলে এলাম কিন্তু পথে লঞ্চটা ডুবে গেল, জানেন?
বললাম, 'কিন্তু কই? দেশে তো কিছু... ?'
কি বলছেন যা তা! স্বাধীনতার কথা শোনেনি? সবচেয়ে বড় কথা লঞ্চ ডুবে গেছে শব্দটি কানে গেলেও খেয়াল করতে পারি নি।
মেয়েটি এখন আর কথা বলছে না, অদ্ভুত এক নিঃশব্দ বিদঘুটে হাসি দিচ্ছে।
আমিও এবার সম্ভিত ফিরে পেয়েছি, ইনি যে মানুষ নন আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে আর দেখাতে হবে না। নার্ভ চেপে চেয়ারের হাতল শক্ত করে বসে আছি। বেশীক্ষণ আর থাকা যাবে না হয়ত। নার্ভাস ব্রেক ডাউন এবার সময়ের ব্যাপার!
তবুও মেয়েটির কথা শুনে যাচ্ছিলাম। মেয়েটি  এবার জানালার শিকের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। মেয়েটির সাথে আমার দূরত্বটা এখন আমার পড়ার টেবিল ব্যবধান!
মেয়েটি কি বলছে এখন আর শুনতে পাচ্ছি না, কেবল তার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখছি। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে, বুঝলাম জ্ঞান হারাচ্ছি। শেষ শুধু হাসিটা শুনতে পাচ্ছি..
জ্ঞান হারানোর আগে যতটা অনুভূতি কাজ করছিল তাই নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'সত্যি করে বলুন তো আপনি কে? '
উনি শব্দহীন একটা হাসি দিয়ে বললেন, 'আমি শ্রীমতী '। এই মেসবাড়ির গিন্নী গো! (হাসির শব্দ)
মুখর চেয়ারসহ ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...