মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৮

গল্পঃ ভুল

মাঝারি বৃষ্টি, রাতের ঘড়ি ১১টা ছুঁয়ে কিছুটা দূর।
 শীতের বৃষ্টি তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা, মাঝেমধ্যে কয়েকটা গাড়ি ছুটে চলেছে হঠাৎ! রাস্তাটা অনেকাংশ অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্ট গুলোর আলো ব্লিংক করছে থেমে থেমে।
আধাঁরের লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে এলেন একজন পথিক। বাস থেকে নামবার পর কাছাকাছি কোথাও যাবেন বলে হালকা যানবাহন খুঁজছেন। 
বৃষ্টি ঝিরিঝিরি, তার মধ্যে শীতে কাঁপুনি তার মাঝে দুই ব্যাগ। এভাবে চলা যায়। খানিক টা এগুতে না এগুতে একটা গাড়ি পথিকের গায়ে কাঁদাজল ছিটিয়ে পালিয়ে গেল দ্রুত। 
এহ! শালা! একগাদা গালি বেড়িয়ে এল পথিকের মুখ থেকে। প্যান্ট ভেজা, জামা ভেজা এবার হাতের ব্যাগ ভিজল। একটা রিক্সা আজ নেই, কই যাবো ভাবতে ভাবতে রাস্তার পাশে মাথা তুলে থাকা একটা ছাউনি ভেতর কায়দা করে মাইল্ড জাম্প করে ঢুকে গেলো সে। ঢুকে টের পাওয়া গেল আরেক বিপদ!
অন্ধকার ছাউনির তলায় তীব্র গঞ্জিকার গন্ধ। এখন কিছু করার নেই যদিও। বোঁটকা ভারী বাতাস এখানে। পথিক পকেটে থেকে রুমাল বের করে হাত, মুখ মুছে নিলেন। ছাউনির ভেতর বাতাস গুমোট ধরে আছে তার উপর গঞ্জিকাসেবী! 
নাহ, একটা কিছু তো করতে হবে। রাস্তায় যেভাবে গাড়ি ছুটে চলেছে সেগুলো তার সামান্য হাত দেখানোয় তার কোন একটা থামবে বলে পথিকের অন্তত বিশ্বাস হয় না। কপাল এতটা খারাপ ই যে আশেপাশে কোন রিক্সা, ভ্যান এমনকি একটা কুলির টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অথচ এটা মোটামুটি একটা জনবহুল বাস স্ট্যান্ড। 
তবুও একটা কুলি পেলে মন্দ..
পেছনের জমাট অন্ধকার ছাউনির ভেতর কড়া কাশির দমক টের পাওয়া গেল। পথিক ভয় কাটানোর জন্য ঘুরে পিছু দেখলেন। সেখানে একটা ছোট্ট আগুনের দলা ক্রমশ জ্বলতে নিভতে দেখা গেল। মানে কেউ আয়েশ করে গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। নেশা এমন এক জিনিশ যা নেবার সময় বিন্দুমাত্র হুশ থাকে না নেশাখোরের। কে এই লোক? ছিনতাইকারী কিংবা চোর নয়তো!  পথিকের ভয় হচ্ছে। ভয় হওয়া টা স্বাভাবিক, সাথে ব্যাগ। দামী জিনিস কম ই হয়ত তবুও সাবধানী হতে দোষ কোথায়?
পথিক ঘাড় ঘুরিয়ে চেষ্টা করেও পেছনে থাকা লোকটির চেহারা আন্দাজ করতে পারলেন না। পরে ভাবলেন, থাক সে তার মতো। পথিকের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না এই মুহুর্তে।
রাস্তায় ছুটে যাওয়া আলোর দমকে অদৃশ্য লোকটার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও পথিক বুঝতে পেরেছেন ভয় টয় যাই হোক তবুও এখন এই লোকটি এখন তার একমাত্র সঙ্গী। তাকে বলে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায় তাতে মন্দ কি? কিছু করতে গেলে একটুআধটু সাহসের বড্ড দরকার ই। 
সাহস করে তাই প্রথমে গলা স্বর নীচু থেকে একটু জোরেশোরে ই ডাক দিলেন পথিক। 
-এই যে ভাই, ভাই! ও ভাই! শুনছেন?
(অন্ধকারে থাকা লোকটির গলার স্বরে বিরক্তি)
-আহ! কে আপনে? কিসের এত্ত ডাকাডাকি? 
(কাতর গলায় পথিক) আসলে এই রাতে বিপদে পড়েছি ভাই, দেখেন রাস্তায় কোন গাড়ি থামছে না। কোন ভ্যান রিক্সা কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। একটু যদি হেল্প করতেন!
-হেলপ! হে হে শব্দে কিছুক্ষণ হেসে আবার তার কাশির দমক.. এহ এহ.. চি চি..

তারপর লোকটি ধীরেসুস্থে উঠে এসে পথিকের মুখোমুখি দাঁড়াল। ঠিক তখনি একটা গাড়ি ছুটে গেল আলো ফেলে। দুজন একে অপরকে সেই আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। 
পথিক মনে হয় ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল! কালো চাঁদর দেয়া লোকটি এত বীভৎস হবে পথিক ভাবতেও পারেন নি।
 এহ! একি?ডরায়েন না! আমার এক চোখ নাই। এক্সিডেন্ট করছিলাম। (অভয় দিল সে লোকটি, তারপর বলল)
আসেন, কই যাইবেন? আমি নিজে ই পৌঁছাই দেই।
পথিক ভয়ে কাপাঁ গলায় বলল, না ভাই! আমি একলা ই যেতে পারবো!
(পথিকের গলায় ভয়ের আওয়াজ পেয়ে লোকটি হাসল খানিকক্ষণ) 
হেহে.. একলা গেলে কি আমারে ডাক দিতেন! দ্যান ব্যাগ টা। আমি চোর ছ্যাচ্চড় না ভাই। চিন্তা নাই। আমার রিক্সা আছে। চলেন পৌঁছাইয়া দেই।
এবার পথিক রাজী হলো। 
লোকটি পথিকের ভারী ব্যাগের একটা মাথায় এবং অন্যটি আরেক হাতে নিয়ে বলল, আসেন রিক্সা সামনে। 
পথিকের পা নিস্তেজ, চলছে না। তবুও ব্যাগে কাপড়চোপড়, দামী জিনিস আছে। চোর-ডাকাত হলে ধস্তাধস্তি করে হলেও মালপত্র বাঁচাতে হবে। কিছুটা পথ এসে সেই লোকটি থামল তারপর মাটিতে ব্যাগ রেখে বলল, এইখানে খারান! আমি রিক্সা টা নিয়া আসি। 
"ক..কই?  রিক্সা? পথিকের গলায় কম্পন"
"ঐ তো গাছ টা দ্যাখতাছেন, ঐটার পিছনে। খারান আনতাছি। " এই বলে দ্রুত পায়ে লোকটি একটা দেয়ালের পেছনে চলে গেলো। তবে ফিরে এলো মিনিট দুই পরে ঝনঝন শব্দে একটা রিক্সা নিয়ে। 
পথিক এবার নিশ্চিত। নাহ! এ অন্তত চোর নয়। রিক্সায় উঠে মনটা অনেক শান্ত হলো পথিকের। 
লোকটিকে উদ্দেশ্য করে পথিক বলল " চলেন ভাই, নটবাড়ি রোড।" 
রিক্সা চলতে লাগল। পথিক আশেপাশে দেখতে লাগল সতর্ক চোখে। তাকে সপ্তাহ আগে ই যেতে হয়েছিল বাড়ি, জরুরি ফোন। জমিজমা নিয়ে শরীকী বিবাদ। সেসব মেটাতে যা সময় লাগল। ভেবেছিল দিন দুয়েকের বেশী লাগবে না। তবে সেটা কেবল ভাবনা চিন্তার হিসেবে ই ছিল, কাজে আর লাগল না।
- ভাই কি সিগারেট খান? 
আচমকা প্রশ্ন শুনে পথিক বলল, না ভাই! কেন?
হে হে, তখন সিন্নি তে ছিলাম। সিন্নি খাওয়ার সময় আশেপাশে কাউকাউ করলে ভালা লাগে না। আগে একা খাইতাম না, দলেবলে মিলা খাইতাম। একটা দল আছিল আমাগো। সেইখানে একেকদিন একেকজনের খরচ করার নিয়ম করছিলাম সবাই। যেমন আইজ আমি, কাইল আরেকজন, পরশু আরেকজন এমনে..
পথিক অনেকটা বিরক্ত এই গাঁজাখুরি আলাপে। মনেমনে ভাবল মা কে বলেছিলাম দেরী না করতে, সেই রান্না করতে গিয়ে দেরী। তাই আজ ফিরতেও। আর কপালে পড়ল এক গাঁজাখোর!
সেই লোকটি বলে চলেছে তখনো... অনেক শান্তি এখন একা একা। হাউকাউ নাই, চুপচাপ খাই। কেউ মাঝখানে ডাক দিলে ই রাগ উইঠা যায়। পথিক ভয় পেলো আবার।
-রাগ মানে? সে কি? ভাই আমি কি?...
হে হে নাহ! আপনে ভালা মানুষ। আপনের উপ্রে রাগ উঠে নাই। তবে আর রাইত কইরা এমন টাইমে কাউরে ডাক দিয়েন না। হিতে বিপরীত হইতে পারে। আজকাল কাউরে বিশ্বাস নাই। 
পথিক চুপ। রিক্সাওয়ালাও চুপ। একজন ভয়ে, আর অন্যজন। হাহা...
রিক্সা দ্রুত চলেছে। প্যাডেলে যান্ত্রিক শব্দ, সেইসাথে রাস্তার ভাঙা গর্তে চাকার পতনের সাথে তীব্র ঝাঁকুনির ধাতব শব্দ, আর কোন শব্দ নেই। 
 রিক্সাওয়ালা একবার বলল নটবাড়িতে কোন বাসা?
হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলল পথিক, " ঐ ডান দিকের গলিটা দিয়ে ভাই।" 
রিক্সা গলিতে আসতে না আসতে পাড়ার চৌধুরীর কুকুর টা ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। রিক্সাওয়ালা হেসে ধীরেধীরে বলল, কুত্তাও গন্ধ পাইছে.. পথিক এবার সাহস পাচ্ছেন রিক্সা তার বাড়ির খুব কাছে এসে গেছে। লোকটি কে এবার তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। গন্ধের কথাটা লোকটির মুখে ধীরেধীরে বলতে শোনায়, বেশ জোর গলাতে পথিক বললেন কিসের গন্ধ?লোকটি উত্তর দিল না।
পথিক আর চাপাচাপি করলেন না। 
হঠাৎ আবার বৃষ্টি শুরু হলো। পথিক রিক্সার হূডি টা তুলে দিলেন। পা ভিজছে কিন্তু কিছু করার নেই।
রিক্সাওয়ালা ভিজছে। বেল বাজিয়ে অনেকটা এসে গেল দুজন। মিনিটখানেকের পথ কেবল বাকী।
আচমকা কথার নীরবতা ভেঙে রিক্সাওয়ালা বলল, আপনার নাম কি হাসান?
পথিক চমকে গেল এবার। এই এই..লোকটা কে তো একবারেও তিনি তার নিজের নাম বলেন নি তিনি। তাহলে? তাহলে কি করে এই লোকটি তার নাম বলে দিলো।
তবুও ভুল বলেছে এমন ভাব করে পথিক বলল, নাহ আমার নাম ইশতিয়াক।
হেহে শব্দে খনখনে হাসি দিয়ে বলল, ঐ তো ভাই ইশতিয়াক হাসান! 
আলমডাঙা স্কুল! ফার্স্ট বয়। 
পথিক এবার নিজের হাতে রিক্সার হুডি শক্ত করে চেপে ধরে কৌতুহলী চোখে জিজ্ঞেস করে কে তুমি? আমাকে চেনো নাকি?
চিনতে না পারা ই কথা। অনেকদিন হয়া গেল কিনা।
 রিক্সা পথিকের বাড়ি থেকে ত্রিশ সেকেন্ড দূরত্বে। রিক্সা থেমে গেল তার আগে। মুখ ঘুরিয়ে একচোখ লোকটি পথিকের দিকে তাকিয়ে বলল, রতন! মনে পড়ে নামটা?
হাসানের মনে পড়ল আকাশপাতাল। রতন নামে তার সেই বন্ধুর কথা। খুব বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মাঝে। মাছ ধরতে যাওয়া, পাখি শিকার, আম চুরি কত কি এডভেঞ্চার! একদিন হঠাৎ ভুল টা হয়। রতন কে গাছে উঠিয়ে দিয়ে শালিকের ডিম চুরি করতে পাঠায় হাসান। কিন্তু সেটা শালিকের বাসা ছিল না। ছিল চিল।
ততক্ষণে অনেক দেরী। রতন কে চিল দুটো ঠোঁকড়ে যাচ্ছিল। হাসান নীচ থেকে পাখি তাড়াতে ঢিল ছোঁড়ে কিন্তু ঢিল টা লাগে রতনের চোখে। চিৎকার করে রতন চোখ ধরে এক হাত ঝোলা হয়ে নীচে সোজা মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
হাসানের বিরুদ্ধে মামলা হয়, হাসানের পরিবার তখন বেশ প্রভাবশালী। এই সামান্য মামলা ঠেকানোর ক্ষমতা তাদের ছিল। আরো কঠিন সিদ্ধান্ত তারা নেন, রতন ও তার পরিবার কে গ্রাম ছাড়া করে দেন তারা। হাসান সে সময়ে ভীত ছিল কোন প্রতিবাদ সে করে নি বরং করতেও পারে নি।
রতনের কথা মনে পড়তে ই রতন!! রতন!! তুমি রতন? বলে চেঁচিয়ে উঠল হাসান। রিক্সা থেমেছে, পথিক ওরফে হাসান নেমে পড়েছেন রিক্সা থেকে। 
রতন!! রতন!! 
রিক্সা তখনো ছুটে যাচ্ছে নটবাড়ির আলোছায়া ঘেরা ল্যাম্পপোস্টের আলোকে পাশ কাটিয়ে। ভাড়া নিয়ে একটা কথাও হয়নি দুজনের। এতটা পথ এসেও দূরত্ব রয়ে গেল পুরোনো ঢঙে। 
অনেক ডাকাডাকির পরেও রতনের রিক্সা টা থামল না। চলে গেল। হাসান কেঁদে উঠল। বন্ধুত্ব্ব টার কথা রতন এখনো ভোলেনি। অথচ হাসান তাকে দেখেও চিনতে পারেনি।


(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র পুরোপুরি কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত কিংবা মৃত কারো কোন মিল নেই, মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...