রবিবার, ১ মে, ২০১৬

পুলক এবং তার অংক দাদু



চৈত্রমাসের কাঠফাটা রোদের মাঝে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল পুলক। গ্রামের পথে গোলগাল গালের ফর্সা মতন ছেলেটা যে পুলক সেটা কেউ চিনতে ভুল করবে না।
পুলক গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস থ্রিতে পড়ে। এমনিতে পড়াশুনোতে ভাল সে কিন্তু কেন জানি খুব করেও অংকতে একশোতে ষাটের বেশী পায় না।
বাড়িতে এই নিয়ে ওর বাবার রাগ!
কেমন ছেলে?
আমি গ্রামের শিক্ষক অথচ আমার ছেলে কিনা অংকতে কাঁচা! সবার কাছে মুখ থাকে আমার?
পুলকের মা অভয় দেন, দেখো না তুমি! ছেলেটার অংকটা তো তুমিও দেখে দিতে পারো?
"কথায় যুক্তি আছে, তবে শিক্ষক মশাই নিজের ছেলেকে সময় দিতে পারেন না তেমন। তার নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে হয় বেশীরভাগ সময়। পুলকের দিকে তাই নজর ও দেয়া হয় না।"

এবার অন্তত নিজে না পারলে ছেলের জন্য টিউশান রেখে দেবেন তিনি।
ব্রিজের এপাশে হেটে আসতে পথে সহপাঠী বন্ধুরা ভেংচি কাটল। "কিরে পুলক? আজ খাতাটা দেবার পর স্যার আজ তোকে এত্ত মারল! " (হি হি শব্দে মুখ চেপে হেসে উঠে বাকী সবাই)
পুলক কিছুই বলল না, অন্যর দূঃখে কি সুখ যে এরা পায়? পুলক বোঝে না।
আবার ওরা বলল,
-ওই, পুলক আজ বিকেলে মাঠে খেলতে আসবি না?
পুলক একটু থেমেই মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে বলল, "দেখি! আসবো মনে হয়।"
-আগেই আসিস রে! পরে এলে খেলতে পারবি না!
-আচ্ছা, আসবো। (নীচু স্বরে জবাব দেয় পুলক)

মাঠ চৌচির করা হি হি হাসি তুলে ওরাও চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্য এ।
পুলক বাড়ির পথে দ্রুত পা চালাল।
 স্কুলের অংকের খাতা আজ দিয়েছে, পুলক খাতায় যথারীতি ষাট পেয়েছে। এখন বাড়ি গিয়ে খাতা দেখালে বিকেলে মা খেলতে দেবে না। তাই রাতে খাতা দেখাবো ভেবে ঠিক করে, বাড়ি ফিরতে থাকে পুলক।
মনে মনে বলে 'অংকের স্যার কৃপণ, আর দশটা নম্বর দিলে কি হয়? বাড়িতে তো বকা খেতে হয় না!'

বাড়ির উঠোনে এসে মায়ের গলা শুনতে পায় পুলক, "পুলক, বাড়ি এলি? "
(মা যেন কি করে ছেলের উপস্থিতি টা বুঝে যান)
হ্যাঁ মা! (উঁচু স্বরে বলে পুলক)
ঘরে ঢুকে আগে ব্যাগ থেকে চুপিচুপি অংকের খাতাটা পড়ার আলমারির তাকে লুকায় জলদি। বিপদের আগেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত।
-পুলক! (মা ডাকেন)
-হ্যাঁ মা!
-হাত-মুখ ধুঁয়ে খেতে আয়।
-আসছি মা!
খাবার টেবিলে মায়ের প্রশ্ন, "কি রে? আজ কি কি পড়ালো ক্লাসে?"
এইত মা, রুটিনে ছিল যা, ওগুলো-ই।
মন দিয়ে পড়িস বাবা।
আচ্ছা।
(ভাগ্য ভাল খাতার কথা মা জিজ্ঞেস করে নি, নয়ত মিথ্যেটা বলতে পারত না পুলক)

খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়ে বিকেলে ক্রিকেটার পুলক ব্যাট নিয়ে সোজা গ্রামের খেলার মাঠে। নাম্বার ওয়ান ব্যাটসম্যান সে।
আজ অবশ্য খেলতে খেলতে সন্ধ্যে নামল, বন্ধুরা যে যার মত বল, ব্যাট, স্ট্যাম্প নিয়ে চলে গেছে। পুলক ও ফিরবে, ক্লান্ত লাগছিল বলে মাঠে ঘাসের উপর খানিক'টা সময় বসে ছিল।
মিনিট দুই পরেই যখন বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছে, তখনি বেশ দূরে হ্যারিকেনের আলো হাতে কেউ ওকে ডাক দিল।
"ও খোকা? এদিকে আসো তো!, একটু শুনে যাও "
পুলক ঘাস ছেড়ে উঠে কয়েক গজ এগিয়ে দেখল, যে লোকটা পুলককে ডেকেছে তার বেশ বয়েস কত হবে? হুম, সেটা আন্দাজে বলে মুশকিল! তবে, বলা যায় পুলকের দাদুর বয়েসী।
পুলকের দাদু আছেন, দিদিমাও আছেন।
ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে লোকটির দিকে এগিয়ে গেল পুলক।
কাছে গিয়েই  জিজ্ঞেস করল, "আমায় ডেকেছেন দাদু? " (যদিও বৃদ্ধ কাউকে দেখে দাদুই বলে ডাকে পুলক)
সে লোকটি বয়ষ্ক কাঁপা গলায় বলল, "আমাকে একটু এগিয়ে দেবে ঐ তালগাছের পথটা একটু?"
পুলক বলল, "হ্যাঁ, অবশ্যই! কেন নয় আসুন আমার সাথে।"
লোকটি পা চালাচ্ছে বেশ ধীরে। ভারী চলন। ধীর পা। এক পা এগিয়ে দেয় তো আরেক পা অনেক পরে। এভাবে হেঁটে গেলে সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে যাবে কিন্তু পুলক ভদ্রতার খাতিরে সেটাও বলছে না। এদিকে দেরী করলে মায়ের হাতে মার এবং বকুনি দুটোই আছে।
বেশ চিন্তা হচ্ছে পুলকের।
বৃদ্ধ কে হাতে ধরে এগুচ্ছে পুলক।
অনেকক্ষণ পর ধীর পায়ে লোকটি আর পুলক তালগাছটার গোড়ায় পৌঁছল। এখান থেকে একটা সরু আইল চলে গেছে দূরের গ্রামে।
বৃদ্ধ, এই দাদু হয়ত সেখানে যাবেন।

এবার পুলক বলল, "দাদু আমি এখন আসি। না হলে মা বকবে! এদিকে সন্ধ্যাও পার হতে চলল।"
বৃদ্ধ লোকটি কাঁপা গলায় বলল, "ঠিকাছে এবার এসো দাদু ভাই!"
বৃদ্ধ সেখানে বসে পড়ল। তার হাতের হ্যারিকেন তখনো জ্বলছে।
বৃদ্ধ বসুক!!
আর দেরী নয়!!
 পুলক দৌড়ে তালগাছ পেড়িয়ে এক মিনিটে আবার মাঠে এসে পড়ল। মাঠে এসে কি মনে করে আবার একটু পেছন ফিরে দেখল।
দেখতে পেল, একটু আগে সে যাকে তালগাছের পথে এগিয়ে দিয়ে এসেছে, সেখানে এখন কেউ নেই!
লোকটির হাতে হ্যারিকেন ছিল, ওটার আলোও এখন চোখে আসছে না। হয়ত হ্যারিকেনের আলো নিভে গেছে, নয়ত সে চলে গেছে।

ইতিউতি ভেবে আর দেরী করল না পুলক, বাড়িতে মা বকবে। জলদি যেতে হবে!
বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই মায়ের গলা, "পুলক! এতক্ষণ কোথায় ছিলি? সন্ধ্যে হয়েছে কখন? পড়াশোনা কখন করবি? "

হাত-মুখ ধুয়ে পুলক বসে গেল পড়তে, আগামীকাল ক্লাসে বাড়ির কাজ আছে। খাতা আজ দেখাবো না!
বাড়ির কাজ করবে বলে পুলক টেবিলের ড্রয়ার খুলে কলম বের করতে গেল এমন সময় ওর পকেট থেকে  'খট ' শব্দ তুলে কিছু একটা মেঝেতে পড়ল!
কি পড়ল সেটা দেখতে গিয়েই পুলক দেখল,
"ওর পছন্দের একটা কলম! ফাউন্টেনপেন!
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এ কলম টা ছিল না, বাবা কে বলেছিল এটা কিনে দিতে, সেটা আর কেনা হয় নি।
বাবা বলেছিল রেজাল্টের পর।
 তাহলে এটা কোথা থেকে এল?
ভ্রু কুঁচকে পুলক 'মা' বলে ডাক দিল,
"কি রে, কি হয়েছে?"- একটুপর মা ঘরে এলেন।
মা, এ কলম কি তুমি দিয়েছো?
পুলকের মা হাতে নিয়ে কলম টা দেখলেন।
 বললেন, "কই না তো! "
পুলক ভাবল, তাহলে ভুল করে হয়ত ক্লাসের কেউ ওর ব্যাগে রেখে গেছে, কাল ই সেটা ফেরত দিয়ে দেবে।

পরদিন বিকেলে, সেই খেলার মাঠে খেলতে গেছে পুলক। খেলার পাশাপাশি পুলক খেলার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছে সেই উত্তর কোণে। গতকাল বৃদ্ধ লোকটা সেখানেই ছিল।
সহপাঠী এক বন্ধু বলল, "ঐ, সেদিকে কি দেখছিস রে, ভাল করে ফিল্ডিং কর "
হ্যাঁ হ্যাঁ করছি!
খেলায় মন দেয় পুলক।
আজ অবশ্য  ক্লাসে সব্বাইকে কলম টা দেখিয়েছে পুলক কিন্তু কেউ নিজের বলে দাবী করেনি।
তাছাড়া যেহেতু গতকাল সন্ধ্যে মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার পর পকেট থেকে সেটা পড়েছিল
 তাই এই কলমটা সে বৃদ্ধ লোকটিরও হতে পারে।
তবে এখনো সে লোকটির দেখা নেই!
এদিকে সন্ধ্যা নামবে কিছুক্ষণ পর। খেলা আজকের মত শেষ।
যখন সবাই ফিরে যাচ্ছে তখন পুলক দেখল হ্যারিকেনের আলো নিয়ে সেই লোকটি আসছে।
তাকে দেখেই এবার পুলক নিজেই ছুটে গেল।
"এই যে দাদু! এই যে শুনছেন? "
লোকটি থেমে গেল, হাসিমুখে বলল, "কি দাদু?"
"আপনি...আপনি ( হাশফাঁশ করছে পুলক) কাল এই কলমটা কি আমার পকেটে দিয়েছিলেন ভুল করে?"
হ্যারিকেনের আলোয় কলমের স্টিল বডি টা চকচক করে উঠল।
বৃদ্ধ লোকটি হাত বাড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ! "
"এটা আমার লাগবে না! আপনি রেখে দিন দাদু" -পুলক বলল
বৃদ্ধ বলল,
"না না! দাদু ভাই..  এটা হবে না, আমি কিছু দিলে সেটা ফেরত তো নিই না! আর আমি তোমাকে তো খুশী হয়ে দিয়েছি।
(কথাগুলো বলেই বৃদ্ধ লোকটি মৃদ্যু হাসল) এটা তোমার জন্যই। "

পুলক কলমটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, ভাবছে নেবে কি নেবে না! ভীষন ইচ্ছে আছে আবার ইচ্ছে নেই। দোটানা!
রেখে দাও দাদুভাই! এটা তোমারি।
হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে এলো বৃদ্ধ বলল,
"আচ্ছা দাদুভাই, আজও আমাকে কি একটু এগিয়ে দেবে পথটা ?" হাসিমুখে সে।
পুলক রাজী হল।
তিনি পুলকের নাম জানতে চাইলেন, বাড়িতে কে আছে? বাবার নাম? আরো কত্ত কি!
পথটুকু যেতে যেতে পুলকও জেনে গেল বৃদ্ধ লোকটির নাম "দেবেন্দ্র কুমার কর "
একসময় এই গ্রামে জাঁদরেল শিক্ষক ছিলেন। তিনি গনিত পড়াতেন। সেও অনেক আগে। এখন আর পড়ান না। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর অভাবটা এখনো তার গায়ে কাটা দেয়।
মন দিয়ে বৃদ্ধ দাদুর কথা শুনতে লাগল পুলক। দাদুও জেনে গেলেন তার নাতি অংকে কাঁচা।
ধীরেধীরে দাদু আর নাতির কথা হলো।
পুলকের সাথে বন্ধুত্ব জমে উঠল তার পাতানো দাদুর। যদিও পাতানো দাদুর গল্প আড়ালে বলতে হয়। দাদুর সামনে তো আর তাকে পাতানো দাদু বলা চলে না!

এদিকে প্রতিদিন দাদু এটা সেটা দেন পুলকের হাতে, কোনদিন বই, কোনোদিন কলম, মিষ্টি।
পাশাপাশি পুলক তার দাদুর কাছে বসে থেকে অংক শেখে। দাদু পুলককে বড্ড আদর করেন।
দাদুর মাষ্টারি চলতে লাগল।
মাসের পর মাস কেটে যেতে থাকল। পুলক পড়াশোনায় ভাল করতে লাগল।
ক্লাসে পুলকের উন্নতি চোখে পড়ার মত হয়। ক্লাস থ্রি বার্ষিক পরীক্ষায় পুলকের ক্লাস রোল এক হলো।
বাবা-মায়ের মুখে হাসি।
ছেলে নতুন ক্লাসে ফার্স্ট বয়। বাবা নতুন নতুন জামা-জুতো কিনে দিলেন। গলা তুলে সহকর্মী শিক্ষকদের বললেন, "পুলক, আমার ছেলে! "

পুলক এদিকে কথা দিয়েছে তার অংক দাদুকে, ক্লাসে প্রথম হলে মায়ের হাতে পিঠেপুলি এনে দাদুকে খেতে দেবে।
মা ছেলের পিঠাপুলির আবদার আজ রেখেছেন। বাড়িতে পিঠেপুলি করেছেন তিনি।
সেই পিঠাপুলি নিয়ে বিকেলে মাঠে হাজির পুলক। বাড়িতে মায়ের কাছে বলেছে তার এক বন্ধুকে পিঠে খাওয়াবে। মা আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি।
কিন্তু মাঠে পিঠেপুলি নিয়ে আসতেই বন্ধু বান্ধবের হানা।
আমাকে দে একটা!
বন্ধু শিশির এসে তো প্রায় নিয়ে নেবেই পিঠে এমন ভাব।
পুলক আজ খেলছে না, বসে পিঠে সামলাচ্ছে।
বকের দৃষ্টিতে!

সবাই চলে যেতেই পুলক দেখতে পেল তার অংক দাদু উত্তর কোণে হ্যারিকেনের আলো নিয়ে হাতের ইশারা করছে।
পুলক ছুটে দাদুর কাছে এল, আর দাদুর হাতে পিঠেপুলির বাটি তুলে দিল। দাদু, কাঁপা হাতে হাসিমুখে মুখে তুলতে লাগলেন রকমারি সব পিঠে।

এদিকে আড়াল থেকে লুকিয়ে পুলকের এহেন কর্মকান্ড দেখতে লাগল বন্ধু শিশির।
শিশির দেখল পুলক কার সাথে যেন একা একা কথা বলছে, সন্ধ্যে লাগছিল বলে দূর থেকে ওখানে কাউকে ভালোমত  দেখা যাচ্ছিল না। যদিও পুলক একা বসে আছে সেটা একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
পুলক কি পাগল হলো তবে? (শিশিরের মনে প্রশ্ন জাগল)
শিশির বাড়ি যাবার পথে পুলকের মায়ের কাছে সবকিছু খুলে বলে গেল।
পুলক বাড়ি ফিরল একগাদা কলম হাতে। আজ অনেক কলম দিয়েছেন দাদু। এও বলেছেন কাল থেকে দাদু আর আসবেন না! কিন্তু কেন আসবেন না সেটা বলেন নি।
আরো বলেছেন,
" আর তোমার এই দাদুর কথা কাউকে বলো না, ঠিকাছে?"
পুলক জিজ্ঞেস করে,
"দাদু, তুমি সত্যি আর আসবে না?"
দাদু বলল, "আসবো, কিন্তু রোজ আসবো না। কোমড়ে ব্যথা হয় রাতে, বেশী হাটাহাটি গায়ে সয় না! "
পুলক মুখ ভার করে।
"তুমি এসে আমাকে মনে করো, আমি হুট করে একদিন আসবো। "( বলে মৃদ্যু হাসি দিলেন দাদু) হাসিতে দাদুর শীর্ণ চামড়ায় টান পড়ল।
পুলকের মন একটু খারাপ, তবে দাদু ডাকলে আসবেন বলেছে এটাই স্বস্তি।

এদিকে বাড়ি ফিরে হইচই দেখে ভয় পেল পুলক। মা-বাবা জেনেছেন, ছেলে নাকি কার না কার সাথে গল্প স্বল্প করে!
পুলক! এদিকে আসো!
মা-বাবা পুলককে ডেকে এনে কাছে বসালেন।
বাবা বললেন, "পুলক! বাবা! তুমি কার সাথে দেখা করো? "
পুলক বলে না, বলে না!! (দাদু মানা করেছে)
পরে ধমক খেয়ে সে বৃদ্ধ লোকটির কথা মা-বাবাকে খুলে বলল পুলক,
লোকটির নাম দেবেন্দ্র কুমার কর, শুনেই অবাক হয়ে গেলেন পুলকের বাবা, তার বিশ্বাস হচ্ছে না ছেলের কথা।
অস্পষ্ট শব্দে তার মুখ থেকে বেড়োল, স্যার!
পুলকের মা সাথে সাথেই বললেন, "স্যার, কার স্যার? "

পুলকের বাবা বললেন, "আমার স্যার ছিলেন। তখন ১৯৭১ আমি সবে ক্লাস থ্রি তে পড়ি। দেশে গন্ডগোল চলছে। দুই পাকিস্তান সরগরম!

তার মাঝেও আমার বাবা, আমাকে পড়াবেন বলে গনিত শিক্ষক দেবেন্দ্র কুমার করের কাছে পড়তে পাঠালেন। বেশ জাদরেল গনিত শিক্ষক তিনি। গলায় এবং হাতে মারাত্বক জোর। মানুষ হিসেবে বড় ভাল।
টালমাটাল সময়ে ক্লাস খুব একটা হতোনা। দেবেন্দ্র স্যারের কাছে আমি কিছুদিনে প্রিয় হয়ে গেলাম। স্যার আমাকে বড় ভালোবাসতেন।
 আমিও স্যারের অনুসারী ছিলাম আর খুব অল্প সময় লেগেছিল স্যারের প্রিয়ভাজন হতে।

কিন্তু মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। যে যার মত পালাল গ্রাম ছেড়ে কিন্তু স্যার গেলেন না। তার একমাত্র ছেলে অনুময় যুদ্ধে গেল।
বাবা দেবেন্দ্র প্রতিদিন হ্যারিকেন নিয়ে গ্রামের সে উত্তর কোণের দিকে বসে থাকতেন, ছেলের ফেরার পথ চেয়ে।
ছেলে ফেরেনি।

একদিন
স্যারকে এলাকার কিছু রাজাকার ধরিয়ে দিল পাকসেনাদের হাতে। নির্মমভাবে স্যার কে বেয়নেট চার্জ করে মেরে ফেলে ওরা। এরপর স্যারের মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। কেউ সাহস করে সেদিন যায়নি স্যারকে বাঁচাতে!
স্যারের লাশ আর মেলে নি।
ধারনা করা হয় স্যারকে মেরে ফেলে পাকসেনারা উত্তরের পুকুর পাড়ে পুতে রেখেছিল। যুদ্ধের পর তেমন কেউ আর স্যারের খোঁজখবর কেউ নেয়নি।  (এতক্ষণ পর থামলেন পুলকের বাবা)
পুলকের মা জিজ্ঞেস করলেন, "তার ছেলে? "
মাথা ধীরেধীরে ডান-বাম করে বোঝালেন ছেলে আর ফেরে নি!

পুলক মুখ ভার করে বসে আছে।
হঠাৎ টেবিলের সেই ফাউন্টেনপেন এবার নজরে এল পুলকের বাবার, উঠে গিয়ে সেটা হাতে নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, "এটা কার? "
দাদু দিয়েছিল! (নীচুগলায় বলল পুলক)
আমাকে নিয়ে যাবি তোর দাদুর কাছে? চকচকে চোখে হাটু গেড়ে ছেলের দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরলেন তিনি।

পুলক হাসিমুখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জিজ্ঞেস করল, " সত্যি যাবে বাবা? "
হ্যাঁ!
ঘড়িতে সন্ধ্যে সাত টা কুঁড়ি,
হাতে টর্চ নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন বাবা আর ছেলে।
মাঠে পৌঁছে পুলক উঁচু গলায় ডাক দিল, দাদু উ উ...
কেউ আসে না... আসে না...
আরো কয়েকবার ডাক দিল পুলক
না! কেউ আসছে না।
অধৈর্য হয়ে পুলকের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, "কিরে? কোথায়? "
এবার দুজনকে অবাক করে,
হঠাৎ উত্তর কোণে হ্যারিকেনের আলো হাতে ধূতি পড়া কেউ এসে দাঁড়াল।
কাঁপা গলায় বৃদ্ধ বলল, "কি দাদুভাই? এত্ত রাতে? "
এত দূর থেকেও দেবেন্দ্র বাবুকে স্পষ্ট নজরে এল পুলকের বাবার,
বিস্ফোরিত চোখ সেদিকে তাকিয়ে। কাঁপা গলায় মুখ থেকে তার গলা থেকে একটা মাত্র শব্দ বেড়োল, সেটা শুধু  "স্যার "

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...