রবিবার, ১ মে, ২০১৬

বারেন ভৌমিকের অসুখ


মাঝবয়সী বারেন ভৌমিকের ভয়ানক অসুখ, দিনে রাতে সমানে কাশি দেন। কাশি টা এমন যে এই বসে আছেন চুপচাপ, কোন কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ- ই খুক খুক শব্দে কেশে উঠেন। কোন আগাম লক্ষণ ছাড়াই- তার এই কাশি। অস্বাভাবিক কাশির ধরন, একবার শুরু হলে আর থামে না।
আয়ুষ্কাল কম?
চিন্তার ভাঁজ খুলে জ্যোতিষ বাড়িতে ডেকে এনে সবিস্তরে বারেন বাবু নিজের জন্ম কুষ্টি গুনিয়েছন দু'বার।
এখানেও জটিলতা এক জ্যোতিষী বলেন আছে, দ্বিতীয়জন বলেন নেই!
কি আছে ঠাকুর? (ভ্যাবাচ্যাকা মুখে বারেন বাবুর প্রশ্ন)
ন্যাকা সুরে জ্যোতিষী জানায়
"বাবু, কাশিতেই! হ্যাঁ ঐ কাশিতেই মৃত্যু "
দ্বিতীয় জ্যোতিষী অবশ্য সেরকম কিছু না বললেও, স্বাস্থ্যহানির কথা জোর গলায় বলেছেন!
তবুও তাদের ভবিষ্যৎ বাণীতে,
দ্বিমত! কই আর যান তিনি! কপাল, মাথা কোনটাই চুলকে সমাধানের দেখা পান না তিনি। এদিকে পাড়ার উটকো কানপড়া লোকের মুখও বন্ধ হয় না। নানা কথা বলে পাড়া মাথায় তোলে, তাদের কানাঘুষা চলে- "বারেন বাবু আর ক'দিন!,  আরে বারেন বাবু? হে হে... কথা থামে না "
বারেন বাবু ভাবেন,
'জ্যোতিষী যাই বলুক, তার মনে তিনি অটল। '
 তিনিও ভেবেই নিয়েছেন যে তার কাশিতেই মৃত্যু হবে। মৃত্যুর আগে তাই একবার কি মনে করে তীর্থ কাশি হয়েই এলেন। ভাল খড়চা-পাতি করলেন।
বাড়িতে ফিরেই কাশি সারার কামনা করে গরীব দূঃখী খাওয়ালেন।
না এর পরও বছর পাঁচেক কেটে গেল, কাশি সারে না। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি শেষতক, ঝাঁড়ফুঁক। নাহ, সারে না।
যে ডাক্তার আসেন; নাড়ী টেপেন, চোখের ব্যাসার্ধ ছোট বড় করেন, কপালে ভাঁজ তুলে প্রেসার মাপেন এরপরে নিয়মমাফিক মতো খচখচ শব্দে সাদা কাগজের পাতায় কয়েকটা ওষুধপাতির নাম লিখেন।
ভারী গম্ভীর গলায় বলেন, "খেতে হবে ওষধি, না হলে হবে না কোন গতি "
বারেন বাবু বলেন, " কি আর করিব? এত্ত খাইলাম ওষধি তবুও হইল না ক্ষীণ উন্নতি! "
ডাক্তার চলে যাবার আগে উঠতে উঠতে বলেন, " এইবার দেখুন, সারিবে বোধকরি যদি থাকে স্রষ্টার সুমতি "
ডাক্তার মাঝে মাঝেই বাড়ি আসেন আবার চলেও যান। মাঝে ওষুধ বদলায়, ডাক্তার বদলায় কিন্তু মোদ্দা কথায়,
বারেন ভৌমিকের ব্যারাম সাড়ে না!
শেষে অবস্থা এমন জায়গায় দাঁড়াল যে ভৌমিক বাবু, এলাকায় কাশি বাবু নামে পরিচিত হতে লাগলেন। মনের কষ্ট মনে রেখে ব্যাবসা বানিজ্য পুত্রের হাতে তুলে একপ্রকার বাড়িতেই নিজেকে বন্দি করে ফেললেন।
না এ মুখ আর কাউকে দেখাচ্ছি না! (ভীষন পণ করলেন মনে মনে)
একপ্রকার গৃহবন্দী জীবন যখন প্রায় দূর্বিসহ হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনি,
হঠাৎ একদিন, শুনতে পেলেন তার পাড়ায় নতুন এক ডাক্তার এসেছে, নাম রক্তিম পালিত, বিলেত ঘুরে বেশ নাম কামিয়েছেন তিনি। তবে তিনি এল্যোপ্যাথি ডাক্তার নন বরং তিনি দেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা।
সে হোক, অসুখ সারা নিয়ে কথা!
পালকি চাপিয়ে বিকেলেই বাড়ির দারোয়ান শংকর কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন পালিত বাবুর চেম্বারের উদ্দেশ্যে।

রোগ মুক্তির আশায় চেম্বারে পা রাখলেন বারেন ভৌমিক।
বিকেলের চেম্বার, ভীর কম। তবুও মুখ চেনা রোগীরা বারেন বাবুকে দেখেই মুখ টিপে হাসতে লাগল।
"ওই দেখ, কে এসেছে?"
কে? কাশি বাবু! হে হে
এহেম এহেম (গলা খাঁকারি দিলেন বারেন বাবু, হাসাহাসি কিছুটা স্তিমিত হল)
পালিত বাবু কাগজের লেখা ফেলে আগন্তুকের দিকে চাইতেই বারেন বাবুর দু'হাতের তালু এক করে লম্বা নমষ্কার দিলেন "নমষ্কার! "
প্রতিনমস্কার জানিয়ে, রক্তিম পালিত তার লেখায় মন দিলেন।
চেয়ারে বসেই আপাদমস্তক পালিত বাবুর দিকে এক নজর দেখলেন বারেন বাবু। চেহারায় বেশ গাম্ভীর্য আছে লোকটির।
বেশ কিছু রোগীর পর সিরিয়াল এলো বারেন বাবুর,
খুব মার্জিত কিন্তু ঠান্ডা গলায় পালিত বাবু জিজ্ঞেস করলেন,
"কি সমস্যা আপনার? খুলে বলুন "
মন থেকে সাহস পেয়ে এক নিঃশ্বাসে সব খুলে বললেন বারেন বাবু, সেই সাথে কাশি ভ্রমণের কথাও উল্লেখ করতে ভুললেন না। লোকমুখের অপমানের কথাও বললেন সেই সাথে।
সব শুনে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন রক্তিম পালিত। এরপর বললেন, "আমি ওষুধ দেব কিন্তু তাতে শর্ত আছে! "
-কি শর্ত?
বারেন বাবু, পালিত বাবুর শর্ত শুনে মাথা হ্যাঁ সূচক ভাবে নাড়লেন। বললেন, "আমি রাজী! "
পালিত বাবু একগাল হেসে নিজের চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন।
এরপর কাঁচের আলমারি তাকে সাজানো ওষুধের ভরা শিশিবোতলের ভীরে স্বচ্ছ তরল ভর্তি মাঝারি মানের বোতল এনে বারেন বাবুর সামনে এনে রাখলেন।
এরপর বললেন,  "এতেই আপনার ব্যামো সাড়বে।"
বারেন ভৌমিক খুশীতে খুক খুক করে কেশেই দিলেন
"হ্যাঁ, সাড়বে খুক... খুক সত্যি. তো? . খুক খুক! "

পালিত বাবু আবার তার কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন,
"হ্যাঁ, তবে আমার শর্ত মানলেই সেটা সম্ভবপর হবে "
বারেন ভৌমিক রাজী ছিলেন শর্তে।
 চিকিৎসক রক্তিম পালিত ওষুধ দিলেন।
নিয়ম করে ভোরে এবং রাতে খেতে হবে, সাথে শারীরিক ব্যায়াম। জোর করে নয়, যতটা শরীরে কুলোয়।

প্রায় মাস'খানেক যাবার পর বারেন বাবুর কাশির দমক কমে এল।
এদিকে পালিত বাবুর গুনের ধন্যি পড়ে গেল।
আহা! একি ডাক্তার? না দেবতা!
যেখানে এত এত বৈদ্য, ওঝা, চিকিৎসক অসহায় ছিলেন, সেখানে পালিত বাবু কি করে সফল হলেন?
মহান ডাক্তার পালিত বাবু।
লোকে-জনে রক্তিম পালিতের নাম অনেক প্রচার হল।
এদিকে,
ধীরেধীরে একদিন সত্যি সত্যিই বারেন ভৌমিকের কাশি সেরে গেল।
বারেন ভৌমিক তার ব্যাবসায় মন দিলেন পুনরায় এবং ঠিক করলেন পালিত বাবুকে বাড়ি এনে ভালমন্দ কিছু খাওয়ানোর নিমন্ত্রণ করতেই হবে।
সবকিছু ভেবেচিন্তে সেদিন বিকেলে মিষ্টি নিয়ে পৌঁছে গেলেন পালিত বাবুর চেম্বারে।
রক্তিম বাবু তখন রোগী সামলাতে মহাব্যাস্ত।
চেম্বারে ঢুকেই বারেন ভৌমিক দু'হাতের তালু এক করে,
"নমস্কার পালিত বাবু! "(বেশ জোর গলাতে জানালেন বারেন বাবু)
পালিত, বারেন বাবুকে ইশারায় বসতে বললেন শুধু।
রোগী চলে যেতেই বারেন ভৌমিকের কন্ঠে প্রশংসার স্তুতি ফুটল।
আপনি এই, আপনি সেই!
সব শুনে রক্তিম পালিত মুচকি হাসলেন, বললেন, "আমি তো আপনাকে কোন ওষুধই দেই নি মশাই "
প্রথমে কথাটা শুনে বেশ হাসিচ্ছলেই সেটা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বারেন বাবু কিন্তু গম্ভীর মুখে পালিত বাবুর পরের কথাগুলো শুনে তার হাসির দমক কমে শুন্যে নেমে এল।
স্তিমিত গলায় অবাক হয়েই প্রশ্নটা করলেন বারেন ভৌমিক, "মানে?"
পালিত বাবু বললেন, "দেখুন, আমি আপনাকে একটা শর্ত দিয়েছিলাম, সেটা কি মনে আছে আপনার ?"
বারেন বাবুর মনে এল সে শর্ত, "ওষুধ খাবার পর কাশি দেয়া যাবে না, ইচ্ছে হলেও না "
(বিড়বিড় করে মুখস্থ বললেন কথাগুলো)
পালিত বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বারেন বাবুর কাঁধে বাম হাত চাপড়ে বললেন,
"এই তো, মনে আছে দেখছি! আসলে আপনার এলাজ করার জন্য সেটাই ছিল মহৌষধ। আমার দেয়া শিশিতে তো শুধু সাধারণ সুপেয় জল ছিল, যেটা আমি সাধারণত ওষুধের শিশিতে মেশাই। আসলে অসুখটা সেড়েছে শুধু আপনার একান্ত ইচ্ছে শক্তিতে। "
লম্বা কথা বলে আবার নিজের চেয়ারে এসে বসলেন পালিত বাবু। তিনি এবার আনন্দের হাসি দিচ্ছেন।
কিন্তু বিষ্ময় ভাবটা কাটেনি বারেন ভৌমিকের!
তিনি কি বলবেন সেটা ভেবে পাচ্ছেন না, অতি আনন্দে তিনি বোবাকান্নায় তার দু'চোখের কোণা ভিজিয়ে ফেলেছেন।
বারেন ভৌমিকের মনে পড়ল, ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে মেলায় সার্কাসের ভোজবাজী দেখেছেন, অবাক সব কান্ডকারখানা দেখায় ওরা। এক পলকে ভ্যানিশ করে দিত সব!
আজকের ডাক্তার পালিত বাবুও তেমন একজন। তার মনে হচ্ছে যাত্রার ভোজবাজী আবার কি? পালিত বাবুর ভোজবাজী তে তার কাশি আজ পরাজিত। কিন্তু সার্কাসের মেলার সেই মিথ্যে মিথ্যে ভোজবাজিকর নন রক্তিম পালিত। তিনি সত্যিকার ভোজবাজিকর, জীবন বদলানো জাদুকর।
চিন্তাজগত থেকে ফিরে এলেন পালিত বাবুর গলার স্বরে, "আজ রোগী দেখতে যাচ্ছি! আপনার নিমন্ত্রণ কাল রক্ষা করতে হবে "
রক্তিম পালিত উঠে দাঁড়ালেন।
বারেন বাবু এখনো বাজির নেশায় ডুবে আছেন, তার বিষ্ময় এখনো কাটেনি!

(সমাপ্ত)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...