সদরঘাট টার্মিনাল, লোকে লোকারণ্য। দম ফেলার জায়গা নেই কোথাও।
ঈদেরছুটি শুরু হয়েছে। তাই বিকেলের এ সময়ে সামান্য ফুসরত ফেলবার সুযোগ নেই কারও
মাঝে। মুখের পর মুখ লঞ্চঘাট মুখী। সাদাকালো, শ্যামলা, ছোট্ট পা আর বড় পায়ের মানুষ ছুটছে প্রাণের টানে
নিজ নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে।
সে ভীরের মাঝেই মাদুর পেতে -থালা হাতে, চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এখনো ভিক্ষা করে যাচ্ছেন
আমিন মিঁয়া।
জন্মের পর পাঁচ
রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আব্বা শফিক মিঁয়া ছেলের নাম রাখেন আমিন। মিঁয়া বাড়ির
প্রথম ছেলে আমিন। পিতার স্বপ্ন ছেলেকে মোক্তবে পড়াবেন। ছেলে মাশাল্লাহ রাজপুত্তুর।
আদবকায়দা, চেহারায়
অতুলনীয়।
তাই ছেলের বয়েস পাঁচ পার হতেই ভর্তি করে দিলেন মোক্তবে।
মোক্তবে পড়া আমিন খুবই ভাল ছাত্র।
তাই ফলাফল দিয়ে আব্বার মুখ উজ্জ্বল করতে সময় নিল না। পিতা-মাতার মুখে
সুখের হাসি। কিন্তু সব সুখ একসাথে মেলে না! শফিক।মিঁয়ার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া জমির
অধিকাংশ ছিল মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে। শেষরক্ষা হলো না আর!
উন্মত্তা মেঘনার নদীর করাল গ্রাসে বেঁচে থাকার সম্বল ফসলের
ক্ষেত ভেসে গেল পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে। গাঁয়ের বাড়িটাও গেল কিছুদিন পর।
গ্রামের অনেক বাড়ির মত মিঁয়া বাড়ি হয়ে গেল অতীত।
পেট চালাতে কাজ চাই, গ্রামে প্রায় সবাই নিঃশ্ব মেঘনার আঘাতে।
তাই কাজের খোঁজে শফিক মিঁয়া তার স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে
আমিন কে নিয়ে চলে এলেন যাদুর নগরী ঢাকায়।
আশ্রয় নিলেন ফুটপাতের পাশে গড়ে উঠা এক বস্তিঘরে। তার
জীবিকানির্বাহের বাহন হল গরীবের গাড়ি রিক্সা।
দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও পুত্র আমিন কে আবার ভর্তি করে দিলেন
এলাকার মাদ্রাসায়। মেধাবী আমিন আবার হাসিমুখে, শফিক মিঁয়া সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ঢাকার পথ চষে
বেড়ান, পরিবারের
ভাল থাকাটা তার জন্য বেশী দরকারি।
বস্তিতে মাদক ব্যবসা চলে, মাঝে মাঝে পুলিশ এসে হানা দেয়। ওরাও সপ্তাহে
আসে যদি পকেটে কিছু না পড়ে। মাদক সম্রাট পুলিশসাহেব কে খুশী করে দেয়।
শফিক মিঁয়ার রাতে ঘুম হয় না, তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি তাকে এমন জীবন কাটাতে
হবে। মেঘনার রাক্ষুসে ক্ষোভ মাত্র এক ধাক্কায় এলোমেলো করে দিয়েছে তার জীবন। চোখের
দু-কোণা
ভিজে আসে তার। কি ভেবেছিলেন আর কি হলো!
চালার টিনের দিকে টিনের ফুটো দিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয়
চোখ যায় তার। ক্লান্তিতে, ঘুমের মায়ায় চোখটা বুজে আসবে যখনি শোনেন
বস্তিতে পুলিশের রেড পড়েছে। বাঁশি বাজিয়ে টর্চের তীব্র আলো পড়ছে বস্তিতে, বুটের ধপাধপ
ভারী শব্দ।
মাদক সম্রাট ধরা পড়েছে। জানালায় চোখ ভিজিয়ে ধরে নেবার দৃশ্য
টা স্ত্রীসহ চুপিচুপি দেখলেন তিনি।
শুকরিয়া আদায় করলেন মন মনে। অন্যায়কারী যতই শক্তিশালী হোক
ধরা তাকে পড়তেই হবে।
এভাবে তাদের বছর কেটে যায়, ঈদ আসে। শফিক মিঁয়ার ঈদ এবার আনন্দে কাটে না, অনাহারী হয়ে
ঈদের আনন্দ কতটুকু আর দাগ কাটে?
তবুও ছেলেকে তা বুঝতে দিতে নারাজ তিনি, ছেলেকে নতুন
পাঞ্জাবি কিনে দেন। সেমাই কেনেন বাড়িতে। ঈদের আয়োজন চলে শত কষ্টের আড়ালে।
ঈদের খুশীতে আমিন আটখানা হয়। পিতা হয়ে সন্তানের এই খুশীই
তার বড় প্রাপ্তধন।
কিন্তু সব খুশীই কেন জানি চিরস্থায়ী হয় না। রিক্সা নিয়ে
ভয়াবহ এক এক্সিডেন্ট করে ফেলেন শফিক মিঁয়া। চলন্ত বাস তার রিক্সাসহ ঠেলে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়।
পংগু হয়ে গেলেন শফিক মিঁয়া। সংসারের হাল ধরলেন স্ত্রী। বাড়ি
বাড়ি গিয়ে ঠিকে কাজে যা ইনকাম হয় তাতে সব খরচ মিলিয়ে আমিনের পড়ালেখার খরচ বাকী থাকে
না। অসুস্থ শফিক মিঁয়ার ওষুধ, সংসারের খরচ মিলিয়ে পড়ার খরচ কই?
ধুঁকে ধুঁকে অসুখে আমিনের বাবা মারা যাওয়ার পর আমিন নামে
ভিক্ষায়। কেউ কাজ দিত না, মাঝে এক হোটেলে বয় হিসেবে নেমেছিল কাজে কিন্তু
হোটেলের মালিক চোর বলে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে।
সেই থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালায় আমিন। সংসারে শুধু
তারা দুজন আমিন এবং তার সন্তান রকিব। মা মারা গেছেন বাবা মারা যাওয়ার দু বছর পর।
অভাবে থেকে পড়ালেখা আর হয়নি।
"আম্মা, আল্লার নামে
কিছু দিয়া যান"
(কাঁদো স্বরে আকুতি জানায় আমিন)
পথচারী মহিলা হাটা থামিয়ে পাঁচ টাকার একটা কয়েন টন শব্দ করে
থালায় ফেলে দিয়ে আবার আগের গতিতে চলে গেলেন তার গন্তব্যে।
আলহামদুলিল্লাহ্!
শুকরিয়া আদায় করলেন আমিন মিঁয়া।
ছেলে রকিব আমিন মিঁয়াকে হাতে ধরে তাড়া দেয়, "আব্বা আইজ
চলেন বাড়ি যাই! অনেক
হইছে!"
আমিন মিঁয়া ছেলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ান।
লঞ্চঘাটের ব্রিজ ধরে এগিয়ে আসেন দুজনে। আমিন এখনো বিয়ে
করেননি। রকিব তার রক্তের কেউ নয়। পথে কুঁড়িয়ে পেয়েছেন ওকে, রক্তের মিল
না হলেও রকিব আমিনের সন্তান। নিজে ভিক্ষে করলেও ছেলেকে পড়াচ্ছেন স্কুলে।
রকিব স্কুলের ফার্স্ট বয়।
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন