অভি; এক নামে জুনিয়র থেকে সিনিওর
সবাই চেনে ওকে, মেডিকেল লাইফের ১৮০ জনের একজন ও। কোঁকড়া চুলের ফর্সা ছেলেটি ভীষণ লাজুক,
মেডিকেল কলেজে বছর বছর নতুন মুখ আসে, আবার চলে যায়। কিন্তু ওর মত দুঃখী কেউ হয়ত এখনও
আসেনি কেউ। নিজের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখে ও।
এক
ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরুর পর থেকেই
অভি ক্লাসে ভীষণ মনযোগী।মন দিয়ে সব ক্লাস করে সে, কি টিওটোরিয়াল কি লেকচার। কিন্তু
চাপা স্বভাবের অভি কারও সাথে মিশতে পারে না।মুখ লুকিয়ে থাকতে কে ভালবাসে? ক্যাম্পাসে
নতুন মুখের যেখানে ছড়াছড়ি সেখানে অভি নিজে থেকে এগিয়ে না এলে কেই বা ওকে বন্ধু বলে
কাছে টেনে নেবে।তবুও অসম্ভব উদ্দীপনায় ক্লাস শুরু করে অভি।
কিছুদিন পর অভির জীবনে দুঃসংবাদ
বয়ে আসে, ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অভির বাবা। অভির পরিবারে অভি একমাত্র ছেলে।বড় বোন
আছে ওর কিন্তু পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে সব দ্বায়িত্ব নিজের এসে পরে অভির কাঁধে। মেডিকেল ছেড়ে অভি ছোটে ওর বাবাকে
নিয়ে। কাছের বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না এ ব্যাপারে। শুরুতে সবাই যখন পড়াশোনা
নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস, সেখানে অভি প্রায় মাস খানেক মিসিং।
এরপর অভি যখন মন খারাপ করে ফিরে
আসে ক্যাম্পাসে ততদিনে, মেডিকেলের অনেক এক্সাম চলে গেছে। সাপ্লি জটিলতায় আটকে যায় অভি।
একের পর এক টার্ম, আটকে যায় ওর। ফিরে এসে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অভি, হতাশায় পড়ে যায়। বুঝে
উঠতে পারে না কোনদিকে যাবে সে। ক্যাম্পাসের হলে ফিরে আসবার পর তার সহপাঠীরা যখন এক্সাম
দিয়ে ফুরফুরে হয়ে আছে, উচ্চস্বরে আনন্দ করছে তখন অভির নিজেকে একা মনে হয়। কান্না লুকোতে
বেড়িয়ে পড়ে সবার অলক্ষ্যে। কাছে থাকা যাদের ও বন্ধু ভেবেছিল ওরাও নিজস্ব চাহিদা আর
ক্ষমতার দাপটে ভুলে যায় ওকে। কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে যায় অভি। এক বুক হতাশ ঘিয়ে ধরে ওকে।
ঢাকার নামকরা কলেজ থেকে পাস করে
বের হওয়া অভি যখন মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। তখন সবচেয়ে খুশী হয়েছিলেন ওর বাবা। সেই
বাবা যখন অসুস্থ, অভির কি করে মন বসে মেডিকেলে!
ছ’মাস কেটে যায় এভাবে। মাঝে অভি
একবার ঢাকা একবার কলেজ, ছুটোছুটি চলতে থাকে অভির। অভির বাবা মাঝে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন
তাকে নিয়ে যেতে হয় দেশের বাইরে, সেখানেও ছোটে অভি। তার আত্বীয়দের কাজে সন্তুষ্ট নয়
সে। বাবার ভিসার আবেদন করেও রীতিমত ঝক্কি পোহাতে নয় তাকে।এরপর আবার মাস খানেক নেই অভি!কাছের
দু-একজন কলেজ বন্ধু ছাড়া কেউ জানে না অভি কোথায়!
অভি ফিরে আসে দেশে। তার বাবা কিছুটা
সুস্থ। অভি মন দেয় পড়াশোনায়।বড় বোনের বিয়ের কথা চলতে থাকে।ওর প্রফের আগে ভাগেই বিয়ে
হয়ে যায় বোনের। কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে অভির মনে।কিন্তু বোন বিয়ের পর দেশের বাইরে
চলে যাওয়ায় বাবাকে নিয়ে বড় একা হয়ে পড়ে অভি।
পড়াশোনায় মন দিতে পারে না, তবুও
চেষ্টা চলতে থাকে ওর। মেডিকেল কলেজের এত্ত চাপ, সেই সাথে পরিবারের নানা সমস্যা আড়ালে
রেখে চলতে থাকে ওর জীবন। কিন্তু স্বস্তির দিন বেশী থাকে না। বাবার মৃত্যু ভীষণভাবে
ভেঙে দেয় ওকে। অভি অসহায় হয়ে যায়!
দুই
তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে।
তার নতুন বন্ধু, রুমমেট এবং ক্লাসমেট শান্ত। দুজনে ভীষণ ভাব। একাকিত্ত ঘোচানোর জন্য
এমন বন্ধুর খোঁজ দিতে অভি রাজী। দুখের দিনগুলো ভুলতে থাকে অভি। চলতে থাকে অভির মেডিকেল
জীবন। এক চান্সে প্রফ পাস করার ভাগ্য খুব কম স্টুডেনেটের হয়। এত হতাশার পরও অভি একের
পর এক ধাপ এগিয়ে আসে।
মন মরা অভির সেখানে কোনদিন ফেসবুকে
আইডি খোলেনি, সব বন্ধুদের পর তার আবির্ভাব হয় ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতে। বছর পার করে
অভি মামা হয়। দূর বিদেশ থেকে ভাগ্নের ছবি পেয়ে উছ্বসিত অভির আনন্দের সীমা ছুঁয়ে যায়
নীল আকাশ।
তিন
এই পর্ব বেশ ছোট এবং অসম্ভব আনন্দের।
ফাইনাল প্রফের গন্ডি পেরিয়ে অভির ফেসবুকে স্ট্যাটাস টা আমার চোখে পড়ে। আমার নিজের কান্না
পাচ্ছিল সেদিন। ওর বাবাকে উৎসর্গ করেছে ওর কৃতিত্ব।এর অনেক পরের কথা অভি গাইনি ওয়ার্ডের
একটি অপারেশন সাক্সেসফুলভাবে শেষ করেছে বেশ আগে। হাতে নিউবর্ন বেবিকে নিয়ে হাসিমুখে
ছবিতুলে ওর পোস্ট ‘আমার প্রথম অপারেশন”
অভি ভাল আছে এখন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন