(১)
ঘড়িতে রাত ১:৩৫।
অন্তু সদ্য ইঞ্জিনিয়ার হয়েই চাকরি টা পেয়েছে। ফ্রেশার বলেই ওর নাইট ডিউটি। মোটের উপর জোর করে রাতের ডিউটি চাপানো হয়েছে।
"না করলে, নেই " মানে চাকরি থাকবে না। অসহায় হয়েই চাকরির জুতোয় পা গলানো। ইমিডিয়েট সিনিয়র যাবার আগে পিঠ চাপড়ে গেলেন, বললেন,' গো অন ' ঘুম এলে ফ্লোরিং!
অবশ্য রাতে না ঘুমানোর অভ্যাস আছে অন্তুর।
আজ অফিসে অন্তু একা। সিনিয়ন নতুন বিয়ে করেছে বলেই চম্পট দিয়েছে। শুধু অফিসের নীচে এক দারোয়ান আছে। অন্তু তার নাম জানে না।
তবে অফিসে ইব্রাহিম নামেই কাউকে একবার ডাকতে শুনেছে।
কয়েকটা ক্লাইন্ট সার্ভ করার পর অন্তু বুঝল ওর ঘুম পাচ্ছে, সচরাচর ঘুম পায়না সেটা আগেই বলেছি। ভাবল একবার ফ্রেশ হয়ে আসি, মুখে পানির ঝাপটা খুব কাজে দেয়। চেয়ার টা ঠেলে অফিস টয়লেটের বেসিনে মুখ ধুঁয়ে, পকেটের রুমাল দিয়ে মুখ মুছে ফের টেবিলে ফিরল অন্তু।
কিন্তু টেবিলে ফিরেই বেশ অবাক, এক কাপ ধোঁয়া ফেলা চা রয়েছে টেবিলে, সাথে কুকিজ!
ক্ষিধেও পাচ্ছিল ওর, একবার এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিল। চা প্রায় শেষ।
ঠিক তখনি, বয়স্ক এক লোক, বেশভূষায় স্পষ্টত
বোঝা যাচ্ছে, সে দারোয়ান; পরণে ইউনিফর্ম। (ভারী গলায় বলল)
স্যার, চা কেমন হইছে?
অন্তু ঘাড় ঘুড়িয়ে বলল, অসাধারণ! জানো এটাই চাইছিলাম। খুব ঘুম পাচ্ছিল জানো।
দারোয়ান জবাব দেয়, জানি স্যার। আরেক কাপ দিমু?
অন্তু এবার না করে। 'না, থাক '।
রাতে ২য় বার আর দারোয়ান আসে না। অন্তু ভোরের দিকে চা খাবে ভেবেছিল কিন্তু তাকে গেটের বাইরে ডেকেও পেল না সে।
সকালে অন্তু টার্ন বুঝিয়ে দেবার আগে তার ইমিডিয়েট সিনিয়র কে রাতের ঘটনা খুলে বলল,
সিনিয়র প্রথমে অবাক-ই হলেন।
পরে অন্তুকে বোঝালেন রাতে এমন কোন দারোয়ান কেন? ওই বয়সী কোন ব্যক্তি এখানে মানে, এই অফিসে থাকেই না।
আর দারোয়ান ইব্রাহিম কখনও রাতে অফিসের আপার ফ্লোরে-ই আসে না।
তাহলে, অন্তুর কি "হ্যালুসিনেশন " হয়েছিল?
(২)
ছোট্টখাট্টো গপ্পো
মেডিকেল ইমারজেন্সি কক্ষ, হর-হামেশাই ভীর। কারো ব্লিডিং, কেউ পা ছিলে ছুটে এসেছে, কারো জরুরী ট্রিটমেন্ট চাই। কোনটা ছেড়ে, কোনটার কথাই বা বলি, সে যাক। এটা দিনের বেলার কথা।
এখন অবশ্য রাত,মাঝরাতেই কাটা ঘড়ি ছুঁয়েছে বেশ আগে।
হাতে কালো অফিস ব্যাগ,সেটাফুলে ঢোল, জ্যাকেট-হাতমোজা জড়িয়ে কেউ একজন ইমারজেন্সি রুমের দরজার দিকে জুতোর ভারী শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে।
এদিকে আসতে আসতে সে হাতের ঘড়িতে সময় দেখল, জ্বলজ্বল করে রেডিয়াম কাটা ১ টার উপর টিকটিক করছে।
লোকটি ডাঃ অভি। সদ্য ডাক্তার।
আজ রাতের ইমারজেন্সি ডিউটিতে শিক্ষানবিশ অভির
প্রথম দিন।
ইমারজেন্সির হালচাল সত্যি বলতে, রাতে খুব একটা পেশেন্ট আসে না। আর যা আসে,তা দেখতে লম্বা সময় কখনোই নেয়া লাগে না, তবে ব্যাতিক্রম তো থাকেই।
অভির আজ প্রথম দিন; আগের বেশ'কিছুদিন শরীরের উপর বড্ড ধকল গেছে।
সাবেক ইউনিটের রেজিস্টার বেশ জাঁদরেল থাকায়, মেডিসিন ইউনিটে কম খাটুনি হয়নি। ভাবল,
"এবার ইমারজেন্সিতে সে ধকলের কিছুটা আশা করি কেটে যাবে"
রুমে ঢুকতেই
(আসসালামু আলাইকুম) স্যার, আসেন। আজকে আপনার ডিউটি?
"হুম (ভারী গলায় অভির জবাব) কোন রোগী এসেছিল এর মাঝে?"
"না স্যার! রাইত্রে রোগী এত আহে না!আক্সিডেন মেক্সিডেন না হইলে পেরায় ফাঁকা! "
আপনার নাম?
নুরুল উদ্দিন।
"আচ্ছা, ঠিকাছে। আশেপাশে-ই থাকেন যাতে, রোগী আসলে আপনাকে পাওয়া যায়।"
কম্পাউন্ডার, মাঝবয়সী। গলায় মাফলার, পড়নে শার্ট-প্যান্ট, গায়ে কালো সোয়েটার। জর্দার গন্ধে অভি বুঝল সে পান খায় আর পান খেয়ে তার মুখখানা লাল করেছে ইতিমধ্যে।
লোকটি রুমের দরজা টেনে চলে গেল।
অভি ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ টা বের করে সেটা অন করল, একা বসে থাকার চেয়ে কিছুক্ষণ গুঁতোগুঁতি করা যাক।
দু'মিনিট পর রুমের দরজায় নক, স্যার, আসুম?
কে?
আমি নুরুল কম্পাউন্ডার, স্যার!
ও, আসেন।
ভেতরে এসেই সে বলল, স্যার চা খাইবেন? (এত রাত হলেও ইমারজেন্সি গেটে মামুন মিঁয়ার বিড়ি-চায়ের দোকান খোলা থাকে)
অভি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়, শুধু লিকার হবে।
জ্বী স্যার বলেই নুরুল মিয়া চলে যায়।
অভি ঘড়ি দেখে, রাত ১ টা ২৭ মিনিট। শীতের রাতে, বিড়ালের পায়ের শব্দ শোনা যায়, ঠিক এতটা নীরবতা।
মিনিট তিনেক পর ফের নক দরজায়, স্যার, আসি?
আসুন (ল্যাপটপ এ মনোযোগ, না দেখেই অনুমতি দেয় অভি)
কিশোর এক ছেলে, ঠিক কিশোর বললে ভুল হবে বলা যায় চেহারায় কিশোর ভাব কিন্তু গলার স্বর যথেষ্ট ম্যাচিউর।
আপনি? নুরুল কম্পাউন্ডার কই?
সে আমাকে পাঠাইছে স্যার। আমি এখানেই থাকি। আমার নাম মুকুল।
ও, আপনি চা চাইছিলেন তো?
হ্যা!
আজকে চা নাই! কফি আনছিলাম।
অভির দিকে ধোঁয়া উঠা কফির কাপ এগিয়ে দেয় মুকুল। (হাত বাড়িয়ে কফির কাপ নিল অভি, সেই সাথে এক নজরে কিশোরের দিকে চোখ বুলাল সে। এই শীতের রাতে, হাফ হাতা শার্ট আর ঝুলঝুলে প্যান্ট পড়ে আছে সে)
অভি কাপে চুমুক দিয়েই বলল, বাহ! বেশ ভালো তো। তুমি বানিয়েছ?
জ্বী স্যার। আপনের ভালো লাগছে?
অসাধারণ! আমার ডিউটি যে ক'দিন, সে কদিন এই কফি চাই। টাকা নিয়ে সমস্যা নেই, পাবে।
কিন্তু স্যার এই কফি তো একরাতের বেশী কেউ খাইতে চায় না!
কি বল! এত্ত ভাল কফি কেউ খায় না?
না স্যার!
নো প্রব্লেম, আমি কথা দিলাম। আমি কফি খাবো। আর এই নাও টাকা।
মুকুল টাকা না নিয়ে বলে, "নুরুল ভাইকে টাকাটা দিয়েন, সে পৌঁছে দিব। আমি এখন আসি"
ওকে, (অভি বলল)
এর মিনিট দশ পরেই চা নিয়ে কম্পাউন্ডার নুরুলের রুমে প্রবেশ, "হে হে.... সরি স্যার, বৌ ফোন দিছিল। তাই, চা আনতে দেরী হইল "
চা? দেরী? তুমি কফি পাঠাও নি?
(নুরুল, চমকে এটা ওটা ভাবে, মুখের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে সে শংকিত)
সে আসছিল?
কে? মুকুল?
হু, স্যার। কোন ডক্টর রাতে একা থাকলে সে আইসা কফি খাওয়ায়।
"ভালো তো " আমার তো কফি খেয়ে ভালোই লাগল।
আচমকা, নুরুল বলে, "স্যার, সে তো মানুষ না "
"মানুষ না মানে? " দিব্যি কফি এনে নিজ হাতে দিল।
স্যার, সত্যি কইতে। নতুন যারা ডিউটিতে আসে, সে তাগোই কফি খাওয়ায়।
অভি এবার ভয় পায়, শীতের তীব্রতা তার শীড়ঁদাড়া বয়ে যায়।
"শুনুন, আপনার আর যাবার দরকার নেই, আপনি পাশের রুমেই থাকুন" অভি বলে।
"স্যার, আমি চায়ের বিল দিয়েই আসতেছি, আপনার ভয় নাই, এই মাত্র দুই মিনিট! " বলেই নুরুল চলে গেল।
অভি জলদি উঠে দরজা ভেতর থেকে আটকে দিল শক্ত করে।
এবার চেয়ারে বসতে না বসতেই, দরজায় নক মুকুলের গলা, স্যার কফি খাবেন না, আরেক কাপ আনছি তো! "
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন