মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০১৬

গল্পঃ অদেখা অনুভব (পর্ব এক)



()
মহিম চুপচাপ, হাটু ভাঁজ করে এখন চেনা নদীটার কিনারে বসে এই বিকেল বেলায় নদীর এপারটায় মাছ ধরার জন্য জেলে ছাড়া আর তেমন কেউ খুব একটা আসে না ওপারে দুটো বাচ্চা শেষবেলায় ঝাপাঝাপিতে ব্যাস্ত
শুধুই একা এখানে
মহিম পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট খুলে একটা অত্যান্ত ম্যাড়মেড়ে বিড়ি হাতে নিল খেতে ইচ্ছে নেই তবুও, দূঃখ্যের জন্য বিড়ির নেশা!

মহিমের আজ মন খারাপ স্ত্রী অনিমার সাথে ব্যাপকতর বচসা হয়েছে বাজার নিয়ে, যদিও বিষয় অতি সামান্য কিন্তু জটিল
মহিম সকালে বেরোয়, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে সারাদিন ব্যাস্ততা, সব শেষ করে বিকেলের আগে যা পায় তাই নিয়ে বাড়ি ফেরে অধিকাংশ সময়ে মাছ পচাঁ থাকে নিয়ে অনিমা অতিবিরক্ত
বেচারা মহিম কি আর করবে?
সকালে স্কুলে ক্লাশ, সেটা বেলা গড়িয়ে দুপুর আবার
বিকেলে টিউশানি করায়, ফিরতে ফিরতে বিকেল থেকে সাঁঝ সময় হয়ে উঠে না একেবারেই!
তাই অবেলায় হাটে মাছ পাওয়া মহিমের জন্য অস্বাভাবিক
 এদিকে, টিউশানি তে ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে ছাড়তে চায় না, "স্যার, এই অংকটা কষে দেন, ওটা তো পারিনা!, তিন নম্বর অংকটাতে তো উত্তর- মেলে না! " আরো কত কি মহিমের সময় মেলে না

এমনিতে মহিম মানুষ হিসেবে অসাধারণ, শারীরিক গঠনে মাঝারি, দেখতে ছিমছাম তার উপর সৎ, বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে সে গনিত শেখায় -পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি ক্লাস ফাইভ টু টেন
একমাত্র স্ত্রী অনিমা, বাড়িতে থাকে
অনিমা বিশেষত  মহিমের বাজার করা নিয়ে বিরক্ত
তবে ইদানিং অনিমার সন্দেহ অন্যদিকে ঘুরেছে, তার ধারনা মহিম প্রেমে পড়েছে
মহিমের সেই প্রেমিকার নাম প্রীতি সে স্কুলের দশম শ্রেণীতে পড়ে দেখতেও মারাত্বক সুন্দরী অনিমা একবার মেয়েটাকে দেখেছে
এদিকে, মহিম সুন্দরের পূজারী, জাতিতে আবার ব্রাক্ষ্মন, তাই এহেন সুন্দরের পূজা করা তার পক্ষে অসম্ভব নয় ব্রাক্ষ্মন বলে কথা!
বাস! অনিমার এই নিয়ে মহিমকে অভিযোগ, মহিমও রাগান্বিত
এই নিয়ে কথাকাটাকাটি দুজনের মহিম ব্যাপারটি বারবার অস্বীকার করলেও অনিমার জেদ, "মহিম সত্যিই প্রীতির প্রেমে পড়েছে! তাই সংসারে মহিমের মন নেই "
অথচ ব্যাপারটা অস্বীকার করছে মহিম!
অনিমার সাথে তাই রাগ করে মহিম আজ সেই যে সকালে বাড়ি ছেড়েছে, দুপুরেও বাড়ি যায়নি, সারাদিনে কিছু মুখেও দেয়নি এখন যদি তাকে স্বয়ং ঈশ্বর এসে খেতে অনুরোধ করে তাও সে খাবার মুখে তুলবে না
অথচ পেটে ক্ষিধের টানে জ্বলছে

হাতের বিড়ি টা নদীর জলে ছুঁড়ে দিতে দিতে মহিম, মুখ দিয়ে অ্যাত্বোক্তি করল মৃদ্যু স্বরে, "ধ্যাততেরিকা! "

অনিমা শুধু শুধু মহিমকে অবিশ্বাস করে, মহিম এমন ছেলেই না! মহিম যে কি পরিমান ভালোবাসে অনিমাকে, অনিমা কি সেটা জানে? জানে হয়ত!
ভাবতে ভাবতে,
দু'বছরের আগের স্মৃতি মনে পড়ে মহিমের, দুপুরবেলা ঘটক এসে মেয়ের প্যাঁচালি পড়ে গেল বাবার কানে কনে সুশ্রী, মাধ্যমিক পাস, সাথে দুটো লেটার
রঙিন একখান ফটো, ফটোতে মেয়েটা চুপচাপ মুখে হাসিটি নেই, মহিম ভেবেছিল,
" আহা! কি ভদ্র, সুশ্রী মেয়ে!
কনের বাবা গত, একমাত্র মেয়ে বাবা নেই, তাই মেয়েটি খুবই নরম স্বভাবের হয়ত "
অবশ্য ছেলে হিসেবে মহিম মোটেই কম ছিলনা মাত্র বিএ পাস করেছে, সাথে সাথে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা, দেখতে উঁচা-লম্বা, নাক অবশ্য বোঁচা তবে বাকী কোন খুঁত নেই, কোন বাজে অভ্যাস নেই
পাত্রীকে পছন্দ পুরো বাড়ির, আরর ওদিকে পাত্রকে পাত্রীপক্ষের তাই আর দেরী কিসের? সে বোশেখেই পাত্রী সম্প্রদান হলো
এখনো সেইদিন,
মহিমের কাছে ফিল্মের রিলের মত ঘুরতে থাকে, অনিমা বাড়ি এসে টানা সাতদিন মহিমের সাথে কথা বলেনি
মহিম ভীষণ অবাক, " রে বাবা, মেয়ে যে বোবা আগে শুনি নি তো! "
কথা অনিমার কানে যেতেই অনিমার চটপটে জবাব, "ব্রত রেখেছিলাম তাই কথা বলিনি!"
"বারে! ব্রত? সে আবার কেন? বরের সাথে কথা নয়! এমন ব্রতের কথা তো শুনি নি! " মহিমের তীর্যক প্রশ্ন,
"বাড়িতে পইপই করে বলেছিল, আমাদের পরিবারে মেয়ের বিয়ে হয়ে সাতদিন, কথা বলা চলা না বরের সাথে, এতে বরের আয়ু কমে! "বলে থেমে গেল অনিমা,
"তাই বুঝি? " মহিম সহাস্যে ফেটে পড়তেই, অনিমা চম্পট
অনিমার সে কথা মনে হতেই, একগাল হেসে দিল মহিম মনে মনে বলল, "যা পারে না, মেয়েটা! "
শুকনো হাসি খেলে গেল মহিমের গালে

রাগী মেয়েটা হয়ত মহিমকে না পেয়ে আজ সারাদিনে কিছু খায়নি!
মহিমের মন আকুল হল অনিমার শুকনো মুখের কথা ভেবে, মহিম সকালে খায়নি, দুপুরে বাড়ি যায়নি দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল থেকে সাঁঝবাতি জ্বলতে শুরু করেছে এখনো, অনিমাও হয়ত কিছু মুখে তোলেনি
মহিম অনিমা কে চেনে, রাগী মেয়েটা অসম্ভব জেদী
কিন্তু বড্ড ভালো
আহা! (মন ভারী হয়ে আসে মহিমের)
আবার ভাবে, থাকুক গে! কি দায় আমার! শুধু শুধু সন্দেহ আমায়, এখন কষ্ট পাচ্ছো না?

মহিম নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না কষ্ট কাগজে লেখা যায় না, কষ্টের ভাষা প্রিয় মানুষটিই -শুধু চোখে চোখ রেখে পড়তে পারে, এর ভাষা আলাদা, এর লেখ্যরূপ নেই
মহিম ভাবে, হয়ত একদিন সে থাকবে না, সেদিন অনিমার কি হবে?
অনিমা মহিমের চোখদুটোর ভাষা কোথায় পাবে?
মহিম সিদ্ধান্ত নেয়, তার চোখদুটো পৃথিবী ছাড়বার আগে অনিমার হাতে দিয়ে যাবে
অনিমা হয়ত কেঁদে বলবে, "চাই না চোখ! "
মহিম হেসে বলবে, "আমি তো তোমার আখিঁতে বেঁচে থাকতে চাই অনিমা "

আচানক! পুরুষালি গলার শব্দ,
"কি মাস্টার? এইহানে সাঁঝবেলায় কি করেন? মন খারাপ নাকি?" জনৈক ব্যাক্তি কথা বলে উঠে
মহিম চোখ তুলে তাকায়, একজন জেলে তার গ্রামের, নাম সুধাংশু, মহিমকে দেখেই সে কথাগুলো বলেছে
"না, এমনি বসে আছি "মহিম জবাব দেয়,
"যাক, এই আন্ধারে তাও মানুষ! আমি তো কি না কি ভাবছিলাম! লগে আবার মাছ!"
মাছের কথা শুনে মহিম উৎসাহী হয়, "কি মাছ?"
"পাঁচটা তেলাপিয়া, কয়ডা কই আর একটা রুই"

মহিম পকেটে হাত রাখে, আজ বিকেলে টিউশানি থেকে টাকা দিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা মাসের শেষ মনেই ছিল না মহিমের, আজ বাজার করার কথা ছিল!
মহিম বলে, "রুই মাছ আর কই গুলা কত হইলে দিবা সুধাংশু?"
"হু, (মাথা চুলকে ভেবেচিন্তে সুধাংশু বলে) রুই টা ১২০, আর কই মিলা ২০০"
মহিম টাকা বের করে জেলের হাতে টাকা দেয়, "এই নেও " আর এখন থেকে সকালে মাছ ধরলে, আমার বাড়ি দিয়া আসবা, টাকা বিকালেই পাইবা "

সুধাংশু, হাসিমুখে টাকা নিয়ে প্রতিনমস্কার জানায় মহিমকে সুধাংশু টাকা নিয়ে গাঁয়ের পথ ধরে

মাছ নিয়ে মহিমও দেরী করল না, দ্রুতগতিতে সেও বাড়ির পথ ধরল যাবার আগে গাঁয়ের বাজার হয়ে বাড়ি যাবে সে

()
উঠোনে বসে অনিমা আঁচলে চোখের জল মুছেছে কয়েকবার, মহিম বাড়ি আসেনি
পরশী বাড়ির বৌ এসে এক ববার জিজ্ঞেস করেছিল "কি গো মেয়েছেলে কাঁদছ ক্যানে? "
অনিমা বলে, "চোখে কি জানি পড়েছে গো"
অনিমা মন খারাপ করে সারাদিন বসে সে নিজেও একদানা খায়নি
অনিমা ভাবে, "আমি হয়ত ভুল বুঝি, এটা ওটা বলি তুমি কেন আমার উপর যেচে রাগ দেখাও? " আমাকে বললে, কেন আমি কি শোধরাতে পারি না? "
সন্ধ্যে বাড়ির ধূপ জ্বালা হয়েছে, বাড়ির উঠোনে কয়েকবার উঁকি দিয়েছে অনিমা, "নাহ! মহিমের দেখা মিলছে না! বাব্বা! এত রাগ? "
ঘরে গিয়ে জানালায় গ্রিল ধরে তাকিয়ে আছে অনিমা, মহিম আসছে না কেন?
অনিমার এখন খুব খারাপ লাগছে

মহিম এসেছে,
মিনিট এক, বাড়ির উঠোনে আঁধারে লুকিয়ে অনিমার ভারী মুখ দেখছে আর মনে মনে বলছে, "দেখেছো, ব্যাপারটা! রাগ দেখাবে আর শেষটায় নিজে কাঁদবে "
মহিম গলায় আওয়াজ তোলে, বাড়ির উঠানে পা ফেলে," অনিমা! অনিমা! কোথায় তুমি? জলদি এসো
দেখো বাজার করেছি কত্তসব! "
অনিমা বাড়ির দোর পর্যন্ত দৌড়ে আসে, (পায়ের নূপুরধ্বনি শোনে মহিম) সেটা দোরে এসে স্তিমিত হয়ে আসে তারপর ঝুমুঝুমু শব্দ করে ধীরে ধীরে মহিমের কাছে এগিয়ে আসে মহিমের কাছে
অভিমানি হালকা গলায় অনিমা বলে, "কে বলেছে বাজার করতে? সারাদিনে খবর নেই! "
মহিম নিঃশব্দ হাসি হাসে, অনিমার রাগ বাড়িয়ে দিতে বলে, "আজ টিউশানি তে প্রীতি ছিল যে! "
অনিমা ঝপ করে মহিমের হাত থেকে বাজার কেড়ে নেয়, " আজ রাতের খাবার বন্ধ "
মহিম হাসে, "মাছগুলো যে পচাঁ যাবে! "
অনিমা রেগে, "পচুঁক গে "
মহিম হেসে উঠে, অনিমাও হাসি লুকোতে পারে না
আজ বোশেখের তারিখ, দু'দিন পর ওদের বিবাহবার্ষিকী মহিম সেটা ভোলেনি
ব্যাগে লাল শাড়িটা অনিমার জন্যই এনেছে মহিম

শুভকামনা, লেখকের কাছ থেকে ভালো থেকো মহিম এবং অনিমা

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...