কাদায় পা দিয়েই পায়ের অর্ধেকটা অদৃশ্য
হয়ে গেল আবিরের,
আরে! একটু সাবধানে ভাই সাব, মেলা ক্যাদা!
দেইখা!
আপনারে কি হেল্প করব?
মুখ তুলে আবিরের জবাব, 'না থাক, আমি পারব,
তুমি শুধু আমার ব্যাগ টা ধর।'
নৌকা থেকে নেমেই পায়ের জুতা হাতে
নেয়া উচিত ছিল, এখন জুতা কাদায় আটকে
গেছে!
জুতা তুলতে গিয়ে এবার বিষম আছাড় খেল
আবির।
পর মুহূর্তেই কিছু মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ
প্রতিধ্বনিত হয়ে নদীর পাড়ের একপাশ থেকে
আরেক পাশে ঢেউ খেলে গেল। হাসাহাসির
বিটকেল শব্দ শুনতে পেল আবির, কেউ বিপদে
পড়লে অন্য মানুষ হাসে এটা নতুন কিছু নয় কিন্ত
এভাবে ফাঁকা নদীর পাড়ে কেউ হেঁসে উঠবে
আবির মোটেও ভাবেনি!
কাঁদা থেকে উঠেই সে দেখতে পেল,
কাছাকাছি পাড়ে বছর কুঁড়ি বয়সের মত হবে
এমন, জন
চারেক মেয়ে আবিরকে দেখে হাসছে। ভীষণ
মজা পেয়েছে ওরা।
রাগে আবিরের কান লাল হয়ে গেল,
মুখ কুঁচকে, চোখের চশমা নাকের উপর জোরে
চাপিয়ে দিল আবির, মাঝিকে কড়া গলায়
বলল,
“ব্যাগ ধরতে এতক্ষন লাগে?”
বিড়ি খেয়ে কালো করা দাঁতের ঝকঝকে
একপাটি দাঁত বের করে মাঝি হেসে দিয়ে
বলল, “আমিতো স্যার আগেই কইছিলাম
আপনারে জায়গা অনেক পিছলা!”
ওকে, বুঝেছি। হাতের ব্যাগ ধর, আমার চলতে
অসুবিধা হচ্ছে!
মাঝি ব্যাগ নিয়ে কাদা পার করে দেবার
ফাঁকেই আরো বার কয়েক আছাড় খেল আবির,
বেচারার আর কি দোষ! এভাবে প্রস্তুতি ছাড়া
কেই বা কাদায় নামে?
স্যার, সাবধানে আহেন, মেলা পিছলা!
না হচ্ছে না, আবির বারবার পিছলে পড়ছে।
কাদামাখা মুর্তির মত বড় বড় পা ফেলে এগুতে
থাকে আবির।
মাঝির তাড়া, 'আহেন, স্যার আহেন '
ফিরতে ফিরতে আরো বার কয়েক হাসির শব্দ
কানে এল আবিরের,
আবির তাকালেই মুখ টিপে হাসছে ওরা....
শুধু ভ্রু কুঁচকে এই হাসি কানে নিল আবির।
'আহেন স্যার, আমার পিছে পিছে আহেন… জুতা
হাতে নিয়া লন, তাইলে আছাড় খাইবেন না '
মাঝির পিছে পিছে চলতে থাকল যথাসম্ভব
ধীরে। নদীর তীরের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা
গাছটা অতিক্রম করতেই আরেক প্রস্থ অট্টহাসি
শুনতে পেল আবির, নাকাল হবার এমন নজির তার
জীবনে নেই!
প্রশ্ন এখন, আবির কে?
এর শুরু অবশ্য অনেক আগে… আবিরের বাবা এই
গ্রামের ছেলে। যা হয়! বিদেশে পড়ার জন্য
আবিরের দাদা তাকে বিদেশ পাঠান কিন্তু
তিনি আর দেশে
ফেরেন নি। কি কারনে? কেন? সে কথা কেউ
জানে না। শুধু বছর চা'রেক পর বাবাকে ছেলে
পত্রমাফিক জানায় বিলেতে সে ভালই আছে
এবং
সে সেখানে বিয়ে করেছে।
ভেঙে পড়েন আবিরের দাদা। নিজের জমি-
জমা বিক্রি করে, ধার দেনা করে উচ্চশিক্ষার
জন্য বিলেত পাঠালেন ছেলেকে, আর ছেলে
তাকেই ভুলে গেল!
বৃদ্ধ বাবা,
ভেবেছিলেন ছেলে দেশে এলে ভাল
চাকরী করবে। বাড়ির জন্য কাজ করবে,
বাবাকে দেখবে। এমনকি, ছেলের জন্য
পাত্রীও দেখে রেখেছিলেন তিনি।
কিন্তু ছেলে ফেরে নি। সুযোগও পাননি শেষ
বয়সে।
আবিরের বাবা মরনঘাতি ব্লাড ক্যান্সারে
মারা গেছেন কিছুদিন আগে।
ছেলে হিসেবে বাবার জন্য কোন দ্বায়িত্ব
পালন করে যেতে পারেননি তিনি। ক্যান্সার
ধরা পড়বার অনেক
আগেই আবিরের মার সাথে তার ডিভোর্স
হয়ে যায়
আবিরের বাবার। সম্পর্কে বনিবনা হয়নি। ভীষন
একা হয়ে পড়েন আবিরের বাবা। ছেলের ভার,
চাকরি এ নিয়ে চাপে পড়ে যান তিনি।
আবির তখন ছোট গ্রেড ওয়ানে পড়ে। মা চলে
যাবার পর বাবা ব্যাস্ত থাকতেন অফিসে।
ছেলেকে সময় দেবার মত সময় ছিলনা তার।
ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন
তিনি। তাই
ছোটবেলা থেকেই বোর্ডিং স্কুলে পড়েছে
আবির। আবির তখনও জানে না, বাংলাদেশের
এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাবার পূর্বপুরুষ এখনো
আছে। নিজের পাপবোধ থেকে মুক্তির সুযোগ
তার ছেলের হাতে তুলে দেন আবিরের বাবা।
মৃত্যুর আগে আবিরকে দিয়ে গেছেন পুর্বপুরুষের
ঠিকানা।
তাই এতদিন পর বাবার ভুল শুধরে নেবার জন্য
আবিরের গ্রামে আসা।
মৃত্যুর আগে ছেলেকে বৃদ্ধ
বাবার কথা বলতেন আবিরের বাবা। চোখের
কোণে ক্ষীন জলের রেখা গড়িয়ে পড়ত তখন।
বাবার না বলা কষ্ট আবির বুঝত। বিদেশের মোহ
বাবাকে একসময় অনেক কষ্ট দিত। নিজের
ছেলেকে কিছু বলতেন না তিনি।
শুধু মনের
কষ্টগুলো আড়াল করে বলতেন বড় হয়ে
দাদুবাড়ী যাবে, দাদুর সাথে কথা বলবে!
"শেয়ার ইউর মাইন্ড " আবিরের হাত শক্ত করে
মুঠোয় পুরে বলতেন কথাগুলো।
আজ আবির পুরোনো সবভুলে তার দাদুবাড়ির
পথে। বাংলাদেশী এক বন্ধুর সাথে গতরাতের
ফ্লাইটে দেশে এসেছে আবির। গ্রামের একটা
ম্যাপ নিয়ে এসেছে হাতে ……
"স্যার, হেহে ভাইসাব একটু সাবধানে আহেন,
রাস্তায় কাটা থাকবার পারে! পারলে জুতা
পায়ে দেন কাটা লাগবো না" মাঝির
সতর্কীকরণ বাণী শুনতে পায় আবির। আগের মত
এবার ভুল করে না সে।
আবির জুতা পড়ে নেয়, মাঝির পেছন পেছন
হাটতে থাকে…
"তুমি চেন তো, ঠিকভাবে? "
জ্বে স্যার, ভালা কইরা চিনি। খালি আহেন
তো...
কাঁচা রাস্তা শেষ করে গ্রামের ভেতরে ঢুকে
পড়ে ওরা দুজন।
আবিরের গায়ে কাঁদায় মাখামাখি। মাঝির
লুংগি কাছা দেয়া এবং হাতে আবিরের
দুটো দশাসই ব্যাগ!
মিনিট সা'তেক পর চলা থামিয়ে, মাঝি
আঙ্গুল দিয়ে একটা বাড়ি
দেখায়, "ওই যে স্যার! ওই বাড়ি!"
চশমা তুলে আবির উৎসুক চোখে এদিক-ওদিক
দেখে। উঠোনটা পরিস্কার ঝকঝকে। কোন
সাড়াশব্দ নেই সেখানে। একচালা বাড়ির
এপাশে-ওপাশে শুন্যতা। একটা ছোট্ট
ছেলেকে পাশের উঠোনে মুখে আঙুল দিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে।
এরই মাঝে মাঝির চিৎকার, "বাড়ির মানুষ কই
গো!, দেহেন ক্যারা আইছে "
বাড়ির ভেতর থেকে একজন বেশ বৃদ্ধ লোক
ভাঙ্গা ভারী গলায় বলল, কে?
মাঝি বলল, "আপ্নেগো বাড়ি মেহমান আইছে!
শহর থাইকা। "নেন স্যার এই আপ্নের ব্যাগ ধরেন!"
বৃদ্ধ লোকটা এগিয়ে আসে আবিরের দিকে,
উত্তল লেন্সের মোটা চশমা তার চোখে,
-কে তুমি বাবা? তোমারে তো চিনলাম না!
-দাদু, আমি আবির, তোমার নাতি!
বিষ্ফোরিত দু’চোখে টলটলে জল আছড়ে পড়ল,
হাতের ভর করা লাঠি ফেলে শীর্ণ দুহাতে
শক্ত করে
বুকে জড়িয়ে ধরলেন নাতিকে। হ্যাঁ, এবার
তিনি চিনতে পেরেছেন নাতিকে।
"দাদাভাই" বলে শশব্দে কেঁদে ফেললেন
তিনি,
-তুই আমারে ছাইড়া যাবি না তো দাদাভাই!
হাছা কইরা ক? যাবি না তো?
-না দাদু আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না!
দাদুর চোখে আনন্দাশ্রু।
আবির বিদেশে ডাক্তারি পড়েছে, সেখানে
প্রাক্টিস করার ভাল সুযোগ ছিল কিন্তু বাবার
কথা মনে করে আর সে বিদেশে থাকেনি।
বাংলাদেশে এসেছে ডাঃ আবির।
দাদুর বয়স ৮০ ছেড়েছে এবার, চোখে কম
দেখছেন, চলতে অসুবিধা তো আছেই। কিন্তু
নাতিকে পেয়ে ভীষন খুশি তিনি। প্রথমে
দেখে নাকি ভেবেছিলেন ছেলে এসেছে
তার! একইরকম চেহারা পেয়েছে তার নাতি।
এতদিন পরে দাদু-নাতি একসাথে। বাবা
বেঁচে থাকার সময় দাদুর কথা বলতেন খুব। আজ
সেই দাদুর সাথে আবির। কত কথা, কত গল্প বলার।
এরই মাঝে বসে গেল দাদু-নাতি।
"বাবা রে, কত ইচ্ছা আছিল পোলাটারে
একবার নিজের চোখে দেখুম! আর পারলাম না।
বৃদ্ধ বয়সে আইসা খালি পোলার চেহারাটা
চোখে ভাসে। বিলেত না পাঠাইলে, গ্রামে
থাকলেও কাছে থাকত!" দাদুর মুখে হতাশার
ছাপ।
"থাক দাদু, বাবা নেই তো কি হয়েছে? আমি
তো আছি। আমিই তোমার সব। বাবা তোমার
কথা খুব বলতেন।"
তোমার মা?
"মা চলে গেছে ছোটবেলাতেই" বলে থেমে
মাথা নিচু করল আবির।
কষ্ট পাইয়ো না দাদুভাই, যা হওনের তা হইয়া
গেছে।
চশমা খুলে বৃদ্ধ দাদুর শীর্ণ হাতের তালু চোখের
জল সরায় কয়েকবার। কান্নার সময় দাদুর মুখের
দিকে তাকিয়ে থাকে আবির।
চোরাবালিতে আটকে থাকা মৃত্যুপথযাত্রী
মানুষের কাছে খরকুটাও সাহস বাড়ায় শতগুন।
আবির এখন সেই খড়কুটো!
ভারী পরিবেশটা হালকা করতে, হাসিমুখের
স্ফুর্তি এনে কথার ঝটকায় ডাকে আবির, শোন
দাদু!
কি দাদুভাই?
আমার ইচ্ছে, আমি এখানেই থাকব। আমি আর
বিলেত যাচ্ছি না।
তা কেমনে হয় দাদুভাই? তুমি বিলেতে মানুষ!
তাছাড়া গ্রামের অজপাড়া জায়গায় কেমনে
থাকবা? আমি তো এমনেই কইছি থাকনের কথা!
না দাদু, আমি সত্যিই থাকব বাংলাদেশে।
আমার কষ্ট হবেনা একটুও।
এই সব একদম ভেবোনা দাদু। আমি ঠিকই থাকতে
পারব।
দাদুর মুখে হাসির ভাজ ফুটে উঠে। কিঞ্চিৎ
নতুন কিছুও ভেবে ফেলেছেন এরই মাঝে। নেও
দাদু, আগে হাত-মুখ ধুইয়া চাইরট্টা খাইয়া নেও।
পরে দাদু নাতি মিলা সব গল্প করুমনে।
হঠাৎ দরজার পাশ থেক ঝন করে একটা শব্দ শুনতে
পায় আবির, কে?
দাদু, বলে উঠেন। ও মনে হয় তিথা!
ও আবার কে দাদু?
"আমার বাড়িতে রান্না করে দিছে আইজ। ও
তো রানতে পারে না। রান্ধে ওর মা। আইজ ওর
মা আসে নাই তাই ও রাইন্ধা দিল।"
দাদু, তিথাকে ডাক দিলেন ভেতরে আসবার
জন্য। "মা, এদিকে আয়। দেখ কে আইছে, আমার
বাড়ি "
তিথা উঁকি দিয়েই দেখতে পায় "এই তো সেই
সাদা ভূত, নদীর পাড়ে কয়েকবার আছাড় খেল "
তিথা কে দেখেও আবিরের চোখ তো
চড়কগাছ!
মনে মনে রেগে আগুন হচ্ছে আবির, আমায়
দেখে হাসাহাসি!
তিথাও একনজরে তাকিয়ে আবিরের মুখে।
(মনে মনে তিথা ভাবছে,'রে বাব্বা, এই পিস
এই বাড়িতে!')
দাদু দুজনের দৃষ্টি বিনিময় দেখে অবাক, দাদুর
মনে প্রশ্ন "ব্যাপারটা কি! "
রাগে গজগজ করছে আবির! খালি দাদু ছিল বলে
নয়ত ধমকে দিত। এভাবে অন্যর বিপদে পড়া
দেখে কেউ হাসে?
বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করতে হয়।
হাসাহাসি করলে সে আরো অসহায় হয়ে পড়ে।
আবিরকে ওভাবে তাকাতে দেখেই ছুটে চলে
গেল তিথা। যেতে যেতে বলল, "দাদু গো
খেয়ে নিও! আমি পরে আসব।"
দাদুর মনে সন্দেহ প্রকট আকার ধারন করেছে।
"ঘটনা কি!" বিশেষ করে, আবির এবং তিথার
দৃষ্টিবিনিময় তার কাছে রীতিমত খটকা
লেগেছে। আবির এলই আজ কিন্তু দৃষ্টি বলছে
আগেও দেখা হয়েছে।
বিকেলে, তিথার সাথে আবিরের দেখা
বাড়ির উঠোনে। আবির তিথাকে দেখেই না
দেখার ভান করল।
কিন্তু তিথা নিজে এগিয়ে এসে বলল,
"ঐ দিনের জন্য সরি, আপনি কিছু মনে করেছেন
কি?"
আবির কড়া গলায়, 'না '।
তাহলে সরি ক্যান্সেল। হিহিহিহি... বলেই
ছুটে চলে গেল তিথা।
আবিরের অবয়বটা দেখার মত তখন, "অদ্ভুত "
অবশ্য,
আবিরের দাদু কাছাকাছিই ছিলেন, আবির
দেখেনি।
ও কথায় কিছু মনে করিস না দাদু, (দাদু মুচকি
হেসে)
'কার কথা দাদু,!' ভ্যাবাচেকা খেয়েছে
আবির।
দাদু হেসে ফেললেন,
হাহা... শোন দাদু, আমার বয়েসও একটা সময়
পঁচিশ ছিল। উত্তরের বাতাস কি করে শীত
ছাড়াও গায়ে লাগে সে আমি জানি। (মুখে
মৃদ্যু হাসি দাদুর)।
তিথা মেয়েটা খুবই ভাল। এবার অনার্স
ফাইনাল দিয়েছে। যদিও খুব জেদী, কারও কথা
শোনে না কিন্তু মনটা বেশ ভাল। সবাইকে
প্রচন্ড ভালবাসে।
আবির মনে মনে বলছে, 'সেরেছে, কি ভাবতে
কি ভাবছে দাদু!
দাদুকে কিচ্ছু বলা যাবে না। আবার কি না
কি বলে! আজকেও 'সরির' বদলে যাচ্ছেতাই বলল
মেয়েটা।
এদিকে দাদুর প্রশংসা চলছে তখনও.... দাদুকে
এখানে কিছু বলা মানেই ফেঁসে যাওয়া।
দাঁড়াও, মেয়েটাকে পাই একবার!
অবশ্য মেয়েটাকে কিন্তু মোটেই খারাপ
লাগেনি আবিরের। লাজুক হাসি আবিরের
মুখে। শুধু 'সরি 'বললেই তো হয়ে যেত। না থাক,
না বলুক সরি। মনে মনে ভাবে আবির।
মেয়েটির গোলাকার হাস্যজ্জ্বোল মুখটা
চোখের সামনে ভেসে উঠে আবিরের।
কেটে গেছে এক মাসের বেশী,
আবির বেশ মানিয়ে নিয়েছে গ্রামের
সাথে। দাদুর মন আজকাল অসম্ভব ভালো থাকে।
প্রেসার টাও নরমাল।
শুধু নরমাল নয় তিথা!
তিথা বুঝতে পেরেছে এ-কদিনে। আবির খুব
সহজে রেগে যায় না। বোকাসোকা
ছেলেরা সহজে রাগে আবার ভুলেও যায়
সহজে। তাই বুঝে শুনে আবিরকে বিরক্ত করে
মাঝে মাঝে। আবিরকে রাগিয়ে ওর ভাল
লাগে। আবির রেগে গেলে তিথার বেশ
লাগে।
সুযোগ পেলেই দিনে একবার রাগিয়ে দেয়
আবিরকে।
এদিকে আবিরও এরই মাঝে গ্রামে ডাক্তারি
শুরু করেছে। দাদু যত্ন করে যাচ্ছে পাশাপাশি।
বাড়িতেই রোগী দেখা চলছে।
একদিন বিকেলে,
চুড়ির ঝনঝন শব্দ পেল আবির, না তাকিয়েই বলল,
ও! তুমি! আজ আবার কি?
কিছু না।
তাহলে?
এমনি!
এমনিতে কেউ আসে না। আজ আবার 'সরি
'বলবে?
কেন?
আবির ফেঁসে গেছে একথা বলে। 'না থাক,
আমি পড়ছি, তুমি এখানে থাকলে পড়া হবে
না।
আমি বাঘ না ভাল্লুক! হ্যা?
("কি রে! কেমন মেয়ে এটা!" মনে মনে বলে
আবির)
আচ্ছা, এরকম করে রাগিয়ে হাসাহাসির
মানে কি? আবির প্রশ্ন করে তিথাকে
আমি তো রাগাই না! বলেই, খিলখিল করে
হেসে ফেলে তিথা।
পাশের ঘর থেকে দাদুর গলা,'কিরে, মা তিথা
আইলি? শুইনা যা একটু! '
হ্যা দাদু, আসি।
থাকো তুমি "সাদা ভূত "
বলেই হাসতে হাসতে চলে যায় তিথা....
আবিরের দিনে দিনে তিথাকে ভাল
লাগছে। আসলে প্রথম দিন মেয়েগুলোর মাঝে
তিথাকে দেখেই ভাল লেগেছে ওর। এক
দেখাতে কাউকে এতটা ভাল লাগতে পারে
আবির ভাবেনি। তবুও গুরুগম্ভীর ভাব দেখাতে
হচ্ছে আবিরকে।
একটুপর তিথা আবার এসেছে, আবির নিজের
ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিল। তিথা এসেছে
বুঝতে পারেনি।
তিথা আবিরকে অন্যমনস্ক দেখতে পেয়ে বলল
'এই যে হাওয়াই মিঠাই, সরি ' শুনছেন!
সম্ভিত ফিরে, কি?
বললাম, সরি।
না ঠিকাছে আমি কিছু মনে করিই নি!
তিথা কি বলবে বুঝল না। শুধু বলল, 'আচ্ছা আসি।'
আবির কি ভালোবাসার চোরাবালিতে
আটকে গেল! হঠাৎ করে কেন যেন সব রাগ এক
পশলা বৃষ্টির মত ঝড়ে গেছে আবিরের মন
থেকে। চুড়ির রিনঝিন শব্দ কানে অনুরণন হয়ে
বাজছে আবিরের।
দাদুও নাতির মনের ভাবাবেগ বুঝেছেন অনেক
আগেই। চুল শুধু বয়সেই পাঁকেনি। শুধু তার মনে ভয়
ছিল নাতি যদি ছেলের মত হারিয়ে যায়!
এরপরের কথার গতির দিকটা কোনদিকে যাবে
সেটা সবাই বুঝেগেছেন হয়ত,
দাদুর ইচ্ছে এবং সম্মতিতে কিছুদিন পরই,
তিথার সাথে বিয়ে হয়ে যায় আবিরের। এখন
প্রতিনিয়ত কাঁচের চুরির রিনরিন শব্দ শোনে
আবির। গ্রামে বিলেত ফেরত ডাক্তার নামে
পরিচিতি পায় আবির।
জীবনে আর কি পাবার আছে আবিরের?
বিকেলে নদীর পাড়ে বসে সুশীতল বাতাসের
ঝাপ্টা, নদীর তীরের ছোট্ট চোরাবালিতে
নিজেকে হারিয়ে ফেলা। গ্রামের শত
মানুষের নদী পাড় হয়ে এপার-ওপার, চলাচল,
কথাবলা সবকিছুর মাঝে নিজেকে ঠিক
অন্যভাবে খুঁজে পেল আবির। এখানে কোন বড়
কিছুর পেছনে অনর্থক ছোটাছুটি নেই, নেই
কোন তড়িঘড়ি। জীবন গুলো চলছে স্বাভাবিক
গতিতে নিজের মতন করে।
অকস্মাৎ খিপ্রতার কোন অধিকার এখানে
খাটে না। শুধু অকস্মাৎ মৃত্যু ছাড়া!
মৃত্যুর মত অকস্মাৎ ঘটনা আর কি -ই বা আছে?
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন