মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৬

গল্পটা সত্যি নয়



কিরে কোথায় তুই?
গলার চিকন কন্ঠে বেশ তীব্রতা, রেস্তোরাঁর
জানালার পাশের টেবিলে বসে আছে
প্রিয়তি। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম বুঝিয়ে
দিচ্ছে অনেক চিন্তিত এখন। প্রিয়তির বাম
কানে শক্ত করে ফোনটা ধরা। বেশ ক'বার
ডায়াল প্যাড চেপে গেছে প্রিয়তি কিন্তু
ফোন ধরেনি পুলক। স্রেফ অলসতা!
পকেটে ফোন থাকলেও সেটা তুলতে আপত্তি
আছে পুলকের!
প্রচন্ড গরমে হাঁসফাস দশা, তবুও পুলক আজ
বেড়িয়েছে। অলস মানুষের কাছে ঘুম অসম্ভব
মূল্যবান। প্রিয়তির কাছে সেটা তুচ্ছ!
পুলক বাসের ভীরে ফোনটা কাঁধে চেপে
দু'হাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরে আছে।
বার ছ'য়েক বেজে যাবার পর ফোন তুলে মৃদ্যু
গলায় পুলক বলল, "এইত আসছি, প্রচন্ড জ্যাম! "
ওপাশে বেশ কড়া সুরে প্রিয়তি,
তোমার টাইম টেবিল সবটা সময়ই মেলে না!!
(ঝপ করে ফোনটা রেখে দিল প্রিয়তি)
রেগে গেলে পুলককে তুমি বলাটা প্রিয়তির
স্বভাব।
পুলক বরাবরই অলস প্রকৃতির, গত তিন সপ্তাহ ধরে
গালের দাঁড়ি পর্যন্ত কামায় নি। স্রেফ অলসতা!
প্রচন্ড ঘুম কাতুরে পুলক, এটাই প্রিয়তির ভীষণ
অপছন্দ!! ক্লাসমেট না হলে ওর খবর ছিল।
প্রিয়তির হুমকি শুনে পুলক মুচকি হাসে, মনে মনে
বলে, 'মেয়েটা পারেও'।
এই অলসতা ব্যাপারটা বাদে, ওদের বন্ধুত্ব একদম
ঝকঝকের পৃথিবীর মাঝে চকচকে উদাহরণ।
গত পাঁচ বছরের মাঝে ঝগড়া শব্দের উপস্থিতি
ছিল না একটুকুও। এর পুরো কৃতিত্ব অবশ্য প্রিয়তির।
মেয়েটির ধৈর্য আছে বলতে হবে।
মামা ভাড়া দেন! হেল্পার ভাড়াত তাগাদা
দিল।
পুলক পকেট থেকে একশ টাকার নোট হাতে
দিতেই ইচ্ছে মত ভাড়া কেটে নিল হেল্পার।
'ভাড়াতো ত্রিশ টাকা! আপনি বেশী
রাখলেন যে? '
মামা, এইটাই ভাড়া, আমরা রেগুলার কাটি!
পুলক বিবাদে বিশ্বাসী নয়। অযথা তর্ক করতে ওর
ভাললাগে না।
তবে এ ব্যাপারটাও প্রিয়তির ভীষণ অপছন্দ,
'নিজের দাবী বোঝে না! ছেড়ে দেব কেন?
হাতেমতাই হয়েছে একটা! '
যে কোন সিদ্ধ্বান্তে পুলক হ্যাঁ কিংবা না
কিছুই বলে না এই নিয়ে প্রিয়তির ক্ষোভ।
জ্যামের চাপে সিগন্যালে আটকে থাকা
বাসের গতি প্রায় শূন্য। গরমে ধাক্কাধাক্কি
করে বাসের ভেতরে সবাই প্রচন্ড বিরক্ত। একজন
তো ধৈর্যের বাঁধ ধরে রাখতেই পারলেন না।
ভাড়া নিয়ে খানিকটা হাতাহাতি হয়ে
গেল হেল্পারের সাথে।
পুলকের দম বন্ধ হয়ে আসছে, এই গরমে থাকা
যাচ্ছে না।
ভ্যাপসা গরমের স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে বেজে
উঠল পুলকের ফোন...
স্ক্রিনে প্রিয়তির নাম, 'হ্যালো! '
কোথায় তুই?
বাসে।
বাসে! কখন থেকে ওয়েট করছি! ভাল্লাগছে
না একদম!
এই আসছি, জ্যামে আটকে আছে গাড়ি।
প্রিয়তি ফোন রেখে দিল।
পুলক বাস থেকে নামবে কিনা এই ভেবে
গেটের পাশে গিয়ে বাসের হাতল ধরল।
হেল্পার চড়া গলায়, 'কি মামা, নামবেন? '
সামনেই নামব। পুলক বলল
খারান মামা, এহনি সিগ্ন্যাল ছাইড়া দিব।
মিনিটের মাঝেই গাড়ি জ্যাম ছাড়ল।
পুলকও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল!
আজকে একটা না বলা গল্পের ইতি টানবে পুলক,
গল্পের শেষটা না টানলেই নয়। অনেকদিন ধরেই
ক্লাসমেট প্রিয়তির সাথে বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব বলে
কাছের সবাইকে নিজের ভালবাসার কথা
লুকিয়ে গেছে। আসলে 'ভালবাসি, বলে
ফেলার পর ভালবাসা কমে যায় ' -পুলকের তাই
মনে হয়। সে করেই নিজের ভালোবাসার কথা
বলা হয়নি প্রিয়তিকে। প্রিয়তি ভীষণ
ভালোবাসে পুলককে।
ওদের এই ভালোবাসা বন্ধুত্বের চাদরে ঢাকা।
কিন্তু কেউ কাউকে মুখ ফুটে বলেনি একটিবার।
এমনিতে প্রিয়তি সোজাসাপ্টা হলেও
ভালবাসায় সবাই মুখচোরা হয়ে যায়।
পুলকের না বলা শুধুমাত্র "স্রেফ অলসতা "!
মামা নামবেন না?
পুলকের ধ্যান ভাঙে।
বাম পা এগিয়ে দিয়েই ঝটপট চলন্ত বাস থেকে
নেমে পড়ে পুলক।
ভার্সিটির উজ্জ্বল ছাত্র পুলক। এক নামে চেনে
সবাই। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এসেই কি এক ভূত
মাথায় চাপে রাজনীতি করবে।
প্রিয়তি বারবার বলেছে এসবে না জড়াতে।
'কি দরকার তোমার এসব করে? '
পুলকের গোলাকার মুখের এক গাল হাসি, 'দেখ,
আমার মত সবাই যদি এগিয়ে না আসে তাহলে
ভাল কেউ করতে পারবে না। ভেবে দেখ, তোর
ছেলেমেয়ে কাকে ভোট দেবে? '
ভ্রু ভাঁজ করে প্রিয়তি জিজ্ঞেস করে,'কাকে?
'
পুলক হেসে, এই আমাকে!
দাঁড়া তোর হচ্ছে বলেই প্রিয়তির হাত ব্যাস্ত
হয়ে যায় পুলকের চুলে।
ছাড়! ছাড়!! মাফ চাই! বলে ধরাশায়ী হয়ে যায়
পুলক।
গত শনিবার, ভার্সিটির এক মিটিং এ
মতবিরোধ দেখা দেয় গ্রুপের কয়েকজন ছেলের
সাথে। ভার্সিটির আশেপাশের কিছু দোকান
থেকে চাঁদা নিয়ে কথা কাটাকাটি।
পুলক কোনোভাবেই এ অন্যায় দাবীতে রাজী
হয়না। জুনিয়র-সিনিয়র অনেকেই নাখোশ হয়ে
সেদিনের মত বৈঠক শেষ করে চলে যায়। তবে
পুলক বুঝতে পারে এরা কেউ সভাপতি
হিসেবে পুলকের এই সিদ্ধ্বান্তে খুশী নয়।
একটা কাচারাস্তার গলিতে এসে পড়েছে
পুলক। জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করে
ডায়াল করে প্রিয়তির ফোনে,
কোথায় তুই?
আমি অরন্য কানন রেস্তোরাঁয়। তুই এসেছিস?
হ্যাঁ, কাছাকাছি।
আচ্ছা, তোর জন্য কি আনবোরে?
হিহিহিহি...
তোর যা ইচ্ছে,
শব্দহীন হাসি হাসে পুলক।
হঠাৎ দেয়ালের পাশের গলি থেকে দুটো
ছেলে এসে জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া আপনি
পুলক?
পুলকের কানে তখনও মোবাইলটা ধরা।
হ্যাঁ। কিন্তু কে...
'কেন ' বলার সময় দেয়নি ছেলেদুটো!
এক রাউন্ড করে দুজনে দু'রাউন্ড শেষ করে দেয়
পুলকের বুকে।
হাতের ফোনটা তীব্র বেগে আছড়ে পড়ে
একটা ইটের টুকরোর ওপর। ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়
এক মুহূর্তে!
ছেলেদুটো দৌড়ে সরে পরে বুলেট গতিতে।
পুলকের নীলচে শার্টে দেখা যায় কালো
ছোপ।
রেস্তোরাঁয় ব্যাগ ফেলে রাস্তায় ছুটে আসে
প্রিয়তি। গুলির শব্দে বোবা কান্না চেপে
ছুটে এগিয়ে আসতে থাকে পুলকের খোঁজে।
কিছুক্ষণ আগের শুনশান নীরবতায় ভরা রাস্তা
মানুষের কোলাহলে ভরে যেতে সময় নেয় না।
কেউ পুলকের সাহায্যে এগিয়ে আসে না।
পুলকের শেষ নিশ্বাস কখন নেয়া হয়েছে কে
জানে?
ভীরের উৎসে ছুটে আসে প্রিয়তি। ভীর ঠেলে
পুলকের নিথর দেহ দেখতে পায় সে।
পুলকের দেহে আর প্রাণ নেই। নিজের গল্পটা
আর বলা হলো না প্রিয়তিকে!
প্রিয়তি বোকা ছেলেটা তোকে প্রচন্ড
ভালবাসে।
এটাও "স্রেফ অলসতা "
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...