বাবা,
লাল রঙের শাড়িটা কিনা দিবা?
মগেন
মিত্র চাপা হাসি দিলেন। মা রে! এইটার অনেক দাম। এইটা কিনা যাইব না।
মণিমালা
মুখ কালো করল ঠিকি কিন্তু কি একটা ভেবে আবার বলল।
থাক
বাবা! ওইটা লাগব না। তুমি তো আগের বছরের পূজা তে ই আমারে লাল জামা টা কিনা দিসিলা।
এইবারেও পূজা তে ওইটাই পড়মু।
মগেন
দূঃখ্য পান, দরিদ্র হওয়ার পাপ আর তার ই কালো ছায়া পড়ছে একমাত্র মেয়ের উপর।
দিন
মজুরি করে এবারে পূজোর আগে পকেটে ভাল জমে নি। জমিতে ফলন ভাল হয় নি পোকার আক্রমণে।
যা হয়েছে তার বেশীরভাগ বিক্রি হয়েছে নীচু দামে।
বৌ এর
একটা শাড়ি, মেয়ের জন্য জামা। নিজে না হয় নাই নিলেন কিন্তু এবারে পকেটে এত টান
পড়েছে যে বৌয়ের শাড়িটাও কেনার সামর্থ্য নেই। হাজার টাকার শাড়ি কিনতে গেলে মাসে
কয়েক দিন দুবেলা আহার ও হয়ত হবে না।
তাই বাড়ি
থেকে যদিও বৌয়ের নিজের শাড়ির আবদার টা নেই তবুও পইপই করে বলে দিয়েছে মেয়ের জন্য
অন্ততপক্ষে একটা জামা কিনবা।
মণিমালা
বয়েসে ছোট, তবুও বাবার চোখের অভিব্যক্তি ভাল করে বোঝে।
বাবার
পকেটে টাকার টানাটানি, সামনে স্কুলের ফি। তাছাড়া খাওয়াদাওয়া, বাড়ির জন্য খরচ তো
আছে।
না বাবা!
লাল জামা টা ভাল না।
আমারে
ঐটা কিনা দাও!
মগেনের
মন আবারো ভারী হল। মেয়েটা তার বড় মেধাবী। স্কুলে সব পরীক্ষায় প্রথম হয়। সেদিন হাট
থেকে ফেরার পথে স্কুলের অংকের শিক্ষকের সাথে দেখা। মগেন কে পেছন থেকে তিনি নিজেই
ডেকে থামালেন।
ওহে
মিত্র! কেমন আছেন?
পেন্নাম
স্যার! ভাল আছেন?
ভাল
ভাল.. তোমার মেয়ের কথা বলছিলাম!
কেন? সে
কি করেছে?
আরে না
না! কিছু করেনি আবার করেছে
মগেন
একটু রেগে, কোন বেয়াদবি?
আরে না!
সে পড়াশোনায় খুবই ভাল। বাড়ির কাজ দিয়েছিলাম খুব ভালো মতই সে করেছে। অংকে তোমার
মেয়ে তো বরাবরি খুবই ভাল। বড় মেধাবী মেয়ে তোমার!
মগেন খুব
খুশী। করজোড়ে আবার শিক্ষকের হাত দুটো ধরে বললেন, " একটু দেখবেন স্যার! "
অবশ্যই! অবশ্যই!
মগেন এবং
মণিমালা বাড়ি ফিরছে। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে গ্রামের পথে। রাস্তাঘাট অনেক টা
ফাঁকা। হঠাৎ তিন-চার জন ওদের পথরোধ করে দাঁড়ায়।
কে?
(আঁতকে উঠেন মগেন, গলাটা ভয়ে শুকিয়ে আসে। বাবার হাত চেপে ধরে মনিমালা)
বাবা!
ওরা কারা?
মগনা
নাকি? আমার ধারের ট্যাকা কই? পূজায় ফূর্তি করবা আর ধারের টাকা দিবানা? (মিচমিচে শয়তায়ের মত হেসে উঠে পাশের দুজন,
অন্ধকারে চোখদুটো শেয়ালের মত জলে উঠে ওদের)
দিমু
ভাই! দিমু! আর দুইটা দিন পর ই দিমু! ( ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে মগেন)
মণিমালা
বাবার হাত টা জড়িয়ে আছে প্রচন্ড ভয়ে।
আইচ্ছা,
আর মাত্র দুইদিন!
অষ্টমী
তে শাড়ি পড়বে বলে মণিমালা বায়না করেছে। মগেনে স্ত্রী ট্রাংক থেকে শাড়ি টা বের করে
নিজে পড়িয়ে দিলেন। মণিমালার খুশী আর দ্যাখে কে!
মণিমালা
যেতে না যেতে মগেন মিত্র ফিরে এলেন বাজার থেকে, দিন দুয়েক পড়ে ভাসান। মেয়েটা কে
কিছুই দেয়া হয় নি এবার।
বৌয়ের
হাতে লাল জামা টা চুপিচুপি দিয়ে বললেন, ভাসানের দিন দিও মাইয়া টারে। আশা করছিল
খুব! পকেটে টাকা আছিল না। মহাজনের কাছে কর্য নিলাম। আগামী মাসে দিয়া দিমু। বৌ জামা
টা ট্রাংকে তুলে রাখল। ভালোই করছো! একটা ই তো বড় পূজা। মগেন ও হাসল।
ভাসানের
দিন জামা পেয়ে মণিমালার যে আনন্দ!
বাবা!
বাবা! করতে করতে সে কতবার সে উঠোনে
ছুটোছুটি করল তা আর দ্যাখে কে!
আমার
বান্ধবী গো দেখাইয়া আসি?
আইচ্ছা
যা! জলদি ফিরা আসিস। আমরা একলগে ভাসানে যামু।
আইচ্ছা
বাবা!
বাংলাদেশের
সীমান্তরেখা। ভাসানের দিন দুই বাংলা এক হয়। আজো হয়েছে। অনেক ভীড়। মেলা বসেছে।
প্যাঁ পোঁ শব্দের নানা খেলনা দিয়ে হরেক দোকান সেজেছে। খাবারদাবার, মিষ্টি ছড়াছড়ি।
মগেন আর তার স্ত্রী ভাসানে এসেছেন। মগেনের ভাই ওই বাংলায় থাকে। এই দিনেই একবার
দেখা করার সুযোগ হয় দুই পরিবারের।
মেয়েটা
কই?
মগেনে বৌ
জবাব দেয়, বাড়ি ই তো আসে নাই সে।
এদিকে
ভাসান শুরু হয়ে গেছে। হইচই, হট্টগোল বাড়ছে। এর মাঝখানে একটা ছোট্ট ছেলে এসে মগেনের
হাত ধরে নাড়া দিল কাকা! শোনেন!
ছেলেটিকে
চিনতে পারেন নি মগেন, তবুও তার ইশারা দেখে পিছু নিলেন।
কাদাজল
পেড়িয়ে নদীর জলে ভাসতে থাকা লাল জামা পড়া কালো চুলের একটা কিছু সে ছেলেটি আঙুল
দিয়ে দেখিয়ে দিতে না দিতেই মগেন চিৎকার করে হাউমাউ শব্দে কেঁদে নদীতে ঝাঁপ দিলেন।
মণিমালা!
মণিমালা! মা রে!
একজন,
দুজন করে লোক জমে গেল দেখতে দেখতে। মগেনের বৌ ছুটে এসছে পড়িমরি করে। মগেন মেয়ের
মৃতদেহ নিয়ে পাড়ে উঠে এলেন। মেয়েকে ওরা বাঁচতে দেয় নি ওরা। লাল জামাটা পশুর মত
ছিঁড়ে ফেলেছে শুয়োরেরা!
( গল্পের ঘটনা ও চরিত্র
সম্পূর্নভাবে কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। মিলে গেলে সেটা
পুরোপুরি কাকতালীয়)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন