মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

গল্পঃ রিভেঞ্জ

স্বপন মিঁয়া হোটেলে কাজ করেন। রোজ ই চুলার পাশে কাজ করতে করতে অভ্যাসী হয়ে গেছেন রীতিমত! সকালে পরোটা, আলুভাজা, শিঙাড়া, সমুচা। দুপুর হলে ই ভাল, মুরগি, সবজি, সালাদ, মাছ। রাতেও একই আইটেম ঘুরেফিরে চলতে থাকে।
স্বপন মিঁয়ার বাড়ি বগুড়া। মালিক বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে স্বপন বলে, " মোর বাড়িত কেউ থাকে না "। মালিকের এতে কিছু যায় আসে না। ঢাকা শহরে হোটেল ব্যবসা সুবিধার না। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম চড়া, তার উপর রান্নার মানুষ পাওয়া সমস্যা। রান্না খারাপ তো কাস্টমার নাই! কাস্টমার নাই তো ব্যবসায় লালবাত্তি।
আসলে হোটেল মালিক স্বপনকে বিশ্বাস করেন না। নাহ, টাকা পয়সা নিয়ে না। ওর অন্য সমস্যা।
হোটেল টা বেশ বড় নয়। আর সাধারণ হোটেলের মত। পেছনের দিকটায় রান্নাঘর, সামনের দিকে কাঁচের দেয়াল ঘেরা ক্যাশ। পনেরো বিশটা টেবিল আছে হোটেলে। পেছনের দিকে আছে বেরোনোর পথ। যেখানে থাকে ওয়াসার পানি ভর্তি ড্রাম। হোটেলে রান্নার পানি এই ড্রাম থেকে ই আসে।
ওস্তাদ ডানের টেবিলে দুইটা ডিম পোচ, ভাত আর ডাইল! বলে হাঁক ছাড়ল সেন্টু। সে এই হোটেলের হোটেল বয়। বলতে গেলে খুব ই বিশ্বস্ত। আজকালকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায় না। নিশ্চিন্তে ক্যাশে বসিয়ে দেয়া যায় সেন্টুকে। একটা পয়সা এদিকওদিক করে না। সেন্টুর বয়েস ১৫, হ্যাংলা পাতলা গরন। গায়ের রঙ শ্যামলা, চুলগুলো কোঁকড়াটে।
হোটেল মালিকের ফোন আসে। কাস্টমারের ভীড় আজকে মনে হয় একটু বেশী। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার ভীড় বেশী থাকে বাস স্টান্ডে। লোকে ঠাসা এই ঢাকা শহরে কোথায় কবে না ভীড় কম হয়েছে।
সেন্টু সিরিয়ালি কাস্টমারের বিল বলতে থাকে, " সাদা শার্ট চল্লিশ, ব্যাগের আপা পঁয়ত্রিশ, বুড়া আংকেল দশ "
বুড়া আংকেল বলতে ই ভদ্রলোক রেগে গেলেন হালকা, " আমাকে কি দেখে বুড়া মনে হয়, মাথায় আবুল হায়াতের মত চুল দেখে?"
সেন্টু লজ্জিত চোখে জ্বিভে কামড় দেয়, ভুল হইয়া গ্যাছে স্যার!
মালিক বিল তুলে ফোন ধরে, ব্যবসায়ী সমিতিতে ডাক পড়েছে তার। সেন্টুর কাছে ক্যাশ ধরিয়ে তিনি তার বাইক নিয়ে চলে গেলেন ধোঁয়া তুলে। সেন্টু এই সময় টা নিজেকে অনেক বড় মনে করে। মালিক তার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। এমন মালিক হয় না। বেতন দেন টাইম মত, খাবার দেন রেগুলার, পোষাক-আষাক সব ই ঈদের আগেভাগে দিয়ে দেন।
মালিক চলে যেতে না যেতে হোটেলের রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে স্বপন। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি সেটা ভিজে সপসপে হয়ে, কোমরে রঙচটা গামছা বাঁধা, সাথে থ্রি কোয়াটার। স্বপনের বড়ির প্রশংসা করতে ই হয়। প্রত্যেকটা মাসল দেখা যাচ্ছে গেঞ্জির ভেতর আর বাইরে।
সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্বপন নীচু গলায় বলে, " কি রে হালা? বইয়া পড়ছস ক্যাশে?" একটা খ্যাশখ্যাশে হাসি হাসে স্বপন। ডান হাতে সিগারেট ধরে বাম ডান টা সেন্টুর দিকে এগিয়ে দেয় সে। "টাকা দে তো দুইশ! দে তাড়াতাড়ি "
সেন্টু হালকা ভয় করে স্বপন করে, বলে " স্বপন ভাই, মজা কইরেন না। যান তো কামে যান!"
স্বপন রেগে যায়, খুব জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় সেন্টুর গালে। ভরা দোকান কাস্টমারের সবাই প্রায় অবাক হয়ে তাকায় ওদের দুজনের দিকে। সেন্টু গালে হাত দিয়ে চুপ হয়ে যায়। স্বপন তাড়াতাড়ি ঢুঁকে যায় রান্নাঘরে।
সেন্টু ক্যাশে বসলে ওর ছোটভাই বয়ের কাজ করে। সে স্কুলে যায়। সকালে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রি তে পড়ে সে।
স্বপনের একটা বাজে অভ্যাসের কথা এই হোটেলে সবাই জানে। সে উঁকি দিয়ে কাস্টমারদের দেখে। রান্নাঘর থেকে উড বোর্ডের দেয়ালের ফুটো দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে মাঝেমাঝে। বলতে গেলে প্রায়শই দেখতে থাকে।
মালিক ব্যাপার টা জানেন, তবুও এতে কাস্টমার কেউ জানেন না কিংবা লক্ষ্য করেন না এসব ভেবে আর তিনিও বাড়াবাড়ি করেন না। যদিও এটা নৈতিকতার মারপ্যাঁচে আটকে।
সেন্টুর কাছেও এসব ছ্যাঁচড়ামি পছন্দ না। সেন্টুর ইচ্ছে সে একদিন মালিকের ডান হাত হবে। শোনা যাচ্ছে মালিক সামনে নাকি আরো দু একটা দোকান দেবে। মালিকের খুশীমত চললে হয়ত সেই দোকানের কোন একটায় সে সেলস ম্যান হতে পারে। তার ইচ্ছে একদিন সে একটা বাইক কিনবে। কিন্তু এই হোটেলের ক্যাশে পার্মানেন্ট করলে সে প্রথমে ওই স্বপন কে তাড়াবে। মনেমনে রাগে গজগজ করে সেন্টু।
সেন্টুর একজন পছন্দের মানুষ আছে। সে তার ছোট ভাইয়ের প্রাইমারি স্কুলে ই পড়ত কিন্তু এবার ক্লাস ফাইভ থেকে সে সিক্সে পড়ছে। বিকেলবেলা মেয়েটি যখন ঠিক প্রাইভেট থেকে ফেরে ঠিক তখনি সেন্টুও মেয়েটিকে তার বাড়ির গলি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। দুজন ঠিক দুদিকে থাকে সেন্টু রাস্তার এপাশে আর মেয়েটি অন্যপাশে। যাতে কেউ ঠিক করে বুঝতে না পারে। মেয়েটির বাবা কে, মা কে কিংবা পরিবারে আর কে আছে সেসব কিন্তু সেন্টু জানে না। ও বলে, " জাইনা আর কি করমু! যেদিন বড় হমু যেদিন দুইজনে বিয়া করমু সেদিন জাইনা নিমু "
হোটেলের ভীড় আজ কমে না। মালিক ও আজ আসেনি। তাই সেন্টুও মেয়েটির সাথে দেখা করতে যেতে পারে না। হোটেলে ক্যাশে কাটাতে হয় সেন্টুকে।
স্বপন আবার আসে।
হোটেল এই রাতে একটু ফাঁকা।
স্বপনের হাতে টুথপিক, সেটা দিয়ে সে খিলাল করতে ব্যস্ত আরো ব্যস্ত আড়চোখে একজন নারী কাস্টমারের দিকে। নারী কাস্টমারের সাথে লাগেজ। সম্ভবত কোথাও যাবেন বা কোথাও থেকে এসেছেন। স্বপন তার চোখ দিয়ে গিলতে থাকে বাজে ভাবে।
সেন্টুর এবার রাগ উঠে যায়। স্বপন কে বলে, " স্বপন ভাই! পানি ভরো ড্রামে। কাইল্কা পানি থাকবো না সকালে"
স্বপন বিরক্ত হয়। একটা হাত উঁচিয়ে ধরে চড় মারবে বলে কিন্তু থেমে যায় কারণ নারী কাস্টমার এখন ক্যাশের কাছে। তার গায়ের পারফিউমের গন্ধ স্বপনের ইন্দ্রিয় নাড়িয়ে দেয়।
সেন্টু রাগে গজগজ করতে থাকে, কিন্তু এবার একটা বাজে ইঙ্গিত করায় সেন্টু আর থামাতে না মেজাজ।
" ভাল হইয়া যাও স্বপন ভাই!"
স্বপন রেগে যায় ভয়াবহ। নারী কাস্টমার একা, তিনিও এই ঝামেলায় না গিয়ে লাগেজ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন হোটেল থেকে।
এরপর লাগল মারামারি, সেন্টুর নাকে ঘুষি বসিয়ে দিল স্বপন। পরিস্থিতি সামলাতে হোটেলের বাকী সবাই ছুটে এলো। মালিক এলেন রাত ১১ টায়। শাসালেন দুজন কে। তার হোটেলে এইসব চলবে না। এমনিতে ই হোটেলে লস চলছে।
এরপর সব ঠিকঠাক চলে, সেন্টু বাচ্চাছেলে কিন্তু প্রচন্ড রাগ। কয়েকদিন ক্যাশে বসেনি সে। মালিক নিজে ই ছিলেন।
সব ঠিকঠাক ই চলছিল কিন্তু একদিন সেন্টুকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই সন্দেহ করল এতে স্বপন কিছু করেছে। সেন্টুর ছোটভাই ও জানাল আগেরদিন বাইরে যাইতাছি বলে ওর ভাই রাতে বাইরে যায় এরপর আর ফেরে নাই। পুলিশ আসে।  সবাইকে জেরা করে।
কিন্তু ঘটনাটা যেদিন ঘটল সেদিন, ড্রাম থেকে পানি ভরছিল হোটেলের বুয়া। সে সকালবেলা থালাবাসন ধুঁয়ে দিয়ে যায়। প্রথমে ট্যাপ খুলে সে গন্ধটা পায়। পরে ড্রামের ঢাকনা খুলে " বাবাগো.. মাগো.." বলে বেড়িয়ে আসে।
লোকজন সকালে দাঁত ব্রাশ করছিল, তারা ছুটে যায়। গিয়ে দেখতে পায় সেন্টুর লাশ ড্রামের ভেতর।
নিঃসন্দেহে গ্রেফতার হয় স্বপন। মালিক ব্যাপার টা ধামাচাপা দিতে টাকা খরচ করেন পুলিশে। স্বপন কে কোর্টে চালান দেয়া হয় তার চৌদ্দ বছরের জেল হয়। হোটেলে নতুন লোক আসে। সেন্টুর ভাই কে নতুন বয় করা হয়। সে ক্যাশেও কাজ করছে বিশ্বস্ততার সাথে। সব ই মিটমাট।
রাতে ব্যবসায়ী সমিতির মিটিং শেষে বাড়ি ফিরছিলেন হোটেলের মালিক। রাতের ব্রেকিং নিউজ টা তিনি হয়ত টিভি তে দ্যাখেন নি। বাইকে তেল না থাকায় আজকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু থমকে গেলেন তিনি।
আঁতকে বললেন, " স্বপন! তুই?"
স্বপন বিল্ডিং এর ছায়াতে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার এগিয়ে একটু আলোতে এল তার চোখ দুটো দেখতে পেল মালিক। ভয়ার্ত গলায় বলল, " তুই এখানে?  তোর না.. "
জেলে থাকনের কথা? তাই না..বলেই একটা গালি দিল স্বপন।
" তুই জানস আমি খুন করি নাই, হ আমার বদস্বভাব আছে ঠিকি কিন্তু কাউরে খুন আমি করতে পারি না। " বলে থামল স্বপন।
ওহ! এইসব কি বলছিস স্বপন? খুন তো?
আমি করি নাই। তুই করছিস বলে আবারো গালি দিল স্বপন। এরপর বলল, আমি সেইদিন ওরে মারার পর বুঝছিলাম আমার ভুল হইসে। এই কাজগুলা খারাপ। আমিও তওবা করছিলাম আর এইসবে যামু না। তাই হোটেল বন্ধ হওনের পর আমি সেন্টুর বাড়ির কাছাকাছি সেন্টুর জন্য অপেক্ষা করতাছিলাম। ও আইলে ওর কাছে মাফ চামু। ওরে দেখলাম ও গলিতে আইতে। পরে দেখি চার পাঁচজন ওরে আচমকা ঘিরা ধরসে। প্রথমে ভাবছি ওর পরিচিত কিন্তু যখন কোপ টা দিল আমি দৌড় দিলাম। ধরতে পারলাম না কাউরে সেন্টুরে জড়ায়া ধরলাম তাড়াতাড়ি। গলার একদিক টা ঝুলে পড়সে। সেন্টু খালি কইল সেই মেয়েটা স্বপন ভাই!
আমিও আর কিছু করতে পারি নাই। ওরে হাসপাতালে নিতে পারি নাই। লোকজন আসতে দেইখা আমি পলাইয়া যাই। যেইটা আমার ভুল। কিন্তু সেন্টু কোন মাইয়ার কথা কইছে আমি বুঝি নাই।
পরে ওর ছোটভাই যখন কইল। এইটা সেই মাইয়া, যে মাইয়া কে সেন্টু পছন্দ করতো। আপনি জানতেন আমি এই খুন করি নাই। আপনারে কত ভাল ভাবসিলাম আর আপনে?
হোটেল মালিক এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি এবার বললেন " আগে তো রান্না করতি, এখন কি নাটক ও করবি ফকিন্নি? তুই তো.. " কথা আর শেষ করতে পারেন না মালিক। তার পায়ে  দৃঢ় হাতের কোপ পড়ে, তিনি হাটুগেড়ে বসে পড়তে না পড়তে এবার ঘাড়ে কোপ পড়ে "
পেছন থেকে সামনে আসে সেন্টুর ছোটভাই। হাতের চাইনিজ কুড়ালে তখন গরম রক্ত।
" মেয়েটা আপনার বোন মালিক, আপনি না করতে পারতেন আমার ভাইরে না মাইরা তো বুঝাইতে পারতেন! "
হোটেল মালিক হাত উঁচিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন।
ধপ করে মুষড়ে পড়লেন পিচের রাস্তায়।




(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ন কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত ও অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...