শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

গল্পঃ মুখাবয়ব

ইদানীং মেয়েটি বড্ড জ্বালাচ্ছে, কোথায় ফোন নম্বর পেয়েছে জানি না। সময়-অসময়ে তার ফোন, মেসেজ করা চাই। প্রচণ্ড জ্যামে যখন নাভিশ্বাস ঠিক তখনি পকেটে ঝড় তুলে তার ফোন।
এইতো সেদিন, ভীড়ের মাঝে থেকেও ফোন বের করতে পকেটে হাত পুরেছি কি পুরিনি! পাশাপাশি দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক একটি কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এরই কাগু! আন্নে কোণাই ছুঁই দিয়েচেন?
দ্রুততম সময়ে হাত সরিয়ে বুঝলাম ভদ্রলোক আমার ডান দিকে গা ঘেঁষে পেছন ফিরে ছিলেন। টাচ টা সম্ভবত তার পেছনে ই করেছি ভুলে।
একদিন তো রাগ করে ই ভাইব্রেশন অন করেছিলাম। বাসের ঠেলাঠেলি প্রতিদিনের মতন সেদিন ও। ভাইব্রেশন করতে ই এক মহিলা রেগে গেলেন!
আরে পাইসেন কি? মহিলা দেখলে ই হুশ থাকে না? বাড়িতে মা-বোন নাই?
উনাকে তখন কিভাবে বোঝাই, যিনি ফোন করেন অবিরত তার কোন কমন সেন্স নাই।
মেয়েটির চেহারা দেখিনি, এক বন্ধুর বিয়েতে নাকি সেই আমাকে দেখেছে। তাতে ই তার পছন্দ আমাকে। কি অদ্ভুত খেয়াল! মানুষের ভালোলাগার আসলে কোন মানে হয় না।
একদিন খুব রাগ করলাম, বকে দিলাম।
পরের দিন ফোন দেয়নি, কিন্তু এস এম এস করেছিল, ঠিকমত অফিসে গেছি কিনা। মেয়েটির উপর এত্ত বিরক্ত ছিলাম যে অফিসের ক্লোজিং হিসেবে গড়মিল করে বসলাম ভুলে। বস খেপে গেলেন, আমিও ক্ষুদ্ধ!
চাকরী টা গেলো না, সিনিয়র এক বড় ভাই ছিলেন বলে।
সেই থেকে এখন মেয়েটি আর মেসেজ করেনি, ফোন ও করেনি। মেয়েটির নাম জানিনা। ফোনে সেইভ করা নম্বরটির টাইটেল ছিল " ফাজিল "।
এক মাস কেটে যেতে মনে খুতখুত করল, ভাবলাম কল করে একটা খোঁজ নেই। কিন্তু নম্বর টা বন্ধ পাওয়া গেলো। ওপাশ থেকে যন্ত্রিক গলায় মহিলাটি বললেন, " এই নম্বরে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না "।
এখন আরো খারাপ লাগা শুরু। মেয়েটির ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না। ভাল করে কোনদিন কথাও বলিনি। এই হয়, যাদের কে হেলায় দূরে ফেলি তাদের গুরুত্ব অনেক দেরীতে হলেও আমরা টের পাই কিন্তু তখন আর সুযোগ হয় না।
ফোন নম্বরের মালিক খুঁজতে বেশ কাঠখড় পোড়ালাম। এক বন্ধু ছিল একটা মোবাইল অপারেটর কোম্পানি তে, নম্বর টা অন্য অপারেটরের। তবুও সে ম্যানেজ করল।
কল হিস্টোরি ও পেলাম অফ দ্যা রেকর্ডে, তাতে কেবল আমাকে ই কল করা হয়েছে প্রায় ৪০০ এর কাছাকাছি। মেয়েটি হয়ত পাগলি, এখন তাই অভিভাবক ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন। মেয়েটির নাম বলছি না, ধরুন "S" সেই মেয়েটির ঠিকানা ধরে একদিন বেড়োলাম। পেয়েও গেলাম।
একটি একতলা বাড়ি, তার সামনে ছোট দোকান, সেখানে জিজ্ঞেস করতে ই জানলাম মেয়েটির ব্রেইন ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। দোকানে তার পরিবারের বেশ টাকা বাকী বলেও দোকানী আক্ষেপ করল। আমি হতবুদ্ধের মতন মিনিট পাঁচ দাঁড়িয়ে থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিলাম।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল তাই অনিচ্ছ্বা সত্ত্বেও একটি সিগারেট খেয়ে সেই হাসপাতালে গেলাম।
মেয়েটির চেনা কেউ নই, দুড় থেকে দেখলাম মেয়েটি বেডে শুয়ে হাতে ক্রানুলা, নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। চোখের তলায় কালি। মেয়েটি কে দেখে ভীষণ কান্না পেলো। চোখের কোণা আপনা আপনি বর্ষার নদীর মতন অনুভূতির ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল।
আচমকা টের পেলাম আমার পেছনে কেউ বাম হাতের কনুই টা চেপে ধরেছে। ঝাপসা চোখে দেখলাম একজন বয়ষ্ক ভদ্রমহিলা, উনি বললেন, " তুমি ই রঞ্জু?"।
আমি বললাম হ্যাঁ।
ও আর বেশীদিন নেই! কথাটা বলেই ভদ্রমহিলা মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালের কেবিনে আমার কপাল ঘেমে উঠল। সাধারণ কেউ হলে দ্রুত বলতো, " প্লিজ কাঁদবেন না, কান্না করা উচিত নয়, মন শক্ত রাখুন ব্লা ব্লা.." -তবে এসবের কোনটির একটিও আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো না। শীতের বিকেলবেলা হঠাৎ করে যেভাবে বাতাসের শুন্যতা টের পাওয়া যায় তেমনি আমি বেড়িয়ে এলাম নিঃশব্দে। আমি আর সেখানে কোনদিন ফিরে আসিনি।
আজকে ১৭ তারিখ, সাল ২০২৮।
নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছি এয়ারপোর্ট। তনয়া ফিরবে আজ, আমারি মেয়ে। লন্ডনে ল' পড়তে গিয়েছিল।
স্যার! আপামণি আইস্যা পড়ছে! আমাকে দেখে কালো ওভারকোট পড়া মেয়েটি আব্বু বলে ছুটে এলো। কেমন আছো আব্বু?
আমার চোখে পানি ছলছল করছিল, সেটি বাঁধভাঙা উল্লাসে গড়িয়ে পড়ল গালে। ভাল আছি রে মা! চল বাড়ি চল।
তনয়া কে দেখে আমি অবাক হই আজকাল, আমার মেয়ের মুখাবয়ব এভাবে বদলে সেই মেয়েটির মতন হয়ে যাবে সে আমি কখনো ভাবিনি।

(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক, বাস্তবের সাথে এর মিল নেই, যদি মিলে যায় তা একান্ত কাকতালীয় এবং অনভিপ্রেত) 

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯

গল্পঃ কেস নম্বর আঠারো

(এক)

        চায়ে হালকা চুমুক দিয়ে বাকীটা পিরিচে ঢেলে নিলেন আতিক স্যার, তারপর সুরুত সুরুত করে বার কয়েক চুমুক দিয়ে বললেন, আনিস! চাকরীর যখন দুই বছর বয়েস ঠিক তখনি প্রথমবারের মতন কেস সলভ করতে গিয়ে বেশ বড়রকমের ধাক্কা খাই!
আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম বেতের চেয়ারে। হাতে থাকা আইনের বইটা টেবিলে রেখে ফোন সাইলেন্ট করে স্যারের কথায় মনোযোগী হলাম। আমি বিকেলে আড্ডা দিতে প্রায়শই আতিক স্যারের বাসায় আসি, আজও এসেছি তেমনিভাবে।
আসলে স্যার যখন কোন ঘটনা বলতে শুরু করেন তখন তার মাঝে ই ক্লু ছেড়ে দেন পুকুরে পোনা ছাড়ার মতন করে, নিঃশব্দে ক্লু মাছের পোনার মতন কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে অথচ বুদ্ধি না থাকলে সেটা ধরা মুশকিল!
তাই মনোযোগী না হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পিরিচ টা সামনের টি টেবিলে রেখে, বাম পা ডান পায়ে তুলে স্যার শুরু করলেন।
তখন ৯০ এর গোড়ায় দিক, আমি খুব তোড়জোড় করছিলাম বদলী হতে। সবে চাকরি, তারপর বিয়ে। এর মাঝে একলা থাকা পোষাচ্ছিল না। আর অফিস এমন অজপাড়া গাঁয়ে যে সাইকেলে করে যেতেও অবস্থা খারাপ।
বর্ষা তখন ভরা যৌবন, চারিদিকে পানি আর পানি। ক্ষেতের ফসল ডুবে যাচ্ছে তবুও মাথা তুলে আংশিকভাবে জানাচ্ছে ওরা এখনো আছে। আমাকে পুলিশি পোষাক পড়তে হতো না কারণ গাঁয়ের প্রায় সবাই ততদিনে এক নামে আমাকে চেনে। আমি থানার প্রধান কর্মকর্তা। গাঁয়ে থাকার এই একটা সুবিধা বলতে পারো, কেউ শহরে তোমার খোঁজ নিলে না নেবে তাতে কোন দায় নেই কিন্তু গাঁয়ে এমনটা হয় না। তোমার নাড়ী-নক্ষত্র তারা জেনে তবে ই শান্ত হবে।
সে যাক!
ঘটনা ঘটল আমার বদলীর কাগজ আসার ঠিক দুইদিন আগে। ডাকে কাগজ আসবে ততক্ষণে জেনেছি কিন্তু অফিসিয়ালি কাগজ হাতে না পেলে কিছু করতে পারছিলাম না কারণ কাগজেকলমে আমি তখনো থানার ইনচার্জ। আর ঘটনাটাও ঘটল তার ই আগের দিন। ভোররাতে শুয়ে আছি, হাবিলদার আমার দরজায় নক করে আমাকে ডাকল, স্যার! স্যার! একটু আর্জেন্ট ডাক পড়েছে! স্যার..
আমি মাথার বালিশের কাছে টর্চ হাতে নিয়ে ঘড়িতে আলো ফেলতে দেখলাম রাত ১ টা ৫০ মিনিট। ট্রান্সফার হয়ে গেছে সে আনন্দে ঘুমাতে প্রায় ১১টা বেজে গেছে। তাই মশারি ঠেলে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও উঠে যেতে হলো। পায়ে স্যান্ডেল পড়ে খটাসখটাস শব্দে টর্চের আলো ফেলে গেট খুলে দিলাম।
হাবিলদার ঘেমে একাকার, মুখের অভিব্যক্তি বোঝাচ্ছিল ভাল কিছু নয়।
স্যার! এক লোক খুন হয়েছে রাতে, সে জুয়াড়ি। লাশ এখন উদ্ধার করে পুলিশি হেফাজতে এনেছি। আপনি ইন্সপেকশন করে দিলে ই মর্গে যাবে ওটা।
আমি গুরুত্ব না দিয়ে বললাম, উহ! আমার দেখার কি দরকার। তাছাড়া আমার তো বদলী ও হয়ে গেছে খামোখা কেন আর কেস নিতে যাবো? তুমি যাও! মর্গে পাঠাও আর আমার জুনিয়র অফিসার কে যেতে বলো সাথে তুমিও যাও। সাক্ষী পেয়েছো?
না স্যার!
মানে কি? খুন হয়েছে কোথায়?
এরপর হাবিলদার যা বলল তাতে আমার আগ্রহ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেড়ে গেলো।
মৃত সেই জুয়াড়ির নাম করিম শেখ। শেখ! মানে গ্রামের মোড়ল, গাজী শেখের একমাত্র ছেলে। আগে মোড়লদের যা ক্ষমতা ছিল তা চোখে না দেখে অনুমান করাও ভুল হবে। তার ই ছেলে খুন, সুতরাং হইহই ব্যাপার। তাছাড়া ঐ মোড়লের ছেলের বিয়েতেও গেছিলাম আমি। কেস না নিলেও সেখানে আমাকে যেতে হলো কারণ জানো ই, কেস আরেকজন এসে ঠিকি হাতে নেবে। আর সেজন্য একটা প্রিলিমিনারি ইনভেস্টিগেশন ফাইল চাই। দুজন হাবিলদার কে সাথে নিয়ে থানার সাইকেলে উঠে গেলাম ঐ রাতে ই।
 সে হোক, কিন্তু স্পটে গিয়ে দেখলাম বিভৎস দৃশ্য। খুন করে তার দু পা বাড়ির দরজায় আর দু হাত বাড়ির জানালায় আর মাথাটা খুঁজে পাওয়া যায় নি। আরেকটু হলে ই কবন্ধ বলে চালিয়ে দেয়া যেতো যদিও কবন্ধ ব্যাপার টা অন্যরকম ডেফিনেশনে তে পড়ে। মৃত করিম শেখের নতুন বৌয়ের জ্ঞান ফেরেনি। আরো জানতে পারলাম উনি তখন তিনমাসের সন্তানসম্ভাবা। তাকে সকালে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে এমনি এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোড়ল সাহেব। তাতে বাধ সাধলাম আমি। এই অবস্থায় মানবিক কারণ হলেও কেসের সাসপেক্ট কিন্তু সবাই। মোড়ল খুব একটা খুশী হলেন না তবে ছেলের শোকে কাতর, এই প্রয়োজন টা ঠিকি বুঝলেন তবে তার ধারণা ছেলের বৌ কাজটি করেনি এবং কোনভাবে জড়িত নয়। তবে আমরা পুলিশ! শোনা, বিশ্বাস এসবের চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে প্রমাণ। আমার তখন তাই দরকার। লাশের মাথা খুঁজতে কয়েকজন কে জোর তৎপরতার সাথে দ্রুত পাঠিয়েদিলাম সাথে সাথে। তারা বাড়ির আশেপাশেও খুঁজতে লাগল। আমি জেলা সদরের ডাক্তার কে আনতে পাঠালাম যাতে ময়নাতদন্ত টা দ্রুত করা যায়। চোখে এত্ত ঘুম ছিল আনিস, যে একজন কে জেরা করতে গিয়ে ঝিম লেগে যাচ্ছিল।
ঘড়িতে শেষরাত, তবুও আশেপাশে লোকের সমাগম কম না। পঞ্চাশ-ষাটজন ঘিরে দূর থেকে দেখছে আমাদের।

(দুই)
       ডাক্তার এসে লাশ এম্বুলেন্সে তুলে নিলেন। আমার সাথে করমর্দন করে বললেন। দেখুন, আমাদের! রাত সাড়ে তিনটা। ডিউটি করছি। মাইনে নেই, সেটা বাড়ে না বরঞ্চ পাব্লিক আমাদের উপর হর-হামেশা উত্তেজিত। ডাক্তার সাহেব কাগজে দ্রুত প্রয়োজনীয় ডাটা তুলে। মৃতের পরিবারের একজন কে সাথে একজন হাবিলদার কে এম্বুলেন্সে তুলে সাইরেন তুলে চলে গেলেন।
ভোরের আজান দিলো, আমি একটা চেয়ারে তখনো বসে। ঘুমে টলছি। তবুও চোখ বুজে থাকার উপায় নেই। মাথা খুঁজে প্রায় এক কিঃমিঃ তন্নতন্ন করেও সেটা পাওয়া যায় নি। হাবিলদার যেমন বিরক্ত তেমনি হতাশ। আমার কাছে এসে একটা স্যালুট ঠুকে বলল, স্যার! পাইলাম না।
বললাম, আশেপাশে নর্দমা, পুকুর এগুলা দেখেছো?
মাথা নাড়াল, না স্যার!
যাও, কাউকে নামিয়ে জাল ফেলে সার্চ করো।
মোড়লের বাড়িতে শোকের মাতম। বেশী কাঁদছেন মৃতের বৃদ্ধ মা। বুক চাপড়ে কাঁদছেন তিনি। আমি সেখান থেকে সরে এলাম। কেস ফাইলে চোখ রেখে দেখলাম অনেক তথ্য অনুমানে বসানো। তবে জেরা করার পর আংশিকভাবে কয়েকটা মিলেছে।
হঠাৎ-' স্যার' ডাক শুনে ফিরে দেখি। বছর ১৬ এর এক ছেলে, চা দোকান চালায় পাশে হয়ত। চা নিয়ে এসেছে। শীতে হাত-পা কাঁপছে। তখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি চলছে। রাতে কিছুটা থেমেথেমে হলেও এখন আবার শুরু হয়েছে। ছেলেটির মাথায় নীল রঙের পাতলা পলিথিন, বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে চা দিতে এসেছে।
-'হাবিলদার কাকা আপনার জন্যি পাঠাইল '
আমি হালকা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ' কি নাম তোর? থাকিস কই?'
সে নাম বলল, জাবির! পাশের গ্রামে থাকে।
জিজ্ঞেস করলাম, মৃত করিম শেখ কে চিনিস?
বলল, হ্যাঁ! মাঝেমধ্যে তার দোকানে আসতো কিন্তু চায়ের পয়সা দিতো না।
-'তুই টাকা চাসনি কোনদিন? '
-' নাহ!'
- ' কেন?'
- 'টাকা দিতো না, রাগ করতো তাই আর চাইতাম না'
বুঝলাম, যে বাপ গাঁয়ের মোড়ল হবার সুবিধা ঠিকি নিতো করিম শেখ। বললাম, 'আচ্ছা এখন যা, বাকী হাবিলদার যারা আছে তাদের কেও চা দিয়ে দে। পরে এসে বিল নিয়ে যাবি আমার থেকে, ঠিকাছে?'
ছেলেটি পলিথিনের ভেতর হলুদাভ দাঁতে হেসে কাঁদামাখা পায়ের ছাপ ফেলে সামনের বাড়ির পেছনে উধাও হয়ে গেলো।
চায়ে এক চুমুক দিয়েছি কি দেই নি, ছাতায় বৃষ্টির শব্দ তুলে মোড়ল সাহেব এসে হাজির।
-' কি করতাছেন? লাশের পুরাটা পাইছেন? চা খাইতাছেন বইস্যা বইস্যা!'
আসলে সারারাত জেগে বসে আছি, মেজাজ টা এত্ত খারাপ তখন। সড়াৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ই কথা শোনাতে যাবো অমনি হাবিলদার চেঁচিয়ে উঠল।
-' স্যার! স্যার! পাওয়া গেছে মাথা! '
চায়ের কাপ নামিয়ে সেদিকে ছুটলাম যেদিকে হাবিলদার চিৎকার করেছে। গিয়ে দেখি অদ্ভুত ঘটনা! মৃত করিম শেখের মাথার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে হাবিলদার। মাথাটা কারো হাতে নেই সেটা মোড়লের বাড়ির কবুতরের খাঁচার উপরে একটা সূচালো বল্লম আকৃতির একটা লাঠিতে গেঁথে রাখা হয়েছে। সেটা দেখে মূর্ছা গেলেন মোড়ল।
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মৃতের মা এসেও সড়াৎ করে পড়ে গেলেন বাড়ির ভেতর থেকে বৃষ্টির জল বেড়িয়ে আসা নালার উপর।
আনিস এতক্ষণে কথা বলল, ' স্যার! দেখে মনে হচ্ছে যে খুন করেছে সে খুব ক্ষুদ্ধ ছিল সেই মৃত লোকটির উপর!'
আতিক সাহেব, চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন, হয়তো তাই! কারণ, আমরা তখনো কিচ্ছু জানি না এই বিষয়ে।
তারপর আতিক সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন,
খাঁচাসহ মাথাটা নামানো হলো তারপর অনেকটা ভেঙে ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজে পেতে লাঠির অংশভাগ রেখে দেয়া হলো। আমরা যা যা প্রিলিমিনারি সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলাম তাই নিয়ে ফিরে এলাম থানায়। রাতে ঘুমাই নি আমরা কেউ। কেবল সে রাতে যারা স্পটে যায়নি কেবল তারা ই থেকে গেলো থানায়। আমি এবং বাকীরা ফিরে এলাম যে যার বাড়ি। একটা ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে আমিও ঘুমালাম, পরিশ্রান্ত হয়ে, ক্লান্তি নিয়ে।

(তিন)

       সেদিন ই বিকেলবেলা আবার থানায় যেতে হলো আসলে যেতে যেতে সন্ধ্যে হলো। থানা ছেড়ে যাচ্ছি তাই অহেতুক এই কেসে আর নিজেকে জুড়তে ইচ্ছে করছিল না। থানায় গিয়ে ই দেখি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এসে গেছে। তাতে লেখা দু-তিনজনের হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। তার মাঝে কিডনি দুটো মিসিং।মাথায়, মানে ঘাড়ে কোপের দাগ। সেটা খুনের আগে না পরে বোঝা মুশকিল কারণ সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, যদিও একটু থেমেছিল। তবে ডাক্তারের ধারণা কয়েকটা দাগ খুব ডীপ তার মানে  পরেও আছে। অস্ত্র দুটো এবং দেশী। খুন করা হয়েছে মোক্ষম কোপে। ধরাশায়ী করে তারপর পিস পিস করা হয়েছে।
শরীরে কিছু ঝোপঝাড়ের বুনো পাতা লেগে ছিল। সেই পাতা কোথায় কোথায় পাওয়া যায় লিস্ট করে সন্ধ্যার আগে দুটো টীম কে সার্চে পাঠালাম। খুনী সেই স্পটের আশেপাশে কেউ কিনা জানা দরকার। তার পাশাপাশি গত সপ্তাহে কামারের হাতে কি কি দেশীয় অস্ত্র গেছে বিক্রি হয়ে আর কারা কিনেছে এই লিস্ট করতে কামারের বাড়ি একজন হাবিলদার কে পাঠালাম।
রাতে অফিসে বসে আছি, তখন এলেন মোড়ল নিজে। চোখদুটো ভয়াবহ লাল। কেঁদে ফেললেন আমার হাত ধরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, স্যার! আমার ছেলের খুন কারা করছে? - খুঁইজা বাইর করেন, জানি! আমার পোলার চরিত্র ভাল ছিলনা, মদ খাইতো, জুয়াড়ি ছিল তারপরেও এর বিচার আমি চাই!
আমি তাকে হাত ধরে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। তারপর একজন হাবিলদার কে একগ্লাস পানি আনতে পাঠিয়ে দিলাম উনার জন্য। উনি পানি খেতে ই বললাম, 'আমি চলে যাচ্ছি, এই কেস অন্য অফিসার এসে দেখবে। আশাকরি উনি এই কেসে উপযুক্ত সমাধান করবে।'
মোড়ল কে হতাশ, একইসাথে অখুশি লাগল। এই উত্তর তিনি আশা করেননি। তিনি গ্লাস নামিয়ে ফিরে গেলেন দ্রুত পায়ে। আসলে আমার এই কেসে কোন আগ্রহ ছিল না আর মোড়লের ছেলের যা ইতিহাস তাতে এমন কিছু ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে খুন টা ভয়াবহ!  একটা লোককে পাঁচ টুকরো করে পাঁচ জায়গায় ফেলে রেখেছিল।
থানা থেকে বাড়ি ফিরবো তখনি স্যালুট ঠুকে হাবিলদার এলো, যাকে পাঠিয়েছিলাম গাঁয়ের দু-চারজন কামারের কাছে। সে জানালো বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝেছে তারা কেউ ই ভারী দেশীয় অস্ত্র ধারালো কিংবা তৈরি করেনি গেলো সপ্তাহে। তবে এও সন্দেহ থেকে গেলো তারা কি আদৌ সত্য বলছে কিনা? মৃতের কিডনি দুটো পাওয়া যায়নি। কাছাকাছি যত ক্লিনিক আর হাসপাতাল ছিল তাতেও কিডনি গত চব্বিশ ঘণ্টায় জমা পড়েনি। কিডনি বিক্রি হয়েছে এটা নিশ্চিত নই আমি। আর খুনের জন্য এই গাঁয়ের গোটা জনবসতির সবাই ই এখন আসামী।
কথার মাঝে এবার মুখ খুলল আনিস, স্যার! মোড়লের বাড়ির সদস্য কারা তাদের ব্যাপারে তো কিছু বললেন না? তারা কি ক্লিন ছিল এই কেসে?
নাহ! মোড়লের বাড়িতে সদস্য বেশী না। মৃত করিম শেখ সহ বাড়িতে মোট সদস্য মাত্র ছ'জন। মোড়ল এবং তার স্ত্রী, পুত্রবধূ, দুজন চাকর বয়েস প্রায় ষাট আর নিহত করিম শেখ। চাকরের মাঝে একজন আয়া মানে ছোট থেকে সে বাড়ির ঠিকে কাজ, রান্না এসব করে। আরেকজন ও তাই বাড়ির ফায়ফরমায়েশ শোনে। এদের শারীরিক গঠন এমন নয় যে এরা এই খুন করতে পারে। তবে শারীরিক গঠনে বিভ্রান্ত হবার কারণ ছিল না। সেখানেও ছাঁইয়ের গাদায় সুঁই খুঁজেছি দশা। তাছাড়া আমি জুয়াড়ি গ্রুপের সদস্যদের জেরা করেছিলাম। ওরা কেউ ই অত রাতে করিম শেখের সাথে ছিল না। তাদের ভাষ্যমতে, করিম শেখ তাসের দুই সেট খেলে জেতার পর মোটা টাকা হবে এই হাজার পাঁচ পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। সে প্রায়শই মদ খেতো কিন্তু মজার ব্যাপার সেদিন সে মদ খায় নি। তাই দূর্বল শক্তির কেউ যদি আক্রমণ করে সেখানে ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যেতো কিন্তু যা ফরেনসিক মানে ময়নাতদন্ত এ পেয়েছি তাতে এমন উল্লেখ ছিল না।  পাকস্থলী তে অ্যালকোহল ছিল না। আর বাকী যা ছিল আমি অত ঘাটাঘাটি করি নি কেবল বদলী হচ্ছিলাম বলে।
আনিস ভ্রু-কুঁচকে কি একটা ভাবতে লাগল। সে কি আঁচ করেছে আতিক স্যার বুঝতে পারলেন না। আতিক বুঝলেন, আনিস হয়ত ভাবছে আমি উদাসীন ছিলাম এই কেসের ব্যাপারে।

(চার)

     আমার বদলীর তারিখ এক মাস পিছিয়ে গেলো। এই খবর যতক্ষণে পেয়েছি আমার মন ততক্ষণে দূঃখ্য-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। প্রথমে ভাবলাম মোড়লের কাজ, স্থানীয় এম পি কে সুপারিশ করে বদলী পিছিয়েছেন। পরে জানলাম যার এখানে আসার কথা তিনি একটি সিরিয়াস খুনী কে ধরার জন্য একটি অপারেশন এ গিয়ে ইঞ্জুরড হয়েছেন। পায়ে গুলি লেগেছে। আপাতত, তাই আমাকে এখানে থাকতে ই হবে। তাছাড়া, এ এস পি নাকি জেনেছেন, খুনের ব্যাপারে। তিনি জানতেন এই কেস সমাধানের মতন ক্যাপাবিলিটি আমার ছিল। তাই তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার বদলী থামিয়ে দিলেন। ফ্যাক্স করে পাঠালেন একটি কাগজ তাতে এই কেস নিয়ে অগ্রগতি এবং আরো নানা কিছু জানতে অনুরোধ করলেন। বাধ্য হয়ে তাই থাকতে হলো। বাসায় ফোনে জানালাম বদলী বিলম্বিত। কেসে অনুসন্ধান করছি ঢিলেঢালা ভাবে। আমার কোন ইচ্ছেও ছিল না এই কেইস সমাধানের। পুলিশ হয়েছি বলে সব কেইস সমাধান করতে হবে এমন তো কথা নেই, দেশে হাজারো খুন, রাহাজানি হয়। কয়টা ই বা সমাধান হয় বলতে পারো আনিস?
আনিস মাথা চুলকে নিলো। আজকেও অফিসে দু তিনটা খুনের কেইস  জমা পড়েছে। এর মাঝে একটি বেওয়ারিশ লাশের খুন।
আতিক বলতে লাগলেন, ' আমি এদিকওদিক ঘুরে কাটাচ্ছি, তখন মোড়ল ও নিজে নিজে দায়িত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করছেন।'
হঠাৎ জানতে পারলাম আরেক খুনের খবর! মাথাটা ঘুরে উঠল। এ এস পি জানতে পেরেছেন। প্রতি থানাতে ই তাদের ছ্যাঁচোর থাকে। সেই লীক করেছে, এবং আরো বলেছে আমি নাকি উদাসী। কেইস ঘেঁটে গেলো, সেইসাথে আমার মেজাজ। এবারের খুন হয়েছে সেই জুয়ার আসরে ই! করিম শেখের সাথে যারা রেগুলার জুয়া খেলতো তাদের ই একজন। বলা যায় করিম শেখের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সে। করিম শেখ মারা যাবার পর পুলিশ গিয়ে জুয়ার আসর ঘরে সীল লাগিয়ে দেয় কিন্তু তারা আসর বসাতো মধ্যরাতে। গ্রামের থেকে বেশ দূরে কোন পরিত্যক্ত ক্ষেতে। এবার হালকা ভাবে আর নেয়া গেলো না। গেলাম জীপ নিয়ে। এই খুন দেখে সহজে অনুমান করা গেলো মোটিভ টা কি। গলা, ঘাড়ে, মাথায়, হাতের মাঝে, পেটে এলোপাথাড়ি স্ট্যাব। ছুরিটা বেশ ধারালো ছিল বোঝা ই যাচ্ছে। লাশ যেখানে পেলাম সেখানে পশু কোরবানি দেয়ার মতন রক্তের স্রোত গেছে।
লাশ পাতায় মুড়িয়ে পাঠানো হলো ময়নাতদন্ত করতে।
খুন টা দেখে বুঝলাম একই খুনী ভিন্ন ভিন্ন মোটিভে কাজটা করেছে। প্রথম খুনে আগ্রাসী ভাব ছিল খুব বেশী। দ্বিতীয় খুনের কারণ গভীর না হলেও তাতেও আগ্রাসী ভাব সুস্পষ্ট!
এ এস পি এলেন পরের দিন। মোড়লের কাজ বুঝতে পারলাম। পুলিশের উদাসীনতা দেখে নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ চেষ্টা তিনি চালিয়েছেন। এ এস পি স্যার আসার পর বেশ কড়া কথা শোনালেন। হ্যান-ত্যান শুনে মাথাটা গেল বিগড়ে। চুপ করে থাকলেও ভেতরে ফুঁসে উঠলাম। ভেবে নিলাম এক সপ্তাহে এই কেইস সলভ করে ছাড়বো নয়ত চাকরী ই ছেড়ে দেবো! অপমান সহ্য করাটা আমার ধাঁতে ছিলো না।
এ এস পি চলে যেতে ই লিস্ট করে করিম শেখ এবং নিহত শুক্কুর আলীর পরিচিত সবাই কে থানায় এনে রাম প্যাঁদানি প্যাদালাম। কেউ না কেউ নিশ্চিত জানে পেছনের ঘটনা।
এদের একজন মুখ খুলল আর তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। করিম শেখ নাকি গ্রামে কোকেন সাপ্লাই শুরু করেছিল। আর সেই কোকেনে পার্টনার ছিল বেশ কয়েকজন জুয়ারি, তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো করিম শেখ কারো সাথে সরাসরি লেনদেন করেনি। কারো না কারো মাধ্যমে টাকা-মালামাল আনা নেয়া করতো। পাশাপাশি কয়েক গ্রামে তাই জুয়ার আসর আর মাদকের লেনদেন হতো পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে। আর এতই গোপনীয়তা ছিল যে, আমি নিজে দুই বছর থাকার পরেও এই ব্যাপারে ঘুণাক্ষরে কিছুই জানতে পারিনি। এমনিতে জুয়ার ব্যাপার যে জানতাম না তা নয়। কেবল মোড়লের অনুরোধে অগ্রাহ্য করতাম জেনেও।
প্যাঁদানি খেয়ে আরো তথ্য ফাঁস করলো এরা। কোকেন নিতে নিতে এরা এতই নেশাখোরে পরিণত হয়েছে যে দুটো লাঠি ভেঙ্গে ফেলেও কিছু করা যায় নি। কোকেন এমনি এক মারাত্মক খুনে নেশা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি সৈন্যরা ছিল ভয়াবহ নির্দয়, এর কারণ জানো? জ্বী স্যার!
methamphetamine আর cocaine এর ভিত্তিক ড্রাগ নিয়ে নিতো তারা। হিটলার এসব ড্রাগ দিতো তার সামনের সারিতে থাকা সেনাদল কে, ফ্লাই করা পাইলট কে। যাতে ওরা সহজে নিস্তেজ না হয়ে পড়ে। তাই কেইস টা এবার হলো আরো জটিল। করিম শেখের আসরে কারা কারা আসতো তাদের লিস্ট করা এক অসামান্য কঠিন কাজ।
এই কোকেন নেয়া মানুষগুলোর হিতাহিত জ্ঞান একেবারে শুন্যেএ কোঠায় থাকে। সামান্য কারণে মেজাজ মর্জি উগ্র হতেও সময় নেয় না। এবং এদের ই কেউ খুন করেছে দুইজন কে। কিন্তু সে নাকি তারা? খুন কি একই ব্যক্তির কাজ না আলাদা আলাদা মানুষ? প্রথমে ভেবেছিলাম খুনীর আগ্রাসী ভাব সুস্পষ্ট। সুতরাং সে বিশাল শরীর নিয়ে কেউ হবে তার মানে নয়। খুনী কোকেন নেয়। কিন্তু সে কোথায়? সে এই গ্রামে ই আছে? না পালিয়ে গেছে?
আশেপাশের গ্রামে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলাম হাবিলদার সহকারে খানাতল্লাশি করে এলাম। দু'চার গ্রাম মিলিয়ে গ্রেফতার করলাম বেশ কয়েকজন জুয়ারি কে। এরা তেমন তথ্য দিতেও পারল না। কারণ এরা কোকেন নেয় কেউ নিঃশ্বাসে, কেউ সিরিঞ্জ দিয়ে। অঘোষিত রিমান্ডে জেরা করা হলো। কিন্তু আশার আলো পাওয়া গেলো না।
বুঝলাম, খুনীর হদিশ যখন পাচ্ছি না সুতরাং সে মোটিভ নিয়ে কাজ করেছে। এটা আরো স্পষ্ট করে বলা যায় কারণ যাদের ধরা হয়েছে তাদের সবাই ই কোন না কোনভাবে কোকেন ব্যবসায় জড়িত। তবে সবার ই ড্রাগ লর্ড ছিল নিহত করিম শেখ। 
গ্রামে এত লোক! এদের মাঝে কে খুনী সেটা খুঁজে পাওয়া ই ছিল দুষ্কর।

 (পাঁচ)

আতিক এবং আনিস দুজনের চুপ। আনিস এর মাঝে ভেতরে গিয়ে খানিক টা ফ্রেশ হয়ে ফিরল এবং প্রশ্নটা চেয়ারে বসতে বসতে করে ফেলল, ' কিন্তু খুনীও তো কোকেন ই নিতো, তাই নয় কি স্যার?'
আতিক এতক্ষণে মৃদ্যু হেসে ফেললেন। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আনিসের পিঠ চাপড়ে ফের নিজের সিটে গিয়ে বসলেন।
ঠিক তাই!  আগেই বলেছিলাম, " নিঃশব্দে ক্লু মাছের পোনার মতন কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে অথচ বুদ্ধি না থাকলে সেটা ধরা মুশকিল! "
কোকেনের চালান গ্রাম কিভাবে এবং কোথায় আসে? কারা কারা চালান করে এসবে জানা টা খুব জরুরি হয়ে পড়ল। কোকেন এমনি এক নেশা না পেলে হিংস্র হতে সময় নেয় না এর গ্রাহক। আমিও আমার কিছু ছ্যাঁচড় রেডী করলাম। টানা সাত দিন বিভিন্ন জুয়ার আসরে ঘুরে বেড়ালাম। যাদের গ্রেফতার করেছিলাম তাদের উপর নজর তো ছিল ই আরো নতুন খদ্দেরের উপর নজর রাখলাম।
কোকেনের সাপ্লাই ধরে ফেললাম, আর সাপ্লাই যেহেতু কমে যাচ্ছিল। দাম ও বেড়ে যাচ্ছিল। একেবারে বন্ধ করিনি কারণ এতে খুনী এলাকা ছেড়ে পালাতে পারে। আর পালালে ই যে সে খুনী তাও অনুমান করা বোকামি। আমি আসলে হাতেনাতে খুনীকে জালে আটকাবার প্লান করেছিলাম। আমার দুজন চৌকস হাবিলদার কে ২৪ ঘন্টা জুয়ার আসরে নেশাখোর সাজিয়ে নজর রাখতে বলেছিলাম।
কিন্তু দূঃখ্যজনক! তাতে কোন ফল পেলাম না। এদিকে মোড়ল সাহেব এ এস পি র প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা দেখিয়ে কথা শুনিয়ে গেলেন বেশ কয়েকবার।
এর ই মাঝে একদিন মোড়লের বাড়ির আশেপাশে সন্ধ্যার পর নজর রাখতে ছদ্মবেশ নিয়ে বাইনোকুলার আর পিস্তল নিয়ে গাছে বসে থাকলাম। বাড়ির ছোট বর্ণনা দিলে বলতে হয়। মোড়লের ঘর টিনের, মেঝেটা ঢালাই করা সিঁড়িও আছে বাইরের দিকে। পাশাপাশি তিনটে ঘর। মাঝের ঘর টা ছেলের, এখন সেটা বন্ধ। সম্ভবত ছেলে বৌ তার বাপের বাড়ি গেছে। তার পাশের ঘরটা তুলনামূলক ছোট, ওটা কাজের লোকটির। উঠোন টা মাঝারি, চোখ বন্ধ করে বলা যায় পঞ্চাশ-ষাট টি চালের বস্তা রাখার মতন জায়গা আছে। মোড়লের ঘরের বিপরীত দিকে গরুর গোয়াল ঘর, রান্নাঘর আর গাছাপালা ঘেরা প্রবেশ পথ। বাড়ির পেছনে পথ আছে সেটা দিয়ে গ্রামের ভেতরে যাওয়া যায় কিন্তু সেটা এখন কেউ ব্যবহার করে না।
ঘরের বাইরে খড়ের বিশাল গাদা, উচ্চতা নয় ফিট (আনুমানিক), তার পাশে ই গোবর ফেলার বড় গর্ত। আর কবুতরের খোপ কোথায় সে তো আগেই বলেছি।
কিন্তু মনে খচখচ করছিল, ক্লু পাচ্ছিলাম না। তাই ওই ব্যবস্থা নিলাম।
আনিস এবার হাসল, এসব কেন স্যার! হাহা..
আতিক স্যার থামলেন না, উনি বলে চললেন - বাড়ির ভেতরে লোকজনের চলাচল স্বাভাবিক। তখন রাত সাড়ে আটটা। সবাই খেতে বসেছে দেখলাম। গাছে বসে আমি ততক্ষণে পোকামাকড় আর মশার কামড় খেয়ে ফেলেছি বিস্তর। খিদে পাচ্ছিল। পকেট থেকে চানাচুর বের করতে যাবো আর তখনি নজরে পড়ল বাড়ির কাজের লোক টা মুখে গামছা বেঁধে বাইরে এলো। প্রস্তুত ই ছিলাম, কিন্তু দেখলা
 দূরে বাড়ির গোবর ফেলার গর্ত তে গিয়ে বসে পড়েছে। মানে প্রাকৃতিক কাজ!
ছ্যাঁ! নিজের উপর নিজে ই বিরক্ত তখন আমি। এই কেচ্ছা দেখতে?..  আর তখনি ঘটল ঘটনাটা!
আধাঁর থেকে ঝট করে আরো একজন বেড়িয়ে পড়ল। খচাখচ শব্দে কি একটা ঢুকিয়ে দিলো সেই কাজের লোকটার শরীরে। আহ! আর্তনাদ শুনতে পেলাম ততক্ষণে.. আমার সাথে টর্চলাইট নেই, এসেছি একা। তবুও দ্রুত কে.. কে..? চিৎকার করতে করতে গাছ থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। খুনী!! আমার সামনে!! কিন্তু গাছ থেকে পড়ে যাবার পর খুনী দ্রুত আমার কাছে এসে মুখে লাইট মেরে চিনতে পেরেছে আমাকে। হাতে একটা ধারাল অস্ত্র খাড়াভাবে আমার দিকে তাক করে বিঁধিয়ে দেবে। আমি প্রমাদ গুনছি, সাথে সাথে লোকজনের আওয়াজ আসতে লাগল। এরই মাঝে খুনী একবার স্ট্যাব করে ফেলেছে আমাকে, কপাল ভাল হেচকা টানে শরীর টা মাটিতে গড়িয়ে নিয়েছি। খুনী লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে দেখলাম মুখের কালো চাঁদর টেনে ঝোপের ভেতর দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে পালিয়ে গেলো।
মিনিট ত্রিশের মাঝে থানা থেকে পুলিশ এসে গেলো ওরা আমাকে দেখে ই আরো অবাক, আমি একা না এলে আজ তাকে ধরা যেতো বলে দুই হাবিলদার আফসোস করে উঠল। আমি আশাবাদী, কারণ দেখলাম কাজের লোকের হাতে গোবর মাখানো একটা প্যাকেট এবং তাতে কোকেন।
একদল পুলিশ কে দ্রুত গতিতে গ্রামের বাস স্টেশনে যেতে বললাম তখনি। বলে দিলাম বছর সতেরো থেকে একুশের কেউ যেন বাসে উঠে পালাতে না পারে। আমার পায়ে আঘাত লেগেছিল। সেটা মচকে গেছে অনেকটা।
একজন হাবিলদারের কাঁধে হাত রেখে বললাম, খুনীকে না চিনলেও চিনতে পেরেছি।
গোবরের গাদা খুঁড়ে আরো পনেরো বিশটা কোকেনের প্যাকেট পাওয়া গেলো। মোড়ল কে থানায় নেয়া হলো। আমি এদিকে অন্তত খুশী হলাম কারণ লোকটা এতদিন খুব বিরক্ত করেছে আমাকে। যাচ্ছেতাই বলে গেছে ক্ষমতা খাঁটিয়ে। আজ কে আর ছাড়া যাবে না।


(ছয়)

  কোকেন সহ মোড়ল ধরা পড়ায় গ্রামবাসী উত্তেজিত হয়ে গেলো। বেশ কয়েজন মুরুব্বি গোছের লোক তারা থানায় এসে মোড়লের বিরুদ্ধে কিছু গরীব গ্রামবাসীর জমি আত্মসাৎ অথবা জোর করে কমদামে দখলের অভিযোগ করে গেলো। সুতরাং
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মাদক কেনাবেচা এবং সঞ্চয় করার আইনে মামলা হলো। সেই সাথে জমি দখলের কারণে মামলা ফাইল হয়ে গেলো। গ্রাম মোড়লহীন মানে অভিভাবকহীন হলো। স্থানীয় এম পি এসে বেশ কয়েকদিন সাফাই গাইলেন মোড়লের নামে। তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হলো। অবশ্য এ এস পি সাহেব স্তিমিয়ে গেছেন এই ব্যাপারে।
আমার মুখে হাসি আর বুকে বিজয়ীর সাহস। এম পি কে পাল্টা ভয় দেখিয়ে ফেরত পাঠালাম। এও বলে দিলাম উকালতি করলে তার বাড়ি ও ওয়ারেন্ট ছাড়া ই সার্চ করতে পারি। বুঝলাম কাজ হয়েছে, এম পি লোকটা দমে গেলেন।
রিমান্ড মঞ্জুর হলো মোড়লের।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পড়ল তদন্তকারী পুলিশের উপর। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ও যখন কথা বের করতে পারছিলাম না তখন আঙুল হালকা বাঁকা করতে ই হয়েছিলো। কড়া টাইটে তিনি মুখ খুললেন। আর তখন অবাক হলাম এই মাদকের ব্যবসা তে তিনি কত খরচ করেছেন আর কত কামিয়েছেন! চেয়ারম্যান /মোড়ল হবার আগে ভোটের পেছনে যা খরচ করেছেন, যারা তার বিরুদ্ধে ছিল তাদের জমি জমা কেড়ে নিয়েছেন। আমি আসলে এত গভীরে যেতে চাইছিলাম না কিন্তু মাঝেমাঝে পরিস্থিতি এমনি হয়। আর বদলি ভুলে দুই সপ্তাহ কাটালাম এই কেইসে। মোড়লের সাথে যাদের বনিবনা হয়নি তাদের ধরা হলো। দফায় দফায় রিমান্ড হলো কিন্তু খুনের মোটিভ কিংবা কে খুনী সেটা পাওয়া গেল না। এমনকি যেদিন মোড়লের বাড়ির সামনে স্বয়ং আমি আড়ি পেতেছিলাম সেদিন ও সেই খুনীকে ধরতে পারিনি। তবে নিশ্চিত ছিলাম সে গ্রামে ই এবং সবার মাঝে মিশে আছে, মজা দেখছে।
আনিস প্রশ্ন টা করল, ' কিন্তু স্যার আপনি না বললেন সে যুবক বয়সের কেউ!' - হ্যাঁ -সে তো বলেছিলাম ঠিকি কিন্তু গ্রামে হাজার যুবক আছে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম ই কি করে?
মাদকের মামলা অনেক কঠিন তাই মোড়লের জামিন হলো না। উপজেলা থেকে একজন মেম্বার গ্রামের প্রশাসনিক দায়িত্ব নিলেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে। আমিও ততদিনে এই আনসলভ কেসে কূলকিনারা পাইনি। বদলী হতে আর দিন তিনেক হাতে। মন উদাস! কেইস সলভ করতে না পারার হতাশা থেকে ই হোক অথবা অন্য কোন কারণে ই হোক গ্রামের পথে শেষবারের মতন একাকী হাঁটতে বেড়িয়ে গেলাম। হাতে টর্চ ছিল যেটা দুটো পেন্সিল ব্যাটারি তে চলে। চুপচাপ গ্রামের স্কুল ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। শীত শীত ভাব, টানা বৃষ্টিতে তেমন হাওয়া দিচ্ছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে যখন আসছিলাম তখন সন্ধ্যা গাড় রঙ ধরেছে। আযান পড়েছে একটু আগে ই রাস্তা ফাঁকা। গাছপালা ঘেরা রাস্তার পুরোটা যেন ইংল্যান্ডের কোন এক ট্রেনের টানেল। এত অন্ধকারেও যেন কি মনে করে টর্চের সুইচে হাত রেখেও আলো জ্বালালাম না। নিঃশব্দে এগুতে লাগলাম বিড়ালের মতন, তখনি দুজন মানুষের কথার আওয়াজ পেলাম। রাস্তার পাশের এক চালা ঘরে হালকা বাকবিতণ্ডা চলছে। ভাল করে খেয়াল না করলে বোঝা মুশকিল! আমি আমার মতন একইভাবে ফিরে আসছিলাম তখনি একটা কথা শুনে থমকে গেলাম, " -তরে না কইসিলাম ধার ভাল কইরা দিতে, টান যাতে দুইবার না দিতে হয়? " -ভুল হইসে ভাই!
ফিসফিসানি গলার এবার বলল, পুলিশ টা সেইদিন ঝামেলা না করলে তামাতামা কইরা দিতাম...!
আমি হাতের টর্চ টা মুঠোয় নিলাম, মাটিতে বেড়া দেবার জন্য কাঠ কেটে ফেলে রাখা ছিল তার একটা নিঃশব্দে হাতে নিতে ই ওদের কথা থেমে গেলো।
এরপর তীব্র একটা টর্চের আলো আমার চোখে পড়ল.. পলা!!! পুলিশ!! রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু ঐ ঘর আর কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে পিচ্ছিল ও। আমার পায়ে কেডস, তবুও এক জাম্পে রাস্তা ছেড়ে, হেইয়ো বলে উঠে গেলাম ঘরের উঠানে। একজন ভয় পেলে আঁধারে ছুটে গেলো কিন্তু আরেকজন? নাহ! তার মুখে আলো ফেলতে ই যেমন আমি চমকে গেলাম তেমনি সেই সুযোগে আমার বা'হাতে কনুইয়ের উপরে খপ করে একটা কোপ পড়ল।
আমি ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম! আমার বা'হাত থেকে টর্চ টা কাদামাখা উঠানে পড়ে গেলো। হুশ হারাই নি! এক কোপে উত্তেজনা স্তিমিত হয় না। হিউমেন ব্রেইন এমনি এক জিনিস!
দ্বিতীয় কোপ দেয়ার আগে ই আমার ডান হাতে ধরা কাঠের ঐ লাঠি দিয়ে সজোরে মারলাম ওর বা পায়ের হাঁটু জয়েন্ট বরাবর। পা ধরে পড়ে গেলো, সেইসাথে হাতের ধারালো অস্ত্র টা। কপাল ভাল মোক্ষম সুযোগে কাবু করে ফেলেছি। হাতের উপর হাত রেখে বুঝলাম বা'হাত টা কাঁপছে আমার। ভেজা হাত রক্ত স্রোতের জানান দিচ্ছে।
কিন্তু এর ই মাঝে সে পালিয়ে না গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দিয়ে আমার গলা দু হাতে চেপে ধরলো! ডান হাতে যত শক্তি ছিলো সেটা বাগিয়ে মোক্ষম একটা ঘুষি দিলাম মুখ বরাবর। এতক্ষণে কাদাতে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। ঘুষি খেয়ে আর উঠতে পারেনি সে। আমার শার্ট খুলে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে নিলাম। রুমালে বাঁধলাম কব্জি। রক্ত তখনো পড়ছে। হেলান দিয়ে বসে পড়লাম ঘরের দেয়াল ঘেঁষে।
বলেছিলাম আযান হয়েছিল তাই রাস্তা ছিল ফাঁকা। মিনিট দশ পড়েই সেই রাস্তা দিয়ে আলো ফেলে কয়েকজন নামাজ শেষ করে টর্চের আলো ফেলে ফিরছিলেন। তারা দুইজন আহত লোকের গোঙানির আওয়াজ পেয়ে এই অবস্থা দেখলেন। প্রথমে তারা ভেবেছিলেন আমরা চোর! কিন্তু একজন আমাকে চিনতে পারলেন। থানার বড়বাবু!!
আমাদের দুজন কে ই হাসপাতালে নেয়া হলো, আমার বা'হাতে পড়ল তিনটা সেলাই। আর খুনীর পায়ে ব্যান্ডেজ।
আনিস প্রশ্ন করল, " -কিন্তু স্যার! খুনীকে দেখে অবাক হয়েছিলেন কেন? সে কি চেনা কেউ? "
আতিক প্রশ্ন শুনে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ! আমার অফিসের ই কন্সটেবল। তার নাম ইকবাল। শারিরীক অসুস্থতা দেখিয়ে লিভ নিয়েছিল এক সপ্তাহের। গ্রামে ই থাকতো সে। খুনের দিনেও আমার সাথে ডিউটি করেছে। এমনকি সে কাছে থেকে আমার অনেক সিদ্ধান্ত ভেস্তেও দিয়েছে। তাই জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে এই কেইস। তাছাড়া পুলিশের ট্রেনিং ছিল তাই লিকলিকে শারীরিক গঠন হলেও সে ছিল ফিট। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার সব প্লানের সাথে আগে থেকে অন্যদের মতন সেও থাকতো, কেবল ঐ মোড়লের বাড়ি যাওয়ার একলা প্লান সে কেবল জানতো না। পুলিশে থেকে সে কোকেনের কালো তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। আদতে গরীব ইকবালের পয়সাকড়ি ভালো ই এসেছে এই কাজ করে। ধরা পড়ে সে স্বীকার করলো, দুটো খুন ই তার। প্রথম খুনের কারণ কোকেনের লেনদেন নিয়ে মনমালিন্য, দ্বিতীয় খুনের কারণ পুলিশের চোখে ধাঁধা লাগানো একই সাথে কোকেনের চালান মোড়ল কই রাখত সেটাও উদ্ধার। কিন্তু সেই প্লান বানচাল হয় আমার কারণে। আর ধরা পড়ার ব্যাপার টা কাকতালীয় হলেও সাফল্য ই ধরে নিলাম আমার জন্যে।
আনিস বলল, " তাহলে এর আগে যাদের জেরা করা হয়েছিল, মানে করিম শেখের সাথে যারা লেনদেন করতো তারা কি এই ইকবাল-করিম শেখের লেনদেন নিয়ে জানতো না?"
- নাহ! করিম শেখ খুব চালাকচতুর ছিল। তার কোকেনের কতটা সে কিভাবে চালান দিতো পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে তার হিসেবে গেলে বিরাট ধাক্কা খেতে ই হতো।
আনিস ভ্রু কুঁচকে কি একটা ভাবতে লাগল।
আতিক বললেন, কেইস টা আপাতত রফা করে ফিরছি। বদলি হয়েছি আর কত? আমাকে এগিয়ে দিতে এলো প্রিয় কয়েকজন হাবিলদার। অনেকে কোলাকুলি করে বলল, ' স্যার! আপনাকে অনেক মিস করবো! ' সবাই মিলে একটা ভারী গিফটের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিলো আমার। সাথে দুটো লাগেজ। একজন হাবিলদার দুটো লাগেজ তুলতে যাবে তখনি গেটে তার সাথে একজন মহিলার ধাক্কা লেগে মহিলা বাস স্টেশনে পড়ে গেলেনে সবার সামনে। আর ঘটনাটা এরপর যা ঘটল তাতে আমি সহ সেখানে যারা ছিলাম তারা হতভম্ব হয়ে গেলাম সেই আকস্মিকতায়। মোড়লের ছেলেবউ বাস থেকে নামছিলেন আর তার ই সাথে ধাক্কা লাগে হাবিলদারের। ভদ্রমহিলা পড়ে যেতে ই হায় হায় করে উঠে জনতা! কারণ তিনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন কিন্তু পড়ে যাবার পর ই তার পেটে লুকোনো কোকেনের একটা থলে বেড়িয়ে তার অনেকটা ছড়িয়ে পড়ল রাস্তার সেই কাদাজলে!
আনিস ও দেখি বিষ্মিত চোখে আমার কথা তে অবাক, আমিও তার চেয়ে কম অবাক হইনি।
একজন হাবিলদার চট করে ভদ্রমহিলা কে তুলে তার হাতে দড়ি বেঁধে আমাকে বললেন, স্যার! আপনি যা করেছেন সেটা এবার আমরা ই শেষ করবো।
আমি আনন্দে শুকনো হাসি দিলাম, আমার বাস ছেড়ে দিবে।


(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ন কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। যদি মিলে থাকে তা একান্ত কাকতালীয়)

সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৯

ছোটগল্পঃ বন্ধু

কেমন আছিস?
প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়নি অন্তু, জানালায় মাথা রেখে বাইরে সোডিয়াম আলোতে হারিয়ে যাওয়া গাছগুলোকে একনজরে দেখছিল সে। ঈষৎ হলদে আলোর মাঝে অন্ধকারের এক অবিচ্ছিন্ন এক মেলবন্ধন সেখানে।
কিরে? প্রশ্নটা আবার এলো,
মাথা টা কিঞ্চিৎ বা'দিকে ঘুরিয়ে দেখল শ্যাম এসেছে, শ্যাম পাল। ওর সবথেকে কাছের বন্ধু।
ভালো! ছোট্ট করে উত্তর এলো।
-একটা শীত শীত ভাব না বাইরে, কেমন একটা গন্ধ ও আসছে। কি ফুল?
-বেলী!
এক নিঃশ্বাসে ঘ্রাণ নিলো শ্যাম। আমার প্রিয় ফু.. কথাটা শেষ করতে পারলো সে, বাধা দিয়ে অন্তু বলল প্লিজ তুই আর আসিস না এখানে। আমার পছন্দ না। তুই থাকলে আমার ভাল লাগে না। তুই অসহ্য যন্ত্রণা! তুই কেন জোরাজুরি করতে গেলি আমার সাথে? দেখছিলি তো প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল!
শ্যাম বিরক্ত হয়েছে কিনা বোঝা গেলো না, ওর মুখ এখন আধাঁরে-আলোতে হারিয়ে। সেখান থেকে কথা বলল,
-আমরা কিন্তু ভাল বন্ধু অন্তু, সেই স্কুল থেকে। তুই যেদিন চক্রবর্তী স্যারের ড্রয়িং করিস নি, সেদিন কে একেঁছিল তোর খাতায়? ছাদে কে তোর সাথে ফুটবল খেলেছে ঝুম বৃষ্টিতে?
অন্তু মাথা নিচু করে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে.. ভেজা গলায় বলল তবুও আসিস না।
শ্যাম পাল নিশ্চুপ, কোন কথা বলল না। সম্পূর্ণ নীরবতা এই মুহূর্তে।
বুনো একটা পাখি হঠাৎ ডেকে উঠল পাশের সরু নারিকেল গাছে, সেখানে আলো নেই। পাশাপাশি বাড়ি গুলোতে শ্মশানের মতন শব্দহীন।
অন্তু ফের বাইরে তাকিয়ে রইল, কিন্তু সে এখন এখানে সশরীরে থাকলেও তার মস্তিষ্ক এখানে নেই। সে এখন স্কুলের মাঠে, গোলকিপার।
প্রতিপক্ষ দলের স্ট্রাইকার এগিয়ে আসছে অনেকগুলো ডিফেন্ডার কে কাটিয়ে, কাছাকাছি এসে সে অন্তুকে দেখে হাসি দিল। শর্ট নিল সজোরে, বল জাপটে ধরতে গিয়ে সেটা লাগল মাথায়, এরপর দৃশ্য পরিবর্তন দ্রুত। অন্তু এখন শ্যামদের বাসায় ছাদে ফুটবল খেলা চলছে।
পারবি না! পারবি না!  বলে ভেংচি কাটছে শ্যাম। অন্তুর পছন্দ হলো না। ওর শার্টের জামা খামচে ধরতে গিয়ে পিছলে গেলো শ্যাম। কিছু একটা ভারী পড়ে গেলো চারতলা ছাদ থেকে।
আচমকা ভয়াবহ চিৎকার দিয়ে সম্ভিত ফিরে পেলো অন্তু!
দরজা ঠেলে অন্তুর বাবা-মা ঘরে এলেন, বাবা! ভয় পেয়েছিস? কি হয়েছে?
অন্তু দেখলো, ঠিক যেখানে এতক্ষণ শ্যাম ছিল সেখানে সে নেই।
মা..মা আ আ.. আমার শীত লাগছে..
অন্তুর মা গায়ে হাত রাখলেন, অন্তুর জ্বর এসেছে।
অন্তুর বাবা ফোনে ডায়ল করলেন, ডাক্তার শুভ্র! একটু ইমারজেন্সী! আসতে পারবেন এখন। উত্তর এলো, হ্যাঁ।
ডাক্তার চলে যাচ্ছিলেন, উদ্বিগ্ন বাবা-মা তার হাত চেপে ধরলেন, এরোটোমেনিক ডিল্যুশনস! কাছাকাছি থাকুন। পারলে দূরে কোথাও ঘুরে আসুন। এখানে থাকলে উন্নতি হওয়া টা কঠিন। যে বেঁচে নেই তাকে নিয়ে ই একটা কাল্পনিক জগতে বাস করছে অন্তু। সিঁড়ি ধরে এগিয়ে চললেন ডাক্তার।



(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক, বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই। যদি।মিলে থাকে তা একান্ত কাকতালীয়)

রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৯

গল্পঃ অভিশাপ

দুপুর আড়াইটা,
            ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে ই টের পেলাম ফোনে অনেক টা সময় আমি কাটিয়ে ফেলেছি। এদিকে হাতের কাজ আজকে নেই বললে ই চলে। ঈদের পর ছুটি কাটানোর লোভ তাই আর সামলাতে পারলাম না। বেড়িয়ে পড়লাম রংপুরের পথে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বন্ধু যার নাম শুনে অনেকে হেসে ফেলবে, সেই কুমোর নন্দীর বাড়ি তে যাবো বলে বাসে উঠে পড়লাম।
বাসে করে লম্বা সফরে দুই ধরনের ব্যাপার দেখা যায়। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ঝিমুনি আসে নয়তো, আশেপাশে কারো সাথে জমাটি গল্প বেধে যায়। তারপর যদি সে হয় সমবয়সী, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
 যেকোন সফরে আমার সবসময়ের সঙ্গী হচ্ছে ছোট্ট লেদারের ব্যাগ। তাতে নিত্য ব্যবহার্য কিছু জিনিসপত্র আগে থেকে ই ভরা থাকে। কুমোর নন্দী আমার লেখার ফ্যান এবং বন্ধু, তার সাথে আমার পরিচয় বছর দুই আগে। আমাদের প্রেসের একটা কুইজ প্রতিযোগিতা নিয়ে তার সাথে প্রথম ফোনালাপ। ভদ্রলোক কুইজ জিতে ই আমাদের কাছ থেকে নগদ পাঁচশত টাকা জিতে নিয়েছেন ততক্ষণে। তবে তার একটা কথাতে তখন আমার তাকে বেশ মনে ধরে গেলো, জানি না অনুমান থেকে কিনা - তিনি বললেন, " আপনি কি বিভূতিভূষণ? হরোর গল্পের এডিটর? "।
আমি ততক্ষণে অবাক, বিমোহিত এবং একটু যে খুশি হয়েছি তা অস্বীকার করবো না। আমি যদিও ফোনে প্রথমে বলেছিলাম, " এটা কি কুমোর নন্দীর নম্বর? আমি মাসিক হরোর পত্রিকা থেকে বলছি, উনি একটা কুইজ জিতেছেন আমাদের তরফ থেকে সেটা কনফার্ম করতে চাইছি। "
তবে উনি আমার নাম ধরে ডাকায় সেদিন অনেকটা খুশী হয়ে ই পরিচিত হলাম তার সাথে। আমার সাথে সেই আলাপ, এর পরে ব্যস্ততা আর কাজের চাপে তার নিমন্ত্রণ রাখতে পারি নি। আজ তাই অতিথি হতে যাচ্ছি।

বাসে গায়ে পড়া ভীড় নেই। প্রায় সিট ই ফাঁকা। দেখা যাচ্ছে একটা জোড়া সিটের একপাশে একজন অন্যটি ফাঁকা। আমার সিট টা পড়েছে ড্রাইভারের সারিতে, মানে ডানদিকের কর্ণারে মানে ই-২। বাস ছাড়ার আগে ফ্রেশ হয়ে দ্রুততম সময়ে বসে গেলাম সিটে। সবার টিকিট চেক করে ই বাস ছাড়ল। পেছনে যাতে কোন যাত্রী যাতে মিস না হয়ে যায়।
আমি কানে হেডফোন দিয়ে একটা রবীন্দ্রসংগীত বাজাতে যাবো, এমন সময়ে ঠিক পেছন থেকে একজন কাঁচাপাকা চুলের মাঝবয়েসী ভদ্রলোক বাসের গতির বিপরীত দিকে কসরত করে এলেন আমার পাশে। বসতে পারি ভাই! কেউ যদি না থাকে মানে ফাঁকা সিট!
আমি বললাম, হ্যাঁ বসুন। বলা শেষ হতে না হতেই ভদ্রলোক ঝট করে চেপে বসে গেছেন হুড়মুড়িয়ে। তার হাতে খবরের পত্রিকা মোড়া একটা তক্তা সাইজের চারকোণা একটা জিনিস। সিটে বসার পর সেটা কোলে তুলে ই রাখলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে কিছু বললেন হাসিমুখে। আমি তার হাবভাব খেয়াল করতে করতে কানে হেডফোন গুজে ফেলেছি।
কান থেকে সেটা আংশিক খুলে বললাম, কিছু বললেন?-জ্বী, অনেক ধন্যবাদ!
উত্তরে হালকা মাথা নেড়ে, আমি মৃদ্যু হেসে বসার সিট টাকে একটু হেলান করিয়ে আয়েশি ভঙ্গীতে চোখ বুজতে চেষ্টা করলাম।

শো শো শব্দে উত্তাল বাতাস এফোঁড়ওফোঁড় করে পার হয়ে যাচ্ছে বাসের ভেতর টা। তাই এতক্ষণ যা একটু ভ্যাপসা গরম ছিল সেটা কেটে গেলো নিমেষে। কানে সুমধুর রবীন্দ্রসংগীত বাজার দরুণ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু মাঝপথে চেকিং এর যন্ত্রণায় সেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। বাইরের দেশে এমন হয় কিনা জানি না, এদেশে বারবার চেকিং চলে। যাত্রী না চোর সেটা বোঝা মুশকিল।
দেখলাম আমার পাশের ভদ্রলোক বেশ আয়েশি হয়ে আছেন। তার হাতের জিনিস টা দিব্যি কোলে রেখেছেন।
ঘুম আসছিল না দেখে এবারে নিজে ই তাকে ডেকে বললাম, " রংপুর কি আপনার বাড়ি? "উনি মাথা না সূচক নাড়লেন।
 -বেড়াতে যাচ্ছেন? (সেখানেও দিব্যি না।) তারপর বললেন জরুরী একটা কাজ আছে। কি কাজ সেটা খুলেও বললেন না।
গল্পের খাতিরে নিজে ই গেছিলাম এগিয়ে কথা বলতে, যেটা আমি কখনো করিনা। তবে তাকে ই বেশী রিলাকট্যান্ট লাগলো।
তবুও বললাম,আচ্ছা, তাহলে হাতের জিনিস টা নীচে, না হলে পাশের ফাঁকা সিটে রেখে আয়েশ করে নিন। অনেক লম্বা যাত্রাপথ, বুঝলেন!
উনি রাজী হলেন না, বুঝলাম আমার একটা কথাতেও যখন তিনি পাত্তা দিলেন না তখন আমার চুপ করে বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখা ই বরং ভালো হবে।
ঘুরে বাইরে দেখছি কি দেখিনি, ভদ্রলোক সন্তর্পণে আমার কাঁধে আঙুল ছুঁয়ে ডাক দিয়ে বললেন।
-এর নাম জানতে চাইবেন না প্লিজ, এটা ভালো জিনিস নয়! এর নাম জানা বারণ।
আমার একটু কৌতূহল হলো পাশাপাশি হাসিও পেলো। পাগল নাকি?
আমি হাসবো কি হাসবো না, ভেবে অট্টহাসি তে ফেটে পড়লাম। আমি নিজে হরোর লিখি, যদিও পেট চালাতে আজেবাজে লিখতে হয় তবে এই লোকটি এমন কথা বলছে যাতে একটা গূঢ় ভয় আছে, যা নিয়ে কথা বলা বারণ।
আমার হাসির শব্দে সুপারভাইজার পেছনে এলেন, বললেন, কোন সমস্যা স্যার?আরে না না, তেমন কিছু না। আমরা আনন্দে হাসছি। (বললাম আমি)
সুপারভাইজার চলে যেতেই অনেকটা চেপে ধরলাম লোকটাকে।
 বললাম, "আপনি মজা করছেন? এতে এমন কি ই বা আছে? যা নিয়ে কথা বলা যাবে ই না"
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। কেবল তার ডান হাতের তর্জনী টা নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে ইশারা করলেন চুপ করতে। তারপর ইশারা করে জানতে চাইলেন আমার কাছে কাগজ, কলম আছে কিনা?
আমার লেদারের ব্যাগে কাগজ কলম থাকে সেটা ই বের করে এগিয়ে দিতে না দিতে তিনি আঁকাবাঁকা হাতের কাঁপন দেয়া চলন্ত বাসে কি একটা দ্রুত লিখে আবার তর্জনী তার ঠোঁটে রেখে না সূচক কিছু একটা বোঝালেন।আমি দ্রুত লেখায় চোখ দিলাম, সেখানে লেখা এটা আয়না। এতে যে আছে তার নাম উচ্চারণ করলে বিপদ আসন্ন।
এবার উত্তরে জানতে চেয়ে আমি কাগজে লিখলাম, তাহলে এটা কি? তারপর লেখাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। উনি পড়ে সেটার উত্তর লিখলেন। তার সংক্ষেপ এমন, আয়না টা তার একটা কালেকশন। উনি আসলে এন্টিক ব্যবসায়ী। জুতা থেকে শুরু করে পুরনো ধাতব মুদ্রা সব নাকি তিনি ঢাকা তে বিক্রি করেন। তবে এই আয়না টা নিয়ে বেঁধেছে আপত্তি। এই নিয়ে তিনি এটা যাদের কে বিক্রি করেছেন তারা ই একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ফেরত দিয়ে গেছেন। এক খদ্দের তো সেদিন এসে ই বললেন, তিনি রাতে জেগে পড়াশোনা করেন। রাতে আয়না টা ড্রয়িংরুম এ ছিল। হঠাৎ পানি পিপাসা লাগায় পানি খেতে এসে দ্যাখেন আয়না উল্টে আছে। ড্রয়িংরুমে একটা ডীম আলো জ্বলে যাতে আলো থাকে এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও হয়। তিনি আয়না উল্টো থেকে সোজা করে ঘুরে যখনি ফিরতে গেছেন তখনি একটা কালো ছায়া তার সামনে হঠাৎ করে এসে পড়ে।ভয়ে আঁতকে উঠেন তিনি। সাথে সাথে জ্ঞান হারান। তারপর?তিনি ডাক্তারের কাছে যান, প্রথমে ভেবেছিলেন রাত জেগে জেগে তার হ্যালুসিনেশন হয়েছে। পরে দেখা গেলো সব ঠিক। আয়না টা অভিশপ্ত। আমি অনেকটা অবাক হয়ে ই কাগুজে কথোপকথনে জানতে চাইলাম, আপনি যদি জেনে ই থাকেন এটা অভিশপ্ত তাহলে ভেঙে ফেলছেন না কেন?
ভদ্রলোক এতে আর কিছু লিখলেন না, মাথা নীচু করে বললেন " চেষ্টা করেছিলাম ভেঙে ফেলতে। "
বলতে লাগলেন, " এত সমস্যার পর নিজের বাসায় এনে রাখি। উদ্দেশ্য ছিল ভেঙে ফেলবো কিন্তু পারি নি।" (কথাগুলো এবার মুখে ই বলছেন তিনি)
তারপর একটু ফুঁপিয়ে বললেন, এটার কারণে আমার সংসারে ও বিপদ এসেছে। আমার স্ত্রী হঠাৎ করে পিছলে পড়ে হাটুতে ব্যথা পান।
মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম, নাতি টা আয়না রাখার ঘরে বল কুড়োতে গিয়ে এখন আবোলতাবোল কথা বলে। সম্ভবত কোন কিছু দেখে মারাত্মক ভয় পেয়েছে।
একদিন রাতে আমরা সবাই ঘুমে। কোন এক কারণে আমার ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে একটা সিগারেট খেতে বাইরে এলাম। বিশ্বাস করবেন না বললে, একজন মহিলা ঠিক আমারি পাশ দিয়ে বেড়িয়ে পাশের ঝোপে হারিয়ে গেলো অন্ধকারে। আমার হাতের সিগারেট ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গেছে। আমি আমার স্ত্রী আর কাজের ছেলেটা ছাড়া যেখানে আমাদের ঘরে আর কেউ থাকে না জানেন!
দোতলা বাসা। নীচে আগে যারা ভাড়াটে ছিল তারা বাড়ি ও ছিল না।
গায়ের লোম শিউরে উঠা ব্যাপার। গা ঝটকা দিয়ে দ্রুত বাসার দরজা শক্ত করে আটকে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তারপর একটা শব্দে যেন গা অবশ হয়ে গেলো।
কেউ দরজা খুলে ঘরের ভেতর এলো তারপর আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। ধীরেধীরে কারো পায়ের শব্দ শুনলাম আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘরে কেবল আমি আর আমার অসুস্থ স্ত্রী শুয়ে। স্ত্রী ঘুমে অচেতন।
একটা ভারী পুরুষালী গলা বলল, " কি রে? দেখলি না আমি বাইরে গেলাম! আটকে এলি কেন? আমি কি ঘরে আসবো না! এরপর এমন করবি না। ফলাফল ভালো হবে না। "
তারপর বললেন, এক অঘোরীর বেশ নাম শুনেছি। আজ সেখানে ই যাচ্ছি। এটা জমা দিয়ে আসব। রিচ্যুয়াল যা করার তিনি করবেন বলে কথা হয়েছে। আপাতত মুক্তি চাই ভাই!
ভদ্রলোকের কথা তে আমি অবাক হবো কিনা ভাবছি, কিন্তু আয়নাটা?...
লোকটা আমার দিকে চমকে তাকালেন! কেন তাকালেন বুঝতে দেরী হয় নি, কারণ আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে গেছে " আয়না "
আর আমার প্রশ্ন টা করেও শেষ করতে পারি নি।
 বাসের ভেতর তীব্র একটা ঝাঁকুনি খেলাম। মনে হলো বাসের পেছন থেকে খুব জোরে কেউ একটা ধাক্কা দিয়েছে। এত জোরে ধাক্কা লেগেছে যে যাত্রীরা হুড়মুড় করে বাতাসে উড়া মুড়ির মতন সামনে ছিটকে গেলো। আমার পাশে বসা সেই ভদ্রলোক এবং তার অভিশপ্ত আয়না আলাদা হয়ে গেলো এবার। দেখলাম, বাস টা আর রাস্তায় নেই! আমাদের কে নিয়ে সেটা উড়ে পড়ছে রাস্তার বাইরে গভীর খাদে। শেষ যতটা জ্ঞান ছিল তাতে টের পেলাম আমি জানালার কাঁচে ধাক্কা খেয়েছি, কপাল কেটে বেড়িয়ে গেছে লাল রক্ত!
পাশের লোকটা কে আর দেখতে পাইনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।
জ্ঞান ফিরল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাত-পা সমানে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বেঁচে আছি যেনে একটু স্বস্তি পেলাম।
নার্স এসে আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে বলল, কেমন আছেন বিভূতি?  আপনার পিঠে অসংখ্য কাঁচ ঢুকে গেছিল। আপাতত, সেগুলো অনেকগুলো বের করা হয়েছে। চিন্তা করবেন না।
বললাম, একটা ফোন করে দেবেন আমার হয়ে?
উনি মাথা নেড়ে বললেন অবশ্যই!
ফোন দেয়া হলো, রংপুরের বন্ধু কুমোর নন্দী কে। খবর শুনে উনি এলেন। আমাকে এই অবস্থায় পেয়ে অনেক মর্মাহত দেখালো তাকে, আমাকে সাহস এবং সান্ত্বনা দুটোই দিলেন।
তিন দিন পর জানলাম, সেই রংপুরগামী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসে থাকা ৩০ জন নিহত এবং আরো ১১ জন আহত। সেই ১১ জনের মাঝে আমি একজন। তবে খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই আয়না বহনকারী ভদ্রলোক বাঁচেন নি। উনি স্পট ডেড। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
রিলিজ করার দিন নিজে হেঁটে হেঁটে ই ফ্রেশ হতে গেলাম। হাসপাতালের বেসিনে মুখ ধুঁয়ে নিজের চেহারা দেখতে যাচ্ছি হঠাৎ দেখলাম প্রতিবিম্ব তে সেই ভদ্রলোক!
আমাকে দেখে বললেন, চিন্তা করবেন না! আমি আপনাকে দোষ দেবো না। আপনি ভালো থাকুন।
ঝটকা খেয়ে সরে এলাম। নিজের মুখে কয়েকবার হাত রেখে ফের আয়না তে তাকালাম। নাহ, আমাকে ই দেখা যাচ্ছে।
ঘটনার অনেক পরে পাবলিক লাইব্রেরি হয়ে ফিরছিলাম পায়ে হেঁটে। সেখানে দেখলাম পুরোনো অনেক কিছু বিক্রি হচ্ছে। চোখ গেলো যেটায় তাতে আমার শরীরের সমস্ত লোম মুহুর্তে খাড়া হয়ে গেলো।
এইতো সেটা! সেই অভিশপ্ত.....

(সমাপ্ত)

বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৯

গল্পঃ তোমার কে?

(১)

তিথিদের পাশের বাসায় নতুন যে ভাড়াটিয়া টা এলো সে একটা ব্যাংকে জব করে। দেখতে ভয়াবহ স্মার্ট এবং সুন্দর।
তিথির কাছে স্মার্ট মানে আলাদা কিছু, ঐ তো চুলে জেল ছেঁড়াখোঁড়া জিন্স পড়া, সানগ্লান পড়া এমন কেউ না। যার চেহারায় মার্জিত ভাব আছে, আচরণে যথেষ্ট ভদ্র, বিনয়ী সেই মানুষ টি হচ্ছে আসল স্মার্ট।
সেই তালিকানীতির কড়াকড়ি তে সেই লোকটি স্মার্ট তো নয় আরো অনেক বেশী কিছু। একে কোন মেয়ে ই না অন্তত করতে পারবে না যদি না সে খুব বেশী ফ্যাশন ওরিয়েন্টেড না হয়ে থাকে। তাই বলে ভদ্রলোক কে রবীন্দ্রনাথ সালের কেউ বলে ধরে নেয়া উচিত হবে ই না। ভদ্রলোক কে দেখে ই একটা নান্দনিকতা টের পাওয়া যায়। তিথি তাই পড়ার টেবিলে বসে, বইয়ের তাকের আড়ালে মাঝেমাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়ে লোকটা কে দেখে।
ভদ্রলোক ফেরেন ঠিক টাইম করে। ঘড়ি ধরে না হলেও একেবারে সময়মত। সন্ধ্যে ৮ টা থেকে রাত ৯ টা। এসেই রান্না করেন, মনে হয় ডিমভাজি তার খুব ই প্রিয়। এটা তিনি রেগুলার করেন। ভাজতে ভাজতে দুই থেকে তিনবার ঘড়ি দেখেন এরপর ই ছুটে যান টিভিসেটের সামনে। বেশ জোরে নিউজ দেখেন।
তিথির জানালা টা ভদ্রলোকের জানালার ঠিক পাশাপাশি, যাকে বলে লাগোয়া দেয়াল তবে অনেক ফাঁকা।
জানালা দিয়ে পড়ার টেবিল ধরে পাশের ঘর টা আলগোছে দেখা যায়। এজন্য খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। তিথির জানালার পর্দা টা একপাশে সরিয়ে নিলে ই থাই গ্লাসের ওপারে বেশ ভালো দেখা যায়।
এই প্রথম লোকটা কে দেখে তিথির বুক দুরুদুরু করে উঠল। এমনটা এর আগে কখনো হয় নি। হবে ই বা কেন?
ক্লাসমেট আতিক, ইরতিজা, আনিস রেগুলার পেছনে পড়ে ছিল। ফোন, মেসেজ এমনকি নিজের ক্লোজ বান্ধবী আনিয়া কে ও ওদের একজন প্রায় হাত করে ফেলেছিল। ভাগ্যিস ভাই বলে ছাড়া পেয়েছে তিথি।
সে যাই হোক, তিথি এখন এটা নিয়ে নিশ্চিত যে ক্লাসমেট কেউ আর তাকে প্রেম নিবেদন করবে না।
তিথি!! আমার চা টা দিয়া যা তো মা!
তিথির মা নুসরাত বেগম, এই বাড়ির কড়া বাড়িওয়ালী। রেগুলার চা খান সেটা অবশ্য কাজের লোকের হাতে নয় বরং তার মেয়ে তিথির হাতে। এককালে ডাক সাইটে সুন্দরী ছিলেন বেগম নুসরাত। এলাকার অনেক ছেলেপেলে তার প্রেমে দিওয়ানা ছিল। বাড়ি ছিল পুরান ঢাকায়। বাবা ব্যবসায়ী এখন ও আছেন দিব্যি। রোজ সকালে ফোন করে মেয়ের খবর নেন। নাতনী তিথির বফ তিনি। নানুজানু বলেই তিথি ভুলিয়ে ভালিয়ে নানার অর্থসম্পদে হ্রাস ঘটিয়ে ফেলেছে এতদিনে।
একমাত্র নাতনী বলে কথা! তবে তিথির মামা কে কোন ছাড়া দেন না নানুজানু জলিল সাহেব।
তিথি!!
কয়েকবার ডাকার পর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তিথি চায়ের কাপ হাতে ঘরে এলো। কি রে মা? এত্ত দেরী করছস কেলা? জানস ই তো তর হাতে চা না খাইলে ভালা লাগে না।
তিথি হাসল আবার একটু অভিমান করে বলল, আমি না থাকলে কে চা করে দেবে শুনি?
তিথির মা চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, তর লাইগা ঘরজামাই আনমু দরকার হইলে, একমাত্র হীরামানিক আমার!
আম্মুকে জড়িয়ে ধরে তিথি বলল, যদি কেউ ঘরজামাই না হয়!
আরে হইব না ক্যালা? হইতে ই হইবো। অখন যা আমি সিরিয়াল টা দেখি। তিথির মা পুরান ঢাকার মেয়ে, তার বাবা ছিলেন জাদরেল ব্যবসায়ী। ব্যবসায় লস খেয়ে সেটা এক সপ্তাহে আবার তুলে আনেন নি এমন কখনো হয় নি। চার-চারটা ছেলেমেয়ে কে সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কখনো মাথা নত করবি না। জিতে আসবি। তাই সহজে হার না মানার পাত্রী তিনি নন।
তিথি রুমে চলে এলো। এখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা পাশের লাগোয়া বিল্ডিং থেকে নিউজের আওয়াজ আসছে, সেই সাথে ডিম ভাজার পোড়া গন্ধ!
তিথির ভীষণ হাসি পাচ্ছে এই দেখে সেই ভদ্রলোক পা নাচিয়ে নিউজ দেখছেন, এদিকে চুলোয় তার ডিম পুড়ছে।


(২)

আজ ইউনিভার্সিটি থেকে আসার পথে লোকটির সাথে তিথির দেখাদেখি হলো, লোকটি লজ্জা পাচ্ছে তিথি কে দেখে। মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে সে মেয়ের চোখে ধরা পড়বার পর চোখ নীচু হয়ে আনত হয়ে যাওয়া হয়ত ভুল কিংবা অসম্ভব কিছু নয় যদিও এই ব্যাপার টি এখন একেবারে দেখাই যায় না কোন পুরুষের চোখে। ভদ্রলোক তিথিকে যখন দেখছিলেন, আড়চোখে তিথিও তাকে দেখছিল। ব্যস, চোখাচোখি!
তিথির হাসি পেলো। তিথি অন্তত যেভাবে তাকাল তাতে আজকালকার ছেলেরা এগিয়ে এসে আগ বাড়িয়ে কথা বলতো।
ভদ্রলোক তেমন কথা বলার মত বলে মনে হলো না। তার হাতে বাজারের থলি। আজ শনিবারের ছুটি টা কাজে লাগাচ্ছেন। তিনি অবশ্য লজ্জিত, মনে হচ্ছে চোখের কাছে তার এই ধরা পড়ে যাওয়া অনেকটা আত্মসম্মান হারানোর মতন যদিও সেই ধরা পড়া চোখে বাজে কোন দৃষ্টি ছিল না।
কোন কথা হলো নানা দুজনের, তিথি চলে এলো। ভদ্রলোক নিজেও দ্রুত চলে গেলেন।
কাল প্রেজেন্টেশন। এটা একটা ঝক্কি আবার একটা এক্সসাইটমেন্ট ও বটে।
ডিপার্টমেন্ট এর স্যার সবাইকে টাইম মত যেতে বলেছেন। কোন ভুল করা যাবে না।
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে তাই পড়ে থাকা প্রেজেন্টেশন নিয়ে বসতে হলো ওকে। তবে নাকে এসে গন্ধটা লাগল সেটায় মুগ্ধ না হয়ে পারা গেল না। চিকেন টা যা হচ্ছে নিশ্চই সেই ভদ্রলোক!
ঠিক তাই।
রান্নাঘরে ধোঁয়া দেখা গেল। সেখানে ই রান্নাচড়ানো।
এসব বাদ নিয়ে তিথি ভাবল, লোকটা সত্যিই ভাল রান্না পারে।
আগে এখানে যারা থাকতো ওরাও ব্যাচেলর ই ছিল। প্রতিদিন দাঁত মাজার ভান করে হ্যাংলা ষাঁড়ের মত দাঁত কেলিয়ে এদিকে তাকিয়ে থাকতো। মাঝেমাঝে তিথিকে দেখেই গান ধরতো, " সুন রাহা হ্যায় না তু... " রাগে তিথির গা রিরি করতো।
নালিশ না করলে আজকেও তাদের দেখা যেতো দাঁত কেলাতে।
উফ, অসহ্য!
দুপুরবেলা কারেন্ট টা গেল। ভাল গরম। জানালার পর্দা যতটা ভেজানো ছিল সেটা একটু সরিয়ে দিতে ই হলো তিথিকে। কিন্তু জানালায় গিয়ে ই গরমের মাঝে তিথির মেজাজ আরো গরম হয়ে উঠল।
মেয়ে? ঐ বাসায়?
মেয়েটি বেশ সুশ্রী। লাল রঙের একটা সেলোয়ার কামিজ পড়া। হাসিহাসি মুখে রান্নাঘরে এসে ই মাংস টা নাড়া দিল। ভদ্রলোক কে দেখা গেল গোসল সেরে বাইরে আসতে মাথা মুছতে মুছতে। ব্যাচেলর বাসায় মেয়ে?
তিথির মনে আগুন ধরে গেল এই তোমার ভালোমানুষি! কলির কেষ্ট... আরো কিছু মনে মনে বলে গেলো তিথি সেসব ভাষা দূর্বদ্ধ। লেখায় আনা ক্রমশ জটিলতর। সব ছেলেরা ই এমন, তিথির প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এজন্য দূর থেকে কাউকে ভালো লাগতে নেই। তাতে কষ্ট বাড়ে কিন্তু আসলে ই কি মাঝেমাঝে আমরা লজিকে পড়ে ভাবতে চাই। হয়তো চাই কিন্তু হয়ে উঠে না। আমরা তখনি হেরে যায়, তিথিও সম্ভবত হেরে গেলো মনের কাছে, লজিকের মারপ্যাঁচে।


(৩)
প্রেজেন্টেশন ভাল হলো না। অথচ তিথি বরাবরি অনেক ভাল ছাত্রী। স্যার অনেকটা আফসোস করলেন। সামনে ভাল করতে হবে বলেও উপদেশ দিলেন।
বাড়ি ফিরতে দেরী হলো না আজ কে। প্রেজেন্টেশন শেষে সবাই বসে আড্ডা দিলো, আইস্ক্রিম খেলো।  তিথির কিছু খেতে ইচ্ছে করলো না, কথাও কারো সাথে বলল না ভালো করে।
আরিন কেও কিছু বলল না। তিথি চাপা স্বভাবের। তাই বন্ধু-বান্ধব খুব কম। যা হয় আরিন নয়ত মা। আব্বু বেঁচে থাকলে কারো সাহস হতো না ওকে জোর গলায় দুটো কথা বলার।
তিথির আব্বু আর্মি কর্নেল ছিলেন। একটা সেনা কনভয়ে থাকাকালীন মারাত্মক ভাবে আহত হন পরে মারা যান। তিথি তখন ক্লাস সেভেনে।
আব্বুকে সে খুব মিস করে। আব্বুর কথা বলে পড়লে নিজের ঘরে ঢুকে জানালা দরজা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে চুপিচুপি কাঁদে।
আজ ঘরে ফিরে ই তিথি সব কিছু বন্ধ করে দিলো।
নুসরাত বেগম দেখলেন তার মেয়ে হনহন করে তার সামনে দিয়ে এসেই রুমে ঢুকে গিয়ে সব বন্ধ করে দিল।
তিনি এগিয়ে এসে দরজার কাছে নক করতে গিয়েও করলেন না। তিথির কষ্ট টা অনেকটা বরষার কালো মেঘের মতো। মুষলধারার মত চলে থেমে যায়।

বিকেলবেলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিথি। মেঘ কেটে গেছে। রোদ এখনো মনের উঠোনে আসেনি তবে ভারী আকাশের মত থমথমে এখনো।
এই যে!  শুনছেন?
তিথি প্রথমে খেয়াল করেনি। পরে আচমকা সে ভদ্রলোকের দিকে নজর পড়ল।
এই যে! কাইন্ডলি একটা ম্যাচ পাওয়া যাবে?
তিথির আবার রাগ উঠে গেল কিছু না বলেই জানালায় পর্দা টেনে দিল।
ভদ্রলোক অনেকটা আঁতকে উঠলেন হয়তো।

(৪)

এক সপ্তাহ পর, বাসায় নীচে তিথির সাথে ভদ্রলোকের দেখা। ভদ্রলোক সেদিনের ব্যবহারে হয়ত অবাক এবং মাইন্ড ও করেছেন। তাই তিথি অনেকটা নিজে ই এগিয়ে এসে বলল, সরি! সেদিন আসলে..
আরে না না, ঠিকাছে। আমার ঠিক সেভাবে জিজ্ঞাসা করাটাও উচিত হয় নি।
তিথি নিজের বাসা আঙুলে দেখিয়ে বলল, এই দেখছেন নুসরাত ভিলা। এটা আমাদের বাড়ি একদিন আসুন আম্মু খুশী হবেন।
ভদ্রলোক যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করে ই নিজের বাসায় চলে গেলেন।
মেয়েটিকে সেদিন দেখার পর আর খুব একটা দেখা যায় নি। মেয়েটি কি তাহলে ভদ্রলোকের আত্বীয়? না.. ধুরছাঁই কি সব ভাবছি।
তিথি!! আয় তো মা..
তিথি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তখনি জানালার বাইরে চোখ পড়ল। আবার সেই মেয়েটি!
দুজনে বসে টিভি দেখছে আর চা বা কফি কিছু একটা খাচ্ছে।
তিথির এবার মনখারাপ হলো না, ওর মনে হলো ভাল মানুষগুলো পৃথিবীতে একেবারে নগণ্য, নয়ত এঙ্গেজড!
মায়ের চা করতে হবে। তিথির আর ভাবার সময় নেই এখন সামনে সেমিষ্টার ফাইনাল।
তিথি জানলা বন্ধ করে, পর্দা টেনে দিলো। নাহ, আর না। এমন একজন লোক কে বারবার দেখে যাওয়ার কোন মানে হয়না। তিনি বিবাহিত।
বৌ দূরে থাকে তাই মাঝেমাঝে এসে দেখা করেন।
তিথির পরীক্ষা ছিল।
পড়াশোনা তে ব্যস্ত ছিল খুব, ইচ্ছে করে ই আর জানালা খোলে নি তার পরদিন থেকে। লজিকে বেঁধে রেখেছে নিজেকে।
পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো সেদিন ভারী গানের আওয়াজে ঘুম ভাঙল তিথির। এক্সাম শেষ করে সবে ঘরের ভেতর শুয়েছিল ও। তিনি তীব্র আওয়াজে আর থাকা গেলো না। উঠে সেই বন্ধ জানালা খুলে দেখলো, সে বাসার বারান্দায় একটা ছেলে টেনিস বল দড়ি তে ঝুলিয়ে ক্রিকেট ব্যাটে খেলছে।
এই! এই ছেলে! কি নাম তোমার? তিথি উঁচু গলায় ডাকল।
আরিয়ান!
এখানে কবে এলে?
ছেলেটি বলল, এক সপ্তাহ। আমরা নতুন এসেছি। তোমার নাম কি?
আমি তিথি। এটা আমাদের বাসা। এসো একদিন।
কথোপকথনের মাঝে একটু স্বাস্থ্যবান নাদুসনুদুস মহিলা এলেন, কে আপনি?
আমি তিথি, আসলে আপনাদের ঘরে খুব জোরে গান বাজছে। ঘুমোতে পারছিলাম না।
ওহ আচ্ছা! না না, আমার ছেলের কাজ। মহিলা হেসে দ্রুত ঘরে দিয়ে গান একাবারে বন্ধ করে আবার ফিরে এলেন। বললেন, এবার ঠিকাছে?
তিথি একটু হেসে বলল, হ্যাঁ! অনেক ধন্যবাদ। আসবেন আমাদের বাসায়। এটাই আমাদের বাসা। আসলে আমার মা খুশী হবেন।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমরা এক সপ্তাহ আগে এসেছি। অঙ্কুরের আব্বুর বদলীর চাকরী তাই এক জেলা থেকে আরেক জেলা রাতারাতি চলে যেতে হয়।
আরো কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথা হলো দুজনের। তাতে তিথি জানলো আগের ভদ্রলোক চলে গেছেন। তিনি একা থাকতেন। তার নতুন কোথাও চাকরী হয়েছে ব্যস এতটুকু ই জানা গেলো।

(৫)

গ্রাজুয়েশনের দিন তিথি খুব খুশী। আরো তিন বছর কেটে গেছে খুব দ্রুত। ট্রিপল ই পাস করা তিথি ভাবছে চাকরী করবে।
তিথির মা নুসরাত বেগম চাইছেন মেয়ের বিয়ে হোক, দেখভাল করতে কোন হাতে তুলে দিতে চান মেয়েকে। তিথি রাজী নয়। সে স্বাধীনচেতা স্বভাবের। কেন শুধু শুধু পোষা প্রাণীর মতন কারো হাতে বেঁচে থাকতে হবে তিথিকে। তারপর তার ছেলেমেয়ে হলে তাকে মানুষ করা, রান্না করা এসবে ই দিন কাটাতে হবে?
নুসরাত বেগম বলেন, এমতে ই জীবন যাইবো রে মা, দেইখা ল!
তিথি তাতে রাজী হয় না।
নুসরাত বেগমের মাথায় হাত। মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে তাকে হবে ই। এটাই আপাতত তার মিশন।
এর মাঝে তিথির একটা চাকরী হয় ছোট একটা আই টি ফার্মে। বেতন কুঁড়ির কাছাকাছি। নুসরাত বেগম হতাশ। বাপের জমিজমা, ট্যাকাপয়সা এগুলা দেখবো ক্যাডা।
তিথির উত্তর, এতিখানায় দিয়ে দাও!
নুসরাত বেগমের চোখ কপালে, মাইয়া আমার কয় কি!
সব ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু তিথির অফিস থেকে বদলীর আদেশ এলো। তিথির মতন দক্ষ হাতের দরকার তাদের। তাই প্রমোশন দিয়ে এই বদলী। তিথির মা এতে রাজী নন। মেয়েকে তিনি ছাড়বেন না।
'আমার পোলা নাই, আরো কেউ নাই কেবল একটা খালি মাইয়া! আমি পারমু না' নুসরাত বেগম বেঁকে বসলেন। তাকে রাজী করানো মুশকিল। তিথিও হতাশ তবে একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো মা কে ম্যানেজ করার। বলল, বিয়ে করতে তিথি রাজী কিন্তু নতুন জায়গায় তাকে যেতে দিতে হবে।
নুসরাত বেগম চোখ মুছে রাজী না হলেও এবার হয়ে গেলেন।
তিথি চলে গেলো তার নতুন অফিস। যেখানে থাকার জন্য বাসা অফিস থেকে ই করে দিয়েছে। দু রুমের ঘর, একটা ছোট বারান্দা, রান্নাঘর, টয়লেট। মোটামুটি সিঙ্গেল জনের জন্য যথেষ্ট।
অফিসে ছুটতে হলো পরের দিন।
মেইন ব্রাঞ্চের মতন অত বড় না তবে কাজের চাপ প্রচুর। গভর্নমেন্ট একটা প্রজেক্টে কাজ করছে এরা। তাই চাপ আছে।
ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করে ছিল তিথি। এবার ম্যানেজারের রুমে ডাক পড়ল। ঢুকতে ই দুইজোড়া চোখ একে অন্যের উপর কয়েক মুহুর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো।
ম্যানেজার ভদ্রলোক মৃদ্যু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন প্লিজ বসুন!
তিথি সামলে নিয়ে যখন ম্যানেজারের সামনে বসল, তার স্মৃতি ততক্ষণে অনেক পেছনে ঘুরতে চলে গেছে।
ভদ্রলোকের চেহারা কিছুটা বদলে গেছে, হালকা ফ্রেমের চশমা বসেছে চোখে। নাকের নীচে সরু গোঁফ। শার্টের চেক বদলে গেছে এখন সেটা একরঙা। হাতের ঘড়িটা দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘড়ির প্রতি সৌখিন। আঙুলে কোন আঙটি নেই। ফোনেএ রিসিভার কানে তুলে, তিথির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, চা না কফি?
কফি! মৃদ্য স্বরে বলল তিথি।
তিথি শাড়ি পড়েছে আজ, কচুপাতা রঙের। কপালে ছোট সবুজ টিপ। চোখে রিমলেস চশমা। তার উপর কপাল থেকে কয়েকটি চুল এসে আছড়ে পড়ছে বাতাসের তোড়ে।
কেমন আছেন? একটু মৃদ্যু স্বরে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
জ্বী ভাল, আপনি?
এইতো চলছে, অনেকদিন পর!
হ্যাঁ, একটু ঘুরেফিরে অফিস টা একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল তিথি।
আপনাদের বাসায় আর যাওয়া হলো না।
নাহ, আসলে... কিছু বলতে গেছিল তিথি কফি হাতে একজন আসায় তাতে বাধা পড়ল।
নিন! কফি নিন। ভদ্রলোক নিজেও কফি নিলেন।
আমার নাম তো এখনো জানেন না, আমি সীমান্ত। আপনাদের ওখানে যখন ছিলাম তখন আমার সবে জয়েন।
কফিতে ছোট ছোট চুমুক আর কথা শুনছিল তিথি।
পরে, ব্যস্ততা বাড়ল। আর সময় হলো না।
তিথি কি একটা বলতে গিয়ে আবার থামল, সীমান্ত বললেন, সরি! কিছু বলছিলেন?
তিথি কেবল না সূচক মাথাটা নাড়ল। কফিটা কড়া। চিনি কম।
আচ্ছা, আসলে আমি চিনি কম খাই, তাই হয়ত। আপনার চিনি লাগবে বলে বেল বাজাতে গেছিলেন তখনি হাত উঁচু করে, ইটস ওকে বলল তিথি।
-আপনার আম্মু কেমন আছেন?
-এখন ভাল।
-এখানে আসতে দিলেন?
-হ্যাঁ, ঐরকম জোর তো একটু করতে ই হলো।
-আপনার ফ্যামিলি? -তিথি প্রশ্ন টা করলো
-মা আছেন, বাবা নেই। বোন আছে, একটা ভাগ্নে আছে। দারুণ দুরন্ত!
তিথি সম্ভবত অন্যকিছু জানতে চাইছিল, ফ্ল্যাটের সেই মেয়েটির কথা এখনো মনে আছে ওর। তাহলে সে কি!
-কি ভাবছেন? সীমান্তর পাল্টা প্রশ্ন
-না মানে? তিথি আমতাআমতা করছিল।
বিয়ে তো! বলে ই মাথা নীচু করে কফির মগে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, ব্যস্ত মানুষ কে মেয়েরা বিয়ে করে না।
তিথি একটু হাসল।
সীমান্ত বলল, এক মিনিট! কথার মাঝে আসল ব্যাপার ভুলে ই গেছি।
তারপর ড্রয়ার খুলে জয়েনিং লেটার টা এগিয়ে দিয়ে বলল। ওয়েলকাম, মিস তিথি।
থ্যাংকিউ।
ম্যানেজারের রুমের বাইরে আসতে ই মায়ের ফোন, তিথি! ভালা আছোস মা, কোন কষ্ট হয়নাইক্কা?
নাহ মা আমি ঠিকাছি, কি বলবে?
তোর লাইজ্ঞা পোলা দেখছি, ঘটক ওখনো আমার সামনে ই আচে। নাম সীমান্ত, মায়ের এক পোলা, আবার ইঞ্জিনিয়ার। তো পছন্দ হইবো?
তিথি বললো, ঘটক কে বলো ছবি আর বায়োডাটা পাঠাতে। পরে ভেবে দেখছি।
হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিল তিথি।

(সমাপ্ত)

(গল্পের চরিত্র এবং ঘটনা সম্পূর্ন কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো সাথে কোন মিল নেই, মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়) 

বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৯

গল্পঃ অবিনীতা

অঞ্জন! -'নীল পাঞ্জাবি টা তোমায় ভালোলাগে, কেন পড়োনি? আমার যেকোন অনুরোধ ই তুমি রাখো না!'
-'পাঞ্জাবি টা গতকাল পড়েছিলাম, ঘামে দূগন্ধ করছিল তাই কেচে দিয়েছি, তোমার পছন্দের টি-শার্ট টা তো ঠিকি পড়েছি আজ।'
বিনীতা রাগ করলো না খুশী হলো মুখ দেখে অনুমান করা বড্ড মুশকিল।
তবে বারবার পলক ফেলছে বিনীতা, কোন বিষয়ে আংশিক এক্সাইটেড হলে বিনীতা এমন করে। সেই স্কুল থেকে দেখে আসছি! যেবার ক্লাসে দ্বিতীয় হলো সেদিন ই বুঝেছিল অঞ্জন। তবে মেয়েদের মন আকাশের মেঘের মতন, কখন কি হয় পূর্বাভাস দেয়া মুশকিল।
টেবিলে বিনীর হাত পড়ে ছিল, অঞ্জন সে হাতের উপর নিজের হাত লাগল। শীতের দিনের জমাট ঠান্ডার মতন হাতটা ঠান্ডা বিনীর। অঞ্জনের হাত বিনীর হাত ছোঁয়াতে ই হাত টা সরিয়ে নিল বিনী। রাগ কমেনি এখনো।
বিনীতা শাড়ি পড়েছে, শাড়ির রঙ নীলাভ কালো, আলোছায়ার খেলায় একবার শাড়ির রঙ কালো দেখাচ্ছে।
ওরা যে রেস্টুরেন্ট বসে আছে, আজ সেটা অনেকটা ফাঁকা। ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডার চাইল। হ্যাংলা মতন এক যুবক, বয়েস আন্দাজ কুঁড়ি হবে। একটু হেসে অঞ্জন কে বলল,
স্যার? কি খাবেন?
অঞ্জন একবার বিনীতার দিকে তাকালো, বিনীতা বাইরে তাকিয়ে বাঁকা হয়ে বসে আছে অভিমানে। মেয়েটা রেগে গেলে সত্যি সামলে নেয়া মুশকিল! ওকে এখন জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা।
তাই অঞ্জন নিজে ইই অর্ডার দিল।
আচ্ছা, দুটো পপ চিকেন আর দুটো বেভারেজ।
-কোলা?
-হ্যাঁ!
-থ্যাংকইউ স্যার! বলে আড়চোখে দুজনের মান অভিমান দেখে একটু মুচকি হেসে চলে গেলো ওয়েটার।
অঞ্জন ডাকল, বিনী! এই! বিনী..ই..ই শোন!
বিনীতা নাছোড়বান্দা, মুখ যে বাইরে ঘুরিয়ে রেখেছে কখন থেকে আর ফেরানোর নাম ই নেই। বড্ড জেদী আর অভিমানী মেয়ে বিনী।
একবার অঞ্জন কে ঘটনাটা বলেছিল বিনীতা। ক্লাস নাইনের কথা, ক্লাস টিচার বিনীর ম্যাথের খাতা কেটেকুটে একটা জিরো দিয়েছিলেন একটা অংকের জন্য। অথচ সেটা ঠিকি ছিলো যদিও ঠিকভাবে ই বিনীতা সেটা করেছিল তবে ম্যাথ টিচারের সে নিয়ম টা পছন্দ হয়নি তাই খাতায় জিরো দিয়েছে।
বিনীর সে কি জেদ! ম্যাথ টিচার কে বলে বোঝালো, তিনি কনভিন্স না হওয়াতে  নম্বর পেতে গেছে সোজা প্রিন্সিপ্যালের কাছে। টিচারের থেকে নম্বর নিয়ে তারপর ই সেদিন স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে।
স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল সেদিন বিনীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বিনীতা! এত্ত রাগ করে না। আমাদের সবার ই একটুআধটু ভুল হয়, ভুল শুধরে ই চলতে হয় জীবনে।
রাগ, জেদ না অভিমান? অঞ্জন জানে না। অঞ্জনের ধারণা অনেকটা সাধাসিধে। অঞ্জন শান্ত স্বভাবের। খুব একটা প্রতিবাদী চরিত্র নয়। বিনীতা বরং তার উল্টো পিঠে।
তবে বিনীর রাগ কতটা অঞ্জন তার সীমারেখা মেপেও কোনদিন যে দিকভ্রান্ত হবে না সে কথা কেউ ই দিতে পারে না।
রেস্টুরেন্টের নাম সেট আপ লাউঞ্জ, বাইরে সেই নামের সাইনবোর্ড। তাতে আলো জ্বলতে শুরু করেছে।
বিকেলের আলো হাত পা গুটিয়ে এবার ফিরে যাবে পৃথিবীর উল্টো পিঠে বসবাস করা সাদা মানুষদের জাগিয়ে তুলতে।
আধাআধি দুজনে বসে, রেস্টুরেন্টের ভেতরকার ফ্যাকাশে লাল-সবুজ আলোর খেলা চলছে দুজনের মান-অভিমানে।
রেস্টুরেন্ট এ গান বাজছে নীচু আওয়াজে।
 বাপ্পা মজুমদারের, " আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে" আর অঞ্জনের মনে তখন বাজছে " আজ তোমার অনেক রাগ মেয়ে " ভেবে নিজে নিজে ই একটু হেসে ফেলল অঞ্জন। ঝাপসা চোখে বিনীর চোখ গেলো অঞ্জনের দিকে।
-হাসছো ক্যানো? আমার কষ্টে তোমার হাসি পায়?
অঞ্জন দেখল, বিনী পলক ফেলছে দ্রুত, রেগে লালচে দেখাচ্ছে ওকে।
অতি সুন্দর মেয়ের এই একটা বাড়তি সৌন্দর্য, যখন খুব রেগে যায় গালদুটো তে একটা লালচে আভা দেখা যায়। বিনীর ক্ষেত্রেও এখন তাই দেখাচ্ছে।
অঞ্জন সামলে নিয়ে বলল, আরে না না! রাস্তায়, ওই তো রাস্তায় দেখছিলাম জানো। একজন লোক জুতো ফেলে ই দৌড়ে রোড ক্রস করছিল।
-মিথ্যে বলছো? -বিনীতা বলল
-না না! হ্যাঁ। বলে দিল অঞ্জন।
-আমার সাথে সবসময় তুমি এমন করো, আমাকে অসহায় ভাবো। আমি একদম অসহায় নই অঞ্জন এটা তোমাকে বুঝতে হবে।
 বিনীতা কেঁদে ফেলল।
অঞ্জন এমন একটা পরিস্থিতি তে পড়ে আচমকা বিনীর হাতে হাত রেখে বলল, আচ্ছা!! আচ্ছা! সরি! আর মিথ্যে বলবো না। চলো আমরা অন্যকোন কথা বলি, তোমার ড্রয়িং? তোমার বাসায় বারান্দায় তোমার ঐ টিয়ে?
কথার মাঝে ই সেই ওয়েটার ছেলেটি এসে খাবার দিন তারপর মাথা নিচু করে অঞ্জনের কাছে এসে বলল,
- স্যার! এনি প্রব্লেম?
অঞ্জন বলল, নো থ্যাংকস!
-এঞ্জয় আওয়ার ফুড স্যার!
-ওকে।
ওয়েটার ছেলেটি যেতে যেতে পিছু ফিরে বার দুয়েক অঞ্জন আর বিনীতার দিকে ফিরে চাইল।
বিনীতা বলল, অঞ্জন কেন বোঝাও বারবার আমি তোমার কাছে অসহায়? আমার এসব একদম ভালো লাগে না! কেন মিথ্যে কথা বলো? আমি জানি, তোমার গলার স্বরে কোনটি সত্যি, আর কোনটি মিথ্যে।
অঞ্জন বিনীতার হাত ধরে অনেকটা গম্ভীর গলায় বলল, জানি বিনী। তুমি অসহায় একদম নও।
বিনীতা বলল, আমি চোখে দেখতে পাই না বলে তুমি মিথ্যে বোঝাবে?
অঞ্জন মাথা নিচু করে বলল, সরি বিনী, এমন আর হবে না। তুমি আমার কাছে একটা সাহস, অসহায়ত্ব নও।
বিনীতা চোখ মুছে নিল। সত্যি তো? না?
না না! একদম একদম সত্যি!
আবার না!
না মানে হ্যাঁ, মানে সত্যি দেবো না।  আমি তোমাকে একটা গান শোনাতে চাই। তুমি কি শুনবে?
বিনীতা একটু হেসে বা দিকে মাথাটা হেলিয়ে দিল। মানে ও রাজী।
অঞ্জন চেয়ারের সাথে দাঁড়া করিয়ে রাখা গীটার টা হাতে তুলে সুর তুলল,
স্টিং এর গাওয়া সেই fields of gold
" You'll remember me when the west wind moves upon the
fields of barley
You'll forget the sun in his jealous sky as we walk in
fields of gold "
বিনীতা অঞ্জনের হাতে হাত রাখল, বিনীর মনের ভেতর কষ্ট নেই। ও জানে অঞ্জন বিনীকে বড্ড ভালোবাসে। তা না হলে বিনী চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কের মাঝপথে হঠাৎ হারিয়ে ফেলার পরেও অঞ্জন বিনীর হাতটা ধরে ই ছিল, ছেড়ে যায় নি।
অঞ্জন বলল, বিনী তোমার ঐ চোখ দুটোকে আমি ভালোবাসি, তুমি আবার দেখবে আমি চেষ্টা করছি।
বিনীতা বলল, তোমার চোখে ই আমি আপাতত দেখতে চাই অঞ্জন!
অঞ্জন চশমার নীচ থেকে চোখের কোণা মুছে নিল।
-তুমি কাঁদছো অঞ্জন?
-না না! বিনী।
-আবার মিথ্যে!
(ওদের দুজনের কথার মাঝে চলে এলেন একজন)
হ্যালো স্যার, আমি ইমতিয়াজ! এই রেস্টুরেন্টের ওউনার কাম ম্যানেজার। আপনাদের জন্য একটা স্পেশাল গিফট আছে।
অঞ্জন অনেকটা আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু? কেন? আমরা তো কিছু চাইনি এক্সট্রা!
ইমতিয়াজ বললেন, স্যার! আসলে আমাদের রেস্টুরেন্ট এ একটা বদনাম আছে। যারা ই কাপল হয়ে আসে অদ্ভুত কারণে তাদের ই ব্রেক আপ হয় এখানে এসে। এটা কাপলদের কাছে কুফা রেস্টুরেন্ট বলতে পারেন। লোকাল অনেক এর নাম দিয়েছে মজা করে, " ব্রেক আপ লাউঞ্জ "।
 তাই কাপল কেউ আজকাল এখানে আসে না, মানে যারা জানে এই ব্যাপারে। কিন্তু ওয়েটার এসে যখন আপনাদের কথা বলল তখন আমি ডেস্কে এসে আড়ি না পেতে পারলাম না। এজন্য আমি এক্সট্রেইমলি সরি।
কিন্তু এই কেক টা আপনাদের জন্য করে এনেছি, উড ইউ প্লিজ?
অঞ্জন উঠে দাঁড়াল কেক কাটার ছুরি হাতে। সিউর, হোয়াই নট!
বিনীতা চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিল তখনি। অঞ্জন দ্রুত সামলে নিল। সাবধানে বিনী।
দুজনের হাত একসাথে, তাতে ধরা কেক কাটার ছুরি, সমবেত সবাই উল্লাসিত। কেক টা কাটা হলো আর সেখানে উপস্থিত সবাই হাততালি তে রেস্টুরেন্ট হল মাতালেন।
ওই আর ভ্যারি হ্যাপি স্যার এন্ড ম্যাম, বললেন ইমতিয়াজ।
বিনীতা হেসে বলল, থ্যাংক ইউ সো মাচ।
 অঞ্জন একবার বিনীতার দিকে ফিরল, গুমোট বাতাসে যেমন দমকা মেঘ তার ঠিকানা হারিয়ে ফেলে, তেমনি বিনীর অভিমানী মুখ আনন্দে হারিয়ে ফেলেছে সাময়িক অস্তিত্ব।

(সমাপ্ত)

(গল্পের চরিত্র এবং ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক বাস্তবের সাথে কোন মিল থাকলে তা একান্ত কাকতালীয়)

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯

থ্রিলারঃ স্টেপ ওয়ান



(এক)
শুরুতে একটু ধারনা দেয়া ভাল, কারণ যাদের ভূতে বিশ্বাস নেই তারা অধিক বিজ্ঞানমনস্ক। নয়তো, তারা একে রীতিমত অগোছালো পাগলাটে প্রলাপ বলে চালিয়ে দিতে পারেন। তবে আজকের থ্রিলার এবং ভূত, পরস্পরজড়িত। আমার স্যার আতিক, আপাতত অবসরে চলে এসেছেন। গোয়েন্দা দপ্তরে কাজ করতে লাগে ক্ষুরধার মস্তিস্ক, তাতে বোধকরি কোন অভাব নেই। তবে তিনি স্বেচ্ছায় কেন অবসরে এসেছেন। তা আমি জিজ্ঞেস করিনি। করলে কোন না কোন ভাবে স্যার আমাকে সাত পাঁচ বুঝিয়ে দেবেন। হয়তো, বলবেন, ' শোনো আনিস, নিজের কথা কি ভেবেছো?- কোথায় গেলে বাকী জীবন টা আয়েশে কাটাবে? আমার তো সমুদ্র ব্যাপক ভালো লাগে। কই? সমুদ্রে তো পা ভেজাতে পারিনি গোটা দশ বছরে। -এই চোর ছ্যাচ্চর, দাগী আসামী, খুনী, রেপিস্ট, সুইসাইড -এসবের ভীড়ে সময় পেয়েছি বলে তোমার মনে হচ্ছে?'
স্যার আর যাই বলুক, মনে মনে কিন্তু গোয়েন্দা দপ্তরের প্রতি তার একটা টান আছে, সে আমি ভালো করে জানি। এখনো কোন খুনের খবর পেলে ই সেটা নিয়ে আমাকে ব্রিফ করতে ভালোবাসেন তিনি। ফোন করে ই বাসায় ডাকেন, ' আনিস! মজার স্টোরি আছে, চলে আয়!'
আমার কাজ এখন বেড়েছে, হয়েছে প্রমোশন। বড়কর্তা হবার ঠেলা সামলাতে এখন হিমশিম খাই, একদিন তো স্যার কে বলে ই দিলাম অবসর নেবো। স্যার চোখমুখ কুঁকড়ে বললেন, ' এই কাজটি করিস না, এখন উঠতি সময়, আমার মতো বুড়ো হলে টের পাবি অবসরে থাকার কষ্ট টা আসলে কি!'
গল্পের ছলে, সেদিন ই এই কেসের ব্যাপারে কথা হলো। আমারো অফিসে ছুটি। বিকেলবেলা তাই একসময়কার গুরু-শিষ্য বসেছিলাম চা চক্রে। অনেকক্ষণ চুপচাপ ই ছিলাম, ব্যস্ত ছিলাম ফোনের স্ক্রিনে, স্যার পত্রিকায়। ম্যাডামের চা অসাধারণ। সে চায়ে সল্টেড বিস্কুট ডুবিয়ে আয়েশে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ স্যার বললেন, 'ভূতে বিশ্বাস আছে আনিস?'
হেহে করে নিঃশব্দে হাসি দিয়ে বললাম, -কি যে বলেন স্যার! ভূত! সারাদিন আসল খুনীকে ধরে সময় পাইনা। এসবে মন দেবো কখন?
আমার কথা শুনে স্যার ও পত্রিকা ভাঁজ করতে করতে মাথানিচু করে হাসলেন, তারপর বললেন, -এটা অনেক আগের দিকের কথা। আমি সবে জয়েন করেছি। অনেক বড়বড় অফিসারের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করি। তারা আমাকে এসিসট্যান্ট করে রেখেছেন তখন। এই সময়ে আমি শুধু তাদের কাজ ফলো করি। নিজের করে বলার মতো মতামত তখনো হয়নি। যেমন, কোন খুন হলো সেখানে স্যারের সাথে আমিও যাই। স্পট দেখে নিজের ধারণা করি। স্যারের ধারণা আমার সাথে মেলাই। তারপর স্যার আমার কাজের একটা রিপোর্ট উপরমহলে জমা দেন। শিক্ষানবিশ আর কি!
তো ঠিক ভালো ই যাচ্ছিল গোয়েন্দা দপ্তরে। একদিন একটা কেইস এলো। কোন এক এসাইলামে সুইসাইড কেস। এসাইলাম টা শহরের কাছে। খুব বড় নয়, জেলাশহরে এসাইলাম আছে কিংবা আদৌ থাকতে পারে বলে আমার মোটেই ধারণা ছিল না। তবে, যেহেতু সুইসাইড তাই পুলিশ কেইস হলো। আমার স্যার আমাকেও সাথে নিলেন স্পটে। একতলা একটা বাড়ি। তার চারপাশে বিঘাতক ফাঁকা মাঠ। উঁচু দেয়াল ঘেরা, সেটা আনুমানিকভাবে ১১ থেকে ১২ ফিট উঁচু। পরে মেপে দেখেছিলাম ঠিক আছে। সেখানে এক মহিলা সুইসাইড করে। তাকে ফ্যানের সাথে সকালবেলা ঝুলতে দেখে এসাইলামের ওয়ার্ডবয়। সে ঝাড়ু দিতে এসে প্রথমে বেডে পেশেন্ট কে না পেয়ে আতঙ্কিত হয়, তারপর ই পা ঝুলতে দেখে সিলিঙ ফ্যানের সাথে। চিৎকার চেঁচামেচি করে এসাইলামে ছোটাছুটি শুরু করে। তারপর ডিরেক্টর মানে এসাইলামের পরিচালক ফোন পেয়ে আসেন, পুলিশে ততক্ষণে কেউ খবর দিয়েছিল। সম্ভবত কোন নার্স, এতে তিনি অনেকটা ক্ষিপ্ত হন। গালাগালি করেন এরপর দ্রুত পুলিশ এসে পড়াতে লাশ সৎকার্য করতে পারেন না। আমরা গিয়ে দেখলাম, পেশেন্টের পরিবারে তেমন কেউ নেই। তবে তার নামে তার বাবার ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ছিল, আর ছিল সৎ ভাই। নিহত মহিলার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে টা টেকে নি কারণ, দ্বিতীয় স্ত্রী কোন এক প্রবাসী লোকের সাথে পরে পালিয়ে যায়। নিহত মহিলার বয়েস সতেরো থেকে কুঁড়ি। ছোটবেলা থেকে ই মানসিক ভারসাম্যহীন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোন বিষয় বুঝিয়ে বললে সে নাকি বুঝতো এবং হেসে জবাব দিত। জোর করলে কিংবা গায়ে হাত তুললে সে পাগলামি শুরু করতো যা ঘুমের ইনজেকশন না দেয়া পর্যন্ত থামানো যেতো না।
সুইসাইডের আগের রাতেও নাকি এমন কিছু একটা হয়েছিল বলে একজন নার্স আমাদের জানায়। ডাক্তার নিজে ই তাকে সে ইনজেকশন টা পুশ করেন। মজার ব্যাপার হলো, সে নার্সের ই কথায়। সন্দেহ টা সেখানে বাড়ে আমাদের। নার্সের রাতের ডিউটি ছিল। সে জানায় রাত ১ টা থেকে রাত ৩ টা সে পাঁচবারের বেশী টহল দিয়ে গেছে। মেয়েটি/মহিলাটি ঘুমাচ্ছিল অঘোরে। কোনরকম মুভমেন্ট সে দেখতে পায় নি। তাছাড়া এসাইলামের ভেতর মৃদু আলোর ব্যবস্থা আছে তাতেও কোনপ্রকার অস্বাভাবিকতা নাকি তার নজরে আসেনি।
রাত ৩ টার পর নার্স দুই ঘন্টার ন্যাপ নিতে যায় এরপর ই আরেক বয়ের টহল দেয়ার কথা। সে টহল না নিয়ে এসাইলামের বারান্দায় বসে শিবের প্রসাদ মানে গঞ্জিকা টানছিল। সুতরাং আর তার হুশ ছিল না। তখন সিসি ক্যামেরার চল ছিল না। কেইস একবার চুনের পানির মতো উপরে স্বচ্ছ আর তলানী সমাধানের বাইরে। রুমের বাইরে তালা সুতরাং কারো আসা অসম্ভব, ছাদ কংক্রিটের ঢালাই। টিনের নয় যে কেউ কেটে খুন করে আসবে। নার্সের মতে মেয়েটির পায়ে একটু সমস্যা ছিল, তার মানে দাঁড়ায় সে দাঁড়িয়ে সিলিঙে দড়ি বাঁধতে পারে না। সেটা অসম্ভব। রুমের চাবি কেবল ডাক্তার, নার্স,বয় এবং এসালাইমের পরিচালকের কাছে থাকে। এসাইলামের ডাক্তার রাতে ছিলেন না কারণ মেয়ের জন্মদিন থাকায় রাত বারোটার আগে তিনি হাসপাতাল ছেড়ে যান নিজের নিসান গাড়িতে। বাইরের সদর দরোজায় তালা। এসাইলামের করিডোরে কলাস্পিবল গেইট এবং সেটাও তালা।

(দুই)
ঘড়িতে বিকেল ৫টা, ম্যাডাম চিপস ভেজে দু'বাটি আমাদের দুজন কে দিয়ে গেলেন। আমি মুখে পুড়ে এবার কথা বললাম। অনেকগুলো প্রশ্ন জমেছে। প্রথমত, মহিলার খুনের মটিভ কোথায়? দ্বিতীয়ত, কে করলো খুন?
আতিক স্যার কে এবার প্রশ্ন করলাম।
স্যার তার চায়ে চুমুক দিয়ে, চিপস খেতে খেতে বললেন। তোমার কি ধারণা হলো এসব শুনে? আগে শুনি, সুইসাইড না খুন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, সুইসাইড!
স্যার এমনভাবে হাসলেন যে তার চা পারলে উড়ে আমার গায়ে ই পড়তো। হাসি থামিয়ে বললেন, এই তোমার অবজারভেশন!
আমিও এবারো আমতা আমতা করে বললাম, খুঁত তো পেলাম না স্যার। কোন মোটিভ নেই। যদি ধরি সম্পত্তির জন্য কেউ খুন করেছে সে তো তার সৎ ভাই। আর এসাইলামের যা সিকিউরিটি ফিরিস্তি পেলাম তাতে তো মাছি ঢোকাও পসিবল না।
স্যার চিপস তুলে বললেন, পৃথিবীতে যত কড়াকড়ি যেখানে, সেখানে সবচেয়ে বড় গুমোড় থাকে আনিস। মানে হলো এই কেইস টা ক্রাক আমি ই করি প্রথমে। আর তারপর ই অফিসিয়ালি আমার নিয়োগ হয় গোয়েন্দা দপ্তরে। বলে ই স্যার মুচকি হাসলেন।
আমি এবারে আশাবাদী। যেহেতু স্যার বলেছে খুন, তাহলে আমার উচিত এবার ক্লু বের করা।
-যদি দেয়াল টপকে? দড়ি ছুঁড়ে কেউ এসে থাকে?
-হ্যাঁ, সেটা পারে কিন্তু বাইরে দারোয়ান থাকে। যদি সেটাও টপকে আসে তাহলে কলাপ্সিবল গেইট তাকে ক্রস করতে হবে। যেটা জার্মান তালা। দু একজনের বাইরে আর কেউ সেটা জানে না। মানে দারোয়ান এসে অসাদচরন করার কথা ভাবতেও পারবে না। খুন তো বাদ!
আমি ভাবছি সারেন্ডার করে দিব এবার, যেটা ই ভাবছি স্যার ক্যান্সেল করে দিচ্ছে। শেষমেশ বললাম, যদি আগের থেকে ঘরে কিংবা বাথরুমে কেউ বসে থাকে?
স্যার বললেন, তাহলেও তার ধরা পড়ার কথা কারণ, কলাপ্সিবল গেইটে তালা থাকে সবসময়। খোলা হয়ে কেবল ডাক্তার এবং পরিচালক এলে। এবং তারা এসে চেক করে ই নার্স অথবা বয় কে অনুমতি দেন হাসপাতালে ঢোকার।
কিন্তু স্যার খুন হবার পর তো তার ই সৎ ভাই সব সম্পত্তি পাবে।
হ্যাঁ, সাধারণভাবে ভাবলে এটাই আসল মোটিভ হয়। কিন্তু ঘটনা আরো জটিল ছিল। আমার সিনিয়নের হাতে আরেকটা কেস ছিল তাই তিনি এই কেস টা আমাকে হ্যান্ডওভার করলেন। তার ধারণা ছিল এই চুনোপুঁটি কেসে উনার কোন ফায়দা নেই। উনি প্রমোশনের লোভে এটা ছেড়ে দিলেন আমার উপর। আমিও তরুণ, কেস একেবারে ইনচার্জ হয়ে সমাধানে নেমে গেলাম।
তখন সবে বিয়েও করেছি, এরেঞ্জ ম্যারেজ আমাদের। কেউ কাউকে বিয়ের আগে চিনতাম না। আর এই কেসে পড়ে গিয়ে কথা বলার সুযোগ ও কম। সারাদিন কেস ফাইল, মর্গ, ইভিডেন্স খুঁজে ফিরছি। রিমান্ড চলছে। বাসায় ফিরে রাতেও ঘুমে অনেক দেরী। তোমার ম্যাডাম রাত জেগে বই পড়তো, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র চলছে..
একরাতে বলল " গৃহদাহ " পড়েছি কিনা, জোর গলাতে ই একটু মেজাজ ভারী করে উত্তর দিলাম, নাহ! সাথে সাথে দেখলাম তোমার ম্যাডাম টেবিল ল্যাম্প ঠাস করে নিভিয়ে হাতের বইটা সশব্দে টেবিলে ফেলে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আমার হাতে কেস ফাইল রেখে, আলো নিভিয়ে দিলাম। বুঝলাম গৃহদাহ টা আসলে কি!
আনিস হো হো করে খানিকটা হাসল। তারপর বলল, স্যার কোন ক্লু পেলেন?
নাহ। আমিও তখন খুব হতাশ। মনে হচ্ছিল এভাবে রেগুলার কিছুদিন থানা-এসাইলাম-দপ্তর-বাড়ি-বৌ করে করে আমিও এসাইলামের একজন হয়ে যাবো।
ঠিক তখনি ক্লু টা মাথায় আসে। মানসিক চাপ, এর থেকে মুক্তি!

(তিন)
তাহলে তো স্যার, এটা সুইসাইড ই। খুন হয় না!
স্যার বললেন, খুন কখন হয়? এর আসল সংঙ্গা কি জানো?
Murder is the unlawful killing of another human without justification or valid excuse, especially the unlawful killing of another human being with malice aforethought. This state of mind may, depending upon the jurisdiction, distinguish murder from other forms of unlawful homicide, such as manslaughter.
তার মানে জাস্টিফিকেশন করে নয়, সেন্সের মাঝে থেকে নয়, যেটা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না।
আনিস মাথা নাড়ল সায় দিয়ে।
আতিক সাহেব এবার শুরু করলেন, শোন আনিস! যদি কেউ জেনেশুনে খুন করে দিত তাহলেও কি সেটা খুন নয়? আসলে সেটাও খুন। তবে এই সংঙ্গা তে সেটি আসে কিনা আমার দ্বিমত আছে।
তুমি যদি ভিক্টিমের কাছের কেউ হও তাকে যদি তুমি ভুল পথে পরিচালিত করো সেটা কি এই বিশ্লেষণে পড়ে!
পাজল্ড লাগছে, তার মানে স্যার কেউ তাকে প্ররোচিত করেছে?
ইয়েস!
আমি যতদিন কেসে ছিলাম নার্স আমাদের কে অনেক হেল্প করেছে। তার নাম সিস্টার মেরী। আগে সে কোন এক চার্চে যাজিকা ছিল। সেখানে আমি খোঁজ নেই। আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি। সি ওয়াজ এবিউজড, চার্চের ফাদার তাকে সেখানে আশ্রয় দেয়। পড়ালেখা শেখায় কিন্তু কোন না কোন ভাবে সে তার অতীত স্মৃতি থেকে বের হতে পারেনি।
কিন্তু স্যার?
বলছি, (স্যার চায়ে চুমুক দিলেন)
এরপর বললেন, এর সাথে কেসের কি সম্পর্ক? ভিক্টিম মানে খুন হওয়া মেয়েটি বয়েসে তরুণী। আগেও বলেছি, কলাপ্সিবল গেইটের কারণে দারোয়ান কেউ বাইরে থেকে ভেতরে আসতে পারতো না। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসাইলামের ভেতরে ফাঁকা মাঠে রোগীদের ছেড়ে দেয়া হতো। ওরা ইচ্ছেমত ঘুরতো সেখানে।
এমনি এক সময়ে কোন এক দারোয়ান মেয়েটিকে এবিউজ করার চেষ্টা করে, নার্স মেরী সেটা দেখে ফেলে এবং দারোয়ান কে শাসায়। হিতে বিপরীত বলে একটা কথা কথা আছে। সেটা ই হলো।
নার্স মেরীর ছোটবেলা তাকে মানসিকভাবে দূর্বল করে রেখেছিল, এত সময় পার হবার পরেও তার সে অতীতের ভয় কাটেনি। একে একে দুই মেলায় সে। ভিক্টিম নার্স মেরীর ভক্ত ছিল। আগেই বলেছি, বুঝিয়ে বললে মেয়েটির মতন ভালো আর কেউ হয় না।
এবার আমি চেঁচিয়ে বললাম, তাহলে নার্স ই খুনী?
নাহ!
আমার আবারো হতাশা। বললাম,
-দারোয়ান, ডাক্তার, এরা বাদ বাকী থাকে বয় আর পরিচালক!
ডাক্তার, দারোয়ান বাদ? কে বলল তোমাকে?
আমি বললাম স্যার একটা সিগারেট খেতে চাই বড্ড মাথা ধরেছে।

(চার)
সিগারেট ফুঁকে আসতে আসতে দেখলাম ঘড়িতে প্রায় ছ'টার কাঁটা ছুঁইছুঁই। আজ অফিস ছুটি তাই হয়তো আমারো এই কেস নিয়ে মাথা ঘামাতে মন্দ লাগছে না।
ফিরে এসে ই ফাঁকা চেয়ারে বসে বললাম, স্যার প্লিজ বলুন এবার ফাইনালি ক্রাক করলেন কিভাবে?
স্যার ফোনে কি একটা করছিলেন, তিনি তার চোখ নামিয়ে বললেন- আজকাল দ্রুত সন্ধ্যা হয়ে যায়। হ্যাঁ, যা বলছিলাম! তো এমনি এক অবস্থায়। গৃহদাহ টা তুমুলঝগড়া তে পরিণত হলো। তোমার ম্যাডাম ঘরে না থেকে চলে গেলো বাবার বাড়ি আমি একা একা ডিমভাজি আর ভাত করে তাবৎ মুরগীর ভবিষ্যৎ যখন আঁধারের কাজে ব্যস্ত তখনি খুব সিম্পল ক্লু এর কথা আমার মনে পড়ল।
ফাঁসির দড়ি! সেটায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট তো থাকার কথা। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে সেখানে কারো হাতের ছাপ নেই! স্ট্রেইঞ্জ! আমি রিপোর্ট টা আবার পড়লাম। আনুষঙ্গিক আরো যা যা দেখার দেখলাম। তাহলে? এক্সপার্ট কেউ? তাকে ঝুলিয়ে কেস টা সুইসাইড বলে চালিয়ে দিচ্ছে?
 সকালে ফরেনসিকে ফোন করে রিপোর্ট নিয়ে আরো ভালো করে কথা বলার কথা ভেবে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘড়িতে কটা বাজে ঠিক মনে পড়ছে না। আমার হঠাৎ ই ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে মৃদু আলো আসছিল। কারণ বাইরের রাস্তার কাছে একটা আলো সারারাত জ্বলে। আমি দেখলাম আমার সেলিঙ ধরে কেউ ঝুলছে। তার চুল এলোমেলো, হাত দিয়ে দূরে কিছু দেখাচ্ছে। আমি সেদিকে তাকালাম কেবল পাশের ঘরের বন্ধ দরজা ছাড়া কিন্তু দেখলাম না। সাহসী মানুষ আমি, কিন্তু ঘুম ভেঙে এসব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার দেখার পর শক্ত থাকতে নার্ভের জোর লাগে। আমার ছিল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবলাম যা দেখছি সব অবাস্তব, হ্যালুসিনেশন!
চোখ খুলে দেখি কারেন্ট নেই, ঘেমে নেয়ে গেছি। বাইরের আলোর লাইন টা অন্য লাইন তাই সেটা কেবল জ্বলছে। উঠে সিগারেট হাতে বারান্দায় গেলাম। এমন স্বপ্ন দেখার কারণ কি আমি কেস নিয়ে বেশী ভাবছি! জলদি, আবার ঘরে এলাম বন্ধ দরজার দিকে ছুটে গিয়ে হেচকা টানে সেটা খুলে ফেললাম। ঘর টা ফাঁকা, তোমার ম্যাডামের আনা কিছু জিনিসপত্র তখনো প্যাকিং করা ছিলো। আমি ম্যাচ জ্বালিয়ে ভেতর টা দেখতে থাকলাম। বইয়ের পোকা সে, সবধরনের বইয়ে ঠাসা মেঝে। দুটো লাগেজে জামাকাপড়।
ফিরে আসছি, চোখে পড়ল একটা বই "Disinfection, Sterilization, and Preservation " বইটা থেকে ধূলো ঝেড়ে হাতে নিয়ে ফিরলাম। কারেন্ট এসে গেছে দিব্যি ফ্যানের বাতাসে শরীরে ঘাম শুকিয়ে কেমন একটা শীত শীত লাগছে। বইটার কয়েক পাতা পড়ে মাথায় যেটা এলো সেটি এতদিন কেন আসেনি বুঝলাম না। বলেছিলাম না, সবচেয়ে কঠোর জায়গাতে খুঁতের পরিমান অনেক বেশী থাকে!
ফরেনসিক ল্যাবে গেলাম পরদিন সকালে। তার আগে তোমার ম্যাডাম কে ফোন করে অনুরোধ করলাম যাতে সে ফিরে আসে আমরা সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি একসাথে।
ল্যাবে গিয়ে আমি নিজেও দেখলাম, ব্যবহৃত দড়ি টি ছিল ডিসইনফিকটেন্ট, মানে স্টেরিলাইজড করা। দড়ি কখনো এমন হয়? কেউ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করছে? এসাইলামের ডাক্তার? তার কাছেও তো চাবি থাকে। ফোর্স নিয়ে যাবো কিন্তু ডাক্তার ই করেছে তার প্রমাণ কই?
মনে আছে গৃহদাহ?
আমি বললাম হ্যাঁ, আসলে এসাইলাম টা আর চলছিল না। আগেও বলেছি ঐরকম একটা জেলাশহরে এসাইলাম আছে কে জানে? ডাক্তারের আরো ভাল বেতনের অফার ছিল। তাই সে চাপ দিচ্ছিল পরিচালক কে যাতে তাকে অধিক টাকা দেয়া হয় এবং সেও চাকরী ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিলো।
সবার টাকা বাকী, নার্স, বয়, দারোয়ান তাই যথেচ্ছাচার ছিল তাদের সবার চালচলনে কিন্তু নার্স মেরী ছিল অন্যরকম মনের। কথায় আছে, আহত মানুষ ই অন্য আহত লোকের দরদ বোঝে। তাই সে নিজের মতোন সেবা করে যেতো পয়সা ছাড়া। কিন্তু বাকীরা হয়ে উঠে বেপরোয়া। ডাক্তার ও পরিচালক কে ফাঁসিয়ে দেবার প্ল্যান করে। তাই যাবার আগে তার নিজের কাছে থাকা চাবি দারোয়ান কে দিয়ে যায় এবং সব সতর্কতা নেয়া আছে জানিয়ে কি করতে হবে বলে যায়। দারোয়ান জানতো টাকা পেলে সে সব পারে, নার্স মেরীর প্রতি তার কুনজর ছিল কিন্তু সে ভেতরে গিয়ে খুন করে বেড়িয়ে এলেও কেউ টের পায়নি। মেয়েটি ঘুমিয়ে ছিল, ঘুমের মাঝে ই খুন হয়ে যায়। শুরুতে বলেছিলাম, ডাক্তার রাতে ই মেয়েটিকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছে।
তাই এমন ঘটনা ঘটেছে জেনে ধামাচাপা দিতে চায় এসাইলামের পরিচালক কিন্তু নার্স মেরীর কারণে সেটি আর হয় না। সে আগেই ফোনে পুলিশ কে জানিয়ে দেয়। পরে ডাক্তার কে আমরা গ্রেফতার করি, সেই সাথে খুনী দারোয়ান কেও ধরা হয়।
আমি বললাম, তাহলে মেয়েটি যে স্বপ্নে না তার আত্মা..
আতিক স্যার, ডান হাত উঁচু করে থামিয়ে বললেন, ব্যস এটা কে আধিভৌতিক ভেবে বসা টা ঠিক নয়। তবে তুমি যেহেতু একটা কারণ দর্শাতে দেখাও সেটা দেখাতে আপত্তি নেই তবে, প্রমাণ ছাড়া বাকীসব কিন্তু সার। এখানে আরো
মজার ব্যাপার হলো, কেউ পালায় নি এমন একটা ঘটনার পর। পুলিশ আসবে কেউ ভাবেনি হয়ত। তবে পুলিশ তদন্তের পরেও এরা এতটাই আশ্বস্ত ছিল যে, পুলিশ এই কেস সলভ করতে পারবে ই না। বার কয়েক জেরা করার সময়েও ডাক্তার কে ততটা অস্থির মনে হয়নি অথচ তিনি ছিলেন ঘটনায় মাস্টার মাইন্ড! আর  দারোয়ান ও কিভাবে নেশা করে ঠান্ডা মাথায় খুন করে। নেশা বড় মারাত্মক আনিস, বুঝলে! চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে আতিক স্যার তার হাতে থাকা সিগারেট প্যাকেটের দিকে একবার এবং আরেকবার আমার দিকে ফিরলেন। তারপর সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সন্ধ্যার অন্ধকারে।

(সমাপ্ত)

(গল্পের ঘটনা, স্থান, কাল, চরিত্র সব কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কিংবা জীবিত অথবা মৃত কারো সাথে কোন মিল থেকে থাকলে তা একান্ত অনভিপ্রেত এবং কাকতালীয়) 

রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯

গল্পঃ তৃতীয় নয়ন (হরর থ্রিলার)


(এক)
ট্রেন লাইনের দু'পাশের সবটা ঘিরে কালো
অন্ধকার। চোখের সবটুকু ক্ষমতা খাটিয়ে বুঝলাম
বেশ গাছপালা আছে এদিকটায়।
ট্রেন লাইনের শেষ মাথা দুটো দূরে গিয়ে
কুঁচকুচে আঁধারে মিলেছে। যতদূর চোখ যায়,
তাতে আধাঁর ছাড়া আর কিছু নজরে আসছে না।
ময়মসিংহের এই রাস্তায় আমার আগে আসা
হয়নি। তবে একদম আসিনি তা নয়, ট্রেনে চড়ে
এই পথে যাওয়াআসা অনেকভাবে। কিন্তু
একটিবার স্টেশনে নামা হয়নি।
তবে ছোটবেলায় এসেছিলাম বাবার হাত
ধরে। তখন সবে ক্লাস ওয়ান! এতটা স্মৃতি এখন আর
মনে নেই।
অনেক বদলে গেছে এখন। হাতের বামে ধরে
গেলে একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ছে।
বাইরের সে মাটির চুলো থেকে উড়ে যাওয়া
ধোঁয়া এখনও সাদা আবছা দেখা যাচ্ছে। হয়ত,
বেশী দেরী হয়নি -দোকানী তার দোকান
বন্ধ করে চলে গেছে।
সত্যি বলতে স্টেশন টা একদম খালি। শুনশান
নীরবতা এই মাঝ রাত্তিরে। এটা গেঁয়ো
স্টেশন, তাই লোকজনের ভীর-বাট্টা একদম নেই।
ঝুট ঝাট করে এখানে ট্রেন থামেনা। যদি না-
সিগন্যাল দিয়ে থামানো না হয়।
আজ, আমারো ভুল "কি দরকার ছিল একটু ফ্রেশ
হয়ে পান চিবানোর! " ট্রেন মিস হয়ে গেল।
স্টেশনের আশেপাশে জনবসতি নেই, শুধু স্টেশন
মাস্টারের একটা টিনের একতলা চালা।
যেটার সদর দরজায় মস্ত বড় তালা ঝুলছে।
লাইনের থেকে বেশ দূরেই যাত্রীদের বসার
জন্য কাঠের বেঞ্চ।
ব্যাগটা হাতের পাশে রেখে বেঞ্চে বসলাম।
প্রকৃতি প্রচন্ডরকম শুনশান।
আনমনে বেঞ্চে বসে পা দোলাচ্ছি। একা
একা খুব ভয় লাগছে। সেই সাথে চোর-
ডাকাতের চিন্তা মাথায় চাড়া দিয়েছে-
সাথে অবশ্য মালামাল হালকা-পাতলা। কাপড়
বোঝাই ব্যাগ, সাথে সিগারেট, ম্যাচ আর
শরৎচন্দ্র সমগ্র। ট্রেনে বসে বোরিং ভাব
কাটাতে বইয়ের আয়োজন। এখন সেটাই ভারী
মনে হচ্ছে। কেউ আক্রমণ করলে পালানোর পথে
ভারী কিছু নিয়ে দৌড় দেয়া বোকামী। ধরা
পড়বার চান্স প্রকট!
তবে,
মজার ব্যাপার হলো আমার ম্যাচটার নিচের
দিকে একটা টর্চের মত আছে। সেটাই এদিক-
ওদিক করে দেখছি কেউ আসছে কিনা। খুব কম
হলেও এখন এইটুকু আলো আমার কাছে মহা কিছু!
ডান হাতটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে
সিগারেট বের করে আগুন জ্বালালাম। একরাশ
ধোঁয়া ছেড়ে বুঝলাম। শীতের প্রকোপ পাওয়া
যাচ্ছে। গায়ে শিরশিরে একটা ভাব। ব্যাগের
থেকে টাওয়েল বের করে গলায় দিলাম।
"নো কম্প্রোমাইজ উইথ কোল্ড"
শীতটা আরো বাড়ছে। আধা ঘন্টা পার করে
ফেলেছি অথচ কেউ একবার এদিকে এলোই না।
নাহ! বিষয়টা সুবিধের লাগছে না। শেষ সম্বল,
সিগারেট দুটো শেষ করেছি এরই মাঝে।
বাকী আছে মাত্র এক!
ভাবলাম বেঞ্চে গা এলিয়ে দেই। গা
এলিয়ে পায়ের কিছুটা বাড়াতেই অর্ধেক
গিয়ে আটকে গেল,
আরে একি! বেঞ্চের বাকি অংশে একটা
বস্তা রাখা। গ্রামের লোকের আর কাজ! বসার
জায়গাও দখল চাই! হু!
অগত্য বস্তায় মাথা রেখে গা এলিয়ে দিলাম।
প্যু ও ও ও ও ও......
ধরমর করে উঠে বসলাম। গা ঝাড়া দিয়ে ব্যাগ
হাতে নিলাম ট্রেন এসে গেছে কি কপাল!
আহা!
থাম!!!! থাম!!! ঐ.... ট্রেন!!!
কিন্তু বিধি বাম! ট্রেন থামল না। আমি তো আর
সুপার ম্যান কিংবা ডাকু নই' দৌড় দিয়েই
ট্রেনে চড়ে যাব।
মেজাজ প্রচন্ড খারাপ।
হাতের ব্যাগ বেঞ্চের কোনায় ছুড়ে দিলাম।
সিগারেট আছে মাত্র একটি। সেটা জ্বালাব
কি জ্বালাব না ভেবে শেষমেষ পকেটে
রেখে দিলাম। জানি না কতক্ষন এখানে
থাকতে হয়!
হাতঘড়িতে রেডিয়াম কাটা দুটা জ্বলছে আর
আমার দিকে ফিরে মুচকি হাসছে। নিজেকে
বিনে পয়সার জোকার মনে হচ্ছে।
চুপচাপ বসে ঘড়ির কাটার মুভমেন্ট দেখতে
লাগলাম। আমার পাশে, কিছুটা গাছপালা
ঝোপের পর খোলা মাঠ। আধাঁরে অপরুপ কিছু দৃশ্য
আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল হঠাৎ। থোকা থোকা
জোনাকী। আকাশের তারা যখন মেঘমুক্ত
আকাশের রাতে জ্বলজ্বল করে, ঠিকে তেমনি
জোনাকী গুলোর ঝলকানি।
(দুই)
কখন যে ঘুম এসে গেছে বুঝিনি। তাকিয়ে
দেখলাম নিজের বা হাতে কাত হয়ে ঘুম
দিয়েছিলাম। আড়মোড়া ভেঙে এবার শেষ
সম্বল টা জ্বালিয়ে দিলাম। সিগারেট খোর
দের বড্ড বাজে অভ্যাস। না জ্বালিয়ে থাকা
যায় না। সকাল হলে পাশের দোকান থেকে
কিনে নেয়া যাবে। থাক, কি হবে আর কষ্ট
করে।
হঠাৎ ভয় হলো, আরে আমার ব্যাগ, টাকা!
নাহ, নিশ্চিত হলাম। কিছু খোয়া যায়নি। তার
মানে ঘুমোবার সময় কেউ আসেনি এখানে।
ধ্যাত, চোর হলেও এই রাতে সংগ পাওয়া যেত।
একা একা থাকার কোন মানেই হয় না।
এখনো সেই জোনাকী গুলো জ্বলজ্বল করছে
আগের মত। ফ্রেশ হবার তাগিদে ঝোপের
পাশে গিয়েছি হঠাৎ দেখলাম, উত্তর-পূর্ব কোন
ধরে, ঠিকে যেদিকে ক্ষেতের শুরু ঠিক
সেখান থেকে কেউ একজন স্টেশনের দিকেই
আসছে।
যাক গে, যে আসুক! কথা বলার মত কেউ তো
আসছে। হাতের সিগারেট শেষ। ফিল্টার টা
ছুড়ে দিলাম জংগলে।
লোকটা প্রায় কাছেই এসে গেছে, আমিও
বেঞ্চে ফিরেছি। ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে।
কি বাবু? কে আপনে?
আমি বিভূতিভূষণ।
পাশের গ্রামের পরের গ্রামে আমার কাকার
বাড়ি। সেখানেই আজ যাবার কথা কিন্তু
মাঝপথে ট্রেন মিস করে এই জনমানুষহীন
স্টেশনে বসে আছি।
কার বাড়ি?
কমল জোয়ার্দার!
আরে সে তো আমাগো আপনা লোক! আপনে
কি তার আপন ভাইস্তা?
না। সে দূরসম্পর্কের কাকা।
আইচ্ছা। কোন চিন্তা নাই আমি আছি এই হারু
আছে, আপনে আমার লগে আসেন। আমি
আপনারে পৌঁছায় দিব। আসেন!
না থাক! ধন্যবাদ। আমি একাই একটু পরে চলে
যাব। এখন রাত তিনটা! ভোর হতে বেশী দেরী
নেই।
আহা! এত রাতে স্টেশন এ একা থাকবেন? এইটা
ক্যামনে হয়? আসেন তো! (বলেই আমার হাতের
ব্যাগ নিজে টেনে নিল)
আসেন, আসেন। কাছেই আমার ভ্যান গাড়ি।
তাছাড়া গতরাতে এইখানে একটা
অ্যাক্সিডেন্ট হইছে। তাই আইজ আর ট্রেন থামব
না।
-অ্যাক্সিডেন্ট?
-হ' আজ এর লাইগ্যা ট্রেন নাই। এমনেই আহে না
তার পরে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট!
অচেনা লোক হলেও কথা ভাল বলেছে। আজজ
রাত অন্তত লোকটার আশ্রয়ে কাটিয়ে কাল
রওনা দেয়া যাবে।
ঘড়িতে রাত তিনটে কুড়ি।
বললাম আচ্ছা চলুন তবে।
ট্রেন লাইন ছেড়ে আমরা ক্ষেতের আইলে এসে
পড়েছি। লোকটা নানা কথা বলে যাচ্ছে। কি
করে? তার দাদা নাকি মস্ত বড় পালোয়ান
ছিল। অথচ সে দেখতে শীর্ণকায়।
তার এক ছেলে, সে ক্লাস ফাইভে পড়ে।
আমিও হাতের ছোট্ট ম্যাচলাইট জ্বালিয়ে
তার পিছুপিছু চলেছি। গ্রামের ছেলে আমিও।
তাই ক্ষেতের আইলে হাটতে আমার অসুবিধা
হচ্ছে না।
লোকটাকে থামিয়ে আমি জানতে চাইলাম,"
ভাই, আপনি কি করেন? "
আমি, বলে এক গাল হাসল। গ্রাম্য সহজ সরল
হাসি।
ভ্যান চালাই।
আপনার ভ্যান?
হ' আমার বিয়াতে বৌয়ের বাড়ি থেইকা
যৌতুক দিসিল। লোকটা এক মুহূর্তে লাজুক হয়ে
গেল। কথার বেগ কমে এল তার।
আমারও ভাল লাগছে লোকটার সাথে কথা
বলে।
আমাকেও পাল্টা প্রশ্ন করল হারু মিয়া।
"দাদা কি বিয়ে করছেন? "
না ভাই, করিনি!
কন কি? বিয়া করবেন না?
(লোকটার এই প্রশ্নের কারন স্বাভাবিক, আমার
কপালের পাশে, জুলফিতে পাঁক ধরেছে। এই
বয়সে বিয়ে করিনি দেখে অবাক না হবার
কিছু নেই)
(লোকটাকে থামিয়ে,) এহেম এহেম, আর কতদূর?
এইত আইস্যা গেছি!
আপনে কি করেন?
লেখালেখি।
শুনছি, যারা লেখে তাগো অনেক ভক্ত?
হুম, তা থাকে।
আপনের ভক্ত কেমন?
আছে, গোনা সম্ভব নাহ।
হেহেহেহেহ, ঐ যে আমগাছের বাগান ঐ
খানেই আমার বাড়ি। আহেন, ভ্যানে উঠেন।
ব্যাগটা সাইডে রেখে ভ্যানে উঠলাম।
হারু মিয়া বলল, শক্ত কইরা বইসেন! বলে এক গাল
হাসি দিল। আধাঁরে দাতগুলো চকচক করছে।
কিছুটা সময় ধীরে চললেও ভ্যানের গতি দ্বিগুণ
হল মিনিট দুই পরে, আস্তে আস্তে ভ্যানের গতি
ট্রেনের গতিকে হার মানাচ্ছে।
আমার দু'হাত তখন ব্যাস্ত ভ্যানের সিট চেপে
ধরতে।
হঠাৎ দেখলাম ভ্যান, একটা ট্রেন লাইন ক্রস
করছে।
আর বিপরীত দিক থেকে একটা ট্রেন হুইসেল
চেপে তীব্র বেগে ছুটে আসছে।
আমি আর্তচিৎকার করে বললাম, "হারু মিয়া!
ভ্যান থামাও!! ভ্যান থামাও!! "
হারু মিয়া শুনছে না। তার ভ্যানের গতি তীব্র
হচ্ছে।
আমি ভেবে পেলাম না যে স্টেশন ছেড়ে
এলাম সেখানে আবার আমি কি করে এই
ভ্যানেই এলাম।
আমাকে অবাক করে ভ্যানগাড়ি চলে গেল
ট্রেনের নিচে, আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান
হারানোর আগে দেখলাম হারু মিয়ার মাথা
ট্রেনে কাটা পড়ে আলাদা হয়ে গেল।
এই যে! এই যে ভাই?
কে আপনে?
চোখ মেলে তাকালাম। একি! আমি এখনো
বেঞ্চে শুয়ে! কিন্তু হারু মিয়া?
একি! তাকিয়ে দেখি হারু মিয়া আমাকে
ডাকছে।
আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম।
হারু মিয়া তুমি মর নি?
কে মরবো দাদা? আমি না আপনে?
লোকটা কেলিয়ে হেসে দিল। বলল " আমি তো
মরছি, এইবার তো আপনে মরবেন? "
(পা ফেলে আমার দিকে এক পা করে এগিয়ে
আসতে লাগল, আমি ভয়ে পেছানো শুরু করলাম)
অবশেষে থাকতে না পেরে দৌড় দিলাম।
চিৎকার করে চেঁচাতে লাগলাম, বাঁচাও!
বাঁচাও!!!
পেছনে ফিরে দেখলাম লোকটা বড় বড় পা
ফেলে আমার দিকে ছুটে আসছে
আমি প্রানান্তকর ছুটে চলেছি...
দুরে এসে দেখলাম হারু মিয়া আসছে না। আমি
দৌড়ে কোথায় এসেছি জানি না।
হঠাৎ পেছন থেকে কাঁধে হাত পড়ল!
ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, কে এ এ এ এ!!!!
আমি স্টেশন মাস্টার রহমান।
আপনি কে? আর এমন করে হাপাচ্ছেন কেন? কি
হয়েছে?
হারু উ উ...
মানে?
ভ্যান চালক হারু মিয়া!
আসেন, আসেন আমার সাথে।
কোথায়?
স্টেশনে। (লোকটার হাতে কেরোসিনের
হারিকেন, মৃদ্যু আলোতে জ্বলছে। সেটা দেখে
ভয় কমল)
আবার তার সাথে স্টেশনে ফিরে এলাম।
বেঞ্চে আমার ব্যাগ জলদি হাতে নিলাম।
আমাকে স্টেশনের কামড়ায় বসিয়ে হাতে এক
গ্লাস পানি দিলেন তিনি। বললেন, "নিন
পানি খান "
এক ঢোকে খেয়ে নিলাম।
এরপর বললেন, "দেখুন তো আপনার পেছনে যে
লোকটি দাঁড়িয়ে, এ সেই হারু কিনা? "
আমি ঘুরে আর জ্ঞান রাখতে পারলাম না। হারু
মিয়া গায়ে রক্ত নিয়ে আমার পেছনে।
তীব্র কোলাহলে ঘুম ভাঙল।
বেশ লোকজনের ভীর। চায়ের কাপে টুংটাং
শুনছি। বামের সেই দোকানে মধ্য বয়সী
দোকানী।
সেই সাথে আরো কয়েকজন মুরুব্বি। তারা চা
খাচ্ছে।
আমি কিছু না বলে সেখানে গেলাম। বালতি
থেকে পানি নিয়ে মুখে ঝাপটা দিলাম।
"চাচা, চা হবে? "
হইব বাবা, বহ।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনলাম। গত রাতে
ট্রেনে কাটা পড়ে দুজন মারা গেছে। একজন
ভ্যান চালক হারু, পাশের গ্রামে যার বাড়ি।
আরেকজন রহমান, যে এখানকার স্টেশনের
মাস্টার!
আমার চায়ে চিনি বেশী হয়েছে। চাচা
আমাকে আর এক কাপ চা দেবেন?
দিতাছি বাবা।
(সমাপ্ত)

টার্ন অন (ইয়োটা সিরিজের ৪র্থ পর্ব)

ইয়োটার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে
কয়েকদিন থেকে, যদি বলি চা" আনো সে আনে
কফি, কফি আনতে বললে চা!
ভুল ধরিয়ে দিলে আরো রেগে যায়। ভেন্ডর
কোম্পানী কে বললাম, তারা ওয়ারেন্টওয়ালা
কাগজের টুকরো হাতে ঝুলিয়ে দিল, মনে মনে
বললাম "মর জ্বালা "
সব কাজে বাহানা দেয়ার স্বভাব এখনো কারো
যায়নি।
অর্থি কে বললাম, ব্যাপারটা দেখো। নাহ, তার
সেমিষ্টার এক্সাম।
ইলিনের কাজে ইলিন বিজি। আমারও এক্সাম।
মাঝে মাথাখারাপ করা কাজেকর্মে ব্যাস্ত
ইয়োটা।
মন খারাপ করে বসে আছি এমন সময়, বাড়ির লনে
আওয়াজ!
কড়কড় ধম! মেটাল কিছু পড়েছে হয়ত!
কফির কাপ টেবিলে রেখে ছুটে গেলাম
বারান্দায়।
হ্যালো! সরি! (ল্যান্ড করা ব্যাক্তি আমাকে
দেখেই)
ফিরতি হ্যালো দিয়েই বললাম, "প্রব্লেম কি?"
-সরি, জিপিএস ফেইলিওর।
মেশিনটা কাজ করছিল না। ভাগ্যিস লনে
ইমারজেন্সি ল্যান্ড করা গেল।
-কিন্তু ল্যান্ড করতে গিয়ে তো আমার বাগানের
তেরটা বাজিয়ে দিলেন।
-সরি, ইচ্ছে করে তো আর করিনি!
আমার পেছন থেকে সজোরে চেঁচিয়ে, "হে!  ইউ!
শিট, ইউ জাস্ট রুয়িন্ড দিস প্লেস! "
ব্যাক্তি টিকে দ্বিতীয়বার পরিচিত করার
প্রয়োজন নেই, ইনি স্বয়ং ইয়োটা।
ভীনগ্রহের লোকজন ভয়াবহ হয়, অচেনা কাউকে
ছেড়ে কথা বলে না ইয়োটা। আজো তার
ব্যাতিক্রম হয়নি।
তবে ইয়োটার কথায় তেমন পাত্তা দিল না নাক
লম্বা, চিকন কাঠির মত বাদামী রঙের
প্রাণীটি। গোটা শরীরের মাঝে নাকটা একদম
অসাধারণ। রঙ বদলাচ্ছে একটু পর পর। ঠিক যেন
মরিচ বাতি।
ইয়োটাকে নিয়ে ভেতরে এলাম। আবার কি না
কি বলে বসে, এরপর আমার শান্ত বাসায় এরা
দলবেঁধে আক্রমণ করুক।
মেইল চেক করতে বসলাম,
দু'বার বুঝিয়ে দিলাম ইয়োটাকে, যে আমি কফি
চাই। আগের কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
মাথা নেড়ে বলল, অ্যাই আন্ডারস্ট্যান্ড।
পরে দেখা যাবে কি না কি তৈরি করে আনে!
মেয়রের মেইল পেয়েছি গতকাল, বৃষ্টি থেকে
দূরে থাকতে সতর্ক বাণী। অ্যাসিড রেইন,
স্বাস্থ্যহানিকর।
আজ প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, এখানকার বৃষ্টিজল
একেকরকম। সকালে সবুজ, দুপুরে লালচে, রাতে
নীল বর্নের। অন্ধকারে রাতের রঙ বোঝা যায়না,
আমি কাপে সংগ্রহ করে দেখেছিলাম।
ইয়োটা কাপে কফি দিল, আর হাতে ফোন ধরিয়ে
দিয়ে বলল, অনেক আগে থেকে বাজছিল। বৃষ্টির
শব্দের জন্য ফোনের রিংটোন কানে আসেনি।
হ্যালো,
হ্যালো না!  ছাই!
ও একগাল হেসে বললাম, তুমি?
কেন অন্য কেউ ফোন করবে ভাবছিলে?
না না! বৃষ্টি দেখছিলাম।
বৃষ্টি!! সে কে?
(নেটওয়ার্ক ইরোর, ঝামেলা!!) আরে বৃষ্টি পড়া
দেখছিলাম
ও তাই বলো। জানো আজ কি হয়েছে?
কি?
কড়কড় বম্মম!!! (ফোনের লাইন কেটে গেল)
আকাশে বজ্রপাতের ভয়াবহ শব্দ।
বারান্দার দরজা চাপিয়ে ঘরে চলে এলাম, ফোন
আবার বাজছে,
হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো?
হ্যা, আজ না চুড়ি কিনেছি! (রিনিঝিনি করে
শব্দ শোনালো অর্থি।)
হা, ভালো শোনাচ্ছে....
শোনো, আমার একটা কাজ করে দাওতো। (আগেই
জানতাম, আমাকে খুশী করে কোন কাজ
চাপানোর ধান্দা করছে অর্থি)
কি কাজ?
কিছু নোটস এডিট করা লাগবে। আমি মেইল
করছি।
বিকেলে বাইরে একসাথে খেতে যাব, ওকে?
হুম, ওকে।
দাঁড়াও, ইয়োটাকে একবার ডাকি। বাই দ্যা ওয়ে,
ইলিনকে বলে দাও তো কিচেনে দুপুরে কিছু করে
দিতে।
ইয়োটার কি একটা প্রব্লেম হয়েছে, খাবার ভাল
করে করতে পারছে না।
কেন?  সিস্টেমে কিছু একটা হয়েছে।
রিবুট দাও। ফিক্স করে ফেল। আমার এক্সাম তাই
হেল্প করতে পারছি না।
আচ্ছা আমি দেখছি, তুমি মেইল করো জলদি।
শাহরিয়ার কম্পিউটার অন করে প্রাইভেট মুডে
কানেক্ট করল, (মনে মনে ভাবল স্ন্যাকস খেতে
খেতে কাজ করলে খারাপ হয় না)
ইয়োটা!  ইয়োটা!
কোন সাড়াশব্দ নেই, ভাবলাম চার্জ নিচ্ছে।
অর্থির নোটস গুলো চেক করা শেষ করে চেয়ারে
কাঁধ ঝুলিয়ে দিলাম।
ক্ষিদে পেয়েছে, বাইরে বৃষ্টি তাই টেস্ট বদলে
অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে হলো। ইয়োটাকে আবার
ডাকলাম, কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই!
হঠাৎ কি একটা সন্দেহ মনে চাড়া দিল, ঝট করে
উঠে এদিক-সেদিক খুঁজতে লাগলাম, কোথাও
নেই।
অর্থিকে ফোন দিলাম,
হ্যালো আচ্ছা ইয়োটাকে পাচ্ছি না। ও কি
তোমার বাসায়?
ইয়োটা!! কই না তো! কিন্তু পাচ্ছো না মানে?
এ ঘর-ও ঘর, বারান্দা, লন, কোথাও বাদ রাখি নি।
পেলাম না।
ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা,
আমার পাশে অর্থি বসে আছে, ইলিন পাশে
দাঁড়িয়ে।
দু'হাতে মাথার চুল আঁচড়ে যাচ্ছি কিন্তু কিছুই
মাথায় আসছে না।
রাত দশটা বাজে, ইয়োটা আসছে না।
বাইরে যে সব জায়গায় খোঁজ নেয়া দরকার,
নেয়া কমপ্লিট।
কোথায় গেল? এর মাঝে আবার সিপিইউ তে
গড়বড় অবস্থা। হারিয়ে গেল না তো! অজানা
আতংকে মন ভরে গেল।
অর্থি বলল, টেনশন করো না। হয়ত কোথাও গেছে,
চলে আসবে।
শাহরিয়ার বলল, আমাকে না বলে ইয়োটা
কোথাও যায় না।
সেদিন রাতে আর ফিরল না ইয়োটা।
সকালে ভেন্ডর কোম্পানী অফিস আর পুলিশ
স্টেশন ঘুরে এলো শাহরিয়ার।
দুপক্ষ থেকেই আশ্বাস পাওয়া গেল তবে ভেন্ডর
থেকে মেরামত করে দেবার পাশাপাশি
ভ্যালিডিটি রিনিউ করার প্রস্তাব পেল
শাহরিয়ার।
এরপর, এক সপ্তাহ কেটে গেছে ইয়োটা নেই।
ইলিন এর মাঝে পুরোনো কয়েকটা চেনা জায়গা
নিজে থেকে ঘুরে এসেছে, যেখানে সচরাচর
ওরা দুজনে যেত কিন্তু সেখানেও দেখা গেল না
ইয়োটাকে।
নিখোঁজ সংবাদ দেয়া হল, অর্থের লোভে
অনেকেই নকল ইয়োটা তৈরি করে শাহরিয়ার কে
দেখাল কিন্তু আসল ইয়োটাকে আর পাওয়া গেল
না।
তবে গুম হয়ে যাবার কোন কারন খুঁজে পেল না সে।
ওদিকে ইলিন-অর্থি দুজনে খোঁজ চালিয়ে
যাচ্ছে।
অনলাইনে মেইললিস্ট গুলো দেখছিল শাহরিয়ার,
হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পেল বাড়ির লনে।
একরকম ছুটে বারান্দায় গেল সে, একি!
সেদিন যে ভিনগ্রহের প্রাণী এখানে জিপিএস
ভুল করে ল্যান্ড করেছিল সেই আজো ল্যান্ড
করেছে।
শাহরিয়ার আজ প্রায় বিরক্ত, হেই! ইউ! বারবার
এখানে ল্যান্ড করছ কেন? এর আগে ল্যান্ড করে
আমার লনের তেরটা বাজিয়েছ, আজ পছন্দের
রেড অর্কিডটার বারটা বাজিয়ে দিলে?
সো সরি, আসলে আমার জিপিএস টা ঠিকি
আছে কিন্তু ঠিক এ বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে
গেলেই এমনটা হয়। এরর আগে মনে করেছিলাম
জিপিএস এ গলদ আছে। এখন দেখতে পাচ্ছি,
সেটা একদমই নয়।
শাহরিয়ারের মাথায় বিদ্যুৎ ঝলক খেল মনে হয়,
তার মানে আমার বাসার আশেপাশে কেউ
"ম্যাগনেটিক রে" ইউজ করছে!
কিন্তু কেন?
আর হয়ত না, এই রে এর জন্য ইয়োটা আবোল-
তাবোল কাজ করছিল। ওর কন্ট্রোলার রিমোটলি
কেউ এংগেজ করে, এক্সেস করছিল।
ব্যাপারটা, চেক করতে যাবার জন্য ঘরের
ভেতরে যাচ্ছিল শাহরিয়ার কিন্তু পেছন থেকে
ডাক দিল, ভিনগ্রহের প্রাণী, হ্যালো! এই যে?
শাহরিয়ার ঘুরে বলল, হোয়াট?
তোমার বোট কোথায়? সেদিন যে হুমকি দিল
আমাকে!
হি ইজ লস্ট!
(ভিনগ্রহের প্রাণী মাথা নিচু করে কি একটা
ভাবল, এরপর মাথা তুলে কি একটা বলতে যাচ্ছিল
কিন্তু সেটা আর না বলে থেমে গেল) নো, ইটস
ওকে।
শাহরিয়ার বলল, বাই দ্যা ওয়ে। প্লিজ আমার
বোট কে দেখতে পেলে আমায় জানাবে।
ডেফিনেটলি! (ইঞ্জিন স্টার্ট করে উড়ে গেল
নাক লম্বা অদ্ভুত প্রাণী)
ঘরে এসেই অর্থিকে ফোন দিল, এরপর অর্থি
বাসায় আসতেই "ম্যাগনেটিক রে" এর কথা খুলে
বলল শাহরিয়ার।
কিছুক্ষন পর দুজনে চেক করে দেখল কথা একদম
হুবহু মিলে যাচ্ছে। ঠিক বাসার সবখানে,
জিপিএস কাজ করছে না।
একটা "ডেড ট্রায়াঙ্গল " হয়ে আছে বাসার
আশপাশ ঘিরে। ফোনের জিপিএস, ডিরেকশন,
কিছু চলছে না।
কিন্তু কেন?
যদি এটাই হয় তবে, ইলিনের কেন ডিরেকশন
প্রব্লেম হচ্ছে না।
মাথায় কিছু আসছে না। তবে কেউ দূর থেকে এ
অন্যায় কাজ করছে বলেই মনে হচ্ছে। তার মানে
সে বাসার সবার মুভমেন্ট ফলো করছে।
ইয়োটার কমান্ড প্রম্পট তাহলে ওকে-ই ছিল। এই
রে এর জন্য কাজ করছিল না।
তাই তো বলি বারবার রিবুট, রিসেট, প্যাক
আপলোড করে কাজ কেন হচ্ছিল না।
কিন্তু এখন এই প্রব্লেম টা সলভ করবে কি করে?
"ম্যাগনেটিক রে " ট্রাক করে কিভাবে সে
অপরাধী কে ধরবে বুঝতে পারছে না শাহরিয়ার।
এরপরের কয়েকদিন কেটে গেছে, কোন
ইম্প্রুভমেন্ট নেই। পুলিশ সহাস্যে শাহরিয়ারের
জিপিএস হ্যাকিং, তাও আবার জাস্ট নিজের
বাসার এরিয়ায় শুনে হো হো করে হেসে উড়িয়ে
দিয়েছে।
অর্থি কিংবা ইলিন, এমনকি শাহরিয়ার নিজে
এই "ম্যাগনেটিক রে" হ্যাকিং সম্পর্কে
আইডিয়া নেই।
এতদিন সমস্যা খুঁজে পাচ্ছিল না, এখন সমস্যা
আছে কিন্তু সলিউশন নেই।
কি করব? কি করব? মাথায় ঘুরছে শাহরিয়ারের।
বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিল। দেখল, আবার
সেই একই যান ল্যান্ড করছে বাড়ির লনে।
আগেই হেই! হেই! বলে চিৎকার করল শাহরিয়ার,
এবার ল্যান্ড করে কি না কি ভাঙে ভিনগ্রহের
প্রাণী। কিন্তু অবাক করে দিয়ে সুন্দর করে
ল্যান্ড করল সে।
যান থেকে নেমে শাহরিয়ার কে
 হাই! হ্যালো! করল
শুকনো চিকনাকার হাত দুটো নেড়ে।
যানে লক করে সোজা শাহরিয়ারের বাসায়
এসে বেল দিল সে।
-হাই
-হ্যালো,বলে ভেতরে আসতে দিল শাহরিয়ার।
প্লিজ, সিট।
-থ্যাংকস। আজ ভুল করে ল্যান্ড করিনি,"অ্যাই
হ্যাভ সলভ দিজ ইস্যু " বলে থামল ভিনগ্রহের
প্রাণী।
হাত বাড়িয়ে বলল,  আমি টুইটন! ক্যাপিটাল
সাস্টেশিয়াস আমার আবাস্থল।
এখানে এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে আসি।
-আচ্ছা। বাই দ্যা ওয়ে, কি খাবেন? চা ওর কফি?
-নো থ্যাংকস। আমি নাইট্রাস ট্রেট্টা
আসিটাইল ছাড়া কিছু খাই না। ইউ নো 'হজমে
সমস্যা!
 এনিওয়ে,
মেইন থিং ইজ, সেদিন মনে করেও বলা হয় নি।
আমার বন্ধুর বাসায় তোমার সে বোটের মত একটা
বোট নজরে এল। ভাবলাম এটা সেই বোট। বাট
স্ট্রেইঞ্জ এটাই তোমার বোট হলে আমাকে
চেনার কথা, কিন্তু চিনল না।
শাহরিয়ার যা একটু  আশার কথা ভাবছিল, তাও
সেটা বেলুনের মত চুপসে গেল।
টুইটন বলল, আজ আসি। আমি খবর পেলে জানাবো।
টুইটন দরজা দিয়ে বেড়িয়েছে প্রায়, শাহরিয়ার
হঠাৎ বলল, আচ্ছা জিপিএস ফিক্স করলে কি
করে? সেটা তো জানাবে একটু?..... মুখ ফিরিয়ে
হাসি দিল টুইটন, বিদঘুটে হাসি, এদের ক্লানের
লোকাল হাসি মে বি। দেখা যায় কিন্তু আওয়াজ
নেই।
বলল, সিউর!
শাহরিয়ার ড্রোন নিয়ে সেই সকাল থেকে বসে
আছে। উড়ে গিয়েই পড়ে যাচ্ছে, না হয় দেয়ালে
বারি খাচ্ছে।
এটা দিয়ে ট্রাক করবে শাহরিয়ার।
জিপিএস বাড়ির নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় কাজ
করে, সেখান থেকে আর বাড়ির ভেতর থেকে
ওয়েভ লেন্থ এক্সামিন করবে। দেন, বাকী কাজ।
ইতিমধ্যে, অর্থি "ট্রেবল" নামে একটা ভাইরাস
নিয়ে কাজ করছে। এটা ইনপুট করা হবে বাইরে
থেকে; হ্যাকারের সার্ভারে (যে শাহরিয়ারের
জিপিএস সিস্টেম হ্যাক করেছে তার নেটওয়ার্ক
এ)
বিকেলের দিকে ড্রোন শুন্যে উড়ে
শাহরিয়ারের কষ্টের  অজস্র ঘামের দাম দিল।
লিনাক্স বেইজড ড্রোনের দুটো কাজ, একসাথে
সে ভালনারেবল এবং রেজিস্টিভ।
তার মানে প্রথমে ড্রোন, বোকা সেজে নিজেই
হ্যাক হবে দেন, হ্যাকার যখন বুঝবে সে হ্যাক
হয়েছে। তখনি সে উল্টো নিজের সিস্টেমে
ট্রেবল নামক ভাইরাস নিজে ইনপুট করে দিবে।
এরপর হ্যাকারের সাথে কানেক্ট হবার কারনে
ড্রোনের ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে হ্যাকারের
সার্ভারে। যদি না হ্যাকার আগে থেকে নিজ
সার্ভারে প্রটেকশন চালু না করে।
ড্রোন কাজে লেগে গেল কিন্তু প্রথমটা হলেও
বাকি কাজ হলো না, তবে হ্যাকারের
সার্ভারের নাম জানা গেল।
নাম MkHkZ!
শাহরিয়ার কে যতটুকু হেল্প টুইটন করেছে তার
সবটুকু দিয়ে শুধু জিপিএস কে বোকা বানানো
যায় কিন্তু হ্যাক করা যাচ্ছে না। ভাইরাস তো
দূরের কথা।
শেল প্রটেকশন বেশ কঠিন।
কিন্তু এই MkHkZ টা আসলে কে? আর কেনইবা
করছে?
ভাবতে ভাবতে টুইটন কে মেইল করল শাহরিয়ার।
কিছু একটা অবশ্যই করে টুইটন!
পরদিন, সকালে টুইটন এলো। দুজনে মিলে কাজে
লেগে গেল কিন্তু সবই হচ্ছে, শেষে গিয়ে আর
হচ্ছে না। এরোর আসছে।
কারন ওরা যে শেলকে অ্যাটাক করছে সেটা
নির্দিষ্ট মিনিট পর বদলে যাচ্ছে, তাই আক্সেস
হচ্ছে না হলেও প্রটেকশন থাকায় ফেইল্ড করছে।
শেল ভ্যারিয়েবল।
নাহ, হচ্ছে না। একে ফাঁকি দেয়া যাচ্ছে না।
তার মানে আগে থেকে যেসব ডিভাইসে
প্রটেকশন নেই তারা চাইলেও ফ্রি হতে পারবে
না শুধু শেল পয়েন্ট ভ্যারিয়েবল হবার কারনে।
শাহরিয়ার বুঝল, আর হয়ত এ কারনেই ইয়োটা কাজ
করছে না। হ্যাকার ইয়োটার সিপিইউ তে থাকা
জিপিএস কমান্ড প্রম্পট হ্যাক করেছে। যে
কারনে সেটা রিগেইন করছে না!
টুইটন বলল, মে বি! তবে আমার বন্ধুর বাসায় যে
বোট দেখেছি সেটা তো তোমার ইয়োটা নয়!
শাহরিয়ার বলল, তোমার বন্ধুর নাম ই তো জানা
হয়নি!
টুইটন মাথা তুলে বলল, মিখাইল। আগে আমার
ক্লানে ছিল, এখন তোমার পাশের ক্লানে থাকে
আর আমি সেখানেই আসি বেড়াতে। ওর বাসায়
আসতে গিয়েই তো দু'বার জিপিএস ঝামেলায়
পড়লাম।
শাহরিয়ার এবার নিশ্চিত, মিখাইল এই সেই
হ্যাকার। জিপিএস হ্যাক করা এর কাজ। আর টুইটন
যাকে মিখাইলের বাসায় দেখেছে সেটাই
ইয়োটা।
এখন, একথা টুইটন কে বললে যদি টুইটন শাহরিয়ার
কে হেল্প না করে, তাছাড়া নিজের বন্ধুর
বিরুদ্ধে কেন সে যাবে? যার জন্য সেই দূরের
ক্লান থেকে ছুটে আসে দেখা করতে!
অনেক্ষন ভাবল শাহরিয়ার,
শাহরিয়ার কে ভাবতে দেখে টুইটন বলল, কি
ভাবছ?
শাহরিয়ার বলল, ধরো তোমার বন্ধু যদি এ
হ্যাকার হয় তুমি কি করবে?
একটু ভেবে টুইটন বলল, দ্যাখো, যে কাজটা
করেছে সেটাকে প্রশংসা করতেই হয়। কারন তার
মাঝে ট্যালেন্ট লুকিয়ে আছে। তবে কাজটা
মোটেই ঠিক নয় সেটা মানি। তবে যে করেছে
তার শাস্তি হওয়া উচিত কারন, সে শুধু শত্রুতা
করেই স্রেফ তোমার এরিয়াতে এটা করেছে।
শাহরিয়ার শান্ত গলায় বলল, এটা আর কেউ
করেনি তোমার বন্ধু মিখাইলের কাজ।
আর MkHkZ আইডি টা ওর। এবং ওর বাসায় যে
বোটের কথা বললে সেটাও আমার বোট।
(বলে থামল শাহরিয়ার)
চুপ করে কিছুক্ষন ভেবে টুইটন বলল, আমি
তোমাকে হেল্প করব কারন সে যেটা করছে
সেটা কোন পজিটিভ কাজ নয়।
আমি ওর বাসায় গিয়ে সিস্টেম টার্ন অফ করে
দিচ্ছি।
তুমি এসে তোমার বোট নিয়ে যাও।
আমি বা তুমি এটা হ্যাক করা সম্ভব নয়!
আমি যাচ্ছি, বাই দ্যা ওয়ে তুমি একা এসো না
পুলিশ নিয়ে এসো, সাথে তোমার বানানো
হ্যাকড ড্রোন। প্রমাণ লাগবে। ইয়োটা তো
আছেই!
শাহরিয়ার পুলিশ নিয়ে সরাসরি মিখাইলের
বাসায় গেল।
কিন্ত পুলিশ গিয়ে দেখল, সেখানে কেউ নেই।
বাড়ি খালি।
টুইটন ধোঁকা দিল!
টুইটন কোথায় থাকে, সে ঠিকানা আগেই নিয়ে
রেখেছিল শাহরিয়ার। এবার ওর খোঁজে সে
ঠিকানায় গেল কিন্তু সেখানকার সবাই বলল, দিন
তিনেক নাকি সে ফেরেই নি। তবে টুইটনকে কি
বন্দী করে রেখেছে মিখাইল?
এর পাঁচ পাঁচটি দিন কেটে গেছে। বাসায়
জিপিএস এবার সম্পুর্ন অচল।
কাজ করছে না। ইলিনের সেইম সমস্যা দেখা
দিয়েছে। অর্থি তাই ইলিনের ব্যাটারি খুলে অফ
করে রেখেছে। ইয়োটা গেছে, ইলিন গেলে ভীষণ
প্রব্লেম হবে।
শাহরিয়ার ভাবছে, কি করব বুঝতে পারছি না।
অর্থিও ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছেনা।
শাহরিয়ার বুঝেছে যে করেই হোক, মিখাইলের
সিস্টেম ডাউন করতে হবে। ডাউন হলেই ইয়োটার
জিপিএস কাজ করবে, বাকী কাজ আর
শাহরিয়ার কে করতে হবে না। পুলিশ আসার
আগে ইয়োটা সেটা ভাল করেই হ্যান্ডেল করে
নেবে।
হঠাৎ শাহরিয়ার বলল, অন্য কোন নামে ভাইরাস
এন্টার হচ্ছে না। শে'ল্ল ভ্যারিয়েবল। কেমন হয়
যদি হ্যাকারের MkHkZ নামে ভাইরাসের নাম
করে এন্টার করি!
অর্থি বলল, লেট'স ট্রাই দেন!
ভাইরাসের নাম বদলে দিলাম, ইম্পপ্যাক্ট টাইম
দেয়া হল ০.০০১ মাইক্রো সেকেন্ড।
প্রায় পচিঁশবার চেষ্টার পর, আক্সেস হল।
এরপর ভাইরাস ইনফো পাঠাতে শুরু করল।
হ্যাকারের লোকেশন, ফ্রিকোয়েন্সি, সব।
শাহরিয়ার উচ্ছাসে ভেসে গেল।
এবার ওর সিস্টেম শাট করছি। ভাইরাস এন্টার
করে কমান্ড প্রম্পট বদলে দেওয়ায়, মিখাইলের
বাসায় থাকা ইয়োটা একেক সময় একেক কাজ
করতে লাগল। একবার সে উড়ে, একবার ঘোরে,
কিন্তু ভুল করেও অফ করতে চাইছে না। কারন
ইয়োটার দেয়া সে ভোল্টেজের কথা মনে আছে
মিখাইলের। একবার জিপিএস হ্যাক থেকে
ইয়োটা মুক্ত হয়ে গেলে রক্ষে নেই।
শাহরিয়ার ভাইরাসের গন্ডগোল এদিকে
ভালোমত পাঁকিয়ে দিল।
 এবার অর্থিকে বলল, ভাইরাস ইনপুট সচল রাখতে।
আমি ড্রোন নিয়ে লোকেশন ট্রাক করে সেখানে
পুলিশ নিয়ে যাচ্ছি।
মিনিট কুঁড়ি লাগল পুলিশকে বোঝাতে।
বেচারারা বোঝেই না!
গাড়ি নিয়ে বাসায় যেতেই দেখতে পেল,
মিখাইল বাসায় ব্যাপক ব্যাস্ত।
শাহরিয়ার কে দেখে অবাক হল, সেই সাথে
পুলিশ প্লাটুন!
ইয়োটার ব্যাটারি খুলে রেখেছে মিখাইল। তবে
ঘরে ঢুকেই দেখা গেল বিশাল তছনছ দশা।
জিনিসপত্র এলোমেলো।
পুলিশ ঘর তল্লাশি শুরু করল। টুইটন কে পাওয়া গেল
হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় খাটের নীচে। সাথে
একটা বোট আছে, যেটার ব্যাটারি খোলা।
পুলিশ টুইটন এবং বোট (ইয়োটাকে) বাইরে আনল।
শাহরিয়ার ইয়োটার ব্যাটারি কানেক্ট করে
সেটা সুইচ অন করল।
অন হতেই তেড়ে গেল ইয়োটা!! মিখাইল কে
দেখেই তার মেজাজ গরম হয়েছে।
শাহরিয়ার মিখাইল কে বলল, কি মিখাইল?
সিস্টেমে জটিলতা?
আরেকবার "টার্ন অন " করার ইচ্ছে আছে?
পুলিশ হাত কড়া দেবার আগে। ২০০ ভোল্ট ইনপুট
করেছে ইয়োটা।
শাহরিয়ার বলল, আরে না না!! নো পুলিশ উইল
হ্যান্ডেল হিম!
ইয়োটা বলল, উপ্স! জাস্ট ২০০ ভোল্ট! সরি!
(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...