রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯

গল্পঃ তৃতীয় নয়ন (হরর থ্রিলার)


(এক)
ট্রেন লাইনের দু'পাশের সবটা ঘিরে কালো
অন্ধকার। চোখের সবটুকু ক্ষমতা খাটিয়ে বুঝলাম
বেশ গাছপালা আছে এদিকটায়।
ট্রেন লাইনের শেষ মাথা দুটো দূরে গিয়ে
কুঁচকুচে আঁধারে মিলেছে। যতদূর চোখ যায়,
তাতে আধাঁর ছাড়া আর কিছু নজরে আসছে না।
ময়মসিংহের এই রাস্তায় আমার আগে আসা
হয়নি। তবে একদম আসিনি তা নয়, ট্রেনে চড়ে
এই পথে যাওয়াআসা অনেকভাবে। কিন্তু
একটিবার স্টেশনে নামা হয়নি।
তবে ছোটবেলায় এসেছিলাম বাবার হাত
ধরে। তখন সবে ক্লাস ওয়ান! এতটা স্মৃতি এখন আর
মনে নেই।
অনেক বদলে গেছে এখন। হাতের বামে ধরে
গেলে একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ছে।
বাইরের সে মাটির চুলো থেকে উড়ে যাওয়া
ধোঁয়া এখনও সাদা আবছা দেখা যাচ্ছে। হয়ত,
বেশী দেরী হয়নি -দোকানী তার দোকান
বন্ধ করে চলে গেছে।
সত্যি বলতে স্টেশন টা একদম খালি। শুনশান
নীরবতা এই মাঝ রাত্তিরে। এটা গেঁয়ো
স্টেশন, তাই লোকজনের ভীর-বাট্টা একদম নেই।
ঝুট ঝাট করে এখানে ট্রেন থামেনা। যদি না-
সিগন্যাল দিয়ে থামানো না হয়।
আজ, আমারো ভুল "কি দরকার ছিল একটু ফ্রেশ
হয়ে পান চিবানোর! " ট্রেন মিস হয়ে গেল।
স্টেশনের আশেপাশে জনবসতি নেই, শুধু স্টেশন
মাস্টারের একটা টিনের একতলা চালা।
যেটার সদর দরজায় মস্ত বড় তালা ঝুলছে।
লাইনের থেকে বেশ দূরেই যাত্রীদের বসার
জন্য কাঠের বেঞ্চ।
ব্যাগটা হাতের পাশে রেখে বেঞ্চে বসলাম।
প্রকৃতি প্রচন্ডরকম শুনশান।
আনমনে বেঞ্চে বসে পা দোলাচ্ছি। একা
একা খুব ভয় লাগছে। সেই সাথে চোর-
ডাকাতের চিন্তা মাথায় চাড়া দিয়েছে-
সাথে অবশ্য মালামাল হালকা-পাতলা। কাপড়
বোঝাই ব্যাগ, সাথে সিগারেট, ম্যাচ আর
শরৎচন্দ্র সমগ্র। ট্রেনে বসে বোরিং ভাব
কাটাতে বইয়ের আয়োজন। এখন সেটাই ভারী
মনে হচ্ছে। কেউ আক্রমণ করলে পালানোর পথে
ভারী কিছু নিয়ে দৌড় দেয়া বোকামী। ধরা
পড়বার চান্স প্রকট!
তবে,
মজার ব্যাপার হলো আমার ম্যাচটার নিচের
দিকে একটা টর্চের মত আছে। সেটাই এদিক-
ওদিক করে দেখছি কেউ আসছে কিনা। খুব কম
হলেও এখন এইটুকু আলো আমার কাছে মহা কিছু!
ডান হাতটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে
সিগারেট বের করে আগুন জ্বালালাম। একরাশ
ধোঁয়া ছেড়ে বুঝলাম। শীতের প্রকোপ পাওয়া
যাচ্ছে। গায়ে শিরশিরে একটা ভাব। ব্যাগের
থেকে টাওয়েল বের করে গলায় দিলাম।
"নো কম্প্রোমাইজ উইথ কোল্ড"
শীতটা আরো বাড়ছে। আধা ঘন্টা পার করে
ফেলেছি অথচ কেউ একবার এদিকে এলোই না।
নাহ! বিষয়টা সুবিধের লাগছে না। শেষ সম্বল,
সিগারেট দুটো শেষ করেছি এরই মাঝে।
বাকী আছে মাত্র এক!
ভাবলাম বেঞ্চে গা এলিয়ে দেই। গা
এলিয়ে পায়ের কিছুটা বাড়াতেই অর্ধেক
গিয়ে আটকে গেল,
আরে একি! বেঞ্চের বাকি অংশে একটা
বস্তা রাখা। গ্রামের লোকের আর কাজ! বসার
জায়গাও দখল চাই! হু!
অগত্য বস্তায় মাথা রেখে গা এলিয়ে দিলাম।
প্যু ও ও ও ও ও......
ধরমর করে উঠে বসলাম। গা ঝাড়া দিয়ে ব্যাগ
হাতে নিলাম ট্রেন এসে গেছে কি কপাল!
আহা!
থাম!!!! থাম!!! ঐ.... ট্রেন!!!
কিন্তু বিধি বাম! ট্রেন থামল না। আমি তো আর
সুপার ম্যান কিংবা ডাকু নই' দৌড় দিয়েই
ট্রেনে চড়ে যাব।
মেজাজ প্রচন্ড খারাপ।
হাতের ব্যাগ বেঞ্চের কোনায় ছুড়ে দিলাম।
সিগারেট আছে মাত্র একটি। সেটা জ্বালাব
কি জ্বালাব না ভেবে শেষমেষ পকেটে
রেখে দিলাম। জানি না কতক্ষন এখানে
থাকতে হয়!
হাতঘড়িতে রেডিয়াম কাটা দুটা জ্বলছে আর
আমার দিকে ফিরে মুচকি হাসছে। নিজেকে
বিনে পয়সার জোকার মনে হচ্ছে।
চুপচাপ বসে ঘড়ির কাটার মুভমেন্ট দেখতে
লাগলাম। আমার পাশে, কিছুটা গাছপালা
ঝোপের পর খোলা মাঠ। আধাঁরে অপরুপ কিছু দৃশ্য
আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল হঠাৎ। থোকা থোকা
জোনাকী। আকাশের তারা যখন মেঘমুক্ত
আকাশের রাতে জ্বলজ্বল করে, ঠিকে তেমনি
জোনাকী গুলোর ঝলকানি।
(দুই)
কখন যে ঘুম এসে গেছে বুঝিনি। তাকিয়ে
দেখলাম নিজের বা হাতে কাত হয়ে ঘুম
দিয়েছিলাম। আড়মোড়া ভেঙে এবার শেষ
সম্বল টা জ্বালিয়ে দিলাম। সিগারেট খোর
দের বড্ড বাজে অভ্যাস। না জ্বালিয়ে থাকা
যায় না। সকাল হলে পাশের দোকান থেকে
কিনে নেয়া যাবে। থাক, কি হবে আর কষ্ট
করে।
হঠাৎ ভয় হলো, আরে আমার ব্যাগ, টাকা!
নাহ, নিশ্চিত হলাম। কিছু খোয়া যায়নি। তার
মানে ঘুমোবার সময় কেউ আসেনি এখানে।
ধ্যাত, চোর হলেও এই রাতে সংগ পাওয়া যেত।
একা একা থাকার কোন মানেই হয় না।
এখনো সেই জোনাকী গুলো জ্বলজ্বল করছে
আগের মত। ফ্রেশ হবার তাগিদে ঝোপের
পাশে গিয়েছি হঠাৎ দেখলাম, উত্তর-পূর্ব কোন
ধরে, ঠিকে যেদিকে ক্ষেতের শুরু ঠিক
সেখান থেকে কেউ একজন স্টেশনের দিকেই
আসছে।
যাক গে, যে আসুক! কথা বলার মত কেউ তো
আসছে। হাতের সিগারেট শেষ। ফিল্টার টা
ছুড়ে দিলাম জংগলে।
লোকটা প্রায় কাছেই এসে গেছে, আমিও
বেঞ্চে ফিরেছি। ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে।
কি বাবু? কে আপনে?
আমি বিভূতিভূষণ।
পাশের গ্রামের পরের গ্রামে আমার কাকার
বাড়ি। সেখানেই আজ যাবার কথা কিন্তু
মাঝপথে ট্রেন মিস করে এই জনমানুষহীন
স্টেশনে বসে আছি।
কার বাড়ি?
কমল জোয়ার্দার!
আরে সে তো আমাগো আপনা লোক! আপনে
কি তার আপন ভাইস্তা?
না। সে দূরসম্পর্কের কাকা।
আইচ্ছা। কোন চিন্তা নাই আমি আছি এই হারু
আছে, আপনে আমার লগে আসেন। আমি
আপনারে পৌঁছায় দিব। আসেন!
না থাক! ধন্যবাদ। আমি একাই একটু পরে চলে
যাব। এখন রাত তিনটা! ভোর হতে বেশী দেরী
নেই।
আহা! এত রাতে স্টেশন এ একা থাকবেন? এইটা
ক্যামনে হয়? আসেন তো! (বলেই আমার হাতের
ব্যাগ নিজে টেনে নিল)
আসেন, আসেন। কাছেই আমার ভ্যান গাড়ি।
তাছাড়া গতরাতে এইখানে একটা
অ্যাক্সিডেন্ট হইছে। তাই আইজ আর ট্রেন থামব
না।
-অ্যাক্সিডেন্ট?
-হ' আজ এর লাইগ্যা ট্রেন নাই। এমনেই আহে না
তার পরে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট!
অচেনা লোক হলেও কথা ভাল বলেছে। আজজ
রাত অন্তত লোকটার আশ্রয়ে কাটিয়ে কাল
রওনা দেয়া যাবে।
ঘড়িতে রাত তিনটে কুড়ি।
বললাম আচ্ছা চলুন তবে।
ট্রেন লাইন ছেড়ে আমরা ক্ষেতের আইলে এসে
পড়েছি। লোকটা নানা কথা বলে যাচ্ছে। কি
করে? তার দাদা নাকি মস্ত বড় পালোয়ান
ছিল। অথচ সে দেখতে শীর্ণকায়।
তার এক ছেলে, সে ক্লাস ফাইভে পড়ে।
আমিও হাতের ছোট্ট ম্যাচলাইট জ্বালিয়ে
তার পিছুপিছু চলেছি। গ্রামের ছেলে আমিও।
তাই ক্ষেতের আইলে হাটতে আমার অসুবিধা
হচ্ছে না।
লোকটাকে থামিয়ে আমি জানতে চাইলাম,"
ভাই, আপনি কি করেন? "
আমি, বলে এক গাল হাসল। গ্রাম্য সহজ সরল
হাসি।
ভ্যান চালাই।
আপনার ভ্যান?
হ' আমার বিয়াতে বৌয়ের বাড়ি থেইকা
যৌতুক দিসিল। লোকটা এক মুহূর্তে লাজুক হয়ে
গেল। কথার বেগ কমে এল তার।
আমারও ভাল লাগছে লোকটার সাথে কথা
বলে।
আমাকেও পাল্টা প্রশ্ন করল হারু মিয়া।
"দাদা কি বিয়ে করছেন? "
না ভাই, করিনি!
কন কি? বিয়া করবেন না?
(লোকটার এই প্রশ্নের কারন স্বাভাবিক, আমার
কপালের পাশে, জুলফিতে পাঁক ধরেছে। এই
বয়সে বিয়ে করিনি দেখে অবাক না হবার
কিছু নেই)
(লোকটাকে থামিয়ে,) এহেম এহেম, আর কতদূর?
এইত আইস্যা গেছি!
আপনে কি করেন?
লেখালেখি।
শুনছি, যারা লেখে তাগো অনেক ভক্ত?
হুম, তা থাকে।
আপনের ভক্ত কেমন?
আছে, গোনা সম্ভব নাহ।
হেহেহেহেহ, ঐ যে আমগাছের বাগান ঐ
খানেই আমার বাড়ি। আহেন, ভ্যানে উঠেন।
ব্যাগটা সাইডে রেখে ভ্যানে উঠলাম।
হারু মিয়া বলল, শক্ত কইরা বইসেন! বলে এক গাল
হাসি দিল। আধাঁরে দাতগুলো চকচক করছে।
কিছুটা সময় ধীরে চললেও ভ্যানের গতি দ্বিগুণ
হল মিনিট দুই পরে, আস্তে আস্তে ভ্যানের গতি
ট্রেনের গতিকে হার মানাচ্ছে।
আমার দু'হাত তখন ব্যাস্ত ভ্যানের সিট চেপে
ধরতে।
হঠাৎ দেখলাম ভ্যান, একটা ট্রেন লাইন ক্রস
করছে।
আর বিপরীত দিক থেকে একটা ট্রেন হুইসেল
চেপে তীব্র বেগে ছুটে আসছে।
আমি আর্তচিৎকার করে বললাম, "হারু মিয়া!
ভ্যান থামাও!! ভ্যান থামাও!! "
হারু মিয়া শুনছে না। তার ভ্যানের গতি তীব্র
হচ্ছে।
আমি ভেবে পেলাম না যে স্টেশন ছেড়ে
এলাম সেখানে আবার আমি কি করে এই
ভ্যানেই এলাম।
আমাকে অবাক করে ভ্যানগাড়ি চলে গেল
ট্রেনের নিচে, আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান
হারানোর আগে দেখলাম হারু মিয়ার মাথা
ট্রেনে কাটা পড়ে আলাদা হয়ে গেল।
এই যে! এই যে ভাই?
কে আপনে?
চোখ মেলে তাকালাম। একি! আমি এখনো
বেঞ্চে শুয়ে! কিন্তু হারু মিয়া?
একি! তাকিয়ে দেখি হারু মিয়া আমাকে
ডাকছে।
আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম।
হারু মিয়া তুমি মর নি?
কে মরবো দাদা? আমি না আপনে?
লোকটা কেলিয়ে হেসে দিল। বলল " আমি তো
মরছি, এইবার তো আপনে মরবেন? "
(পা ফেলে আমার দিকে এক পা করে এগিয়ে
আসতে লাগল, আমি ভয়ে পেছানো শুরু করলাম)
অবশেষে থাকতে না পেরে দৌড় দিলাম।
চিৎকার করে চেঁচাতে লাগলাম, বাঁচাও!
বাঁচাও!!!
পেছনে ফিরে দেখলাম লোকটা বড় বড় পা
ফেলে আমার দিকে ছুটে আসছে
আমি প্রানান্তকর ছুটে চলেছি...
দুরে এসে দেখলাম হারু মিয়া আসছে না। আমি
দৌড়ে কোথায় এসেছি জানি না।
হঠাৎ পেছন থেকে কাঁধে হাত পড়ল!
ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, কে এ এ এ এ!!!!
আমি স্টেশন মাস্টার রহমান।
আপনি কে? আর এমন করে হাপাচ্ছেন কেন? কি
হয়েছে?
হারু উ উ...
মানে?
ভ্যান চালক হারু মিয়া!
আসেন, আসেন আমার সাথে।
কোথায়?
স্টেশনে। (লোকটার হাতে কেরোসিনের
হারিকেন, মৃদ্যু আলোতে জ্বলছে। সেটা দেখে
ভয় কমল)
আবার তার সাথে স্টেশনে ফিরে এলাম।
বেঞ্চে আমার ব্যাগ জলদি হাতে নিলাম।
আমাকে স্টেশনের কামড়ায় বসিয়ে হাতে এক
গ্লাস পানি দিলেন তিনি। বললেন, "নিন
পানি খান "
এক ঢোকে খেয়ে নিলাম।
এরপর বললেন, "দেখুন তো আপনার পেছনে যে
লোকটি দাঁড়িয়ে, এ সেই হারু কিনা? "
আমি ঘুরে আর জ্ঞান রাখতে পারলাম না। হারু
মিয়া গায়ে রক্ত নিয়ে আমার পেছনে।
তীব্র কোলাহলে ঘুম ভাঙল।
বেশ লোকজনের ভীর। চায়ের কাপে টুংটাং
শুনছি। বামের সেই দোকানে মধ্য বয়সী
দোকানী।
সেই সাথে আরো কয়েকজন মুরুব্বি। তারা চা
খাচ্ছে।
আমি কিছু না বলে সেখানে গেলাম। বালতি
থেকে পানি নিয়ে মুখে ঝাপটা দিলাম।
"চাচা, চা হবে? "
হইব বাবা, বহ।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনলাম। গত রাতে
ট্রেনে কাটা পড়ে দুজন মারা গেছে। একজন
ভ্যান চালক হারু, পাশের গ্রামে যার বাড়ি।
আরেকজন রহমান, যে এখানকার স্টেশনের
মাস্টার!
আমার চায়ে চিনি বেশী হয়েছে। চাচা
আমাকে আর এক কাপ চা দেবেন?
দিতাছি বাবা।
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...