মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯

গল্পঃ কেস নম্বর আঠারো

(এক)

        চায়ে হালকা চুমুক দিয়ে বাকীটা পিরিচে ঢেলে নিলেন আতিক স্যার, তারপর সুরুত সুরুত করে বার কয়েক চুমুক দিয়ে বললেন, আনিস! চাকরীর যখন দুই বছর বয়েস ঠিক তখনি প্রথমবারের মতন কেস সলভ করতে গিয়ে বেশ বড়রকমের ধাক্কা খাই!
আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম বেতের চেয়ারে। হাতে থাকা আইনের বইটা টেবিলে রেখে ফোন সাইলেন্ট করে স্যারের কথায় মনোযোগী হলাম। আমি বিকেলে আড্ডা দিতে প্রায়শই আতিক স্যারের বাসায় আসি, আজও এসেছি তেমনিভাবে।
আসলে স্যার যখন কোন ঘটনা বলতে শুরু করেন তখন তার মাঝে ই ক্লু ছেড়ে দেন পুকুরে পোনা ছাড়ার মতন করে, নিঃশব্দে ক্লু মাছের পোনার মতন কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে অথচ বুদ্ধি না থাকলে সেটা ধরা মুশকিল!
তাই মনোযোগী না হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পিরিচ টা সামনের টি টেবিলে রেখে, বাম পা ডান পায়ে তুলে স্যার শুরু করলেন।
তখন ৯০ এর গোড়ায় দিক, আমি খুব তোড়জোড় করছিলাম বদলী হতে। সবে চাকরি, তারপর বিয়ে। এর মাঝে একলা থাকা পোষাচ্ছিল না। আর অফিস এমন অজপাড়া গাঁয়ে যে সাইকেলে করে যেতেও অবস্থা খারাপ।
বর্ষা তখন ভরা যৌবন, চারিদিকে পানি আর পানি। ক্ষেতের ফসল ডুবে যাচ্ছে তবুও মাথা তুলে আংশিকভাবে জানাচ্ছে ওরা এখনো আছে। আমাকে পুলিশি পোষাক পড়তে হতো না কারণ গাঁয়ের প্রায় সবাই ততদিনে এক নামে আমাকে চেনে। আমি থানার প্রধান কর্মকর্তা। গাঁয়ে থাকার এই একটা সুবিধা বলতে পারো, কেউ শহরে তোমার খোঁজ নিলে না নেবে তাতে কোন দায় নেই কিন্তু গাঁয়ে এমনটা হয় না। তোমার নাড়ী-নক্ষত্র তারা জেনে তবে ই শান্ত হবে।
সে যাক!
ঘটনা ঘটল আমার বদলীর কাগজ আসার ঠিক দুইদিন আগে। ডাকে কাগজ আসবে ততক্ষণে জেনেছি কিন্তু অফিসিয়ালি কাগজ হাতে না পেলে কিছু করতে পারছিলাম না কারণ কাগজেকলমে আমি তখনো থানার ইনচার্জ। আর ঘটনাটাও ঘটল তার ই আগের দিন। ভোররাতে শুয়ে আছি, হাবিলদার আমার দরজায় নক করে আমাকে ডাকল, স্যার! স্যার! একটু আর্জেন্ট ডাক পড়েছে! স্যার..
আমি মাথার বালিশের কাছে টর্চ হাতে নিয়ে ঘড়িতে আলো ফেলতে দেখলাম রাত ১ টা ৫০ মিনিট। ট্রান্সফার হয়ে গেছে সে আনন্দে ঘুমাতে প্রায় ১১টা বেজে গেছে। তাই মশারি ঠেলে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও উঠে যেতে হলো। পায়ে স্যান্ডেল পড়ে খটাসখটাস শব্দে টর্চের আলো ফেলে গেট খুলে দিলাম।
হাবিলদার ঘেমে একাকার, মুখের অভিব্যক্তি বোঝাচ্ছিল ভাল কিছু নয়।
স্যার! এক লোক খুন হয়েছে রাতে, সে জুয়াড়ি। লাশ এখন উদ্ধার করে পুলিশি হেফাজতে এনেছি। আপনি ইন্সপেকশন করে দিলে ই মর্গে যাবে ওটা।
আমি গুরুত্ব না দিয়ে বললাম, উহ! আমার দেখার কি দরকার। তাছাড়া আমার তো বদলী ও হয়ে গেছে খামোখা কেন আর কেস নিতে যাবো? তুমি যাও! মর্গে পাঠাও আর আমার জুনিয়র অফিসার কে যেতে বলো সাথে তুমিও যাও। সাক্ষী পেয়েছো?
না স্যার!
মানে কি? খুন হয়েছে কোথায়?
এরপর হাবিলদার যা বলল তাতে আমার আগ্রহ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেড়ে গেলো।
মৃত সেই জুয়াড়ির নাম করিম শেখ। শেখ! মানে গ্রামের মোড়ল, গাজী শেখের একমাত্র ছেলে। আগে মোড়লদের যা ক্ষমতা ছিল তা চোখে না দেখে অনুমান করাও ভুল হবে। তার ই ছেলে খুন, সুতরাং হইহই ব্যাপার। তাছাড়া ঐ মোড়লের ছেলের বিয়েতেও গেছিলাম আমি। কেস না নিলেও সেখানে আমাকে যেতে হলো কারণ জানো ই, কেস আরেকজন এসে ঠিকি হাতে নেবে। আর সেজন্য একটা প্রিলিমিনারি ইনভেস্টিগেশন ফাইল চাই। দুজন হাবিলদার কে সাথে নিয়ে থানার সাইকেলে উঠে গেলাম ঐ রাতে ই।
 সে হোক, কিন্তু স্পটে গিয়ে দেখলাম বিভৎস দৃশ্য। খুন করে তার দু পা বাড়ির দরজায় আর দু হাত বাড়ির জানালায় আর মাথাটা খুঁজে পাওয়া যায় নি। আরেকটু হলে ই কবন্ধ বলে চালিয়ে দেয়া যেতো যদিও কবন্ধ ব্যাপার টা অন্যরকম ডেফিনেশনে তে পড়ে। মৃত করিম শেখের নতুন বৌয়ের জ্ঞান ফেরেনি। আরো জানতে পারলাম উনি তখন তিনমাসের সন্তানসম্ভাবা। তাকে সকালে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে এমনি এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোড়ল সাহেব। তাতে বাধ সাধলাম আমি। এই অবস্থায় মানবিক কারণ হলেও কেসের সাসপেক্ট কিন্তু সবাই। মোড়ল খুব একটা খুশী হলেন না তবে ছেলের শোকে কাতর, এই প্রয়োজন টা ঠিকি বুঝলেন তবে তার ধারণা ছেলের বৌ কাজটি করেনি এবং কোনভাবে জড়িত নয়। তবে আমরা পুলিশ! শোনা, বিশ্বাস এসবের চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে প্রমাণ। আমার তখন তাই দরকার। লাশের মাথা খুঁজতে কয়েকজন কে জোর তৎপরতার সাথে দ্রুত পাঠিয়েদিলাম সাথে সাথে। তারা বাড়ির আশেপাশেও খুঁজতে লাগল। আমি জেলা সদরের ডাক্তার কে আনতে পাঠালাম যাতে ময়নাতদন্ত টা দ্রুত করা যায়। চোখে এত্ত ঘুম ছিল আনিস, যে একজন কে জেরা করতে গিয়ে ঝিম লেগে যাচ্ছিল।
ঘড়িতে শেষরাত, তবুও আশেপাশে লোকের সমাগম কম না। পঞ্চাশ-ষাটজন ঘিরে দূর থেকে দেখছে আমাদের।

(দুই)
       ডাক্তার এসে লাশ এম্বুলেন্সে তুলে নিলেন। আমার সাথে করমর্দন করে বললেন। দেখুন, আমাদের! রাত সাড়ে তিনটা। ডিউটি করছি। মাইনে নেই, সেটা বাড়ে না বরঞ্চ পাব্লিক আমাদের উপর হর-হামেশা উত্তেজিত। ডাক্তার সাহেব কাগজে দ্রুত প্রয়োজনীয় ডাটা তুলে। মৃতের পরিবারের একজন কে সাথে একজন হাবিলদার কে এম্বুলেন্সে তুলে সাইরেন তুলে চলে গেলেন।
ভোরের আজান দিলো, আমি একটা চেয়ারে তখনো বসে। ঘুমে টলছি। তবুও চোখ বুজে থাকার উপায় নেই। মাথা খুঁজে প্রায় এক কিঃমিঃ তন্নতন্ন করেও সেটা পাওয়া যায় নি। হাবিলদার যেমন বিরক্ত তেমনি হতাশ। আমার কাছে এসে একটা স্যালুট ঠুকে বলল, স্যার! পাইলাম না।
বললাম, আশেপাশে নর্দমা, পুকুর এগুলা দেখেছো?
মাথা নাড়াল, না স্যার!
যাও, কাউকে নামিয়ে জাল ফেলে সার্চ করো।
মোড়লের বাড়িতে শোকের মাতম। বেশী কাঁদছেন মৃতের বৃদ্ধ মা। বুক চাপড়ে কাঁদছেন তিনি। আমি সেখান থেকে সরে এলাম। কেস ফাইলে চোখ রেখে দেখলাম অনেক তথ্য অনুমানে বসানো। তবে জেরা করার পর আংশিকভাবে কয়েকটা মিলেছে।
হঠাৎ-' স্যার' ডাক শুনে ফিরে দেখি। বছর ১৬ এর এক ছেলে, চা দোকান চালায় পাশে হয়ত। চা নিয়ে এসেছে। শীতে হাত-পা কাঁপছে। তখনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি চলছে। রাতে কিছুটা থেমেথেমে হলেও এখন আবার শুরু হয়েছে। ছেলেটির মাথায় নীল রঙের পাতলা পলিথিন, বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে চা দিতে এসেছে।
-'হাবিলদার কাকা আপনার জন্যি পাঠাইল '
আমি হালকা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ' কি নাম তোর? থাকিস কই?'
সে নাম বলল, জাবির! পাশের গ্রামে থাকে।
জিজ্ঞেস করলাম, মৃত করিম শেখ কে চিনিস?
বলল, হ্যাঁ! মাঝেমধ্যে তার দোকানে আসতো কিন্তু চায়ের পয়সা দিতো না।
-'তুই টাকা চাসনি কোনদিন? '
-' নাহ!'
- ' কেন?'
- 'টাকা দিতো না, রাগ করতো তাই আর চাইতাম না'
বুঝলাম, যে বাপ গাঁয়ের মোড়ল হবার সুবিধা ঠিকি নিতো করিম শেখ। বললাম, 'আচ্ছা এখন যা, বাকী হাবিলদার যারা আছে তাদের কেও চা দিয়ে দে। পরে এসে বিল নিয়ে যাবি আমার থেকে, ঠিকাছে?'
ছেলেটি পলিথিনের ভেতর হলুদাভ দাঁতে হেসে কাঁদামাখা পায়ের ছাপ ফেলে সামনের বাড়ির পেছনে উধাও হয়ে গেলো।
চায়ে এক চুমুক দিয়েছি কি দেই নি, ছাতায় বৃষ্টির শব্দ তুলে মোড়ল সাহেব এসে হাজির।
-' কি করতাছেন? লাশের পুরাটা পাইছেন? চা খাইতাছেন বইস্যা বইস্যা!'
আসলে সারারাত জেগে বসে আছি, মেজাজ টা এত্ত খারাপ তখন। সড়াৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ই কথা শোনাতে যাবো অমনি হাবিলদার চেঁচিয়ে উঠল।
-' স্যার! স্যার! পাওয়া গেছে মাথা! '
চায়ের কাপ নামিয়ে সেদিকে ছুটলাম যেদিকে হাবিলদার চিৎকার করেছে। গিয়ে দেখি অদ্ভুত ঘটনা! মৃত করিম শেখের মাথার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে হাবিলদার। মাথাটা কারো হাতে নেই সেটা মোড়লের বাড়ির কবুতরের খাঁচার উপরে একটা সূচালো বল্লম আকৃতির একটা লাঠিতে গেঁথে রাখা হয়েছে। সেটা দেখে মূর্ছা গেলেন মোড়ল।
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মৃতের মা এসেও সড়াৎ করে পড়ে গেলেন বাড়ির ভেতর থেকে বৃষ্টির জল বেড়িয়ে আসা নালার উপর।
আনিস এতক্ষণে কথা বলল, ' স্যার! দেখে মনে হচ্ছে যে খুন করেছে সে খুব ক্ষুদ্ধ ছিল সেই মৃত লোকটির উপর!'
আতিক সাহেব, চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন, হয়তো তাই! কারণ, আমরা তখনো কিচ্ছু জানি না এই বিষয়ে।
তারপর আতিক সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন,
খাঁচাসহ মাথাটা নামানো হলো তারপর অনেকটা ভেঙে ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজে পেতে লাঠির অংশভাগ রেখে দেয়া হলো। আমরা যা যা প্রিলিমিনারি সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলাম তাই নিয়ে ফিরে এলাম থানায়। রাতে ঘুমাই নি আমরা কেউ। কেবল সে রাতে যারা স্পটে যায়নি কেবল তারা ই থেকে গেলো থানায়। আমি এবং বাকীরা ফিরে এলাম যে যার বাড়ি। একটা ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে আমিও ঘুমালাম, পরিশ্রান্ত হয়ে, ক্লান্তি নিয়ে।

(তিন)

       সেদিন ই বিকেলবেলা আবার থানায় যেতে হলো আসলে যেতে যেতে সন্ধ্যে হলো। থানা ছেড়ে যাচ্ছি তাই অহেতুক এই কেসে আর নিজেকে জুড়তে ইচ্ছে করছিল না। থানায় গিয়ে ই দেখি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এসে গেছে। তাতে লেখা দু-তিনজনের হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। তার মাঝে কিডনি দুটো মিসিং।মাথায়, মানে ঘাড়ে কোপের দাগ। সেটা খুনের আগে না পরে বোঝা মুশকিল কারণ সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, যদিও একটু থেমেছিল। তবে ডাক্তারের ধারণা কয়েকটা দাগ খুব ডীপ তার মানে  পরেও আছে। অস্ত্র দুটো এবং দেশী। খুন করা হয়েছে মোক্ষম কোপে। ধরাশায়ী করে তারপর পিস পিস করা হয়েছে।
শরীরে কিছু ঝোপঝাড়ের বুনো পাতা লেগে ছিল। সেই পাতা কোথায় কোথায় পাওয়া যায় লিস্ট করে সন্ধ্যার আগে দুটো টীম কে সার্চে পাঠালাম। খুনী সেই স্পটের আশেপাশে কেউ কিনা জানা দরকার। তার পাশাপাশি গত সপ্তাহে কামারের হাতে কি কি দেশীয় অস্ত্র গেছে বিক্রি হয়ে আর কারা কিনেছে এই লিস্ট করতে কামারের বাড়ি একজন হাবিলদার কে পাঠালাম।
রাতে অফিসে বসে আছি, তখন এলেন মোড়ল নিজে। চোখদুটো ভয়াবহ লাল। কেঁদে ফেললেন আমার হাত ধরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, স্যার! আমার ছেলের খুন কারা করছে? - খুঁইজা বাইর করেন, জানি! আমার পোলার চরিত্র ভাল ছিলনা, মদ খাইতো, জুয়াড়ি ছিল তারপরেও এর বিচার আমি চাই!
আমি তাকে হাত ধরে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। তারপর একজন হাবিলদার কে একগ্লাস পানি আনতে পাঠিয়ে দিলাম উনার জন্য। উনি পানি খেতে ই বললাম, 'আমি চলে যাচ্ছি, এই কেস অন্য অফিসার এসে দেখবে। আশাকরি উনি এই কেসে উপযুক্ত সমাধান করবে।'
মোড়ল কে হতাশ, একইসাথে অখুশি লাগল। এই উত্তর তিনি আশা করেননি। তিনি গ্লাস নামিয়ে ফিরে গেলেন দ্রুত পায়ে। আসলে আমার এই কেসে কোন আগ্রহ ছিল না আর মোড়লের ছেলের যা ইতিহাস তাতে এমন কিছু ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে খুন টা ভয়াবহ!  একটা লোককে পাঁচ টুকরো করে পাঁচ জায়গায় ফেলে রেখেছিল।
থানা থেকে বাড়ি ফিরবো তখনি স্যালুট ঠুকে হাবিলদার এলো, যাকে পাঠিয়েছিলাম গাঁয়ের দু-চারজন কামারের কাছে। সে জানালো বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝেছে তারা কেউ ই ভারী দেশীয় অস্ত্র ধারালো কিংবা তৈরি করেনি গেলো সপ্তাহে। তবে এও সন্দেহ থেকে গেলো তারা কি আদৌ সত্য বলছে কিনা? মৃতের কিডনি দুটো পাওয়া যায়নি। কাছাকাছি যত ক্লিনিক আর হাসপাতাল ছিল তাতেও কিডনি গত চব্বিশ ঘণ্টায় জমা পড়েনি। কিডনি বিক্রি হয়েছে এটা নিশ্চিত নই আমি। আর খুনের জন্য এই গাঁয়ের গোটা জনবসতির সবাই ই এখন আসামী।
কথার মাঝে এবার মুখ খুলল আনিস, স্যার! মোড়লের বাড়ির সদস্য কারা তাদের ব্যাপারে তো কিছু বললেন না? তারা কি ক্লিন ছিল এই কেসে?
নাহ! মোড়লের বাড়িতে সদস্য বেশী না। মৃত করিম শেখ সহ বাড়িতে মোট সদস্য মাত্র ছ'জন। মোড়ল এবং তার স্ত্রী, পুত্রবধূ, দুজন চাকর বয়েস প্রায় ষাট আর নিহত করিম শেখ। চাকরের মাঝে একজন আয়া মানে ছোট থেকে সে বাড়ির ঠিকে কাজ, রান্না এসব করে। আরেকজন ও তাই বাড়ির ফায়ফরমায়েশ শোনে। এদের শারীরিক গঠন এমন নয় যে এরা এই খুন করতে পারে। তবে শারীরিক গঠনে বিভ্রান্ত হবার কারণ ছিল না। সেখানেও ছাঁইয়ের গাদায় সুঁই খুঁজেছি দশা। তাছাড়া আমি জুয়াড়ি গ্রুপের সদস্যদের জেরা করেছিলাম। ওরা কেউ ই অত রাতে করিম শেখের সাথে ছিল না। তাদের ভাষ্যমতে, করিম শেখ তাসের দুই সেট খেলে জেতার পর মোটা টাকা হবে এই হাজার পাঁচ পকেটে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। সে প্রায়শই মদ খেতো কিন্তু মজার ব্যাপার সেদিন সে মদ খায় নি। তাই দূর্বল শক্তির কেউ যদি আক্রমণ করে সেখানে ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যেতো কিন্তু যা ফরেনসিক মানে ময়নাতদন্ত এ পেয়েছি তাতে এমন উল্লেখ ছিল না।  পাকস্থলী তে অ্যালকোহল ছিল না। আর বাকী যা ছিল আমি অত ঘাটাঘাটি করি নি কেবল বদলী হচ্ছিলাম বলে।
আনিস ভ্রু-কুঁচকে কি একটা ভাবতে লাগল। সে কি আঁচ করেছে আতিক স্যার বুঝতে পারলেন না। আতিক বুঝলেন, আনিস হয়ত ভাবছে আমি উদাসীন ছিলাম এই কেসের ব্যাপারে।

(চার)

     আমার বদলীর তারিখ এক মাস পিছিয়ে গেলো। এই খবর যতক্ষণে পেয়েছি আমার মন ততক্ষণে দূঃখ্য-ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। প্রথমে ভাবলাম মোড়লের কাজ, স্থানীয় এম পি কে সুপারিশ করে বদলী পিছিয়েছেন। পরে জানলাম যার এখানে আসার কথা তিনি একটি সিরিয়াস খুনী কে ধরার জন্য একটি অপারেশন এ গিয়ে ইঞ্জুরড হয়েছেন। পায়ে গুলি লেগেছে। আপাতত, তাই আমাকে এখানে থাকতে ই হবে। তাছাড়া, এ এস পি নাকি জেনেছেন, খুনের ব্যাপারে। তিনি জানতেন এই কেস সমাধানের মতন ক্যাপাবিলিটি আমার ছিল। তাই তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার বদলী থামিয়ে দিলেন। ফ্যাক্স করে পাঠালেন একটি কাগজ তাতে এই কেস নিয়ে অগ্রগতি এবং আরো নানা কিছু জানতে অনুরোধ করলেন। বাধ্য হয়ে তাই থাকতে হলো। বাসায় ফোনে জানালাম বদলী বিলম্বিত। কেসে অনুসন্ধান করছি ঢিলেঢালা ভাবে। আমার কোন ইচ্ছেও ছিল না এই কেইস সমাধানের। পুলিশ হয়েছি বলে সব কেইস সমাধান করতে হবে এমন তো কথা নেই, দেশে হাজারো খুন, রাহাজানি হয়। কয়টা ই বা সমাধান হয় বলতে পারো আনিস?
আনিস মাথা চুলকে নিলো। আজকেও অফিসে দু তিনটা খুনের কেইস  জমা পড়েছে। এর মাঝে একটি বেওয়ারিশ লাশের খুন।
আতিক বলতে লাগলেন, ' আমি এদিকওদিক ঘুরে কাটাচ্ছি, তখন মোড়ল ও নিজে নিজে দায়িত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করছেন।'
হঠাৎ জানতে পারলাম আরেক খুনের খবর! মাথাটা ঘুরে উঠল। এ এস পি জানতে পেরেছেন। প্রতি থানাতে ই তাদের ছ্যাঁচোর থাকে। সেই লীক করেছে, এবং আরো বলেছে আমি নাকি উদাসী। কেইস ঘেঁটে গেলো, সেইসাথে আমার মেজাজ। এবারের খুন হয়েছে সেই জুয়ার আসরে ই! করিম শেখের সাথে যারা রেগুলার জুয়া খেলতো তাদের ই একজন। বলা যায় করিম শেখের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সে। করিম শেখ মারা যাবার পর পুলিশ গিয়ে জুয়ার আসর ঘরে সীল লাগিয়ে দেয় কিন্তু তারা আসর বসাতো মধ্যরাতে। গ্রামের থেকে বেশ দূরে কোন পরিত্যক্ত ক্ষেতে। এবার হালকা ভাবে আর নেয়া গেলো না। গেলাম জীপ নিয়ে। এই খুন দেখে সহজে অনুমান করা গেলো মোটিভ টা কি। গলা, ঘাড়ে, মাথায়, হাতের মাঝে, পেটে এলোপাথাড়ি স্ট্যাব। ছুরিটা বেশ ধারালো ছিল বোঝা ই যাচ্ছে। লাশ যেখানে পেলাম সেখানে পশু কোরবানি দেয়ার মতন রক্তের স্রোত গেছে।
লাশ পাতায় মুড়িয়ে পাঠানো হলো ময়নাতদন্ত করতে।
খুন টা দেখে বুঝলাম একই খুনী ভিন্ন ভিন্ন মোটিভে কাজটা করেছে। প্রথম খুনে আগ্রাসী ভাব ছিল খুব বেশী। দ্বিতীয় খুনের কারণ গভীর না হলেও তাতেও আগ্রাসী ভাব সুস্পষ্ট!
এ এস পি এলেন পরের দিন। মোড়লের কাজ বুঝতে পারলাম। পুলিশের উদাসীনতা দেখে নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ চেষ্টা তিনি চালিয়েছেন। এ এস পি স্যার আসার পর বেশ কড়া কথা শোনালেন। হ্যান-ত্যান শুনে মাথাটা গেল বিগড়ে। চুপ করে থাকলেও ভেতরে ফুঁসে উঠলাম। ভেবে নিলাম এক সপ্তাহে এই কেইস সলভ করে ছাড়বো নয়ত চাকরী ই ছেড়ে দেবো! অপমান সহ্য করাটা আমার ধাঁতে ছিলো না।
এ এস পি চলে যেতে ই লিস্ট করে করিম শেখ এবং নিহত শুক্কুর আলীর পরিচিত সবাই কে থানায় এনে রাম প্যাঁদানি প্যাদালাম। কেউ না কেউ নিশ্চিত জানে পেছনের ঘটনা।
এদের একজন মুখ খুলল আর তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। করিম শেখ নাকি গ্রামে কোকেন সাপ্লাই শুরু করেছিল। আর সেই কোকেনে পার্টনার ছিল বেশ কয়েকজন জুয়ারি, তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো করিম শেখ কারো সাথে সরাসরি লেনদেন করেনি। কারো না কারো মাধ্যমে টাকা-মালামাল আনা নেয়া করতো। পাশাপাশি কয়েক গ্রামে তাই জুয়ার আসর আর মাদকের লেনদেন হতো পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে। আর এতই গোপনীয়তা ছিল যে, আমি নিজে দুই বছর থাকার পরেও এই ব্যাপারে ঘুণাক্ষরে কিছুই জানতে পারিনি। এমনিতে জুয়ার ব্যাপার যে জানতাম না তা নয়। কেবল মোড়লের অনুরোধে অগ্রাহ্য করতাম জেনেও।
প্যাঁদানি খেয়ে আরো তথ্য ফাঁস করলো এরা। কোকেন নিতে নিতে এরা এতই নেশাখোরে পরিণত হয়েছে যে দুটো লাঠি ভেঙ্গে ফেলেও কিছু করা যায় নি। কোকেন এমনি এক মারাত্মক খুনে নেশা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি সৈন্যরা ছিল ভয়াবহ নির্দয়, এর কারণ জানো? জ্বী স্যার!
methamphetamine আর cocaine এর ভিত্তিক ড্রাগ নিয়ে নিতো তারা। হিটলার এসব ড্রাগ দিতো তার সামনের সারিতে থাকা সেনাদল কে, ফ্লাই করা পাইলট কে। যাতে ওরা সহজে নিস্তেজ না হয়ে পড়ে। তাই কেইস টা এবার হলো আরো জটিল। করিম শেখের আসরে কারা কারা আসতো তাদের লিস্ট করা এক অসামান্য কঠিন কাজ।
এই কোকেন নেয়া মানুষগুলোর হিতাহিত জ্ঞান একেবারে শুন্যেএ কোঠায় থাকে। সামান্য কারণে মেজাজ মর্জি উগ্র হতেও সময় নেয় না। এবং এদের ই কেউ খুন করেছে দুইজন কে। কিন্তু সে নাকি তারা? খুন কি একই ব্যক্তির কাজ না আলাদা আলাদা মানুষ? প্রথমে ভেবেছিলাম খুনীর আগ্রাসী ভাব সুস্পষ্ট। সুতরাং সে বিশাল শরীর নিয়ে কেউ হবে তার মানে নয়। খুনী কোকেন নেয়। কিন্তু সে কোথায়? সে এই গ্রামে ই আছে? না পালিয়ে গেছে?
আশেপাশের গ্রামে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলাম হাবিলদার সহকারে খানাতল্লাশি করে এলাম। দু'চার গ্রাম মিলিয়ে গ্রেফতার করলাম বেশ কয়েকজন জুয়ারি কে। এরা তেমন তথ্য দিতেও পারল না। কারণ এরা কোকেন নেয় কেউ নিঃশ্বাসে, কেউ সিরিঞ্জ দিয়ে। অঘোষিত রিমান্ডে জেরা করা হলো। কিন্তু আশার আলো পাওয়া গেলো না।
বুঝলাম, খুনীর হদিশ যখন পাচ্ছি না সুতরাং সে মোটিভ নিয়ে কাজ করেছে। এটা আরো স্পষ্ট করে বলা যায় কারণ যাদের ধরা হয়েছে তাদের সবাই ই কোন না কোনভাবে কোকেন ব্যবসায় জড়িত। তবে সবার ই ড্রাগ লর্ড ছিল নিহত করিম শেখ। 
গ্রামে এত লোক! এদের মাঝে কে খুনী সেটা খুঁজে পাওয়া ই ছিল দুষ্কর।

 (পাঁচ)

আতিক এবং আনিস দুজনের চুপ। আনিস এর মাঝে ভেতরে গিয়ে খানিক টা ফ্রেশ হয়ে ফিরল এবং প্রশ্নটা চেয়ারে বসতে বসতে করে ফেলল, ' কিন্তু খুনীও তো কোকেন ই নিতো, তাই নয় কি স্যার?'
আতিক এতক্ষণে মৃদ্যু হেসে ফেললেন। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আনিসের পিঠ চাপড়ে ফের নিজের সিটে গিয়ে বসলেন।
ঠিক তাই!  আগেই বলেছিলাম, " নিঃশব্দে ক্লু মাছের পোনার মতন কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে অথচ বুদ্ধি না থাকলে সেটা ধরা মুশকিল! "
কোকেনের চালান গ্রাম কিভাবে এবং কোথায় আসে? কারা কারা চালান করে এসবে জানা টা খুব জরুরি হয়ে পড়ল। কোকেন এমনি এক নেশা না পেলে হিংস্র হতে সময় নেয় না এর গ্রাহক। আমিও আমার কিছু ছ্যাঁচড় রেডী করলাম। টানা সাত দিন বিভিন্ন জুয়ার আসরে ঘুরে বেড়ালাম। যাদের গ্রেফতার করেছিলাম তাদের উপর নজর তো ছিল ই আরো নতুন খদ্দেরের উপর নজর রাখলাম।
কোকেনের সাপ্লাই ধরে ফেললাম, আর সাপ্লাই যেহেতু কমে যাচ্ছিল। দাম ও বেড়ে যাচ্ছিল। একেবারে বন্ধ করিনি কারণ এতে খুনী এলাকা ছেড়ে পালাতে পারে। আর পালালে ই যে সে খুনী তাও অনুমান করা বোকামি। আমি আসলে হাতেনাতে খুনীকে জালে আটকাবার প্লান করেছিলাম। আমার দুজন চৌকস হাবিলদার কে ২৪ ঘন্টা জুয়ার আসরে নেশাখোর সাজিয়ে নজর রাখতে বলেছিলাম।
কিন্তু দূঃখ্যজনক! তাতে কোন ফল পেলাম না। এদিকে মোড়ল সাহেব এ এস পি র প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা দেখিয়ে কথা শুনিয়ে গেলেন বেশ কয়েকবার।
এর ই মাঝে একদিন মোড়লের বাড়ির আশেপাশে সন্ধ্যার পর নজর রাখতে ছদ্মবেশ নিয়ে বাইনোকুলার আর পিস্তল নিয়ে গাছে বসে থাকলাম। বাড়ির ছোট বর্ণনা দিলে বলতে হয়। মোড়লের ঘর টিনের, মেঝেটা ঢালাই করা সিঁড়িও আছে বাইরের দিকে। পাশাপাশি তিনটে ঘর। মাঝের ঘর টা ছেলের, এখন সেটা বন্ধ। সম্ভবত ছেলে বৌ তার বাপের বাড়ি গেছে। তার পাশের ঘরটা তুলনামূলক ছোট, ওটা কাজের লোকটির। উঠোন টা মাঝারি, চোখ বন্ধ করে বলা যায় পঞ্চাশ-ষাট টি চালের বস্তা রাখার মতন জায়গা আছে। মোড়লের ঘরের বিপরীত দিকে গরুর গোয়াল ঘর, রান্নাঘর আর গাছাপালা ঘেরা প্রবেশ পথ। বাড়ির পেছনে পথ আছে সেটা দিয়ে গ্রামের ভেতরে যাওয়া যায় কিন্তু সেটা এখন কেউ ব্যবহার করে না।
ঘরের বাইরে খড়ের বিশাল গাদা, উচ্চতা নয় ফিট (আনুমানিক), তার পাশে ই গোবর ফেলার বড় গর্ত। আর কবুতরের খোপ কোথায় সে তো আগেই বলেছি।
কিন্তু মনে খচখচ করছিল, ক্লু পাচ্ছিলাম না। তাই ওই ব্যবস্থা নিলাম।
আনিস এবার হাসল, এসব কেন স্যার! হাহা..
আতিক স্যার থামলেন না, উনি বলে চললেন - বাড়ির ভেতরে লোকজনের চলাচল স্বাভাবিক। তখন রাত সাড়ে আটটা। সবাই খেতে বসেছে দেখলাম। গাছে বসে আমি ততক্ষণে পোকামাকড় আর মশার কামড় খেয়ে ফেলেছি বিস্তর। খিদে পাচ্ছিল। পকেট থেকে চানাচুর বের করতে যাবো আর তখনি নজরে পড়ল বাড়ির কাজের লোক টা মুখে গামছা বেঁধে বাইরে এলো। প্রস্তুত ই ছিলাম, কিন্তু দেখলা
 দূরে বাড়ির গোবর ফেলার গর্ত তে গিয়ে বসে পড়েছে। মানে প্রাকৃতিক কাজ!
ছ্যাঁ! নিজের উপর নিজে ই বিরক্ত তখন আমি। এই কেচ্ছা দেখতে?..  আর তখনি ঘটল ঘটনাটা!
আধাঁর থেকে ঝট করে আরো একজন বেড়িয়ে পড়ল। খচাখচ শব্দে কি একটা ঢুকিয়ে দিলো সেই কাজের লোকটার শরীরে। আহ! আর্তনাদ শুনতে পেলাম ততক্ষণে.. আমার সাথে টর্চলাইট নেই, এসেছি একা। তবুও দ্রুত কে.. কে..? চিৎকার করতে করতে গাছ থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। খুনী!! আমার সামনে!! কিন্তু গাছ থেকে পড়ে যাবার পর খুনী দ্রুত আমার কাছে এসে মুখে লাইট মেরে চিনতে পেরেছে আমাকে। হাতে একটা ধারাল অস্ত্র খাড়াভাবে আমার দিকে তাক করে বিঁধিয়ে দেবে। আমি প্রমাদ গুনছি, সাথে সাথে লোকজনের আওয়াজ আসতে লাগল। এরই মাঝে খুনী একবার স্ট্যাব করে ফেলেছে আমাকে, কপাল ভাল হেচকা টানে শরীর টা মাটিতে গড়িয়ে নিয়েছি। খুনী লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে দেখলাম মুখের কালো চাঁদর টেনে ঝোপের ভেতর দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে পালিয়ে গেলো।
মিনিট ত্রিশের মাঝে থানা থেকে পুলিশ এসে গেলো ওরা আমাকে দেখে ই আরো অবাক, আমি একা না এলে আজ তাকে ধরা যেতো বলে দুই হাবিলদার আফসোস করে উঠল। আমি আশাবাদী, কারণ দেখলাম কাজের লোকের হাতে গোবর মাখানো একটা প্যাকেট এবং তাতে কোকেন।
একদল পুলিশ কে দ্রুত গতিতে গ্রামের বাস স্টেশনে যেতে বললাম তখনি। বলে দিলাম বছর সতেরো থেকে একুশের কেউ যেন বাসে উঠে পালাতে না পারে। আমার পায়ে আঘাত লেগেছিল। সেটা মচকে গেছে অনেকটা।
একজন হাবিলদারের কাঁধে হাত রেখে বললাম, খুনীকে না চিনলেও চিনতে পেরেছি।
গোবরের গাদা খুঁড়ে আরো পনেরো বিশটা কোকেনের প্যাকেট পাওয়া গেলো। মোড়ল কে থানায় নেয়া হলো। আমি এদিকে অন্তত খুশী হলাম কারণ লোকটা এতদিন খুব বিরক্ত করেছে আমাকে। যাচ্ছেতাই বলে গেছে ক্ষমতা খাঁটিয়ে। আজ কে আর ছাড়া যাবে না।


(ছয়)

  কোকেন সহ মোড়ল ধরা পড়ায় গ্রামবাসী উত্তেজিত হয়ে গেলো। বেশ কয়েজন মুরুব্বি গোছের লোক তারা থানায় এসে মোড়লের বিরুদ্ধে কিছু গরীব গ্রামবাসীর জমি আত্মসাৎ অথবা জোর করে কমদামে দখলের অভিযোগ করে গেলো। সুতরাং
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মাদক কেনাবেচা এবং সঞ্চয় করার আইনে মামলা হলো। সেই সাথে জমি দখলের কারণে মামলা ফাইল হয়ে গেলো। গ্রাম মোড়লহীন মানে অভিভাবকহীন হলো। স্থানীয় এম পি এসে বেশ কয়েকদিন সাফাই গাইলেন মোড়লের নামে। তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হলো। অবশ্য এ এস পি সাহেব স্তিমিয়ে গেছেন এই ব্যাপারে।
আমার মুখে হাসি আর বুকে বিজয়ীর সাহস। এম পি কে পাল্টা ভয় দেখিয়ে ফেরত পাঠালাম। এও বলে দিলাম উকালতি করলে তার বাড়ি ও ওয়ারেন্ট ছাড়া ই সার্চ করতে পারি। বুঝলাম কাজ হয়েছে, এম পি লোকটা দমে গেলেন।
রিমান্ড মঞ্জুর হলো মোড়লের।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পড়ল তদন্তকারী পুলিশের উপর। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ও যখন কথা বের করতে পারছিলাম না তখন আঙুল হালকা বাঁকা করতে ই হয়েছিলো। কড়া টাইটে তিনি মুখ খুললেন। আর তখন অবাক হলাম এই মাদকের ব্যবসা তে তিনি কত খরচ করেছেন আর কত কামিয়েছেন! চেয়ারম্যান /মোড়ল হবার আগে ভোটের পেছনে যা খরচ করেছেন, যারা তার বিরুদ্ধে ছিল তাদের জমি জমা কেড়ে নিয়েছেন। আমি আসলে এত গভীরে যেতে চাইছিলাম না কিন্তু মাঝেমাঝে পরিস্থিতি এমনি হয়। আর বদলি ভুলে দুই সপ্তাহ কাটালাম এই কেইসে। মোড়লের সাথে যাদের বনিবনা হয়নি তাদের ধরা হলো। দফায় দফায় রিমান্ড হলো কিন্তু খুনের মোটিভ কিংবা কে খুনী সেটা পাওয়া গেল না। এমনকি যেদিন মোড়লের বাড়ির সামনে স্বয়ং আমি আড়ি পেতেছিলাম সেদিন ও সেই খুনীকে ধরতে পারিনি। তবে নিশ্চিত ছিলাম সে গ্রামে ই এবং সবার মাঝে মিশে আছে, মজা দেখছে।
আনিস প্রশ্ন টা করল, ' কিন্তু স্যার আপনি না বললেন সে যুবক বয়সের কেউ!' - হ্যাঁ -সে তো বলেছিলাম ঠিকি কিন্তু গ্রামে হাজার যুবক আছে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম ই কি করে?
মাদকের মামলা অনেক কঠিন তাই মোড়লের জামিন হলো না। উপজেলা থেকে একজন মেম্বার গ্রামের প্রশাসনিক দায়িত্ব নিলেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে। আমিও ততদিনে এই আনসলভ কেসে কূলকিনারা পাইনি। বদলী হতে আর দিন তিনেক হাতে। মন উদাস! কেইস সলভ করতে না পারার হতাশা থেকে ই হোক অথবা অন্য কোন কারণে ই হোক গ্রামের পথে শেষবারের মতন একাকী হাঁটতে বেড়িয়ে গেলাম। হাতে টর্চ ছিল যেটা দুটো পেন্সিল ব্যাটারি তে চলে। চুপচাপ গ্রামের স্কুল ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। শীত শীত ভাব, টানা বৃষ্টিতে তেমন হাওয়া দিচ্ছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে যখন আসছিলাম তখন সন্ধ্যা গাড় রঙ ধরেছে। আযান পড়েছে একটু আগে ই রাস্তা ফাঁকা। গাছপালা ঘেরা রাস্তার পুরোটা যেন ইংল্যান্ডের কোন এক ট্রেনের টানেল। এত অন্ধকারেও যেন কি মনে করে টর্চের সুইচে হাত রেখেও আলো জ্বালালাম না। নিঃশব্দে এগুতে লাগলাম বিড়ালের মতন, তখনি দুজন মানুষের কথার আওয়াজ পেলাম। রাস্তার পাশের এক চালা ঘরে হালকা বাকবিতণ্ডা চলছে। ভাল করে খেয়াল না করলে বোঝা মুশকিল! আমি আমার মতন একইভাবে ফিরে আসছিলাম তখনি একটা কথা শুনে থমকে গেলাম, " -তরে না কইসিলাম ধার ভাল কইরা দিতে, টান যাতে দুইবার না দিতে হয়? " -ভুল হইসে ভাই!
ফিসফিসানি গলার এবার বলল, পুলিশ টা সেইদিন ঝামেলা না করলে তামাতামা কইরা দিতাম...!
আমি হাতের টর্চ টা মুঠোয় নিলাম, মাটিতে বেড়া দেবার জন্য কাঠ কেটে ফেলে রাখা ছিল তার একটা নিঃশব্দে হাতে নিতে ই ওদের কথা থেমে গেলো।
এরপর তীব্র একটা টর্চের আলো আমার চোখে পড়ল.. পলা!!! পুলিশ!! রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু ঐ ঘর আর কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে পিচ্ছিল ও। আমার পায়ে কেডস, তবুও এক জাম্পে রাস্তা ছেড়ে, হেইয়ো বলে উঠে গেলাম ঘরের উঠানে। একজন ভয় পেলে আঁধারে ছুটে গেলো কিন্তু আরেকজন? নাহ! তার মুখে আলো ফেলতে ই যেমন আমি চমকে গেলাম তেমনি সেই সুযোগে আমার বা'হাতে কনুইয়ের উপরে খপ করে একটা কোপ পড়ল।
আমি ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম! আমার বা'হাত থেকে টর্চ টা কাদামাখা উঠানে পড়ে গেলো। হুশ হারাই নি! এক কোপে উত্তেজনা স্তিমিত হয় না। হিউমেন ব্রেইন এমনি এক জিনিস!
দ্বিতীয় কোপ দেয়ার আগে ই আমার ডান হাতে ধরা কাঠের ঐ লাঠি দিয়ে সজোরে মারলাম ওর বা পায়ের হাঁটু জয়েন্ট বরাবর। পা ধরে পড়ে গেলো, সেইসাথে হাতের ধারালো অস্ত্র টা। কপাল ভাল মোক্ষম সুযোগে কাবু করে ফেলেছি। হাতের উপর হাত রেখে বুঝলাম বা'হাত টা কাঁপছে আমার। ভেজা হাত রক্ত স্রোতের জানান দিচ্ছে।
কিন্তু এর ই মাঝে সে পালিয়ে না গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দিয়ে আমার গলা দু হাতে চেপে ধরলো! ডান হাতে যত শক্তি ছিলো সেটা বাগিয়ে মোক্ষম একটা ঘুষি দিলাম মুখ বরাবর। এতক্ষণে কাদাতে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। ঘুষি খেয়ে আর উঠতে পারেনি সে। আমার শার্ট খুলে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে নিলাম। রুমালে বাঁধলাম কব্জি। রক্ত তখনো পড়ছে। হেলান দিয়ে বসে পড়লাম ঘরের দেয়াল ঘেঁষে।
বলেছিলাম আযান হয়েছিল তাই রাস্তা ছিল ফাঁকা। মিনিট দশ পড়েই সেই রাস্তা দিয়ে আলো ফেলে কয়েকজন নামাজ শেষ করে টর্চের আলো ফেলে ফিরছিলেন। তারা দুইজন আহত লোকের গোঙানির আওয়াজ পেয়ে এই অবস্থা দেখলেন। প্রথমে তারা ভেবেছিলেন আমরা চোর! কিন্তু একজন আমাকে চিনতে পারলেন। থানার বড়বাবু!!
আমাদের দুজন কে ই হাসপাতালে নেয়া হলো, আমার বা'হাতে পড়ল তিনটা সেলাই। আর খুনীর পায়ে ব্যান্ডেজ।
আনিস প্রশ্ন করল, " -কিন্তু স্যার! খুনীকে দেখে অবাক হয়েছিলেন কেন? সে কি চেনা কেউ? "
আতিক প্রশ্ন শুনে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ! আমার অফিসের ই কন্সটেবল। তার নাম ইকবাল। শারিরীক অসুস্থতা দেখিয়ে লিভ নিয়েছিল এক সপ্তাহের। গ্রামে ই থাকতো সে। খুনের দিনেও আমার সাথে ডিউটি করেছে। এমনকি সে কাছে থেকে আমার অনেক সিদ্ধান্ত ভেস্তেও দিয়েছে। তাই জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে এই কেইস। তাছাড়া পুলিশের ট্রেনিং ছিল তাই লিকলিকে শারীরিক গঠন হলেও সে ছিল ফিট। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার সব প্লানের সাথে আগে থেকে অন্যদের মতন সেও থাকতো, কেবল ঐ মোড়লের বাড়ি যাওয়ার একলা প্লান সে কেবল জানতো না। পুলিশে থেকে সে কোকেনের কালো তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। আদতে গরীব ইকবালের পয়সাকড়ি ভালো ই এসেছে এই কাজ করে। ধরা পড়ে সে স্বীকার করলো, দুটো খুন ই তার। প্রথম খুনের কারণ কোকেনের লেনদেন নিয়ে মনমালিন্য, দ্বিতীয় খুনের কারণ পুলিশের চোখে ধাঁধা লাগানো একই সাথে কোকেনের চালান মোড়ল কই রাখত সেটাও উদ্ধার। কিন্তু সেই প্লান বানচাল হয় আমার কারণে। আর ধরা পড়ার ব্যাপার টা কাকতালীয় হলেও সাফল্য ই ধরে নিলাম আমার জন্যে।
আনিস বলল, " তাহলে এর আগে যাদের জেরা করা হয়েছিল, মানে করিম শেখের সাথে যারা লেনদেন করতো তারা কি এই ইকবাল-করিম শেখের লেনদেন নিয়ে জানতো না?"
- নাহ! করিম শেখ খুব চালাকচতুর ছিল। তার কোকেনের কতটা সে কিভাবে চালান দিতো পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে তার হিসেবে গেলে বিরাট ধাক্কা খেতে ই হতো।
আনিস ভ্রু কুঁচকে কি একটা ভাবতে লাগল।
আতিক বললেন, কেইস টা আপাতত রফা করে ফিরছি। বদলি হয়েছি আর কত? আমাকে এগিয়ে দিতে এলো প্রিয় কয়েকজন হাবিলদার। অনেকে কোলাকুলি করে বলল, ' স্যার! আপনাকে অনেক মিস করবো! ' সবাই মিলে একটা ভারী গিফটের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিলো আমার। সাথে দুটো লাগেজ। একজন হাবিলদার দুটো লাগেজ তুলতে যাবে তখনি গেটে তার সাথে একজন মহিলার ধাক্কা লেগে মহিলা বাস স্টেশনে পড়ে গেলেনে সবার সামনে। আর ঘটনাটা এরপর যা ঘটল তাতে আমি সহ সেখানে যারা ছিলাম তারা হতভম্ব হয়ে গেলাম সেই আকস্মিকতায়। মোড়লের ছেলেবউ বাস থেকে নামছিলেন আর তার ই সাথে ধাক্কা লাগে হাবিলদারের। ভদ্রমহিলা পড়ে যেতে ই হায় হায় করে উঠে জনতা! কারণ তিনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন কিন্তু পড়ে যাবার পর ই তার পেটে লুকোনো কোকেনের একটা থলে বেড়িয়ে তার অনেকটা ছড়িয়ে পড়ল রাস্তার সেই কাদাজলে!
আনিস ও দেখি বিষ্মিত চোখে আমার কথা তে অবাক, আমিও তার চেয়ে কম অবাক হইনি।
একজন হাবিলদার চট করে ভদ্রমহিলা কে তুলে তার হাতে দড়ি বেঁধে আমাকে বললেন, স্যার! আপনি যা করেছেন সেটা এবার আমরা ই শেষ করবো।
আমি আনন্দে শুকনো হাসি দিলাম, আমার বাস ছেড়ে দিবে।


(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ন কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। যদি মিলে থাকে তা একান্ত কাকতালীয়)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...