শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

গল্পঃ মুখাবয়ব

ইদানীং মেয়েটি বড্ড জ্বালাচ্ছে, কোথায় ফোন নম্বর পেয়েছে জানি না। সময়-অসময়ে তার ফোন, মেসেজ করা চাই। প্রচণ্ড জ্যামে যখন নাভিশ্বাস ঠিক তখনি পকেটে ঝড় তুলে তার ফোন।
এইতো সেদিন, ভীড়ের মাঝে থেকেও ফোন বের করতে পকেটে হাত পুরেছি কি পুরিনি! পাশাপাশি দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক একটি কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এরই কাগু! আন্নে কোণাই ছুঁই দিয়েচেন?
দ্রুততম সময়ে হাত সরিয়ে বুঝলাম ভদ্রলোক আমার ডান দিকে গা ঘেঁষে পেছন ফিরে ছিলেন। টাচ টা সম্ভবত তার পেছনে ই করেছি ভুলে।
একদিন তো রাগ করে ই ভাইব্রেশন অন করেছিলাম। বাসের ঠেলাঠেলি প্রতিদিনের মতন সেদিন ও। ভাইব্রেশন করতে ই এক মহিলা রেগে গেলেন!
আরে পাইসেন কি? মহিলা দেখলে ই হুশ থাকে না? বাড়িতে মা-বোন নাই?
উনাকে তখন কিভাবে বোঝাই, যিনি ফোন করেন অবিরত তার কোন কমন সেন্স নাই।
মেয়েটির চেহারা দেখিনি, এক বন্ধুর বিয়েতে নাকি সেই আমাকে দেখেছে। তাতে ই তার পছন্দ আমাকে। কি অদ্ভুত খেয়াল! মানুষের ভালোলাগার আসলে কোন মানে হয় না।
একদিন খুব রাগ করলাম, বকে দিলাম।
পরের দিন ফোন দেয়নি, কিন্তু এস এম এস করেছিল, ঠিকমত অফিসে গেছি কিনা। মেয়েটির উপর এত্ত বিরক্ত ছিলাম যে অফিসের ক্লোজিং হিসেবে গড়মিল করে বসলাম ভুলে। বস খেপে গেলেন, আমিও ক্ষুদ্ধ!
চাকরী টা গেলো না, সিনিয়র এক বড় ভাই ছিলেন বলে।
সেই থেকে এখন মেয়েটি আর মেসেজ করেনি, ফোন ও করেনি। মেয়েটির নাম জানিনা। ফোনে সেইভ করা নম্বরটির টাইটেল ছিল " ফাজিল "।
এক মাস কেটে যেতে মনে খুতখুত করল, ভাবলাম কল করে একটা খোঁজ নেই। কিন্তু নম্বর টা বন্ধ পাওয়া গেলো। ওপাশ থেকে যন্ত্রিক গলায় মহিলাটি বললেন, " এই নম্বরে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না "।
এখন আরো খারাপ লাগা শুরু। মেয়েটির ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না। ভাল করে কোনদিন কথাও বলিনি। এই হয়, যাদের কে হেলায় দূরে ফেলি তাদের গুরুত্ব অনেক দেরীতে হলেও আমরা টের পাই কিন্তু তখন আর সুযোগ হয় না।
ফোন নম্বরের মালিক খুঁজতে বেশ কাঠখড় পোড়ালাম। এক বন্ধু ছিল একটা মোবাইল অপারেটর কোম্পানি তে, নম্বর টা অন্য অপারেটরের। তবুও সে ম্যানেজ করল।
কল হিস্টোরি ও পেলাম অফ দ্যা রেকর্ডে, তাতে কেবল আমাকে ই কল করা হয়েছে প্রায় ৪০০ এর কাছাকাছি। মেয়েটি হয়ত পাগলি, এখন তাই অভিভাবক ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন। মেয়েটির নাম বলছি না, ধরুন "S" সেই মেয়েটির ঠিকানা ধরে একদিন বেড়োলাম। পেয়েও গেলাম।
একটি একতলা বাড়ি, তার সামনে ছোট দোকান, সেখানে জিজ্ঞেস করতে ই জানলাম মেয়েটির ব্রেইন ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। দোকানে তার পরিবারের বেশ টাকা বাকী বলেও দোকানী আক্ষেপ করল। আমি হতবুদ্ধের মতন মিনিট পাঁচ দাঁড়িয়ে থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিলাম।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল তাই অনিচ্ছ্বা সত্ত্বেও একটি সিগারেট খেয়ে সেই হাসপাতালে গেলাম।
মেয়েটির চেনা কেউ নই, দুড় থেকে দেখলাম মেয়েটি বেডে শুয়ে হাতে ক্রানুলা, নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। চোখের তলায় কালি। মেয়েটি কে দেখে ভীষণ কান্না পেলো। চোখের কোণা আপনা আপনি বর্ষার নদীর মতন অনুভূতির ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল।
আচমকা টের পেলাম আমার পেছনে কেউ বাম হাতের কনুই টা চেপে ধরেছে। ঝাপসা চোখে দেখলাম একজন বয়ষ্ক ভদ্রমহিলা, উনি বললেন, " তুমি ই রঞ্জু?"।
আমি বললাম হ্যাঁ।
ও আর বেশীদিন নেই! কথাটা বলেই ভদ্রমহিলা মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালের কেবিনে আমার কপাল ঘেমে উঠল। সাধারণ কেউ হলে দ্রুত বলতো, " প্লিজ কাঁদবেন না, কান্না করা উচিত নয়, মন শক্ত রাখুন ব্লা ব্লা.." -তবে এসবের কোনটির একটিও আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো না। শীতের বিকেলবেলা হঠাৎ করে যেভাবে বাতাসের শুন্যতা টের পাওয়া যায় তেমনি আমি বেড়িয়ে এলাম নিঃশব্দে। আমি আর সেখানে কোনদিন ফিরে আসিনি।
আজকে ১৭ তারিখ, সাল ২০২৮।
নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছি এয়ারপোর্ট। তনয়া ফিরবে আজ, আমারি মেয়ে। লন্ডনে ল' পড়তে গিয়েছিল।
স্যার! আপামণি আইস্যা পড়ছে! আমাকে দেখে কালো ওভারকোট পড়া মেয়েটি আব্বু বলে ছুটে এলো। কেমন আছো আব্বু?
আমার চোখে পানি ছলছল করছিল, সেটি বাঁধভাঙা উল্লাসে গড়িয়ে পড়ল গালে। ভাল আছি রে মা! চল বাড়ি চল।
তনয়া কে দেখে আমি অবাক হই আজকাল, আমার মেয়ের মুখাবয়ব এভাবে বদলে সেই মেয়েটির মতন হয়ে যাবে সে আমি কখনো ভাবিনি।

(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক, বাস্তবের সাথে এর মিল নেই, যদি মিলে যায় তা একান্ত কাকতালীয় এবং অনভিপ্রেত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...