রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৯

গল্পঃ অভিশাপ

দুপুর আড়াইটা,
            ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে ই টের পেলাম ফোনে অনেক টা সময় আমি কাটিয়ে ফেলেছি। এদিকে হাতের কাজ আজকে নেই বললে ই চলে। ঈদের পর ছুটি কাটানোর লোভ তাই আর সামলাতে পারলাম না। বেড়িয়ে পড়লাম রংপুরের পথে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বন্ধু যার নাম শুনে অনেকে হেসে ফেলবে, সেই কুমোর নন্দীর বাড়ি তে যাবো বলে বাসে উঠে পড়লাম।
বাসে করে লম্বা সফরে দুই ধরনের ব্যাপার দেখা যায়। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ঝিমুনি আসে নয়তো, আশেপাশে কারো সাথে জমাটি গল্প বেধে যায়। তারপর যদি সে হয় সমবয়সী, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
 যেকোন সফরে আমার সবসময়ের সঙ্গী হচ্ছে ছোট্ট লেদারের ব্যাগ। তাতে নিত্য ব্যবহার্য কিছু জিনিসপত্র আগে থেকে ই ভরা থাকে। কুমোর নন্দী আমার লেখার ফ্যান এবং বন্ধু, তার সাথে আমার পরিচয় বছর দুই আগে। আমাদের প্রেসের একটা কুইজ প্রতিযোগিতা নিয়ে তার সাথে প্রথম ফোনালাপ। ভদ্রলোক কুইজ জিতে ই আমাদের কাছ থেকে নগদ পাঁচশত টাকা জিতে নিয়েছেন ততক্ষণে। তবে তার একটা কথাতে তখন আমার তাকে বেশ মনে ধরে গেলো, জানি না অনুমান থেকে কিনা - তিনি বললেন, " আপনি কি বিভূতিভূষণ? হরোর গল্পের এডিটর? "।
আমি ততক্ষণে অবাক, বিমোহিত এবং একটু যে খুশি হয়েছি তা অস্বীকার করবো না। আমি যদিও ফোনে প্রথমে বলেছিলাম, " এটা কি কুমোর নন্দীর নম্বর? আমি মাসিক হরোর পত্রিকা থেকে বলছি, উনি একটা কুইজ জিতেছেন আমাদের তরফ থেকে সেটা কনফার্ম করতে চাইছি। "
তবে উনি আমার নাম ধরে ডাকায় সেদিন অনেকটা খুশী হয়ে ই পরিচিত হলাম তার সাথে। আমার সাথে সেই আলাপ, এর পরে ব্যস্ততা আর কাজের চাপে তার নিমন্ত্রণ রাখতে পারি নি। আজ তাই অতিথি হতে যাচ্ছি।

বাসে গায়ে পড়া ভীড় নেই। প্রায় সিট ই ফাঁকা। দেখা যাচ্ছে একটা জোড়া সিটের একপাশে একজন অন্যটি ফাঁকা। আমার সিট টা পড়েছে ড্রাইভারের সারিতে, মানে ডানদিকের কর্ণারে মানে ই-২। বাস ছাড়ার আগে ফ্রেশ হয়ে দ্রুততম সময়ে বসে গেলাম সিটে। সবার টিকিট চেক করে ই বাস ছাড়ল। পেছনে যাতে কোন যাত্রী যাতে মিস না হয়ে যায়।
আমি কানে হেডফোন দিয়ে একটা রবীন্দ্রসংগীত বাজাতে যাবো, এমন সময়ে ঠিক পেছন থেকে একজন কাঁচাপাকা চুলের মাঝবয়েসী ভদ্রলোক বাসের গতির বিপরীত দিকে কসরত করে এলেন আমার পাশে। বসতে পারি ভাই! কেউ যদি না থাকে মানে ফাঁকা সিট!
আমি বললাম, হ্যাঁ বসুন। বলা শেষ হতে না হতেই ভদ্রলোক ঝট করে চেপে বসে গেছেন হুড়মুড়িয়ে। তার হাতে খবরের পত্রিকা মোড়া একটা তক্তা সাইজের চারকোণা একটা জিনিস। সিটে বসার পর সেটা কোলে তুলে ই রাখলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে কিছু বললেন হাসিমুখে। আমি তার হাবভাব খেয়াল করতে করতে কানে হেডফোন গুজে ফেলেছি।
কান থেকে সেটা আংশিক খুলে বললাম, কিছু বললেন?-জ্বী, অনেক ধন্যবাদ!
উত্তরে হালকা মাথা নেড়ে, আমি মৃদ্যু হেসে বসার সিট টাকে একটু হেলান করিয়ে আয়েশি ভঙ্গীতে চোখ বুজতে চেষ্টা করলাম।

শো শো শব্দে উত্তাল বাতাস এফোঁড়ওফোঁড় করে পার হয়ে যাচ্ছে বাসের ভেতর টা। তাই এতক্ষণ যা একটু ভ্যাপসা গরম ছিল সেটা কেটে গেলো নিমেষে। কানে সুমধুর রবীন্দ্রসংগীত বাজার দরুণ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু মাঝপথে চেকিং এর যন্ত্রণায় সেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। বাইরের দেশে এমন হয় কিনা জানি না, এদেশে বারবার চেকিং চলে। যাত্রী না চোর সেটা বোঝা মুশকিল।
দেখলাম আমার পাশের ভদ্রলোক বেশ আয়েশি হয়ে আছেন। তার হাতের জিনিস টা দিব্যি কোলে রেখেছেন।
ঘুম আসছিল না দেখে এবারে নিজে ই তাকে ডেকে বললাম, " রংপুর কি আপনার বাড়ি? "উনি মাথা না সূচক নাড়লেন।
 -বেড়াতে যাচ্ছেন? (সেখানেও দিব্যি না।) তারপর বললেন জরুরী একটা কাজ আছে। কি কাজ সেটা খুলেও বললেন না।
গল্পের খাতিরে নিজে ই গেছিলাম এগিয়ে কথা বলতে, যেটা আমি কখনো করিনা। তবে তাকে ই বেশী রিলাকট্যান্ট লাগলো।
তবুও বললাম,আচ্ছা, তাহলে হাতের জিনিস টা নীচে, না হলে পাশের ফাঁকা সিটে রেখে আয়েশ করে নিন। অনেক লম্বা যাত্রাপথ, বুঝলেন!
উনি রাজী হলেন না, বুঝলাম আমার একটা কথাতেও যখন তিনি পাত্তা দিলেন না তখন আমার চুপ করে বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখা ই বরং ভালো হবে।
ঘুরে বাইরে দেখছি কি দেখিনি, ভদ্রলোক সন্তর্পণে আমার কাঁধে আঙুল ছুঁয়ে ডাক দিয়ে বললেন।
-এর নাম জানতে চাইবেন না প্লিজ, এটা ভালো জিনিস নয়! এর নাম জানা বারণ।
আমার একটু কৌতূহল হলো পাশাপাশি হাসিও পেলো। পাগল নাকি?
আমি হাসবো কি হাসবো না, ভেবে অট্টহাসি তে ফেটে পড়লাম। আমি নিজে হরোর লিখি, যদিও পেট চালাতে আজেবাজে লিখতে হয় তবে এই লোকটি এমন কথা বলছে যাতে একটা গূঢ় ভয় আছে, যা নিয়ে কথা বলা বারণ।
আমার হাসির শব্দে সুপারভাইজার পেছনে এলেন, বললেন, কোন সমস্যা স্যার?আরে না না, তেমন কিছু না। আমরা আনন্দে হাসছি। (বললাম আমি)
সুপারভাইজার চলে যেতেই অনেকটা চেপে ধরলাম লোকটাকে।
 বললাম, "আপনি মজা করছেন? এতে এমন কি ই বা আছে? যা নিয়ে কথা বলা যাবে ই না"
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। কেবল তার ডান হাতের তর্জনী টা নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে ইশারা করলেন চুপ করতে। তারপর ইশারা করে জানতে চাইলেন আমার কাছে কাগজ, কলম আছে কিনা?
আমার লেদারের ব্যাগে কাগজ কলম থাকে সেটা ই বের করে এগিয়ে দিতে না দিতে তিনি আঁকাবাঁকা হাতের কাঁপন দেয়া চলন্ত বাসে কি একটা দ্রুত লিখে আবার তর্জনী তার ঠোঁটে রেখে না সূচক কিছু একটা বোঝালেন।আমি দ্রুত লেখায় চোখ দিলাম, সেখানে লেখা এটা আয়না। এতে যে আছে তার নাম উচ্চারণ করলে বিপদ আসন্ন।
এবার উত্তরে জানতে চেয়ে আমি কাগজে লিখলাম, তাহলে এটা কি? তারপর লেখাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। উনি পড়ে সেটার উত্তর লিখলেন। তার সংক্ষেপ এমন, আয়না টা তার একটা কালেকশন। উনি আসলে এন্টিক ব্যবসায়ী। জুতা থেকে শুরু করে পুরনো ধাতব মুদ্রা সব নাকি তিনি ঢাকা তে বিক্রি করেন। তবে এই আয়না টা নিয়ে বেঁধেছে আপত্তি। এই নিয়ে তিনি এটা যাদের কে বিক্রি করেছেন তারা ই একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ফেরত দিয়ে গেছেন। এক খদ্দের তো সেদিন এসে ই বললেন, তিনি রাতে জেগে পড়াশোনা করেন। রাতে আয়না টা ড্রয়িংরুম এ ছিল। হঠাৎ পানি পিপাসা লাগায় পানি খেতে এসে দ্যাখেন আয়না উল্টে আছে। ড্রয়িংরুমে একটা ডীম আলো জ্বলে যাতে আলো থাকে এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও হয়। তিনি আয়না উল্টো থেকে সোজা করে ঘুরে যখনি ফিরতে গেছেন তখনি একটা কালো ছায়া তার সামনে হঠাৎ করে এসে পড়ে।ভয়ে আঁতকে উঠেন তিনি। সাথে সাথে জ্ঞান হারান। তারপর?তিনি ডাক্তারের কাছে যান, প্রথমে ভেবেছিলেন রাত জেগে জেগে তার হ্যালুসিনেশন হয়েছে। পরে দেখা গেলো সব ঠিক। আয়না টা অভিশপ্ত। আমি অনেকটা অবাক হয়ে ই কাগুজে কথোপকথনে জানতে চাইলাম, আপনি যদি জেনে ই থাকেন এটা অভিশপ্ত তাহলে ভেঙে ফেলছেন না কেন?
ভদ্রলোক এতে আর কিছু লিখলেন না, মাথা নীচু করে বললেন " চেষ্টা করেছিলাম ভেঙে ফেলতে। "
বলতে লাগলেন, " এত সমস্যার পর নিজের বাসায় এনে রাখি। উদ্দেশ্য ছিল ভেঙে ফেলবো কিন্তু পারি নি।" (কথাগুলো এবার মুখে ই বলছেন তিনি)
তারপর একটু ফুঁপিয়ে বললেন, এটার কারণে আমার সংসারে ও বিপদ এসেছে। আমার স্ত্রী হঠাৎ করে পিছলে পড়ে হাটুতে ব্যথা পান।
মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম, নাতি টা আয়না রাখার ঘরে বল কুড়োতে গিয়ে এখন আবোলতাবোল কথা বলে। সম্ভবত কোন কিছু দেখে মারাত্মক ভয় পেয়েছে।
একদিন রাতে আমরা সবাই ঘুমে। কোন এক কারণে আমার ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে একটা সিগারেট খেতে বাইরে এলাম। বিশ্বাস করবেন না বললে, একজন মহিলা ঠিক আমারি পাশ দিয়ে বেড়িয়ে পাশের ঝোপে হারিয়ে গেলো অন্ধকারে। আমার হাতের সিগারেট ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গেছে। আমি আমার স্ত্রী আর কাজের ছেলেটা ছাড়া যেখানে আমাদের ঘরে আর কেউ থাকে না জানেন!
দোতলা বাসা। নীচে আগে যারা ভাড়াটে ছিল তারা বাড়ি ও ছিল না।
গায়ের লোম শিউরে উঠা ব্যাপার। গা ঝটকা দিয়ে দ্রুত বাসার দরজা শক্ত করে আটকে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তারপর একটা শব্দে যেন গা অবশ হয়ে গেলো।
কেউ দরজা খুলে ঘরের ভেতর এলো তারপর আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। ধীরেধীরে কারো পায়ের শব্দ শুনলাম আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘরে কেবল আমি আর আমার অসুস্থ স্ত্রী শুয়ে। স্ত্রী ঘুমে অচেতন।
একটা ভারী পুরুষালী গলা বলল, " কি রে? দেখলি না আমি বাইরে গেলাম! আটকে এলি কেন? আমি কি ঘরে আসবো না! এরপর এমন করবি না। ফলাফল ভালো হবে না। "
তারপর বললেন, এক অঘোরীর বেশ নাম শুনেছি। আজ সেখানে ই যাচ্ছি। এটা জমা দিয়ে আসব। রিচ্যুয়াল যা করার তিনি করবেন বলে কথা হয়েছে। আপাতত মুক্তি চাই ভাই!
ভদ্রলোকের কথা তে আমি অবাক হবো কিনা ভাবছি, কিন্তু আয়নাটা?...
লোকটা আমার দিকে চমকে তাকালেন! কেন তাকালেন বুঝতে দেরী হয় নি, কারণ আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে গেছে " আয়না "
আর আমার প্রশ্ন টা করেও শেষ করতে পারি নি।
 বাসের ভেতর তীব্র একটা ঝাঁকুনি খেলাম। মনে হলো বাসের পেছন থেকে খুব জোরে কেউ একটা ধাক্কা দিয়েছে। এত জোরে ধাক্কা লেগেছে যে যাত্রীরা হুড়মুড় করে বাতাসে উড়া মুড়ির মতন সামনে ছিটকে গেলো। আমার পাশে বসা সেই ভদ্রলোক এবং তার অভিশপ্ত আয়না আলাদা হয়ে গেলো এবার। দেখলাম, বাস টা আর রাস্তায় নেই! আমাদের কে নিয়ে সেটা উড়ে পড়ছে রাস্তার বাইরে গভীর খাদে। শেষ যতটা জ্ঞান ছিল তাতে টের পেলাম আমি জানালার কাঁচে ধাক্কা খেয়েছি, কপাল কেটে বেড়িয়ে গেছে লাল রক্ত!
পাশের লোকটা কে আর দেখতে পাইনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।
জ্ঞান ফিরল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাত-পা সমানে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বেঁচে আছি যেনে একটু স্বস্তি পেলাম।
নার্স এসে আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে বলল, কেমন আছেন বিভূতি?  আপনার পিঠে অসংখ্য কাঁচ ঢুকে গেছিল। আপাতত, সেগুলো অনেকগুলো বের করা হয়েছে। চিন্তা করবেন না।
বললাম, একটা ফোন করে দেবেন আমার হয়ে?
উনি মাথা নেড়ে বললেন অবশ্যই!
ফোন দেয়া হলো, রংপুরের বন্ধু কুমোর নন্দী কে। খবর শুনে উনি এলেন। আমাকে এই অবস্থায় পেয়ে অনেক মর্মাহত দেখালো তাকে, আমাকে সাহস এবং সান্ত্বনা দুটোই দিলেন।
তিন দিন পর জানলাম, সেই রংপুরগামী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসে থাকা ৩০ জন নিহত এবং আরো ১১ জন আহত। সেই ১১ জনের মাঝে আমি একজন। তবে খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই আয়না বহনকারী ভদ্রলোক বাঁচেন নি। উনি স্পট ডেড। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
রিলিজ করার দিন নিজে হেঁটে হেঁটে ই ফ্রেশ হতে গেলাম। হাসপাতালের বেসিনে মুখ ধুঁয়ে নিজের চেহারা দেখতে যাচ্ছি হঠাৎ দেখলাম প্রতিবিম্ব তে সেই ভদ্রলোক!
আমাকে দেখে বললেন, চিন্তা করবেন না! আমি আপনাকে দোষ দেবো না। আপনি ভালো থাকুন।
ঝটকা খেয়ে সরে এলাম। নিজের মুখে কয়েকবার হাত রেখে ফের আয়না তে তাকালাম। নাহ, আমাকে ই দেখা যাচ্ছে।
ঘটনার অনেক পরে পাবলিক লাইব্রেরি হয়ে ফিরছিলাম পায়ে হেঁটে। সেখানে দেখলাম পুরোনো অনেক কিছু বিক্রি হচ্ছে। চোখ গেলো যেটায় তাতে আমার শরীরের সমস্ত লোম মুহুর্তে খাড়া হয়ে গেলো।
এইতো সেটা! সেই অভিশপ্ত.....

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...