মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৮

গল্পঃ ভুল

মাঝারি বৃষ্টি, রাতের ঘড়ি ১১টা ছুঁয়ে কিছুটা দূর।
 শীতের বৃষ্টি তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা, মাঝেমধ্যে কয়েকটা গাড়ি ছুটে চলেছে হঠাৎ! রাস্তাটা অনেকাংশ অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্ট গুলোর আলো ব্লিংক করছে থেমে থেমে।
আধাঁরের লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে এলেন একজন পথিক। বাস থেকে নামবার পর কাছাকাছি কোথাও যাবেন বলে হালকা যানবাহন খুঁজছেন। 
বৃষ্টি ঝিরিঝিরি, তার মধ্যে শীতে কাঁপুনি তার মাঝে দুই ব্যাগ। এভাবে চলা যায়। খানিক টা এগুতে না এগুতে একটা গাড়ি পথিকের গায়ে কাঁদাজল ছিটিয়ে পালিয়ে গেল দ্রুত। 
এহ! শালা! একগাদা গালি বেড়িয়ে এল পথিকের মুখ থেকে। প্যান্ট ভেজা, জামা ভেজা এবার হাতের ব্যাগ ভিজল। একটা রিক্সা আজ নেই, কই যাবো ভাবতে ভাবতে রাস্তার পাশে মাথা তুলে থাকা একটা ছাউনি ভেতর কায়দা করে মাইল্ড জাম্প করে ঢুকে গেলো সে। ঢুকে টের পাওয়া গেল আরেক বিপদ!
অন্ধকার ছাউনির তলায় তীব্র গঞ্জিকার গন্ধ। এখন কিছু করার নেই যদিও। বোঁটকা ভারী বাতাস এখানে। পথিক পকেটে থেকে রুমাল বের করে হাত, মুখ মুছে নিলেন। ছাউনির ভেতর বাতাস গুমোট ধরে আছে তার উপর গঞ্জিকাসেবী! 
নাহ, একটা কিছু তো করতে হবে। রাস্তায় যেভাবে গাড়ি ছুটে চলেছে সেগুলো তার সামান্য হাত দেখানোয় তার কোন একটা থামবে বলে পথিকের অন্তত বিশ্বাস হয় না। কপাল এতটা খারাপ ই যে আশেপাশে কোন রিক্সা, ভ্যান এমনকি একটা কুলির টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অথচ এটা মোটামুটি একটা জনবহুল বাস স্ট্যান্ড। 
তবুও একটা কুলি পেলে মন্দ..
পেছনের জমাট অন্ধকার ছাউনির ভেতর কড়া কাশির দমক টের পাওয়া গেল। পথিক ভয় কাটানোর জন্য ঘুরে পিছু দেখলেন। সেখানে একটা ছোট্ট আগুনের দলা ক্রমশ জ্বলতে নিভতে দেখা গেল। মানে কেউ আয়েশ করে গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। নেশা এমন এক জিনিশ যা নেবার সময় বিন্দুমাত্র হুশ থাকে না নেশাখোরের। কে এই লোক? ছিনতাইকারী কিংবা চোর নয়তো!  পথিকের ভয় হচ্ছে। ভয় হওয়া টা স্বাভাবিক, সাথে ব্যাগ। দামী জিনিস কম ই হয়ত তবুও সাবধানী হতে দোষ কোথায়?
পথিক ঘাড় ঘুরিয়ে চেষ্টা করেও পেছনে থাকা লোকটির চেহারা আন্দাজ করতে পারলেন না। পরে ভাবলেন, থাক সে তার মতো। পথিকের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না এই মুহুর্তে।
রাস্তায় ছুটে যাওয়া আলোর দমকে অদৃশ্য লোকটার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও পথিক বুঝতে পেরেছেন ভয় টয় যাই হোক তবুও এখন এই লোকটি এখন তার একমাত্র সঙ্গী। তাকে বলে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায় তাতে মন্দ কি? কিছু করতে গেলে একটুআধটু সাহসের বড্ড দরকার ই। 
সাহস করে তাই প্রথমে গলা স্বর নীচু থেকে একটু জোরেশোরে ই ডাক দিলেন পথিক। 
-এই যে ভাই, ভাই! ও ভাই! শুনছেন?
(অন্ধকারে থাকা লোকটির গলার স্বরে বিরক্তি)
-আহ! কে আপনে? কিসের এত্ত ডাকাডাকি? 
(কাতর গলায় পথিক) আসলে এই রাতে বিপদে পড়েছি ভাই, দেখেন রাস্তায় কোন গাড়ি থামছে না। কোন ভ্যান রিক্সা কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। একটু যদি হেল্প করতেন!
-হেলপ! হে হে শব্দে কিছুক্ষণ হেসে আবার তার কাশির দমক.. এহ এহ.. চি চি..

তারপর লোকটি ধীরেসুস্থে উঠে এসে পথিকের মুখোমুখি দাঁড়াল। ঠিক তখনি একটা গাড়ি ছুটে গেল আলো ফেলে। দুজন একে অপরকে সেই আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। 
পথিক মনে হয় ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল! কালো চাঁদর দেয়া লোকটি এত বীভৎস হবে পথিক ভাবতেও পারেন নি।
 এহ! একি?ডরায়েন না! আমার এক চোখ নাই। এক্সিডেন্ট করছিলাম। (অভয় দিল সে লোকটি, তারপর বলল)
আসেন, কই যাইবেন? আমি নিজে ই পৌঁছাই দেই।
পথিক ভয়ে কাপাঁ গলায় বলল, না ভাই! আমি একলা ই যেতে পারবো!
(পথিকের গলায় ভয়ের আওয়াজ পেয়ে লোকটি হাসল খানিকক্ষণ) 
হেহে.. একলা গেলে কি আমারে ডাক দিতেন! দ্যান ব্যাগ টা। আমি চোর ছ্যাচ্চড় না ভাই। চিন্তা নাই। আমার রিক্সা আছে। চলেন পৌঁছাইয়া দেই।
এবার পথিক রাজী হলো। 
লোকটি পথিকের ভারী ব্যাগের একটা মাথায় এবং অন্যটি আরেক হাতে নিয়ে বলল, আসেন রিক্সা সামনে। 
পথিকের পা নিস্তেজ, চলছে না। তবুও ব্যাগে কাপড়চোপড়, দামী জিনিস আছে। চোর-ডাকাত হলে ধস্তাধস্তি করে হলেও মালপত্র বাঁচাতে হবে। কিছুটা পথ এসে সেই লোকটি থামল তারপর মাটিতে ব্যাগ রেখে বলল, এইখানে খারান! আমি রিক্সা টা নিয়া আসি। 
"ক..কই?  রিক্সা? পথিকের গলায় কম্পন"
"ঐ তো গাছ টা দ্যাখতাছেন, ঐটার পিছনে। খারান আনতাছি। " এই বলে দ্রুত পায়ে লোকটি একটা দেয়ালের পেছনে চলে গেলো। তবে ফিরে এলো মিনিট দুই পরে ঝনঝন শব্দে একটা রিক্সা নিয়ে। 
পথিক এবার নিশ্চিত। নাহ! এ অন্তত চোর নয়। রিক্সায় উঠে মনটা অনেক শান্ত হলো পথিকের। 
লোকটিকে উদ্দেশ্য করে পথিক বলল " চলেন ভাই, নটবাড়ি রোড।" 
রিক্সা চলতে লাগল। পথিক আশেপাশে দেখতে লাগল সতর্ক চোখে। তাকে সপ্তাহ আগে ই যেতে হয়েছিল বাড়ি, জরুরি ফোন। জমিজমা নিয়ে শরীকী বিবাদ। সেসব মেটাতে যা সময় লাগল। ভেবেছিল দিন দুয়েকের বেশী লাগবে না। তবে সেটা কেবল ভাবনা চিন্তার হিসেবে ই ছিল, কাজে আর লাগল না।
- ভাই কি সিগারেট খান? 
আচমকা প্রশ্ন শুনে পথিক বলল, না ভাই! কেন?
হে হে, তখন সিন্নি তে ছিলাম। সিন্নি খাওয়ার সময় আশেপাশে কাউকাউ করলে ভালা লাগে না। আগে একা খাইতাম না, দলেবলে মিলা খাইতাম। একটা দল আছিল আমাগো। সেইখানে একেকদিন একেকজনের খরচ করার নিয়ম করছিলাম সবাই। যেমন আইজ আমি, কাইল আরেকজন, পরশু আরেকজন এমনে..
পথিক অনেকটা বিরক্ত এই গাঁজাখুরি আলাপে। মনেমনে ভাবল মা কে বলেছিলাম দেরী না করতে, সেই রান্না করতে গিয়ে দেরী। তাই আজ ফিরতেও। আর কপালে পড়ল এক গাঁজাখোর!
সেই লোকটি বলে চলেছে তখনো... অনেক শান্তি এখন একা একা। হাউকাউ নাই, চুপচাপ খাই। কেউ মাঝখানে ডাক দিলে ই রাগ উইঠা যায়। পথিক ভয় পেলো আবার।
-রাগ মানে? সে কি? ভাই আমি কি?...
হে হে নাহ! আপনে ভালা মানুষ। আপনের উপ্রে রাগ উঠে নাই। তবে আর রাইত কইরা এমন টাইমে কাউরে ডাক দিয়েন না। হিতে বিপরীত হইতে পারে। আজকাল কাউরে বিশ্বাস নাই। 
পথিক চুপ। রিক্সাওয়ালাও চুপ। একজন ভয়ে, আর অন্যজন। হাহা...
রিক্সা দ্রুত চলেছে। প্যাডেলে যান্ত্রিক শব্দ, সেইসাথে রাস্তার ভাঙা গর্তে চাকার পতনের সাথে তীব্র ঝাঁকুনির ধাতব শব্দ, আর কোন শব্দ নেই। 
 রিক্সাওয়ালা একবার বলল নটবাড়িতে কোন বাসা?
হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলল পথিক, " ঐ ডান দিকের গলিটা দিয়ে ভাই।" 
রিক্সা গলিতে আসতে না আসতে পাড়ার চৌধুরীর কুকুর টা ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। রিক্সাওয়ালা হেসে ধীরেধীরে বলল, কুত্তাও গন্ধ পাইছে.. পথিক এবার সাহস পাচ্ছেন রিক্সা তার বাড়ির খুব কাছে এসে গেছে। লোকটি কে এবার তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। গন্ধের কথাটা লোকটির মুখে ধীরেধীরে বলতে শোনায়, বেশ জোর গলাতে পথিক বললেন কিসের গন্ধ?লোকটি উত্তর দিল না।
পথিক আর চাপাচাপি করলেন না। 
হঠাৎ আবার বৃষ্টি শুরু হলো। পথিক রিক্সার হূডি টা তুলে দিলেন। পা ভিজছে কিন্তু কিছু করার নেই।
রিক্সাওয়ালা ভিজছে। বেল বাজিয়ে অনেকটা এসে গেল দুজন। মিনিটখানেকের পথ কেবল বাকী।
আচমকা কথার নীরবতা ভেঙে রিক্সাওয়ালা বলল, আপনার নাম কি হাসান?
পথিক চমকে গেল এবার। এই এই..লোকটা কে তো একবারেও তিনি তার নিজের নাম বলেন নি তিনি। তাহলে? তাহলে কি করে এই লোকটি তার নাম বলে দিলো।
তবুও ভুল বলেছে এমন ভাব করে পথিক বলল, নাহ আমার নাম ইশতিয়াক।
হেহে শব্দে খনখনে হাসি দিয়ে বলল, ঐ তো ভাই ইশতিয়াক হাসান! 
আলমডাঙা স্কুল! ফার্স্ট বয়। 
পথিক এবার নিজের হাতে রিক্সার হুডি শক্ত করে চেপে ধরে কৌতুহলী চোখে জিজ্ঞেস করে কে তুমি? আমাকে চেনো নাকি?
চিনতে না পারা ই কথা। অনেকদিন হয়া গেল কিনা।
 রিক্সা পথিকের বাড়ি থেকে ত্রিশ সেকেন্ড দূরত্বে। রিক্সা থেমে গেল তার আগে। মুখ ঘুরিয়ে একচোখ লোকটি পথিকের দিকে তাকিয়ে বলল, রতন! মনে পড়ে নামটা?
হাসানের মনে পড়ল আকাশপাতাল। রতন নামে তার সেই বন্ধুর কথা। খুব বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মাঝে। মাছ ধরতে যাওয়া, পাখি শিকার, আম চুরি কত কি এডভেঞ্চার! একদিন হঠাৎ ভুল টা হয়। রতন কে গাছে উঠিয়ে দিয়ে শালিকের ডিম চুরি করতে পাঠায় হাসান। কিন্তু সেটা শালিকের বাসা ছিল না। ছিল চিল।
ততক্ষণে অনেক দেরী। রতন কে চিল দুটো ঠোঁকড়ে যাচ্ছিল। হাসান নীচ থেকে পাখি তাড়াতে ঢিল ছোঁড়ে কিন্তু ঢিল টা লাগে রতনের চোখে। চিৎকার করে রতন চোখ ধরে এক হাত ঝোলা হয়ে নীচে সোজা মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
হাসানের বিরুদ্ধে মামলা হয়, হাসানের পরিবার তখন বেশ প্রভাবশালী। এই সামান্য মামলা ঠেকানোর ক্ষমতা তাদের ছিল। আরো কঠিন সিদ্ধান্ত তারা নেন, রতন ও তার পরিবার কে গ্রাম ছাড়া করে দেন তারা। হাসান সে সময়ে ভীত ছিল কোন প্রতিবাদ সে করে নি বরং করতেও পারে নি।
রতনের কথা মনে পড়তে ই রতন!! রতন!! তুমি রতন? বলে চেঁচিয়ে উঠল হাসান। রিক্সা থেমেছে, পথিক ওরফে হাসান নেমে পড়েছেন রিক্সা থেকে। 
রতন!! রতন!! 
রিক্সা তখনো ছুটে যাচ্ছে নটবাড়ির আলোছায়া ঘেরা ল্যাম্পপোস্টের আলোকে পাশ কাটিয়ে। ভাড়া নিয়ে একটা কথাও হয়নি দুজনের। এতটা পথ এসেও দূরত্ব রয়ে গেল পুরোনো ঢঙে। 
অনেক ডাকাডাকির পরেও রতনের রিক্সা টা থামল না। চলে গেল। হাসান কেঁদে উঠল। বন্ধুত্ব্ব টার কথা রতন এখনো ভোলেনি। অথচ হাসান তাকে দেখেও চিনতে পারেনি।


(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র পুরোপুরি কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত কিংবা মৃত কারো কোন মিল নেই, মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়) 

সোমবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৮

অবেলায়

(১)

এনায়েউল্লাহ যতক্ষণে ঘুম থেকে উঠলেন ততক্ষণে দুপুরের রোদ টাইলস করা বারান্দায় হামলে পড়েছে আক্রোশের সাথে। বিছানার পাশে এখন মাঝারি সাইজের কোলবালিশ দেয়া থাকে যেখানে মাস তিনেক আগেও তার অসুস্থ স্ত্রী সুফিয়া খাতুন আধমরা হয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতেন। হাঁপানি রোগী, এই ঘরে বড্ড বাতাসের অভাব। তবুও অভিযোগের জায়গা নেই। আছেন দয়া পেয়ে এতে ই কম কি?
স্ত্রী চলে যাওয়ায় পাখির ডানার মত একগাদা ভারী পাথর এসে যেন কাঁধে জুটেছে ধীরেধীরে। চলাফেরায় এসেছে স্থবিরতা। ছেলেবউ, নাতি-নাতনি সবাই আছে তবুও প্রাণে কোন চঞ্চলতা নেই। বিছানা ছেড়ে টী টেবিলে থাকা মোটা চশমা টা চোখে দিয়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে না যেতে শব্দ টা পেলেন। কাজের মেয়েটা কাঁদছে, সম্ভবতঃ বৌমা তাকে মারছে। মেয়েটা ত্রাহিত্রাহি চিৎকার করছে।
মনে মনে ভাবলেন, রোজ করে এভাবে মেরে মেরে আধমরা না করে একেবারে মেরে ফেলে দিলে ই তো ভাল হয়। ওয়াশরুমে যাবার তাড়া থাকলেও ধীর পায়ে তিনি একবার শব্দ উৎসের দিকে যেতে মনস্থির করে হাঁটা দিলেন, ড্রয়িংরুম থেকে রান্নাঘরের মাঝামাঝি এসে থেমে গেলেন। কন্সট্রাকশান কাজে বেঁচে যাওয়া রড দিয়ে মেয়েটার পিঠে, শরীরে বেধড়ক মারছে বৌ মা!
কি হয়েছে মা! ওরে মারছো ক্যান?
আব্বা!! আব্বা!! আপনি সরেন, না হলে আপনার গায়েও পড়বে!!
আহা! একে না মেরে বোঝানো যায় না? বাচ্চা মেয়ে-
আপনি বোঝান! বোঝান না কেন? সারাদিন ঘরে বসে কেবল ছেলের অন্ন গেলেন। একটু তো কাজ করেন।
এনায়েতউল্লাহর শিঁড়দাড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত খেলে গেলো, এভাবে তাকে অপমান করে গেল বৌমা। একবার স্কুলের টি এন ও সাহেব কে মনে পড়ে গেলো এনায়েত সাহেবের। তাগড়া বয়েস, স্কুলের সহকারী শিক্ষক এনায়েতউল্লাহ।
এক ছেলে পরীক্ষায় নকল করে লিখছিল, সেটা তার নজরে না এলেও ঠিকি এলো টি এন ও-র নজরে। ধমকে উঠলেন টি এন ও, অনেক টা রেগেও গেলেন তিনি।
গার্ড দিচ্ছেন না মোয়া গেলাচ্ছেন?
সেদিন ও কড়া শিক্ষক এনায়েতউল্লাহ রক্তটগবগে জবাব দিতে গিয়েও দেন নি, কারণ এটা সরকারি চাকরি। বাড়িতে মুখগুলো না খেয়ে থাকবে। আজো থমকে গেলেন, নিজের মুখের ভয়ে নয় বরং আত্মসম্মান!
মেয়েটার মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে চলে এলেন দ্রুত, চোখের কোণায় জল। না না, কড়া মনের মানুষের চোখের জল তো এত টা তুচ্ছ হতে পারে না। ঝটকায় এসে ঝরে যাবে!

(২)

শার্ট ইন করে একেবারে বৌয়ের মুখোমুখি হলেন আকিফ হাসান, উঠতি ব্যবসায়ী। তিন বন্ধুর একসাথে পার্টনারশিপ, সেখানে বাবার টাকার একাংশ নিয়ে ব্যবসা শুরু তার। বাবা বুড়ো হয়েছেন, এখন তার টাকা দিয়ে কি করার আছে?
বরং তিনি আমাদের সাথে থাকবেন। দরকার হলে ছোট ভাই বোনের কাছেও যাবেন। আকিফের মা এ শুনে বলেছিলেন, " বাবা, আমাগো কি কলার ভেলা বানাই দিলি একবার এই ঘর, আবার ঐ ঘর ভাসাইন্না ভেলা!”
ছোট ছেলেটা বলে উঠে, " মা চুপ থাকো, এটাই ভাল তুমি বুঝবা না! "
এনায়েতউল্লাহ স্ত্রীর হাতে হাত রেখে বলেন, " চুপ থাকো "
সেদিন চলে গেছে অনেক আগে ই, দিন দ্রুত চলে যায়। খুব দরকারী ছাড়া আমরা কিছু ই আজকাল মনে রাখি না। টাকা পাবার তারিখের মতো লাভ ছাড়া কিছু তারিখ আমরা আজকাল ভুলে যেতে ভালোবাসি।
-কি হয়েছে? সকাল সকাল চেঁচামেচি করছিলে যে?
(প্রশ্ন টা করেই জ্বিভে দাঁতের কামড় দিলেন আকিফ)
-কি ই? আমি? আমি করি চেঁচামেচি! তাহলে কে আছে? হ্যাঁ কে সামলায় এ সংসার? বেশী বুঝবে না বলে দিলাম!
-আচ্ছা, আমি তো কথাটা সেভাবে বলিনি।
-কিভাবে বলবে? হ্যাঁ, আমি সারাদিন কাজ করে ঝিঁ এর মত মরে যাই আর আমার ঘাড়ে ফেলে রেখেছো দুই অকর্মণ্য বসে খাওয়া দুই টা মানুষ!
(এনায়েতউল্লাহ ভাবছিলেন, বউমা কে গিয়ে একটু বুঝিয়ে বলে আসবেন কিন্তু দরজার মুখে এসে নিজের নামে অকর্মণ্য শব্দটা শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, কষ্টে বুকের ছাতি তার ফেঁটে যেতে চাইল। বৌমা এতকিছু বলে গেল অথচ তার ছেলে নিজের বাবার হয়ে কিছুই বলল না!)
ধীর পায়ে আবার নিজের ঘরের দিকে ফিরলেন এনায়েতউল্লাহ। মনে মনে ভাবলেন এখনো অনেক গাধা পিটিয়ে তিনি মানুষ করার ক্ষমতা রাখেন।
ছেলের বৌয়ের গলায় আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো হয়ত, এবার শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, " বসে বসে আর কত? একটু হাতের কাজও তো করা যায়!"
আকিফ মাথা নীচু করে গলার টাই টা জোরে কয়েকবার টেনে ঘরে থেকে দ্রুত বেড়িয়ে গেলেন।
-কই যাও? খেয়ে যাও!
-খিদে নেই!

(৩)

আলুর প্লেটে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিলেন এনায়েতউল্লাহ।
-আরে আব্বা কি করছেন?
-কাজ করছি!
-না না আব্বা, আসুন আসুন (হাত থেকে ছুরি আর আলুর প্লেট সরিয়ে তাকে রুমে দিয়ে এলেন বৌমা)
কাজের মেয়েটি শুয়ে, মেয়েটিকে আলু খোসা ছাড়ানোর কথা বলে দুপুরের নিউজ দেখছিলেন তিনি। এই ফাঁকে কাজের মেয়েটি পরে পরে ঘুমাচ্ছে আর শশুর এসে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছে।
দেখে মোটেই পছন্দ হলো না তার, চুলের মুঠি ধরে ই রডের আঘাতে লাল হয়ে আসা সেই পিঠেই কষে চড় থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। আচমকা আক্রমণে মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে অন্য ঘরের দিকে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলো। মা গো.. বাবা গো.. বলে..
অফিসে জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন আকিফ, একটা চাইনিজ পোষাক আমদানি কারি কোম্পানির কয়েকজনের সাথে। সেখানে বৌয়ের ফোন, একবার দুবার নয় পনেরোবার!!
ফোন সাইলেন্ট থাকায় ক্লায়েন্ট ব্যাপার টা বুঝতে পারেনি ঠিকি কিন্তু অন্যমনস্ক ভাব টা তারা বুঝতে পেরেছে।
এদের একজন ই বললেন, " আর ইউ ইন এনি ট্রাবল? প্লিজ, টেক এ ব্রেক দেন "
আকিফ কৃতজ্ঞতাসূচক মাথা নাড়িয়ে ফোন হাতে বাইরে এলেন রুমের,
-হ্যালো! কি হয়েছে?  বারবার ফোন করছো কেন?
- এই তোমার বাবা, তোমার বাবা!! তার জন্য আজকে কাজের মেয়েটার এত্ত সাহস।
- শোন, আমি জরুরি একটা মিটিংয়ে আছি এই ডিল টা না হলে না খেয়ে থাকতে হবে বুঝলে?
- আমি কিছু বুঝি না, তোমার বাবা কে আর এ বাসায় দেখতে চাই না আমি বুঝলে?
- আমি রাখছি।
ফোনের বিপ টোন শোনা গেলো।
কাজের মেয়েটিকে চুল ধরে টেনে এনে আবার কাজে বসিয়ে দিলেন তিনি।

(৪)
মেয়েটা চা দিতে এসেছে এনায়েতউল্লাহ কে, মেয়েটার কেউ কেউ কাছের বলতে। এক চাচী আছে সে ও ঠিকে ঝি। বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায় সে। বাচ্চা মেয়েটি বস্তিতে একা নিরাপদ নয় তাই মেয়েটিকে আর সেখানে না রেখে এই বাসায় টুকটাক কাজের জন্য রাখা হয়েছে। মাস শেষে তিনহাজার টাকা পায় সেই চাচী তাই এই মারধরের ব্যাপার টাকার সামনে আর টেকে না। টাকা পেয়ে পাঁচশ'র মত খরচ করে জামাকাপড় কিনে দেন মেয়েটিকে বাকী টাকা নিজের কাছে রেখে দেন। মেয়েটির হাতে একটা পয়সা জোটে না, কেবল জোটে মারধর।
মেয়েটি কাপ সেই টী টেবিলে রেখেই আবার চলে যায় কাজে।
এনায়েতউল্লাহর বৃদ্ধ হাত অসাবধানে ফেলে দিল চায়ের কাপ বৌমা ছুটে এলো দ্রুত। তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া কাপের সেটে এখন একটা পিস মিসিং।
সহ্য হল না বৌয়ের!
রাগ আর বাবার উপর না ঝেরে তুমুল মারধর করলেন কাজের মেয়েটাকে। এবার আর এনায়েতউল্লাহ গেলেন না বাঁচাতে। নিজেকে এতো ছোট, এতো নীচ তার কোনদিনই মনে হয় নি।
সমস্তটা একটা রি রি করা ঘৃণার মত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এই বিছানায়। নিজের স্ত্রী থাকলে হয়ত বলতেন, " একা একা তো এখন আমাকে ফেলে ভালোই আছো!"
পাশের ফ্ল্যাট থেকে শায়নীর আম্মু ছুটে না এলে আজ হয়ত কাজের মেয়েটা মারা পড়ত এ বাড়ির লক্ষী বৌয়ের হাতে।
শায়নীর আম্মু ও থামিয়ে বললেন, " দেখেছেন ভাবী, কেমন করে আবার তাকিয়ে আছে। আমার বাচ্চারা কখনো এত্ত সাহস পায় না জানেন?"
আরো একবার তেড়ে গিয়ে গালে একটা চড় বসালেন তিনি।
-আর আপনারা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিন না আপনার শ্বশুর কে, আমি টুটুনের বাবা কে বলেই আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি দুজন কেই পাঠিয়ে দিয়েছি। সেখানেই ভালো থাকবে তারা। আর ভাবুন তো! এদের রেখে বাইরেও যেতে পারতাম না।
কি যে ইনসিকিউরড ফিল হতো ভাবী!
বিছানায় বসে সব শুনলেন এনায়েতউল্লাহ। তিনি সাত পাঁচ ভাবতে লাগলেন। তার যুবা বয়সের কথা মনে পড়ল। তখন তিনি সদ্য শিক্ষক। গণিত পড়ান ক্লাস এইটে। সেই সাথে ছাত্রছাত্রীদের চরম পেটান। ভয়ে সবাই অস্থির তখন। আর যাই হোক অংক ভুল করা যাবে না।
রহমত নামে একটা ছেলে ছিল তার ক্লাসে, সে রীতিমত সাহসী। একবার না বেশকয়েকবার সে অংক না করে ক্লাসে আসতো। তার নাকি স্যারের মার খেতে ভাল লাগে। এনায়েতউল্লাহ পরে নিজে থেকে খবর নিলেন রহমতের, জানা গেল তার মা ছোটবেলায় মারা গেছে। বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। সৎ মা তাকে খেতে দেয় না। তাই সে সারাদিন গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়ায়, এ গাছের ফল সে বাড়ির চিড়ামুড়ি, বন্ধুর বাড়িতে শুয়ে বসে কাটায়। রাতে বাড়ি ফিরলে বাড়ির ঘানি তে কাজ করায় ওর বাবা। সারারাত ঘানি টানে, ভোরে একটু শুয়ে আবার সকালে স্কুলে আসে।
এনায়েতউল্লাহ'র মনে মায়া হল। তিনি আর তার ক্লাসে ওকে মারতেন না। রহমত কে কাছে ডেকে অংক বুঝিয়ে দিতেন। ছেলেটা দারুন মেধাবী, একবার বলে দিলে ই হয়ে যেত। ঈদের আগে নিজের পকেটে থেকে টাকা খরচ করে ওর জন্য একটা জামা আর ফুল প্যান্ট কিনে হাতে দিলেন।
হাউমাউ করে স্যারকে জড়িয়ে ছেলেটা কেঁদেছিল সে সময়, স্যার! আপনি এত্ত ভালো ক্যান!! স্যার!! কেঁদে কেঁদে একাকার হয়েছিল সেদিন ছেলেটি।
বড় ছেলের বাড়ি আসবার পথে তার সাথে সেবার দেখা হয়েছিল। ম্যাসাচুসেট্স থেকে ডক্টরেট করেছে। সেখানে এখন সে প্রফেসর। এতবছর পর স্যার কে দেখে ওর চিনতে কোন ভুল হয়নি। স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করে স্যারকে জড়িয়ে তখনো সে কেঁদেছে। স্যার না থাকলে স্কলারশিপ পেয়ে সেখানে ডক্টরেট করাটা হয়ত ওর হতো না।
রহমতের কথা মনে হতে ই এনায়েতউল্লাহ'র চোখের কোণা ভিজে গেল আবেগে।

(৫)

চিঠিটা আমেরিকার,
আজই এসেছে
স্যার আমার সালাম নেবেন। আমি জানি আপনি সবসময় ভাল চিন্তা এবং পজেটিভ সিদ্ধান্ত নেন। আপনি আমার জীবনে বড় একটা পাওয়া। আপনার এই ইচ্ছে টাও পূরণ হোক সেই কামনা থাকল। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি এবং এলিস ভালো আছি। এলিস আপনার কথা শুনে আপনাকে দেখতে চেয়েছে। আমি গ্রামের সাইবার কামরুল কে বলেছি। আপনাকে আমাদের সাথে স্কাইপে কানেক্ট করিয়ে দিতে।
দোয়া করবেন,
রহমত।
একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে এনায়েতউল্লাহ'র এত ভাল লাগছে এতদিন পর বেঁচে থাকার ইচ্ছে টা অনেক বড় করে দেখা দিয়েছে চোখের সামনে। রগড়ে চোখের জল মুছে আবার চশমা টা পড়লেন তিনি। কয়েকশ বাচ্চামুখ চেঁচিয়ে উঠল খিলখিল শব্দে, "স্যার কাঁদছে.. হিহি.."
এনায়েতউল্লাহ একটু হাসলেন তারপর বললেন তোমরা পড়া শুরু করো ছেলেমেয়েরা। বানান ভুল করা যাবে না একদম।
ক্লাসের বাইরে এসে পত্রিকায় চোখ বুলালেন তিনি, তার চোখ আটকে গেল এক কোণা তে,
" সম্মানিত ব্যবসায়ী পরিষদের সভাপতি আকিফ হাসানে পিতা মোঃ এনায়েতউল্লাহ কে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন সহৃদয় ব্যক্তি উনার সন্ধান পেলে তার সন্ধান দিতে অনুরোধ করা হলো, ফোন নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদি "
পত্রিকাটা মুচড়ে ছিড়ে ছুড়ে ফেললেন তিনি। তার চোখ গেল সাইনবোর্ডে। সেখানে বড় বড় হরফে লেখা " এনায়েতউল্লাহ'র আদর্শ স্কুল, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আশ্রয়স্থল "
ভেতরে উঁকি দিয়ে সেই কাজের মেয়েটিকেও দেখা গেল, ওর নাম সাথী।


(সমাপ্ত)


গল্পের সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক এর সাথে জীবিত, মৃত কিংবা অর্ধমৃত কারো কোন মিল খুঁজে পেলে তা একান্ত কাকতালীয়)


বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

গল্পঃ বাবাজীর পাল্লায়


(এক)
যখন আমি নিরুদ্দেশ হতে চাই, ঠিক তখনি আমার ফোন বন্ধ করে রাখি। এতে দুটো সুবিধে হয়। এক. অকারণে কোন ফোন এটেন্ড করতে হয় না এবং দুই. উটকো আবদার আসে না।
অনেকদিন থেকে ই ভাবছিলাম কোথায় যাবো! সত্যি বলতে গ্রামে যেতে আমার বড্ড মন টানে। গ্রামের ছেলে আমি, আজ ঠিক এখন হয়ত আর বয়েসের বেড়াজালে ছেলে বয়েসে আটকে নই তবুও মনের ছেলেমি টা এখনো কাটেনি। জোর করেই সেটা প্রকাশ পায় যখন একটু সময় পেলে বিকেলে বেড়িবাঁধের দিকটায় যাই।
আসলে ঢাকায় চলাফেরা, আসাযাওয়া বলতে কেবল হাতিলঝিল আর ঐ বেড়িবাঁধ। এর বাইরে খুব যেতে ইচ্ছে হয় এমন জায়গা নেই। তাই গ্রামের পথে আমার হুটহাট বেড়িয়ে পড়া। অবশ্য এমন ভাবার কারণ নেই যে, একেবারে অচেনা জায়গায় না জেনে রওনা করি। আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরি ভালো, সে বয়েসে ছোট কিংবা বড়!
তাদের চেনাপরিচিত গ্রাম, শহর, বাড়ি, লোকজন এসব না জেনে আমি কিন্তু বেড়িয়ে পড়ি না।  বড্ড বাজে বকি আমি!
আজ যাচ্ছি সৈয়দপুর।
আমার চেনা নয়। আমার পরিচিত এক লেখকের শশুরবাড়ি। আমাকে রেকমেন্ড করতে চাইছিলেন তার শশুরবাড়ি থাকতে কিন্তু আমি ই রাজী হলাম না। ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি হলে ভাবা যেত, একে তিনি ই সে বাড়ির জামাই তারপরে আমার যাওয়া টা খুব ভাল দেখাতো না। তবে ভদ্রলোকের শ্যালক জাহাঙ্গীর আমাকে সেখানে সাহায্য করতে রাজী, এমনকি সৈয়দপুরের কয়েকটা গ্রামে ঘুরে বেড়াতে সে তার নিজস্ব বাইকে আমাকে নিয়েও যাবে। আমার এতে ই ষোলআনা পূর্ণ।
ঢাকায় আজ ৩৯ ডিগ্রী, বাতাসের আর্দ্রতা এত্ত বেশী যে শরীরের গেঞ্জি থেকে পাঞ্জাবি ভিজে সপসপ করছে। ডান পকেটে থেকে রুমাল টা বের করে কপাল, ঘাড় মুছে নিলাম। বোতল খুলে পানি খেলাম ঢকঢক করে।
আহ! এই গরমে বেঁচে থাকা অসহ্য।
ট্রেন এখনো ছাড়েনি। লোক উঠছে। আমার পাশে এদিকওদিক লোকের গলার আওয়াজে গমগম করছে।
বাইরে হকারের চিৎকার, চা গ্রম লাগবো চা? ফানি.. ফানি.ফানির বোতল! ১০ ট্যাকা ১০ ট্যাকা!
আমি হকারকে ডেকে এক প্যাক সিগারেট নিলাম, সাথে একটা মশলার কৌটো। এই পান মশলা খাওয়া টা আজকাল বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারপর জানালা বরাবর হেলান দিয়ে পত্রিকা মুখের সামনে তুলে সেটায় মনোযোগী হলাম।
লোকজন ট্রেনে উঠবার সাথে সাথে গরম টাও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।


(দুই)

ট্রেন ছাড়ল আরো আধাঘণ্টা পর। ঘেমে যাওয়া শরীর চামড়ার টান ধরিয়ে শুকিয়ে যেতে লাগল জানলা দিয়ে আসা বাতাসে। পত্রিকা ব্যাগে পুরে বোতল বের করে পানি খাবো ঠিক তখনি চোখ গেল পাশের সিটে।
রে ব্বাব্বা!
এমন আওয়াজ আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে পড়ার কারণ যথেষ্ট আছে। মাথায় পাগড়ী, চুলে জটা, পরণে লাল কাপড়। সাধুর সাথে ট্রাভেল? হাহা..
মৃদ্যু হাসি দিতে না দিতেই পাগলের সাথে আমার চোখাচোখি। চোখ ভালোরকম লাল, ভাবলাম কড়া গঞ্জিকা সেবনের ফল। আমি মুচকি হাসছিলাম।
হঠাৎ দেখলাম,
লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বড়বড় করে। তাকে দেখে যে আমি হেসেছি এটা মনে হয় সে বুঝে গেছে। তর্জনী আমার দিকে সোজা কোরে তুলে কয়েকবার এদিকওদিক নাড়িয়ে বোঝাল আমি যাতে না হাসি। অবশ্য আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে উপর-নিচে, ডানে-বামে তাকিয়ে দেখলাম আমার এই কামরায় কেবল আমরা দুজন! আর তর্জনী আমাকে ই দেখানো হয়েছে।
আমি স্বাভাবিক ভাবে বসে আগের মত পড়ে রইলাম। একবার ভাবলাম, "চোর-টোর না তো?, এমনভাবে ট্রেনে ডাকাত ও হতে পারে। পরে নিজেই মনে মনে হাসলাম আমারো তেলেসমাতি ভাবনা। " আমি পড়ে রইলাম আমার মত। কোথাকার কোন পাগল এসে জুটেছে আমার সহযাত্রী হয়ে।

(তিন)

ট্রেন টা ধাতব ক্যাঁচক্যাঁচে শব্দে থেমেছে কোন স্টেশনে। আমি চমকে উঠেছিলাম তবে কনুই দিয়ে আবার চোখ ঢেকে ফের শুয়ে যাচ্ছি, চমকে গেলাম হইহই শব্দে। অনেক লোকের হট্টগোলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনি শব্দ হলো। আমার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ই ছিল পাশের সিটে চোখ রাখা। সেটাই করলাম ভাবলাম পাগল আবার ডাকাতি করে পালালো নাকি?
আমার অমন চাহনি দেখে পাগল ভ্রু কুঁচকে চাইল আমার দিকে। সে এখন জোড়াসনে বসে। মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। দেখে মনে হয় ধ্যানে বসেছে। পাগলের সাথে অস্ত্র? এবার মনে সন্দেহ জাগল।
পাগল এই প্রথম মুচকি হাসল আমার দিকে চেয়ে। আমি কামরা থেকে বেড়িয়ে পড়ব ভাবছি ঠিক তখনি কামরার দরজা ঠেলে একপাল লোক ঢুকল। কেউ করজোড়ে, কেউ কাঁদোকাঁদো গলায় " বাবা.. বাবা.. " বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমিও এই আদিখ্যেতা দেখে বলিহারি যাই! বাবারে?  কোন জন্মের বাবা এ তোদের? আসল বাবাও (জন্মদাতা) এমন ভালবাসা পায় কিনা সন্দেহ! (কথাটা অবশ্য মনে মনে, এই কথা মুখে বলে পিঠের ছালচামড়া আলাদা করার সময় এখন না)
তবে একটা কথা!
আমিও কিন্তু বাবা ভক্ত তবে এমন অন্ধভক্ত নই। একসময় যখন আমার লেখা কোন কাগজে ছাপানো হতো না, তখন আমার এক সমবয়সী বন্ধুর অনুরোধে গিয়েছিলাম এক বাবার কাছে। সেও প্রায় একইধরনের ছিল। আমার হাতে একটা বাতাসা ধরিয়ে বলেছিলেন " নে খা "। হাত খুলে দেখি সেটা পিঁপড়ে খাওয়া এক বাতাসা, কিছুটা হলদে হয়ে গেছে। নির্ঘাত ফুড পয়জনিং হয়ে যাবে খেলে!
তবুও বন্ধু আর আধ্যাত্মিক বাবার ভয়ে মুখে পুড়েছিলাম। এখন সেটা অতীত।
আমার নাম রীতিমত কাগুজে পাড়ায় ভাল লেখক পদবীসহ জুটে যায় তার ই দিন পনেরো পর। তবে এরপর আর সে বাবার কাছে যাইনি। আজকালকার বাবাদের যে কেচ্ছা কাহিনী দেখি টিভি আর পত্রিকায় তাতে বাবাজী সমাজের প্রতি আর শ্রদ্ধা থাকে না বলা চলে। বিশেষত, সত্যজিৎ রায়ের " মহাপুরুষ " টা দেখলে বুজরুকি টা কিছুটা ধরা যায়। আমরাও এমনি। তাবৎ কোন কাজ নিজে করতে না পারলে বাবার কাছে যাই, পায়ে পড়ি। যদি কোনভাবে দৈববলে কাজ হয়ে যায় তাহলে তো বাবাজীর কেল্লাফতে! ভক্তের আদরে ফুলো বেলুন। যাই হোক, আমি কিন্তু নাস্তিক নই। ধর্মে বিশ্বাস আছে। তবে বাবাজীদের ব্যাপার টা বরঞ্চ আলাদা।
লোকের ভীড় কমেছে এতক্ষণে। ট্রেন ছাড়ার শব্দে লোক নেমে গেছে। যে দুই একজন আছে এরাও ঝটপট বাবাজীর পায়ের ধূলো নিয়ে দ্রুত নেমে গেল। কয়েকজন যারা নামছিল না তাদের টিকিটচেকার ঘেঁটি ধরে নামিয়ে দিল। এরা কিভাবে যেন জানতে পেয়েছে এই মহান বাবা এই ট্রেনে ই যাচ্ছে তখনি দেখা করার সুযোগ না পেয়ে তখন হইচই বাঁধিয়েছিল। ট্রেন এখন শান্ত। তবে খেয়াল করলাম, ট্রেনের বাবাজীর পা চকচকে পরিস্কার। বুঝলাম, সব ধূলো ভক্তরা সাথে নিয়ে স্টেশনে নেম গেছে।

(চার)
আমাদের ট্রেন টা ভালো ই ছুটেছে মৃদ্যুমন্দ গতিতে। কতক্ষণ আর শুয়ে কাটানো যায়। লম্বা ভ্রমণে এই একটা সমস্যা। বিলেতে বুলেট ট্রেনের কথা মনে পড়ল। আহা! কত সময় ই বা লাগত! কবে হবে বুলেট ট্রেন ভাবতে ভাবতে সিগারেট জ্বালাচ্ছি। তখনি বাবাজী পাগলা বেঁকে বসল, তাও রীতিমত তুই তোকারি করে।
" বিড়ি জ্বালাবি না "
আমিও তখন রেগে, মামাবাড়ির আবদার নাকি?
পাগল আমার দিকে আবার তর্জনী দেখিয়ে হিন্দী মুভির ভিলেন চেহারায়।
আমিও তেড়েফুঁড়ে গেছি!
কামরায় ঢুঁকল টিকিটচেকার। আমি চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে লাগলাম। চেকার আমার টিকিট চেক করল। তারপর পাগলের দিকে ফিরে ফিরে তার টিকিটখানাও দেখে চলে গেল। চেকিং করতে করতে আমার বিড়ি খাওয়া প্রায় শেষ। ফিল্টার ফেলে বোতল থেকে পানি খেয়ে ফের পত্রিকা হাতে নিলাম, আর আড়চোখে পাগলের দিকে দেখতে লাগলাম।
পাগল দুধ-মুড়ি খাচ্ছে, পাঁকা আম দিয়ে। কয়েকটা মুড়ি আবার আটকে গেছে তার মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফে।

(পাঁচ)
আমার ফোন বন্ধ। কি মনে হতেই সেটা অন করে বসলাম। দু-চারটে মেসেজ এসেছে।
বন্ধু তুই কই?
কয়েকটা মিসড কল এলার্ট। কলের সংখ্যা কম নয়। ত্রিশের বেশী। মেসেজ ও কম সে কম বিশ টা।
তবে সবকয়টা তে একই কথা। তুই কোন ট্রেনে?  কোথায় দাদা? সুস্থ আছিস?
ফোন বন্ধ কেন করিস?
আমার বন্ধু, প্রেস অফিসের কলিগ, কর্মচারী সবাই বেশ আতঙ্কিত!
পাগল এখন হাসছে। এই প্রথম পাগলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এক পা সিটের নীচে, আরেক পা হাঁটু ভাজ করে কোলের কাছে। দুহাতে তালি দিচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পাগলের গলায় থাকা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতের আংটি সবকিছুতে আমি কেমন যেন ঝঙ্কার ধ্বনি পাচ্ছি। তবে হাসি থামিয়ে সে যা বলল তাতে আমি আরো অবাক হলাম।
" যাবি, যাবি আমার সাথে?"
আমি আরো অবাক, একদিকে এইসব মেসেজের মানে তখনো মাথায় ঢুকছে না তারপরে আবার পাগলের পাগলামি!
সহ্য হল না। কড়া গলায় বললাম, " কই যাবো রে পাগলু?"
পাগল মনে হয় এতে খুশী হলো না। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, " থেকে যাবি ট্রেনে? তাহলে থাক! আমি নেমে যাচ্ছি। "
আমি আরো অবাক, ঘন্টায় প্রায় ৮০ কিঃমিঃ গতিতে ছুটছে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক্সপ্রেস ট্রেন। এখান থেকে পাগল কি এখন লাফ দেবে?
ফোন টা হাতে বেজে উঠল। পাগল তার ঝোলা, জিনিসপত্র গোটাচ্ছে। সম্ভবত পাগল সত্যি সত্যি ট্রেন থেকে নেমে যাবে।
আমি ফোন রিসিভ করলাম। আমার পরিচিত সেই লেখক ফোনের অন্যপাশে।
দাদা! আপনি কোথায়?
আমি তো..! (পাগল তার নিজের তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে আমাকে কথা না বলার নির্দেশ দিল) তাই আমি কোথায় আর বলা হলো না।
অন্যপ্রান্তে সে ভদ্রলোক বললেন, কপাল ভাল!  আপনি বেঁচে আছেন। আপনার সে ট্রেন টা তো দুপুরে এক্সিডেন্ট করেছে। শ' এর উপরে লোক আহত। নিহত কতজন এখনো জানা যায় নি।
আমি পরে ফোন করছি বলে ফোন কাটলাম। নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। ট্রেনও চলছে। তাহলে কোনটা সত্যি? ফোন কল টাও তো ভুল না। দিব্যি কথা বলছি। সব বাস্তব, তাহলে হচ্ছে টা কি!
পাগল এবার কথা বললেন, " নেমে যাবি আমার সাথে, তাহলে বেঁচে যাবি "
ঘোরে ছিলাম।
হ্যাঁ বলতে না বলতে পাগল আমার হাত ধরল। হাত টা ভীষণ শক্তিশালী। এমন হাত ব্যায়ামবীরের ও হয়না মনে হয়।
এরপর কেবল বুঝলাম আমরা ট্রেনের বাইরে যাচ্ছি। শরীরটা বাতাসের মত হালকা হয়ে গেছে। ঠিক যেন, আমি সুতো কাঁটা ঘুড়ি।

(ছয়)
জ্ঞান ফিরতে বুঝলাম। আমি হাসপাতালে। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কপালে পট্টি, গালে ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। এদিকে ওষুধপত্র, আর ভারী গন্ধ নাকে আসছে। পাশের কেবিনে থাকা একজন নার্স আমার বেডের দিকে এসে আমার পালস চেক করলেন।
চোখের সামনে আঙুল ধরে বললেন, " শুনতে পাচ্ছেন? দেখতে পাচ্ছেন?"
আমি শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
নার্স বাইরে সবাইকে ডাকলেন। আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করুন তবে কেউ হট্টগোল করবেন না।
দেখলাম, আমার চেনাজানা সবাই এসেছে। সবাই বেশ চিন্তিত। তবে আমার জ্ঞান ফেরা দেখে প্রথম ই কথা বললেন আমার পরিচিত সেই লেখক।
সরি! আপনি এভাবে ট্রেন এক্সিডেন্ট করবেন জানলে আপনাকে আমার গাড়ি করে ই পাঠাতাম।
ট্রেন এক্সিডেন্ট!  আমি বিষ্মিত তবে মনে আছে আমি আর পাগল সেই ট্রেন থেকে আগেই বেড়িয়ে পড়ি। তাহলে সেই পাগল? (কাউকে পাগলের কথা বললাম না এতে আমাকে এরা কি ভেবে বসে, হয়ত মাথায় বিকৃতি হয়েছে এমন ভাবতে পারে)
দিন দুয়েক পর সুস্থ হতেই পত্রিকা হাতে নিতে পারলাম। আমি তখনো হাসপাতালে। বেডে শুয়ে ফলমূল খাচ্ছি। তবে পত্রিকা খুঁজে কোন পাগল ট্রেন দূর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহত হবার খবর পেলাম না। আমিও এটা অবাস্তব ভেবে ভুলে গেলাম। তবে সৈয়দপুর যাবার লোভ কাটেনি। সুস্থ হবার মাস দুয়েক পর আবার সৈয়দপুর যাবো বলে ঠিক করলাম। তবে এবার ভাড়াটে প্রাইভেটকারে।

(সাত)

আমি এবার একা যাচ্ছি না। সাথে আমার লেখক বন্ধু ও তার পরিবারবর্গ ও সাথে। সবাই মিলে ছয়জন। চাপাচাপি করে ই চলছিলাম। মাঝপথে একটু ফ্রেশ হতে সবাই ব্রেক নিতে নামলাম। কাছাকাছি একটা বাজারে আমি একাই গেলাম। কিছু ঠান্ডা পানীয়, বিস্কুট এইসব কেনাও যাবে।
একটা খাবার হোটেলে ঢুকে পানি খাচ্ছি হঠাৎ চোখ গেল হোটেলের দেয়ালে। সাদাকালো এক পোস্টারে চোখ আটকাল আমার, সেখানে একজন পাগলের ছবি। তার নাকি মাজারে উৎসব! এই নিয়ে পোস্টার। আরে, এই তো সেই ট্রেনের পাগল।
আমি খুশীমনে দোকানদার কে টাকা দিয়ে জিনিসপত্র হাতে নিতে নিতে বললাম, " ভাই? উনি খুবই ভাল। আমার সাথে একবার ট্রেনে দেখা হয়েছে অনেক আগে। আচ্ছা! এই পাগল বাবার দর্শন পাওয়া যাবে আজকে?"
দোকানি তো বটে, পাশের আর যারা সেখানে ছিল সবাই আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকাল।
হে হে! কি যে বলেন! দোকানি বলে উঠল, " ঐ পাগল বাবা! - সে তো সেই কবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মারা গেছে। একাত্তর সাল, কে কই যায় তার দিশা নানাই তখন! গ্রামের ভেতর পাকবাহিনী ঢুকে পড়সে। যারে পায় তার কাছে জানতে চায় মুক্তি কিধার হ্যায়? গ্রামে তখন কিছু লোক সেই বাবাজীর ডেরায় আশ্রয় নেয়, তার মধ্যে ছিল কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবা ছিল দয়াল মানুষ, হানাহানি তে তার কোন সায় ছিল না। তারে যারা মানতো, তিনি কেবল তাদের বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেন। তাও সবার বাড়িতে না। উনি যাদের বাড়ি যেতেন তাদের ই কপাল খুলে যেত! তাই বাবাজীর প্রতি অনেকের যেমন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ছিল তেমনি কিছু লোকের আতিথেয়তা না পাওয়ায় ক্ষোভ ও ছিল। আর তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের হুকুম তলব করার মত লোকের অভাব হয় নাই। এদের কিছু লোক বাবাজীর নামে মুক্তিসেনাদের সহযোগীতার তথ্য দেয়। পাক সেনারা তখন পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায়।
পাকবাহিনী পাগলের আস্তানায় এক রাতে আসে। এলাকার এক রাজাকার পাগলের ডেরার সন্ধান দেয়। তারপর পাগল রে মাইরা তার আস্তানায় ই মাটিচাপা দেয়। সেইখানেই তার ভক্তরা বার্ষিকী করে ফের বছর।"
কথা শোনার সময়ে আমার মাথায় অনেককিছু এনালগ ঘড়ির কাটার মত ঘুরছিল।
আমার বলার ভাষা ছিল না। তবে এর বেশী কথা বলাও বোকামি। কেউ বিশ্বাস করুক বা নাই করুক। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি নিজে যা দেখেছি, যা হয়েছে তা কেবল আমার মাঝে থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
কাউকে বিশ্বাস করানো টা আমার দ্বারা হবে না। সে লোকটি যেই হোক না কেন, কেন তিনি সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন জানি না। তবে আরেকদিন দেখা হলে সেটা অবশ্যই জেনে নেবো সেই পাগলাটে বাবাজী মশায়ের কাছে। আমার কপাল হয়তো বেশ চওয়া, ভাগ্য মন্দ নয় অনায়াসে ই বলা যায়।
দোকানী বলল, "তা ভাই! চা খাইবেন তো এক কাপ? আরেক টা গল্প ও শুনলেন খাইতে খাইতে.. "



(গল্পের সমস্ত ঘটনা এবং চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো সাথে কোন মিল নেই, মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়)

গল্পঃ নখ

(এক)

নোংরা নোংরা !!
ছিঃ ছিঃ বলে চেঁচিয়ে উঠল নীরার মা। মেয়েটি নীরার সমবয়সী। কতই বা বয়েস! ওই হয়ত নয় বা দশ। এমন বাচ্চা মেয়েকে কেউ কাজে দেয়! কিছু যদি অঘটন ঘটায় তাহলে তার দায় কে নেবে?
মেয়েটির কোন নাম জানা ছিল না নীরার মায়ের। মেয়েটির মা খুব গরীব। সে নিজেও বাড়ি বাড়ি কাজ করে। স্বামী পরিত্যক্তা তাই মেয়েটিকে সারাদিনে দেখভাল করার মত কেউ নেই। একাকী মেয়ের উপর বস্তির লোকের কু-নজর। সে নজর কোন বয়েস, রঙ, মনুষ্যত্ব বোঝে না।
আপা! (হাত দুটো জোড় করে ধরে)  আমার মাইয়া টা খুব চুপচাপ। এমনি কোন কামকাজ পারে না তয় ছোটখাটো কাজে সব ই পারে। এই যেমন, দোকানে কেনাকাটা, এইটা সেইটা হাতে হাতে আগাই দেওয়া। আপনে হাজার এক দুই যাই দেন আপা দিয়েন। মাইয়া টা সেইফ থাকবো আপনার কাছে।
নীরার মায়ের তখন তাড়াতাড়ি। সানগ্লাস চোখে হ্যান্ডব্যাগ ঠিক করছেন।
নীরা! তাড়াতাড়ি!
স্কুলে লেইট হচ্ছে!
নীরার গলা শোনা যায়, আসছি মাম্মি।
আমার আবার একটা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে মিটিং আছে প্রেসের সাথে। আর তুমিও! বিকেলে আসতে পারো না!
আপা বিকালে কয়দিন ধইরা আইছি কিন্তু দারোয়ান কয় আপনে নাকি বাড়িতে নাই, ফিরা গেছি।
আচ্ছা আচ্ছা.. এখন যাও তুমি। কাল মেয়েকে এসে দিয়ে যেও। ঠিকাছে। এখন এসো।
নীরা...রা.. এলি?
নীরার মা এখন আর কথা বলতে পারছেন না। ডাক্তার বলছেন তিনি নাকি মানসিকভাবে সুস্থ নন। হাসপাতালের বাইরে হট্টগোল।
বিচার চাই! বিচার চাই!
স্লোগান দিচ্ছে ভদ্রমহিলার নিজের সংগঠনের কিছু কর্মী। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কর্তব্যরত ডাক্তার এসে স্টোথোস্কোপ দিয়ে নীরার মায়ের হৃদস্পন্দন চেক করলেন। পালস দূর্বল, তাছাড়া ব্লাড প্রেসার ও লো। মুখে কিছু খেতে চাইছেন না। এমনি চলতে থাকলে আরো দূর্বল হয়ে যাবেন তো!
স্যালাইন চালু করা হল। আপাতত নল দিয়ে খাবার খাওয়ানো হবে। তিনি রেস্পন্স ও খুব একটা করছেন না।
ভদ্রমহিলার স্বামীকে ডাক্তার ডেকে নিলেন রুমে, প্লিজ ফলো মি!
ডাক্তারের রুমে এসে ই ভদ্রলোক কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, "আমার ওয়াইফ বাঁচবে তো "
ডাক্তার বললেন, দেখুন আপাতত চিন্তার কিছু নেই। শরীর অনেক দূর্বল। আমি ওষুধ দিয়েছি। উনার পর্যাপ্ত ঘুমের দরকার। আমি ঘুমের ইঞ্জেকশান দিতে বলেছি নার্স কে। সম্ভবত উনি ভাল শক পেয়েছেন। কি করে পেলেন?
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে, আসলে..
(রুমে হইহই করে হাসপাতালের দারোয়ান এসে বলল স্যার, বাইরে ঢেইলাইতাছে)
হোয়াট!! কল দ্যা কপস!! ইমিডিয়েটলি।
ভদ্রলোকের সাথে আর কথা হলো না। ডাক্তার উঠে পড়লেন। বাইরে বস্তির লোকজন, সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ! তাড়া ঢিল ছুঁড়ে হাসপাতালের করিডোর ভরে ফেলেছে। এক দুই জন আহত। তাদের মাথা ফেটে রক্তাক্ত।
পুলিশ এসে যাবার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলো কিন্তু স্লোগান বাড়ল।
খুনীর সাজা চাই! রক্ষা নাই! রক্ষা নাই!
ডাক্তার তার রুমে ফিরলেন। মাঝের সময়ে কয়েকজন ইমারজেন্সী পেশেন্ট কেও দেখতে হলো। ডিউটিরত ডাক্তার আজ আসেন নি তাই। এম ও হয়েও ইমারজেন্সী দেখতে হলো।
কফি খাবেন? (ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে)
ডাক্তার এপ্রন খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে দিলেন। এই লাইফে ব্যস্ততা একটা শব্দ না। এখনি ডাক পড়লে ঈ আমাকে ছুটে যেতে হবে। একটা সেকেন্ড নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি না গেলে তো আরো সমস্যা। আগামীকাল আমাকে হেডলাইনে পাবেন, "ডাক্তারের অবহেলা এবং রোগীর মৃত্যু "।
ভদ্রলোক ডাক্তারের কথায় কেবল ঈষৎ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। কফি এসে গেলো। কম্পাউন্ডার কফির ট্রে রেখে গেল।
কফিতে চুমুক রেখে ডাক্তার বললেন, এবার বলুন ঘটনা কি? উনি কি থেকে এত্ত শক পেলেন?
ভদ্রলোক কফির মগ ট্রে তে রেখে বললেন। আমাদের বাসায় কাজের মেয়েটিকে প্রায় অনেক অনুরোধের পর রাখা হলো। আসলে আমার স্ত্রী শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করেন তবুও তিনি রাজী হলেন। ওরা খুব গরীব, আমাদেরও ছোটখাটো কাজে এই বই আনা, টেবিল মোছা, এটা ওটা আনা-নেয়ার জন্য লোক লাগে। তাই রাখা হলো।
কিন্তু আমার স্ত্রী একটা কারণে খুব বেশী অবসেসড হয়ে পড়ল। মেয়েটির হাতের নখ। এই নখে কালো কালো ময়লা জমে থাকতো। বারবার নখ কাটার কথা বললেও মেয়েটি শুনতো না!
আমার স্ত্রীও একরোখা। জোর করে নখ কেটে দিতো। এভাবে কয়েকদিন কাটল। হঠাৎ একদিন একই সমস্যা দেখা দিলো। এমনিতে মেয়েটি সব কথা ঠিকঠাক শুনতো, কাজও করতো কিন্তু সে কিছুতেই হাতের নখ কাটবে না।
আমার স্ত্রী মেয়েটির মা কে ডেকে পাঠালো এভাবে অপরিষ্কার থাকলে আমাদের বাসায় একে আর রাখবো না। মেয়েটির মা বুঝিয়ে শুনিয়ে মেয়েটির হাতের নখ নিজে কেটে দিয়ে গেল।
তারপর ঈ ঘটল ঘটনা। আমার স্ত্রী রোজ ঈ স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। যেখানে কেবল সে আর আমাদের কাজের মেয়েটি। মেয়েটি, হাতে নখ দুহাত খামচি দেয়ার ছল করে তাকে দেখাচ্ছে।
আমাকে এটা বলতে ই আমি হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলাম। বললাম, একই জিনিস বারবার ঘুরেফিরে তোমার মাথায় ঘুরছে। আমি ই ওকে ডাক্তারের কাছে নেবো বলে ঠিক করি কিন্তু তার ই আগের দিন ঘটে গেল।
(বলে মুখ ঢেকে টেবিলের উপর মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক, তারপর মুখ তুলে বললেন)
কাজের মেয়েটাকে সকালে মৃত পাওয়া গেল আমাদের ছাদে। গলায় স্পষ্ট হাতের দাগ। কেউ গলাটিপে হত্যা করেছে। সবার ধারণা আমার স্ত্রী। আসলে প্রথমে ও নিজেই দেখতে পায় আর ওর চিৎকার চেঁচামেচি তে আমরা সবাই গিয়ে দেখতে পাই। সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। আমি নিজে ছাদের দরজায় তালা লাগিয়ে এসেছিলাম। চাবিও ড্রয়ারে থাকে সেটাও আমার মাথার কাছে। কেউ নিলে আমি আগে টের পাবো। ও যে চাবি আমার সামনে থেকে নিয়েছে আমি নিজে ই দেখেছি ঘুম থেকে উঠে। আমি শুয়েই ছিলাম। আমার সামনে থেকে চাবি নিয়ে ও ছাদে গেল এক্সারসাইজ করবে বলে। আর তখনি..
স্যার! ১০০৩ এ পেশেন্ট এর অবস্থা ভাল না! জলদি আসেন!
নার্স ডাক দিতে না দিতেই দ্রুত বেড়িয়ে গেলেন ডাক্তার। উপরওয়ালা ভুল করলেও ডাক্তারের ভুল ক্ষমা করে না মানুষ। বাতাসের বেগে ছুটে গেলেন তিনি।

(দুই)

 ডাক্তার ফিরলেন আরো মিনিট বিশ পরে। কপাল ঘেমে জুলফি পর্যন্ত ভিজে গেছে তার। কাঁচাপাকা চুল তার, বয়েস খুব বেশী হবে না। কারণ তার চামড়া তে বার্ধক্যের ছোঁয়া নেই।
বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন তিনি। বললেন, পেশেন্টের অবস্থা খুব একটা ভাল না। ব্লিডিং হচ্ছে। চব্বিশঘন্টা ফলোআপে রাখা হয়েছে।
আপনি কিছু খাবেন তো! (প্রশ্ন না অনুরোধ সেটা ঠিক বোঝা গেল না)
ক্ষিধে ছিল তাই ভদ্রলোক আর না করলেন না।
ডাক্তার তার কম্পাউন্ডার কে পাঠালেন চিজ বার্গার আর কোক আনতে।
আপনার স্ত্রীর কি ঘুম ভেঙেছে?
নাহ!
বেটার। উনার রেস্ট দরকার। মাইন্ড টা অস্থির হয়ে আছে। তারপর? কি হলো? আমি দ্রুত ছুটে গেলাম তো তাই আর শোনা হলো না!
ভদ্রলোক রগড়ে কপাল থেকে ঘাম মুছে নিলেন। এবার তিনি ঘেমে যাচ্ছেন। খুব গরম পড়েছে।
ডাক্তার এসি বাড়িয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক বললেন, " আমি ভাবছিলাম আপনি এসব উদ্ভট গল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।"
না না.. পেশেন্ট দেখা টা তখন জরুরি ছিল, আপনি এখন বলতে পারেন। ডাক্তার টেবিলের গ্লাস উল্টে পানি খেলেন মাঝখানে।
ভদ্রলোক শুরু করলেন আবার,
আমি ভেবেছিলাম আমার স্ত্রী প্রচন্ড শক পেয়েছে তাই হয়ত এমন দূঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ও যখন রেগুলার দেখতে থাকল ঠিক তখনি বুঝলাম এটা মোটেও দূঃস্বপ্ন না!
ও প্রায় রাতে দেখতো মেয়েটি ময়লা নখ ভর্তি হাতে আঁকড়ে ধরার মত এসে আমার স্ত্রীর গলা টিপতে চাইছে।
স্ট্রেঞ্জ! (ডাক্তার বিস্মিত)
তবে মেয়েটির সাথে আমার স্ত্রীর দেখা হতো আমাদের বাড়ির নানা জায়গায়। এই ধরুন, কোনদিন আমাদের ড্রয়িংরুম, কোনোদিন ছাদে, কোনোদিন গেটের বাইরে।
-আপনার স্ত্রী কি?
ভদ্রলোক চমকে গেলেন। বললেন, না না.. একদম ই না। আমার স্ত্রী এই খুন করতে পারে না। আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।
-পুলিশ কি বলছে?
পুলিশ বলছে যে লোকটি গলা টিপেছে তার হাতের আঙুল খুব বড়। এত্ত সহজে এমন আঙুল কারো হয় না। মানুষের অন্তত না! না না! (ভদ্রলোক না- সুলভ মাথা কয়েকবার ডানে-বামে ঝাঁকালেন) পুলিশ আমাদের সবার আঙুলের ছাপ নিয়েছে। সবকিছু সার্চ করেছে। যা ছিল সব। তারপরেও জানেন কিচ্ছু পায় নি। তাই আমাদের কে ওরা দোষারোপ ও করেনি। আমার মনে হয় আধিভৌতিক কিছু হতে পারে।
ডাক্তার বেশ জোরেশোরে হেসে উঠলেন।
আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন। আমি.. (কথা শেষ হলো না)
কম্পাউন্ডার বার্গার, কোক নিয়ে হাজির।
ডাক্তার বললেন, " নিন শুরু করুন।"
ভদ্রলোকের খিদে পেয়েছিল ডাক্তারের সামনে খাবারগুলো যেভাবে খেলেন তাতে গোটা পরিবার কে ই সাইকোসিসে আক্রান্ত মনে হল তার কাছে।
খাবার শেষ করলেন দুজনে বেশ দ্রুত ই।
আপনি কি আরো কিছু বলবেন? ডাক্তারের পেশেন্ট দেখতে হবে তাই তিনি চেয়ার ছেড়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করলেন।
ভদ্রলোক কি একটা বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলেন। বললেন, " না থাক।"
ডাক্তারের তাড়া আছে এখন আর আধিভৌতিক বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।

(তিন)

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশসাহেব এসে অনেকবার টাকা পয়সার জন্য বলে গেছেন। তাদের চারজন কন্সটেবল বাইরে আধাভেজা হয়ে ডিউটিরত। তাদের চা-জলখাবার টা তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেবে তো নাকি?
সরকারি পুলিশ ভাই আমরা, বলতে গেলে চাকর! অর্ডার না মানলে চাকরি থাকবে না। অনেক মানুষ লাইন ধরে আছে পুলিশ হইতে। হাজার পুলিশ মরলেও সরকারের চার পয়সা ক্ষতি নাই। আমরা নাই তো কি! পুলিশ থাকবে।
হাসপাতাল টা বেসরকারি। পুলিশ পাহারা আছে গতরাত থেকে। ঐ মহিলা ভর্তি হবার পর তার বিরুদ্ধ্বে যারা ছিল তারা এখনো বাইরে পলিথিন মোড়া হয়ে বসে আছে। সেখানে আছে নিহত মেয়েটির মা, সঙ্গে আরো বস্তিবাসী।
ডাক্তার একা হাসপাতাল সামলাচ্ছেন। হাসপাতালের মালিক এর মাঝে গেছেন আরব আমিরাত। সেখানেও তার নাকি বিজনেস আছে।
সিনিয়র হিসেবে হাসপাতালের দ্বায়িত্ব এখন কেবল তার। কয়েকবার ফোনে মালিক কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে জানা গেলো এবারে নাকি তিনি আগের হোটেলে উঠেন নি। তাছাড়া রোমিং সুবিধা তিনি নেন না। তাই ব্যক্তিগত ফোন এখন অচল। তবে তার শ্যালক এসেছেন একটু আগে। ফিনান্সিয়াল কিছু ঝামেলা এখন মালিকের পক্ষে তিনি ই মেটাবেন।
ডাক্তার এবার একটু যা স্বস্তি পেলেন। চেম্বারে এসে হেলান দিয়ে পড়ে গেলেন নিজের চেয়ারে। এমন ক্লান্তির পরেও লোকে ডাক্তারের নামে যা তা বলে বেড়ায়। ডাক্তারি তো আর মাঠে বসে ঘাস কাটা নয়!
এর মাঝে আবার হট্টগোল শোনা গেল বাইরে। বিক্ষুব্ধ হয়ে আবার হামলা করেছে সেই বস্তিবাসী। তারা মহিলার দৃষ্টান্তমূলক সাজা চায়। কম্পাউন্ডার এসে ডাক্তার কে নিয়ে গেলেন আবার।
মালিকের শ্যালক এবং ডাক্তার রোগীর কথা খুলে বুঝিয়ে বললেন। ভিড় থেকে মেয়েটির মা এগিয়ে এলো, বলল, " আব্বাজান, আমার মেয়েরে ওরা মারছে, আমি এই খুনের বিচার চাই!" আবার বিক্ষুব্ধ হলো সবাই।
শ্যালক এবার পুলিশ কে অনুরোধ করল, " দ্যাখেন। মালসামাল তো শ্যাষ কইরা দিব। টাকা পয়সা যা নিবেন লন, মাগার হাসপাতাল বাঁচান! "
পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করল। বিক্ষুব্ধ জনতা মনে হয় বেড়ে গেল আরো। পুলিশ কয়েকজন কে গ্রেফতার করতে ই আবার পরিস্থিতি শান্ত হলো কিছূটা।

(চার)

ডাক্তার আর মালিকের শ্যালক তর্কাতর্কি করছে মিনিট দশ। প্রথমে আস্তে শোনা গেলেও এবার জোরে শোনা গেল কথোপকথন। শ্যালক চাইছে টিয়ার শেল দিয়ে তাড়ানো হোক। ডাক্তার বলছে একটা মীমাংসা করা হোক।
এদের মাঝে এসে গেলেন সেই ভদ্রলোক।
তাকে দেখে শ্যালক আরো উত্তেজিত, আপনে কেঠা?
আমি পেশেন্টের স্বামী।
শোনেন, ক্যাচাল বহুত হইছে। আমরা আপনারে এহনি এম্বুলেন্স দিতাছি ওইটা অন্য হাসপাতালে লইয়া যাইব। ট্রিটমেন্ট হ্যানে করবেন। আমার হাসপাতাল তো সামনে থিকা খাইয়া দিসে মাইনষে!
বলে উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নেড়ে রুমের বাইরে চলে গেল সে।
ডাক্তার অসহায়, তবুও ভদ্রলোকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, " আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি দেখছি কি করা যায়। "
পুলিশ এসে হাজার দুইয়ের উপর ক্যাশ নিয়ে গেছে। সাথে চা নাস্তা চলছে। বাইরে থেকে কেবল নিহত মেয়েটির মা কে এনে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করার কথা ভাবছেন ডাক্তার। মালিকের শ্যালক এতে রাজী না।
ভদ্রলোক রাজী যদিও তবে মহিলাকে আনা টা ঝামেলার কাজ আবার যদি এরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। হাসপাতালের সামনের দিকে যা ছিল তা ভেঙেচুড়ে একাকার।
পুলিশ কে এনে আলোচনার ব্যাপার টা খুলে বলা হলো। সব শুনে সে বলল, " তা তো বুঝলাম ভাই! আমার ভাগ টা! "
মহিলা কে আনা হলো। তিনি একটা চেয়ারে বসলেন। পাশের চেয়ারে পুলিশ, ঠিক তার পাশে মালিকের শ্যালক। ডাক্তার এবং ভদ্রলোক বসলেন কাছাকাছি আর মহিলার হাতের নাগাল থেকে দূরে।
মহিলা বললেন, " তার উয়াইফ আমার মাইয়ারে মারছে গলা টিপা!"
ভদ্রলোক না-সূচক মাথা নাড়লেন।
মহিলা রেগেমেগে একবার মারমুখী হলেন। তাকে পুলিশ থামাল।
ডাক্তার বললেন, " আপনার মেয়ে মারা গেছে আমরা সবাই সে শোক টা বুঝি কিন্তু আপনি কি চান উনার স্ত্রী যিনি মৃত্যুমুখে পড়ে আছেন তাকে ও মেরে ফেলতে?"
মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, "হ চাই!"
ভদ্রলোক হাতজোড় করে বললেন, "বোন আমাদের কেউ ই তোমার মেয়েকে খুন করে নাই" তার গলায় যথেষ্ট আকুতি।
মহিলা মুখে আচঁল চেপে ঢুঁকরে কেঁদে উঠলেন। আমার ময়না রে! ও মা!...
মহিলা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
ডাক্তার তার পালস দেখে দ্রুত একটা বেডে পাঠালেন। পুলিশ বলল, " কাম সারা! বাইরে যদি কেউ জানে যে মহিলা ভিত্রে অজ্ঞান হয়ে গেছে তাইলে তো হাসপাতাল ভাইঙ্গা গুড়া করে দিবে"
শ্যালক চেঁচিয়ে বলল, "শালা! আমার ভাগ কই? এই কথা কওনের সোম মাথায় এইটা আছিল না? এহন জলদি সামাল দে নাইলে তোর চাকরি খাইছি আইজকা"
"শোনেন ভাই! গালি দিবেন না কইতাছি। আমরা এইখানে না থাকলে কি হইতে পারে আগে বুইঝা লন।" পুলিশ হুঙ্কার দিল।
ডাক্তার এসে দুপক্ষকে শান্ত করলেন।

(পাঁচ)

বৃষ্টি থেমেছে। ইলশেগুঁড়ি চলছে। দুই মহিলার ই জ্ঞান ফিরেছে। একজন চা খাচ্ছেন আরেকজন হালকা পাতলা কথা বলছেন।
ডাক্তার তার চেম্বারে মাথা টেবিলে ঠেকিয়ে আধশোয়া। তার জীবনে এই ঘটনা প্রথম নয়। ডাক্তারি জীবনের শুরুতে এমন একবার ঘটেছিল। তখন তিনি ছিলেন শিক্ষানবিশ। তার সময়ে তিনি এমন বিপদে পড়তে দেখেছিলেন তার স্যার কে। তিনি যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার মানুষ। সবকিছু স্যার একা সামলেছিলেন। তার ছাত্র হয়ে আজকে ডাক্তার নিজে কি শিখলেন!
কম্পাউন্ডার রুমে এলো, " স্যার! আপনের কফি"
শোন! ঐ ৩৯ নম্বর বেডের ভদ্রলোক কে ডেকে পাঠাও আমার রুমে। কফি নেড়েচেড়ে তাতে চুমুক দিলেন ছোট করে। ডাক্তার একাকী। তাই হাসপাতাল টা তার পরিবারের মত। এখানে কোন ভুল হোক তা তিনি চান না।
ভদ্রলোক এলেন।
তার চোখমুখ দেখে বোঝা গেল তিনি কিছুটা গোলমেলে হয়ে আছেন।
আপনার আদিভৌতিক গল্পটা শুনতে ডেকেছি। কোথায় যেন ছিলেন? ও হ্যাঁ!
তেমন কিছু শুরু করেন নি। কিন্ত..
সত্যি জানেন, চেয়ার টেনে ভদ্রলোক বসে ই বলতে শুরু করলেন। স্বপ্নটা আমিও দেখতে শুরু করলাম।
ডাক্তার এবার নড়েচড়ে বসলেন। অদ্ভুত!
প্রথমে ভেবেছিলাম আমার স্ত্রী যা বলছে আমিও তাই স্বপ্নে দেখছি। পরে বুঝলাম নাহ! দুটো আলাদা কিছু।
ডাক্তার বললেন, " আপনি কি দেখতেন?"
আমি দেখতাম মেয়েটি আমার কাছে আসছে, আমার কাছে এসে হাসছে। বলছে এই দ্যাখো আমার নখ নেই! কেটে ফেলেছি।
ডাক্তার কফিতে চুমুক দিয়ে মনে মনে বললেন, " গোটা পাগলের পরিবার "।
নাহ! পাগল নই।
ডাক্তার চমকে গেলেন; তার হাত থেকে কফির মগ জোরে শব্দ করে পড়ে ভেঙে গেল। এটা তো আমি আপনাকে মুখে বলিনি! আপনি জানলেন কি করে?
ও বলেছে! (ভদ্রলোকের মুখে মিটিমিটি হাসি) ক্রুর হেসে ভদ্রলোক তার হাত দেখালেন ডাক্তার কে। তার নখ ময়লা।
পুলিশ! পুলিশ! নার্স! কম্পাউন্ডার! না আ আর্স..

(ছয়)

শ্যালক এদিকে খুন হওয়া মেয়েটির মায়ের সাথে বোঝাপড়া করে ফেলেছে। দুই লাখ টাকা পেলে সে এখন আর মামলা করবে না। মিউচুয়াল ভাবে কেস মিটিয়ে নেবে। ক্যাশ আপাতত না থাকলে সমস্যা নেই। শ্যালক আপাতত নিজে টাকা ম্যানেজ করে দেবে। পরে টাকা তারা ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করে টাকা পরিশোধ করে দেব।
তাই হলো। মহিলা টাকা নিলেন। বললেন, " আমার মাইয়ার দাম দুই লাখ! গরীব দেইখা দাম হইল দুই লাখ তয় আমার মাইয়া আমার কাছে কোটি টাকার বেশী আছিল"
হাসপাতাল শান্ত হয়ে গেলো।
ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী অন্য হাসপাতালে চলে গেলেন।
ডাক্তার তখনো অজ্ঞান। তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। মালিকের শ্যালকের হাসিমুখ, সব ভাল ভালয় মিটা গ্যাছে। দুলাভাই রে কয়া এওবার একটা ২০০ সিসি বাইকে লমু গিফট হিসাবে। হাসপাতালের বাইরে গাড়িতে উঠে সে সিগারেট ধরালো। পুলিশ ভ্যান চলে গেছে। তাদের নাস্তায় দেয়া পাউরুটির কিছু অংশ, কলার খোসা, চায়ের কাপ পড়ে আছে করিডোরে।
ডাক্তার তখনো অজ্ঞান। কেউ তাকে নখ দেখাচ্ছে স্বপ্নে। এই যে!  এই যে! দ্যাখো আমার নখে কত্ত ময়লা।

(সমাপ্ত)

(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত, কিংবা অর্ধমৃত কারো মিল নেই। মিল থাকলে তা একান্ত কাকতালীয়)

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮

গল্পঃ এনকাউন্টার



গলায় পাশে চাকু টা চকচক করছে। যে ধরে আছে চাকু, আবছা আধাঁরে তার বয়েস আন্দাজ সতেরো থেকে পঁচিশ!
বাড়ির কাছাকাছি এসে এমন একটা পরিস্থিতি তে পড়তে হবে মোহাইমেন সাহেব কল্পনাও করতে পারেন নি। কিন্তু এখন তাকে তো বাঁচতে হবে!
নীচু গলায় দাবী করে যাচ্ছে ছেলেটি, " জলদি বের করেন যা আছে! না হলে গলায় চালিয়ে দেবো! "
আবছা আধাঁরে কেউ কাউকে স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছে না। হাতের স্মার্ট ওয়াচ, স্মার্টফোন খুব দ্রুত বের করে দিতে হলো।
ছেলেটা এই দুটো জিনিস হাতে পেয়েও প্রায় কোবরা সাপের মত ফুঁসে উঠল!
মানিব্যাগ? মানিব্যাগ টা আগে বের কর!
মোহাইমেন মানিব্যাগ ধীরেধীরে বের করে দিলেন।
পাশ দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে এক যুবক এর মাঝে দুজন কে ক্রস করছিল।  তাদের দুজনের মুখোমুখি হয়ে একটু থেমে সে আবার আগের চেয়ে দ্রুত পা ফেলে বিপরীত দিকে চলে গেল। বলা ভাল, বিপদে দেখে সরে পড়ল।
মোহাইমেনের মানিব্যাগে পনের হাজার টাকা নগদ ছিল। আজকে উঠিয়েছিলেন। আগামীকাল শুক্রবার।
বাড়ির জন্য বাজার করতে হবে তাকে। তাই ফেরা পথে বুথ থেকে টাকা উঠিয়ে এনেছেন তিনি।
ঐ ব্যাটা! আর টাকা নাই! গলায় আগ্রাসী ভাব ছেলেটার।
না বাবা! আর নাই!
" চুপ শালা! আমি তোর বাবা না! বেশী কথা বলবি না। আমি এইখানে দাঁড়াইসি। তুই সোজা যাবি গা! এর মাঝে যদি পেছনে লোকজন আনিস তোর ভুঁড়ি কোরবানির গরুর মত করে দিমু!"
আচ্ছা! আসব না। ভয়ে ভয়ে দ্রুত পা ফেলেন মোহাইমেন। টাকা গেছে যাক, শারীরিকভাবে তো আক্রমণ করে নি এই কপাল!
কয়েক গজ এগিয়ে যেতে না যেতে টহল পুলিশের একটা গাড়ি একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল তার।
বিধ্বস্ত মোহাইমেন কে দেখে একজন অফিসার গাড়ী থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, " কি হয়েছে?"
মোহাইমেন কান্নাজড়িত গলায় বললেন, হাইজ্যাকার!
সাথে সাথে দুজন গাড়ি থেকে ঝটপট নেমে এলেন। অফিসারের সাথে আরেকজন কে ওয়াকিটকি তে কথা বলতে দেখা গেল।
আনুমানিক চেহারার বিবরণ দিতে না দিতে আরো সাইরেন শোনা গেল কাছাকাছি দূরত্বে। র‍্যাবের একটা টহল দল পাশের ফেলে আসা গলিতে ঢুকে যেতে না যেতে সেখানে গুলির শব্দ। ধুমম! সাইরেন বাজছে তখনো!
মোহাইমেনের বাড়ির ঠিকানা পুলিশের অফিসার ঠুকে নিলেন নোটবুকে। র‍্যাবের টহলদারি দল টির ক্যাপ্টেন ফিরে এসেছেন।
সদর্পে বললেন, হাইজ্যাকার এনকাউন্টারে ডেড! সাথে মোহাইমেন সাহেবের মানিব্যাগ, ঘড়ি এবং ফোন তিনটি ই উদ্ধার হয়েছে।
তবে এসব বুঝে পেতে কাল তাকে থানায় একবার যেতে হবে।
র‍্যাবের ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলেন, মোহাইমেন শারীরিকভাবে ঠিক আছেন কিনা? তাদের গাড়ি প্রয়োজনে বাড়ি পৌঁছে দেবে। ভয় পাবার কোন কারণ নেই।
বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতে সাইরেনের শব্দে বাড়ির আশেপাশে জানালা, দরজা প্রায় সবখানে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছেন। এত রাতে একজন ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে যদি পুলিশ আসে তা হলে সেটা উঁকিঝুঁকি না দিয়ে থেকে পারা যায়?
পুলিশের ধমকে প্রতিবেশী সবাই যে যার মত ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।
মোহাইমেন সাহেবের ছেলেমেয়ে বাইরে আতংকিত চোখে পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা শুনে নিল। তাদের কে কাল থানায় গিয়ে জিনিশপত্র গুলো আনতে বলে তারা চলে গেল।
পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে এল।
কিন্তু কান্নার রোল পড়ল তার পরের দিন সকালে।
মোহাইমেন সাহেবের বাড়ি থেকে দূরে তার ই প্রতিবেশী সালাম উদ্দিনের বাড়ি থেকে। তার ছেলে গতকাল রাতে র‍্যাবের এনকাউন্টারে মারা গেছে।



(গল্পের প্রতিটি চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত কিংবা অর্ধমৃত কারো সাথে কোন মিল নেই। যদি মিলে থাকে তা একান্ত কাকতালীয়)

গল্পঃ ক্রান্তি



ভাই! কথা শোনেন। ব্যাপারটা...
(কথা শেষ করতে দিল না আকবর, অভিযোগ করছিল তার ই সাগরেদ সেন্টু। যাকে সবাই ব্লেড সেন্টু নামে সবাই চেনে)
তোর সমস্যা মানে আমারো সমস্যা, চল আইজকা সলুশন নিমূ! পাপাই আর বোতল রে কল মার। অপারেশন আইজকা সন্ধ্যায়।
সেন্টুর হলদে দাঁতে শিকারি শেয়ালের মত উজ্জ্বলতা দেখা যায়। মোহাম্মদপুরের কাছাকাছি একটা গলিতে ওরা চারজন ওত পেতে থাকে।
ল্যাম্পপোস্ট টা নষ্ট, একদিক থেকে দেখলে ধরা যায় রাস্তার বিপরীত দিকে একটা মিটমিটে হলদে আলো জ্বলছে। সচরাচর রাস্তাটা ফাঁকা থাকে না। আজকে কেন জানি কবরের নিস্তব্ধতা!
একটা রিক্সার খড়খড়ে আওয়াজ পেয়ে অন্ধকারে শিশ দিয়ে উঠে। পাপাই আর বোতল গান গায়। হিন্দী গান.. মারাত্বক বেসুরে।
ওদের ধমকে উঠে যাযাবর। সিগারেটের ফিল্টার টা সোজা ছুঁড়ে দেয় রিক্সার সামনের চাকার খুব কাছে।
রিক্সাওয়ালা একটু শব্দ করতে না করতে ই নাক বরাবর ঘুষি বাগিয়ে বসে পাপাই।
" চোপ শালারপুত!  বেশী কথা কইলে কাইটা দিমু "
রিক্সাওয়ালার নাক বেয়ে কাল তরলের ধারা বেয়ে যায়। নাক ধরে সে রাস্তাতে বসে পড়ে। পাপাই আরো কয়েকটা কড়া লাথি মারে রিক্সাওয়ালার পেট বরাবর। সে কুঁকড়ে উঠে সরে যায় রাস্তার একপাশে।
যাযাবর আড়ালে সাগরেদের কুকর্ম দেখে যাচ্ছে নিশ্চুপ!
সেন্টু ধূর্ত শেয়ালের মত মেয়েটির গায়ে হাত দিতে ই চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠে।
যাযাবরের গলা শুকিয়ে যায়, মোনালিসা! তুই?
মেয়েটি যাযাবরের গলা চিনতে পেরেছে। সেন্টুর তখন ও হুশ নেই।
যাযাবর এগিয়ে আসে, গলা বাষ্পরুদ্ধ!
কিন্তু কিছু বোঝার আগে ই কেউ একজন আঁতকা রডের আঘাতে ধরাশায়ী করে ফেলে যাযাবর কে। পাপাই কে ততক্ষণে পালাতে দেখা গেল।
সেন্টুর মুখের উপর এলোপাথাড়ি আঘাত চলছে। সেও লুটিয়ে পড়েছে প্রায় রিক্সার নীচে। এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল রিক্সাওয়ালা, হাতে লোহার রড। রাস্তার পাশে কন্সট্রাকশনের কাজে রাখা ছিল রড।
কাঁপা গলায় বলল, "আপামনি আপনার ভয় নাই, আমি আছি।"
রিক্সাওয়ালা রিক্সায় উঠে প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে কয়েকবার তার নাক মুছল। রক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে। মেয়েটি চুপচাপ।
রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, " এগো চিনতেন আফামনি?"
শান্ত গলায় মেয়েটির উত্তর, " আপনি যার মাথায় পেছন থেকে সবার আগে আঘাত করলেন, সে আমার ভাই!"।
রিক্সাওয়ালা প্যাডেল কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল।
মেয়েটি তখনও নির্বিকার।
রিক্সা আবার চলতে শুরু করল মেয়েটির গন্তব্য।




(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র পুরোপুরি কাল্পনিক যা জীবিত কিংবা মৃত কারো সাথে মিলে গেলে একান্ত কাকতালীয়)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...