বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

গল্পঃ বাবাজীর পাল্লায়


(এক)
যখন আমি নিরুদ্দেশ হতে চাই, ঠিক তখনি আমার ফোন বন্ধ করে রাখি। এতে দুটো সুবিধে হয়। এক. অকারণে কোন ফোন এটেন্ড করতে হয় না এবং দুই. উটকো আবদার আসে না।
অনেকদিন থেকে ই ভাবছিলাম কোথায় যাবো! সত্যি বলতে গ্রামে যেতে আমার বড্ড মন টানে। গ্রামের ছেলে আমি, আজ ঠিক এখন হয়ত আর বয়েসের বেড়াজালে ছেলে বয়েসে আটকে নই তবুও মনের ছেলেমি টা এখনো কাটেনি। জোর করেই সেটা প্রকাশ পায় যখন একটু সময় পেলে বিকেলে বেড়িবাঁধের দিকটায় যাই।
আসলে ঢাকায় চলাফেরা, আসাযাওয়া বলতে কেবল হাতিলঝিল আর ঐ বেড়িবাঁধ। এর বাইরে খুব যেতে ইচ্ছে হয় এমন জায়গা নেই। তাই গ্রামের পথে আমার হুটহাট বেড়িয়ে পড়া। অবশ্য এমন ভাবার কারণ নেই যে, একেবারে অচেনা জায়গায় না জেনে রওনা করি। আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরি ভালো, সে বয়েসে ছোট কিংবা বড়!
তাদের চেনাপরিচিত গ্রাম, শহর, বাড়ি, লোকজন এসব না জেনে আমি কিন্তু বেড়িয়ে পড়ি না।  বড্ড বাজে বকি আমি!
আজ যাচ্ছি সৈয়দপুর।
আমার চেনা নয়। আমার পরিচিত এক লেখকের শশুরবাড়ি। আমাকে রেকমেন্ড করতে চাইছিলেন তার শশুরবাড়ি থাকতে কিন্তু আমি ই রাজী হলাম না। ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি হলে ভাবা যেত, একে তিনি ই সে বাড়ির জামাই তারপরে আমার যাওয়া টা খুব ভাল দেখাতো না। তবে ভদ্রলোকের শ্যালক জাহাঙ্গীর আমাকে সেখানে সাহায্য করতে রাজী, এমনকি সৈয়দপুরের কয়েকটা গ্রামে ঘুরে বেড়াতে সে তার নিজস্ব বাইকে আমাকে নিয়েও যাবে। আমার এতে ই ষোলআনা পূর্ণ।
ঢাকায় আজ ৩৯ ডিগ্রী, বাতাসের আর্দ্রতা এত্ত বেশী যে শরীরের গেঞ্জি থেকে পাঞ্জাবি ভিজে সপসপ করছে। ডান পকেটে থেকে রুমাল টা বের করে কপাল, ঘাড় মুছে নিলাম। বোতল খুলে পানি খেলাম ঢকঢক করে।
আহ! এই গরমে বেঁচে থাকা অসহ্য।
ট্রেন এখনো ছাড়েনি। লোক উঠছে। আমার পাশে এদিকওদিক লোকের গলার আওয়াজে গমগম করছে।
বাইরে হকারের চিৎকার, চা গ্রম লাগবো চা? ফানি.. ফানি.ফানির বোতল! ১০ ট্যাকা ১০ ট্যাকা!
আমি হকারকে ডেকে এক প্যাক সিগারেট নিলাম, সাথে একটা মশলার কৌটো। এই পান মশলা খাওয়া টা আজকাল বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারপর জানালা বরাবর হেলান দিয়ে পত্রিকা মুখের সামনে তুলে সেটায় মনোযোগী হলাম।
লোকজন ট্রেনে উঠবার সাথে সাথে গরম টাও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।


(দুই)

ট্রেন ছাড়ল আরো আধাঘণ্টা পর। ঘেমে যাওয়া শরীর চামড়ার টান ধরিয়ে শুকিয়ে যেতে লাগল জানলা দিয়ে আসা বাতাসে। পত্রিকা ব্যাগে পুরে বোতল বের করে পানি খাবো ঠিক তখনি চোখ গেল পাশের সিটে।
রে ব্বাব্বা!
এমন আওয়াজ আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে পড়ার কারণ যথেষ্ট আছে। মাথায় পাগড়ী, চুলে জটা, পরণে লাল কাপড়। সাধুর সাথে ট্রাভেল? হাহা..
মৃদ্যু হাসি দিতে না দিতেই পাগলের সাথে আমার চোখাচোখি। চোখ ভালোরকম লাল, ভাবলাম কড়া গঞ্জিকা সেবনের ফল। আমি মুচকি হাসছিলাম।
হঠাৎ দেখলাম,
লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বড়বড় করে। তাকে দেখে যে আমি হেসেছি এটা মনে হয় সে বুঝে গেছে। তর্জনী আমার দিকে সোজা কোরে তুলে কয়েকবার এদিকওদিক নাড়িয়ে বোঝাল আমি যাতে না হাসি। অবশ্য আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে উপর-নিচে, ডানে-বামে তাকিয়ে দেখলাম আমার এই কামরায় কেবল আমরা দুজন! আর তর্জনী আমাকে ই দেখানো হয়েছে।
আমি স্বাভাবিক ভাবে বসে আগের মত পড়ে রইলাম। একবার ভাবলাম, "চোর-টোর না তো?, এমনভাবে ট্রেনে ডাকাত ও হতে পারে। পরে নিজেই মনে মনে হাসলাম আমারো তেলেসমাতি ভাবনা। " আমি পড়ে রইলাম আমার মত। কোথাকার কোন পাগল এসে জুটেছে আমার সহযাত্রী হয়ে।

(তিন)

ট্রেন টা ধাতব ক্যাঁচক্যাঁচে শব্দে থেমেছে কোন স্টেশনে। আমি চমকে উঠেছিলাম তবে কনুই দিয়ে আবার চোখ ঢেকে ফের শুয়ে যাচ্ছি, চমকে গেলাম হইহই শব্দে। অনেক লোকের হট্টগোলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনি শব্দ হলো। আমার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ই ছিল পাশের সিটে চোখ রাখা। সেটাই করলাম ভাবলাম পাগল আবার ডাকাতি করে পালালো নাকি?
আমার অমন চাহনি দেখে পাগল ভ্রু কুঁচকে চাইল আমার দিকে। সে এখন জোড়াসনে বসে। মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। দেখে মনে হয় ধ্যানে বসেছে। পাগলের সাথে অস্ত্র? এবার মনে সন্দেহ জাগল।
পাগল এই প্রথম মুচকি হাসল আমার দিকে চেয়ে। আমি কামরা থেকে বেড়িয়ে পড়ব ভাবছি ঠিক তখনি কামরার দরজা ঠেলে একপাল লোক ঢুকল। কেউ করজোড়ে, কেউ কাঁদোকাঁদো গলায় " বাবা.. বাবা.. " বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমিও এই আদিখ্যেতা দেখে বলিহারি যাই! বাবারে?  কোন জন্মের বাবা এ তোদের? আসল বাবাও (জন্মদাতা) এমন ভালবাসা পায় কিনা সন্দেহ! (কথাটা অবশ্য মনে মনে, এই কথা মুখে বলে পিঠের ছালচামড়া আলাদা করার সময় এখন না)
তবে একটা কথা!
আমিও কিন্তু বাবা ভক্ত তবে এমন অন্ধভক্ত নই। একসময় যখন আমার লেখা কোন কাগজে ছাপানো হতো না, তখন আমার এক সমবয়সী বন্ধুর অনুরোধে গিয়েছিলাম এক বাবার কাছে। সেও প্রায় একইধরনের ছিল। আমার হাতে একটা বাতাসা ধরিয়ে বলেছিলেন " নে খা "। হাত খুলে দেখি সেটা পিঁপড়ে খাওয়া এক বাতাসা, কিছুটা হলদে হয়ে গেছে। নির্ঘাত ফুড পয়জনিং হয়ে যাবে খেলে!
তবুও বন্ধু আর আধ্যাত্মিক বাবার ভয়ে মুখে পুড়েছিলাম। এখন সেটা অতীত।
আমার নাম রীতিমত কাগুজে পাড়ায় ভাল লেখক পদবীসহ জুটে যায় তার ই দিন পনেরো পর। তবে এরপর আর সে বাবার কাছে যাইনি। আজকালকার বাবাদের যে কেচ্ছা কাহিনী দেখি টিভি আর পত্রিকায় তাতে বাবাজী সমাজের প্রতি আর শ্রদ্ধা থাকে না বলা চলে। বিশেষত, সত্যজিৎ রায়ের " মহাপুরুষ " টা দেখলে বুজরুকি টা কিছুটা ধরা যায়। আমরাও এমনি। তাবৎ কোন কাজ নিজে করতে না পারলে বাবার কাছে যাই, পায়ে পড়ি। যদি কোনভাবে দৈববলে কাজ হয়ে যায় তাহলে তো বাবাজীর কেল্লাফতে! ভক্তের আদরে ফুলো বেলুন। যাই হোক, আমি কিন্তু নাস্তিক নই। ধর্মে বিশ্বাস আছে। তবে বাবাজীদের ব্যাপার টা বরঞ্চ আলাদা।
লোকের ভীড় কমেছে এতক্ষণে। ট্রেন ছাড়ার শব্দে লোক নেমে গেছে। যে দুই একজন আছে এরাও ঝটপট বাবাজীর পায়ের ধূলো নিয়ে দ্রুত নেমে গেল। কয়েকজন যারা নামছিল না তাদের টিকিটচেকার ঘেঁটি ধরে নামিয়ে দিল। এরা কিভাবে যেন জানতে পেয়েছে এই মহান বাবা এই ট্রেনে ই যাচ্ছে তখনি দেখা করার সুযোগ না পেয়ে তখন হইচই বাঁধিয়েছিল। ট্রেন এখন শান্ত। তবে খেয়াল করলাম, ট্রেনের বাবাজীর পা চকচকে পরিস্কার। বুঝলাম, সব ধূলো ভক্তরা সাথে নিয়ে স্টেশনে নেম গেছে।

(চার)
আমাদের ট্রেন টা ভালো ই ছুটেছে মৃদ্যুমন্দ গতিতে। কতক্ষণ আর শুয়ে কাটানো যায়। লম্বা ভ্রমণে এই একটা সমস্যা। বিলেতে বুলেট ট্রেনের কথা মনে পড়ল। আহা! কত সময় ই বা লাগত! কবে হবে বুলেট ট্রেন ভাবতে ভাবতে সিগারেট জ্বালাচ্ছি। তখনি বাবাজী পাগলা বেঁকে বসল, তাও রীতিমত তুই তোকারি করে।
" বিড়ি জ্বালাবি না "
আমিও তখন রেগে, মামাবাড়ির আবদার নাকি?
পাগল আমার দিকে আবার তর্জনী দেখিয়ে হিন্দী মুভির ভিলেন চেহারায়।
আমিও তেড়েফুঁড়ে গেছি!
কামরায় ঢুঁকল টিকিটচেকার। আমি চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে লাগলাম। চেকার আমার টিকিট চেক করল। তারপর পাগলের দিকে ফিরে ফিরে তার টিকিটখানাও দেখে চলে গেল। চেকিং করতে করতে আমার বিড়ি খাওয়া প্রায় শেষ। ফিল্টার ফেলে বোতল থেকে পানি খেয়ে ফের পত্রিকা হাতে নিলাম, আর আড়চোখে পাগলের দিকে দেখতে লাগলাম।
পাগল দুধ-মুড়ি খাচ্ছে, পাঁকা আম দিয়ে। কয়েকটা মুড়ি আবার আটকে গেছে তার মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফে।

(পাঁচ)
আমার ফোন বন্ধ। কি মনে হতেই সেটা অন করে বসলাম। দু-চারটে মেসেজ এসেছে।
বন্ধু তুই কই?
কয়েকটা মিসড কল এলার্ট। কলের সংখ্যা কম নয়। ত্রিশের বেশী। মেসেজ ও কম সে কম বিশ টা।
তবে সবকয়টা তে একই কথা। তুই কোন ট্রেনে?  কোথায় দাদা? সুস্থ আছিস?
ফোন বন্ধ কেন করিস?
আমার বন্ধু, প্রেস অফিসের কলিগ, কর্মচারী সবাই বেশ আতঙ্কিত!
পাগল এখন হাসছে। এই প্রথম পাগলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এক পা সিটের নীচে, আরেক পা হাঁটু ভাজ করে কোলের কাছে। দুহাতে তালি দিচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পাগলের গলায় থাকা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতের আংটি সবকিছুতে আমি কেমন যেন ঝঙ্কার ধ্বনি পাচ্ছি। তবে হাসি থামিয়ে সে যা বলল তাতে আমি আরো অবাক হলাম।
" যাবি, যাবি আমার সাথে?"
আমি আরো অবাক, একদিকে এইসব মেসেজের মানে তখনো মাথায় ঢুকছে না তারপরে আবার পাগলের পাগলামি!
সহ্য হল না। কড়া গলায় বললাম, " কই যাবো রে পাগলু?"
পাগল মনে হয় এতে খুশী হলো না। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, " থেকে যাবি ট্রেনে? তাহলে থাক! আমি নেমে যাচ্ছি। "
আমি আরো অবাক, ঘন্টায় প্রায় ৮০ কিঃমিঃ গতিতে ছুটছে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক্সপ্রেস ট্রেন। এখান থেকে পাগল কি এখন লাফ দেবে?
ফোন টা হাতে বেজে উঠল। পাগল তার ঝোলা, জিনিসপত্র গোটাচ্ছে। সম্ভবত পাগল সত্যি সত্যি ট্রেন থেকে নেমে যাবে।
আমি ফোন রিসিভ করলাম। আমার পরিচিত সেই লেখক ফোনের অন্যপাশে।
দাদা! আপনি কোথায়?
আমি তো..! (পাগল তার নিজের তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে আমাকে কথা না বলার নির্দেশ দিল) তাই আমি কোথায় আর বলা হলো না।
অন্যপ্রান্তে সে ভদ্রলোক বললেন, কপাল ভাল!  আপনি বেঁচে আছেন। আপনার সে ট্রেন টা তো দুপুরে এক্সিডেন্ট করেছে। শ' এর উপরে লোক আহত। নিহত কতজন এখনো জানা যায় নি।
আমি পরে ফোন করছি বলে ফোন কাটলাম। নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। ট্রেনও চলছে। তাহলে কোনটা সত্যি? ফোন কল টাও তো ভুল না। দিব্যি কথা বলছি। সব বাস্তব, তাহলে হচ্ছে টা কি!
পাগল এবার কথা বললেন, " নেমে যাবি আমার সাথে, তাহলে বেঁচে যাবি "
ঘোরে ছিলাম।
হ্যাঁ বলতে না বলতে পাগল আমার হাত ধরল। হাত টা ভীষণ শক্তিশালী। এমন হাত ব্যায়ামবীরের ও হয়না মনে হয়।
এরপর কেবল বুঝলাম আমরা ট্রেনের বাইরে যাচ্ছি। শরীরটা বাতাসের মত হালকা হয়ে গেছে। ঠিক যেন, আমি সুতো কাঁটা ঘুড়ি।

(ছয়)
জ্ঞান ফিরতে বুঝলাম। আমি হাসপাতালে। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কপালে পট্টি, গালে ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। এদিকে ওষুধপত্র, আর ভারী গন্ধ নাকে আসছে। পাশের কেবিনে থাকা একজন নার্স আমার বেডের দিকে এসে আমার পালস চেক করলেন।
চোখের সামনে আঙুল ধরে বললেন, " শুনতে পাচ্ছেন? দেখতে পাচ্ছেন?"
আমি শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
নার্স বাইরে সবাইকে ডাকলেন। আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করুন তবে কেউ হট্টগোল করবেন না।
দেখলাম, আমার চেনাজানা সবাই এসেছে। সবাই বেশ চিন্তিত। তবে আমার জ্ঞান ফেরা দেখে প্রথম ই কথা বললেন আমার পরিচিত সেই লেখক।
সরি! আপনি এভাবে ট্রেন এক্সিডেন্ট করবেন জানলে আপনাকে আমার গাড়ি করে ই পাঠাতাম।
ট্রেন এক্সিডেন্ট!  আমি বিষ্মিত তবে মনে আছে আমি আর পাগল সেই ট্রেন থেকে আগেই বেড়িয়ে পড়ি। তাহলে সেই পাগল? (কাউকে পাগলের কথা বললাম না এতে আমাকে এরা কি ভেবে বসে, হয়ত মাথায় বিকৃতি হয়েছে এমন ভাবতে পারে)
দিন দুয়েক পর সুস্থ হতেই পত্রিকা হাতে নিতে পারলাম। আমি তখনো হাসপাতালে। বেডে শুয়ে ফলমূল খাচ্ছি। তবে পত্রিকা খুঁজে কোন পাগল ট্রেন দূর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহত হবার খবর পেলাম না। আমিও এটা অবাস্তব ভেবে ভুলে গেলাম। তবে সৈয়দপুর যাবার লোভ কাটেনি। সুস্থ হবার মাস দুয়েক পর আবার সৈয়দপুর যাবো বলে ঠিক করলাম। তবে এবার ভাড়াটে প্রাইভেটকারে।

(সাত)

আমি এবার একা যাচ্ছি না। সাথে আমার লেখক বন্ধু ও তার পরিবারবর্গ ও সাথে। সবাই মিলে ছয়জন। চাপাচাপি করে ই চলছিলাম। মাঝপথে একটু ফ্রেশ হতে সবাই ব্রেক নিতে নামলাম। কাছাকাছি একটা বাজারে আমি একাই গেলাম। কিছু ঠান্ডা পানীয়, বিস্কুট এইসব কেনাও যাবে।
একটা খাবার হোটেলে ঢুকে পানি খাচ্ছি হঠাৎ চোখ গেল হোটেলের দেয়ালে। সাদাকালো এক পোস্টারে চোখ আটকাল আমার, সেখানে একজন পাগলের ছবি। তার নাকি মাজারে উৎসব! এই নিয়ে পোস্টার। আরে, এই তো সেই ট্রেনের পাগল।
আমি খুশীমনে দোকানদার কে টাকা দিয়ে জিনিসপত্র হাতে নিতে নিতে বললাম, " ভাই? উনি খুবই ভাল। আমার সাথে একবার ট্রেনে দেখা হয়েছে অনেক আগে। আচ্ছা! এই পাগল বাবার দর্শন পাওয়া যাবে আজকে?"
দোকানি তো বটে, পাশের আর যারা সেখানে ছিল সবাই আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকাল।
হে হে! কি যে বলেন! দোকানি বলে উঠল, " ঐ পাগল বাবা! - সে তো সেই কবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মারা গেছে। একাত্তর সাল, কে কই যায় তার দিশা নানাই তখন! গ্রামের ভেতর পাকবাহিনী ঢুকে পড়সে। যারে পায় তার কাছে জানতে চায় মুক্তি কিধার হ্যায়? গ্রামে তখন কিছু লোক সেই বাবাজীর ডেরায় আশ্রয় নেয়, তার মধ্যে ছিল কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবা ছিল দয়াল মানুষ, হানাহানি তে তার কোন সায় ছিল না। তারে যারা মানতো, তিনি কেবল তাদের বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেন। তাও সবার বাড়িতে না। উনি যাদের বাড়ি যেতেন তাদের ই কপাল খুলে যেত! তাই বাবাজীর প্রতি অনেকের যেমন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ছিল তেমনি কিছু লোকের আতিথেয়তা না পাওয়ায় ক্ষোভ ও ছিল। আর তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের হুকুম তলব করার মত লোকের অভাব হয় নাই। এদের কিছু লোক বাবাজীর নামে মুক্তিসেনাদের সহযোগীতার তথ্য দেয়। পাক সেনারা তখন পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায়।
পাকবাহিনী পাগলের আস্তানায় এক রাতে আসে। এলাকার এক রাজাকার পাগলের ডেরার সন্ধান দেয়। তারপর পাগল রে মাইরা তার আস্তানায় ই মাটিচাপা দেয়। সেইখানেই তার ভক্তরা বার্ষিকী করে ফের বছর।"
কথা শোনার সময়ে আমার মাথায় অনেককিছু এনালগ ঘড়ির কাটার মত ঘুরছিল।
আমার বলার ভাষা ছিল না। তবে এর বেশী কথা বলাও বোকামি। কেউ বিশ্বাস করুক বা নাই করুক। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি নিজে যা দেখেছি, যা হয়েছে তা কেবল আমার মাঝে থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
কাউকে বিশ্বাস করানো টা আমার দ্বারা হবে না। সে লোকটি যেই হোক না কেন, কেন তিনি সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন জানি না। তবে আরেকদিন দেখা হলে সেটা অবশ্যই জেনে নেবো সেই পাগলাটে বাবাজী মশায়ের কাছে। আমার কপাল হয়তো বেশ চওয়া, ভাগ্য মন্দ নয় অনায়াসে ই বলা যায়।
দোকানী বলল, "তা ভাই! চা খাইবেন তো এক কাপ? আরেক টা গল্প ও শুনলেন খাইতে খাইতে.. "



(গল্পের সমস্ত ঘটনা এবং চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো সাথে কোন মিল নেই, মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...