বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

গল্পঃ দশমী




(এক)
শীতের বিকেল। ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি আজ। বাস কাউন্টারে বসে আজকের পেপারে চোখ রেখে বসেছিলাম। খেলা, রাজনীতি আর বিজ্ঞাপনের ছবিতে পত্রিকা ঠাসা। অবশ্য এর মাঝে বিজ্ঞাপনের খবর টি কেবল মন ভাল করার মত। একটা ডিটার্জেন্ট প্যাকের সাথে ২০% ফ্রি!
"স্যার! বাদাম খাইবেন? গ্রম বাদাম " ("গরম" শব্দের উচ্চারণ টা পাল্টে)
দে দেখি!
কাগজে ভরে দু-মুঠো বাদাম হাতে ধরিয়ে চলে গেল বাদাম বিক্রি করতে আসা ছেলেটি। বিকেলের আলো এবার পড়ে এলো। ফোনে ব্যস্ত বাস কাউন্টারের সবাই। একটুপর পর ই বাস আসছে, যাচ্ছে। কিছুক্ষণ হয়ত ফাঁকা আবার লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ছে কাউন্টার।
আমাকে দেখে হাঁক ছাড়ল কাউন্টারের এক লোক, " ভাই! আপনি কই যাইবেন?"
আমার হাতে বগুড়ার টিকিট কাটা। আমার এক সময়ের ছাত্র অনিমেষ এখন বগুড়া সরকারি আঃ হক কলেজে পড়ায়। অনেকদিন থেকে বলছে শীতে ওদের বাড়ি উৎসব, মানে মেলা বসে। আমাকে তাই ফোন করে, এবার প্রায় জোর করে "আসতেই হবে" কথা নিয়ে তারপর ফোন রেখেছে। আমার হাতেও খানিক টা অবসর। তাই শ্রীমান বিভূতিভূষণ আজ সন্ধ্যায় বগুড়ার পথে।
ও ভাই! ভাই! শুনছেন? আপনার গাড়ি নম্বর কত?
চাঁদর সরিয়ে পাঞ্জাবীর সাইড পকেট থেকে টিকিট টা বের করলাম। তাতে লেখা ২৩০, বিকেল ৫ টার গাড়ি। আমার গাড়ি নাকি জ্যামে আছে। ঘড়িতে এখন ৫ টা ৪৯ মিনিট। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমার বগুড়াগামী বাসের দেখা নেই!
পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, " আর কতক্ষণ? "
কাউন্টারে আমার কথা পৌঁছাল কি না জানি না তবে, উত্তর এল আরেকটুপর, আরো দেরী হবে।
বাদাম খুব তাড়াতাড়ি ই শেষ হয়ে এল। আমি উঠে গিয়ে একটু ফ্রেশ হতে গেলাম।
ফিরে এসে আবার সেই ভীড়!
আমার চেয়ারে একজন মাঝবয়েসী মহিলা এসে বসেছেন। প্রায় সবকয়টি চেয়ার ই কাউন্টারে আসা যাত্রীর দখলে। আচমকা, এক গলায় আমার নাম। " আরে বিভূতিদা'! আপনি? কোথাও গেছিলেন?"
আমার প্রেসের বিজ্ঞাপন দাতা জহির ভাই। কাছে এসে দুজনে হাত মেলালাম। ভদ্রলোকের মুখে সবসময় একটা হাসি লেগে থাকে। যাকে বলে হাসিখুশী মুখ। কষ্টে আছেন, কি নেই! সেটা বোঝা মুশকিল।
বললাম, "আমার ছাত্র অনিমেষ। টিউশানি পড়াতাম ঠিক তখনকার, বেশ পুরোনো পরিচয়। ওর বিয়েতে যেতে বলেছিল যেতে পারিনি। এবার নাকি উৎসব। না গেলে হবে না সে কথা নিয়েছে আমার থেকে। তা আপনি কোথা থেকে ফিরলেন?"
আমি গেছিলাম শশুরবাড়ি। ( বলেই ভদ্রলোক লজ্জায় মুচকি হাসি দিলেন)
আমি আচ্ছা.. আচ্ছা.. বলে হাসি দিলাম। কিন্তু মাঝখানে বাঁধ সাধল
 কাউন্টারের বেরসিক লোকটি।
ভাই! আপনার গাড়ি চইল্যা আইছে! জলদি আসেন।
জহিরের সাথে আর কথা বলা গেল না। একে অপরকে আগামীতে ফোন করবো বলে যে যার পথে দ্রুত ছুটলাম। বাসে উঠে দেখলাম আজ অনেক বয়সের লোক ই যাচ্ছে বগুড়া। আমার সীট পড়েছে জানলার পাশে। শীতের দিনে দূরপাল্লার বাসে জানলার পাশের সীট কখনো সুখের জার্নি হয় না। একে প্রচন্ড বাতাস লাগে, তারপরেও ঠান্ডার সমস্যা হলে তো পোয়াবারো!
আমার পাশের সীটে একটা ছেলে বসেছে। বাসের কমলা হলদে টিমটিমের আলোয় চেহারা বোঝা গেল না। তবে আন্দাজ পঁচিশ-ছাব্বিশ। আমার সাথে ভারী ব্যাগ বলে তেমন কিছু নেই। একদিন দু দিনের জন্য যাচ্ছি অহেতুক ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ!
বাসের সুপারভাইজার এসে একবার সবাইকে স্বাগতম জানাল, তারপর বলল মিনিট পাঁচ পরে যাত্রা করছি আমরা বগুড়ার পথে। আমার বিপরীত সীটে কাপল যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাদের দমকা হাসি শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ করে পেছনের সীট থেকে একটা দুই তিন বছরের বাচ্চা প্যাঁ..  শব্দ তুলে বাসের পরিবেশ গরম করে দিল। সে এই বাসে যাবে না। তার এই বাস ভাল লাগছে না বলে আধোআধো কথায় জানান দিল।
এবার পাঁচ মিনিট পেরিয়ে যেতে না যেতে সামনের সীটে বসা ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিলেন বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায়, "কেংকা বাহে! কখন ছাড়বু বাস!"
সায় দেয়ার মত দুইজন পাওয়া গেল, সেও একেবারে পেছনে সাড়িতে।
বাস ছাড়ার আগে আমার পাশের ছেলেটি হাতের স্মার্টফোন চাপাচাপি বাদ দিয়ে কান্নাজড়িত গলায় প্রায় স্তিমিত গলায় যতটা চেঁচানো যায়। তা দিয়ে চেঁচাল, " বাসটা কি আজ যাবে না!"
সবার মাঝে একটা চাপা ফিসফিস শুরু হলো বুঝলাম, কিন্তু এর বেশী শোনা গেল না। কারণ, ড্রাইভার ইঞ্জিন চালিয়ে বাস ছেড়ে দিয়েছে।
আমার নিজেরও খুব একটা ভাল লাগছিল না। ভাল হতো যদি ট্রেনে যেতে পারতাম!
ব্যাগের থেকে মাফলার টা বের করে কান অব্দি টেনে দিলাম। নাকে চাপালাম মাস্ক। এবার চাঁদর টা ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে সীট টা এলিয়ে ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম। বাসের সব আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। বাস ছাড়বার আগে ঘড়িতে শেষ সময় টা দেখেছিলাম। তখন বাজছিল ৬ টা ২০ মিনিট। এখন কত বাজে কে জানে!
চোখ বুজতে না বুজতে বুঝলাম একটা তীব্র আলো আমার চোখে পড়ছে। পাশাপাশি কানে এলো কাপলের মৃদ্যু হাসাহাসিও।
আলোর উৎস বেশী দূরের না! আমার পাশে মহান ছেলেটি। আলো জ্বালিয়ে কি একটা লিখে যাচ্ছে ফোনে।
বললাম, এক্সকিউজ মি! আলোটা কি নেভানো যায়? আমার সমস্যা হচ্ছে।
কান্নাভেজা গলায় আড়ষ্ট জবাব, " নাহ, আমি লিখছি! " (বলতে না বলতে টপ করে এক ফোঁটা জল চোখ থেকে ফোনে পড়ল, সেটা দ্রুত আঙ্গুলে মুছে আবারো লিখতে লাগল সে)
বললাম, " মনখারাপ?  দ্যাখো আমি তোমার বড় ই হব বয়েসে, তাই বলছি কি হয়েছে আমাকে যদি বল তাতে খারাপ লাগাটা কমতে পারে। "
ছেলেটি বলল, "প্লিজ!, আমার কাজে নাক গলাবেন না। আমাকে আমার মত থাকতে দিন। আমি ফোনের আলো নিভিয়ে দিচ্ছি "
ফোনের আলো ঝট করে নিভে গেল তবে " নাক গলানো " দুটো শব্দ আমার মোটেই ভাল লাগে নি। ভাবলাম, পরিবারে কেউ হয়ত অসুস্থ অথবা মারা গেছে তাই মানসিক চাপে আছে।
ঘুমের মত আসছে হঠাৎ, চাপা কান্নার শব্দ। ইঞ্জিনের শব্দ কমে গেলে বুঝলাম ছেলেটি কাউকে ফোনে বলছে, "কেন এমন হয়? কেন? সবাই কেন ভুল করে? এখন আমি এই উত্তর কোথায় খুঁজবো? "
আমি বাঙালি, তাই আড়িপাতা স্বভাব কন্টিনেন্টালগত কারণে রক্তে মিশে। আমরা সবাই এমন, অন্যের কথা শুনে খুব মজা পাই। এই মজা অন্যরকম! এখানে নিজের সাথে কিছু ঘটে না, ঘটে অন্যের। সে বেচারা কিংবা বেচারি কষ্ট পাক না কেন তাতে আমাদের অসম্ভব আনন্দ হয়। আমারো হচ্ছিল। কিন্তু আমি সবার মত অমানুষ নই! তাই ফোন রাখার পর নিজের সন্ধিৎসু মন কে দমাতে পারলাম না। যদিও একই প্রশ্ন করে অপমানিত হয়েছি একবার।
ছেলেটি কাঁদছে, সান্ত্বনা দেব না প্রশ্ন করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে প্রশ্নটা তাই আবার করলাম। আসলে বেচারা কাঁদছিল। নিজের কাছেও খারাপ লাগা বলে কিছু আছে।
বললাম, " মন খারাপ করা ঠিক না ভাই! "
ছেলেটা আমার দিকে ফিরে বলল, "জানেন কি হয়েছে?"
উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করলাম, "কি?"
আমার বান্ধবীর বিয়ে।
সে তো ভাল কথা। (বলেই নিজেকে বোকার স্বর্গে আবিষ্কার করলাম, আজকাল বান্ধবীর মানে তো গার্লফ্রেন্ড)
বললাম, " খুব কাছের বান্ধবী?"
" হ্যাঁ! "
"এতে কষ্ট পাবার কি আছে? সে তো আর হারিয়ে যাচ্ছে না! "
" যাচ্ছে! আমি ওকে খুব ভালোবাসি। " (এবার কান্নার বরফ গলল)
" দেখো, এভাবে কেন ভাবছো? নিজেকে নিজে বোঝাও। তুমি কি চাওনা তোমার বান্ধবী সুখী থাকুক!"
" চাই! "
" তাহলে? "
" আমার বান্ধবী এই বিয়েতে রাজী নয়, ও নিজেও চায় না এই বিয়ে করতে। আমাকে বলেছে সে সুইসাইড করবে। "
" সুইসাইড! " আঁতকে উঠলাম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কতটা ইমোশনাল ভেবে পাচ্ছি না। বললাম, " তুমি তাহলে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাও। "
" সেটা সম্ভব না, আমার পরিবার এই বিয়ে মানবে না। "
আমি চাঁদরে এবার নাক ঢেকে বললাম, " এখন কি সে মেয়ের বাড়ি যাচ্ছো? "
আমাকে আর উত্তর দিতে পারল না ছেলেটি, ওর ফোন এসেছে। আমি কি আর বলব বুঝে উঠতে না পেরে। চেয়ারে হেলান দিলাম। এমন ঘটনা আমার জীবনে যে ছিল না, তা-তো নয়।
(দুই)
ঘুম ভেঙেছে।
বাসের কাপল দুজন সেই আগের মত চড়াই মানে স্প্যারো কাপলের মত কথা বলেই চলেছে। আমিও ব্যাগ খুলে কোল ড্রিংকস আর বিস্কুট খেয়ে নিলাম। ভুল করে জল খাবার বোতল আনা হয়নি। বগুড়া পৌঁছেই জল যা খাবার খেয়ে নেব। বাসের বিরতি চলছিল।
আমার পাশের ছেলেটিকে বাসে পেলাম না। হয়ত কাছাকাছি ই আছে। আমিও কোমর নড়াচড়া করতে সীটে ছেড়ে বাসের বাইরে এলাম। বগুড়া হাইওয়ে তে রেস্টুরেন্ট। পিপাসা এত পাচ্ছিল তাই আর দেরী না করে সেখান থেকেই এক বোতল মিনারেল ওয়াটার নিলাম।
এখানে ফোনের নেটওয়ার্ক বেশ পাঁকা। আমার ফোন বাজল। হয়ত, অনিমেষ!
ঠিক তাই, ফোন ধরলাম।
হ্যালো, স্যার! এখন কতদূর?
ঠিক মাঝপথে। ব্রেকে আছি। একটা হাইওয়ের পাশে রেস্টুরেন্টে।
ঠিকাছে স্যার, সাবধানে আসবেন। এসে আমাকে একটা ফোন দেবেন। আমি নিজে গাড়ি নিয়ে আসছি।
আচ্ছা।
(ফোন কেটে গেল)
পকেট থেকে একটা মার্লব্রো বের করে সেটা ধরিয়ে নিলাম। অনিমেষ আমার টিউশানির ছাত্র। আমি তখন অনার্সে পড়ি। বাড়ি থেকে টাকা খুব একটা পাই না। কাছাকাছি এক ভাই ছিলেন। সে যা দিতেন তাতে অভিযোগ করার মত জায়গা থাকলেও সুযোগ ছিল না। পাছে, ওটাও না বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভাবলাম নিজেই নামি না নিজের যোগানে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মতিন আমাকে এই টিউশানি টা পাইয়ে দিল। অনেকদিন পড়েয়েছি সেই ক্লাস এইট থেকে ইন্টারমিডিয়েট। বড় বাঁদর ছিল। আমি পড়াতে এলে ই ছাঁইপাশ অংক করত। আর হাতের লেখা দেখে মনে হতো তেলাপোকা নোংরা করেছে খাতায়। একবার কষে একটা চড় দিলাম। ভেবেছিলাম, পড়া পারেনি- মেরেছি, ঠিকাছে। নাহ, সেটা আর হলো না।
ওর বাবা আর্মির কর্নেল। আমাকে কড়া কথা শোনালেন। বাচ্চাদের নাকি মারতে নেই। তবে অনিমেষের মায়ের এই মারধরে আপত্তি ছিল না। এরপর আর গায়ে হাত তুলি নি।
" শি করো বাবু, শি করো! " গায়ের উপর গরম জল পড়তে ই সরে গেলাম জলদি। আমার চাঁদরের কানায় লেগে ভিজে গেল।
একি! বাসের জানালা দিয়ে সেই বাচ্চাটাকে " শিস " দেয়ানো হয়েছে। আমাকে দেখেন নি হয়ত বাসের পাশে।
জ্বীভ কেটে, " ওহ!  সরি! সরি! আমি দেখি নি। "
এতক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। আমার চাঁদরে গন্ধ করতে শুরু করেছে। এই চাঁদর আর গায়ে দেয়া যাবে না। এদিকে বাসের হর্ণ দিয়ে ফেলল। বাস ছাড়বে।
"কি করি! "
সুপারভাইজার কে বলে জলদি করে রেস্টুরেন্ট এ ছুটে গিয়ে চাঁদরের ঐ অংশটুকু ধুঁয়ে ফিরে এলাম বাসে।
সীটে বসতে গিয়ে দেখলাম। ছেলেটি আমার আগে বসে আছে।
আমি বসে ভেজা চাঁদর ঠিক করতে না করতে; সে জিজ্ঞেস করল, " আপনার চাঁদর ভিজল কি করে? "
" আরে ঐ বাচ্চাটা জানালা দিয়ে হিসি করেছে আর আমার গায়ে! "
" আমার জ্যাকেট আছে। এটা নিন। আপাতত এই ঠান্ডায় আর ঠান্ডা লাগাবেন না "
আমি চাঁদর টা ব্যাগে পুরে জ্যাকেট টা পড়ে নিলাম। আর ভাবতে লাগলাম মানুষ এত্ত বেয়াক্কেলে হয় কি করে?
" জানেন, আমার বান্ধবীর এক ভাই আছে। সে চায় আমি তার বোনের কাছে না যাই। আমাকে হুমকিও দিয়েছে। আমি ছাত্র মানুষ। কোন চাকরী নেই। সাহস পেলেও আমার কোন সহায় নেই। আমার বাড়িতেও আমি অসহায়। তবুও আজ সাহস করেছি বান্ধবীকে শেষবারের মত দেখতে যাচ্ছি। "
আমার মন আবার ভারী হয়ে উঠল, কোন উত্তর নেই। বললাম, " তুমি আমার সাথে চলো। আমি আমার এক ছাত্রের বাড়ি একটা উৎসবে যাচ্ছি। সেখানে কি হবে সে জানায় নি। কাল না হয় বান্ধবীর বিয়েতে যেও। "
ছেলেটি অন্ধকারে আমার দিকে একবার ফিরল। এরপর অঝোরে কাঁদতে লাগল।
সবার জীবন ই এমন কোন না কোন অতৃপ্তিকর অধ্যায় থাকে। আমার নিজের ও আছে। এই অধ্যায়ের কোন শিরোনাম থাকে না। তবে বেদনাবোধ নিয়ে শেষ বরাবরের মত আছে, থাকে, থেকে যায়।

(তিন)
আমি স্টেশনে নামলাম। ছেলেটি আমার সাথে বগুড়া তে নামল। ওর বাড়ি রংপুর। বান্ধবী এবং সে বগুড়া ক্যান্টপাবলিক কলেজে পড়ত। সেই থেকে চেনাজানা পরিচয়, বন্ধুত্ব, ভালোলাগা।
" স্যার! আপনি কাকে ফোন করবেন বলেছেন? " (ছেলেটি আমাকে স্যার বলে ডাকছে, মনের দিক থেকে যথেষ্ট হালকা লাগছে তাকে)
আচ্ছা, তুমি আমার জন্য এক প্যাকেট মার্লব্রো নিয়ে আসো। আমি ফোন করে দেখি। ওর হাতে জোর করে টাকা দিতেও সে নিল না।
অনিমেষ কে ফোন করতে, সে ফোন ধরল। বলল,
-আমি এসে গেছি স্যার আর দুই মিনিট!
-ওকে।
ছেলেটি দোকান থেকে এখনো আসে নি ওর নাম সুজয়। বিবিএ পড়ছে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় একা থাকে। বাড়ি থেকে খরচ দেয়া হয়। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হবে। সরকারি কোথাও আর চান্স হয়নি।
স্যার!
গাড়ি থেকে নেমে অনিমেষ আমার পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করল। আমি বুকে জড়িয়ে পিঠ চাপড়ে দিলাম। অনিমেষ অনেক বদলে গেছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পাঁকানো গোঁফ। পড়নে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। পায়ে চামড়া জুতো।
" আপনার ব্যাগ কোথায় স্যার? "
আমার পাশে সুজয়ের লাগেজ টা ছিল সেটা দেখে অনিমেষ তুলতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, " এটা তো সে ছেলেটির। দাঁড়াও একটু। ও এখানেই আছে। আমার জন্য সিগারেট কিনতে গেছে। ওকে আমার সাথে নিয়ে যাবো কথা দিয়েছি, তোমার আপত্তি নেই তো অনিমেষ! "
" না স্যার! আপনি বলেছেন এতে ই হবে। কোথায় সে? "
সুজয় সিগারেট কিনে আমাদের সামনে আসতে না আসতে ওকে দেখে অনিমেষ এমন ভাবে রেগে ছুটে গিয়ে ছেলেটির কলার চেপে ধরল যেন সে ওকে মেরে ফেলবে।
আমি এগিয়ে না গেলে অবস্থা বেগতিক হতে বেশী সময় নিত না।
" কি হচ্ছে অনিমেষ! " এসব কি? চেঁচিয়ে উঠলাম।
" আপনি জানেন না স্যার, এই হারামি টা নাকি আমার বোনকে ভালবাসে, " বলে আবার তেড়ে যাচ্ছিল দেখে আমি থামালাম আবার।
" আজকের তোমাদের বাড়ির উৎসব টা কি তাহলে? "
" আমার বোনের বিয়ে। " কপালের ঘাম রুমালে মুছল অনিমেষ।
আমি ওদেরকে নিয়ে একসাথে চা খেতে বসে কিছু বলব বলে রাজী করালাম। ওরা রাজী হল।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, "অনিমেষ, তুমি জানো আমি কেমন স্বভাবের। দোষটা আমার আমি সুজয় কে না জেনে এনেছি। তুমি ওর গায়ে হাত দিয়েছো মানে আমাকেও অপমান করেছো "
" না স্যার, এভাবে বলবেন না"
শোন, অনিমেষ। ছেলেটি কে আমিও চিনতাম না। আর ওর কাছে জানতেও চাইনি। আমি জানি আজ তোমার বাড়ি উৎসব। আর আমি যদি ওকে নিয়ে না যেতে পারি। তাহলে আমিও ফিরে যাবো। তুমি তা চাও? আর আমাকে সুজয় কথা দিয়েছে ও আর আসবে না জ্বালাতে। আজকের উৎসব ওর কাছে দশমী।
অনিমেষের হাতে আমার শীতল হাত রেখে বললাম, " অনিমেষ, ওকে এই সুযোগ টা তো দেবে! "
অনিমেষ মাথা নাড়ল।
আমাদের ব্যাগ, লাগেজ গাড়িতে উঠল। সাথে আমরা। উৎসব এ যাচ্ছি আমরা, বিয়েবাড়ি হট্টগোল। কেবল সুজয় নামের ছেলেটির কাছে আজ কেবল প্রেমের দশমী।
(সমাপ্ত)




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...