উবার অ্যাপ টা থেকে একটা গাড়ি ঠিক করে দিল শান্ত। শান্ত
আমাদের বাসায় সেই ছোট থেকে আছে। পালক সন্তানের থেকেও অনেক বেশী পরিমাণ জায়গা নিয়ে
আছে আমার মামা-মামীর কাছে। এবার কলেজ ফাইনাল দিল, সামনে এইচ এস সি। শান্ত আমাকে দাদাভাই বলে ডাকে। ব্যালকনির পাশে আমাদের
থাকার ঘর। যে কাজ আমি করতে পারি না। সেগুলো করতে শান্ত আমাকে হেল্প করে।
দাদাভাই! তোমার গাড়ি এসে গেছে। (বারান্দা দিয়ে বাড়ির গেট বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, সেখান থেকে দেখে এসেছে শান্ত)
আচ্ছা! তুই স্প্রে টা আনতো! গায়ে দিয়ে নি।
শান্ত মুচকি হাসতে হাসতে বলল, " দাদা, গোলমাল পাকিয়ো না দেখো! "
রেগে বললাম, মস্করা করিস না!
আমার মামা-মামী চাইছিলেন আমি একা যাই। কিন্তু
কেন জানি না তখন সাহস করে " হ্যাঁ " বলে ফেলেও এখন ভয় পাচ্ছি। কারো সাথে দেখা করতে যেতে এই প্রথম অভিজ্ঞতা।
গল্পের বইয়ে, নাটকে কত ভাবে ই না এই দেখাদেখি টা চলে। অথচ
বাস্তব জীবনে এসে সেটা কতটা কঠিন টের পাচ্ছি এ মুহুর্তে।
গাড়ীটা নীচে দু'বার হর্ণ দিল।
শান্ত আমার সাথে সাথে নীচে এগিয়ে দিতে এল। মামী এলেন
পেছনে। বললেন, " কি কথা হলো, আমাকে এসে
জানাবি। ভয়-টয় মনে নিস না। সাহসী থাক, ঠিকাছে! "
মামীর কথা শুনে শান্ত হাহা শব্দে এবার হেসে উঠল। মামী ওর
পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, "যা! পড়তে বস গিয়ে,
তোর না ফাইনাল সামনে "
আরে যাচ্ছি মামী! অযথা মারধর! দেখো না, আমি থাকলে দাদাভাই সাহস পায়।
হয়েছে এবার যা! মামী ওকে পারলে তাড়িয়ে দেন।
শান্ত মুখ টিপে হেসে হেসে উপরে চলে গেল।
উবারের ড্রাইভার একটু বিরক্ত!
গেটের ভেতরে এসে বললেন, " স্যার!
আপনি যাবেন? একটু তাড়াতাড়ি!
"
হ্যাঁ!
আমি গাড়ীতে উঠলাম। মামী পকেটে ফোন টা দিয়ে বললেন, " গুডলাক "
গাড়ী গলি পেড়িয়ে ছুটল।
পকেটের ফোন ভাইব্রেট করছে। তুলতে পারছি না। এখন তোলা
সম্ভব না। আমি কেন আর কোথায় যাচ্ছি এই ব্যাপারটা বলে ফেলা উচিত।
যাচ্ছি একজনের সাথে দেখা করতে। উনি একজন নারী। আমার
কিংবা আমাদের পরিবারের কেউ অবশ্য তিনি নন। তবে ভবিষ্যৎ এ হবেন। মামী অনেকদিন থেকে
ই বলছিল আমি যেন গিয়ে দেখা করে আসি। তবে আমি যে কলেজে পড়াই সেখানে ছুটি পাচ্ছিলাম
না। আর মেয়েটিও একটা অফিসে আছে। সবমিলিয়ে যাকে বলে গোলমেলে। মামী মেয়েটির একটা ছবি
আমাকে দিয়েছে। সেটা নাকি মেয়েটির ফেইসবুক একাউন্ট থেকে নেয়া। কাল দেখেছি ছবিটা।
মেয়েটি ছবিতে জানালার পাশে বসে কফি খাচ্ছিল। চোখে কাল চশমা। বিকেলের দিকে তোলা।
ছবি তোলার সময়ে হয়ত মেয়েটি প্রস্তুত ছিল না। যেমন করে, রেডি
ওয়ান..টু.. থ্রি বলে ছবি তোলা
হয়।
যাকে বলে ক্যান্ডিড!
স্যার, বা'দিক দিয়ে
যাবো? ডানে জ্যাম! লেইট হবে
সেদিকে গেলে।
আমি বা"দিক দিয়ে যেতে ইশারা করলাম
ড্রাইভার কে।
বা'দিকে ঘড়ঘড় শব্দে মোড় নিল গাড়ি।
সত্যি বলতে, আমি একেবারে গোলমেলে টাইপের। নিজের
কাজ, কলেজ এই নিয়ে থাকা হয় বেশী। এই বাইরে ভাবনা আছে যদিও,
তা থেকে কেবল দূরে থাকতে চেয়েছি পালিয়ে থাকার মত করে।
কিন্তু এবার আর সেটা কন্টিনিউ করা গেল না। মামা-মামীর
বয়েস বেড়েছে। আমি একাকী। শান্ত কিছুদিন পর হয়ত ইউনিভার্সিটি যাবে। আমার সাথে কে
থাকবে? তাদের ভাবনা!
নিজের কাজে আমি ডুবে থাকি। এটা নাকি স্রেফ পাগলামি আমার।
স্যার, এখানে রেখে দেব? পাশে পার্কিং করা যাবে না।
ড্রাইভার নেমে এসে গাড়ীর দরজা খুলে দিল। আমি নেমে গেলাম।
শপিং মলের ঠিক উপরে একটা কফি শপ।
আমাকে আসতে দেখে শপের বাইরে দারোয়ান দরজা টেনে দিল।
কফি শপের ভেতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ। টিমটিম করে রংধনু রঙা
আলো জ্বলছে।
দেখলাম সে আলোতে,
ঠিক শপের জানালা ধরে কেউ একজন বসে। আমি ছবিতে যেমন
দেখেছি ঠিক তেমনি। চোখে সানগ্লাস। সামনে কফির মগ। দৃষ্টি কফি শপের বাইরে।
হ্যালো!
আমি নিবিড়! বসতে পারি?
বসুন।
একটু লেইট করে ফেললাম, আসলে..
কফি খাবেন? মেয়েটি জানতে চাইল।
বললাম, " নো, থ্যাংকস
"।
মামী আসলে আপনার কথা আমাকে বলেছে। আপনি একটা ওয়েলফেয়ার
কোম্পানি'র সাথে আছেন। আপনার কিছু শখ মানে হবি'স। এর
বেশী খুব একটা জানি না।
আমি নায়শা। মেয়েটি বলল। আপনি কলেজে পড়ান, সে
জেনেছি। আমার ভাইয়া আপনার মামীর বন্ধু ছিল। ভাইয়া আমাকে বলেছে। আপনার প্রিয় রঙ
কালো, শখ বই পড়া, ইচ্ছে পাহাড়ে
ঘুরতে যাওয়া। মাঝে মাঝে আপনি ইচ্ছে করে নাকি রাত জাগেন। বারান্দায় বসে আকাশের তারা
দেখে যান। (বলে মেয়েটি থামল)
(আমি অনেকটা অবাক, এতকিছু জানে
আমার ব্যাপারে। অথচ, মেয়েটির কেবল কফি খাবার শখ টি ছাড়া
আমার আর কিছু জানা নেই!)
-কিছু ভাবছেন? নায়শা বলল
না আসলে, আমার ব্যাপারে এতটা জানেন। দেখুন আমি
খুব জানি না।
নায়শা একটু হাসল, এরপর বলল। আপনি যে রাত জেগে তারা
দেখে থাকেন, তাতে কয়টা তারা আপনার জানা বলুন? তবুও তো দূর থেকে অপলক দেখে যান। কিছু কিছু ব্যাপারে না জানা একধরণের
সান্ত্বনা। এতে ক্লেশ, কষ্ট এসব থেকে মানুষ দূরে থাকতে
পারে।
কিন্তু আনন্দ! সেটাও তো থাকতে পারে? চটজলদি বোকার মত প্রশ্ন করলাম।
নায়শা মুচকি হেসে ফেলল। হাহা.. আপনি
শিক্ষক সেটা আপনার প্রশ্নের ধরণে বোঝা যায়।
আমিও সলজ্জিত।
" কফি?" মেয়েটি আবার
কফির অফার দিল।
এবারে না করলাম না, মোহ কাজ করছিল আমার। অনুরোধ কেবল রইল
না আমার কাছে।
কফি আসতে আসতে নায়শা বলল, " আমার ব্যাপারে
আপনার মামী আর কিছু বলেনি বলছেন?"
নাহ! মানে, ঠিক
বলেনি তা নয়। আমি আসলে তখন নিজের কাজে ডুবে ছিলাম তাই ঠিক করে জানা হয়নি।
ওয়েটার কফি রেখে গেল টেবিলে।
নায়শা বলল, " আপনার ব্যাপারে আমি কৌতূহলী।
মানে নতুন কারো সাথে না জেনে কথা বলাটা ঠিক কতটা ভাল হতো সেটা আন্দাজ করে আগ্রহী
ছিলাম "।
আমি কেবল, মাথা নাড়লাম।
-আপনার কফি ঠান্ডা হচ্ছে।
- জ্বী, মানে হ্যাঁ। খাচ্ছি।
মেয়েটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ওর কথা বলা, মুখভঙ্গি
দেখে যাচ্ছি। এই মেয়ে আমার মত ছেলেকে বিয়ে করবে বলে আমার মন সায় দিচ্ছে না।
হাহা.. বলে হাসি থামাল মেয়েটি। কি? এবার আপনি বলুন? নাকি আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ পাঠকের মত ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে কেবল
আমাকে শুনেই যাবেন।
আ..আমি! হ্যাঁ,
বলছি তো।
মেয়েটার পাশে ভাজ করে রাখা সাদাছড়িটা এয়ক্ষণে দেখতে
পেলাম, কেন জানি আড়াল করতে চাইছে। কেন? নিজে অন্ধ বলে ছোট লাগছে আমার সামনে! নাহ,
অসহায়ত্ব লুকোতে চায়।
আমার চোখ সেদিকে পড়তে এবার মেয়েটির কথার তোড় যেন কিছুটা
নেমে গেল।
তারপর বলল, " আমি দেখতে পাই, আমি অন্ধ নই! " ফুঁপিয়ে উঠল গলা।
আমি ইতস্তত বোধ করলাম, এভাবে হঠাৎ করে এমন
কথা বলে বসবে ভাবি নি।
সরি, প্লিজ আপনি শান্ত হোন। আমি সেরকম
কিছু বলি নি আপনাকে।
ওয়েটার এসে গেছে, এক্সকিউজ মি! এনি প্রব্লেম?
নো! থ্যাংকস। এক গ্লাস অফ ওয়াটার প্লিজ!
ওকে স্যার।
এক ঢোকে গ্লাস খালি করে দিল মেয়েটি। কিছুটা শান্ত
দেখাচ্ছে এবার ওকে। যা ভয় পেয়েছিলাম!
নায়শা এবার মুখ খুলল। বলল, " জানেন,
আমি চোখে দেখিনা বলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আমার প্রিয় বন্ধু।
অন্ধের সাথে ভালবাসা নাকি হয় না। আমি অনুরোধ করিনি। কাউকে ধরে রাখা যায় না। চলে
যাবার মত যারা তাদের খুব তাড়া থাকে। এরা আপনার দেখা সেই তারার মত, রোজ সাথে থাকে তারপর হুট করে হারিয়ে যায়। "
মেয়েটির হাত টেবিলে ছিল। সান্ত্বনা দেবার ইচ্ছে থেকে হাত
আমি ধরতে পারলাম না।
মেয়েটি চুপ হয়ে গেল।
কফি শপে লোকজন কমে এসেছে। ঘড়িতে রাত ৮ টা।
নায়শা! (আমার ডাক শুনে মেয়েটি আমার দিকে
মাথা উঁচু করে তাকাল)
অ্যাই অ্যাম সো সরি, নায়শা! আমি তোমাকে চিনতাম না, জানতাম না। আমি সত্যি
দূঃখিত!
আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
নায়শা, চশমার বাইরে থেকে চোখ মুছল। বলল,
"কফি খাবেন?"
হেসে বললাম, " আমি রাজী, যদি তুমি আমার জন্য সারাজীবন কফি বানাতে রাজী থাকো। "
কফি শপে কত সেকেন্ড নীরবতা ছিল মনে নেই।
সম্ভিত ভাঙ্গল, মেয়েটি মানে এহেম, নায়শার " ইয়েস " চিৎকারে।
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন