রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭

ছোটগল্পঃ বিপদের হাত



(১)
 কাঠজ্বালনো কড়া রোদ। গাড়িটা একটা দোকানের সামনে পার্ক করে মাল নামানো হচ্ছে। আচমকা..
-ভাই কত বাজে?
পাশ ফিরে তাকাতে ই হলো আমাকে। কড়া রোদে আমার বা'হাতে চকচকে স্টেইনলেস স্টিলের ঘড়িটা জ্বলজ্বল করছে।
প্রশ্নটা করতে করতে এক পাজা দাঁতের ঝলকানি তার মুখে, কপালে ঘাম, পড়নে লুঙ্গি, গায়ে প্রায় কালো হয়ে যাওয়া একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। বা'হাতে লুঙ্গীর পেছনে চুলকে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
আবার অবাক চাহুনি দেখে আবার ডান হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল, "ভাই, কইলেন না? কয়টা? "
-হুম, ১১ টা ত্রিশ মিনিট।
-বাংলায় কন না ভাই!
-বাংলায় ই তো বললাম!
-না, সাড়ে না পৌঁনে?
-সাড়ে এগারটা।
-আইচ্ছা। ( কথাটা শেষ করেই হনহন করে যেদিক থেকে এসেছিল তার উলটো পথে হাটা দিল লোকটি)
তার কাজকর্ম দেখে আমি অন্ততপক্ষে অবাক।
সেলসম্যান!
না মানে আমি।
তারেক হাসান। মাস্টার্স শেষ করে এখন আর যখন চাকরী নামক সোনার হরিণ টা মায়া দেখিয়ে মুহূর্মূহু পালাচ্ছে ঠিক সে সময়ে এই চাকরি। একটা কোম্পানি'র বিস্কুট বিক্রি করতে এই উপশহর এ আসা।
জামালপুরের এই উপশহর এ এখন প্রায় ই আসা হয় ইসলামপুরের পরে এই উপশহর। শহরের মাঝামাঝি পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্র নদ।
কোম্পানীর গাড়িতে আমার চলাফেরা, মালামাল ভরে দিন চারেক গাড়ি নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিতে হয় সারা জামালপুর।
আমার গাড়ির ড্রাইভার সিরাজউদ্দিন। মানে সিরাজ ভাই, উনার বাড়ি অবশ্য সিরাজগঞ্জ।
এর আগেও নানা জায়গায় গাড়ি চালিয়েছেন মোটামুটি দক্ষ ড্রাইভার কাতারে চোখ বন্ধ করে তাকে রাখা যায়। গাড়িতে করে যখন চলি তখন উনি আমাকে তারেক ভাই বলে ডাকেন। বস বলেন না, শুরুতে বলতেন কিন্তু এখন আর বলেন না। এমনকি রাস্তায় ব্রেক নিতে গেলেও আনুগত্য আর মজার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে হাসিমুখে বলেন, "তারেক ভাই, ফ্রেশ হমু! "
আজ সিরাজ গাড়িতে ই বসে। আমাদের মালামাল দিতে হলো না। জাস্ট চেকিং করে নিলাম আমি নিজে।
আমি দোকানে খোঁজ নেবার পর সিরাজ ভাই তাড়া দিলেন, "ভাই, আসেন জলদি! আরো দোকান আছে।"
চায়ের তেষ্টা পেয়েছে, গাড়িতে ফেরার পথে দেখছিলাম চা দোকানে কড়া চায়ের আড্ডা বসেছে। ঘড়িতেও সাড়ে এগারো।
সিরাজ ভাই! ( দূর থেকেই ডাক দিলাম)
কি ভাই?
আসেন, এক কাপ করে চা খাই!
এক কাপ ই খাইবেন? (মুচকি হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলেন সিরাজ ভাই)
পাটাতন দেয়া বসবার মত উঁচু করে দেয়া হয়েছে চা খাবার দোকানে। মাথার উপর পাতলা বাঁশের বেড়া।
-চা দিমু ভাই?
-হুম দেন, দুই কাপ! (সিরাজ ভাইয়ের চায়ের নেশা নেই উনি দোকানের পেপারে চোখে বোলাচ্ছেন)
চা দোকানী ব্যস্ত হয়ে গেল দুটো স্বচ্ছ কাঁচের হাতল দেয়া কাপ নিয়ে।
দুপুরের ঠিক আগে আগে অন্যসব দোকানে ভীড় কম হলেও চা দোকানের ভীড় চোখে পড়ার মত। আমরা দুজন ছাড়াও জন আটেক আছে। একেকজন একেকে ভাবে বসে।
দেখার মত বলতে ষাঠোর্দ্ধ এক বৃদ্ধ, দুহাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপচাপ চা গিলে যাচ্ছেন।
আমার পর্যবেক্ষণ চোখের উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন, "বিস্কুট বেঁচেন?"
-না, মানে সাপ্লাই করি।
-ওইডাই, বেঁচেন। খাইছি আপনেগো বিস্কুট, চায়ে দিলে ডুইবা যায়। একবার ডুবাইলেই শ্যাষ!
-এ তো সব বিস্কুটে...(কথা শেষ করা গেল না) মাঝ থেকে বলে উঠলেন আবার দাম বেশী। আমাগো সময়ে বিস্কুট আছিল ভাল, এহন কি দিয়া বিস্কুট বানায় কেডা জানে! (বলে, চায়ে চুমুক দিলেন তিনি)
আমি আর কথা কথা বাড়ালাম না, চা এসে গেছে তাতে আমার তীব্র মনোযোগ।
অসাধারণ চা!
(২)
ইসলামপুর ছেড়ে এসেছি সোজা শহরে। আমাকে কোম্পানীর মালামাল বাকীটা বুঝিয়ে দিতে হলো।  মাসের আজ ২৯ তারিখ, বেতন পাবো বলে খুব আশা করে একাউন্টস এ গেলাম।
না না হবে না! ( আমাকে দেখে ই হাঁক দিলেন সাইফুদ্দিন ভাই)
মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল, গেল মাসটাও শেষে ধার করে চলেছি মেসমেট শান্ত ভাইয়ের থেকে দু'হাজার নিয়ে। তাছাড়া আমি সৎ ভাবে কাজ করি কোম্পানীর টাকা, মালামাল এদিকওদিক কোনদিন ই করিনা। যেখানে অনেকেই আছে এমনি করে নিজের আখের ঠিক করে নেয়।
তবুও একটু আশা সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম,
-ভাই, হবে না কেন?
-হবে না রে হবে না! কোম্পানী এই মাসে লস খাইছে, লাখ দশের মত। এইবার দেরী হবে।
কোম্পানীর এগুলা বাহানাবাজি, আমি ভাল করেই জানি। টিভি খুললেই বিস্কুট নিয়ে মডেলের অ্যাড দেখি ডেইলি। কোম্পানীর সেল ভাল তারপরেও একটা প্যানিক তুলে রাখে।
-আজ হবে না ভাই?
-না! ৩০ তারিখে দেখি। এখন যান।
মেসে ফিরে চুপচাপ বাংলা "দ" অক্ষরের মত চেয়ারে বসে আছি। শান্ত ভাই হুড়মুড় করে মেসের রুমে এলেন, হাসঁফাস গলায় বললেন, "একগ্লাস পানি দে তারেক! তেষ্টায় মরে গেলাম! " (গলার টাই টা হেঁচকা টানে খুলে লুঙ্গী দ্রুত পালটে নিলেন এর ফাঁকে)
আমি পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ওটা এক ঢোকে শেষ করে বললেন, " কিরে? হয়েছে কি?"
-না ভাই কিছু না!
-কিছুনা মানে? আরে বল না হলে আজকে রুমের বাইরে থাকবি। (এটা অবশ্য মজা করেই বলে শান্ত ভাই)
মাথানিচু করে বললাম, "ভাই, বেতন দিল না। আজকে ২৯ তারিখ!  বলল কোম্পানীর নাকি লস! "
চৌকিতে বসে ই বললেন, "কে বলল লস? আমার ব্যাংকে আজ তোদের কোম্পানীর এম ডি আসছিল। একাউন্ট আপডেট করে গেল। সবাইকে বিস্কুট দিয়ে গেছে। " ( এ কথা বলে ব্যাগ থেকে গ্লুকোজ বিস্কুটের একটা প্যাকেট আমার দিকে ছুঁড়ে দিল তারেক ভাই)
-নে খা!
-না ভাই!
-কেন?
-বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। আম্মা ফোন করেছিল, আব্বার ওষুধ এ মাসে শেষ হয়েছে দিন দুই আগে। আজকে ভাবছিলাম টাকা পেলে বাড়ির ঠিকানায় পাঠাবো। বোনের এক্সাম ফি!  সব ই আটকে রইল ভাই!
শান্ত ভাই, মুখ ভার করে এসে আমার ডান কাঁধে হাত রেখে বললেন, " কাল বাড়িতে টাকা টা পাঠাস। এখানে হাজার তিন আছে। আমাকে না হয় পরে দিস "
আমার চোখের কোণা ভিজে এল, আমার কোন বড় ভাই নেই
 শান্ত ভাইয়ের সাথে আমার মেসে পরিচয়। উনিও যে খুব ভাল চলেন তা না, হাউজ লোন নিয়ে বাড়ি করেছেন। বাড়িতে থাকেন তার মা, স্ত্রী আর এক মেয়ে। সেখানে তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হয়, সেই সাথে লোনের কিস্তি।
না ভাই! আর দুটো দিন পার হয়েই যাবে।
চুপ! এই নে। দু'দিন পর আমাকে তুই দিবি। এখন এটা রাখ! ভালো কথা, রাতে খেয়েছিস?
হ্যাঁ ভাই! আমার ব্যাগে একটা স্যান্ডউইচ আছে। ওটা খেয়ে নে। আমি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আসি।
(৩)

কোম্পানীর গাড়ি করে আজ মালামাল নিয়ে সেই ইসলামপুরে আসতে হলো, মাঝে গেছিলাম মাদারগঞ্জ। পুরো জামালপুর চষে বেড়াতে হয়েছে সারাদিন। এখানে সেখানে মালামাল পৌঁছে দিতে দিতে আর খুব একটা সময় পেলাম না বাড়ির জন্য সে তিন হাজার টাকা পাঠাতে।
ক্যাশে আজ বেতন পেয়েছি। আজ ত্রিশ তারিখ। হাজার বারো আছে সবমিলিয়ে। মালামালেত আজকেত হিসেব কাল দেবো বলে কাগজপত্র সাথে রেখে সিরাজ ভাইকে গাড়ি নিয়ে একাই চলে যেতে বলেছি। তাই,
সিরাজ ভাই আগে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। আমি একা কিছুক্ষণ ঘুরব বলে নেমে গেছি এখানকার বাজারে। হাঁটতে হাঁটতে আমিও সে চায়ের দোকানে আজ একা ই বসলাম।
ঘড়িতে সন্ধ্যে সাড়ে ৭ টা।
দু'কাপ চা খেয়ে বিল মেটালাম দোকানের। সন্ধ্যে বেলায় দোকান রমরমে, রাজনীতি আর ক্রিকেট চানাচুরের মত মচমচে আলোচ্য বিষয়। এর থেকে আলোচ্য এখানে সারাদিনে কার কেমন গেল। হঠাৎ দেখলাম, প্রথমদিন চা খেতে দেখা সেই বৃদ্ধকে। উনি পরিচিত হাঁটুভাঁজ করা ভঙ্গিতে চা খাচ্ছেন।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, " ভালো আছেন?"
মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, " ভালো আছি। কিন্তু এত দেরী করা এই এলাকায় ঠিক না।"
কেন? জিজ্ঞেস করতে আর জবাব দিলেন না।
জবাব টা হয়ত নিজের উপলব্ধি করা বাকী ছিল, কিছুটা দূর যেতে আর যানবাহন পাচ্ছি না। ঘড়িতে সোয়া ৮ টা। যেদিক থেকে এলাম সেখানে লোকের ভীড় ছিল। এদিককার পুরোটা প্রায় ফাঁকা। মিনিট দশ হেঁটে গেলে একটা রিক্সা স্ট্যান্ড আছে দেখেছি এর আগে। তাই সেদিক করেই পা দ্রুত চালালাম।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা বাইকে খুব দ্রুত এসে আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করল।
আমি চোখে ষর্ষে ফুল দেখার আগে কিছুটা হইহই শুনলাম। এরপর হাতাহাতি। আর জ্ঞান নেই!
জ্ঞান ফিরতে বুঝলাম মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আমি এখন জামালপুর সদর হাসপাতালে।
জ্ঞান ফিরেছে দেখে শান্ত ভাই এগিয়ে এলেন। বললেন, "তোর বাড়িতে খবর দিয়েছি। আরো বলেছি এখন ভালো আছিস "
একটুপর একজন লোক হাসপাতালের পর্দা ঠেলে ভেতরে এল আমার সেই স্টিলের ঘড়িটা হাতে। চেনাচেনা লাগছিল একে, কই দেখেছি ভাবার আগে সেই বলল, "ভাই, আপনারে তো চিনি না! তয় আপনার ঘড়ি দেইখা কাইল রাইতে চিনছি। দেখি দুইজন আপনার মাথায় বাড়ি দিতাছে। আমি দেরী করি নাই হাতের কাঁচি নিয়ে ধাওয়া দিসি। আপনার পকেটে ট্যাকা আছিল মনে হয় ওইটাই নিতে চাইছিল। এই নেন আপনের ঘড়ি! "
আমি ঘড়িটা নিয়ে বললাম, "আপনি কি করে জানলেন? সেখানে তো আমি কাউকে দেখি নি সে রাতে!"
লোকটা একটু হেঁসে বলল, " আমার আব্বা বলল আপনে নাকি রাইতে একা যাইতাছিলেন? তাই আমারে একটু আগাইয়া দেখতে কইল আমিও আইসা দেখি এই কাহিনী"
শান্ত ভাই বললেন, " উনি না থাকলে, তোকে বাঁচানো কঠিন ছিল! হাসপাতালে উনি ই তোকে নিয়ে আসে "
কিন্তু আমার খটকা!  উনি জানল কি করে? আর আপনার আব্বা কে?
উনি হেঁসে বললেন, " আপনি চা খাইতে গিয়ে যার কুশল নিছিলেন, সেই আমার আব্বা "
আমি আমার স্টেইনলেস ঘড়িতে লোকটার হাতে জোর করে দিয়ে বললাম, "আপনি অনেক ভালো লোক, এই ঘড়িটা আজ থেকে আপনার। আর আপনার আব্বাকে আমার সালাম দেবেন "

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...