শনিবার, ১১ মার্চ, ২০১৭

গল্পঃ মুক্তি




(এক)
 ঘটনাটা যেদিন ঘটে গেল সেদিন আমি মেসে ফিরতে দেরী করেছিলাম। ইচ্ছে করে দেরী করিনি, ছিলাম প্রগতি স্বরণী তে। জ্যামে পিষ্ট হচ্ছিলাম!
মুঠোফোনের ভয়াবহ ভাইব্রেশন একদিকে, অন্যদিকে গরমে, জ্যামে, ভীরে ঘামের গন্ধে আমার প্রাণ উষ্ঠাগত!
ফোন ধরার কিঞ্চিৎ সময় আর সুযোগ কোনটিই ছিল না।
মেসে রিক্সার পথে ফোনে বাকীটা শুনে থ' বনে গেলাম।
এবার শুরু করি আসল ঘটনা,
আমাদের মেস বেশ ছিমছাম, থাকি তিনজন। আমি, শান্তনু দা' আর প্রবাল ভাই। প্রবাল ভাই বিয়ে করেছেন। আমরা আনম্যারিড। আমি ভার্সিটি শেষ করে সবে একটা আই টি ফার্মে ইন্টার্ন। কুত্তার মত পরিশ্রম করায়, তাই মেসে ফিরে যা এনার্জি অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে ই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমে টলিয়ে যাই। আমাদের মেসের রুমটা আয়তন বেশ কম। তিনজনে প্রায় ঠাসাঠাসি!
আসবাবপত্র খুব কম, যা আছে একটা কাপড়চোপড় ঝোলানোর আলনা, তিনটে পাতলা সাইজের চৌকি আর আমার একটা টেবিল। এর মাঝে স্পেশাল সম্পত্তি বলতে এই মেসে এসে তিনজনের একটা সরকারি সম্পত্তি ভাঙা আয়না।
আয়নাতে অসংখ্য স্ক্রাচ আছে, সাইজে একজন মানুষের অর্ধেক। আমার চৌকির ঠিক মাথায় দেয়ালে ঝোলানো আছে ওটা।
সকালে বের হবার আগে একবারের জন্য নিজেদের চুল আঁচড়ানো, দাঁত ব্রাশ এবং ঝটপট সেইভ। ভালোই চলে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটল, প্রথম দিন।
শান্তনু দা' যেদিন রাতে একা মেসে ছিলেন। আমি গেছিলাম আমার ভার্সিটির এক বন্ধুর বাসায় এসাইনমেন্টের কাজে। রাতে ফিরবো না বলে গেছি, এদিকে প্রবাল ভাই গেছেন নিজের গ্রামের বাড়ি পরিবারের সাথে দেখা করতে।
তাই শান্তনু দা' ছিলেন, মেসে একদম একা।
রাতে খাওয়া বাইরে মাটন দিয়ে খেয়ে এসে দিব্যি ঘুমোবার প্লান করে, বিছানা ঝেড়ে ঠিক শোবেন। হঠাৎ দাঁতের কোণে এক টুকরো মাটন মুখে খচখচানি তুলল। তাই মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বেলে টুথপিক নিয়ে আয়নার সামনে যেতে দেখলেন। আয়নার ওপাশে কেউ একজন মাথা নিচু করে বসে।
আঁতকে উঠে পেছনে ফ্ল্যাশের আলো ফেললেন শান্তনু দা'। কে? (কাঁপা গলায়)
মেসের রুম এমনিতে অনেক ছোট, তাই তৃতীয় কেউ রুমে এলে তিনি রুমে ঢুকেই সেটা বুঝতেন।
তাড়াতাড়ি ফিরতি আলো ফেলে আয়নায় দেখলেন সেখানে কেউ নেই!
নিজেকে নিজেই বোঝালেন, ইদানীং আজগুবি গল্প আর মুভি দেখার ফলাফল এটা।
যত্ন করে টুথপিকের কাজ সেরে এবার শুয়ে গেলেন।
ঘুম এলো কি আসে নি, কাঁচ ভাঙার এক আচমকা শব্দে এবার ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন তিনি। মোবাইল জ্বালিয়ে আলো প্রথমে ফেললেন জানালায়, পরে আয়নায়।
আরে! কিছুই তো ভাঙে নি! তাহলে শব্দ এই কোথা থেকে? গোটা রাত আলো না জ্বালিয়ে ঘুম এলো না তার।
(দুই)
 পরদিন আমরা দুজন ই মেসে ফিরলাম। শান্তনু দা' এমন সুপারন্যাচারাল গল্প বলতে প্রবাল ভাই যে ভাবগম্ভীর ভাব নিলেন তাতে ঠিক আমার মুখে আসে হাসিটা চাপতে বেশ বেগ দিতে হচ্ছিল।
তারপর তার মুখের হাসির শব্দ শুনে আমার হাসি একেবারে সুনামি তুলে দিল।
শান্তনু দা' লজ্জায় আর কথা না বলে সরাসরি চুপ করে গেলেন।
আমরাও ব্যাপারটা ভুলে গেলাম।
এইসব ছাইপাশ!  মুখরোচক গল্প বই, মুভি কিংবা গল্পে শুনতে মানায়। নয়ত আমাদের অবসর কাটঁতো কি করে!
শান্তনু দা' এসব ব্যাপারে যে সিরিয়াস। তা বুঝলাম ঠিক তার পরের দিন। যখন নিজের জন্য আলাদা করে একটা হাতল দেয়া আয়না কিনে মেসে আনলেন।
প্রবাল ভাই আর আমি চোখাচোখি করলাম।
প্রবাল ভাই নিঃশব্দে খানিক হেসে আমার দিকে ফিরে নিজের মাথার উপর এক চক্কর আঙুল ঘুড়িয়ে বোঝালেন শান্তনু দা' পাগলামি করছেন।
আমি ও একটু হেসে থেমে গেলাম।
এরপর আরো মাস দুই কেটে গেছে আমরা তিনজনে পুরোনো কোন কিছু আর মনে রাখিনি। প্রবাল ভাই প্রমোশন পেয়ে অফিসার। আমি ইন্টার্ন আর শান্তনু দা'র বিয়ের কথা এই ছিল সে সপ্তাহে আমাদের আপডেট।
আমার হাতে নতুন টাকা, খরচের হাত। মেসে যা ইচ্ছে খাবার নিয়ে আসি। তিনজনে ভাগ করে খাই। আমাদের ভ্রাতৃত্ব!
আমাদের তিন মা হলেও, আমরা এক।
যাই হোক, এবার আবারো আমাদের দুজনের অনুপস্থিতিতে সেদিন ঘটলো ঝামেলা। আমি রাতে গেছিলাম আমার অফিসে নাইট ছিল বলে। প্রবাল ভাই, নিজের বাড়ি।
শান্তনু দা' রাতে ঘুমিয়েছেন, হঠাৎ কাঁচ ভাঙার শব্দ পেলেন। চোখ কোনমতে ডলে উঠে বসে আলো জ্বালিয়ে দেখলেন তার কেনা আয়নাটা ভেঙে চুরমার!
রুমে কি কেউ? মানে চোর? তিন তিনিটা চৌকির তলা চেক করলেন তিনি। নাহ! কেউ তো নেই!
তবে আয়না ভাঙল কে!
আর আয়না ছিল টেবিলে শোয়ানো, দেয়ালে ঝোলা থাকলেও তো বুঝতাম সেটা পড়ে ভেঙেছে।
তাহলে!
ঘুম আর এলো না শান্তনু দা'র, ঘড়িতে দেখলেন রাত দুটো কুড়ি। ঘুমে চোখ ভাঙছে।
 (তিন)
 ফোন পেয়ে আমি রীতিমত রিক্সাওয়ালাকে বলেছি দ্রুত চালাও। শান্তনু দা মারাত্মকভাবে ইঞ্জুরিতে পড়েছেন। নিজেই নিজের হাত আয়না দিয়ে কেটে ফালাফালা করেছেন।
রুমে কেউ ছিল না। প্রবাল ভাই রুমে ফিরে ই এইসব দেখে নিজেও ভয়াবহতা দেখে ঘাবড়ে গেছেন।
আমাকে ফোন করে যাচ্ছিলেন অনবরত। অ্যাম্বুলেন্স এ ফোন করে শান্তনু দা' কে নিয়ে আছেন এখন হসপিটালে।
দ্রুত ব্লাড জোগাড় করতে হবে। ব্লিডিং থামেনি। জ্ঞান ও ফেরেনি।
আমি পা চালিয়ে ইনকোয়ারি থেকে জানলাম, ইমারজেন্সি থেক এখন ওটি তে আছেন শান্তনু দা'। অপারেশন চলছে তার।
প্রবাল ভাইকে পেলাম। কোণায় দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে।
ডাক দিলাম, "প্রবাল ভাই!"
আমাকে দেখে কাঁদোকাঁদো চেহারায় ছুটে এলেন তিনি। বোবা শব্দে হাতের ইশারায় কি একটা বলে কেঁদে দিলেন এবার।
ব্লাড জোগাড় হয়েছে?
মাথা নাড়লেন ' হ্যাঁ '।
আর কথা হলো না। ২৪ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরল দাদার। পরিবার থেকে তার ভাই-বোনেরা এসেছেন। তার মা খুবই বৃদ্ধা। নিজেই চলতে পারেন কম। তাই তাকে জানানো হয়নি ব্যাপারটা।
ছোট ভাই অতনু মাস্টার্স করছে একটা পাব্লিক ভার্সিটি থেকে। আমাদের দু চারটা ব্যাপারে কথা হলো। আমার দু বছরের ছোট সে।
উৎসাহ নিয়ে যা জানলাম। তাতে আমি নিজে অবাক না হয়ে পারলাম না।
শান্তনু দা' ভার্সিটি পড়বার সময় তার ডিপার্টমেন্ট এক জুনিয়রের প্রেমে পড়েন। মেয়েটিও তাকে পছন্দ করতো।
এক দুই করে দুজনে দেখা করেন। মন দেয়া নেয়া। ভালোই চলছিল।
কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল একদিন।
মেয়েটা নাকি রাত জেগে থাকতো আর অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করতো। তার এসব আচরণে রুমমেট ডীনের কাছে রুম চেঞ্জের আবেদন করে।
পরে মেয়েটিকে একা একটা রুমে দেয়া দেয়। একা একা থাকত, রুমে নিজের গান শুনত। বিশেষ করে একটা গান ফুল ভলিউমে জোরে পরপর বাজাতো। রবীন্দ্রসংগীত টা ঠিক এই গানটা
" এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে... "
আর বুঝতেই পারছেন!
এক গান প্রতিদিন বাজায় অবশ্য কেউ বিরক্ত, কেউ পছন্দ একাধারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মেয়েটি পাগলাটে!  তাই জোর করে যেচে কথা বলতো না। রাতে এই গান বাজা প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেল বলতে গেলে। কিন্তু
একদিন রাতে একই রবীন্দ্রসংগীত বাজতে লাগল। সকাল, দুপুর, গড়িয়ে বিকেল অবশেষে রাত। আগে যেটা সকাল হলে থেমে যেত।
হলের এক সিনিয়রের এক্সাম ছিল পরেরদিন। তাই কেউ কিছু না বললেও বিরক্ত হয়ে তিনি গেলেন মেয়েটির রুমে নক করতে।
বার কয়েক নক করার পর যখন মেয়েটি খুলল না, তখন তিনি গেলেন প্রক্টর বরাবর নালিশ জানাতে।
তারা এসেও নাম ধরে মেয়েটিকে ডাকল। অথচ সাড়া নেই!
প্রক্টর দরজা ভাঙার আদেশ দিতে ই দরজা ভাঙা হলো।
রুমে ঢুকেই বীভৎস চিত্র। মেয়েটি দেয়ালে ঝোলানো একটা আয়না মাটিতে নামিয়ে মেঝের সাথে কাত করে রেখেছে। হয়ত সেখানেই বসে ছিল, এলিয়ে এলোচুলে কাত হয়ে পড়ে আছে। মেঝে রক্তাক্ত!
দৌড়ে একজন ছুটে গেলেন। না মেয়েটির শরীর শক্ত হয়ে নীল হয়ে গেছে, বা'হাতের কবজি কাটা। রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে।
দু-একজন মেয়ে দেখেই সেখানে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়।
পরে পুলিশ আসে, ইনভেস্টিগেশন হয়। মেয়ে ছিল পরিবারে একমাত্র আবার চার ভাইয়ের ছোট বোন। তারা নিজে থেকেও এটাকে আত্মহত্যা বলে মেনে নেন।
কেইস ক্লোজ করা হয়।
রুদ্ধশ্বাস ব্যাপার!
অতনু জিজ্ঞেস করল, " কিছু বললেন?"
-না না। মেয়েটির একটা ছবি পাওয়া যাবে? (অতনুর কাছে জানতে চাইলাম)
-না ভাই!
আমার জানামতে মেয়েটির ফ্যামিলি একজন আর তাদের পৈত্রিক নিবাসে থাকেন না। তবে তার বন্ধুরা বলতো সে নাকি প্রেতাত্মা নিয়ে চর্চা করতো!
- ও আচ্ছা। (প্রেতাত্মা, শব্দটা ভার্সিটি পড়া তরুণের মুখে শুনে আমার ভালো লাগলো না, তাই নিজে আর কথা বাড়ালাম না)
আমি মেসে ফিরলাম একা। মেস বদলাবো কাল। আজ খুব ক্লান্ত। গিয়ে ঘুমাতে হবে।
প্রবাল ভাই নিজের বাড়ি গেলেন। আমাকে বলে গেলেন সাবধানে থাকতে।
(চার)
মেসে এসে রক্তের ছোপ এক মেথর ডেকে পরিস্কার করালাম। দুদিনের নাইটে শেইভ করা হয় নি। গালে নলখাগড়া চাড়া দিয়েছে।
ড্রয়ার খুলে ব্লেড খুঁজে সেটা রেজারে সেট করে ফোম টা খুজঁছিলাম।
হঠাৎ কাঁচ ভাঙার শব্দে ঘুরে তাকাতেই হলো। দেখলাম, দেয়ালের আয়টানা একা একা পড়ে ভেঙে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার তো!
সাবধানে পা ফেলে টুকরো আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে ভয়ে আমার হৃদকম্পন শুরু হলো, বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি দিয়ে দড়াম দড়াম শব্দে পেটাচ্ছে।
একটা মেয়ে, ঠিক মহিলার মত। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। ভাঙা টুকরোর প্রতি প্রতি কোণায় সে মেয়েটি।
এলোচুলে মুখের সামনে ঢাকা।
আমি ভয়ে পালাবো না দাঁড়াবো বুঝতে পারছি না। কোন শব্দ নেই মেসের এই রুমে হঠাৎ মেয়েটি একটা হাত তুলে চুল সরিয়ে তার মুখের বীভৎস আধেক দেখিয়ে বলল, " আমাকে দেখতে চাইছিলি তো? এই দেখ!"  বলে অট্টহাসি দিয়ে আয়নার মধ্যে অন্যদিকে দৌড়ে কই যেন চলে গেল। যেন সেখানে অনেক গলি, যেমনটা ভার্সিটি পিকনিক করতে লখনৌতে গিয়ে ঠিক ভুলভুলাইয়াতে দেখেছিলাম।
এখানে বলা রাখা ভাল, এটাই সেই আয়না। শান্তনু দা' শক পেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটির সে আয়না টা এখানে এনেছিলেন। তিনি নিজেও তার প্রেমিকার মৃত্যুতে ভেঙে যান।
যদিও মেয়েটি শান্তনু দা' কে প্রায়শই বলল, "আমি খুব খারাপ নেশায় জড়িয়ে গেছি"
কি নেশা?  -জিজ্ঞেস করলে বলতো না।
আসলে সে কালো জাদু তে জড়িয়ে গেছিল, যাকে বলে " ব্ল্যাক ম্যাজিক "। আর সেজন্য মেয়েটি মুক্তির উপায় হিসেবে নিজেকেই উৎসর্গ করে আত্মহত্যা করে।
তার প্রেতাত্মা যে আয়নাতে থেকে যাবে এটা শান্তনু দা' জানতো না। অথচ, শান্তনু দা'র আত্মহত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম এই আয়না আগে থেকে মেসে ছিল।
আমরা কেউ একা শান্তনু দা'কে রাখিনি। কেউ না কেউ ছিলাম, ব্যস দুটো দিন ছিলাম না। এই ঘটনা এই দুটো দিনের ই।
ভালো কথা, আয়না টা ভেঙে গেছে। শুনেছি ভাঙা আয়নাতে মুখ দেখা বারণ।
ওটা ফেলে দিয়েছি গতকাল।
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...