মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

গল্পঃ গুরু



(এক)
টিকিট কাটা ছিল কিন্তু  এর আগের বাস ধরতে পারিনি।
ঢাকার জ্যাম আগের বাসটা ধরতে দিল না আমায়। গরম সেভাবে যদিও পড়েনি শহরে তবুও আমি ঘেমে একাকার।
আজ আমার গন্তব্য চট্টগ্রাম, আমার প্রেসের কাজে যাচ্ছি। অনেক চাপ; পদোন্নতি পাওয়ার দরুন অনেক কাজ নিজের কাধেঁ এসে জুটেছে।
এই যেমন স্পন্সর বের করা, কোথায় কোথায় ম্যাগাজিন যাবে খোঁজ রাখা, পাশাপাশি অর্থকড়ি টা।
অফিসের বস হয়েছি গেল সেপ্টেম্বর মাসে,
সেদিন মংগলবার।
বস রুমে ডাকলেন, বিভূতিভূষণ আসুন তো একটু!
গিয়ে দেখি বস বেশ রিলাক্স মুডে হাতল চেয়ারে পা তুলে বসে দিব্যি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
বস!
আরে বিভূতি! বসে যাও চেয়ার টেনে।
চেয়ারে বসে সাহস করে বলেফেললাম, " বস, আজ অনেক রিলাক্স লাগছে আপনাকে "
বস, চা খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে একটু তাকালেন। তারপর মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, বিভূতি, আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি!
অবাক হয়ে গেলাম, স্যারের কথায়। জিজ্ঞেস করলাম, "কবে স্যার?"
এ মাসে ই। আর প্রেস টা আমি তোমার নামে করে দিয়েছি। যেহেতু, আমি ফাউন্ডার তাই সবটা না দিয়ে অনলি ৭০%
আমি বিভূতি নিজের পেট আর লেখালেখি ছাড়া আর দুনিয়ার খবর খুব রাখি না। এই প্রেস আমার মত অগোছালো টাইপের একজন কে তুলে দেবেন এটা আমার কাছে স্বপ্নের মত!
কি! পারবে তো! বলে এবার কাপ টেবিলে রেখে আমার মুখোমুখি হয়ে বসলেন বস।
আমি কি বলবো ভাবতে পারছিলাম না, আচমকা এমন বড় প্রস্তাব যে কারো ঘিলু নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। আমার ও তাই দশা হয়েছে।
বস বলতে শুরু করলেন, আর আমিও মনোযোগী হলাম
" আমার মেয়ে টা সেখানে থাকে, প্রায়শই বলে সেখানে যেতে। আমার আর যাওয়া হয় না। এবার ভেবেছি একেবারে চলে যাবো "
তবে প্রেস তো আর যার তার হাতে দিয়ে যেতে পারি না। ট্রাস্টেড হাত চাই, বিভুতি আমার মতে তুমি সেই ব্যক্তি!  এখন বাকীটা তোমার আপত্তি না থাকলে।
আমি হাসি দিয়ে বললাম, " আপত্তি নেই বস, তবে একা এত বড় দ্বায়িত্ব সামলানো বেশ কঠিন হবে আমার জন্যে, আগে আপনি ছিলেন ছোটখাটো কাজে হাত দিলেই নিজেকে অনেক বড় বড় মনে হতো। এখন সত্যিকার বড় হতে হবে আমাকে। "
বস একটু হেসে বললেন, " তাহলে তোমার টেকওভার করতে আপত্তি নেই! "
না বস। বেশ কনফিডেন্স নিয়ে জবাব দিয়ে দিলাম।

এটাই প্রেসের হবার ছোটগল্প।
ব্যাগ লকারে তুলে দিয়ে ফিরলাম E2 মানে আমার সিটে। পরিবহণ আর রাস্তা নিয়ে কেউ কোনোদিন কৈফিয়ত তোলে নি, আর যারা তুলেছে তারা শুধু মুখে ফেঁনা তুলেছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি।
আমি সিটে বসতে না বসতে বাস চলতে শুরু করেছে। তাই ঝাঁকুনি খেয়ে আমার সিটে প্রায় ধপাস করে বসে গেলাম।
আমার পাশের E1 এর ভদ্রলোক দেখলাম বেশ বিরক্ত হলেন তাতে। পত্রিকার খানিকটা মুচড়ে যাওয়ার পর কিছুটা ক্রুর চোখে চাইলেন আমার দিকে।
" দেখে বসতে পারেন না! "(কাঁপা কাঁপা স্বরে কথাটা বললেন)

ভদ্রলোকের দিকে নজর ফিরিয়ে বুঝলাম, তার বয়েস আশির কাছাকাছি। কমলা কালো ফ্রেমে উত্তল লেন্সের আড়ালে পৌঁড় চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে দিনের আলোয়। হলদে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। চুলের একটিও কাঁচা নয়, ব্যাক ব্রাশ করা ধবধবে সাদা। টিভিতে দেখানো গুড়ো সাবানের বিজ্ঞাপনের মত সাদা। চোয়ালে এক টুকরো মাংসের ছিটেফোঁটা নেই। শুকনো খরখরে শরীর, তবে গলার আওয়াজ বেশ জোড়ালো!
আমি সরি বলে থেমে গেলাম, আর কিছু বলাটা প্রগলভতা!
ঘড়িতে পাঁচটা বেজে সতেরো, বিকেল করে যাত্রা আজ।
ক্লান্তি লাগছে।
জার্নিতে অলসভাব কাটে আমার, মাঝে সুযোগ পেলে বেড়িয়ে পড়ি। মনের কথা শোনা উচিত আমার মতে, মন যা চায় সেটা সে না পেলে মনের দিনকাল ভাল যায় না।  আমি মনের কথা গত মাসে থেকে শুনি নি, বেচারা রেগে আছে। এটা এক ধরনের পাগলামি বলা যায় তবুও আজকাল কে শোনে মনের কথা! সবাই তো জলজ্যান্ত রোবট।
টাইম টেবিলের চক্করে যেখানে ঘড়ি হয়ে যাচ্ছে আমাদের অভিভাবক।
স্মার্টফোনের হোমে গিয়ে ই-বুক খুলে পড়তে শুরু করলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের  ' দত্তা '।

(দুই)
 বাসের জানালা খোলাই ছিল, সবে বসন্ত এসেছে সেটা জানি কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে তে বৃষ্টির মুখোমুখি হবো ভাবিনি।
মুখতুলে আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা!
সে কি!
এতো বৃষ্টি নয়!
পাশের ভদ্রলোক জানালা খুলে বমি করছে।
তিড়িং করে উঠে দাঁড়ালাম। বাসের সুপারভাইজার এতক্ষণে এসে গেছে। পলিব্যাগ দিয়ে বাকীটা কন্ট্রোলের চেষ্টা চলছে।
আমি রেগে কূল হারিয়ে ফেলেছি। ও সিটে আমি আর বসবো না!  ব্যস!
সুপারভাইজার আমাকে কিছুক্ষণ সরি বলে বোঝালেন, " দেখুন, বয়ষ্ক মানুষ!  একটু কষ্ট করে মেনে নিন। তাছাড়া বাসে তো আর সিট ফাঁকা নেই! "
এর মাঝে দেখলাম, চিকণ করে চেক ব্লু শার্ট আর জিন্স পড়া বয়েস পঁচিশের কাছাকাছি এক যুবক, সে বয়ষ্ক ভদ্রলোক কে বাবা, বাবা ডাকে সাহায্য করতে লাগল।
আমি টিশ্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সুপারভাইজার কে বললাম, " উনার ছেলে?"
সুপারভাইজার মাথা নাড়ল।
বাস এখনো চলছে। আমি এবং সুপারভাইজার ঠায় সিটের পাশে দাঁড়িয়ে। ঝাঁকুনি দিয়ে মহাসড়ক ধরে বাস চলছে ১২০ এর উপর গতি নিয়ে।
দেখলাম, ছেলেটি, বয়ষ্ক ভদ্রলোক কে চেয়ার হেলান করে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, " সরি, আপনার ডিস্টার্ব হলো। আসলে আমাদের সিট পাশাপাশি নেয়ার কথা ছিল কিন্তু সিট পাইনি আগে বুক হয়ে গেছে। আপনি চাইলে আমরা অদলবদল করে নিতে পারি! "
আমি সম্মত হলাম।
বাসের আলো নিভে গেল। এখন বাইরে অন্ধকার পড়ে গেছে। বাসের ভেতর আলো নেই। বাইরের সব ঘরবাড়ি আমাদের কে ছেড়ে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে।

(তিন)
বেমাক্কা হর্ণে ঘুম ভাঙল।
আমাদের প্রথম স্টপেজ। কারো কিছু খেতে ইচ্ছে হলে খেয়ে নিতে পারবেন। হোটেল কে কেন্দ্র করে অনেক বাস থেমে আছে সেখানে।
আমি মুঠোফোন পকেটে পুরে বাস থেকে নামলাম।
ওয়াশরুম খুঁজে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নান আর একটা চিলি চিকেন অর্ডার করলাম।
শ'খানেক মুখ করিডোরে। কেউ হাসছে, কেউ ভীষণ ব্যস্ত, ওয়েটার ছুটছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা শুনলাম কারো কারো মুখে।
শেষ নানের একটু মুখে তুলতে না তুলতে দেখলাম করিডোরে সামান্য হইচই!
মাথা তুলতে বুঝলাম আবার সেই বয়ষ্ক ভদ্রলোক কেইস!
কার উপর যেন বমি করেছেন এবার। তাই চেঁচামেচি।
কৌতূহল জমেছে আমার মনে।
নান শেষ করে ফিরলাম সিগারেট ধরিয়ে, বাসে সিগারেট ধরানো যায় না।
একটা বাচ্চা এসে আমাকে বলল, "কাকু, তুমি এখানে কি করছো? বাসে চলো! "
আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম, " আমি তোমার কাকু? "
বাচ্চাটা ভুল করেছে দেখতে, তাই আমার সিগারেট মুখো চেহারা দেখে দৌড়ে পালাল।
আমি খানিকটা অট্টহাসি তে ফেঁটে পড়লাম।
তারপর দেখলাম, এক মহিলাকে টেনে এনে ডেকে দূর থেকে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে।
মহিলা বাচ্চাটাকে টেনে আবার চলে গেলেন।
আমি আর কাকু হতে পারলাম না।
হ্যালো!
ফিল্টার টা ফেলে দিয়ে দেখলাম। সিট এক্সচেঞ্জ করা সেই বয়ষ্ক ভদ্রলোকের ছেলেটি।
হ্যাঁ, কিছু বলবেন?
না, মানে। আপনি ঐ বমির ব্যাপারটা তে কিছু মনে করেন নি তো!
আরে না না! আমি মনেই রাখিনি। এটা হতে -ই পারে।
ছেলেটি আমতাআমতা করে বলল। আমার বাবার আসলে স্টোমাকে ক্যান্সার ধরা পড়েছে, ডায়াবেটিকস আগে ই ছিল। সব মিলিয়ে একেবারে বিপদে পড়ে গেছি।
আপনাকে দেখে চেনা মনে হচ্ছিল আমার, আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি তাই একটু আলাপ করতে এলাম।
আমাকে? দেখেছেন? হাসি মুখে বললাম, না মনে হয়। আমি আপাতত একটা প্রেসে আছি। পত্রিকায় লিখিটিখি কিন্তু ছবিতে আসি নি। আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও!
ছেলেটি এবার বলল, না না!  আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার বাড়ি নেত্রকোনা?
এবার ছেলেটির কথায় গুরুত্ব দিতে হলো। আমার আদি বাসস্থল নেত্রকোনা।
হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?
আমার বাবা সরকারি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সহকারী শিক্ষক, জীববিজ্ঞান বিভাগ।  নাম শুনে থাকবেন হয়ত,  নৃপেশ মিত্র।
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।
সে বয়ষ্ক ভদ্রলোক আমার স্যার আর আমি চিনতে পারিনি। চোখের কোণা নড়ে এলো। এ বয়েসে চোখ ভিজবে বুঝি নি।
আবেগী গলায় কাঁপা স্বরে বললাম, তুমি সুহৃদ মিত্র?
হ্যাঁ। আপনি আমার নাম জানেন?
আমি কার্তিকের মেলা থেকে একবার তোমাকে চড়কি কিনে দিয়েছিলাম তোমার মনে পড়েছে?
বিভূদা বলে বাস্পকণ্ঠে ছেলেটা দাদা বলে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো আমায়।
আমাদের কান্নাকাটি দেখে কিছু লোক সেখানে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আমি চিনতে পারিনি সুহৃদ। সরি রে ভাই! (চোখ মুছতে মুছতে বললাম)
একেবারে অনিচ্ছাকৃত ছিল।
সুহৃদ বলল, বাবা অনেকদিন আপনার কথা বলেছে। আমার এক ছাত্র বায়োলজি ক্লাসে কবিতা লেখতো, একদিন বেদম পিটিয়েছিলাম! " কবিতা লিখিস? মানুষের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস বল তো! পুরোটা বলে দিল। আমার মায়া লাগল, ছেলেটাকে আমার বাড়ি এনে দুপুরবেলা খাওয়ালাম। বড় ভাল ছেলে "
সুহৃদের কথা শুনে আমি চোখের জল আর ধরে রাখতে পারি নি।
সুহৃদ বলতে লাগল, " বাবা এখন খুব সহজে কাউকে মনে রাখতে পারেন না, হঠাৎ কিছু মনে হলে নিজে নিজে আওড়ান। নয়ত চুপ করে থাকেন, কাছাকাছি কেউ থাকলে অযথা ধমক দেন। "
রুমালে চোখ মুছে বললাম, " তুমি এখন কি করছো ভাই? "
একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে এম বি এ করেছি, এখন মাস দুয়েক ধরে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করছি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
বাসের হর্ণ দিয়েছে। ফির এলাম বাসে, সুহৃদ কে জোর করে ওর আগের সিটে পাঠালাম। আমি স্যারের পাশে বসলাম।
স্যার নিথর দৃষ্টি তুলে বাইরে দেখছেন।
আমি স্যারকে ডাকলাম, স্যার!  স্যার!
স্যার সাড়া দিলেন। আমার দিকে তাকালেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে চশমা বের করে আমার দিকে চাইলেন। বললেন, "কে তুমি বাবা? "
আমার ভেজা চোখ বলে উঠল, স্যার, আমি বিভূতি!
স্যার, আমার হাতে তার শীর্ণ হাতের মুঠোয় নিলেন।
তার মুখে অশ্রুসজল হাসি।
(সমাপ্ত)


1 টি মন্তব্য:

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...