শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬

কৃষ্ণ গহ্বর (Black Hole)





ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর আসলে কীঃ
  আমাদের চোখে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে (The observable universe) ছড়িয়ে আছে কমপক্ষে ১০০ বিলিওন ছায়াপথ।
আবার, প্রতিটা ছায়াপথে রয়েছে ১০০ বিলিওন থেকে ১০০ ট্রিলিওন Star বা নক্ষত্র। সৃষ্টির শুরু থেকেই এই তারাগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে একের পর এক ভয়ানক বিস্ফোরণ। এর বিক্রিয়ার নাম নিউক্লিয়ার ফিউশন বা সংযুক্তি বিক্রিয়া।

 একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে শক্তি হিসাবে নির্গত করে আলো, তাপ,তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি।
কিন্তু তারকা সমূহের এই জ্বালানি (হাইড্রোজেন)  একটা সময় শেষ হয়ে যায়। তখন বিস্ফোরণ, আলো, তাপ কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। সূর্যের চেয়ে ১০-১২ গুণ বা আরও বেশি ভরবিশিষ্ট নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে নিভে যায়। এই নিভে যাওয়া নক্ষত্রগুলোকেই ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর বলা হয়।

কৃষ্ণগহ্বরের শুরু কিভাবেঃ

নক্ষত্রগুলোর মধ্যে সর্বদাই নিউক্লিয়ার সংযুক্তি বিক্রিয়ার বিস্ফোরণ চলতে থাকে এবং সেই কারণেই একটা শক্তিশালী বহির্মুখী চাপ (radiation) সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট বস্তুগুলোকে (particles) নক্ষত্রের বাহিরের দিকে ঠেলতে থাকে। আবার নক্ষত্রে অধিক শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে, যা ওই বস্তুগুলোকে ভিতরের দিকে টানতে থাকে।
 এই দুই বলের কারণে তৈরি হয় একটা সুষম ভারসাম্য (সমতা) যা চলতে থাকে বিলিওন বছর ধরে কিন্তু মূল জ্বালানি হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রুপান্তরিত হতে হতে এক সময় একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়, বাকি থাকে শুধুই হিলিয়াম। তখন
পর্যায়ক্রমে কার্বন আর অক্সিজেন সংশ্লেষণ তৈরি করে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালু থাকে।

 সূর্যের মত ছোট তারকা গুলো মোটামুটি এখানেই থেমে যায়। আর যথেষ্ট ভর না থাকায় এরা কোনো বিক্রিয়া চালাতে সক্ষম হয় না ঠিক তখনই মৃত্যু ঘটে এই তারকার। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় White Dwarf. বাংলায় শ্বেত বামন।
তব্ব নিউক্লিয়ার সংযুক্তি বিক্রিয়া না চললেও
অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে এরা জ্বলজ্বল করে। বিলিওন বিলিওন বছর পরে এগুলো নীরবে ঠাণ্ডা হয়ে অন্য অবস্থায় রুপান্তরিত হয় যাকে বলা হয়
Planetary Nebula বা নীহারিকা। পরবর্তীতে এসব নীহারিকা থেকেই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন গ্রহ নক্ষত্রের।

সূর্যের চেয়ে সামান্য বড় বা কয়েক গুণ বড় তারকা গুলো আরও কয়েক ধাপে ফিউশন বিক্রিয়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এদের মাধ্যাকর্ষণ বল যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে যায় ইলেক্ট্রন আর প্রোটনকে প্রচণ্ড চাপে নিউট্রন আর নিউট্রিনোতে পরিণত করার জন্য। নিউট্রিনো অন্যন্ত গতিশীল হওয়ার কারণে এরা শূন্যে হারিয়ে যায়, রয়ে যায় শুধু নিউট্রন।

 নিউট্রনকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করার মত যথেষ্ট শক্তি না থাকায় এই তারকাগুলো এখানেই থেমে যায়। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় Neutron Star.
এদের ঘনত্ব এত বেশি হয় যে এক চা চামচ নিউট্রন নক্ষত্রের ভর পুরো মাউন্ট এভারেস্টের ভরের সমান।
 নিউট্রন স্টারের ভিতরে কিছু কিছু প্রোটন আর ইলেক্ট্রন তখনো পর্যন্ত অবশিষ্ট থেকে
যায় যা এর মধ্যে একটা শক্তিশালী Magnetic field বা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। নিউট্রন নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকে, এটা নিজ অক্ষে মিনিটে
৪০ হাজার বার পর্যন্ত হতে পারে।
 প্রচণ্ড ঘূর্ণন গতি আর শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের (Magnetic field) কারণে নিউট্রন নক্ষত্র থেকে শক্তিশালী আলোক রশ্মি নির্গত হয় যা অনেকটা  লাইট হাউজের আলোর মত। দেখে মনে হয় জ্বলছে আর। এই ধরনের নিউট্রন স্টারকে বলা হয় Pulsar.
কিন্তু সূর্যের চেয়ে ১০-১২ গুণ বা তারও বেশি ভর বিশিষ্ট তারকাগুলো তখন পর্যন্ত সংযুক্তি বিক্রিয়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরা নিউট্রনকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে বিক্রিয়া চালু রাখে। এভাবে পর্যায়ক্রমে পর্যায় সারণির সিলিকন, অ্যলুমিনিয়াম, পটাসিয়াম তৈরি করতে করতে এক সময় লোহায় এসে থামে।
এরপরে আর শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না তাই মুহূর্তেই ওই তারকার বহির্মুখী চাপ উৎপাদনকারী প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায় আররয়ে যায় শুধু মধ্যাকর্ষণ শক্তি।
যেহেতু অন্তর্মুখী বল (মাধ্যাকর্ষণ শক্তি) ছাড়া অন্য কোনো শক্তি তখন আর কার্যকর থাকে না তাই নক্ষত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আর এক সেকেন্ডের মিলিওন ভাগের এক ভাগ
সময়ের মধ্যে গোটা নক্ষত্রটা তার নিজের ভিতরেই collapse করে।
 collapse করার আগ মুহূর্তে তার
বহির্ভাগে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় যাকে বলা হয় Super Nova. আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি বড় নক্ষত্র (Super massive Stars) গুলোর ক্ষেত্রে এই
বিষ্ফোরণকে বলা হয় Hyper Nova.

এই বিস্ফোরণগুলো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের
সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বলতম বিস্ফোরণ, যার প্রথম ১ সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা আমাদের সূর্যের সারা জীবনে (নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত)
নির্গত সব শক্তির চেয়ে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে।
অন্য দিকে ভয়াবহ মধ্যাকর্ষণ বলের চাপে তারকাটা ছোট হতে হতে তার নিজের আয়তনের ট্রিলিওন ট্রিলিওন ভাগের এক ভাগের সমান আকৃতি ধারণ করে যার ফলে এর ভিতরের ঘনত্ব আর মাধ্যাকর্ষণ বল অসীম আকার ধারণ করে আর সৃষ্টি হয় এক নতুন কৃষ্ণগহ্বর।

বিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে বলে Singularity যেখানে স্থান এবং কাল হয়ে পড়ে অর্থহীন। আর চিরাচরিত
পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র অকেজো হয়ে যায়। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই নব্য সৃষ্ট এই কৃষ্ণগহ্বরের দুই পাশ দিয়ে অত্যাধিক উত্তপ্ত কণার দুটো ফোয়ারা (Super heated Particles) দুই দিকে ছুটে যেতে
থাকে আলোর গতিতে। চলার পথে এদের সংস্পর্শে আসা সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এটাকে বলা হয় Gamma ray burst.
কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই বেশি থাকে যে এর সীমানার (Event Horizon) মধ্যে যা কিছু আসে তার সবই এর ভিতরে হারিয়ে যায়। এমনকি আলোও এর আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না যার কারণে কৃষ্ণগহ্বর কখনো দেখাও যায় না, এজন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে
ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর।

তাছাড়া, প্রায় প্রত্যেকটা ছায়াপথের কেন্দ্রে অত্যন্ত বিশাল আকৃতির শক্তিশালী একটা করে কৃষ্ণগহ্বর থাকে, যেগুলো সৃষ্টি হয়েছে Big Bang এর সাথে সাথেই। কেন্দ্রের এই Super Massive Black Hole গুলো পরবর্তীতে নতুন ছায়াপথ তৈরিতে সাহায্য করে। ক্ষেত্র বিশেষে এরা এত বড় হয় যে এ যাবত আবিষ্কৃত সকল ব্ল্যাক হোলের মধ্যে
সবচেয়ে বেশি ভরের কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে আমাদের সূর্যের চেয়ে ৪০ বিলিওন বা ৪০০ কোটি গুণ ভারী

আমাদের নিজস্ব ছায়াপথের কেন্দ্রেও রয়েছে একটি
অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর যা আমাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় ২৬ হাজার আলোক বর্ষ (light years) দূরে যার আকৃতি সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০ লক্ষ গুণ ভারী।

শক্তিশালী চৌম্বক আবেশের কারণে এই কৃষ্ণগহ্বরগুলোর চারপাশে জমে থাকা ধুলোকণার মেঘ, গ্যাস ইত্যাদি প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে শক্তিশালী x-ray আর radio wave তৈরি করে যা এর দুই পাশ দিয়ে
প্রচণ্ড গতিতে রশ্মির মত বিকিরিত হতে থাকে। এই রশ্মিগুলো পার্শ্ববর্তী ছায়াপথের ধুলিকণার মেঘ, গ্যাস ইত্যাদিকে অত্যাধিক চাপ ও তাপে উত্তপ্ত করে, যার ফলে পরবর্তীতে ওই ছায়াপথে নতুন নতুন তারকারাজির সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় AGN বা Active Galactic Nucleus. সব ছায়াপথে AGN থাকে না, যেমন আমাদের কেন্দ্রীয়
কৃষ্ণগহ্বরের কোনো AGN নেই। আমরা যখন আমাদের অবস্থান থেকে এই বিকিরিতরশ্মিগুলোকে উল্লম্বভাবে দেখি তখন
একে বলা হয় Radio Galaxy. যখন কোনো কোণ থেকে দেখি, তখন একে বলা হয় Quasar বা কোয়েইজার। আর যখন আমরা সরাসরি আলোর উৎস বরাবর রশ্মির কেন্দ্রের দিকে দেখি, তখন একে বলা হয় Blazar. মূলত একই জিনিসকে ভিন্ন ভিন্ন
দৃষ্টিভঙ্গি আর অবস্থানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়ে থাকে।

কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যুঃ
ব্ল্যাক হোল নিজেই একটা মৃত তারকা, তারও আবার মৃত্যু আছে? উত্তর, হ্যাঁ!  আছে। যে জিনিষের শুরু আছে তার অবশ্যই একটা শেষ আছে। কৃষ্ণগহ্বরেরও মৃত্যু হয়। কৃষ্ণগহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ বল এতই শক্তিশালী যে এর ভেতর থেকে কোনো কিছুই (এমনকি আলোও)
বেরিয়ে আসতে পারে না। যত বেশি বস্তু কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে হারিয়ে যাবে, কৃষ্ণগহ্বরের আকৃতি দিনে দিনে ততই বড় হবে। তবে স্টিফেন হকিং এর মতে, কৃষ্ণগহ্বরও কিছু জিনিস নির্গত করে, আর তা হচ্ছে রেডিয়েশন বা বিকিরণ। তার
মতে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে প্রতিনিয়ত রেডিয়েশন বিকিরিত হতে হতে এক সময় (বিলিওন ট্রিলিওন বছর পর) কৃষ্ণগহ্বর শূন্যে মিলিয়ে (Evaporate) যাবে। মহাশূন্যের প্রতিটা জায়গায় মূহূর্তে মূহূর্তে স্বল্প সময়ের জন্য ধনাত্মক ও ঋণাত্মক ভর যুক্ত subatomic particles তৈরি এবং ধ্বংস হচ্ছে।

এই প্রক্রিয়া যখন কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের আশেপাশে হয়, তখন ধনাত্মক ভরবিশিষ্ট কণাগুলো অত্যাধিক শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিকিরিত
হয়ে যায়। বিকিরণের এই তত্ত্বকে বলা হয় Hawking Radiation. অন্যদিকে, ঋণাত্মক ভরবিশিষ্ট কণাগুলো কৃষ্ণগহ্বরের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণের কারণে এর ভিতরে পড়ে হারিয়ে যায়। ঋণাত্মক ভরবিশিষ্ট হওয়ার কারণে এরা কৃষ্ণগহ্বরের ভর খানিকটা কমিয়ে দেয়।
এভাবে বিলিওন ট্রিলিওন বছর ধরে একই প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক সময় কৃষ্ণগহ্বরের ভরও শূন্য হয়ে যাবে, আর কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যু হবে।

কিন্তু হকিং এর সমাধান বিজ্ঞানীদের বড় এক প্রশ্নের সম্মুখীন করে। কৃষ্ণগহ্বর যদি এভাবে একদিন শূন্যে
মিলিয়ে যায়, তাহলে এর ভিতরের সব তথ্যও এর সাথে চিরতরে হারিয়ে যাবে, যা চিরাচরিত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক বিধানের
সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিধান মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শক্তি সবসময় সমান থাকবে। একে কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যাবে না। আর এজন্যই হকিং এর থিওরি নতুন এক প্রশ্নের সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় Black Hole Information Paradox.

তাহলে সমাধান কীঃ

এই সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হকিং নতুন এক তত্ত্ব প্রদান করেন। তার মতে, যেসব তথ্য কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে হারিয়ে যায় তার কোনোকিছুই এর কেন্দ্রে অবস্থান করে না, বরং অবস্থান
করে তার ঘটনা দিগন্তের মধ্যে। তার মতে, এই তথ্যগুলো সংরক্ষিত হয় হলোগ্রামের আকারে। একে বলা হয় Holographic Principle. এই তত্ত্ব মতে,
ত্রিমাত্রিক কোনো বস্তুর ভিতরের প্রত্যেকটা তথ্য, দ্বিমাত্রিক তথ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব, যার মানে হচ্ছে – তথ্যগুলো হারিয়ে যাছে না,
বরং অন্য অবস্থায় রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজে বের করতে পারেননি যে
কিভাবে ওই তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
হাইলি জটিল!!

ক্রেডিটঃ অনলাইন এবং মাথার ঘাম :/

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬

গল্পঃ মেসবাড়িটা এবং অসমাপ্ত একটি গল্প





-হ্যালো! মুখর ভাই? ( ভাইব্রেশন তুলে ফোনকল টা এসেছে কামাল ভাইয়ের দৈনিক কাগজের অফিস থেকে)
কানে চেপে উত্তর দিলাম, 'বলছি!'
' বুঝেছেন ভাই, কালকের মাঝেই আপনার লেখাটা চাই, কাল না পেলে কিন্তু প্রেসে যাবে না আপনার লেখা'
'আরে ধুর! শান্ত ভাই, মিছে চিন্তা নিচ্ছেন। আজ রাতেই আবার বসছি লেখাটা নিয়ে। শেষ করেই এনেছি প্রায় '
ওকে, লেখা শেষ করে-ই আমাকে জলদি মেইল করে দেবেন প্লিজ!
আচ্ছা ভাই।
মুখর, ফোন ডিসকানেক্ট করেই  এক বুক জমানো নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল বন্ধ ঘরের ভেতর। পকেটে শুন্যতা চলছে, সোজা কথায় ক্যারিকেচার করা কার্টুনের মত পকেটে মাছি উড়া ভনভনে দশা। এই চাপ না হয় ধার কর্যে চালিয়ে দিলাম কিন্তু আগামী সপ্তাহে শুরু হচ্ছে সেমেস্টার এক্সাম, তারপর আবার প্রকাশকের লেখার তাগাদা! হা-পিত্তেশ ছাড়া দ্বিতীয় কোন অপশন আর নেই।
মেসের ঘরটায় ধূলোতে ঠাসা। মাকড়সা উঁকি দেয় যখন তখন। একটি মাত্র জানালা, সেটাও উত্তরদিকে। ওয়াল অনেক পুরোনো ক্যালেন্ডারে ঠাসা। একের পর এক ক্যালেন্ডার বসেছে অথচ পুরোনো টা না সরিয়ে।
ঘরের ঝুল পড়া দেয়ালে মিকি মাউসের ছবিটা কে এঁকেছিল কেউ জানে না। তবে গত কুঁড়ি বছরে মেসের দেয়ালে রঙের কোন ছোঁয়া লাগে নি। দেয়ালের পূর্ব কোণে বাংলায় গোটা অক্ষরে একটি নাম লেখা। হয়ত, বিদায় নেয়া এক মেস সিনিয়র তার ভালোবাসাযুক্ত আবেগে এক থোকা পানের পেঁচকি দিয়ে নিজের নাম লিখে রেখে গেছে। তাই লিখা 'আখতার ' ১৯৮৯ নাম এখনো দৃশ্যমান। এদিক সেদিকে দৃশ্যমান মেসের জরাজীর্ণতা।

 মুখর  মনোবিজ্ঞানের ছাত্র, জগন্নাথে তার সেভেন সেমেস্টার চলছে; পাশাপাশি লেখালেখি। ভার্সিটির হলে থাকার বিন্দুমাত্র জো নেই, যদিও সে সিনিয়র তবুও নাক টেপা চেহারায় ছোট্টখাট্ট প্রথম বর্ষের রাজনীতি করা বাচ্চা ছেলেটির ক্ষমতা অন্ততপক্ষে মুখরের চেয়ে ঢের বেশী। তাই হলের সিট অতি সসম্মানে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন গ্যাঁটের টাকা খরচ করে জায়গা হয়েছে পুরোনো ঢাকার চিপা গলিতে লেনের পাশে বেঁচে থাকা পুরোনো দালানের এই ব্যাচেলর মেসে।
এক রুমে গাদাগাদি করে তিনজন, কপাল ভাল রুমে একজন কমেছে। গত মাসেই একজনের চাকরি জুটেছে তাই তিনি মেস ছেড়েছেন। দম ফেলার জায়গা হয়েছে, তাও বেশীদিনের জন্য নয়। আজ সকালেই  পান চিবাতে চিবাতে মেসের কেয়ারটেকার অবশ্য  নতুন কোন মেস মেইট খোঁজার তাগাদা দিয়ে গেছে। আরো বলে গেছে, 'না পেলে গলির মাথায় মাংস বিক্রেতা আমাদের সাথে সামনের মাসে মেস মেইট হবে।' অপেন থ্রেট!

  মুখর সহ আরো দুজন মিলে মোট তিনজন। বাকী দুজনের মাঝে একজন আরিব্বাই, মানে ভার্সিটির আরিফ ভাই গত দু'বছর ধরে বিসিএস দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এবারে তিনি নিশ্চিত তার বিসিএস গেঁড়ো কাটলো বলে। আরেকজন, শিমুল। প্রচন্ড মাত্রায় হতাশ, তাকে দেখে পৃথিবীর সর্বশেষ হতাশাগ্রস্ত মানুষটি খিলখিল করে হেসে ফেলবে এটা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। আমি তার নাম দিয়েছি শিমুলাতাশ! আরিব্বাই নামটাও আমার দেয়া।
শিমুলাতাশ ভাই নিয়ম করে প্রতিদিন দুটো সিগারেট খায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর মধ্যরাতে শোবার আগে। পিকুলিয়ার টাইপের ছেলে। মাথায় লম্বা চুল, মুখে লম্বা দাড়ি। লালন ফকিরের ভীষন ভক্ত। চাঁদনী রাতে গলা ছেড়ে গানও গায়। তখন ঢাকায় বিদ্যুৎ থাকে না। বৃষ্টির দিনে রবীন্দ্রসংগীত। ভাইয়ের গলা মাশাল্লাহ ভাল। ঢাকা, অদ্ভুতুড়ে শহর আমার, গরমে লোডশেডিং হয় তুঙ্গে আর বৃষ্টির দিনে রাস্তাঘাট হয়ে যায় খাল। যাক সে কথা, বলছি শিমুল ভাইয়ের কথা। শিমুল ভাই লোক ভাল। ভাল লোকের নাকি দুঃখ্য বেশী।
এইত সেদিনের ঘটনা, সকালে ক্লাস ছিল বলে টেবিল ল্যাম্পের আলো নিভিয়ে সবে ঘুম দেব বলে বিছানায় শুতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বলা কওয়া নেই, বাইরে থেকে এসেই কান্নাকাটি জুড়ে দিল শিমুল ভাই। বেকার মানুষ সারাদিন পথে পথে ঘুরে, রাস্তায় এক ছেলেকে কাঁদতে দেখে পকেট চালানোর দুশো টাকা দিয়ে এসেছেন ছেলেটিকে। এখন তিনি অতিমাত্রায় কেঁদে যাচ্ছেন। ঘুমের বদলে তাকে দিতে হলো শান্তনা, কারন এই মাসে তার মেসের বিল মেটাতে হবে আমাকে-ই।
এক গ্লাস পানি ঢোক ঢোক শব্দে গিলেই বসে গেলাম টেবিলে। প্রেসের গল্পটা আজ শেষ করতেই হবে। ঘড়িতে বাজে রাত প্রায় সোয়া ১১ টা।
কাগজ কলম নিয়ে গল্পের প্লট ভাবছি হঠাৎ পেছন থেকে আরিব্বাই এসে কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, 'কি রে? কাগজ নিয়ে বসে গেলি? '
'হ্যাঁ ভাই, '
'তুই পারিস ও বটে '
এইত ভাই!
মৃদ্যু একটা 'হুম' বলে মশারির নীচে চলে গেলেন চুপচাপ। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, শিমুল ভাই তার বিছানায় নেই, উঠোনে বসে তিনি রুটিনবাঁধা দ্বিতীয় সিগারেটের নেশায় ডুবে আছেন, তার পোড়া গন্ধ নাকে আসছে। সস্তা বিড়ির গন্ধ, আজো হয়ত কাউকে পকেটের সব দিয়ে এসেছেন ভালোবেসে।

প্রায় মিনিটের ত্রিশেক ধরে বসে আছি কিন্তু কোন আইডিয়া কাজ করছে না। ঘড়িতে দুটোর কাটা ছুঁইছুঁই, আরিফ ভাই নাক ডাকছেন, শিমুল ভাইও আধা ঘন্টা আগে দরজা ভিজিয়ে চলে গেছেন  গভীর ঘুমে। ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন সেপ্টেম্বর মাস, হালকা শীতের হাওয়া গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল মেসের উত্তরদিকের খোলা জানালা ভেসে। আমার সামনে-ই জানালা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে মাঝে মাঝেই। লেখালেখির চল্লিশা চলে।

'কি? ঘুমাচ্ছেন? '
আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেছে, ঘুমে চোখ ধরে এসেছিল হয়ত। বুঝলাম, চেয়ারে ঘাড় কাত করে অবচেতনে পড়ে ছিলাম। সারাদিন গেছে দৌড়ের উপর; ক্লাস, এসাইনমেন্ট, টিউশানি ব্লা ব্লা। তবে যে কন্ঠটা শুনে ঘুম ভেঙেছে তাতে জানলা ভেদ করে গায়ে লাগা মৃদ্যু ঠান্ডা বাতাস আরো ঠান্ডা ঠেকল।
সে কি! নারী কন্ঠ? ভুল শুনছি! কই না তো!
আমার সামনের জানালার বাইরে এক নারীমুখ দাঁড়িয়ে। স্বপ্নটপ্ন দেখছি না তো!
বিষ্ময় কাটল দ্বিতীয় ডাকে,
'ঘুমাচ্ছিলেন বুঝি?' কন্ঠটা আবার জিজ্ঞেস করল।
এবার ভয়ে গা শিউরে গেল, লালদেয়াল ঘেরা মেসখানা অনেক পুরোনো। উত্তর দিকের জানালা ঘেরা দিকটা ফাঁকা বটে তবে ওদিকে কেউ যায় না। কিন্তু এত রাত্রে এই নারী সেখানে কি ই বা করছে?
আশ্রয় না পেয়ে অনেকেই এমন থাকতে পারে তবে সেটা নিতান্ত অমূলক!
তবে কি ভূতের পাল্লায় পড়লাম?
সে হতে পারে কিন্তু তাই বলে মেসে ভূত কিংবা ভৌতিক কিছু ঘটেছে এর আগে তেমন শুনিনি। ভৌতিক ব্যাপার নাও তো হতে পারে! একে একে দুই মেলালাম আমি।
'শুনছেন? ' (আবার ডাক দিল অচেনা গলা)
চেয়ারের হাতল চেপে সোজা হয়ে বসলাম, চোখ গেল লোহার শিকের উপারে জানালার বাইরে। সেখানে দেখলাম আবছা আলোয় একজন নারী দাঁড়িয়ে, ভালোভাবে বলতে গেলে বয়েস আন্দাজ তরুণী-ই হবে। চেহারা সম্ভ্রান্ত, আধাঁরে বোঝা না গেলেও এটি সুস্পষ্ট মেয়েটি ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
'আমাকে বলল, একগ্লাস জল হবে? ভীষন তেষ্টা পেয়েছে '
পুরুষ মেসে নারী! কেলেংকারি!
 তাও আবার এত্ত রাত্রে? মারাত্বক স্ক্যান্ডেল হয়ে যাবে! কি করব তাই ভেবে পাচ্ছি না এখন।
আরিফ ভাই আর শিমুল ভাইকে ডাকার সাহস পেলাম না। পিছন ফিরে দেখলাম দুজন-ই অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তার মানে, আমি ছাড়া মেয়েটির গলা কেউ তাহলে আর কেউ শোনেনি! জল খাইয়ে মানে মানে বিদেয় করি তবে।
  জানালার বাইরে আগন্তুক মেয়েটি হিন্দু ঘরের সেটা বুঝতে আমার ভুল হয়নি। মেয়েটি 'জল খেতে' চাইছে বলল যখন!
জল আনছি বলেই,
 আমি চেয়ার ঠেলে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যতটা দেখছিলাম তাতেই সোজা দেখতে দেখতে চুপিচুপি বিড়ালের মত পা ফেলে এগিয়ে গেলাম মেঝেতে রাখা পানির জগের দিকে। এক গ্লাস পানি ঢেলে গ্লাস হাতে ফিরে এলাম আবার টেবিলের কাছে জানালায়, যেখানে জানালার বাইরে মেয়েটি তখনো দাঁড়িয়ে।
পানির গ্লাস হাতে নিয়েই এক ঢোকে গ্লাস খালি করতে সময় নিল না অচেনা মেয়েটি। খালি গ্লাসটা এগিয়ে দিল এবার আমার দিকে, মেয়েটির হাতে চোখ গেল এবার। নতুন সাদা রঙের শাঁখা, সেটা আবছা আধাঁরেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আঙুলে লাল আলতা দেয়া মনে হয়, তবে আলতা এভাবে পুরো হাতে কেউ দেয় আগে দেখিনি।
জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কে? এখানে কি করছেন? কি হয়েছে আপনার? এখানে এত রাতে? জানেন তো এটা ছেলেদের মেস কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! '
মেয়েটি উত্তরে তার নাম বলল না, শুধু বলল, 'এটা (মেসবাড়িটা) আমার স্বামীর বাড়ি। আমি তার স্ত্রী, গতকাল রাতে বরিশালের বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছি কিন্তু আপনারা এখানে কি করছেন? '
মেয়েটি পাশাপাশি শাসানোর ভংগিতে ওর হাতের আঙুল জানালা গলিয়ে ভেতরকার আরিফ এবং শিমুল ভাই দুজন কে দেখিয়ে বলল, 'এরা কারা? আমি ক'দিন নেই তাই জবরদখল! '
আমি কি বলব, তখনো বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড মাত্রায় কপাল বেয়ে ঘাম দরদরিয়ে ঝড়ছে, আমার জানামতে এই বাড়ি প্রায় শ'বছরের পুরোনো। আগে কোন এক জমিদারের ছিল বলে শুনেছি, তবে এ বাড়ি স্বাধীনতার পরপর বর্তমান মালিক তার নিজের নামে করে আছেন প্রায় চল্লিশ বছরের বেশী। তবে ইনি কে? নিজের স্বামীর বাড়ি বলে দাবী করছেন?
ঘুমন্ত ভাই ব্রাদারহুড কে চেঁচিয়ে ডাকার মত গলায় আওয়াজ পাচ্ছি না। যদিও আরিফ ভাই.. আরিফ ভাই..... বলে দু'বার ডেকেছি কিন্তু নিজের গলা নিজেই শুনি নি।
মেয়েটি তখনো জানালার বাইরে, বুঝে গেছে আমি ভয় পেয়েছি।
শান্ত গলায় বলল, 'ভয় পাচ্ছেন কেন? '
নিজেকে শান্ত রাখার কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না একটি বারও।
মেয়েটি বলে চলল, পরশু গিয়েছিলাম বাপের বাড়ি। উনি টেলিগ্রাম করলেন।
(আমিও কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলাম, টে.. টে.. টেলিগ্রাম?)
'হ্যাঁ। লিখেছেন, দেশের অবস্থা ভালো না জলদি ফিরে আসো। আমিও আর দেরি করতে পারলাম না বাড়িতে সোজা লঞ্চে চলে এলাম কিন্তু পথে লঞ্চটা ডুবে গেল, জানেন?
বললাম, 'কিন্তু কই? দেশে তো কিছু... ?'
কি বলছেন যা তা! স্বাধীনতার কথা শোনেনি? সবচেয়ে বড় কথা লঞ্চ ডুবে গেছে শব্দটি কানে গেলেও খেয়াল করতে পারি নি।
মেয়েটি এখন আর কথা বলছে না, অদ্ভুত এক নিঃশব্দ বিদঘুটে হাসি দিচ্ছে।
আমিও এবার সম্ভিত ফিরে পেয়েছি, ইনি যে মানুষ নন আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে আর দেখাতে হবে না। নার্ভ চেপে চেয়ারের হাতল শক্ত করে বসে আছি। বেশীক্ষণ আর থাকা যাবে না হয়ত। নার্ভাস ব্রেক ডাউন এবার সময়ের ব্যাপার!
তবুও মেয়েটির কথা শুনে যাচ্ছিলাম। মেয়েটি  এবার জানালার শিকের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। মেয়েটির সাথে আমার দূরত্বটা এখন আমার পড়ার টেবিল ব্যবধান!
মেয়েটি কি বলছে এখন আর শুনতে পাচ্ছি না, কেবল তার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখছি। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে, বুঝলাম জ্ঞান হারাচ্ছি। শেষ শুধু হাসিটা শুনতে পাচ্ছি..
জ্ঞান হারানোর আগে যতটা অনুভূতি কাজ করছিল তাই নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'সত্যি করে বলুন তো আপনি কে? '
উনি শব্দহীন একটা হাসি দিয়ে বললেন, 'আমি শ্রীমতী '। এই মেসবাড়ির গিন্নী গো! (হাসির শব্দ)
মুখর চেয়ারসহ ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।

(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...