বুধবার, ১ মে, ২০২৪

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

 

সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google)


পৃথিবী কেন গরমঃ

                      ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ্রিজের কোক আছে। দুটোতেই দুই হাতের দুটো আঙুল অল্প সময়ের জন্য ডুবিয়ে দেখা যেতে পারে। এতে বোঝা যাবে চা গরম এবং কোক ঠান্ডা। এবার দুটো কাপই টেবিলে রেখে দেওয়া যাক কিছুক্ষণের জন্য। কয়েক ঘণ্টা পর আবার আঙুল ডোবালে দেখা যাবে চা আর গরম নেই এবং কোকও আর ঠান্ডা নেই। দুটোই একই তাপমাত্রায় চলে এসেছে, যাকে আমরা ঘরের তাপমাত্রা বলি। ঘরের তাপমাত্রা বলতে আমরা পরিবেশের তাপমাত্রাকে বোঝাই।

গরম চা কীভাবে ঠান্ডা হলো? শুরুতে চায়ের ভেতর এমন একটা কিছু ছিল, যা এখন নেই, একে আমরা তাপ বলি। তাপ একধরনের শক্তি, অন্যভাবে বলা যায় শক্তির একটি রূপ হলো তাপ। আর ঠান্ডা বা গরমের যে অনুভূতি, তাকে বলি তাপমাত্রা। একটি বস্তু শূন্য কেলভিনের (প্রায় মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ওপর থাকলেই তাপ বিকিরণ করতে থাকে। এই বিকিরণের মাত্রা নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার ওপর, বস্তুর তাপের ওপর নয়। বিকিরণ করার মানে হলো, তাপ হারানো। কাপের চা তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে গেছে।

এবার প্রশ্ন হলো ঠান্ডা কোক কীভাবে ঠান্ডা থেকে ঘরের তাপমাত্রায় এল? কোকের তাপমাত্রা কম থাকলেও তা শূন্য কেলভিন নয়। সুতরাং কোকও তাপ বিকিরণ করেছে। তারপরও কোক কীভাবে আগের চেয়ে গরম হলো? কারণ, বস্তু একই সঙ্গে তাপ বিকিরণ করে (এখানে শুধু বিকিরণ অংশটা ধরছি। বিকিরণ ছাড়াও একটি বস্তু আরও দুটি উপায়ে তাপ হারাতে পারে, যেগুলোকে পরিচলন এবং পরিবহন বলে। পৃথিবী কেন গরম, এর ব্যাখ্যার জন্য মূলত বিকিরণই প্রয়োজন) এবং তাপ গ্রহণ করে বা শোষণ করে। কোথা থেকে তাপ গ্রহণ করে? বস্তুর পরিবেশ থেকে। যেমন কোক তাপ গ্রহণ করেছে আশপাশের বাতাস থেকে, আসলে পুরো পরিবেশ থেকেই, যে পরিবেশে আছে টেবিল–চেয়ার, ঘরের দেয়াল। তার মানে কোকভর্তি কাপের আশপাশে যা কিছু আছে এর সব কিছু থেকেই কোক তাপ গ্রহণ করেছে। কোক তাপ হারিয়েছে এবং কোক তাপ গ্রহণ করেছে; কিন্তু কোক বেশি তাপ গ্রহণ করেছে এবং তাপ অল্প হারিয়েছে। সে জন্যই কোকের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চা তাপ বেশি হারিয়েছে এবং অল্প তাপ গ্রহণ করেছে। তাপ বেশি গ্রহণ করবে, না তাপ বেশি হারাবে, তা নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রা এবং পরিবেশের তাপমাত্রার পার্থক্যের ওপর। সারাক্ষণই একটি বস্তু এবং এর পরিবেশের মধ্যে তাপের আদান-প্রদান চলছে। এমনকি যখন বস্তু এবং পরিবেশ দুটোই একই তাপমাত্রায় তখনো তাপের আদান–প্রদান চলছে। এ অবস্থায় বস্তু যে হারে তাপ হারাচ্ছে ঠিকই একই হারে তাপ গ্রহণ করছে। ফলে বস্তুর তাপমাত্রার কোনো হেরফের হচ্ছে না। এর মানে হলো প্রতিটি বস্তুই একই সঙ্গে তাপ হারাচ্ছে এবং তাপ গ্রহণ করছে (তাপ হারাতে হলে বস্তুর তাপমাত্রা অবশ্যই শূন্য কেলভিনের বেশি হতে হবে)।

সূর্যের তাপ বিকিরণ (ছবিঃ Google)


এবার চলে যাই বিকিরণে। বিকিরণ হলো তরঙ্গের মাধ্যমে তাপ নির্গত করা। আলো যেমন তরঙ্গ, ঠিক তেমনি তরঙ্গ দিয়ে একটি বস্তু তাপ বিকিরণ করে। একটি তরঙ্গের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে, একটি হলো এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং অন্যটি কম্পাঙ্ক। বিকিরিত তাপের বেগ আলোর বেগের সমান। তার মানে তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে কম্পনসংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই আমরা তরঙ্গ বা আলোর বেগ বের করতে পারি। শূন্য মাধ্যমে আলো ১ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার যায়।

যেহেতু তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্কের গুণফল একটি নির্দিষ্ট রাশি, যা কিনা আলোর বেগ, শুধু তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা শুধু কম্পাঙ্ক নিয়ে কথা বললেই চলে। আমরা এখানে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে কথা বলব। এখন ইলেকট্রিক হিটারের কয়েলকে গরম করতে থাকলে কয়েল থেকে তাপ বেরিয়ে আসতে থাকবে এবং এর রংও বদলাতে থাকবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। হিটারের কয়েল যত বেশি গরম হতে থাকবে, তত কম দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ বিকিরণ করবে। আমাদের চোখে নির্দিষ্ট সব ধরনের তরঙ্গ দেখা যায় না। সে জন্য অল্প তাপমাত্রায় থাকলে আমরা হাত দিয়ে ধরলে গরম বুঝি, কিন্তু চোখে কোনো আলো দেখতে পাই না। কিন্তু বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে এই আলো ঠিকই দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হলো পৃথিবী গরম কেন?

মজার বিষয় হচ্ছে, কাচের ভেতর দিয়ে সব ধরনের তরঙ্গ যাতায়াত করতে পারে না। সূর্যের আলোর মধ্যে অনেক অনেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ থাকে। এর একটি অংশ আমাদের দেখার কাজে লাগে। সূর্যের আলোর বড় অংশটি সহজেই কাচের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। যার ফলে কাচের জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর আলো ঢুকে পড়ে। এখন ধরি জানালা বন্ধ আছে এবং জানালায় কোনো পর্দা নেই। কাচের জানালা দিয়ে ঘরে আলো ঢুকে পড়েছে। আলোর কারণে ঘরের ভেতরের জিনিস সব গরম হয়ে গেল বা তাপমাত্রা বেড়ে গেল। এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ওরাও বেশি হারে তাপ বিকিরণ করতে থাকে। কিন্তু ওগুলোর তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়তে পারে না। ফলে ওদের বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়, যা কাচের জানালা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে না। তার মানে হলো ঘরে তাপ ঢুকছে (আলো হিসেবে) কিন্তু ঘর থেকে তাপ বেরিয়ে যেতে পারছে না, যদিও তাপের সামান্য অংশ বের হতে পারে। ফলে ঘরের ভেতরটা বাইরের চেয়ে গরম থাকে। ঠিক একইভাবে গরমের দিনে গাড়ি অনেকক্ষণ রোদে থাকলে, গাড়ির ভেতরটা বাইরের চেয়ে অনেক গরম হয়ে যায়। শীতপ্রধান দেশে কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘর বানিয়ে ওর ভেতর সবজি চাষ করা হয়। এগুলোকে গ্রিনহাউস বলে। এ ধরনের ঘরগুলো কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা থাকে বলে বাইরের সঙ্গে বাতাসের আদান–প্রদান হয় না। এতে করে ভেতরে যদি কোনো তাপের উৎস থাকে, যেমন হিটার, তাহলে তাপ সহজে বাইরে যেতে পারে না। যার ফলে ঘরের ভেতরটা বাইরের থেকে গরম থাকে এবং গ্রিনহাউসগুলোকে সবজি চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রায় রাখা হয়। বড় তরঙ্গের আলো যে কাচ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না, এটাও গ্রিনহাউস গরম রাখতে সামান্য একটা ভূমিকা রাখে বটে!

পৃথিবীর চারদিকে যে বায়ুমণ্ডল, তা অনেকটাই কাচের মতো কাজ করে। পৃথিবীর চারদিক বায়ুমণ্ডল প্রায় এক শ কিলোমিটার বিস্তৃত বলে ধরা হয়। কিন্তু এর বেশির ভাগই (ভর অনুপাতে প্রায় ৯০ শতাংশ) আছে ১৬ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে। এর ভেতর দিয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ যাতায়াত করতে পারে, কিন্তু বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ অত সহজে যাতায়াত করতে পারে না। বায়ুমণ্ডলের কারণে সূর্যের আলোর বড় একটি অংশ প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। কিছু অংশ বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে আসে। এতে পৃথিবী (মাটি, নদী, গাছ ইত্যাদি) তাপ গ্রহণ করে গরম হয়। গরম হলেই তাপ বিকিরণ শুরু করে, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়, এদের বেশির ভাগই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবী গরম থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে বায়ুমণ্ডল হলো পৃথিবীর কম্বল, যা পৃথিবীর তাপ ধরে রাখে। এ কারণেই পৃথিবী বেশ গরম, যা আমাদের জন্য সহনীয়। পৃথিবীর চারপাশে যদি বায়ুমণ্ডল না থাকত, তাহলে দিনের বেলায় সরাসরি সূর্যের আলোতে তাপমাত্রা এমন হতো যে আমরা পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম, আর রাতের বেলায় তাপমাত্রা এত কম হতো যে আমরা সবাই শক্ত বরফ হয়ে যেতাম।

বায়ুমণ্ডলে অনেক ধরনের মৌল এবং যৌগ আছে। যেগুলো তাপ চলাচলে ভূমিকা রাখে। এদের মধ্যে একটি হলো কার্বন ডাই অক্সাইড। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে তাপ সহজে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যে যেতে পারে না। ফলে তাপ পৃথিবীতেই আটকা পড়ে থাকে এবং পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের জোগান দেয় প্রাণিজগৎ (নিশ্বাস) এবং কলকারখানা। কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। যেটুকু বাড়বে তা আমাদের সহ্যক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর পানির একটা অংশ জমাট বরফ হয়ে আছে (পর্বতগুলোতে এবং মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ)। সামান্য তাপমাত্রা বাড়তেই জমাট বরফ একটু বেশি হারে গলতে থাকবে এবং নদীপথে এসে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। ধারণা করা হয়, এর ফলে পৃথিবীর নিচু অঞ্চলগুলো ডুবে যাবে। তখন নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। পৃথিবী (আসলে মহাবিশ্বই) চমৎকার একটি তাপীয় সাম্যাবস্থায় আছে, এর সাম্যতা সামান্য নষ্ট হলেই বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে এবং অনেক অনেক দিন পর নতুন করে ভিন্ন একটি সাম্যাবস্থা তৈরি হতে পারে। যে সাম্যাবস্থায় মানুষের অস্তিত্ব না–ও থাকতে পারে।

এখন তীব্র গরম। সারা দেশ জ্বলছে। তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরী। দিনের বেলা বের হলেই প্রচণ্ড গরমের আঁচ লাগছে গায়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদের তীব্রতা যত বাড়ে, গরমে নগরবাসীকে ততটাই গলদঘর্ম হতে দেখা গেছে। পরিত্রাণ কোথায়? কেনই বা বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা?

কেন এবং কিভাবে বেড়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রাঃ

তাপমাত্রার উঠানামা (ছবিঃ Google)


                    উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয় বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড আর অন্য কয়েকটি গ্যাস। প্রায় একশ বছর আগে বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে দ্রুত। গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যত পৃথিবীর বড় বিপদ ডেকে আনছে। অতএব সাবধান।”

আরহেনিয়াস ছিলেন একজন সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি ১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯০৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আরহেনিয়াসই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে বাতাসে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সরাসরি সম্পর্ক আছে। বাতাসে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন আছে ৯৯ ভাগ, বাকি এক ভাগের মধ্যে আছে অল্প পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড। ভূপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ নিঃসরণ হয় তা শুষে নেয় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প, পৃথিবীর তাপমাত্রা তাই বেড়ে যায়। এ কারণেই পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে পৃথিবীতে প্রাণ-প্রকৃতির উদ্ভব হয়।

আরহেনিয়াস হিসাবপত্র করে দেখিয়েছেন যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যদি হ্রাস পেয়ে অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি হ্রাস পেতে পারে। এতে পৃথিবীতে আবার বরফযুগ শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে কী হবে? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাবে, জলবায়ুর বড় পরিবর্তন আসবে।

আরহেনিয়াস প্রায় একশ বছর আগেই আমাদের সাবধান করেছিলেন, কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। তাই আজ বিশ্ব উষ্ণায়ন। দেশে দেশে ভয়ংকর ঝড়-বাদল-তুফান-খরা-বন্যা ঘটে চলেছে। অনেক দেশ জলে ডুবে গেছে, ডুবতে বসেছে বহু দ্বীপরাষ্ট্র। পরিত্রাণ কোথায়? তার আগে অন্য প্রশ্ন। কোন কৌশলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল বা সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়? গ্যাসটি তাপ শোষণ করে রাখে বলেই এমনটা ঘটে। কেমন করে?

উত্তর লুকিয়ে আছে গ্যাসটির রাসায়নিক গঠনে। তিনটি মাত্র পরমাণু, একটা কার্বন আর দুটো অক্সিজেন দিয়ে তৈরি রাসায়নিক যৌগ কার্বন ডাই-অক্সাইড। গ্যাসটি শুষে নেয় অবলোহিত আলো বা ইনফ্রারেড লাইট। সূর্যের সাত রঙের বর্ণালিতে দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর। কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। ফলে বাতাস উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না গিয়ে মাটিতে ফিরে আসে, যাকে আমরা গ্রিনহাউস ইফেক্ট বলি। গ্রিনহাউস গ্যাসের অন্য সদস্যও করে এমন কাজ। তবে ভূপৃষ্ঠে তাপ ফিরিয়ে আনার কাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইড আর জলীয় বাষ্পের।

তীব্র দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত (ছবিঃ Google)


আশ্চর্য ঘটনা! নেপথ্যের কারণটাও জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস। বলছেন, বাতাস দুভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হওয়ার সময়- যাকে বলা হয় ‘সিলেক্টিভ ডিফিউশন’ এবং তাপ শোষণ বা অ্যাবজর্পশনের মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদানগুলোয় যেমন দুই পরমাণুর নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনে তাপের প্রভাবে কম্পন ঘটে। অর্থাৎ দুই পরমাণুর মধ্যকার বন্ধনীর কম্পন। ফলে প্রচুর পরিমাণ তাপ শোষণ করতে পারে তারা।
কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প তাপ গ্রহণ করে শোষণ প্রক্রিয়া বা অ্যাবজর্পশনে। এদের (CO2) পরমাণুগুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত বা হিট ইনফ্রারেড অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা একটি অণু তাপমোচন বা ইমিশন করলে আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে। অর্থাৎ তাপ ধরে রাখতে পারে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড অনু (CO2)
তাহলে তাপ থেকে পরিত্রাণ পাবো কীভাবে? পরিত্রাণ গাছের কাজকর্মে। বৃক্ষই পারে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কমিয়ে রাখতে। কেমন করে? বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে নিজের খাদ্য বানায় গাছ, যাকে ফটোসিন্থেসিস বলে। এ প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় অক্সিজেন। বায়ুমণ্ডল শুদ্ধ করার প্রাকৃতিক সম্পদ গাছ, বৃক্ষসমৃদ্ধ অরণ্য।

পরিত্রাণের উপায়ঃ

        এমন জেনেও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অরণ্য ধ্বংস করছি আমরা। আমাদের দরকার গাছ লাগানো, বৃক্ষ সম্পদ নষ্ট না করা। গাছ লাগানো মানে যে কোনও গাছ। বড় বৃক্ষ না হোক, বাঁশ-ঘাস-লতা হলেও নিজ গুণে সেই উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেবে। অর্থাৎ আমাদের অক্সিজেন জোগাবে, ধরণী শীতল হবে।

পানি পান অত্যন্ত জরুরি (ছবিঃ Google)


গাছ লাগানোর সুযোগ না থাকলে আমাদের অন্য উপায়ও আছে। ফল খেয়ে তার বীজ নষ্ট না করা। বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে মাঠে প্রান্তরে, বাসে বা রেলপথে যেতে যেতে। কিছু পড়বে পাথরে, রুক্ষ মাটিতে। কিছু পড়বে সঠিক মৃত্তিকায়, জন্ম নেবে গাছ।
শহরে নিশ্চিতভাবেই অনেক গাছপালা দেখা যায় না। ফুটপাত, রাস্তা আর উঁচু ভবন শহরের স্বাভাবিক দৃশ্য। এগুলো ইট, সিমেন্ট, কাচ, ইস্পাতের মতো উপকরণ দিয়ে তৈরি। সাধারণত খুব গাঢ় রঙের হয়। কালো, বাদামি আর ধূসর রং দেখা যায়। কালো বস্তু আলোক শক্তির সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে তাপে রূপান্তরিত করে। বিপরীতে সাদা বস্তু আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। আলো তাপে রূপান্তরিত হয় না এবং সাদা বস্তুর তাপমাত্রা তেমন বাড়ে না। শহরের রাস্তা কালো পিচের তৈরি। ছাদগুলো ধূসর আবরণ দেওয়া। উত্তাপের বড় অংশ আসে এসব স্থাপনা থেকে। বিল্ডিংয়ের উপকরণ শহর এলাকায় তাপ আটকানোর আরেকটি কারণ। অনেক আধুনিক বিল্ডিং উপকরণের কারণে পৃষ্ঠতল থেকে পানি ইট বা সিমেন্টের প্যাঁচে পড়ে ওপর থেকেই বাষ্প হয়ে যায়। ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হতে পারে না। গ্রামে উদ্ভিদের মাধ্যমে যেমন এলাকা ঠান্ডা হয়, শহরে বড় জলাধার তৈরি আর মাটি দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে তাপমাত্রা কমতে পারে। তাছাড়া,  বৃক্ষরোপণ ব্যতীত আর কোন দ্বিতীয় এবং কার্যকরী উপায় আপাতত আর নেই।


শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

হায়ারোগ্লিফের দেশে (বই রিভিউ)

 


হায়ারোগ্লিফের দেশে- অনির্বাণ ঘোষ

There are very few Bengalis who are not curious about the country of Egypt. A civilization that is more than five and a half thousand years old, with which the names of many Pharaohs and gods are associated. Pyramids, mummies, sphinxes and more! What thrilling narratives are interwoven with its history. Again, in the city of Calcutta on the banks of the Hooghly river, there are countless Egyptian miniatures. How many people keep his news! In the 'Land of Hieroglyphs' came stories some of which are known, and most of which are unknown. The capital of this book is not the gloss of dry history, but the story of a lost time told in the form of a sweet yet digestible story. He has more than 200 pictures, some of which are rare. There are very few such books in Bengali language. Better pictures, better pages, brighter prints.



Our knowledge of the history of the city of Egypt is limited. In the "Met Museum" of New York, you can see Egyptian hair brushes, mason jars, and straw sticks. It seems that people had these things in their hands a few days ago. That man is no longer alive, his son, daughter, grandson, daughter-in-law, great-grandson are nowhere to be found. Maybe life was as chaotic then as it is today, maybe it wasn't, no one knows. Now only a few things remain. And those things seemed to hold those departed souls, as if they had never left, but were whispering around us in the guise of wind.


In this book we see the thoughts of Egyptian architects at that time. How man can build an unforgettable creation by building stone upon stone, how he can overcome all the adversities with the power of intellect in his unique signature book. We learn about Imhotep, who built the Step Pyramid.


We see the common people of Egypt, their life, their dress, their language. The book also details their writings. Hieroglyphs sit at the tail end of the world's writing history.


There are also references to the monotheism that was practiced in Egypt, and light touches on the sinister entanglement of religion and politics. It amazes me to think that people's character remains almost the same even after passing through time.


The book will satisfy all those interested in Egypt. Along with that more than 200 pictures have enriched. There are many things in the book, which I have never heard before. For example: I used to know that Cleopatra was very beautiful. But after reading the book I came to know that although she was not very beautiful in appearance, she was intelligent and very beautiful in terms of personality. Again, before the Cleopatra that we know, there were 6 other Cleopatras that I would not have known if I had not read the book. I enjoyed the descriptions of Bhaveshda, Spandan and PG's conversation with history so much that I did not realize when I had come to the end of the book. I had fun learning how to read hieroglyphs because it's actually not as complicated as it looks once you know the rules.



মিশর দেশটা নিয়ে কৌতূহলী নয় এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি পুরোনো একটা সভ্যতা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত ফারাও, কত দেবদেবীর নাম। পিরামিড, মমি, স্ফিংস এবং আরও কত কী! কত রোমাঞ্চকর সব আখ্যান জড়িয়ে রয়েছে এর ইতিহাসের সঙ্গে। আবার হুগলী নদীর তীরের কলকাতা শহরে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মিশরীয় মনিমানিক্য। তার খবরই বা ক’জন রাখেন! ‘হায়রোগ্লিফের দেশে’ নিয়ে এল সেই সব গল্প যার কিছু কিছু জানা, এবং বেশির ভাগই অজানা। শুকনো ইতিহাসের কচকচি না, বরং স্বাদু অথচ সহজপাচ্য গল্পের আকারে বলা এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথাই এই বইয়ের মূলধন। তার সঙ্গে আছে ২০০-এর বেশি ছবি, যার বেশ কিছু দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য। এমন বই বাংলা ভাষায় খুব কমই আছে। আারও ভাল ছবি, আরও ভাল পাতা, ঝকঝকে ছাপা।


মিশর শহরের ইতিহাস নিয়ে আমাদের জ্ঞান সীমিত। নিউ ইয়র্কের " মেট মিউজিয়ামে " ঈজিপশিয়ান জাতির চুলের বুরুশ, মাজনের কৌটো, খড়কে কাঠি এসব দেখতে দেখতে মনে হয়, কত-কত দিন আগে মানুষের হাতে ছিল এই জিনিস। সে মানুষ আর বেঁচে নেই, তার পুত্র, কন্যা, পৌত্র, দৌহিত্র, প্রপৌত্র কেউ কোত্থাও নেই আর। হয়তো জীবন সেদিনও আজকের মত ম্যাড়মেড়ে ছিল, হয়তো ছিল না, কেউ কিছু জানে না আর। এখন শুধু কয়েকটা জিনিস পড়ে আছে। আর সেই জিনিসগুলো যেন ধরে রেখেছে সেসব বিদেহী আত্মাকে, যেন গিয়েও চলে যায়নি তারা, শুধু বাতাসের ছদ্মবেশে আমাদেরই আশেপাশে ফিসফিস করে ঘুরে চলেছে।

এই বইতে আমরা দেখতে পাই সেসময়ের মিশরের স্থপতিদের চিন্তার কথা। মানুষ কীভাবে পাথরের ওপর পাথর গেঁথে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি করতে পারে, কেমন ভাবে সব প্রতিকূলতাকে কাটাতে পারে বুদ্ধির জোরে তার অনন্য স্বাক্ষর বইয়ের ভেতর। আমরা জানতে পারি ইমহোটেপের কথা, যিনি বানিয়েছিলেন স্টেপ পিরামিড।

আমরা দেখতে পাই মিশরের সাধারণ লোকেদের, তাদের জীবন, তাদের পরিধান, তাদের ভাষা। তাদের লেখা সম্বন্ধেও বইটিতে বিশদ বিবরণ রয়েছে। হায়রোগ্লিফ পৃথিবীর লেখার ইতিহাসের শেষপ্রান্তে বসে আছে।


মিশরের এই ধর্মাচরণের মাঝেও যে একেশ্বরবাদের চর্চা হয়েছিল সেটার উল্লেখও রয়েছে, এবং হাল্কা ছোঁয়া আছে ধর্ম আর রাজনীতির অশুভ আঁতাতের। কালের সুদূর পার পেরিয়েও মানুষের চরিত্র যে প্রায় একই আছে ভাবলে পুলকিত হই।


বইটি মিশর নিয়ে সকল আগ্রহী মানুষের মনের খোরাক বেশ ভালোভাবে মেটাবে। সেই সাথে ২০০ এর ওপরে ছবি আরো সমৃদ্ধ করেছে। এমন অনেক কিছুই বইতে আছে, যা আগে কখনো শুনিনি। যেমনঃ আগে জানতাম ক্লিওপেট্রা নাকি দেখতে দারুণ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু বই পড়ে জানলাম তিনি দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও ছিলেন বুদ্ধিমতী এবং ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে ছিলেন নিদারুণ সুন্দর। আবার আমরা যে ক্লিওপেট্রাকে চিনি তার আগে আরো ৬ জন ক্লিওপেট্রা ছিলেন সেটা বই না পড়লে জানতাম না। ইতিহাসের সাথে ভবেশদা, স্পন্দন আর পিজির আড্ডার বর্ণনাগুলোই এতটাই উপভোগ করেছি যে কখন যে বইয়ের শেষে চলে এসেছি তা টেরই পাইনি। মজা পেয়েছি হায়রোগ্লিফ পড়ার পদ্ধতি শিখে কারণ এটা দেখতে যতটা জটিল বলে মনে হয় নিয়ম জানলে বাস্তবিকভাবে অতটা জটিল না। 

বই লিংকঃ https://t.me/boipatra


সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৩

ছোটগল্পঃ শালা ভূত

 নিপেন বাবু গণিতের শিক্ষক। গ্রামের পরিচিত অতি পুরানো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি সেই যুবা বয়েস থেকে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে চলেছেন। অবশ্য, একটু ঘুরেফিরে দেখলে দেখা যায়, এই স্কুলে গেলো চল্লিশ বছরে বহু শিক্ষক এসেছেন আবার চাকরি ছেড়ে কিংবা বদলি হয়ে চলেও গেছেন তবে বহাল তবিয়ত রয়ে গেছেন নিপেন বাবু। তিনি এই গ্রামের ছেলে। তাই গ্রামের প্রতি তার নাড়ীর টান অসামান্য। সুযোগ থাকার পরেও তাই বদলী নেন নি।



নিপেন বাবু বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান, স্ত্রী ছিল। তিনিও গত হয়েছেন বছর দশেক। ছেলেপেলে নেই, একাকী থাকেন। গ্রামে তিনি বেশ পরিচিত, এক নামে অনেকে ই তাকে চেনে। 

চোখের দেখায় দেখতে গেলে নিপেন বাবুর মুখটা গোলগাল, চোখ জোড়া কুতকুতে ছোট। চোখের সমস্যায় ভুগে এখন চশমা পড়ছেন। মাথার চুল সবিস্তারে পেকে গেছে। বয়েস হলেও যথেষ্ট নিয়ম মেনে চলেন তিনি।

রোজ নিয়ম করে সকালে স্নান করে স্কুলে যান এবং বিকেলবেলা ছুটির পর সোজা বাড়ি ফেরেন। নিজের রান্নাও নিজে ই করেন। আশেপাশে কয়েক ঘর আছে তারা ব্যতীত গ্রামের অন্য লোকজন খুব একটা নিপেন বাবুর কাছাকাছি আসেন না। 

পাশের ঘরের লবন ব্যবসায়ী নগেনের দুই ছেলে। ওরা একবেলা এসে অংক শেখে। বিনিময়ে নিপেন পারিশ্রমিক নেন না। আগে স্ত্রী বেঁচে থাকতে একবেলা ব্যাচ পড়াতেন এখন সেটা নিপেন বাবুর ভাল লাগে না। এদেরকেও পড়ানোর ইচ্ছে ছিল না কিন্তু নগেনের অনুরোধ ফেলতে পারেন নি।

বাড়ির পেছনে সবজি বাগান করেছেন। তাতে বেগুন, পেঁপে তো প্রায়শই হয়। তাছাড়া শীত গ্রীষ্ম বুঝে হালকা আবাদ ও করছেন রীতিমত। রোজকার বাজার খরচা বেঁচে যাচ্ছে। তবে বাজার একদিন করতে ই হয় আমিষের চাহিদা মেটাতে।

গ্রামে একদিন হাট বসে সেখানে ই তিনি তার বাজার-সদাই করেন। এমনি একদিন হাট থেকে সদাই শেষে বাড়ি ফিরছিলেন নিপেন বাবু। তখন প্রায় সন্ধ্যা। মাছের নেশা ধরেছিলো কিছুদিন ধরে। ইলিশ মাছের দাম প্রায় সস্তা। এদিকে দুইদিন আগে বেতন তুলেছেন তাই মাছ কেনার সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছে করলো না। দশাসই একটা ইলিশ কিনে হেঁটে ফিরছেন আজ আর তার হাতে ধরা সাদা চটের থলি থেকে ইলিশের লেজ টা উঁকি দিচ্ছে। এদিকে লেবুর গন্ধে বেলতলা আসার পথ টা ম ম করছে। মন টাও সে গন্ধে ভীষণ খুশী খুশী নিপেন বাবুর। বাড়ি গিয়ে লেবুর সাথে ইলিশের ঝোল! আহা! 

" মাছের রাজা যাচ্ছে বাড়ি

ভেজে খাবো ভাত, হাড়ি হাড়ি " 

মনে মনে ছন্দ বেঁধে আরো উদ্বেলিত নিপেন বাবু।

শ্মশানের পাশের অন্ধকার রাস্তাটা ধরে কিছুটা আসার কিছুটা পরে ই পুরনো কাঁকড় গাছে একটা ডাল ঝাঁকির শব্দ শুনলেন তিনি। 

যা বাবা! বাতাস নেই! মানুষ নেই! ডাল টা ঝাঁকালো কে?

নিপেন বাবুর মন টা একটুপরে ই ছ্যাৎ করে উঠলো। মেছো ভূত নয়তো! ওই বুড়ো বয়েসে ভূতের ভয়! নিজে ই মুচকি হাসলেন একবার। 

মনে মনে বললেন, " না, আর দেরী করা যাবে না।"  ইলিশের ঝোল খাওয়ার তর সইছে না নিপেন বাবুর!

বাড়ি ফিরে ই হাত পা ধুয়ে রান্নাঘরে ছাউনির নীচে মাছ কাটতে বসলেন নিপেন বাবু। একলা মানুষের কাজের সঙ্গী আপাতদৃষ্টিতে কেউ নেই। মাছ কেটেকুটে প্রায় শেষ, তখনি বেড়ার ফাঁকে মাথা গলিয়ে মিউ মিউ.. শব্দে পাড়ার মেনি বিড়াল হাজির। অন্ধকারে সাদা বিড়াল দেখে প্রথমে ভড়কে গেছিলেন তাই বিড়াল টাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "ধুর! ছুঁচা বিড়াল! " 

মেনি বিড়াল রোজ রাতে আসে নিপেন বাবুর খাবার সময়ে। একা সময়ে মেনি বিড়াল টা তার সঙ্গী হয়।

 মাছের কাটাকুটি শেষ করে মাছের আঁশ আর কাটাকুটি বিড়াল কে খেতে দিয়ে মাছ ভাজতে শুরু করলেন এবার। ইলিশের গন্ধে ছোট পাকের ঘরটা ম ম করতে লাগল। জেলের কথায় দম আছে, "বাবু! নিয়ে যান। ভাল মাছ " 

গ্রামের লোক, অবিশ্বাস হয়না কাউকে। মাস্টার মানুষের দাম দিতে জানে এরা। ঠকাবে না এই বিশ্বাস আছে।

মাছে লবণ হয়েছে কিনা একটু চেখে দেখতে যাবেন ঠিক তখনি কণ্ঠস্বর টা শোনা গেলো।  নাকি সুরে কেউ বলছে,

" জামাইবাবু!  একটু দেবেন! অনেকদিন এমন ইলিশ খাইনি।" 

জামাইবাবু ডাক শুনে চমকে নিপেন বাবু এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলেন কাউকে ই দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার গলার আওয়াজ তিনি শুনছেন। 

কে? - জিজ্ঞাসা করে, হাতের কাছে কূপীটা তুলে সলতে বাড়িয়ে চারিদিকে একবার ঘুরিয়ে দেখলেন কেউ আছে কিনা। 

নাহ! কেউ নেই!

খামোখা ভুল শুনেছেন। হয়ত ভুল শুনেছেন ভেবে আবার মাছ ভাজায় মন দিলেন।

মাছ ভাজা প্রায় শেষ তখন আবার অনুরোধ টা এলো। 

" জামাইবাবু!  ও জামাইবাবু!  অবহেলা করেছেন তাইনা! আপন শালা নই বলে এভাবে অগ্রাহ্য করছেন!"

নিপেন বাবু এবার রেগে ই গেলেন, 

"কে রে তুই! আমার শালা ছিল না কোনদিন, শালী আছে, বিয়েও হয়েছে। তুই কে রে? দেখা দে আমাকে!"

আড়াল থেকে জিভ কেটে চুকচুক করার শব্দ এলো। তারপর কেউ  বলল, " না না.. এমন টি ভুলেও বলবেন না, আঁতকে উঠলে অক্কা পাবেন "

নিপেন বাবু বললেন, " আয় না! দেখি! কে তুই! আমার সঙ্গে মশকরা? ঘাড়ে মাথা কয়টা দেখি আয়!"

অন্ধকার ঠেলে যে চেহারা কূপীর আলোয় এলো তা রীতিমত আঁতকে উঠার মত ই। কালো কুচকুচে একটা চেহারা তাতে লাল জোড়া চোখ। কানে মাদুলি, নাকে নথ! 

সেই বিচ্ছিরি চেহারা দেখে আঁতকে উঠে নিপেন বাবু বললেন, " এই!  এই! কে রে তুই? মুখে কালি মেখেছিস কেন? তোর বাড়ি কই? বাবার নাম কি? নিজেকে শালা বলে দাবী করছিস কেন রে?" পেন্নাম স্যার! আমি মেছো ভূত, আগের জন্মের নামটা এখন ভুলে গেছি। সে যাক!  তারপর ফুঁপিয়ে হালকা কেঁদে অভিমান মিশিয়ে বলল, 

" জানেন না তো!  আমার মায়ের। স্বর্গীয় দিপালী দেবীর ইচ্ছে ছিলো তার একটা মেয়ে হবে। কিন্তু মেয়ে আর হলো কই! হলাম আমি। মা তাই শখ করে নাকে কানে অলংকার পড়িয়ে দিতেন মাঝেমধ্যে। আর কি কপাল এই অলংকার নিয়ে ই মরতে হলো। পাড়ার ছেলেগুলো তক্কেতক্কে থাকতো আমার নাম ব্যঙ্গ করতো। দূঃখের কথা কি জানেন স্যার? এই ভূত সমাজেও আমায় কেউ ছেলে বলে মানে না। সেদিনকার ছেলে!  আমার নিয়ে মশকরা পর্যন্ত করে। ব্যাটাছেলে কে এমন ভয় দেখিয়েছি তারপর..(নাকি সুরে হেসে ফেলল মেছো ভূত)

নিপেন বাবু বললেন, 

-তো এবার আমার কাছে কি? 

আপনার কাছে সে আর কি চাইবো স্যার বলুন, ওই ইলিশ মাছের পেটির একটা টুকরা! 

-ওহ, আচ্ছা! মাছ খাবি!

" মশাই! শুনুন! দয়া করে তুই তোকারি করবেন না। মাছ দেন কিংবা না ই দেন। তুই তোকারি করবেন না। আমি কিন্তু গ্রাজুয়েট! "

ভীষণ বিরক্তির সুরে বলল মেছো ভূত।

নিপেন বাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। স্কুলের ৩০০ খাতা দেখা বাকী। মেছো ভূত যদি সে কাজে সাহায্য করে তাহলে মাছের অর্ধেক তাকে খাওয়াতেও রাজী তিনি। যেই ভাবা সেই কাজ।

একটু ভারিক্কি চালে নিপেন বাবু বললেন, গ্রাজুয়েট তার প্রমাণ কই? 

দেখুন মশাই আমি গ্রাজুয়েট সে আপনি যাই বলুন!

নিপেন বাবু বললেন, "মাছ অবশ্যই দেবো! তবে শর্ত একটা আছে "

মেছো ভূত বিরক্ত হয়ে বলল, " মানুষের যা স্বভাব! একটু যদি সৎ হতে পারতো! আরেহ খাওয়াবে যদি সোজাসাপ্টা খাইয়ে দাও বাবা! চলে যাই! তা না! শর্ত দিয়ে খাওয়ানো!"

" আচ্ছা! তাহলে যাও!"- নির্বিকার ভাবে বললেন নিপেন বাবু। 

মেছো ভূত দেখলো মাছের গন্ধটা এসব শর্তের কাছে টিকছে না তখন নিজে থেকে ই বলল, " আচ্ছা বলুন মশাই বলুন! মাটিকাটা, জলভরে আনা, কাপড়কাচা এসব কায়িক পরিশ্রম করতে পারবো না আগেভাগে ই বলে দিচ্ছি! " 

নিপেন বাবু তার শর্ত দিলেন ৩০০ খাতা দেখে দিতে হবে। মেছো ভূত এতে বরং খুশী ই হলো। একরাতে সব খাতা দেখা শেষ করে ফেলল সে। নিপেন বাবুও কথা রাখলেন ইলিশের দুটো পেটির টুকরো তুলে দিলেন মেছো ভূতের হাতে।

পরদিন স্কুলে খাতা জমা দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন নিপেন বাবু। তাকে বদনজরে দেখা বেশ কয়েকজন শিক্ষক ভ্রুকুটি টেনে বললেন, " এও সম্ভব!"

নিপেন বাবু মুচকি হেসে মনে মনে তখন ভাবছেন, যে অংকগুলো আগে করতে অসুবিধে হতো সেসব তিনি নতুন শালাবাবু কে দিয়ে ই করাবেন। তাছাড়া পরীক্ষার খাতা দেখার শ্রম টাও তো লাঘব হতে চলছে। ওরে আমার শালাবাবু জয়তুঃ তারপর কপালে জোড় হাত করে ঠেকালেন দুইবার। 



(সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২

ছোটগল্পঃ স্বচ্ছ

 (১)

অমিত কে দিনের পর দিন অবিশ্বাস করে চলেছে মুনিয়া। বিয়ের কেবল মাত্র দুটি বছর পার হয়েছে। বিয়ে নিয়ে সমাজের গুরুজনরা বলে থাকেন, " তিনটি বছর পার না হলে নাকি বিয়েটা কাঁচা থেকে যায়! আর সেটা যদি হয় প্রচলিত এরেঞ্জ ম্যারেজ। " এরেঞ্জ ম্যারেজ মানে কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রী এর সম্পর্ক হয়, গোটা দুই পরিবারের সাথে দুই পরিবারের মিল মিশেল। 

তবে প্রচলিত কথা যাই বলুক,- মুনিয়ার ঠিক প্রথমদিন থেকে কখনো ই মনে হয়নি অমিত তার অচেনা কেউ। অমিত বন্ধুর চেয়েও ঢের বেশি।

 মাইন্ড রিডিং বলে মনোবিজ্ঞানে একটা বিষয় আছে। এর মানে দাঁড়ায় "মন পড়া " অর্থাৎ আপনি কারও মনের কথা পড়তে চাইছেন তার সাথে কোন ধরনের আলাপচারিতায় না গিয়ে। সোজা ভাষায় " মাইন্ড হ্যাকিং " কি অদ্ভুত! একজনের মনের ভেতরের গল্প/চিন্তা/ক্ষোভ/ আনন্দ সহজে ই অনুমান করে নিচ্ছে অচেনা/চেনা আরেকজন মানুষ। অমিত তেমনি। মুনিয়ার প্রায় দু'বছরে ঘুরে বেড়ানো, শপিং স্বাদ-আহ্লাদ কিছুই পূরণ করতে বাকী রাখেনি অমিত। 

এমনিতে প্রচণ্ড চাপা স্বভাবের অমিত সহজে কাউকে কিছুই বলে না। অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের মানুষেরা নাকি হিংস্র হয়। প্রকাশ না করতে কথা একসময় বারুদের মতন ফোঁস করে জ্বলে উঠে। 

রান্নায় লবন বেশি, কিংবা টেবিলের জমাট ধূলো, সেলিঙে বাস করা মাকড়শারজাল এসব থাকলে অনেক পুরুষ ই অভিযোগ করে। কিছু পুরুষ অনেকটা মেয়েলি স্বভাবের হয়। খাওয়া দাওয়া থেকে মেয়েলি রান্না নিয়ে তাদের বিস্তর অভিযোগ থাকে। তাদের পরিবার তাদের নিয়ে সবসময় ই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় পড়ে। হয়তো ভুলের ফলে ই কোন ভুল না হয়ে যায়, নচেৎ বড়সড় হাঙ্গামা।

অমিত ব্যতিক্রম। করোনায় চাকরি চলে যাবার পরেও ওর মাঝে তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি। পুরুষ ঘরে থাকলে মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়, মুনিয়া অমিতের ক্ষেত্রে সেসব দ্যাখেনি। অমিত ভিন্ন, এমন ছেলে হয়না। অমিতে এখন চাকরি হয়েছে। একমাস ধরে অফিসে যাচ্ছে। মাঝের খারাপ সময় টা চলে যাচ্ছে। খারাপ সময়েও অমিত কোন বিষয়ে মুনিয়ার সাথে দূর্ব্যবহার করেনি। অমিত মাটির মানুষ।

বান্ধবী একদিন সেসব নিয়ে বলতে ই মুনিয়া বান্ধবী বলেছিলো, " এমন আবার হয় নাকি? নিশ্চই কোথাও না কোথাও ঝামেলা আছে" 

মুনিয়া তারপর থেকে ই বান্ধবীর সাথে দেখা তো দূর, ফোনেও যোগাযোগ করেনা। 


(২) 

অমিতের বর্তমান আচরণ বেশ রহস্যঘন। সে বাসায় থাকলে টুকটাক অভিযোগ করে। এই যেমন আগেরদিন দুপুরবেলা। মুনিয়া ঘুমিয়ে ছিলো। সকালে এসে রান্নার আমেনা বুয়া থালাবাসন সব ধুয়ে রেখে গেছে। মুনিয়া চিংড়ি মালাইকারি, সবজি ভাজা আর ভাত রান্না করে খাবারের টেবিলে তুলে রেখেছিলো। গোসল সেরে ই বড্ড ঘুম পেয়ে যাওয়ায় সে হালকা নিদ্রাতুর হয়ে পড়েছিলো ঠিক তখনি অমিতের গলায় ডাক শুনে আচমকা ঘুম ভাঙে!

-মুনিয়া! মুনিয়া! উঠো! এই ভরা দুপুরবেলা কিসের ঘুম?

মুনিয়া উঠে পড়ে, তবে ঘুমের ভাব তখনো কাটেনি ওর।

অমিত বলতে থাকে, টিভির রিমোট টা গেলো কই? কিচ্ছু সাজিয়ে রাখো না আজকাল! কাজে কর্মে একদম খেয়াল নেই। এভাবে কিভাবে হয়? বলো?

মুনিয়া বোঝে নি অমিত এই ভরদুপুর বেলা অফিস থেকে বাসায় কেন! তাছাড়া এসে ই এমন কেন করছে!

-খেতে দাও! আজ কি করেছো? 

মুনিয়ার কথায় জড়তা, 

-চিংড়ি মালাইকারি! তোমার তো পছন্দ!

-মুরগি করোনি? ফ্রিজে না আছে!

-আজ মালাইকারি টা খাও, রাতে করবো। তুমি খাবার টেবিলে এসো।

মুনিয়ার এরপর থেকে অমিত কে বিশ্বাস হয় না। সকালে অমিত অফিসে চলে যায় আর ফেরে সেই রাতে। কিন্তু ইদানীং হুটহাট করে ই দুপুরবেলা অথবা বিকেলবেলা বাসায় চলে আসে। একটা ফোন করেও আসে না। ফোন করে এলে হয়তো ওর জন্য কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে ই পারে মুনিয়া। 

এভাবে চলছে প্রায় এক মাস। দিনের অমিত আর রাতের অমিতে মাঝে বিস্তর ফাঁরাক খুঁজে পায় মুনিয়া। অমিত রাতে ফিরলে কত শান্ত, স্থির অথচ দিনের অমিত মেজাজে উগ্র। মুনিয়ার কিছু মাথায় ঢোকে না। 


(৩)

সকালে অমিত অফিসে গিয়েছিলো আবার ফিরেও এসেছে আজ বেশ তাড়াতাড়ি। অফিসে গেলে অমিত খুব একটা ফোন করেনা। আজ এসে ই টিভি দেখতে বসে গেছে ড্রয়িংরুম এ। ডিসকভারি চ্যানেলে জন্তুজানোয়ার শিকার দেখে তারপর কিছুক্ষণ পর মিটিং আছে বলে আবার অফিস।

-কই? আমার চা কোথায়?  (টিভি দেখছে অমিত সেখান থেকে ই তার চায়ের আর্জি)

ভাবনায় বাধা পড়ে মুনিয়ার। চুল বাঁধতে বাঁধতে রান্নাঘরে এসে ঢুকে সে। চুলায় চায়ের পানি বসায়। তারপর, বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসার আগ্রহ বোধ করে। চোখেমুখে পানি দিয়ে আয়নায় তাকাতে ই হঠাৎ ই খেয়াল করে গলায় লাল আঙ্গুলের ছাপ। দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ আক্রোশে চেপে ধরেছিলো গলা। গলায় হাত বুলিয়ে মনে পড়লো ঘুম ভাঙ্গিয়েছিল অমিত। ঘুমালে মুনিয়ার কিছু খেয়াল থাকে না। প্রচণ্ড ঘুম মুনিয়ার। হয়ত এলার্জি তে লাল হয়েছে। চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে চা বানালো সে।

মুখ মুছে চা বানিয়ে একটা ট্রে তে করে দু কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে ড্রয়িংরুম এ যায় মুনিয়া। চায়ের কাপ অমিত কে দিয়ে সে নিজেও হাতে তুলে নেয় এক কাপ। অবচেতন মনে অমিত বলে, " গতকাল রাতে ভয় খুব পেয়েছিলে তাইনা? "

-কেন? ভয় কিসের... (কথার মাঝে ফোন বেজে উঠে)

এখন আবার কার ফোন! 

মুনিয়া উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে কানে দেয়। 

-হ্যালো! মুন! আমার ফিরতে আজ রাত হবে, বস মিটিং ডেকেছে রাতের খাবার টা খেয়ে নিও। আমি খেয়ে ই আসবো। লক্ষ্মীসোনা প্লিজ রাগ করোনা।

মুনিয়ার হাত কাঁপতে থাকে, রিসিভার টা ধপ করে মেঝেতে পড়ে যায়। অমিত অফিসে থাকলে এখন তাহলে বাসায় কে! হৃদপিন্ড টা হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন ধরাম ধরাম শব্দে পেটাচ্ছে! আতঙ্ক আর ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে মুনিয়ার।

ওপাশে অমিতের গলা, হ্যালো.. মুন কি হয়েছে? হ্যালো! মুন... 



(সমাপ্ত)



রবিবার, ২ জানুয়ারী, ২০২২

ছোটগল্পঃ করোনাকাল

 আজ রিমির জন্মদিন। বয়েস এখন ১৬, স্কুল বন্ধ থাকায় আনিতা, বীনা, রেখা ওদের সাথে মিলেমিশে আজ জন্মদিন টা পালন করা হচ্ছে না। তাই রিমির মন অনেক খারাপ। জন্মদিনের দিনটি শিশু থেকে বুড়ো সবারি মনের ভেতর টা নরম হয়ে যায়, নানারকম চিন্তাভাবনা ঘিরে বসে দ্রুত। কেমন ছিল আজকের দিন? বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, আচ্ছা? আর কতদিন বাঁচব? এরকম নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের ভেতর।

রিমির তেমনি হচ্ছে। মা অসুস্থ, বাবা কোয়ারেন্টিনে আছেন। বড় বোন সামিহা এখন একলা বাসার সব কাজ করছে। মায়ের জমানো টাকা থেকে চলছে মাসের বাজার। বাবার চাকরি গেছে করোনার দ্বিতীয় বছরে। আপাতত একটা রকমারি দোকানে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়ে অভাবের থাবা এসে পুরোপুরিভাবে পড়েছে সংসারের ঘাড়ে। 

আপা! কি করছিস? 

সামিহা রান্নাঘরে ভাত রান্না করছে। চোখেমুখে ঘাম আর বিরক্তির রেখা স্পষ্ট! মুখে বিরক্তি এনে ই বলল, " দেখছিস না কি করছি! যা ভাগ!"

রিমির মন আজ অনেক দূর্বল, সম্ভবত জন্মদিনের দিনটি সবারি এমন হয়। নিজের রুমে ফোন হাতে নিয়ে ই দেখল বান্ধবীরা জন্মদিনের উইশ করেছে ইনবক্সে। ক্লাসের এক ম্যাম শুভেচ্ছা জানিয়ে খোঁজ ও নিয়েছে পাশাপাশি।

দুপুরবেলা সবাই এখন আলাদা খাওয়াদাওয়া করে। সামিহার কাঁধে পুরো দায়িত্ব। অর্নাস ক্লাসে ভর্তির পর ক্লাসের চেয়ে সংসার সামলাতে গিয়ে মেয়েটা গার্হস্থ্য লাইফ টা শেখায় লেটার মার্কস পাবে। এরকম চলতে থাকলে মেয়েটির বাবা-মা ও ভাল ছেলে খুঁজে ফেলবেরন অদূর ভবিষ্যৎ এ সেটা হয়ত অনুমান না করে ই বলা যায়। 

রিমি ঘুমাচ্ছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় গতবছরের লাল দাগ এখনো জ্বলজ্বল করছে। নতুন ক্যালেন্ডার সেভাবে গুরুত্ব পায়নি এ বছর। জন্মদিন হবে না জেনে শুয়ে পড়েছিলো মেয়েটি। 

হঠাৎ ডাকাডাকি তে ঘুম ভাঙল রিমির!

ওঠ মা! এই রিমি! 

বাবা মা কাছাকাছি দূরে দাঁড়িয়ে। হোমমেড কেক, সামিহা করেছে নিজে ই। কেকের দিকে তাকিয়ে আনন্দে চোখের কোণা ভিজে এলো রিমির। শুভ জন্মদিন রিমি!


(সমাপ্ত)


রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সায়েন্স ফিকশন গল্পঃ নাবিল ও মঙ্গলের আজব প্রাণী

 



(১)

সন্ধ্যা থেকে ই মাথাব্যথা! এস্পিরিন জাতীয় ওষুধ খেয়েও কূল পাচ্ছেনা নাবিল। রাতের পর রাত জেগে এসাইনমেন্ট করতে হচ্ছে।  বছরের প্রায় শেষ। কিভাবে দেড়টা বছর ভার্চুয়াল ক্লাসে ই কেটে গেলো মহামারি সময়ে, এখনো সেসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে অবাক হচ্ছে নাবিল। এখন স্কুল খুলেছে, সেই সাথে বেড়েছে নানাবিধ ব্যস্ততা। পড়াশোনা এবং কাজ, কোনটা কিভাবে এগিয়ে নেবে সেটা বুঝতে গিয়ে ই বারবার হিমশিম খেতে হচ্ছে নাবিল কে। 

দোতলার জানালার পর্দা ভেদ করে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে ঘরের ভেতর উঁকি দিচ্ছে।

দেয়ালে ঝুলছে ডিজিটাল ওয়াচ। নাবিল একবার ঘড়ির লাল চলমান রেখা গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। রাত ১ টা বেজে ৩৯ মিনিট। যখনি ঘড়ির দিকে নাবিল তাকায়, মিনিটের ঘরে সর্বদা বিজোড় সংখ্য ই মেলে। ব্যাপারটা একেবারে ই কাকতালীয়। 

এতক্ষণ একনাগাড়ে টেবিলে বসে লিখতে লিখতে, সময়ের কাটা চেক করতে ভুলে গেছে নাবিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বইয়ের তাকে সাজানো সায়েন্স ফিকশন বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে কয়েক পাতা পড়তে লাগল নাবিল। নাবিল সায়েন্স ফিকশনের পোকা। ব্যস্ততা না থাকলে বইয়ের তাকে ধূলো জমার সাহস করেনা কোনদিন। তাছাড়া প্রতিদিন কোন না কোন বই নাবিলের হাতে মেলে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়।

নতুন বইটা এবার খুলতে পারেনি এসাইনমেন্টের চাপে। একটা গল্পে চোখ আটকে গেলো নাবিলের। " ইভেগা " নামের এক ভিনদেশী প্রানী'র গল্প। সে নাকি অনেক অনেক দূরের লাল গ্রহ মঙ্গলে থাকে। বিজ্ঞানীরা নাকি তাকে খুঁজে বেড়াছে বছরের পর বছর কিন্তু এই ইভেগা এতটা ই চালাক যে, সে পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত রেখে যায় না মঙ্গলের মাটিতে। সুতরাং সে কিভাবে মঙ্গলে পা ফেলে চলছে সেটা ই আরেক রহস্য। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ইভেগার নয়টা হাত, শরীরের রঙ পাল্টে যেতে পারে চারটে প্রধান রঙে। এমনকি সে অনেকটা গিরগিটির মতন রঙ পরিবর্তনে সক্ষম। চেহারা অক্টোপাসের মতন অখণ্ডিত। এছাড়া, তার আচরণ ও অত্যন্ত রহস্যঘন।

নাবিল আক্ষেপের করুণ সুরে খানিকক্ষণ হাসে। নাবিলের আজ যদি নয়টা হাত থাকতো তাহলে হয়ত এসাইনমেন্ট গুলো দ্রুত শেষ করে পরেরদিন ই স্কুলের ম্যামের হাতে জমা দিয়ে বলতো, " ম্যাম! সব এসাইনমেন্ট শেষ। "

ম্যাগাজিন পড়তে সময় চলে গেলো। ঘড়িতে রাত ১ টা ৫৯ মিনিট।নাবিল ভাবলো, এখন বরং শুয়ে পড়া যাক। রুমের আলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ফ্রেশ হতে গেলো নাবিল।


(২)

নাবিলের রুম খুব একটা বড় নয়। হোস্টেলের রুম। নাবিলের মা বাবা একসাথে থাকে না। দুজনে ই চাকরী করছেন দেশের দুই প্রান্তে তাই ছেলেকে রেখেছেন এখানে। কেবল ঈদ কিংবা পূজার ছুটিতে নাবিল এবং তার পরিবারের মানুষ গুলো একে অন্যের সাথে দেখা করে। হোস্টেলে পাশাপাশি ওর সমবয়সী আরো ছেলে আছে, তাদের রুম গুলোও একেবারে আলাদা। প্রত্যেকটি রুমে একজন করে ছাত্র থাকে। সবার রুমেও আসবাবপত্র সংখ্যা একই।

নাবিলের রুমের ভেতর আসবাবপত্র বলতে আছে একটি মাঝারি উচ্চতার আলনা, একটি টেবিল, একটি চেয়ার, একটি খাট আর টুকিটাকি জিনিসপত্র। এটা তিন তলা বিশিষ্ট একটি হোস্টেল। যেখানে শুধুমাত্র স্কুলের ছেলেরা ই থাকে। একটি রুমের সাথে অন্য রুমের তেমন একটা যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ই এমন ব্যবস্থা।

হোস্টেলে একজন সুপার আছেন তিনি নিয়মিত দেখভাল করেন ছাত্রদের। সকাল- দুপুর- রাত খাবারের ব্যবস্থা করেন। বেশ ভালো ই চলে যায় সবার। ছুটির দিনে কেবলমাত্র ব্যতিক্রম। সেদিন সবার জন্য টিভি, খেলাধুলা করার সুযোগ দেয়া হয়। নাবিল সেদিন টিভি দেখে। তাছাড়া নাবিলের রাতঘুমের সঙ্গী রঙিল মলাট দেয়া সায়েন্স ফিকশন তো আছে ই। পৃথিবীর কোথায় স্বর্ণের খনি, সিঙ্কহোল কি, আফ্রিকা মহাদেশ কি আবার জুড়ে বড় হচ্ছে, সমুদ্রের তলায় কতটা নীচে গেলে মানুষের কিছু হবেনা, কোথায় গেলে হীরে জহরথের দেখা মেলে, কোন নভোচারী স্পেস স্টেশনে গিয়ে বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন কিংবা সাম্প্রতিকতম সময়ে পাওয়া মনোলিথ রহস্য! এসব গল্প পড়তে ওর ভীষণ ভালো লাগে।


(৩)

রুমে ঢুকে ই অদ্ভুতুড়ে এক আলো দেয়ালে দেখতে পেয়ে ভয়ে দেয়ালের একদিকে সটকে পড়ল নাবিল। একটা লালচে বেগুনি আলো। ক্রমশ পুঞ্জীভূত মেঘের মতন ধীরেধীরে বড় হতে হতে সারা ঘরটা সেই আলো দিয়ে রঙিন করে ফেলছে।নাবিল রুদ্ধশ্বাসে সে দৃশ্য গিলে চলছে চুপচাপ কিন্তু চিৎকার করছে না। 

- হ্যালো ফ্রেন্ড, অ্যাই এম ইভেগা, ডোন্ট ইউ রিমেম্বার? ইউ রিড এবাউট মি এ ফিউ মোমেন্টস এগো। 

নাবিল কাঁপা গলায় বলল, 

- তুমি? ইভেগা! যাকে মঙ্গলগ্রহ তে বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছে? আর তুমি এখানে! অবিশ্বাস্য!

- ইয়েস, অ্যাম হেয়ার টু হেল্প ইউ আউট!

নাবিল কয়েক আরো কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা  শক্ত করে দাঁড়ালো। তারপর ধীর গলায় বলল,

- তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছো?

ভীনগ্রহের প্রানী ইভেগা অনেকটা ঘোড়ার ডাকের মতন চিঁহি স্বরে শব্দ করলো। 

নাবিল বলল, 

- এমন শব্দ করছো কেন?

ইভেগা বলল, 

- আমার হাসিতে এমন শব্দ হয়। তোমরা মানুষ, নিশ্চয় তোমরাও আনন্দ পেলে হাসো। আমিও হাসি। তখন এমন শব্দ হয়।

নাবিল অবাক! বলল, 

- সে কি এখন যে বাংলায় কথা বলছো?

- আমি প্রায় ৯০ কোটি ভাষা পারি যার মাঝে বাংলাও আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ইংরেজি তে ই বলবো কিন্তু তুমি বাংলায় বলছো। একে অন্যের সাথে মনের ভাব আদানপ্রদান খুব জরুরি। এজন্য ভাষা একইরকম হওয়া উচিত। 

নাবিলের ভয় অনেকটা কাটল। বলল,

- ম্যাগাজিন এ পড়লাম তুমি অনেক মেধাবী।

ইভেগা চিঁহি শব্দ করলো। তারপর বলল,

- আমাদের কমিউনিটি তে কাউকে মেধাবী বলা হয় না, বলে ইবিউ!

নাবিল একটু হেসে বলল, 

- ইবিউ ইভেগা! ডাবল -ই। আচ্ছা, আমাকে এখন বলতো- তুমি কেন আমার দেশে? আবার এসে ঠিক আমার ঘরে যখন তোমাকে বিজ্ঞানীরা ট্রেস করে পাচ্ছেনা তাহলে আমাকে কেন তুমি ধরা দিচ্ছো?যদি আমি সবাইকে বলে দেই?

ইভেগা বলল, 

- কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কারণ তোমাদের পৃথিবীর প্রায় সবাই অবিশ্বাসী। এক অন্যকে ঠকিয়ে চলেছে দিনের পর দিন। তোমাদের সব কাজের দলিল অথবা প্রমাণ প্রয়োজনীয়। এজন্য কাগজ লাগছে প্রতিদিন, তোমরা গাছ কেটে ফেলছো। জানো ই তো গাছ কাগজ উৎপাদনের একটি প্রধান উপাদান। পরিবেশ বিপর্যয়। কিন্তু আমাদের দেখো। আমাদের দেশে কথা দিলে আমরা কথা রাখি, ডাটা সংরক্ষণ করতে ব্রেইন ইউজ করি। সেগুলো ট্রান্সফার করতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা মিথ্যেবাদী নই। তাই প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। কেউ কাউকে ঠকায় না, আমরা অবিশ্বাস করিনা কেউ কাউকে।

নাবিল কিছুক্ষণ ভাবল তারপর বলল, 

- তোমার কথায় বেশ যুক্তি আছে। আমরা তোমাদের মতন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে সত্যি অনেক এগিয়ে যেতাম।

ইভেগা ক্রস চিহ্ন দেখালো। মানে সে নাবিলের সাথে একমত। তারপর বলল, 

- আজ অনেক দেরী হয়ে গেলো। এবার তোমায় সাহায্য করা যাক।

ইভেগা এগিয়ে এসে নাবিলের টেবিলের দিকে গেলো তারপর অক্টোপাসের মতন নয়টা হাত বের করে নয়টা এসাইনমেন্ট একসাথে দ্রুত লিখে ফেলল মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। যেগুলো আগে ই সমাধান করে রেখেছিলো নাবিল।

নাবিল বলল,

- একি! এসব তো আমার কাজ! 

ইভেগা বলল,

- কাল সব জমা দেয়ার তারিখ তাইতো? লেখা কিন্তু শেষ হয়নি। করোনার কারণে তোমাদের স্কুল বন্ধ ছিলো। এখন খুলেছে।

নাবিল মাথা নাড়ালো।

ইভেগা বলতে লাগল,

- কাল তোমার মা আসবে তোমাকে নিয়ে যেতে। তোমাকে নিয়ে উনি বেড়াতে যাবেন সমুদ্রে। (সম্ভবত ভবিষৎবাণী) 

নাবিলের চোখ চকচক করে উঠলো। 

- সত্যি? 

ইভেগা বলল, 

- হ্যাঁ। আজ আসি। ভোরের আলো আসার দুই ঘন্টা আগে আমাকে মঙ্গলে ফিরতে হবে। ওয়াদার ব্যালেন্স হওয়া জরুরি। 

নাবিল কে ধন্যবাদ দেবার সুযোগ টুকুও দিলো না ইভেগা। জানালা গলে চলে গেল বাইরে তারপর তারা খসে পড়ার মতন ধীর গতিতে চলে গেলো উত্তর দিকের আকাশে। নাবিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আসমানে।

অ্যালার্ম শব্দে নয়, নাবিলের ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, 

- কেমন আছিস নাবিল? 

- মা! নাবিল অবাক। 

তারপর অবাক চোখে বলল, ইভেগা! 

মা প্রশ্ন করলেন, ইভেগা?

বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে পড়ল নাবিল। দ্রুত টেবিলে ঝুঁকে এসাইনমেন্ট গুলো খুলে ফেলল পাতার পর পাতা। সেখানে সব কমপ্লিট। তাহলে, রাতে কি স্বপ্ন দেখেনি নাবিল? হয়ত না আবার হয়ত হ্যাঁ। 



(সমাপ্ত) 


সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গল্পঃ পয়সা

 (১)

নিশুতি রাত। শো শো শব্দে বাতাস বইছে। হালকা বাতাসে বাতাবি লেবু গাছের ডালটা একটু দূরে ই নড়ে আলোছায়া খেলা খেলছে।

চারিপাশ ফাঁকা। মাঝেমধ্যে মাটির গর্ত থেকে বেড়িয়ে ঝিঝি পোকারা একনাগাড়ে ডাকছে। এমন মৃদ্যুমন্দ আবহাওয়া তে মন উদাসী হয়। আর রাত হলে নানারকম কথা মানুষের মাথায় ঘুরতে থাকে। ঠিক এখন- যেমনটা সগীরের মাথায় খেলা করে চলছে। কথার একটা অংশ দখল করে স্মৃতিময় অতীত।

মানুষের জীবনে এই স্মৃতিকাতরতা -এক অদ্ভুত অসুখ। অতীতের সেইসব কথা ভাবতে ভাবতে আনন্দে -কখনো মুখের চামড়া উদার হয়ে হাসে, আবার কখনোবা চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ে। গ্রামের নাম জনমশীলা। এ গ্রামের বাসিন্দা সগীর উদ্দিন। এখন বন্ধুর সাথে নানান ব্যাপারে কথার আদানপ্রদান করছে সে। বন্ধুর নাম আলমগির, দুজনের বয়েসের ব্যবধান কম। 

সগীর উদ্দিন বলল, " এইখানে এতদিন ধরে পড়ে আছি অথচ আমার ছেলেটা এদ্দিন পর দেশে ফিরেও একবার আমাকে দেখতে আসলো না। " 

অভিযোগের বিপরীতে বন্ধুবর আলমগির নীরব। 

এখানে -পাশাপাশি দুজন। বাসিন্দা আরো আছে, তবে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব বলতে এই দুজনের ই, সগীর এবং আলমগির। 

একসময় দূর্দান্ত প্রতাপ ছিল দুই বন্ধুর। গ্রামে দুজনের দস্যিপনার কথা লোকেরমুখে মুখে ঘুরে ফিরতো। আজ সেসব অবশ্য অতীত। নতুন গাছে সবুজ পাতা দেখলে যেমন মানুষের মনে খুশীর ভাব জাগে, সেই পাতা ই হলুদ হয়ে ঝরে পড়লে আর তার কোন খবর থাকে না। 

সগীর বলতে লাগলো, জীবনের দাম আজ আর নাই আলমগির। দাম থাকতো যদি কিছু করতে পারতা। দুনিয়াদারী তে পরিশ্রম, টাকা এগুলার দাম মানুষের থেকে বেশি। আলমগির কিছু বলে না। সে এখানে আসার প্রথম দিন থেকে ই চুপচাপ। এখনো কিছু ঘটনা তার নিজের ই বিশ্বাস হয় না। পূর্ণিমারাত আসলে সে উদাসীন হয়, নতুন দেয়া বাঁশের বেড়া ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ো কাঁদে। আলমগির এভাবে ই কাঁদতো পৌষের মেলা ফেরত আসার পর। গরীবের ছাওয়াল আলমগির। মেলার সব খেলনা কিভাবে সে একা কিনবে? এত পয়সা তার ছিল না। সগীর বলতো, আমি নাহয় বাঁশি কিনি, তুই আরেকটা খেলনা কিনে নে। দুজনে ভাগাভাগি করে খেলমু!

আলমগিরের সাথে ঠিক এভাবে ই সগীরের বন্ধুত্ব জমাট বাঁধে। কথায় আছে, আত্মার বন্ধু টিকে যায়-হলোও তাই। 

একটা সময় ছোট থেকে বড়, বিয়েশাদি সব ই জীবনের নিয়মে পালন করলো দুজনে। বন্ধুতা টিকে ও রইল দুজনের মাঝে। এরপর বুড়ো হলো, নিজের ছেলেমেয়ে কে বিয়ে দিয়ে হলো নিশ্চিন্ত। সেসব কতদিন -কতশত ঘটনা। 


(২)

রাত বাড়ছে। কুয়াশা হানা দিতে শুরু করেছে গাছের পাতায়। কুয়াশা পানির মতন টপটপ করে ঝরে পড়ছে মাটিতে। ওদের ঠান্ডা লাগছে কি?কথায় আছে- " মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। "

আলমগির আচমকা বলে উঠলো, ওরে! সগীর। সেই যে- বিহানবেলা তে মাছ ধরার কথা তোর মনে আছে রে?

 সগীর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ! এতবড় একটা বোয়ালমাছ ধরার পর দুইটা দিন বাড়িতে মাছের কত প্রশংসা করসে। মাছ ধরাটা একপ্রকার নেশা হয়ে গেছিলো। আহারে দিন ছিল। সগীরের চোখে পানি। দুজনের নীরবতা। 

কিছুক্ষণ পর একদল লোকের গলা আর পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। আগের মতন ই নিশ্চুপ হয়ে গেলো দুই বন্ধু। 

একদল লোক অনেকক্ষণ কান্নাকাটি, হাটাহাটি তারপর দোয়া পড়ে যে যার মতন বাড়ি ফিরলো। এখন রাত নয়টা। ধীরেধীরে রাত বেড়ে চলেছে গ্রামে। তাছাড়া, গ্রামের দিকে রাত নয়টা মানে অনেক। রাত বাড়লে গ্রামের দিকে শিয়াল আসে, ঝিঝি পোকার ডাক বাড়ে। কুকুরগুলো কুঁকিয়ে উঠে শীতের কাঁপনে। ঝোপঝাড় থেকে জোনাকিপোকা দল আলো জ্বেলে দলে দলে বেড়িয়ে আসে। কুকুরগুলো দূরের বাড়িগুলো থেকে থমকে থমকে ঘেউ ঘেউ করে জানান দিকে থাকে ওদের অস্তিত্বের। 

হঠাৎ ভারী গলার আওয়াজে চমকে উঠে সগীর আর আলমগির। 

-স্লামালেকুম! (গলার আওয়াজ নতুন) 

সগীর প্রশ্ন করে, আপনার পরিচয়?

-আমি মোস্তফা! চেয়ারম্যান নূরে মোস্তফা!

আলমগির পাল্টা প্রশ্ন করে, আপনি তো শুনছি প্রায় যুবক!কিন্তু আপনে এইখানে কেন?

-আরেহ মিঁয়া!  এত প্রশ্ন করেন ক্যান? আপনারা কি একলা থাকবেন এক জায়গায় এমন তো কথা নাই। এই জায়গা টাও আমার ছিল। গ্রামের বিরোধী পক্ষ কাইড়া নিছে আমার থেকে, হু!

সগীর মৃদ্যু হাসলো। মনে মনে ভাবলো- এখনো দেমাক কমে নাই চেয়ারম্যান সাবের।

 কথায় আছে ক্ষমতা এক অদ্ভুত জিনিস। 

আচমকা ই একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল সগীর। বলল, আপনে আমারে চিনেন? 

-কে তুমি?

-সগীর! 

-ওহ! চিনছি! তাতে কি?

-চিনলে তো অবশ্যই মনে পড়ার কথা পুকুরপাড় এর জমিটা আপনার ভাই জোর কইরা আমার হাতে টিপসই দিয়া নিয়া নিলেন।

-হ! এগুলা কানাঘুষা! সব বিরোধী পক্ষের কামকাজ! আমার দ্বারা এগুলা হয় না।

আলমগির বাঁধা দিয়ে বলল, " থাম সগীর থাম! এখন একটু শান্তি দে। কি করসে এগুলা কইয়া খামাখা ঝামেলার কি দরকার।"


(৩)


শীতের রাত। হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে পাহারাদার কয়েকবার আলো ফেলে পুরো এলাকা একবার চক্কর দিলো। 

সগীর শুনলো নয়নের মা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রোজ রাতে ই মহিলা একলা একলা কাঁদে। কাজের ধান্ধায় ছেলেটা বিদেশে গেছিলো ওর। সম্ভবত দুবাই, বিয়েও দিয়েছিলো ভাল ঘর দেখে, মেয়েটি সুন্দরি। বিদেশ যাওয়ার মাস খানেক মোটা টাকা বৌয়ের নামে পাঠাতে লাগল নয়ন। সব ই ঠিকঠাক চলছিলো। 

একদিন বৃদ্ধ মা দেখলো বাড়ির বৌ, দুই বাড়ি পরে বাড়ির দুই বাচ্চার বাপের সাথে পালিয়ে গেছে। এতদিন ছেলেটা যত টাকা পাঠাইসে সব নিয়ে ভেগে গেছে। বৃদ্ধা মা একদিন পরে ই শুনলো আরেক খারাপ খবর। নয়ন ছেলেটা উঁচুতলায় কাজ করার সময় অসাবধানতা বশত পড়ে মারা গেছে। খবর শুনে বুড়া মায়ের সেই যে হুশ গেলো। তারপর এখন সে কাঁদে। নয়নের নামে কাঁদে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। 

আচমকা -পায়ের মৃদ্যু আওয়াজ শোনা গেলো। টর্চের আলো হাতে পাহারাদার জয়নাল হাজির। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা! জয়নালের দেখা মিলবে ই এখানে। সে লোকটা ভয়ে কাঁপে তবুও প্রচণ্ড সাহস ওর। টাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে। এখন সে ভয় কে জয় করতে শিখে ফেলেছে।

নয়নের মায়ের কান্নার আওয়াজ কমে যায় কিন্তু থামে না। কান্নার আওয়াজ তীক্ষ্ণ হয়। ভয় পেয়েছে জয়নাল।

কাঁপা হাতে গলায় বাঁধা তাবিজ টা কয়েকবার চুমু দিয়ে বলল, ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! বাঁচাও। তারপর আয়াতুল কুরসি পড়লো। তারপর চাদর টা ভাল করে জড়িয়ে টর্চের আলো ফেলে ঘাসের উপর খসখসে পা ফেলে চলে গেলো অন্যদিকে।

একরাশ নীরবতায় ঢেকে পড়লো চারপাশ। কেউ কোন কথা বলছে না। নয়নের মা এখন নিশ্চুপ। মনে হয় ক্লান্ত হয়ে গেছে। ক্লান্ত হলে সে চুপ হয়ে যায়।


(৪) 

ভোররাত, আলো উঁকি দিবে আরো কিছুক্ষণ পর। ঘুম ভাঙে আওয়াজে।কারো পায়ের শব্দে কেঁপে উঠে আলমগির। ওর কবরের উপরে কেউ এসেছে। হাটাহাটি করছে। চেয়ারম্যান মোস্তাফা ঘুমাচ্ছে। প্রথমদিন এসে ই সবাই কবরে গভীর ঘুমে ঘুমায়। একে বলে " মরার ঘুম! " 

আলমগির মৃদ্যু কাতরোক্তি করে সগীর কে ডাকে। সগীর বুঝতে পারে, সেও ভীতসন্ত্রস্ত। চাপা গলায় বলে, "কে? কারা?"

আলমগির মাথা নাড়ায় ঠিক যেন- সেও জানেনা কিছুই। সগীর বুঝতে পারে। কারা যেন শাবল দিয়ে কবর খুঁড়ছে। মরার পরেও শান্তি নাই। দ্রুত খুঁড়ে ফেলেছে এরা। আলমগিরের কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বের করছে চারজন। আলমগির এখন পুরনো কঙ্কাল। সগীর দেখতে পেলো আলমগিরের ছেলে এসেছে- সাথে নিয়েছে আরো তিনজন কে। ওরা কবর খুঁড়ে বের করে নিচ্ছে আলমগিরের কঙ্কাল।

 বিস্মিত দুই বন্ধু সগীর এবং আলমগির। ওদের লাশ তুলতে এসেছে ওরা। 

চটের ছালায় হাড়গোড় ভরে নিতে নিতে ওরা আলাপ করলো। " আব্বায় বাইঁচা থাকতে এক পয়সা সম্পত্তি দিবার পারে নাই। মইরা গিয়াও কবরের দাম খরচা করাইসে। এখন এই হাড্ডি বেঁইচা যদি কিছু আয় হয়।"

সগীরের মনটা কাতর। বন্ধুর শেষ অস্তিত্ব টা কাটা হয়ে গেছে। এখন ওর কবর খোঁড়া চলছে। আলমগিরের ছেলেটা হয়েছে বেঈমান। কীটনাশক খাইয়ে তার বাবাকে ই কে এই ছেলে মেরে ফেলেছিলো দুই বছর আগে। 



(সমাপ্ত) 

শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০২১

ছোটগল্পঃ হরিশের ভিটে


দেয়াশলাই টা দপ করে নিভে গেলো। শিক দেয়া জানালা দিয়ে বাতাস যেন অনুমতির তোয়াক্কা না করে ই ঢুকে পড়ছে দ্রুত।
ধ্যাত! (অনেকটা ই বিরক্ত হরিশ ভদ্র)
আরেকবার দেয়াশলাই থেকে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেও সেটা দপ করে আগেরবারের মতন পুনরাবৃত্তি হয়ে দ্রুত ই নিভে গেলো। ম্যাচ টা পকেটে পুরে লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালাতে বাধ্য হলেন হরিশ ভদ্র। অন্ধকারে বন্ধ ঘরের শুধুমাত্র জানালা একটি, একটিমাত্র দরজা যেটি এখন পুরোপুরিভাবে বন্ধ তবুও বাতাসের তীব্র গোঙানি তে কেঁপে উঠছে থরোথরো। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কাঠের চেয়ার টেনে এবার জানালার ফাঁকা অংশে বসলেন তিনি। চারদিকে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরের কোন পাখি সশব্দে আর্তচিৎকার তুললো, সাথে সাথে আরো জোরালো হলো বাতাস। মনে হলো, পাখির কন্ঠে সায় দিলো সে।

হরিশের ভিটে। এই গ্রামে সবাই এই বাড়িটা একনামে চেনে। ছোটবেলায় অসীম, শাশ্বত, অভিষেক একসাথে মাইনে দিয়ে পড়তে আসতো এখানে। ক্লাস ওয়ানের ছেলেপেলে মারাত্মক ভয় পেত হরিশ স্যার কে। তবে এখনকার পড়ুয়া ছাত্ররা আগের মতন নয়, শিক্ষক কে তেমন একটা ভয় তারা আজকাল করে না। গুরুজন কেও সম্মান ততটা করে না। অথচ পুরোনো সময়ে যখন ওরা ছাত্র ছিল, তখন অসীম একবার হরিশ ভদ্রের ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলো। দুইয়ের সাথে বায়ান্ন যোগ করলে কত হয় অসীম সেটা বলতে পারেনি। হরিশ ভদ্রের চেহারা অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দেবীর সাথে থাকা অসুরের মতন। গালে মোটা তিল, পাঁকানো গোঁফ তার সাথে মাঝ বরাবর সিঁথিকাটা আলুর মতন গোলাকার চেহারা। দেখলে ই পিলে চমকে যেত ওদের।
"কি রে শাশ্বত?  অংক করিস নাই কেন?"
স্যার! ক.. করি..নাই!
"অসীম পাঁঠা? অংকের খাতা কই?"
স্যা..র..
নাম শুনে ই অসীম কান্ডখানা করেছিলো।
হরিশ ভদ্র অনেকবছর স্কুলে পড়ালেন। বগলে ছাতা, পায়ে সস্তা স্যান্ডেল, তেল দেয়া মসৃণ চুল। প্রায়শ এভাবের কোথাও না কোথাও দেখা যেতো তাকে। ২০০-৩০০ টাকায় দূর্বল ছাত্ররা পড়তে যেতো তার কাছে। স্কুলের পাশাপাশি নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলেছিলেন। তবে শিক্ষকদের রেষারেষি তে বেশিদিন চালাতে পারেন নি। শেষদিকে চাকরি টা তার চলে যায়। তখন একবার শাশ্বত তাকে গ্রামের বাজারে দেখতে পেয়েছিলো। মাথার চুল পেঁকে গেছে, চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে তবে সেই আগের মতন ই আছেন। স্যার কে দেখে কুশল বিনিময় করলেও হরিশ ভদ্র কে আন্তরিক দেখা গেলো না। বহু বহুবছরের পুরোনো ছাত্রকে দেখে তিনি আপ্লুত হলেন না দেখে শাশ্বত অনেকটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলো সেদিন।
সাবধানে! সাবধানে!
অভিষেক সতর্ক করলো বাকী দুজন কে। মোবাইল আর টর্চ হাতে ওরা তিনজন এগিয়ে চলেছে হরিশ ভদ্রের ভিটার দিকে। একবার হলেও এই শুনশান নীরব রাতে ওরা দেখতে চায় গুঞ্জন কতটা সত্যি!
এই! এই! শক্ত করে শাশ্বত'র হাত চেপে ধরলো অসীম। তারপর আগুল তুলে অন্ধকার জানালায় জ্বলতে থাকা সিগারেটের ছোট্ট আগুন দেখে গায়ত্রী মন্ত্র জপতে লাগল অভিষেক।
শাশ্বত গলা নামিয়ে বলল, " যা শুনেছি সেসব তবে সত্যি! "
একরাতে আগুন লাগে, স্যার একা থাকতেন। ঘুম বেজায় কড়া তাই আর বাঁচতে পারেননি ঘর ছেড়ে। দিনের বেলার এলে দেখবি বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে আছে।
পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিলো অভিষেক।
"চল ফিরে যাই, ভিটে টা এখন ভৌতিক।"
ফিরে চলল ওরা। ধীরেধীরে আঁধারের মাঝে পথ দেখে ফিরতে লাগল তিনজন। শাশ্বত কি একটা মনে করে পিছু ফিরলো। জানালায় এখন লাল আলো তিনটি। সম্ভবত চোখজোড়া জ্বলছে।

(সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

ছোটগল্পঃ প্রত্যাবর্তন

 পাণ্ডুলিপি টা প্রায় শেষ, এডিটিং করাটা বাকী। আগের রাতেও কথা হলো প্রকাশকের সাথে। ভদ্রলোক আমাকে দেখে মারাত্মক ভয় পেলেন! আমার এতে পেট ফাটানো হাসি পেলো। হাতের ইলিশ মাছ জোড়ার মায়া ছেড়ে উল্টোদিক লক্ষ্য করে তিনি প্রায় পড়িমরি করে ছুটে গেলেন। ভেবেছেন আমি হয়ত- পাওনা টাকা টা আগে ই চেয়ে বসবো। বিশ্বাস করুন, আমি তেমন মহাজন ঘরানার মানুষ নই।

বাবা! তোমার চা!

মেয়েটা ক্লাস টেনে উঠলো। অসাধারণ মেধাবী, তবুও লোকে কুৎসা রটায়! বলছে মেয়েটা নাকি পাগলি। বাবা হিসেবে এ কথা শুনতে কতটা খারাপ লাগে সেটা বোধহয় পৃথিবীর তাবৎ বাবা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। জানি মেয়েটা আংশিকভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তবে লোকের কথায় সে তো আর পুরোপুরিভাবে পাগলি নয়।

অংশুক বাসায় এসে ব্যাগ ছুড়ে দিলো সোফায়, মার্চের আগুনে গরমে ওর মুখ লাল। আজ স্কুলের রেস ছিল, স্পোর্টসে রীতিমত ভাল। আজো জিতে এসেছে সে। পায়ের ধুলোবালি, টি টেবিলে রাখা কবজি সাইজের ক্রেস্ট টা তার ই প্রমাণ।

নিবেদিতা ঘরে এলো, আমার ঘরে সে এখন কম আসে। সারাদিন ছুটোছুটি চলছে ওর। শুনলাম পেনশনের টাকাটা এখনো আসেনি আমার। ফাইলের মারপ্যাঁচ খেলতে খেলতে হয়ত কোন এক টেবিলে আটকে পড়েছে। টাকা চুরি করতে শিখিনি বলে এখানেও তেমন উৎকোচ দেয়ার সামর্থ নিবেদিতার নেই। তাই উপরওয়ালা বরাবর নালিশ রেখে তার দুয়ারে মাথা ঠেকাচ্ছে আমার উনি। সে ঠেকাক! কিন্তু যারা পেনশনের ফাইল টা ঠেকিয়ে রেখেছে তাদের কে ঠেকাবে কে? পত্রিকার পড়লাম, নচ্ছার বলে একদল আরেক দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উভয় নচ্ছার ই একে অন্যের পরিপূরক। মাঝখানে পড়ে আম ছালা চলে যায় আম পাব্লিকের। সৎ মানুষের অভাব। এদের অভাব নেই, মানুষ কেন জানি সৎ থাকতে পারে না। এই অধিকার টা একটা সময় এরা হারায়। খুব রাগ হচ্ছে, উঠে গিয়ে টেবিলে গুছিয়ে রাখা আমার লেখা পাণ্ডুলিপি টা ছাইপাঁশ বলে ছুঁড়ে দিলাম। কাগজগুলো উড়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। আমার মেয়েটা কোথা থেকে উড়ে এসে সেগুলো গুছিয়ে বাকা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, " বাবার! বাবার লেখাগুলো বাতাসে উড়ে..উড়ে গেলো "

দেয়ালে সাদাকালো ছবিটায় ফুল শুকিয়ে এসেছে। সময়ের মারপ্যাঁচে আমিও শুকিয়ে হারিয়ে গেছি দু-বছর আগে।


(সমাপ্ত) 

শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২১

ছোটগল্পঃ চুড়ি

 রিমঝিম কে বললাম কফি করো তো! 

আড়মোড়া আর চুড়ির সিম্ফনি তুলে বিছানায় শুয়ে ই আওয়াজ করল সে। বলল, আনছি!

এমন যদি হতো শহুরের সব থেকে উঁচু বিল্ডিং এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে একনজরের শহরের বুকে আকাঁ কোন এক পিকাসোর ছবি এক নিমেষে শুধু একবার চোখ বুলিয়ে দেখে ফেলা যেতো! 

আমার এখন ঠিক তেমনি লাগছে। ভোরের কুয়াশা এসে একটি চাদরের মতন জড়িয়ে ফেলেছে গোটা শহর টা। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। আমি ছিলাম কাজে, রিমঝিম পড়েছে বই। ভোরবেলা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে নিজেদের কে নানান নামে ডেকেছি। আজ প্রতিযোগিতা ছিল নিজেদের জানা খাবারের নামে একে অন্যকে ডাকতে। এই যেমন আমি চিনি, ও আমাকে বলছে গুড়!

আমি মুড়ি, ও চানাচুর!

তারপর হঠাৎ কখন ঘুম এসে আলগোছে দুজন কে তুলে নিয়ে গেছে দুজনের কেউ জানিনা।

বিয়ের আগের দিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সাদা পাঞ্জাবির নীচে গেঞ্জি না পড়ায় ভিজে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল আমাকে। তবুও আমার হাতের ছাতাটা রিমঝিমের মাথায় ধরেছিলাম। বিয়ের শুরুটা হয়ত এমনি। একটি মেয়েকে নিজের আশ্রয়ে নেয়া। তাকে সমস্ত ভরসা দিয়ে বলা, " আমার কাঁধে এসে ঘুমাতে পারো, আমি জেগে আছি "। আকাশের চাঁদকে ও হয়ত তারা একই কথা বলে। 

রিমঝিমের পা ভিজেছিল সেদিন, পায়ে লাগানো লাল আলতা দেখে আঁতকে উঠতে হবে! রক্ত! কেটেছে!

রিমঝিম একটা বিরক্তি মুখে বলেছিল! হয়েছে! এত আদিখ্যেতা ভাল নয়। এসব দেখালে নাকি একসময় ভীষণ আফসোস করতে হবে। মানুষের নজর লাগবে। নজর নাকি খুব খারাপ। ওর ছোট ভাই টা খুব সুন্দর হয়েছিল, তবে বেশিদিন বাঁচেনি। অতি সুন্দর মানুষের চোখে সহ্য হয়না।

যাক সে কথা!

রিমঝিম হয়ত এখনো উঠেনি। দমকা বাতাস এসে ঘরের উইন্ড চাইম টাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এই শীতেও আমি দরজা খুলে রেখেছি। বন্ধ ভাব টা আমার ভালো লাগে না, রিমঝিমের তো নয় ই।

কলিং বেল বাজল!

-কে?

-স্যার! পেপার নিবেন না আইজ?

-হ্যাঁ! দাঁড়াও আসছি।

গেট খুলে দাঁড়ানোর পর ছেলেটা আমার দিকে একবার আর তারপর অদ্ভুত চোখে ঘরের ভেতর টা দেখল। শ্যামলা মতন ছেলেটা রোজ ই এই পত্রিকা দেবার বাহানায় এমনটা করে। রাগে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলাম। 

এখন কফি খাবো! রিমঝিম!  রিমঝিম!  তুমি এখনো ঘুম থেকে ই উঠোনি, কফিটা কি আমি ই করবো?...

পত্রিকার ছেলেটা নীচে নেমে ই আকঁড়ে দারোয়ানের হাত ধরল। তারপর বলল, পাগলা আজ খেপছিল! আমারে দেইক্ষা দরজা লাগাই দিসে! বাসায় ভিত্রে চাইছিলাম -দেখি রুম অপরিষ্কার! ঘরের সিলিং এ চুড়ি ঝুলতেছে। শুনলে মনে হয় বাড়িতে মহিলা মানুষ আছে।

দারোয়ান গলা নামিয়ে বলল, যাও গা! ক্যান্সারে বউ টা মরার পর ভদ্রলোকের মাথা ঠিক নাই।



(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সমস্ত কাল্পনিক) 

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০

ছোট গল্পঃ ডেটিং

 

           ট্যাক্সি থেকে যে লোকটি নামল তাকে রেস্তোরা'র জানালা দিয়ে ভালো করে দেখতে পেল সুতপা। একদম বিকেল ৪টা। কথার দাম আছে বলতে হয় ভদ্রলোকের। কালো শার্ট, বাদামী রঙের প্যান্ট আর কাঁধে ব্যাক প্যাক। আপাদমস্তক দেখে নিল সুতপা। ভদ্রলোক,  একেবারে হাতে ধরে টাইম মত হাজির। খুশী ই হয়েছে সুতপা।

রেস্তোরা'র দরজা ঠেলে ভেতরে এসে ই আগে দেয়া বর্ণনামত, কচুপাতা আর লাল টিপ দেয়া মেয়েটাকে ঠিকি চিনে ফেলল ভদ্রলোক।
আপনি ই সুতপা! ( টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল)
সুতপাও মিষ্টি করে একটু হাসল। উত্তরে বলল, " হ্যাঁ আমি ই! প্লিজ বসুন। আসলে অন্য রেস্তোরা তে খুব বেশী ভীড় তাই আপনাকে এখানে ডেকে আনলাম। "
ইটস ওকে। আমারো ট্যাক্সি ভাড়া কমে পড়ল! (হাসিমুখে বললেন ভদ্রলোক)
চেয়ার টা টেনে বসতে না বসতে ভদ্রলোকের কল এল। সেটা রিসিভ করে কথোপকথন যা হলো তার সার সংক্ষেপ,
-জ্বী, কেউ ছিল না বাসায়!
-না সমস্যা হয়নি।
-আচ্ছা, কবে পাবো?
-আজকেই?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ব্যাংক কালও বিকেল পর্যন্ত খোলা।
কথা শেষ করে সেটা আবার ফোন পকেটে রাখতে গিয়ে ভদ্রলোকের পকেট থেকে নাইলনের একটা দড়ি ঝট করে বেড়িয়ে পড়ল। সেটা সুতপার চোখ এড়াল না। চাপা হাসি দিয়ে তাই অবাক চোখে তাই প্রশ্নটা করে ই ফেলল ও, " দড়ি কেন? "
আসলে, কাজেকর্মের ফাঁকে ভুল করে পকেটে চলে এসেছে। ( একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন ভদ্রলোক)
সুতপা মুচকি হাসল। আপনি তো দেখছি, কাজে তো খুব মনোযোগী নন!
(কথোপকথন চলতে থাকে)
দেখা হবার আগেরদিন,
ডেটিং সাইটে দুজনের আলাপ। ভদ্রলোকের নাম খালেক। যে ছবিটা সাইটে দেয়া সেটাও খুব ভাল বোঝা যায় না। দেখে মনে হয় লোকটার মাথার সামনে চুল কিছুটা কম, তবে একেবারে টাক নয়। মুখে হালকা চাপ দাঁড়ি। তবে বেশ কথা জানে লোকটি। সাইটে সেই প্রথম এসে সুতপা কে নক দেয়। সুতপার নিজের ছবিও দেয়া ছিল না। রুপাঞ্জেলের এনিমে ছবিটা দেয়া। তা দেখে ই নাকি খালেকের প্রশংসা।
সুতপার স্বামী ডাক্তার। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে একটি কারণে ওরা দূরে দূরে আছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা সাময়িক মান-অভিমান। পরে জানা গেল, নিজেদের রাগারাগি টা একটু বেশী ই। কিন্তু দুজন দুজন কে প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই ছোটবেলা থেকে দুজনের জানাশোনা। একই স্কুল, কলেজ। পরে এসে পড়াশোনার পাঠ আলাদা হয়ে পড়ে কিন্তু দুজনের মাঝে ভালোবাসা একটুও কমেনি। বিয়েও করেছে প্রায় বছর দুই। কিন্তু এখন দুজন দুজন কে দূরে রেখে কষ্ট পাচ্ছে শুধু শুধু! তাই জেলাস করতে সুতপার এই চাল। ডেটিং করে জেলাসী করে দেয়া।
ওরা রেস্তোরা তে এখন খুব ই ব্যস্ত। বেশ হাসাহাসি চলছে। সেখানে একটা টিভিও চলছিল। তাতে বিকেলের নিউজে দেখানো হলো একজন সদ্য বিবাহিত মহিলা খুন হয়েছেন। সম্ভবত দুপুরে ঘটনাটি ঘটে। তাই সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির আশেপাশে কাউকে দেখা যায় নি। মহিলাকে রেইপ করাও হয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করছে। পোষাক পরিচ্ছদের উপর রাফ চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তার থেকে বড় কথা গলায় নাইলনের দড়ি টেনে মহিলাকে খুন করা হয়েছে।
সুতপার চোখে গেল টিভিস্ক্রিণে।
নীচু গলায় বলল, " আপনার কাজ? "
ভদ্রলোক বা দিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, "হ্যাঁ, আর সেটা করে ই দ্বিতীয় ক্লায়েন্টের কাছে এলাম "।
রেইপ?
নাহ, অতো নীচু আমি নই! এটা সুপারির এক্সট্রা আবদার ছিল।
সুতপা একটু হাসল, ক্রুর হাসি। এরপর বলল, আমার কাজটা কি হবে?
নিশ্চই হবে কিন্তু ছবিটা?
আমার পেছনে সাদা শার্ট আর নেভী ব্লু প্যান্ট পড়ে যে লোকটি হাসছে সে। সাথের মেয়েটিকেও...
না না, ডবল করলেন এখন? খালেক আক্ষেপের সুরে বলল।
পেমেন্ট টাও ডবল হবে।
সুতপা উঠে চলে যাচ্ছিল। খালেক প্রশ্ন করল, "কিন্তু কেন করাচ্ছেন সেটা যদি?.."
আমাকে ফেলে ও এখন অন্য মৌচাকে উড়ে বেড়াচ্ছে তাই!
খালেক, নিঃশব্দে হাসল এরপর বলল,  " ইট ওয়াজ এ নাইস মিটিং বাই দ্যা ওয়ে "
অনেকটা এগিয়ে গিয়েও সুতপা আবার কয়েক পা পিছিয়ে এলো,
জিজ্ঞেস করল, "খালেক! এটা তো আপনার আসল নাম নয়! তাই কি?"
উত্তর এলো, " নো "।

গল্পঃ ডেটিং (একটি বিদেশী গল্প অবলম্বনে)

(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক, এর সাথে বাস্তবের কোন জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়)


উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...