বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২

ছোটগল্পঃ স্বচ্ছ

 (১)

অমিত কে দিনের পর দিন অবিশ্বাস করে চলেছে মুনিয়া। বিয়ের কেবল মাত্র দুটি বছর পার হয়েছে। বিয়ে নিয়ে সমাজের গুরুজনরা বলে থাকেন, " তিনটি বছর পার না হলে নাকি বিয়েটা কাঁচা থেকে যায়! আর সেটা যদি হয় প্রচলিত এরেঞ্জ ম্যারেজ। " এরেঞ্জ ম্যারেজ মানে কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রী এর সম্পর্ক হয়, গোটা দুই পরিবারের সাথে দুই পরিবারের মিল মিশেল। 

তবে প্রচলিত কথা যাই বলুক,- মুনিয়ার ঠিক প্রথমদিন থেকে কখনো ই মনে হয়নি অমিত তার অচেনা কেউ। অমিত বন্ধুর চেয়েও ঢের বেশি।

 মাইন্ড রিডিং বলে মনোবিজ্ঞানে একটা বিষয় আছে। এর মানে দাঁড়ায় "মন পড়া " অর্থাৎ আপনি কারও মনের কথা পড়তে চাইছেন তার সাথে কোন ধরনের আলাপচারিতায় না গিয়ে। সোজা ভাষায় " মাইন্ড হ্যাকিং " কি অদ্ভুত! একজনের মনের ভেতরের গল্প/চিন্তা/ক্ষোভ/ আনন্দ সহজে ই অনুমান করে নিচ্ছে অচেনা/চেনা আরেকজন মানুষ। অমিত তেমনি। মুনিয়ার প্রায় দু'বছরে ঘুরে বেড়ানো, শপিং স্বাদ-আহ্লাদ কিছুই পূরণ করতে বাকী রাখেনি অমিত। 

এমনিতে প্রচণ্ড চাপা স্বভাবের অমিত সহজে কাউকে কিছুই বলে না। অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের মানুষেরা নাকি হিংস্র হয়। প্রকাশ না করতে কথা একসময় বারুদের মতন ফোঁস করে জ্বলে উঠে। 

রান্নায় লবন বেশি, কিংবা টেবিলের জমাট ধূলো, সেলিঙে বাস করা মাকড়শারজাল এসব থাকলে অনেক পুরুষ ই অভিযোগ করে। কিছু পুরুষ অনেকটা মেয়েলি স্বভাবের হয়। খাওয়া দাওয়া থেকে মেয়েলি রান্না নিয়ে তাদের বিস্তর অভিযোগ থাকে। তাদের পরিবার তাদের নিয়ে সবসময় ই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় পড়ে। হয়তো ভুলের ফলে ই কোন ভুল না হয়ে যায়, নচেৎ বড়সড় হাঙ্গামা।

অমিত ব্যতিক্রম। করোনায় চাকরি চলে যাবার পরেও ওর মাঝে তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি। পুরুষ ঘরে থাকলে মেজাজ খিটখিটে স্বভাবের হয়, মুনিয়া অমিতের ক্ষেত্রে সেসব দ্যাখেনি। অমিত ভিন্ন, এমন ছেলে হয়না। অমিতে এখন চাকরি হয়েছে। একমাস ধরে অফিসে যাচ্ছে। মাঝের খারাপ সময় টা চলে যাচ্ছে। খারাপ সময়েও অমিত কোন বিষয়ে মুনিয়ার সাথে দূর্ব্যবহার করেনি। অমিত মাটির মানুষ।

বান্ধবী একদিন সেসব নিয়ে বলতে ই মুনিয়া বান্ধবী বলেছিলো, " এমন আবার হয় নাকি? নিশ্চই কোথাও না কোথাও ঝামেলা আছে" 

মুনিয়া তারপর থেকে ই বান্ধবীর সাথে দেখা তো দূর, ফোনেও যোগাযোগ করেনা। 


(২) 

অমিতের বর্তমান আচরণ বেশ রহস্যঘন। সে বাসায় থাকলে টুকটাক অভিযোগ করে। এই যেমন আগেরদিন দুপুরবেলা। মুনিয়া ঘুমিয়ে ছিলো। সকালে এসে রান্নার আমেনা বুয়া থালাবাসন সব ধুয়ে রেখে গেছে। মুনিয়া চিংড়ি মালাইকারি, সবজি ভাজা আর ভাত রান্না করে খাবারের টেবিলে তুলে রেখেছিলো। গোসল সেরে ই বড্ড ঘুম পেয়ে যাওয়ায় সে হালকা নিদ্রাতুর হয়ে পড়েছিলো ঠিক তখনি অমিতের গলায় ডাক শুনে আচমকা ঘুম ভাঙে!

-মুনিয়া! মুনিয়া! উঠো! এই ভরা দুপুরবেলা কিসের ঘুম?

মুনিয়া উঠে পড়ে, তবে ঘুমের ভাব তখনো কাটেনি ওর।

অমিত বলতে থাকে, টিভির রিমোট টা গেলো কই? কিচ্ছু সাজিয়ে রাখো না আজকাল! কাজে কর্মে একদম খেয়াল নেই। এভাবে কিভাবে হয়? বলো?

মুনিয়া বোঝে নি অমিত এই ভরদুপুর বেলা অফিস থেকে বাসায় কেন! তাছাড়া এসে ই এমন কেন করছে!

-খেতে দাও! আজ কি করেছো? 

মুনিয়ার কথায় জড়তা, 

-চিংড়ি মালাইকারি! তোমার তো পছন্দ!

-মুরগি করোনি? ফ্রিজে না আছে!

-আজ মালাইকারি টা খাও, রাতে করবো। তুমি খাবার টেবিলে এসো।

মুনিয়ার এরপর থেকে অমিত কে বিশ্বাস হয় না। সকালে অমিত অফিসে চলে যায় আর ফেরে সেই রাতে। কিন্তু ইদানীং হুটহাট করে ই দুপুরবেলা অথবা বিকেলবেলা বাসায় চলে আসে। একটা ফোন করেও আসে না। ফোন করে এলে হয়তো ওর জন্য কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে ই পারে মুনিয়া। 

এভাবে চলছে প্রায় এক মাস। দিনের অমিত আর রাতের অমিতে মাঝে বিস্তর ফাঁরাক খুঁজে পায় মুনিয়া। অমিত রাতে ফিরলে কত শান্ত, স্থির অথচ দিনের অমিত মেজাজে উগ্র। মুনিয়ার কিছু মাথায় ঢোকে না। 


(৩)

সকালে অমিত অফিসে গিয়েছিলো আবার ফিরেও এসেছে আজ বেশ তাড়াতাড়ি। অফিসে গেলে অমিত খুব একটা ফোন করেনা। আজ এসে ই টিভি দেখতে বসে গেছে ড্রয়িংরুম এ। ডিসকভারি চ্যানেলে জন্তুজানোয়ার শিকার দেখে তারপর কিছুক্ষণ পর মিটিং আছে বলে আবার অফিস।

-কই? আমার চা কোথায়?  (টিভি দেখছে অমিত সেখান থেকে ই তার চায়ের আর্জি)

ভাবনায় বাধা পড়ে মুনিয়ার। চুল বাঁধতে বাঁধতে রান্নাঘরে এসে ঢুকে সে। চুলায় চায়ের পানি বসায়। তারপর, বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসার আগ্রহ বোধ করে। চোখেমুখে পানি দিয়ে আয়নায় তাকাতে ই হঠাৎ ই খেয়াল করে গলায় লাল আঙ্গুলের ছাপ। দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ আক্রোশে চেপে ধরেছিলো গলা। গলায় হাত বুলিয়ে মনে পড়লো ঘুম ভাঙ্গিয়েছিল অমিত। ঘুমালে মুনিয়ার কিছু খেয়াল থাকে না। প্রচণ্ড ঘুম মুনিয়ার। হয়ত এলার্জি তে লাল হয়েছে। চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে চা বানালো সে।

মুখ মুছে চা বানিয়ে একটা ট্রে তে করে দু কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে ড্রয়িংরুম এ যায় মুনিয়া। চায়ের কাপ অমিত কে দিয়ে সে নিজেও হাতে তুলে নেয় এক কাপ। অবচেতন মনে অমিত বলে, " গতকাল রাতে ভয় খুব পেয়েছিলে তাইনা? "

-কেন? ভয় কিসের... (কথার মাঝে ফোন বেজে উঠে)

এখন আবার কার ফোন! 

মুনিয়া উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে কানে দেয়। 

-হ্যালো! মুন! আমার ফিরতে আজ রাত হবে, বস মিটিং ডেকেছে রাতের খাবার টা খেয়ে নিও। আমি খেয়ে ই আসবো। লক্ষ্মীসোনা প্লিজ রাগ করোনা।

মুনিয়ার হাত কাঁপতে থাকে, রিসিভার টা ধপ করে মেঝেতে পড়ে যায়। অমিত অফিসে থাকলে এখন তাহলে বাসায় কে! হৃদপিন্ড টা হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন ধরাম ধরাম শব্দে পেটাচ্ছে! আতঙ্ক আর ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে মুনিয়ার।

ওপাশে অমিতের গলা, হ্যালো.. মুন কি হয়েছে? হ্যালো! মুন... 



(সমাপ্ত)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...