রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সায়েন্স ফিকশন গল্পঃ নাবিল ও মঙ্গলের আজব প্রাণী

 



(১)

সন্ধ্যা থেকে ই মাথাব্যথা! এস্পিরিন জাতীয় ওষুধ খেয়েও কূল পাচ্ছেনা নাবিল। রাতের পর রাত জেগে এসাইনমেন্ট করতে হচ্ছে।  বছরের প্রায় শেষ। কিভাবে দেড়টা বছর ভার্চুয়াল ক্লাসে ই কেটে গেলো মহামারি সময়ে, এখনো সেসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে অবাক হচ্ছে নাবিল। এখন স্কুল খুলেছে, সেই সাথে বেড়েছে নানাবিধ ব্যস্ততা। পড়াশোনা এবং কাজ, কোনটা কিভাবে এগিয়ে নেবে সেটা বুঝতে গিয়ে ই বারবার হিমশিম খেতে হচ্ছে নাবিল কে। 

দোতলার জানালার পর্দা ভেদ করে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে ঘরের ভেতর উঁকি দিচ্ছে।

দেয়ালে ঝুলছে ডিজিটাল ওয়াচ। নাবিল একবার ঘড়ির লাল চলমান রেখা গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। রাত ১ টা বেজে ৩৯ মিনিট। যখনি ঘড়ির দিকে নাবিল তাকায়, মিনিটের ঘরে সর্বদা বিজোড় সংখ্য ই মেলে। ব্যাপারটা একেবারে ই কাকতালীয়। 

এতক্ষণ একনাগাড়ে টেবিলে বসে লিখতে লিখতে, সময়ের কাটা চেক করতে ভুলে গেছে নাবিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বইয়ের তাকে সাজানো সায়েন্স ফিকশন বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে কয়েক পাতা পড়তে লাগল নাবিল। নাবিল সায়েন্স ফিকশনের পোকা। ব্যস্ততা না থাকলে বইয়ের তাকে ধূলো জমার সাহস করেনা কোনদিন। তাছাড়া প্রতিদিন কোন না কোন বই নাবিলের হাতে মেলে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়।

নতুন বইটা এবার খুলতে পারেনি এসাইনমেন্টের চাপে। একটা গল্পে চোখ আটকে গেলো নাবিলের। " ইভেগা " নামের এক ভিনদেশী প্রানী'র গল্প। সে নাকি অনেক অনেক দূরের লাল গ্রহ মঙ্গলে থাকে। বিজ্ঞানীরা নাকি তাকে খুঁজে বেড়াছে বছরের পর বছর কিন্তু এই ইভেগা এতটা ই চালাক যে, সে পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত রেখে যায় না মঙ্গলের মাটিতে। সুতরাং সে কিভাবে মঙ্গলে পা ফেলে চলছে সেটা ই আরেক রহস্য। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ইভেগার নয়টা হাত, শরীরের রঙ পাল্টে যেতে পারে চারটে প্রধান রঙে। এমনকি সে অনেকটা গিরগিটির মতন রঙ পরিবর্তনে সক্ষম। চেহারা অক্টোপাসের মতন অখণ্ডিত। এছাড়া, তার আচরণ ও অত্যন্ত রহস্যঘন।

নাবিল আক্ষেপের করুণ সুরে খানিকক্ষণ হাসে। নাবিলের আজ যদি নয়টা হাত থাকতো তাহলে হয়ত এসাইনমেন্ট গুলো দ্রুত শেষ করে পরেরদিন ই স্কুলের ম্যামের হাতে জমা দিয়ে বলতো, " ম্যাম! সব এসাইনমেন্ট শেষ। "

ম্যাগাজিন পড়তে সময় চলে গেলো। ঘড়িতে রাত ১ টা ৫৯ মিনিট।নাবিল ভাবলো, এখন বরং শুয়ে পড়া যাক। রুমের আলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ফ্রেশ হতে গেলো নাবিল।


(২)

নাবিলের রুম খুব একটা বড় নয়। হোস্টেলের রুম। নাবিলের মা বাবা একসাথে থাকে না। দুজনে ই চাকরী করছেন দেশের দুই প্রান্তে তাই ছেলেকে রেখেছেন এখানে। কেবল ঈদ কিংবা পূজার ছুটিতে নাবিল এবং তার পরিবারের মানুষ গুলো একে অন্যের সাথে দেখা করে। হোস্টেলে পাশাপাশি ওর সমবয়সী আরো ছেলে আছে, তাদের রুম গুলোও একেবারে আলাদা। প্রত্যেকটি রুমে একজন করে ছাত্র থাকে। সবার রুমেও আসবাবপত্র সংখ্যা একই।

নাবিলের রুমের ভেতর আসবাবপত্র বলতে আছে একটি মাঝারি উচ্চতার আলনা, একটি টেবিল, একটি চেয়ার, একটি খাট আর টুকিটাকি জিনিসপত্র। এটা তিন তলা বিশিষ্ট একটি হোস্টেল। যেখানে শুধুমাত্র স্কুলের ছেলেরা ই থাকে। একটি রুমের সাথে অন্য রুমের তেমন একটা যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ই এমন ব্যবস্থা।

হোস্টেলে একজন সুপার আছেন তিনি নিয়মিত দেখভাল করেন ছাত্রদের। সকাল- দুপুর- রাত খাবারের ব্যবস্থা করেন। বেশ ভালো ই চলে যায় সবার। ছুটির দিনে কেবলমাত্র ব্যতিক্রম। সেদিন সবার জন্য টিভি, খেলাধুলা করার সুযোগ দেয়া হয়। নাবিল সেদিন টিভি দেখে। তাছাড়া নাবিলের রাতঘুমের সঙ্গী রঙিল মলাট দেয়া সায়েন্স ফিকশন তো আছে ই। পৃথিবীর কোথায় স্বর্ণের খনি, সিঙ্কহোল কি, আফ্রিকা মহাদেশ কি আবার জুড়ে বড় হচ্ছে, সমুদ্রের তলায় কতটা নীচে গেলে মানুষের কিছু হবেনা, কোথায় গেলে হীরে জহরথের দেখা মেলে, কোন নভোচারী স্পেস স্টেশনে গিয়ে বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন কিংবা সাম্প্রতিকতম সময়ে পাওয়া মনোলিথ রহস্য! এসব গল্প পড়তে ওর ভীষণ ভালো লাগে।


(৩)

রুমে ঢুকে ই অদ্ভুতুড়ে এক আলো দেয়ালে দেখতে পেয়ে ভয়ে দেয়ালের একদিকে সটকে পড়ল নাবিল। একটা লালচে বেগুনি আলো। ক্রমশ পুঞ্জীভূত মেঘের মতন ধীরেধীরে বড় হতে হতে সারা ঘরটা সেই আলো দিয়ে রঙিন করে ফেলছে।নাবিল রুদ্ধশ্বাসে সে দৃশ্য গিলে চলছে চুপচাপ কিন্তু চিৎকার করছে না। 

- হ্যালো ফ্রেন্ড, অ্যাই এম ইভেগা, ডোন্ট ইউ রিমেম্বার? ইউ রিড এবাউট মি এ ফিউ মোমেন্টস এগো। 

নাবিল কাঁপা গলায় বলল, 

- তুমি? ইভেগা! যাকে মঙ্গলগ্রহ তে বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছে? আর তুমি এখানে! অবিশ্বাস্য!

- ইয়েস, অ্যাম হেয়ার টু হেল্প ইউ আউট!

নাবিল কয়েক আরো কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা  শক্ত করে দাঁড়ালো। তারপর ধীর গলায় বলল,

- তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছো?

ভীনগ্রহের প্রানী ইভেগা অনেকটা ঘোড়ার ডাকের মতন চিঁহি স্বরে শব্দ করলো। 

নাবিল বলল, 

- এমন শব্দ করছো কেন?

ইভেগা বলল, 

- আমার হাসিতে এমন শব্দ হয়। তোমরা মানুষ, নিশ্চয় তোমরাও আনন্দ পেলে হাসো। আমিও হাসি। তখন এমন শব্দ হয়।

নাবিল অবাক! বলল, 

- সে কি এখন যে বাংলায় কথা বলছো?

- আমি প্রায় ৯০ কোটি ভাষা পারি যার মাঝে বাংলাও আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ইংরেজি তে ই বলবো কিন্তু তুমি বাংলায় বলছো। একে অন্যের সাথে মনের ভাব আদানপ্রদান খুব জরুরি। এজন্য ভাষা একইরকম হওয়া উচিত। 

নাবিলের ভয় অনেকটা কাটল। বলল,

- ম্যাগাজিন এ পড়লাম তুমি অনেক মেধাবী।

ইভেগা চিঁহি শব্দ করলো। তারপর বলল,

- আমাদের কমিউনিটি তে কাউকে মেধাবী বলা হয় না, বলে ইবিউ!

নাবিল একটু হেসে বলল, 

- ইবিউ ইভেগা! ডাবল -ই। আচ্ছা, আমাকে এখন বলতো- তুমি কেন আমার দেশে? আবার এসে ঠিক আমার ঘরে যখন তোমাকে বিজ্ঞানীরা ট্রেস করে পাচ্ছেনা তাহলে আমাকে কেন তুমি ধরা দিচ্ছো?যদি আমি সবাইকে বলে দেই?

ইভেগা বলল, 

- কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কারণ তোমাদের পৃথিবীর প্রায় সবাই অবিশ্বাসী। এক অন্যকে ঠকিয়ে চলেছে দিনের পর দিন। তোমাদের সব কাজের দলিল অথবা প্রমাণ প্রয়োজনীয়। এজন্য কাগজ লাগছে প্রতিদিন, তোমরা গাছ কেটে ফেলছো। জানো ই তো গাছ কাগজ উৎপাদনের একটি প্রধান উপাদান। পরিবেশ বিপর্যয়। কিন্তু আমাদের দেখো। আমাদের দেশে কথা দিলে আমরা কথা রাখি, ডাটা সংরক্ষণ করতে ব্রেইন ইউজ করি। সেগুলো ট্রান্সফার করতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা মিথ্যেবাদী নই। তাই প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। কেউ কাউকে ঠকায় না, আমরা অবিশ্বাস করিনা কেউ কাউকে।

নাবিল কিছুক্ষণ ভাবল তারপর বলল, 

- তোমার কথায় বেশ যুক্তি আছে। আমরা তোমাদের মতন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে সত্যি অনেক এগিয়ে যেতাম।

ইভেগা ক্রস চিহ্ন দেখালো। মানে সে নাবিলের সাথে একমত। তারপর বলল, 

- আজ অনেক দেরী হয়ে গেলো। এবার তোমায় সাহায্য করা যাক।

ইভেগা এগিয়ে এসে নাবিলের টেবিলের দিকে গেলো তারপর অক্টোপাসের মতন নয়টা হাত বের করে নয়টা এসাইনমেন্ট একসাথে দ্রুত লিখে ফেলল মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। যেগুলো আগে ই সমাধান করে রেখেছিলো নাবিল।

নাবিল বলল,

- একি! এসব তো আমার কাজ! 

ইভেগা বলল,

- কাল সব জমা দেয়ার তারিখ তাইতো? লেখা কিন্তু শেষ হয়নি। করোনার কারণে তোমাদের স্কুল বন্ধ ছিলো। এখন খুলেছে।

নাবিল মাথা নাড়ালো।

ইভেগা বলতে লাগল,

- কাল তোমার মা আসবে তোমাকে নিয়ে যেতে। তোমাকে নিয়ে উনি বেড়াতে যাবেন সমুদ্রে। (সম্ভবত ভবিষৎবাণী) 

নাবিলের চোখ চকচক করে উঠলো। 

- সত্যি? 

ইভেগা বলল, 

- হ্যাঁ। আজ আসি। ভোরের আলো আসার দুই ঘন্টা আগে আমাকে মঙ্গলে ফিরতে হবে। ওয়াদার ব্যালেন্স হওয়া জরুরি। 

নাবিল কে ধন্যবাদ দেবার সুযোগ টুকুও দিলো না ইভেগা। জানালা গলে চলে গেল বাইরে তারপর তারা খসে পড়ার মতন ধীর গতিতে চলে গেলো উত্তর দিকের আকাশে। নাবিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আসমানে।

অ্যালার্ম শব্দে নয়, নাবিলের ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, 

- কেমন আছিস নাবিল? 

- মা! নাবিল অবাক। 

তারপর অবাক চোখে বলল, ইভেগা! 

মা প্রশ্ন করলেন, ইভেগা?

বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে পড়ল নাবিল। দ্রুত টেবিলে ঝুঁকে এসাইনমেন্ট গুলো খুলে ফেলল পাতার পর পাতা। সেখানে সব কমপ্লিট। তাহলে, রাতে কি স্বপ্ন দেখেনি নাবিল? হয়ত না আবার হয়ত হ্যাঁ। 



(সমাপ্ত) 


সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গল্পঃ পয়সা

 (১)

নিশুতি রাত। শো শো শব্দে বাতাস বইছে। হালকা বাতাসে বাতাবি লেবু গাছের ডালটা একটু দূরে ই নড়ে আলোছায়া খেলা খেলছে।

চারিপাশ ফাঁকা। মাঝেমধ্যে মাটির গর্ত থেকে বেড়িয়ে ঝিঝি পোকারা একনাগাড়ে ডাকছে। এমন মৃদ্যুমন্দ আবহাওয়া তে মন উদাসী হয়। আর রাত হলে নানারকম কথা মানুষের মাথায় ঘুরতে থাকে। ঠিক এখন- যেমনটা সগীরের মাথায় খেলা করে চলছে। কথার একটা অংশ দখল করে স্মৃতিময় অতীত।

মানুষের জীবনে এই স্মৃতিকাতরতা -এক অদ্ভুত অসুখ। অতীতের সেইসব কথা ভাবতে ভাবতে আনন্দে -কখনো মুখের চামড়া উদার হয়ে হাসে, আবার কখনোবা চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ে। গ্রামের নাম জনমশীলা। এ গ্রামের বাসিন্দা সগীর উদ্দিন। এখন বন্ধুর সাথে নানান ব্যাপারে কথার আদানপ্রদান করছে সে। বন্ধুর নাম আলমগির, দুজনের বয়েসের ব্যবধান কম। 

সগীর উদ্দিন বলল, " এইখানে এতদিন ধরে পড়ে আছি অথচ আমার ছেলেটা এদ্দিন পর দেশে ফিরেও একবার আমাকে দেখতে আসলো না। " 

অভিযোগের বিপরীতে বন্ধুবর আলমগির নীরব। 

এখানে -পাশাপাশি দুজন। বাসিন্দা আরো আছে, তবে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব বলতে এই দুজনের ই, সগীর এবং আলমগির। 

একসময় দূর্দান্ত প্রতাপ ছিল দুই বন্ধুর। গ্রামে দুজনের দস্যিপনার কথা লোকেরমুখে মুখে ঘুরে ফিরতো। আজ সেসব অবশ্য অতীত। নতুন গাছে সবুজ পাতা দেখলে যেমন মানুষের মনে খুশীর ভাব জাগে, সেই পাতা ই হলুদ হয়ে ঝরে পড়লে আর তার কোন খবর থাকে না। 

সগীর বলতে লাগলো, জীবনের দাম আজ আর নাই আলমগির। দাম থাকতো যদি কিছু করতে পারতা। দুনিয়াদারী তে পরিশ্রম, টাকা এগুলার দাম মানুষের থেকে বেশি। আলমগির কিছু বলে না। সে এখানে আসার প্রথম দিন থেকে ই চুপচাপ। এখনো কিছু ঘটনা তার নিজের ই বিশ্বাস হয় না। পূর্ণিমারাত আসলে সে উদাসীন হয়, নতুন দেয়া বাঁশের বেড়া ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ো কাঁদে। আলমগির এভাবে ই কাঁদতো পৌষের মেলা ফেরত আসার পর। গরীবের ছাওয়াল আলমগির। মেলার সব খেলনা কিভাবে সে একা কিনবে? এত পয়সা তার ছিল না। সগীর বলতো, আমি নাহয় বাঁশি কিনি, তুই আরেকটা খেলনা কিনে নে। দুজনে ভাগাভাগি করে খেলমু!

আলমগিরের সাথে ঠিক এভাবে ই সগীরের বন্ধুত্ব জমাট বাঁধে। কথায় আছে, আত্মার বন্ধু টিকে যায়-হলোও তাই। 

একটা সময় ছোট থেকে বড়, বিয়েশাদি সব ই জীবনের নিয়মে পালন করলো দুজনে। বন্ধুতা টিকে ও রইল দুজনের মাঝে। এরপর বুড়ো হলো, নিজের ছেলেমেয়ে কে বিয়ে দিয়ে হলো নিশ্চিন্ত। সেসব কতদিন -কতশত ঘটনা। 


(২)

রাত বাড়ছে। কুয়াশা হানা দিতে শুরু করেছে গাছের পাতায়। কুয়াশা পানির মতন টপটপ করে ঝরে পড়ছে মাটিতে। ওদের ঠান্ডা লাগছে কি?কথায় আছে- " মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। "

আলমগির আচমকা বলে উঠলো, ওরে! সগীর। সেই যে- বিহানবেলা তে মাছ ধরার কথা তোর মনে আছে রে?

 সগীর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ! এতবড় একটা বোয়ালমাছ ধরার পর দুইটা দিন বাড়িতে মাছের কত প্রশংসা করসে। মাছ ধরাটা একপ্রকার নেশা হয়ে গেছিলো। আহারে দিন ছিল। সগীরের চোখে পানি। দুজনের নীরবতা। 

কিছুক্ষণ পর একদল লোকের গলা আর পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। আগের মতন ই নিশ্চুপ হয়ে গেলো দুই বন্ধু। 

একদল লোক অনেকক্ষণ কান্নাকাটি, হাটাহাটি তারপর দোয়া পড়ে যে যার মতন বাড়ি ফিরলো। এখন রাত নয়টা। ধীরেধীরে রাত বেড়ে চলেছে গ্রামে। তাছাড়া, গ্রামের দিকে রাত নয়টা মানে অনেক। রাত বাড়লে গ্রামের দিকে শিয়াল আসে, ঝিঝি পোকার ডাক বাড়ে। কুকুরগুলো কুঁকিয়ে উঠে শীতের কাঁপনে। ঝোপঝাড় থেকে জোনাকিপোকা দল আলো জ্বেলে দলে দলে বেড়িয়ে আসে। কুকুরগুলো দূরের বাড়িগুলো থেকে থমকে থমকে ঘেউ ঘেউ করে জানান দিকে থাকে ওদের অস্তিত্বের। 

হঠাৎ ভারী গলার আওয়াজে চমকে উঠে সগীর আর আলমগির। 

-স্লামালেকুম! (গলার আওয়াজ নতুন) 

সগীর প্রশ্ন করে, আপনার পরিচয়?

-আমি মোস্তফা! চেয়ারম্যান নূরে মোস্তফা!

আলমগির পাল্টা প্রশ্ন করে, আপনি তো শুনছি প্রায় যুবক!কিন্তু আপনে এইখানে কেন?

-আরেহ মিঁয়া!  এত প্রশ্ন করেন ক্যান? আপনারা কি একলা থাকবেন এক জায়গায় এমন তো কথা নাই। এই জায়গা টাও আমার ছিল। গ্রামের বিরোধী পক্ষ কাইড়া নিছে আমার থেকে, হু!

সগীর মৃদ্যু হাসলো। মনে মনে ভাবলো- এখনো দেমাক কমে নাই চেয়ারম্যান সাবের।

 কথায় আছে ক্ষমতা এক অদ্ভুত জিনিস। 

আচমকা ই একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল সগীর। বলল, আপনে আমারে চিনেন? 

-কে তুমি?

-সগীর! 

-ওহ! চিনছি! তাতে কি?

-চিনলে তো অবশ্যই মনে পড়ার কথা পুকুরপাড় এর জমিটা আপনার ভাই জোর কইরা আমার হাতে টিপসই দিয়া নিয়া নিলেন।

-হ! এগুলা কানাঘুষা! সব বিরোধী পক্ষের কামকাজ! আমার দ্বারা এগুলা হয় না।

আলমগির বাঁধা দিয়ে বলল, " থাম সগীর থাম! এখন একটু শান্তি দে। কি করসে এগুলা কইয়া খামাখা ঝামেলার কি দরকার।"


(৩)


শীতের রাত। হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে পাহারাদার কয়েকবার আলো ফেলে পুরো এলাকা একবার চক্কর দিলো। 

সগীর শুনলো নয়নের মা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রোজ রাতে ই মহিলা একলা একলা কাঁদে। কাজের ধান্ধায় ছেলেটা বিদেশে গেছিলো ওর। সম্ভবত দুবাই, বিয়েও দিয়েছিলো ভাল ঘর দেখে, মেয়েটি সুন্দরি। বিদেশ যাওয়ার মাস খানেক মোটা টাকা বৌয়ের নামে পাঠাতে লাগল নয়ন। সব ই ঠিকঠাক চলছিলো। 

একদিন বৃদ্ধ মা দেখলো বাড়ির বৌ, দুই বাড়ি পরে বাড়ির দুই বাচ্চার বাপের সাথে পালিয়ে গেছে। এতদিন ছেলেটা যত টাকা পাঠাইসে সব নিয়ে ভেগে গেছে। বৃদ্ধা মা একদিন পরে ই শুনলো আরেক খারাপ খবর। নয়ন ছেলেটা উঁচুতলায় কাজ করার সময় অসাবধানতা বশত পড়ে মারা গেছে। খবর শুনে বুড়া মায়ের সেই যে হুশ গেলো। তারপর এখন সে কাঁদে। নয়নের নামে কাঁদে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। 

আচমকা -পায়ের মৃদ্যু আওয়াজ শোনা গেলো। টর্চের আলো হাতে পাহারাদার জয়নাল হাজির। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা! জয়নালের দেখা মিলবে ই এখানে। সে লোকটা ভয়ে কাঁপে তবুও প্রচণ্ড সাহস ওর। টাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে। এখন সে ভয় কে জয় করতে শিখে ফেলেছে।

নয়নের মায়ের কান্নার আওয়াজ কমে যায় কিন্তু থামে না। কান্নার আওয়াজ তীক্ষ্ণ হয়। ভয় পেয়েছে জয়নাল।

কাঁপা হাতে গলায় বাঁধা তাবিজ টা কয়েকবার চুমু দিয়ে বলল, ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! বাঁচাও। তারপর আয়াতুল কুরসি পড়লো। তারপর চাদর টা ভাল করে জড়িয়ে টর্চের আলো ফেলে ঘাসের উপর খসখসে পা ফেলে চলে গেলো অন্যদিকে।

একরাশ নীরবতায় ঢেকে পড়লো চারপাশ। কেউ কোন কথা বলছে না। নয়নের মা এখন নিশ্চুপ। মনে হয় ক্লান্ত হয়ে গেছে। ক্লান্ত হলে সে চুপ হয়ে যায়।


(৪) 

ভোররাত, আলো উঁকি দিবে আরো কিছুক্ষণ পর। ঘুম ভাঙে আওয়াজে।কারো পায়ের শব্দে কেঁপে উঠে আলমগির। ওর কবরের উপরে কেউ এসেছে। হাটাহাটি করছে। চেয়ারম্যান মোস্তাফা ঘুমাচ্ছে। প্রথমদিন এসে ই সবাই কবরে গভীর ঘুমে ঘুমায়। একে বলে " মরার ঘুম! " 

আলমগির মৃদ্যু কাতরোক্তি করে সগীর কে ডাকে। সগীর বুঝতে পারে, সেও ভীতসন্ত্রস্ত। চাপা গলায় বলে, "কে? কারা?"

আলমগির মাথা নাড়ায় ঠিক যেন- সেও জানেনা কিছুই। সগীর বুঝতে পারে। কারা যেন শাবল দিয়ে কবর খুঁড়ছে। মরার পরেও শান্তি নাই। দ্রুত খুঁড়ে ফেলেছে এরা। আলমগিরের কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বের করছে চারজন। আলমগির এখন পুরনো কঙ্কাল। সগীর দেখতে পেলো আলমগিরের ছেলে এসেছে- সাথে নিয়েছে আরো তিনজন কে। ওরা কবর খুঁড়ে বের করে নিচ্ছে আলমগিরের কঙ্কাল।

 বিস্মিত দুই বন্ধু সগীর এবং আলমগির। ওদের লাশ তুলতে এসেছে ওরা। 

চটের ছালায় হাড়গোড় ভরে নিতে নিতে ওরা আলাপ করলো। " আব্বায় বাইঁচা থাকতে এক পয়সা সম্পত্তি দিবার পারে নাই। মইরা গিয়াও কবরের দাম খরচা করাইসে। এখন এই হাড্ডি বেঁইচা যদি কিছু আয় হয়।"

সগীরের মনটা কাতর। বন্ধুর শেষ অস্তিত্ব টা কাটা হয়ে গেছে। এখন ওর কবর খোঁড়া চলছে। আলমগিরের ছেলেটা হয়েছে বেঈমান। কীটনাশক খাইয়ে তার বাবাকে ই কে এই ছেলে মেরে ফেলেছিলো দুই বছর আগে। 



(সমাপ্ত) 

শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০২১

ছোটগল্পঃ হরিশের ভিটে


দেয়াশলাই টা দপ করে নিভে গেলো। শিক দেয়া জানালা দিয়ে বাতাস যেন অনুমতির তোয়াক্কা না করে ই ঢুকে পড়ছে দ্রুত।
ধ্যাত! (অনেকটা ই বিরক্ত হরিশ ভদ্র)
আরেকবার দেয়াশলাই থেকে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেও সেটা দপ করে আগেরবারের মতন পুনরাবৃত্তি হয়ে দ্রুত ই নিভে গেলো। ম্যাচ টা পকেটে পুরে লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালাতে বাধ্য হলেন হরিশ ভদ্র। অন্ধকারে বন্ধ ঘরের শুধুমাত্র জানালা একটি, একটিমাত্র দরজা যেটি এখন পুরোপুরিভাবে বন্ধ তবুও বাতাসের তীব্র গোঙানি তে কেঁপে উঠছে থরোথরো। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কাঠের চেয়ার টেনে এবার জানালার ফাঁকা অংশে বসলেন তিনি। চারদিকে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরের কোন পাখি সশব্দে আর্তচিৎকার তুললো, সাথে সাথে আরো জোরালো হলো বাতাস। মনে হলো, পাখির কন্ঠে সায় দিলো সে।

হরিশের ভিটে। এই গ্রামে সবাই এই বাড়িটা একনামে চেনে। ছোটবেলায় অসীম, শাশ্বত, অভিষেক একসাথে মাইনে দিয়ে পড়তে আসতো এখানে। ক্লাস ওয়ানের ছেলেপেলে মারাত্মক ভয় পেত হরিশ স্যার কে। তবে এখনকার পড়ুয়া ছাত্ররা আগের মতন নয়, শিক্ষক কে তেমন একটা ভয় তারা আজকাল করে না। গুরুজন কেও সম্মান ততটা করে না। অথচ পুরোনো সময়ে যখন ওরা ছাত্র ছিল, তখন অসীম একবার হরিশ ভদ্রের ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলো। দুইয়ের সাথে বায়ান্ন যোগ করলে কত হয় অসীম সেটা বলতে পারেনি। হরিশ ভদ্রের চেহারা অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দেবীর সাথে থাকা অসুরের মতন। গালে মোটা তিল, পাঁকানো গোঁফ তার সাথে মাঝ বরাবর সিঁথিকাটা আলুর মতন গোলাকার চেহারা। দেখলে ই পিলে চমকে যেত ওদের।
"কি রে শাশ্বত?  অংক করিস নাই কেন?"
স্যার! ক.. করি..নাই!
"অসীম পাঁঠা? অংকের খাতা কই?"
স্যা..র..
নাম শুনে ই অসীম কান্ডখানা করেছিলো।
হরিশ ভদ্র অনেকবছর স্কুলে পড়ালেন। বগলে ছাতা, পায়ে সস্তা স্যান্ডেল, তেল দেয়া মসৃণ চুল। প্রায়শ এভাবের কোথাও না কোথাও দেখা যেতো তাকে। ২০০-৩০০ টাকায় দূর্বল ছাত্ররা পড়তে যেতো তার কাছে। স্কুলের পাশাপাশি নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলেছিলেন। তবে শিক্ষকদের রেষারেষি তে বেশিদিন চালাতে পারেন নি। শেষদিকে চাকরি টা তার চলে যায়। তখন একবার শাশ্বত তাকে গ্রামের বাজারে দেখতে পেয়েছিলো। মাথার চুল পেঁকে গেছে, চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে তবে সেই আগের মতন ই আছেন। স্যার কে দেখে কুশল বিনিময় করলেও হরিশ ভদ্র কে আন্তরিক দেখা গেলো না। বহু বহুবছরের পুরোনো ছাত্রকে দেখে তিনি আপ্লুত হলেন না দেখে শাশ্বত অনেকটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলো সেদিন।
সাবধানে! সাবধানে!
অভিষেক সতর্ক করলো বাকী দুজন কে। মোবাইল আর টর্চ হাতে ওরা তিনজন এগিয়ে চলেছে হরিশ ভদ্রের ভিটার দিকে। একবার হলেও এই শুনশান নীরব রাতে ওরা দেখতে চায় গুঞ্জন কতটা সত্যি!
এই! এই! শক্ত করে শাশ্বত'র হাত চেপে ধরলো অসীম। তারপর আগুল তুলে অন্ধকার জানালায় জ্বলতে থাকা সিগারেটের ছোট্ট আগুন দেখে গায়ত্রী মন্ত্র জপতে লাগল অভিষেক।
শাশ্বত গলা নামিয়ে বলল, " যা শুনেছি সেসব তবে সত্যি! "
একরাতে আগুন লাগে, স্যার একা থাকতেন। ঘুম বেজায় কড়া তাই আর বাঁচতে পারেননি ঘর ছেড়ে। দিনের বেলার এলে দেখবি বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে আছে।
পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিলো অভিষেক।
"চল ফিরে যাই, ভিটে টা এখন ভৌতিক।"
ফিরে চলল ওরা। ধীরেধীরে আঁধারের মাঝে পথ দেখে ফিরতে লাগল তিনজন। শাশ্বত কি একটা মনে করে পিছু ফিরলো। জানালায় এখন লাল আলো তিনটি। সম্ভবত চোখজোড়া জ্বলছে।

(সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

ছোটগল্পঃ প্রত্যাবর্তন

 পাণ্ডুলিপি টা প্রায় শেষ, এডিটিং করাটা বাকী। আগের রাতেও কথা হলো প্রকাশকের সাথে। ভদ্রলোক আমাকে দেখে মারাত্মক ভয় পেলেন! আমার এতে পেট ফাটানো হাসি পেলো। হাতের ইলিশ মাছ জোড়ার মায়া ছেড়ে উল্টোদিক লক্ষ্য করে তিনি প্রায় পড়িমরি করে ছুটে গেলেন। ভেবেছেন আমি হয়ত- পাওনা টাকা টা আগে ই চেয়ে বসবো। বিশ্বাস করুন, আমি তেমন মহাজন ঘরানার মানুষ নই।

বাবা! তোমার চা!

মেয়েটা ক্লাস টেনে উঠলো। অসাধারণ মেধাবী, তবুও লোকে কুৎসা রটায়! বলছে মেয়েটা নাকি পাগলি। বাবা হিসেবে এ কথা শুনতে কতটা খারাপ লাগে সেটা বোধহয় পৃথিবীর তাবৎ বাবা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। জানি মেয়েটা আংশিকভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তবে লোকের কথায় সে তো আর পুরোপুরিভাবে পাগলি নয়।

অংশুক বাসায় এসে ব্যাগ ছুড়ে দিলো সোফায়, মার্চের আগুনে গরমে ওর মুখ লাল। আজ স্কুলের রেস ছিল, স্পোর্টসে রীতিমত ভাল। আজো জিতে এসেছে সে। পায়ের ধুলোবালি, টি টেবিলে রাখা কবজি সাইজের ক্রেস্ট টা তার ই প্রমাণ।

নিবেদিতা ঘরে এলো, আমার ঘরে সে এখন কম আসে। সারাদিন ছুটোছুটি চলছে ওর। শুনলাম পেনশনের টাকাটা এখনো আসেনি আমার। ফাইলের মারপ্যাঁচ খেলতে খেলতে হয়ত কোন এক টেবিলে আটকে পড়েছে। টাকা চুরি করতে শিখিনি বলে এখানেও তেমন উৎকোচ দেয়ার সামর্থ নিবেদিতার নেই। তাই উপরওয়ালা বরাবর নালিশ রেখে তার দুয়ারে মাথা ঠেকাচ্ছে আমার উনি। সে ঠেকাক! কিন্তু যারা পেনশনের ফাইল টা ঠেকিয়ে রেখেছে তাদের কে ঠেকাবে কে? পত্রিকার পড়লাম, নচ্ছার বলে একদল আরেক দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উভয় নচ্ছার ই একে অন্যের পরিপূরক। মাঝখানে পড়ে আম ছালা চলে যায় আম পাব্লিকের। সৎ মানুষের অভাব। এদের অভাব নেই, মানুষ কেন জানি সৎ থাকতে পারে না। এই অধিকার টা একটা সময় এরা হারায়। খুব রাগ হচ্ছে, উঠে গিয়ে টেবিলে গুছিয়ে রাখা আমার লেখা পাণ্ডুলিপি টা ছাইপাঁশ বলে ছুঁড়ে দিলাম। কাগজগুলো উড়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। আমার মেয়েটা কোথা থেকে উড়ে এসে সেগুলো গুছিয়ে বাকা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, " বাবার! বাবার লেখাগুলো বাতাসে উড়ে..উড়ে গেলো "

দেয়ালে সাদাকালো ছবিটায় ফুল শুকিয়ে এসেছে। সময়ের মারপ্যাঁচে আমিও শুকিয়ে হারিয়ে গেছি দু-বছর আগে।


(সমাপ্ত) 

শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২১

ছোটগল্পঃ চুড়ি

 রিমঝিম কে বললাম কফি করো তো! 

আড়মোড়া আর চুড়ির সিম্ফনি তুলে বিছানায় শুয়ে ই আওয়াজ করল সে। বলল, আনছি!

এমন যদি হতো শহুরের সব থেকে উঁচু বিল্ডিং এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে একনজরের শহরের বুকে আকাঁ কোন এক পিকাসোর ছবি এক নিমেষে শুধু একবার চোখ বুলিয়ে দেখে ফেলা যেতো! 

আমার এখন ঠিক তেমনি লাগছে। ভোরের কুয়াশা এসে একটি চাদরের মতন জড়িয়ে ফেলেছে গোটা শহর টা। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। আমি ছিলাম কাজে, রিমঝিম পড়েছে বই। ভোরবেলা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে নিজেদের কে নানান নামে ডেকেছি। আজ প্রতিযোগিতা ছিল নিজেদের জানা খাবারের নামে একে অন্যকে ডাকতে। এই যেমন আমি চিনি, ও আমাকে বলছে গুড়!

আমি মুড়ি, ও চানাচুর!

তারপর হঠাৎ কখন ঘুম এসে আলগোছে দুজন কে তুলে নিয়ে গেছে দুজনের কেউ জানিনা।

বিয়ের আগের দিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সাদা পাঞ্জাবির নীচে গেঞ্জি না পড়ায় ভিজে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল আমাকে। তবুও আমার হাতের ছাতাটা রিমঝিমের মাথায় ধরেছিলাম। বিয়ের শুরুটা হয়ত এমনি। একটি মেয়েকে নিজের আশ্রয়ে নেয়া। তাকে সমস্ত ভরসা দিয়ে বলা, " আমার কাঁধে এসে ঘুমাতে পারো, আমি জেগে আছি "। আকাশের চাঁদকে ও হয়ত তারা একই কথা বলে। 

রিমঝিমের পা ভিজেছিল সেদিন, পায়ে লাগানো লাল আলতা দেখে আঁতকে উঠতে হবে! রক্ত! কেটেছে!

রিমঝিম একটা বিরক্তি মুখে বলেছিল! হয়েছে! এত আদিখ্যেতা ভাল নয়। এসব দেখালে নাকি একসময় ভীষণ আফসোস করতে হবে। মানুষের নজর লাগবে। নজর নাকি খুব খারাপ। ওর ছোট ভাই টা খুব সুন্দর হয়েছিল, তবে বেশিদিন বাঁচেনি। অতি সুন্দর মানুষের চোখে সহ্য হয়না।

যাক সে কথা!

রিমঝিম হয়ত এখনো উঠেনি। দমকা বাতাস এসে ঘরের উইন্ড চাইম টাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এই শীতেও আমি দরজা খুলে রেখেছি। বন্ধ ভাব টা আমার ভালো লাগে না, রিমঝিমের তো নয় ই।

কলিং বেল বাজল!

-কে?

-স্যার! পেপার নিবেন না আইজ?

-হ্যাঁ! দাঁড়াও আসছি।

গেট খুলে দাঁড়ানোর পর ছেলেটা আমার দিকে একবার আর তারপর অদ্ভুত চোখে ঘরের ভেতর টা দেখল। শ্যামলা মতন ছেলেটা রোজ ই এই পত্রিকা দেবার বাহানায় এমনটা করে। রাগে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলাম। 

এখন কফি খাবো! রিমঝিম!  রিমঝিম!  তুমি এখনো ঘুম থেকে ই উঠোনি, কফিটা কি আমি ই করবো?...

পত্রিকার ছেলেটা নীচে নেমে ই আকঁড়ে দারোয়ানের হাত ধরল। তারপর বলল, পাগলা আজ খেপছিল! আমারে দেইক্ষা দরজা লাগাই দিসে! বাসায় ভিত্রে চাইছিলাম -দেখি রুম অপরিষ্কার! ঘরের সিলিং এ চুড়ি ঝুলতেছে। শুনলে মনে হয় বাড়িতে মহিলা মানুষ আছে।

দারোয়ান গলা নামিয়ে বলল, যাও গা! ক্যান্সারে বউ টা মরার পর ভদ্রলোকের মাথা ঠিক নাই।



(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র সমস্ত কাল্পনিক) 

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...