রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭

গল্পঃ একপাশ




চায়ের কাপের উপর পিরিচ ঢাকা ছিল। ঠান্ডা হচ্ছে চা, সে খেয়াল আছে। খসখসে শব্দে ফাইলে সাইন করে চলেছি একেরপর এক! ভীষণ ব্যস্ততা। তবুও সৌরভ এসেছে আমার অফিসে, কেবলমাত্র আমার সাথে দেখা করতে।
আড়চোখে বার দু'য়েক ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম বন্ধু বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই হাতঘড়ি টা কয়েকবার অনিচ্ছাবশত দেখে চলেছে সে।
গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললাম, দেখছিস তো! অবস্থা! অফিস লাইফ। রোজ সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা। কাগজেকলমে কাজ, এর বাইরে যদি করতে হয় সেটা অবশ্য আন-অফিসিয়ালি বরং অফিসিয়াল!
কথাটা মনে হয় সৌরভের খুব একটা পছন্দ হয়নি। তাই মুখের কোণায় "চুক" জাতীয় একটা শব্দ করে বলল, "তোর অফিস! ফোনেও তাই, আজ এসেছি তবুও সেটাই!"
কলম থামিয়ে বললাম, বন্ধু!  এটাই তো ব্যাবধান। আগে ভাগে ভেবেছিলাম বিজনেস করবো। দ্যাখ! কই ফেঁসে গেলাম.. সরকারি চাকরি।
লস তো আর নেই! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ই কথাটা বলল সৌরভ।
হাহা, সেই দেখবি। এদিকে নিজের স্বাধীনতা অন্যের হাতে লুট হয়ে যাচ্ছে, সে তো আর দেখবি না!
চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে সৌরভ আমার কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল, " বুড়ো হলে পেনশন পাবি না! ওটা তো বিজনেসে পাচ্ছিস না!"
কথার উত্তর দেবার মাঝখানে, পিয়ন এসে হাজির। আরো একগাদা ফাইল নিয়ে এসেছে। অফিসের নতুন জয়েন করা একাউন্টটেন্ট কি একটা ভুল করেছে। গোটা অফিসে নাকি হইচই লেগে গেছে।
সৌরভ, শীতের সকালে ফাঁদে ধরা অতিথি পাখির মত আর্তচিৎকার করতে না পারলেও আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, " নে! আজ উঠি। তুই আমাকে ফ্রি হলে একটা ফোন দিস। "
আচ্ছা।  (চেয়ার ছেড়ে ওঠে চলে গেল সৌরভ)
আমি ওর যাবার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফের কাজে মন দিলাম।
আমার বন্ধু সৌরভ। চোখে পাতলা চশমা, হ্যাংলা। দেখতে শ্যামলা। খুব বেশী টাইমলি চলে। ভার্সিটি লাইফে আমার একনিষ্ঠ রুমমেট। কাগজ-কলম থেকে শুরু করে, গায়ের শার্ট কি না শেয়ার করেছি দুজনে। এমন হতো জামাকাপড় কিনতে গেছি দাম টা আমার হাতের নাগালে নেই, তখন দুজনে মিলে সেটা কিনেছি ভাগাভাগি করে পড়ব বলে।
তবে বন্ধু সৌরভ ছিল সিরিয়াস। পড়াশোনা, লাইফ, ফ্যামিলি প্রায় সবকিছু নিয়ে। ফান কিংবা ফানি কোনকিছু তে ও আসত না। কিন্তু ও ছিল জলজ্যান্ত একটা কমেডি। একবার ভার্সিটি হলে পরীক্ষার মৌসুম চলছে। আমার বান্ধবীর ফোন ঠিক হলের খাবার শেষ করে ঢেঁকুর তুলে দোতলায় নিজের রুমে ফিরছি।
হ্যালো, শুনছিস!
হ্যাঁ, বল রে! কি হয়েছে?
রুমে বাজি ধরা হয়েছে, এই রাত ১২ টার আগে কাঁচা আম নিয়ে চাটনি মাখার।
ভালো তো! আমি কি করতে পারি বল? যদি বলিস, তাহলে অন্তত তোর হলের গেটে এসে আমের লবন টা ঠিক আছে কিনা দেখে আসতে পারি। তবুও আজকাল এসিডিটি হচ্ছে। (বলে ই একটা ঢেঁকুর তুললাম)
ছিঃ ছিঃ কি সব শোনাচ্ছিস রে!
কেন? শব্দটা ভালো নয়! হে হে..
তুই থামবি? শোন কাজের কথা প্রক্টরের অফিসের সামনে আমের গাছ আছে দেখেছিস?
হ্যাঁ, তো!
এখন গিয়ে গাছে ওঠে কয়েকটা আম পেড়ে আমাদের হলের গেটে চলে আয়।
মামাবাড়ি?  না কি! কাল আমার এপ্লাইড কেমিস্ট্রি এক্সাম। আর আমি তোর জন্য আম পাড়বো? মগের মুল্লুক!
পেড়ে দে না ভাই!
ভাই কেন বললি?
ওকে ডিয়ার, প্লিজ পেড়ে দে।
(আসলে "ডিয়ার" শুনে মনটা গলে গেল। তাই সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম আম পাড়তে প্রক্টরের অফিসের ছাদে যাবো।)
রুমে ফিরে চট জলদি লুঙ্গী ছেড়ে ট্রাউজার পড়ে মোবাইলের টর্চ টা চেক করছি। পাশ থেকে সৌরভ বইয়ের ফাঁক থেকে প্রশ্নটা করল, "কি রে? এত রাতে ট্রাউজার পরে কই যাবি? চা খেতে? তাহলে মামাকে বলে আমার রুমে এককাপ পাঠাস"
না! চা খেতে নয়। অন্যকিছু খেতে।
বই বিছানায় ফেলে চশমা উঁচিয়ে মশারীর ফাঁকা দিয়ে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে বলল, "মানে কি?"
মানে ফানে কিচ্ছু না, তুই বইয়ের পাতায় মন দে। আমি আম পেড়ে দিয়ে আসি।
আরে কিসের আম? কাকে দিবি?  বলে মশারীর বাইরে ঝেড়ে বেড়িয়ে এল সৌরভ।
আরে মৌমিতা ফোন করেছিল। বলল, আম পেড়ে দিয়ে যা!
সৌরভের গলায় নিগূঢ় অভিমান ধরা। বলল, " আম পেড়ে দিবি তো যা! আমাকে বলার কি আছে? যা না!" এখানে অভিমানের কারণ টা ওকে না বলা নয়। বেচারা টমবয় মৌমিতার প্রেমে ডুবে আছে সেই প্রথমবর্ষ থেকে। নেহাতি, ভীতু টাইপ নয়ত। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এসেও " ভালোবাসি " শব্দটা মুখ ফুটে বলতে পারেনি সৌরভ। আর কপাল, মৌমিতা আমার ই বান্ধবী!
মোবাইল পকেটে পুরে সৌরভ কে হাত ধরে টেনে মশারী আধছেঁড়া করে বাইরে টেনে বের করলাম। নে চল আমার সাথে। আমি না হয় আম পাড়ব। তুই পৌঁছে দিবি, এতে যদি আমার বান্ধবী ইমপ্রেস হয়। তবুও মেয়েদের ইমপ্রেস করার মানে টাও হয়ত সৌরভ বোঝে না। সে বোঝে অন্ধ টান।
আম পেড়ে দিতে গিয়ে এক ঘন্টা লাগল। আমি আম পেড়ে দিলেও মৌমিতার হাতে আম পৌঁছি দিল সৌরভ। উঁকি দিয়ে যদিও মৌমিতা আমাকে খুঁজছিল। আমি রঙ্গনের ঝোঁপে লুকিয়ে ওদের অবস্থা দেখছিলাম আর মুচকি হাসি দিচ্ছিলাম। মুচকি হাসি ছিল কিনা জানিনা। অন্ধকারে অমনি উঁকি দিয়ে বন্ধু-বান্ধবীর ইতস্তত প্রেম দেখা টা মনে হয় ভার্সিটি এরিয়ার নেড়ি কুকুর টা মোটেই পছন্দ করেনি। ঘেউঘেউ করে আমার পিছু নিল শয়তান টা!
এরপর ওদের কি কথা হয়েছে। তা আর শোনার দূর্ভাগ্য হয়নি। কারণ আমার বন্ধু সৌরভ রীতিমত বদলে গেল চটজলদি। ফোনে কথা, মুচকি হাসি। ওর অন্তর্মুখী বিষয়গুলো আর ওকে বেঁধে রাখতে পারলো না। আমি মনে হয় ততদিনে বুঝে গেছি আমি আমার বন্ধু সৌরভ কে হারিয়ে ফেলেছি। আগেরমত সব বিষয়ে হাসাহাসি, শেয়ার হয় না। রাতবিরেত বেড়িয়ে যাওয়া হয় না। মৌমিতাকে ও আজকাল একা পাওয়া যায় না। এতে অবশ্য আমার খারাপ লাগা মোটেই ছিল না।
স্যার! লাঞ্চ টাইম। দুইটা পনেরো। আপনার খাবার কি এইখানে দিব?
সম্ভিত ফিরে পেলাম, আমি অফিসে। ক্ষণিকের জন্য সেটা হয়ত ভুলে গেছিলাম।
টাইম চেক করতে ফোন টা হাতে নিতে মেসেঞ্জারে সৌরভের মেসেজ।
" শোন, বিকেলবেলা আজ আগে বের হবি। আমি ভার্সিটি ক্যান্টিনের পাশে বসছি। এসে আমাকে কল করে নিস "
আমি থাম্বস আপ পাঠালাম।
ঢাকা নাকি মসজিদের নগরী। জ্যামের নগরী কেন নয় সেটাও প্রশ্ন জাগে মনে। অফিসের বাইরে এসে নিশ্বাস নিতে ভালো লাগে। আজকাল ভার্সিটি তে আসা হয় না। অথচ, এখানে ই কোন একটা সময়ে ছিল আমাদের ব্যাচের আধিপত্য!
পথেরদাবী, সভ্যতার দাবী তে আমাদের থাকা না থাকায় ধূঁলো জমে গেছে সেই কবে, কেউ কোনোদিন ব্যস্ততার ভীড়ে হয়ত খেয়াল ও করেনি।
ক্যান্টিন পৌঁছে কল দিলাম সৌরভ কে।
শোন, পুকুরপাড়ে চলে আয়।
ভার্সিটি পুকুরপাড়, আগেরমত নেই। অনেক ভীড়। কপোত-কপোতী তে ঠাসা। আমাকে দেখে সৌরভ বলল, " ব্যাটা! তাও দেরী করলি? পনেরো মিনিট। "
আরে বলিস না জ্যাম।
বাদ দে, কফি খাবি?
হুম।
মামা, দুটো কফি দিয়েন এইদিকে!
তারপর বল কেমন যাচ্ছে তোর? প্রশ্নটা আমাকে ই করল সৌরভ।
এইত মোটামুটি। দেখলি তো! সরকারি জব।
সৌরভ বলল, তোর মনে আছে? ভার্সিটি লাইফে একদিন বাজী ধরে পুকুরে নেমেছিলাম দুজনে।
হ্যাঁ, সে থাকবে না! মাঝ পুকুরে গিয়ে আমার লাইফ বাজী রেখে উল্টো তোকে বাঁচাতে হলো।
সৌরভ শুকনো হাসি দিল।
আমাদের কফি এসে গেল, তাতে হালকা চুমুক দিয়ে সৌরভ বলল, " জানিস, এদিন টা কেন আসি এখানে। "
 কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও আমার আর দেয়া হলো না।
সৌরভ কাঁদছে।
কফির কাপ মাটিতে নামিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম, "জানি! "
সৌরভ নিজেকে সামলে নিল।
বলল, অনেকদিন কেটে গেল তাই না। তোর অবন্তীর কথা মনে আছে?
হাহা.. থাকবে না। তোর ডিপার্টমেন্ট এ জুনিয়র।
তুই বলেছিলি অফার করবি।
হুম, হ্যাঁ।
আর পড়ে গেছিলি আমার শার্ট, তাও আবার আমার পারফিউম লাগিয়ে।
মেয়েটা বলে, "এক্সকিউজ মি, একটা কথা বলবো? এটা শার্ট কি সৌরভ ভাইয়ার? "
আমার নাজেহাল দশা।
হাহা... সৌরভ কফিতে চুমুক দিল
বুঝলাম ও খানিকটা হালকা হয়ে এসেছে।
তারপর সৌরভ বলল, " হাহা..পরেরদিন আমাকে বলে, ভাইয়া, পুলক ভাইয়া কি আপনার বন্ধু? আমি তো জানি তুই প্রপোজ করেছিস। তাই চট করে বললাম, নাহ কেন?"
পরে বলল, নাহ ভাইয়া! এমনি!
হাহা... জানিস পরে আমাকে কি বলেছে?
কি?
বলেছে, সে তোকে পছন্দ করে। হাহা...
কি অদ্ভুত!  না রে? যাকে ভালোবাসে মানুষ তার উপস্থিতি টের পেতে কত কি মনে গেঁথে রাখে। ঘ্রাণ, হাটাচলা, কথাবার্তা..
নে কফি খা, তোর কফি ঠান্ডা হচ্ছে।
খাচ্ছি, শালা!  এতদিন পর শুধু কফি খাওয়াচ্ছিস? আর কিছু বল!
আরে দাঁড়া!
মামা, দুটো চিপস।
তুই খা তোর চিপস!
তাহলে বল কি খাবি?
দুটো নান বল সাথে শিক। খাপে খাপ!
এরপর দুজনে কফির কাপে মগ্ন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দূরের একজোড়া কপোত-কপোতীর দিকে আঙুল দেখিয়ে সৌরভ আমাকে বলল, "তুই কি একটা না বলবি বলেছিলি সেদিন।"
আঙুলের দিকে তাকিয়ে প্রেম টার মানে বুঝতে হিমশিম খেলাম। চট করে ওর আঙুল নামিয়ে দিলাম। বাদ দে ওসব!
শোন যেটা বলতে চাইছিলাম। অফিসে নতুন কলিগ আমাকে প্রপোজ করেছে।
তাই কি? সৌরভের মুখে হাসির ঝিলিক! সে জানে?
কি জানে? ধুর!
কই আজ গেলাম, দেখালি না যে!
আরে একাউন্টস এ যে মেয়েটা এসেছে।
তুই রাজী মনে হচ্ছে! (মুচকি হাসি দিয়ে সৌরভের খোঁচা।)
মেয়েটা ভাল, জানি হিসেবে ভুল করে, তবুও ভাল।
সৌরভ হেসে বলল, নে শিক খা। এটা নিস না।
মজা নিচ্ছিস?
তুই সিরিয়াস ছিলি কবে?
বললাম, "তুই তো ছিলি!"
কথা শুনে আবার গুমোট ভাব এসে ভর করল ওর মুখে।
বলল, তাই তো সাথে আছে বেঁচে। আর.. এবার সৌরভের চোখের জল আর থামাতে পারলাম না।
মৌমিতার সাথে প্রেম তখন বেশ তুঙ্গে চলছে সৌরভের। আমি এদিকওদিক জুনিয়দের সাথে ডেটিং করে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ একদিন রুমে ফিরতে সৌরভ কেঁদেকেটে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বেশ ভড়কে গেছি ওর হাবভাব দেখে। খানিকটা ভয় ও পেয়েছি। বললাম, "কি হয়েছে রে?"
মৌমিতা বাঁচবে না রে!
কি ফালতু কথা বলছিস? কে বলেছে তোকে?
ডাক্তার!
কবে? খুলে বল?
ওর ক্যান্সার! লাস্ট স্টেইজ। (আমি ভাবছিলাম, প্রথমে ও মজা করছে। এর মাঝে তখন মৌমিতার সাথেও আমার কথা তেমন হতো না।)
আমি কথা বলব ওর সাথে, আরে ভুলভাল শুনেছিস বোকা!
সৌরভ কে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়ে ঘুম পাড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম। জেগে থাকলে ই কাঁদতো ছেলেটা। কেউ এভাবে কাঁদলে আর কার ই ভাল লাগবে। আমার নিজেকে নিজেই বড্ড বেশী অসহায় লাগত।
মৌমিতা আর ক্লাসে আসত না। ফাইনালের রেজাল্ট পাবার আগে ই ট্রিটমেন্টের জন্য মাদ্রাজ নিয়ে যায় ওর পরিবার। বাসায় একমাত্র মেয়ে। খুব বেশী বেয়াড়াপনা ছিল। দুষ্টুমি করত কিন্তু কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নি।
মনে আছে মৌমিতাকে এগিয়ে দিতে আমাদের ব্যাচের সবাই সেদিন গেছিলাম। ওর চুল পড়ে গেছিল ততদিনে। টাক মাথার মৌমিতা একবার শুধু সৌরভ কে অক্সিজেন মাস্ক খুলে বলে গেল, ভালোবাসি কাঠবিড়াল।
আর ফেরে নি মৌমিতা।
সৌরভ এত্ত ইমোশন কোথায় সেদিন লুকিয়ে রেখেছিল সবার সামনে সেটা আজো আমি জানি না। আমার জানবার কথাও না। প্রেম, আবেগ একটা নিখাদ গুপ্তধন।
যার যার মনের যখ ওতে পাহারা দেয়। ওদেরকেও দিয়েছে হয়ত। তাই সৌরভ ও আজ মৌমিতা কে মনে করে পুকুরপাড়ে একটা কাগজের নৌকা ভাসায়।
আমরা দুজন বন্ধু ততক্ষণ ঠায় বসে থাকি যতক্ষণ কাগজের নৌকা টা ডুবে না যায়। ডুবে গেলে বুকের একপাশে ব্যথা বাড়ে। ওটা বা'পাশ যেখানে প্রিয় মানুষগুলো জোর করে বাস করে।
(সমাপ্ত)


রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭

গল্পঃ অনভিপ্রেত




লেখেন-টেখেন?
প্রশ্নটা যে আমাকেই করা হয়েছে এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। গাঁয়ের পথ ধরে মৃদুমন্দ গতিতে চলতে থাকা রংচটা ভ্যানে আমরা যাত্রী তিনজন। এর মাঝে তৃতীয়জন হচ্ছে ভ্যান চালক। পড়নে লুঙ্গী, গায়ে বার্সেলোনার জার্সি কিন্তু সেটা বোধহয় আসল নয়, লোকাল পণ্য। তার চোখ কাঁচা রাস্তা ধরে সামনের দিকে। ভ্যানের প্যাডেলে পা ফেলে সে চলেছে আমাদের দুজন কে পৌঁছে দিতে। রেলস্টেশন থেকে উঠেছি কেবল আমরা দুজন। ঘড়ি ধরে তখন বিকেল চারটে। এখন চারটে বারো। এর মাঝে আমরা তিনজনের কেউ ই কোন কথা বলিনি। আমি ব্যস্ত আমার ট্যাবে। পাশের ভদ্রলোক আজকের পেপারে চোখ রেখেছিলেন। হয়ত সেটাও ট্রেনে কেনা।
এই যে ভাই? শুনছেন? (লোকটি আমাকে আবার ডাক দিল)
জ্বী বলুন! সরি, আমি শুনতে পাই নি।
লেখালেখি করেন মনে হচ্ছে?
না না। ওসবে ধারণা নেই। অনলাইনে নিউজ পরছিলাম।
আচ্ছা। (বলে ভদ্রলোক চুপ হয়ে গেলেন)
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। অযথা গায়ে পড়ে কথা বলা আমার স্বভাবের কোনদিকে ই পড়ে না। আবার মন দিলাম হাতের ট্যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওয়েব পেইজ লোড নিতে দেরী হচ্ছিল দেখে ট্যাবের বারে তাকিয়ে দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই। অজগাঁয়ের যত ভেতরে যাচ্ছি নেটওয়ার্ক তত কানামাছি খেলছে। বার দুয়েক এসেও চলে গেল দুটো নেট বার। বিরক্ত হয়ে বললাম, "ধ্যাত! শহর আর গ্রাম! সব জায়গাতে ই একই দশা। নেটওয়ার্ক থাকে না।"
আবার অভিব্যক্তি দেখে পাশের যাত্রী ভদ্রলোক তার ব্যাগের সাইড পকেটে পেপার টা পুরে চেইন লাগাতে লাগাতে বললেন, "এই চলে বুঝলেন। আমি তো বিরক্ত হয়ে বাড়ির চালে এন্টেনা লাগিয়েছি। বড় ভাই বাইরে থাকে। মাঝেমাঝে ফোনে কথা বলা দরকার হয়। আর বোঝেন! ঠিক ওই সময়ে ই ফোনের টাওয়ার থাকে না। কি মুসিবত! "
আমি সায় না দিয়ে শুধু মুখ দিয়ে ' চুকচুক ' করে একটা আফসোস হাঁক ছাড়লাম।
ভ্যানের চালক ও দেখি বলে উঠল, " আর কইয়েন না কাকা! ফোন আছে বাড়িত কিন্তু কল ই যায় না"
আমি মাঝ থেকে গলা খাকড়ি দিয়ে ভ্যান চালককে বললাম, "আর কতদূর?"
ভ্যান চালক এবার একটু নিঃশব্দ হাসি দিয়ে বলল, " আরো আধাঘণ্টা ভাই! চার মাইলের বেশী রাস্তা। "
ওহ! তাহলে তো আরো পথ।
জ্বে।
শেষবিকেলে সূর্যের আলো লালচে হয় দূরের অদৃশ্য গ্রামের গাছপালা ছুঁয়ে দেবে আরেকটুপর। এখনো রাস্তার পাশে মাঠে লোকজন কাজ করছে। যে মাঠে ফসল আছে তাতে চলছে শেষবেলায় সেচের কাজ। শীত এখনো পড়েনি। তবুও গ্রামে শীতের হাওয়া টা ভাল টের পেলাম।
শীত পড়েছে মনে হচ্ছে?
ভ্যান চালক বলল, " হে হে আর শীত। শীতের দিন আর গরমের দিন আর আলাদা না! দিনে ঠাটা পড়া রৌইদ, আর রাইতে ঠান্ডা। শীত না গরম কিছুই বুঝি না। "
পাশে বসা ভদ্রলোক দেখলাম পকেটে থেকে ফোন বের করে কাকে কাকে যেন বারবার কল করে যাচ্ছেন কিন্তু নেটওয়ার্ক না থাকায় মনে হয় ধরতে পারছেন না ফোনে।
আপনি কি করেন? (যেচে কথা বলতে ই হলো আমাকে)
ফোন ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আমার দিকে একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আমার জন্মস্থান। মাঝে ছিলাম না বছর ছয় তারপর আবার আসা, আবার থাকা।
ছিলেন না মানে? কিন্তু কেন? (আমি বলছি অথচ ভদ্রলোক ফোন ঝাঁকিয়ে ই চলেছেন)
পড়াশোনা, গ্রাজুয়েশন ঐ করে গেল। আহা! একটা টাওয়ার বোধহয় পাওয়া গেল।
হ্যালো! হা আমি, শোনো বাইরে মতিন কে থাকতে বলো। আমি ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়া আসতাছি। (ফোন কেটে গেল)
এরপর ভদ্রলোক বললেন, " আমার স্ত্রী, এই গ্রামের মেয়ে না। বছর দুই হলো বিয়ে। আমার চাকরীর সুবাদে এখানে দুজনের থাকা"
আপনি কি করেন? প্রশ্নটা করলাম
"এখানে সরকারি কলেজের প্রভাষক। ম্যাথ পড়াচ্ছি। "
বললাম, "আচ্ছা। "
এরপর দুজনে চুপচাপ, ভদ্রলোক আর কোন প্রশ্ন আমাকে করলেন না। আমিও আর কথা বলছি না কিন্তু নীরবতা বোধহয় ভদ্রলোকের পছন্দ হলো না। আমাকে পুরনো প্রশ্নটা আবার করলেন।
আপনি কি করছেন ভাই?
আমি একটু শুকনো হেসে বললাম, আপনাদের গ্রামে আমি সরকারি ডাক্তার। বিসিএস হবার পর এই প্রথম এলাম।
ভদ্রলোক এবার বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন। আরে!  তাই নাকি? আপনিও ডাক্তার?
আপনিও ডাক্তার! মানে বুঝলাম না!
ভদ্রলোক বললেন, আমার স্ত্রীও ডাক্তার। সেই কবে থেকে বলছি বিসিএস টাও দাও। জানেন, দিচ্ছে ই না। জোর করে বললাম, শহরে থাকো আমার না হয় গাঁয়ের চাকরী। সেও সরকারি কলেজ। এখানে আমার নিজের ই থাকতে কষ্ট! সেখানে তুমি কি করে থাকবে?
তারপর?
বলল, " নাহ! এখানেও থাকা সম্ভব। এটা ওটা আরো দশটা যুক্তি দেখাল। বুঝুন, ওমেন পাওয়ার! হাহা.. হেরে যেতে হলো। শুনেছি, ছাত্রী থাকা অবস্থায় ও ডিবেট করত কলেজে। ভাল প্রতিভা, গানের গলাও ভাল।
আচ্ছা।
ভদ্রলোক কে প্রথমে ভেবেছিলাম লোকটা অতিরিক্ত কথা বলে। এবার বুঝলাম, নাহ! উনি বেশ প্রাণখোলা টাইপ। নয়ত, কেউ এভাবে অচেনা লোকের কাছে মনখুলে ঘরের গল্প করতে পারে না।
ভদ্রলোক মনে হয় আরো কথা বলতে চলেছেন, এবার শুরু করলেন।
জানেন? আমরা দুই ভাই। একই ক্লাসে একসাথে। সেই প্রাইমারি থেকে পড়াশোনা। ভাই আর আমি দেখতেও যমজ। তাই বড় ভাই গোঁফ রাখল। সেও আমার বিয়ের পর। বৌ যাতে গণ্ডগোল করে না ফেলে। হাহাহা.. বুঝুন ব্যাপার!
আমিও এবার না হেসে পারলাম না। আপনার ভাই?
উনি এখন থাকেন কাতারে। একটা ওয়েল কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার। বছর পাঁচ আগে গেছেন। যা কথা হয় ওই ভিডিও কল, নয়ত ফোন কল। বুঝলেন! হাহা..
ঘড়িতে চারটে পঁচিশ। সূর্য মনে হয় মেঘের আড়ালে চলে গেল। অন্ধকার না হলেও ভালরকম কালো হয়ে গেল আশেপাশে। আমি একঘেয়েমি কাটাতে ম্যাচ জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট ধরাতে দেখে ভদ্রলোক মনে হয় একটু বিরক্ত হলেন। তবে আমার থোড়াই দেখার আছে। সিগারেট খাবার সময় পণ্ডিতি আমার পছন্দ নয়।
আমার সিগারেট জ্বালানো দেখে ভ্যানগাড়ি থামাল ভ্যানচালক। কোমর থেকে গামছা খুলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, " ভাই! একটা সিগারেট হইব?"
হবে। (একটা সিগারেট হাতে দিতে সে নিজের কাছে থাকা লাইটার দিয়ে সিগারেট টা জ্বালিয়ে নিল। সেইসাথে ভ্যানের নীচের হ্যারিকেন টা ধরাল)
অন্ধকার হইতাছে। রাস্তায় লাগবো। সামনে বাঁশবন। আন্ধার আর আন্ধার! ঘুঁটঘুইট্টা আন্ধার।
ভ্যান আবার চলতে শুরু করল। মেঘের আড়ালে থাকা সূর্য আর ফেরত এলো না। আধাঁর ঘনাতে লাগল।
ভদ্রলোক দেখলাম আবার ফোনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠলেন। হ্যালো...হ্যালো...
সিগারেট শেষ হতে আবার আমাদের কথা শুরু হয়। ভদ্রলোক নিজে থেকে প্রশ্নটা করলেন, " বিয়ে করেছেন?"
নাহ!
কেন জানতে পারি? যদি আপত্তি না থাকে। তবে আমাদের গ্রামে পাত্রী পাবেন। সব ঘরের মেয়েই শিক্ষিতা গ্রাজুয়েট। আমার কলিগ ই আছেন।
না, ধন্যবাদ। আসলে, কলেজ লাইফে একজন মেয়ের সাথে ভালোলাগা, প্রেম ছিল। ওটাই প্রথম আর সেই শেষ।
স্কুলকলেজ?
নাহ! মেডিকেল লাইফে।
আচ্ছা, তাহলে হলো না কেন?
ধর্মের বাঁধা!
মানে?
আমার ধর্ম ছিল আলাদা। আর প্রেম তো আর ধর্ম মেনে হয় না, ওই হুট করে ভালোলাগা থেকে প্রেম। শেষ টা ওই শেষে গিয়ে। আমিও শেষ বর্ষে প্রবলভাবে ভেঙে পড়ি।
আহা! ভদ্রলোক এই প্রথম আফসোস করলেন। বললেন, " তাহলে সে মেয়ে?"
আমার সাথে বিয়ে দিতে ওর পরিবার রাজী ছিলনা। ও যদিও প্রথমদিকে রাজী ছিল কিন্তু পরিবারের বাইরে আর পা ফেলতে চাইল না। আমিও তখন একেবারে ভেঙে পড়ি। টাইফয়েড হয় ঠিক আমার ফাইনাল প্রফের আগে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!
আচ্ছা। তারপর?
আর হলো না। ওর পরিবার ফাইনাল প্রফের আগে ওর এনগেজমেন্ট করাল কোন এক ছেলের সাথে। এ কথা আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে জেনেছি। হাতের কাছে ফোন থাকলেও ক্ষোভে, রাগে ফোন করিনি একবারেও! কেন করবো বলুন? এভাবে হুট করে না বলে দেয়ার ক্ষমতা কি করে রাখে সে!
"আপনি কোন মেডিকেলে ছিলেন?" ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।
রংপুর মেডিকেল। ব্যাচ নম্বর বলার পর তার মুখের উজ্বলতা ঠিক সন্ধ্যায় ঠিক এখনকার আকাশের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
আমিও নিজেকে সামলে নিলাম। খুব বেশী ইমোশনাল করে ফেলেছি মনে হয়।
ভ্যানচালক বলে উঠল, " আইসা পড়ছি কাছাকাছি! "
আমি ট্যাব খুলে দেখলাম তাতে একটা টাওয়ার এসেছে। আমার থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। গ্রামের মেম্বার আমাকে ঠিকানা আগেভাগে দিয়ে রেখেছিলেন।
তবে খেয়াল করলাম। আমার মেডিকেলের নাম শোনার পর ভদ্রলোক সেই যে চুপ করেছেন আর কোন কথাও বলেননি একটি বারের জন্য।
কিন্তু এবার দেখলাম ফোন হাতে নিয়ে কাউকে আবার ট্রাই করছেন তিনি।
হ্যালো..হ্যালো.. লীলা, আমি বাড়ির কাছাকাছি। তুমি এসো তো। মতিন কে দরকার নেই!
লীলা!
নাম শুনে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাতে ই উনি একটু আক্ষেপের সুরে বললেন, " আমার স্ত্রী, লীলা। রংপুর মেডিকেল থেকে এম বি বি এস করেছে। আপনার ই ব্যাচ! "
শুকনো হাসি দিয়ে কথাটা শেষ করলেন তিনি।
ভ্যান একটা বাড়ির পাশে এসে থামল। বাড়ির পেছনের এই দিকটা রাস্তার সাথে লাগোয়া। আলো হাতে এক রমণী নেমে এলেন উঁচু রাস্তা ধরে ঠিক নীচে, ভ্যানের কাছে। আমাদের দূরত্ব এখন খুব বেশী নয়। যেটুকু চেনা গেল এতে আমার আঁতকে উঠতে হলো। এই সেই লীলা! আমার লীলা!
ভদ্রলোক বললেন, আপনার নামটা বললেন না তো?
আমি বললাম, " রুদ্র"
লীলা এবং তার স্বামী আমার দিকে একসাথে তাকাল। লীলার হাতে সলতে দেয়া কূপী আমার থেকে অনেক দূরে হলেও আমাকে পোড়াল লীলার ক্ষণিক দৃষ্টি।
আমার ভ্যান আবার চলল।
(সমাপ্ত)


উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...