বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬

গল্পঃ কিছু কথা

(এক)
সন্ধ্যেটা হবে হবে করছে অনেকক্ষণ,
ঘড়িতে দেখলাম -ছ’টার কাঁটাও প্রায় ছুঁয়ে দিবে প্রায়। হাতলদেয়া কাঠের চেয়ারের পাশে রাখা আমার ব্যাগের ভেতর স্টেথোস্কোপ আর স্ফিগমোম্যানোমিটার টা ভরে সবে শার্টের কলারটা ঠিক করছি। হুড়মুড় করে জেলা হাসপাতালের ডোম মুজাহিদ হাজির। আমার বৌ, মানে আজ অদিতির আসবার কথা ঢাকা থেকে। ও বলে দিয়েছে, সন্ধ্যের ট্রেনে এখানে এসে নামবে। আমার তাই তাড়া আছে। অবশ্য সরকারী পোস্টিং পাবার এই এক ঝামেলা- যেখানে যাও, পরিবার সহ। মহা ফাঁপর! আর অদিতিও এসব দৌড়াদৌড়ি খুব একটা পছন্দ করে না। এই নিয়ে আমাদের চার বার বদলাতে হল। অদিতিকে তাই আগেই বলেছি, ‘শোন, তুমি অন্তত এ কটা দিন তোমার বাড়িতে ঘুরে এসো, ততদিনে এদিক টা গুছিয়ে নিচ্ছি আমি।
সালাম স্যার! (শ্যামলা করে গোঁফওয়ালা লোকটির নাম মুজাহিদ, এই হাসপাতালে ডোম)
ব্যাগের ভেতর বাকী সবকিছু ভরে এবার চেইনটা টানতে টানতে বললাম,
‘মুজাহিদ কিছু বলবে?’
স্যার, ‘একখান লাশ আইছে। মাত্রই আইছে!’
‘ওহ!’ জাতীয় একটা অত্যুক্তি করলাম- বললাম, সাথে কি আর কেউ এসেছে?
মুজাহিদ মাথা নাড়ল (তার মানে কেউ আসেনি)
তবুও জোর গলায় বললাম, ‘সে কি! কেউ আসেনি?’
মুজাহিদ আগের মত, না-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভ্রু ভাঁজ করে বললাম, ‘আজ আর থাকতে পারব না। তোমার ম্যাডাম আসছে আজ ঢাকা থেকে। তাকে আনতে যেতে হবে, দেরী হলে রাত্রিতে উপোস করে থাকতে হবে। পোস্টমর্টেম কাল হবে, বুঝলে?’
মুজাহিদ মাথাটা আধা কাত করে বলল, তাইলে চাবিটা দ্যান লাশটা লাশঘরের করিডোরে ফালাই রাইখা আসি।
ড্রয়ার থেকে চাবির তোড়াটা বের করে মুজাহিদের হাতে দিয়ে বললাম, ‘আমি বাইক স্টার্ট করছি তুমি সেখানেই চাবিটা নিয়ে এসো’
মুজাহিদ তখনও দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছিল, বললাম, ‘কিছু বলতে চাও?’
‘মেয়ের জন্য কিছু কিনা নিতে চাইছিলাম স্যার, যদি কিছু দিতেন ভালো হইত’।
হাসিমুখে ম্যানিব্যাগ থেকে দু’শো টাকা তুলে দিলাম। বললাম, ‘লাশটা রেখে জলদি চাবি নিয়ে এসো, ঠিকাছে?’
মুজাহিদ হাসিমুখে বলল, ‘এই যামু আর আমু স্যার’
আমিও আমার রুমে তালা দিয়ে বাইকে ফিরে এলাম। জেলা শহর হলেও শীতের ছোঁয়া বেশ ভালোমত জেঁকেছে এই শহরে। কনকনে না হলেও মাফলার গলায় দিতে হবেই। যেন, একটু পর-ই গায়ে কাঁপন তুলে দেবে। হাসপাতালটা একেবারে শহরের প্রান্তে, তাই শীতের প্রকোপ টাও বেশী বোঝা যায়।
বাইকে স্টার্ট দিতে দিতেই মুজাহিদ এসে গেছে। স্যার, ‘আপনের চাবি। একা একা যাইতে পারবেন তো?’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘কচি খোকা নই আমি, পারব’
বাইকের স্পিড পঞ্চাশের উপর তোলা যায় না। রাস্তার দশাও খুব একটা ভালো না। তবুও যত দ্রুত যাওয়া যায় ততটা তুলেই স্টেশনে এলাম। লোকে ঠাসা পুরো কম্পার্টমেন্ট। এসেই শুনলাম, ঢাকার ট্রেন নাকি মিনিট বিশেক আগেই এসে গেছে। কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানলাম, অদিতি আজ আসেনি।
ফোন করে চেপে ধরলাম অদিতিকে, ‘সে কি! তোমার না আজ আসবার কথা?’
অদিতি ফোনের ওপাশে হাসছে, সরি। আসলে আজ কাকীমা অনেকদিনপর বাড়ি এলেন। তাকে রেখে কি করে ফিরি বলো?
ঠিকাছে, কাল আসছো তো?
হ্যাঁ কাল। প্লিজ মাইন্ড করো না, প্লিজ প্লিজ …।
আমি হেসে ফেললাম, ওকে। বাই
স্টেশনে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে বাইক দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম, সেটার কাছেই ফিরে এলাম। যাক, বাড়ি ফিরে যাই। কপাল ভাল, অদিতি এসে দেখেনি আমি মিনিট বিশ দেরী করেছি। এটা দেখতে পেলে আজ রাতে আর ঘুম হতো না। বড্ড দস্যি মেয়ে -বলতে বলতে, শুকনো হাসি খেলে গেল গালে।
বাইক স্টার্ট দিতে যাবো ঠিক তখনি চোখে আটকাল স্টেশনের চায়ের দোকান। এক কাপ চা খেলে খারাপ হয় না। বাইক টা আবার কাত করে হেঁটে গেলাম চা খাবার নেশায়।
দুই)
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা। অদিতি যে কদিন নেই সে ক’দিন একজন ঠিকে লোক রেখেছি রান্না করে দেয়ার জন্য। আজও রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে। ঐ খেয়েই গেছে দুপুর এবং সকাল আর এখন রাতটাও কাভার করে দেব।
হালকা শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছি সবে। দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। এখন আবার কে এলো?
জিজ্ঞেস করলাম, দরজার এপাশ থেকে, ‘কে?’
জ্বী আমি। নজরুল ইসলাম। রিটায়ার্ড শিক্ষক। একটু কথা ছিল ডাক্তার সাহেব। দরজাটা খুলবেন?
ভারী গলায় আওয়াজ। দরজা খুলতেই ভদ্রলোক আমাকে আদাব দিল ডান হাতটা মুখের কাছে তুলে এনে। বলল, ‘আপনি ডাক্তার দত্ত? আমি নজরুল ইসলাম, আগে শিক্ষক ছিলাম এখন অবসরপ্রাপ্ত। কিছু কথা ছিল যদি সময় হয় আপনার?’
আঁধারে মুখখানা দেখতে না পেলেও বুঝলাম ভদ্রলোক বেশ লম্বা। আমি শহরে নতুন। কাউকে তেমন করে চিনি না। সুতরাং এখানকার কেউ আমার কাছে আসতে পারে এত রাতে সেটা বুঝতে পারছি না। আমাকে চেনে শুধু ঠিকে রান্না করা ছেলেটা। এদিকে রাতে বাসায় একা। এত রাত্রে শিক্ষক সেজে কেউ ডাকাতি করতে এলে অবাক হবার কিছু নেই। খানিকটা ভয় কাজ করছিল।
ভদ্রলোক এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতের ইশারা তুলে বললাম, ‘বসুন, দাঁড়িয়ে কেন!’
দরজার বাইরে ভদ্রলোককে ভালো করে দেখতে পাই নি, এবার আলোতে দেখলাম বেশ বয়েস। আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি হবে। আর যাই হোক, এর দ্বারা ডাকাতি হতে পারে না। কুঁচকানো চামড়া হলেও গায়ের রঙ যথেষ্ট ফর্সা। চোখে হালকা কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। তিনি সোফায় বসে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন। শ্বাস নিতে হয়ত তার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি এই ফাঁকে ফ্যান টা মৃদু করে ছেড়ে দিলাম।
বললাম, কি খাবেন বলুন?
উনি মাথা এবং হাত দুটো একসাথে নাড়িয়ে বললেন, না না! আমি কিছু খাবো না! আমি শুধু কিছু কথা বলতে এসেছি । যদি আপনার সময় হয়।
আমি টি-শার্টটা গায়ে চাপিয়ে তার বিপরীত সোফায় বসে বললাম, ‘বলুন কি বলতে চান, আমি শুনছি’
উনি মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে হাতে নিতে নিতে বললেন, আমার হার্টের বাইপাস সার্জারির পর চলতে ফিরতে খুব সমস্যা হয়। একা চলাটা আমার পক্ষে অনেকটা কষ্টকর। অবসর নিয়েছি প্রায় বছর সাত। একা একাই থাকি।
ভদ্রলোকের কথায় বাঁধা দিয়ে বললাম, ‘আপনার পরিবার?’
উনি বলে চললেন, ‘আমার স্ত্রী গত হয়েছে প্রায় দশ বছর। মেয়ে-ছেলে দুজনই বিয়ে করেছে, দেশের বাইরে থাকে, কানাডায়। সেখান থেকে ইচ্ছে হলে ফোন করে নয়ত না। খবর নেয়ার প্রয়োজন হয়ত মনে করে না।
বলতে বলতে ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘আমি বড় একা, একা বেঁচে থাকাটা যে কি কষ্টকর সেটা আপনাকে কি করে বোঝাবো। এদিকে বুকের ব্যথাটা হঠাত করে মাঝে মাঝেই বাড়ে। খুব কষ্ট হয়।
বললাম, ‘আপনার ছেলে –মেয়েকে বুঝিয়ে তাদের কাছে কেন চলে যাচ্ছেন না?’
উনি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ঐ যে বললাম তাদের আমাকে দেবার মত সময় নেই!
আমি কেবলমাত্র আমার জন্য কফি, হিটারে দিয়ে এসেছিলাম। এখান সেটাই  দুটো কাপে এনে একটি ভদ্রলোককে অফার করে, অন্যটি নিজে নিলাম। কিছু সল্টেড বিস্কুটও টেবিলে রেখে দিলাম অথচ লক্ষ্য করলাম উনি দুটোর কোনটিই মুখ তুললেন না। আমিও আর এই সময়ে তাকে জোর করার মানসিকতা খুঁজে পেলাম না।
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, ‘শুনেছি আপনি ডাক্তার, ডাক্তারদের কাছে সবার অনেক দাবী থাকে। এমনকি তার কাছের মানুষটির থেকেও বেশী। জানি, জেলা শহরে আপনার কাজের চাপ আছে। তবুও সময় নিয়ে, ধৈর্য্য দিয়ে সবাইকে ভালো করে চিকিৎসা দেবেন সেটাই চাওয়া। ভদ্রলোক এবার থামলেন।
ঘড়িতে রাত দশটা পাঁচ, তার সাথে আরো কিছু কথা হয়। বুঝলাম, তার মনের অনেক জমানো কথা আমাকে মন খুলে জানাতে এসেছেন। আমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনে গেলাম।
তাকে রাতের খাবার অফার করতেও সেটা তিনি খেলেন না। বললেন, বাড়ি যাবেন। আমি এগিয়ে দিতে চাইলেও বললেন দরাকার নেই। তবুও দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিলাম টর্চ হাতে।।
সকালবেলা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে, বাইক ছুটিয়ে গেলাম হাসপাতালে। গতকালের লাশটা পোস্টমর্টেম দিয়ে শুরু করব আজকের বাকী কাজ। রাতের সেই ভদ্রলোকের কথাটায় মনে হলো, গতকাল সন্ধ্যে বেলাতেই পোস্টমর্টেম টা করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কথায় আছে, “বেটার লেইট দ্যান নেভার”।
পরদিন সকালে, হসপিটাল মর্গে ঢুকে যা দেখলাম তাতে আমার চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল। মুজাহিদ ডোম পাশেই ছিল, ওকে তর্জনী দেখিয়ে বললাম, ‘এই লোক কখন মারা গেল?’
মুজাহিদ নির্বিকার ভঙ্গীতে বলল, স্যার! এইটা তো সেই লাশ! যেই লাশটা, গতকাল সন্ধ্যায় আসছিল মর্গে। আপনে না কইলেন এইটার পোস্টমর্টেম আজ করবেন। তাই আমিও স্যার তালা দিয়া চলে গেছি। কথা শেষ করেই নিজের কাজে মন দিল মুজাহিদ।
আমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না, এই তো সেই ভদ্রলোক। যার নাম নজরুল ইসলাম। যে ভদ্রলোক গতকাল রাতে আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন।
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...