বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ছোটগল্পঃ সিড়ির ছেলেটি





আজকাল লোডশেডিং শব্দটি বেশ পপুলার কারন সন্ধ্যে হলে- ভদ্রলোকের দেখা মেলে রুটিন মেনে তবে একবার কিংবা দু'বার নয়; বেশ'কবার এই ধরুন ঘড়ি মেপে 'টায় গেল আর ফিরল রাত আটটায় একদম বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! সারাদিনের ক্লান্তিকর দৌড়াদৌড়ি আর ভীড়ে চেপে সিদ্ধ হয়ে- বাসে অফিস ফেরত হবার পর বাসায় ঢুকে যখন দেখি বাসার তিনতলা উঠবার সিড়ির পথটা ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার তখন মেজাজ আর লাইনে থাকে না
তিনতলার দু'রুমের একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি মাস দু'য়েক কাজের চাপে আমার আশেপাশে কে থাকে সে খবর নেয়া খুব একটা হয়ে উঠেনি
কিভাবে হবে?
অফিস সকাল টা, জ্যাম কাটাতে বেড়িয়ে পড়তে হয় ভোরে; নয়ত ঢাকার মুখপোড়া যান্ত্রিক ত্রিকোণমিতি বড্ড বেরসিক ভাবে পিছিয়ে দেবে অফিস পৌঁছনোতবে দেখা হয় বাড়িওয়ালার সাথে, সে ব্যাপার টা হয় মাসের শুরুতে অগ্রিম বাড়িভাড়া দেবার কারণে
তবে ঘটনাটা যেদিন ঘটল সেদিন শনিবার, অফিস ছুটির আনন্দে সেইভ করছিলাম দুপুরের খেয়েদেয়ে ঘুমের প্লানটাও প্রায় হান্ড্রেড পার্সেন্ট করে এনেছি কিন্তু সকালেই এল বেরসিক ফোন! তাও আবার অফিস থেকে
বস ফোন করেই বললেন, ‘আসিফ আজ অফিসে এসো তো, জরুরী কিছু কাজ আছেবসকে না করব তার সাহস নেই! স্যার কড়া মানুষ, ছুটির দিনটাও ছেড়ে দিলেন নাঅবশ্য বস এত কড়া নন ওভারটাইমের জন্য কিছু না কিছু পকেটে দিচ্ছেন বলে মন কে একদিক থেকে একটু-আধটু বোঝানো যায় নে বাবা! দিন শেষে তো গরীবের হাতখানা তো আর খালি ফিরছে না
জলদি সেভ করে তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলাম সেখানে ফিরতে ফিরতে প্রতিদিনের মত সেই সন্ধ্যে যখন আমি একতলার মাঝ সিড়িতে ঠিক তখনি রুটিনমাফিক লোডশেডিং!
ধূর! সিড়িতে দাঁড়িয়ে চোখে গোলগোল ফুলঝুরি দেখতে লাগলাম লোডশেডিং হবার টাইমিং টা মারাত্বক অগত্যা অন্ধকারে পকেট হাতরে স্মার্টফোন বের করলাম লকখানা খুলে সেটার- ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সিড়িতে আলো ফেললামঘুটঘুটে অন্ধকারকোন টুঁ শব্দটি নেই যেন এই তিনতলা বাসায় 
এক তলা ছেড়ে দোতলায় উঠেছি, আচমকা- তিন থেকে চার ফুটের একটা ছায়া দেয়ালের বিপরীতে ঘনীভূত আঁধার থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়াল একেবারে নিঃশব্দে! কাঁদো কাঁদো কন্ঠ কিন্তু শব্দ নেই; একদম বোবাকান্না
ভয়েআমিকে?  কে?’ বলেই চিৎকার করে সিড়িতে পা ফেলতে এলোমেলো করে ফেললাম আরেকটু হলেই হড়কে অনেকটা পড়েই গেছিলাম!
সৌভাগ্য সে ছায়ামূর্তি কথা বললআমি অন্তু! দোতলায় থাকিআবার কান্না
ভয়ে এতক্ষণে আমার গলা প্রায় শুকিয়ে গেছে তবুও গলা খাঁকারি দিয়ে ধমকের সুরে বললাম, ‘ এখানে কি করছ একা?’
বলল, ‘আমার বাসায় বাইরে তালা আমি বাসায় ছিলাম না কোচিং ছিলাম বাসায় ফিরে এসেই দেখি তালা’ (বোবাকান্নাও থেমে নেই ছেলেটির)
এই অন্ধকারে বসে আছো? ভয় লাগে না?’
ছেলেটা কেঁদে ফেলল দোতলায় কান্নার সুর এবার বোবাকান্না থেকে বদলে বেশ জোড়ালো হয়ে গেল মুহূর্তে
আরেআচ্ছা, আচ্ছা! থামো; আমার সাথে- আমার বাসায় এসো ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলে এখানে আবার এসে দেখো তোমার বাসায় কেউ ফিরে এসেছে কিনা? ঠিকাছে?’
বাম হাতে চোখ মুছতে মুছতে 'অ্যা' শব্দ করে থেমে গেল সে
আলো জ্বালিয়ে ছেলেটা কে সাথে নিয়ে চলে এলাম সোজা তিনতলায় আমি একা হলেও ঘরের আসবাবপত্র নেহাৎ কম না একটা বক্স খাট, একটা ড্রেসিংটেবিল, ফ্রিজ এগুলো তো আছেই, সাথে রান্নাচড়ানোর খুঁটিনাটিঘরে ঢুকে টেবিল মোমবাতি জ্বালালাম
এরপর ছেলেটাকে সোফায় বসতে বলে সোজা নিজের রুমে চলে এলামফ্রিজ খুলে ঠান্ডা বরফশীতল পানির এক বোতল ঢকঢক করে ঢেলে দিলাম গলায় ভীষণ ভয় পেয়েছি বলতে হয়, এভাবে নিশ্চুপ আঁধারে হঠাৎ পিলে চমকানো ব্যাপার ঘটলে কেই বা শান্ত থাকতে পারে!
ফ্রিজে একটা কেক রাখা ছিল, সেটাই বের করে একটা প্লেটে নিয়ে ছেলেটির সামনে রেখে বললাম, ‘নাও, আমার বাসায় তেমন কিছু খুব একটা আসলে থাকে না বাইরেই খেতে হয় তাই এটাই আপাতত দেবার মত ছিলবলেই শুকনো হাসি দিলাম
ছেলেটা সোফায় বসে আমার ঘরের এদিক-সেদিক দেখছে যেমন কেউ নতুন কিছু দেখলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঠিক সেভাবে আমি ঘামে পিষ্ট জামাটা বদলে টি-শার্টটা গায়ে দিলাম মুখে পানির ঝাপটা দেবার পর টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললাম, ‘কিছু খাবে?’
ছেলেটি না-সূচক মাথা নাড়ল
আঁধারে চেহারাটা দেখতে না পেলেও এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গোলগাল চেহারায় মায়াময় একটা ছাপ আছে চোখের নীচে ভারী কাঁলচে ছোপ পড়েছে, এতক্ষন কান্নাকাটি করছিল বলে হয়ত! পড়নে সাদা গেঞ্জি এবং কালো হাফপ্যান্ট কাঁধে তখনো একটা স্কুল ব্যাগ ঝুলছে
নীরবতা কাটাতে বললাম, ‘কি ব্যাপার? কেক নিচ্ছ না যে!’
আমার ক্ষিধে নেই!’ (মাথা নিচু করে বামে-ডানে নাড়ল সে)
কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি একা থাকেন?’
একটু শুকনো হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ
আচ্ছা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
ক্লাস থ্রি
রোল?
(রোল নম্বর টা আর বলা হলো না, নীচ থেকে এক মহিলার গলায় আওয়াজ পেলাম, অন্তু )
আমি এখানে!!! (ছেলেটি ডাকে সাড়া দিল)
দেখলাম, ছেলেটিও প্রায় পড়িমড়ি করে সিড়ি ধরে দোতালার দিকে নামতে লাগল আমিও ফিরতে যাবো হঠাৎ আঁধারে সিড়ির গোঁড়ায় ছেলেটি ফিরে এসেই আমাকে বলল, ‘থ্যাংকইউ
আমিও হাত নেড়ে হাসি দিলামসাবধানে যেও!
ওকে থ্যাংকিউ!
এরপর চেলেটির সাথে প্রায় দেখা হতো, বিশেষ করে অফিস ফেরার পথে সিড়িতেকিন্তু কেন জানি কখনও কৌতুহলী হয়ে যেন জিজ্ঞেস করা হয়নি, আসলে দোতলায় কারা থাকে? কিংবা অন্তু নামে ছেলেটির মা-বাবা কি করে?
আমার মনের কথা ছিল একদম সোজা কি দরকার? আমি তো আর শহরের আদমশুমারি করছি নাএকদিন দেখা হলে ঠিকই তো কথা হবে
তবুও একদিন কি মনে করে বাড়িওয়ালার বাড়িভাড়া দিতে গিয়ে দোতলার কথাটা জানতে চাইলাম বললাম প্রায়শই দেখি দোতলার একটা ছেলে, অন্তু নাম! দেখি সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে প্রায় দেখি কিন্তু একে তো ওর মা-বাবা সাথেই নিয়ে যতে পারে খামোখা অন্ধকারে কাঁদে প্রায়ই!
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক হুজুর, মুখে ইয়া লম্বা দাঁড়ি শুধু এতটুকু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেটা কোন সমস্যা করে নাই তো?’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘না তবে ছোট ছেলেমেয়েরা একটু পেরেশান সবাইকেই করে কিন্তু আপনার সমস্যা শব্দটার মানে বুঝলাম না
উনি শুধু বললেন, ‘না না কিছু না
আমিও আমার মত চলছি এদিকে এই বাড়িতে আমার তখন প্রায় মাস 'য়েক অফিসে ক্লোজিং চলছে ব্যাপক ব্যাস্ততা! দম ফেলবার ফুসরত নেই বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা তখন প্রায় কমন ব্যাপার সেদিনও ঘড়ি ধরে প্রায় দশটা ছুঁইছুঁই বাড়ির গেইটে সিএনজি বিদায় করে ক্লান্তি মাখা পায়ে সিড়ি ধরে এগুছি হঠাৎ দোতলায় দেখলাম শার্ট এবং প্যান্ট পরা একজন দোতলায় তালা খুলে ভেতরে যাচ্ছেন পোশাকি ভাষায় বুঝলাম, ভদ্রলোক হয়ত দোকানী নয়ত কোন গার্মেন্টস চাকরি করেন
ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, আচমকা আমি এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যালো! ভালো আছেন?
এতরাতে হ্যালো শুনে ভদ্রলোক সম্ভবত বিরক্ত তিনিও ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে চাইলেন এরপর বললেন, ‘আপনি তিনতলার?’
হ্যাঁ, আসলে আপনার ছেলে অন্তু খুবই ভাল আমার সাথে গত দু'দিন দেখা হয়নি, আমার অফিসে ব্যাস্ততা তাই ওকে দু'দিন দেখিনি এই চকলেট টা ওর জন্য কেমন আছে অন্তু?’
কি বলেন ভাই? এখানে অন্তু নামে কেউ থাকে না আমি সেলিম এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যাবসা করি একাই থাকি সামনে আমার বিয়া আমি এখন অনেক টায়ার্ড
আপনি ব্যাচেলর? কিন্তু.. এর আগে এখানে যারা ছিল?
এবার সে বেশ জোর গলাতে বলল, ‘দ্যাখেন ভাই, গত চারমাস ধরে আছি ভাই আমি কোন অন্তু কে চিনি না  আমি অনেক টায়ার্ড! প্লিজ, আপনি আসেন আরেকদিন কথা হবে ইনশাল্লাহ
আমিও আর কথা বাড়ালাম না সোজা চলে এলাম নিজের ফ্ল্যাটে
অফিসে চাপ থাকায় এই নিয়ে আর মাথাঘামানোর সময় পাইনি কাজের চাপে মানুষ খেতে ভুলে যায় আর এটা তেমন আর কি!
তবে কথাটা আবার মনে পড়ল সেদিন, যেদিন বাড়িওয়ালা কে বাসার ভাড়া দিতে গিয়েছিলাম উনি এটা ওটা নানা কথা বলেন কিন্তু সে ছেলেটির কথা বলেন না আমিও এবার প্রায় চেপে ধরলাম তাকে বলুন তো ব্যাপারটা আসলে কি?
উনি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, ‘দেখুন, ছেলেটা কাউকে কোন সমস্যা করে না তাই আমিও তাকে তেমন কিছু বলি না সে সিড়িতে থাকে
মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলাম,  সিড়িতে থাকে মানে? বাচ্চামানুষ সিড়িতে কেন থাকবে?’
দ্যাখেন, আমি এই বাড়ি নিজে করি নাই, এই বাড়ি সরাসরি কেনা যখন কিনছি তখন খুব সস্তা দামে পাইছিলাম আর পেছনের ঘটনা জানতাম না
কি ঘটনা?’
অন্তু নামে যারে দ্যাখেন, সে এই বাড়ির আগের মালিকের ছেলে একবার ওর মা-বাবা একটা জরুরি কাজে বাসায় তালা দিয়া বাইরে যায় অন্তু বিকালে কোচিং গেছিল ফিরা আইসা দ্যাখে বাসায় তালা চুপচাপ বইসা তখন সিড়িতে বইসা কাঁনতেছিল হঠাৎ লোডশেডিং হয়, বাচ্চা মানুষ! ভয়ে গা শিউরে উঠে এই বাড়ি তখন পুরাটা হয় নাই তিনতলার ঢালাই চলতেছে হঠাৎ শুনশান আন্ধারে ভয় পাই সে তাই সিড়ি ধইরা তাড়াতাড়ি নিচে নামতে গিয়া পা পিছলাই সোজা নিচে পাকায় পইড়া যায়!’
আমার মুখ থেকে ফস করে বেড়িয়ে এল, ‘ইস!’
বাড়িওয়ালা বলতে লাগলেন, ‘তারপর মাটিতে মাথা ফাইটা পইড়া ছিল অনেকক্ষণ মা-বাবা ফিরা আইসা ছেলেরে খুঁজতে খুঁজতে সিড়ির নিচে পায় ততক্ষণে ছেলেটা আর নাই!’
কি বলব আর বুঝতে পারছিলাম না অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটে আমাদের সাথে যার কোন তৃমাত্রিক ব্যাখ্যা নেই তবুও বিশ্বাস করতে হয় সেগুলো, অমূলক বলে গা ঝাড়া দিয়ে ধূলোবালির মত ঝেড়ে ফেলা যায় না
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি বাড়িওয়ালা বলল, ‘আসিফ ভাই, চা খাবেন? চা আনতে বলি?’
না থাক! ধন্যবাদ সোফা ছেড়ে উঠে পড়লাম
ভয়ে, দূঃখ্যে আমার বলার ভাষা হারিয়ে গেছে
বাড়িওয়ালা অভয় দিয়ে বলল, ‘আসলে এই ব্যাপার কেউ জানে না, শুধু আমি ছাড়াআমিও নিজে থেকে কাউকে এই নিয়া কিচ্ছু বলি নাঅনেকেই দেখে কিন্তু জানে না বইলা দেখলেও কিছু বলে না কারন তারা ব্যাপারটা জানে না কিন্তু আপনি সেদিন যখন কইলেন তখন আপনার অনুরোধে না কইয়া পারলাম না
এরপর আর কথা বাড়াইনি
প্রায় দিন সাতেক পর আবার দেখা অন্তুর সাথে, আজ লোডশেডিং সিড়িতে কালো ছায়াটা অন্তুর, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি ভয় না পেয়েও কেন জানি আজ ভয় পাচ্ছি শোনা কথায় ভয় বেশী আমারো মনে তেমন ভয় বাসা বেঁধেছে এই বাসায় আজ আমার শেষ দিন
আমি কাল বাসা ছেড়ে দিচ্ছি

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...