শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

গল্পঃ অভি



অভি; এক নামে জুনিয়র থেকে সিনিওর সবাই চেনে ওকে, মেডিকেল লাইফের ১৮০ জনের একজন ও। কোঁকড়া চুলের ফর্সা ছেলেটি ভীষণ লাজুক, মেডিকেল কলেজে বছর বছর নতুন মুখ আসে, আবার চলে যায়। কিন্তু ওর মত দুঃখী কেউ হয়ত এখনও আসেনি কেউ। নিজের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখে ও।
এক
ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরুর পর থেকেই অভি ক্লাসে ভীষণ মনযোগী।মন দিয়ে সব ক্লাস করে সে, কি টিওটোরিয়াল কি লেকচার। কিন্তু চাপা স্বভাবের অভি কারও সাথে মিশতে পারে না।মুখ লুকিয়ে থাকতে কে ভালবাসে? ক্যাম্পাসে নতুন মুখের যেখানে ছড়াছড়ি সেখানে অভি নিজে থেকে এগিয়ে না এলে কেই বা ওকে বন্ধু বলে কাছে টেনে নেবে।তবুও অসম্ভব উদ্দীপনায় ক্লাস শুরু করে অভি।
কিছুদিন পর অভির জীবনে দুঃসংবাদ বয়ে আসে, ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অভির বাবা। অভির পরিবারে অভি একমাত্র ছেলে।বড় বোন আছে ওর কিন্তু পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে সব দ্বায়িত্ব নিজের  এসে পরে অভির কাঁধে। মেডিকেল ছেড়ে অভি ছোটে ওর বাবাকে নিয়ে। কাছের বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না এ ব্যাপারে। শুরুতে সবাই যখন পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস, সেখানে অভি প্রায় মাস খানেক মিসিং।
এরপর অভি যখন মন খারাপ করে ফিরে আসে ক্যাম্পাসে ততদিনে, মেডিকেলের অনেক এক্সাম চলে গেছে। সাপ্লি জটিলতায় আটকে যায় অভি। একের পর এক টার্ম, আটকে যায় ওর। ফিরে এসে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অভি, হতাশায় পড়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না কোনদিকে যাবে সে। ক্যাম্পাসের হলে ফিরে আসবার পর তার সহপাঠীরা যখন এক্সাম দিয়ে ফুরফুরে হয়ে আছে, উচ্চস্বরে আনন্দ করছে তখন অভির নিজেকে একা মনে হয়। কান্না লুকোতে বেড়িয়ে পড়ে সবার অলক্ষ্যে। কাছে থাকা যাদের ও বন্ধু ভেবেছিল ওরাও নিজস্ব চাহিদা আর ক্ষমতার দাপটে ভুলে যায় ওকে। কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে যায় অভি। এক বুক হতাশ ঘিয়ে ধরে ওকে।
ঢাকার নামকরা কলেজ থেকে পাস করে বের হওয়া অভি যখন মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। তখন সবচেয়ে খুশী হয়েছিলেন ওর বাবা। সেই বাবা যখন অসুস্থ, অভির কি করে মন বসে মেডিকেলে!
ছ’মাস কেটে যায় এভাবে। মাঝে অভি একবার ঢাকা একবার কলেজ, ছুটোছুটি চলতে থাকে অভির। অভির বাবা মাঝে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন তাকে নিয়ে যেতে হয় দেশের বাইরে, সেখানেও ছোটে অভি। তার আত্বীয়দের কাজে সন্তুষ্ট নয় সে। বাবার ভিসার আবেদন করেও রীতিমত ঝক্কি পোহাতে নয় তাকে।এরপর আবার মাস খানেক নেই অভি!কাছের দু-একজন কলেজ বন্ধু ছাড়া কেউ জানে না অভি কোথায়!
অভি ফিরে আসে দেশে। তার বাবা কিছুটা সুস্থ। অভি মন দেয় পড়াশোনায়।বড় বোনের বিয়ের কথা চলতে থাকে।ওর প্রফের আগে ভাগেই বিয়ে হয়ে যায় বোনের। কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে অভির মনে।কিন্তু বোন বিয়ের পর দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় বাবাকে নিয়ে বড় একা হয়ে পড়ে অভি।
পড়াশোনায় মন দিতে পারে না, তবুও চেষ্টা চলতে থাকে ওর। মেডিকেল কলেজের এত্ত চাপ, সেই সাথে পরিবারের নানা সমস্যা আড়ালে রেখে চলতে থাকে ওর জীবন। কিন্তু স্বস্তির দিন বেশী থাকে না। বাবার মৃত্যু ভীষণভাবে ভেঙে দেয় ওকে। অভি অসহায় হয়ে যায়!
দুই
তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। তার নতুন বন্ধু, রুমমেট এবং ক্লাসমেট শান্ত। দুজনে ভীষণ ভাব। একাকিত্ত ঘোচানোর জন্য এমন বন্ধুর খোঁজ দিতে অভি রাজী। দুখের দিনগুলো ভুলতে থাকে অভি। চলতে থাকে অভির মেডিকেল জীবন। এক চান্সে প্রফ পাস করার ভাগ্য খুব কম স্টুডেনেটের হয়। এত হতাশার পরও অভি একের পর এক ধাপ এগিয়ে আসে।
মন মরা অভির সেখানে কোনদিন ফেসবুকে আইডি খোলেনি, সব বন্ধুদের পর তার আবির্ভাব হয় ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতে। বছর পার করে অভি মামা হয়। দূর বিদেশ থেকে ভাগ্নের ছবি পেয়ে উছ্বসিত অভির আনন্দের সীমা ছুঁয়ে যায় নীল আকাশ।
তিন
এই পর্ব বেশ ছোট এবং অসম্ভব আনন্দের। ফাইনাল প্রফের গন্ডি পেরিয়ে অভির ফেসবুকে স্ট্যাটাস টা আমার চোখে পড়ে। আমার নিজের কান্না পাচ্ছিল সেদিন। ওর বাবাকে উৎসর্গ করেছে ওর কৃতিত্ব।এর অনেক পরের কথা অভি গাইনি ওয়ার্ডের একটি অপারেশন সাক্সেসফুলভাবে শেষ করেছে বেশ আগে। হাতে নিউবর্ন বেবিকে নিয়ে হাসিমুখে ছবিতুলে ওর পোস্ট ‘আমার প্রথম অপারেশন”
অভি ভাল আছে এখন।

মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬

গল্প: পাঁচ টাকা



              

সদরঘাট টার্মিনাল, লোকে লোকারণ্য। দম ফেলার জায়গা নেই কোথাও। ঈদেরছুটি শুরু হয়েছে। তাই বিকেলের এ সময়ে সামান্য ফুসরত ফেলবার সুযোগ নেই কারও মাঝে। মুখের পর মুখ লঞ্চঘাট মুখী। সাদাকালো, শ্যামলা, ছোট্ট পা আর বড় পায়ের মানুষ ছুটছে প্রাণের টানে নিজ নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে।
সে ভীরের মাঝেই মাদুর পেতে -থালা হাতে, চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এখনো ভিক্ষা করে যাচ্ছেন আমিন মিঁয়া।
 জন্মের পর পাঁচ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আব্বা শফিক মিঁয়া ছেলের নাম রাখেন আমিন। মিঁয়া বাড়ির প্রথম ছেলে আমিন। পিতার স্বপ্ন ছেলেকে মোক্তবে পড়াবেন। ছেলে মাশাল্লাহ রাজপুত্তুর। আদবকায়দা, চেহারায় অতুলনীয়।
তাই ছেলের বয়েস পাঁচ পার হতেই ভর্তি করে দিলেন মোক্তবে। মোক্তবে পড়া আমিন খুবই ভাল ছাত্র।
তাই ফলাফল দিয়ে আব্বার মুখ উজ্জ্বল করতে সময় নিল না। পিতা-মাতার মুখে সুখের হাসি। কিন্তু সব সুখ একসাথে মেলে না! শফিক।মিঁয়ার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া জমির অধিকাংশ ছিল মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে। শেষরক্ষা হলো না আর!
উন্মত্তা মেঘনার নদীর করাল গ্রাসে বেঁচে থাকার সম্বল ফসলের ক্ষেত ভেসে গেল পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে। গাঁয়ের বাড়িটাও গেল কিছুদিন পর। গ্রামের অনেক বাড়ির মত মিঁয়া বাড়ি হয়ে গেল অতীত।
পেট চালাতে কাজ চাই, গ্রামে প্রায় সবাই নিঃশ্ব মেঘনার আঘাতে।
তাই কাজের খোঁজে শফিক মিঁয়া তার স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে আমিন কে নিয়ে চলে এলেন যাদুর নগরী ঢাকায়।
আশ্রয় নিলেন ফুটপাতের পাশে গড়ে উঠা এক বস্তিঘরে। তার জীবিকানির্বাহের বাহন হল গরীবের গাড়ি রিক্সা।
দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও পুত্র আমিন কে আবার ভর্তি করে দিলেন এলাকার মাদ্রাসায়। মেধাবী আমিন আবার হাসিমুখে, শফিক মিঁয়া সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ঢাকার পথ চষে বেড়ান, পরিবারের ভাল থাকাটা তার জন্য বেশী দরকারি।
বস্তিতে মাদক ব্যবসা চলে, মাঝে মাঝে পুলিশ এসে হানা দেয়। ওরাও সপ্তাহে আসে যদি পকেটে কিছু না পড়ে। মাদক সম্রাট পুলিশসাহেব কে খুশী করে দেয়।
শফিক মিঁয়ার রাতে ঘুম হয় না, তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি তাকে এমন জীবন কাটাতে হবে। মেঘনার রাক্ষুসে ক্ষোভ মাত্র এক ধাক্কায় এলোমেলো করে দিয়েছে তার জীবন। চোখের দু-কোণা ভিজে আসে তার। কি ভেবেছিলেন আর কি হলো!
চালার টিনের দিকে টিনের ফুটো দিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চোখ যায় তার। ক্লান্তিতে, ঘুমের মায়ায় চোখটা বুজে আসবে যখনি শোনেন বস্তিতে পুলিশের রেড পড়েছে। বাঁশি বাজিয়ে টর্চের তীব্র আলো পড়ছে বস্তিতে, বুটের ধপাধপ ভারী শব্দ।
মাদক সম্রাট ধরা পড়েছে। জানালায় চোখ ভিজিয়ে ধরে নেবার দৃশ্য টা স্ত্রীসহ চুপিচুপি দেখলেন তিনি।
শুকরিয়া আদায় করলেন মন মনে। অন্যায়কারী যতই শক্তিশালী হোক ধরা তাকে পড়তেই হবে।
এভাবে তাদের বছর কেটে যায়, ঈদ আসে। শফিক মিঁয়ার ঈদ এবার আনন্দে কাটে না, অনাহারী হয়ে ঈদের আনন্দ কতটুকু আর দাগ কাটে?
তবুও ছেলেকে তা বুঝতে দিতে নারাজ তিনি, ছেলেকে নতুন পাঞ্জাবি কিনে দেন। সেমাই কেনেন বাড়িতে। ঈদের আয়োজন চলে শত কষ্টের আড়ালে।
ঈদের খুশীতে আমিন আটখানা হয়। পিতা হয়ে সন্তানের এই খুশীই তার বড় প্রাপ্তধন।
কিন্তু সব খুশীই কেন জানি চিরস্থায়ী হয় না। রিক্সা নিয়ে ভয়াবহ এক এক্সিডেন্ট করে ফেলেন শফিক মিঁয়া। চলন্ত বাস তার রিক্সাসহ ঠেলে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়।
পংগু হয়ে গেলেন শফিক মিঁয়া। সংসারের হাল ধরলেন স্ত্রী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঠিকে কাজে যা ইনকাম হয় তাতে সব খরচ মিলিয়ে আমিনের পড়ালেখার খরচ বাকী থাকে না। অসুস্থ শফিক মিঁয়ার ওষুধ, সংসারের খরচ মিলিয়ে পড়ার খরচ কই?
ধুঁকে ধুঁকে অসুখে আমিনের বাবা মারা যাওয়ার পর আমিন নামে ভিক্ষায়। কেউ কাজ দিত না, মাঝে এক হোটেলে বয় হিসেবে নেমেছিল কাজে কিন্তু হোটেলের মালিক চোর বলে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে।
সেই থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালায় আমিন। সংসারে শুধু তারা দুজন আমিন এবং তার সন্তান রকিব। মা মারা গেছেন বাবা মারা যাওয়ার দু বছর পর। অভাবে থেকে পড়ালেখা আর হয়নি।
"আম্মা, আল্লার নামে কিছু দিয়া যান" (কাঁদো স্বরে আকুতি জানায় আমিন)
পথচারী মহিলা হাটা থামিয়ে পাঁচ টাকার একটা কয়েন টন শব্দ করে থালায় ফেলে দিয়ে আবার আগের গতিতে চলে গেলেন তার গন্তব্যে।
আলহামদুলিল্লাহ্‌!
শুকরিয়া আদায় করলেন আমিন মিঁয়া।
ছেলে রকিব আমিন মিঁয়াকে হাতে ধরে তাড়া দেয়, "আব্বা আইজ চলেন বাড়ি যাই! অনেক হইছে!"
আমিন মিঁয়া ছেলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ান।
লঞ্চঘাটের ব্রিজ ধরে এগিয়ে আসেন দুজনে। আমিন এখনো বিয়ে করেননি। রকিব তার রক্তের কেউ নয়। পথে কুঁড়িয়ে পেয়েছেন ওকে, রক্তের মিল না হলেও রকিব আমিনের সন্তান। নিজে ভিক্ষে করলেও ছেলেকে পড়াচ্ছেন স্কুলে।
রকিব স্কুলের ফার্স্ট বয়।

(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...