শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০২১

ছোটগল্পঃ হরিশের ভিটে


দেয়াশলাই টা দপ করে নিভে গেলো। শিক দেয়া জানালা দিয়ে বাতাস যেন অনুমতির তোয়াক্কা না করে ই ঢুকে পড়ছে দ্রুত।
ধ্যাত! (অনেকটা ই বিরক্ত হরিশ ভদ্র)
আরেকবার দেয়াশলাই থেকে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেও সেটা দপ করে আগেরবারের মতন পুনরাবৃত্তি হয়ে দ্রুত ই নিভে গেলো। ম্যাচ টা পকেটে পুরে লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালাতে বাধ্য হলেন হরিশ ভদ্র। অন্ধকারে বন্ধ ঘরের শুধুমাত্র জানালা একটি, একটিমাত্র দরজা যেটি এখন পুরোপুরিভাবে বন্ধ তবুও বাতাসের তীব্র গোঙানি তে কেঁপে উঠছে থরোথরো। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কাঠের চেয়ার টেনে এবার জানালার ফাঁকা অংশে বসলেন তিনি। চারদিকে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরের কোন পাখি সশব্দে আর্তচিৎকার তুললো, সাথে সাথে আরো জোরালো হলো বাতাস। মনে হলো, পাখির কন্ঠে সায় দিলো সে।

হরিশের ভিটে। এই গ্রামে সবাই এই বাড়িটা একনামে চেনে। ছোটবেলায় অসীম, শাশ্বত, অভিষেক একসাথে মাইনে দিয়ে পড়তে আসতো এখানে। ক্লাস ওয়ানের ছেলেপেলে মারাত্মক ভয় পেত হরিশ স্যার কে। তবে এখনকার পড়ুয়া ছাত্ররা আগের মতন নয়, শিক্ষক কে তেমন একটা ভয় তারা আজকাল করে না। গুরুজন কেও সম্মান ততটা করে না। অথচ পুরোনো সময়ে যখন ওরা ছাত্র ছিল, তখন অসীম একবার হরিশ ভদ্রের ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলো। দুইয়ের সাথে বায়ান্ন যোগ করলে কত হয় অসীম সেটা বলতে পারেনি। হরিশ ভদ্রের চেহারা অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দেবীর সাথে থাকা অসুরের মতন। গালে মোটা তিল, পাঁকানো গোঁফ তার সাথে মাঝ বরাবর সিঁথিকাটা আলুর মতন গোলাকার চেহারা। দেখলে ই পিলে চমকে যেত ওদের।
"কি রে শাশ্বত?  অংক করিস নাই কেন?"
স্যার! ক.. করি..নাই!
"অসীম পাঁঠা? অংকের খাতা কই?"
স্যা..র..
নাম শুনে ই অসীম কান্ডখানা করেছিলো।
হরিশ ভদ্র অনেকবছর স্কুলে পড়ালেন। বগলে ছাতা, পায়ে সস্তা স্যান্ডেল, তেল দেয়া মসৃণ চুল। প্রায়শ এভাবের কোথাও না কোথাও দেখা যেতো তাকে। ২০০-৩০০ টাকায় দূর্বল ছাত্ররা পড়তে যেতো তার কাছে। স্কুলের পাশাপাশি নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলেছিলেন। তবে শিক্ষকদের রেষারেষি তে বেশিদিন চালাতে পারেন নি। শেষদিকে চাকরি টা তার চলে যায়। তখন একবার শাশ্বত তাকে গ্রামের বাজারে দেখতে পেয়েছিলো। মাথার চুল পেঁকে গেছে, চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে তবে সেই আগের মতন ই আছেন। স্যার কে দেখে কুশল বিনিময় করলেও হরিশ ভদ্র কে আন্তরিক দেখা গেলো না। বহু বহুবছরের পুরোনো ছাত্রকে দেখে তিনি আপ্লুত হলেন না দেখে শাশ্বত অনেকটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলো সেদিন।
সাবধানে! সাবধানে!
অভিষেক সতর্ক করলো বাকী দুজন কে। মোবাইল আর টর্চ হাতে ওরা তিনজন এগিয়ে চলেছে হরিশ ভদ্রের ভিটার দিকে। একবার হলেও এই শুনশান নীরব রাতে ওরা দেখতে চায় গুঞ্জন কতটা সত্যি!
এই! এই! শক্ত করে শাশ্বত'র হাত চেপে ধরলো অসীম। তারপর আগুল তুলে অন্ধকার জানালায় জ্বলতে থাকা সিগারেটের ছোট্ট আগুন দেখে গায়ত্রী মন্ত্র জপতে লাগল অভিষেক।
শাশ্বত গলা নামিয়ে বলল, " যা শুনেছি সেসব তবে সত্যি! "
একরাতে আগুন লাগে, স্যার একা থাকতেন। ঘুম বেজায় কড়া তাই আর বাঁচতে পারেননি ঘর ছেড়ে। দিনের বেলার এলে দেখবি বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে আছে।
পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিলো অভিষেক।
"চল ফিরে যাই, ভিটে টা এখন ভৌতিক।"
ফিরে চলল ওরা। ধীরেধীরে আঁধারের মাঝে পথ দেখে ফিরতে লাগল তিনজন। শাশ্বত কি একটা মনে করে পিছু ফিরলো। জানালায় এখন লাল আলো তিনটি। সম্ভবত চোখজোড়া জ্বলছে।

(সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

ছোটগল্পঃ প্রত্যাবর্তন

 পাণ্ডুলিপি টা প্রায় শেষ, এডিটিং করাটা বাকী। আগের রাতেও কথা হলো প্রকাশকের সাথে। ভদ্রলোক আমাকে দেখে মারাত্মক ভয় পেলেন! আমার এতে পেট ফাটানো হাসি পেলো। হাতের ইলিশ মাছ জোড়ার মায়া ছেড়ে উল্টোদিক লক্ষ্য করে তিনি প্রায় পড়িমরি করে ছুটে গেলেন। ভেবেছেন আমি হয়ত- পাওনা টাকা টা আগে ই চেয়ে বসবো। বিশ্বাস করুন, আমি তেমন মহাজন ঘরানার মানুষ নই।

বাবা! তোমার চা!

মেয়েটা ক্লাস টেনে উঠলো। অসাধারণ মেধাবী, তবুও লোকে কুৎসা রটায়! বলছে মেয়েটা নাকি পাগলি। বাবা হিসেবে এ কথা শুনতে কতটা খারাপ লাগে সেটা বোধহয় পৃথিবীর তাবৎ বাবা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। জানি মেয়েটা আংশিকভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তবে লোকের কথায় সে তো আর পুরোপুরিভাবে পাগলি নয়।

অংশুক বাসায় এসে ব্যাগ ছুড়ে দিলো সোফায়, মার্চের আগুনে গরমে ওর মুখ লাল। আজ স্কুলের রেস ছিল, স্পোর্টসে রীতিমত ভাল। আজো জিতে এসেছে সে। পায়ের ধুলোবালি, টি টেবিলে রাখা কবজি সাইজের ক্রেস্ট টা তার ই প্রমাণ।

নিবেদিতা ঘরে এলো, আমার ঘরে সে এখন কম আসে। সারাদিন ছুটোছুটি চলছে ওর। শুনলাম পেনশনের টাকাটা এখনো আসেনি আমার। ফাইলের মারপ্যাঁচ খেলতে খেলতে হয়ত কোন এক টেবিলে আটকে পড়েছে। টাকা চুরি করতে শিখিনি বলে এখানেও তেমন উৎকোচ দেয়ার সামর্থ নিবেদিতার নেই। তাই উপরওয়ালা বরাবর নালিশ রেখে তার দুয়ারে মাথা ঠেকাচ্ছে আমার উনি। সে ঠেকাক! কিন্তু যারা পেনশনের ফাইল টা ঠেকিয়ে রেখেছে তাদের কে ঠেকাবে কে? পত্রিকার পড়লাম, নচ্ছার বলে একদল আরেক দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উভয় নচ্ছার ই একে অন্যের পরিপূরক। মাঝখানে পড়ে আম ছালা চলে যায় আম পাব্লিকের। সৎ মানুষের অভাব। এদের অভাব নেই, মানুষ কেন জানি সৎ থাকতে পারে না। এই অধিকার টা একটা সময় এরা হারায়। খুব রাগ হচ্ছে, উঠে গিয়ে টেবিলে গুছিয়ে রাখা আমার লেখা পাণ্ডুলিপি টা ছাইপাঁশ বলে ছুঁড়ে দিলাম। কাগজগুলো উড়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। আমার মেয়েটা কোথা থেকে উড়ে এসে সেগুলো গুছিয়ে বাকা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, " বাবার! বাবার লেখাগুলো বাতাসে উড়ে..উড়ে গেলো "

দেয়ালে সাদাকালো ছবিটায় ফুল শুকিয়ে এসেছে। সময়ের মারপ্যাঁচে আমিও শুকিয়ে হারিয়ে গেছি দু-বছর আগে।


(সমাপ্ত) 

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...