মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০

ছোট গল্পঃ ডেটিং

 

           ট্যাক্সি থেকে যে লোকটি নামল তাকে রেস্তোরা'র জানালা দিয়ে ভালো করে দেখতে পেল সুতপা। একদম বিকেল ৪টা। কথার দাম আছে বলতে হয় ভদ্রলোকের। কালো শার্ট, বাদামী রঙের প্যান্ট আর কাঁধে ব্যাক প্যাক। আপাদমস্তক দেখে নিল সুতপা। ভদ্রলোক,  একেবারে হাতে ধরে টাইম মত হাজির। খুশী ই হয়েছে সুতপা।

রেস্তোরা'র দরজা ঠেলে ভেতরে এসে ই আগে দেয়া বর্ণনামত, কচুপাতা আর লাল টিপ দেয়া মেয়েটাকে ঠিকি চিনে ফেলল ভদ্রলোক।
আপনি ই সুতপা! ( টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল)
সুতপাও মিষ্টি করে একটু হাসল। উত্তরে বলল, " হ্যাঁ আমি ই! প্লিজ বসুন। আসলে অন্য রেস্তোরা তে খুব বেশী ভীড় তাই আপনাকে এখানে ডেকে আনলাম। "
ইটস ওকে। আমারো ট্যাক্সি ভাড়া কমে পড়ল! (হাসিমুখে বললেন ভদ্রলোক)
চেয়ার টা টেনে বসতে না বসতে ভদ্রলোকের কল এল। সেটা রিসিভ করে কথোপকথন যা হলো তার সার সংক্ষেপ,
-জ্বী, কেউ ছিল না বাসায়!
-না সমস্যা হয়নি।
-আচ্ছা, কবে পাবো?
-আজকেই?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ব্যাংক কালও বিকেল পর্যন্ত খোলা।
কথা শেষ করে সেটা আবার ফোন পকেটে রাখতে গিয়ে ভদ্রলোকের পকেট থেকে নাইলনের একটা দড়ি ঝট করে বেড়িয়ে পড়ল। সেটা সুতপার চোখ এড়াল না। চাপা হাসি দিয়ে তাই অবাক চোখে তাই প্রশ্নটা করে ই ফেলল ও, " দড়ি কেন? "
আসলে, কাজেকর্মের ফাঁকে ভুল করে পকেটে চলে এসেছে। ( একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন ভদ্রলোক)
সুতপা মুচকি হাসল। আপনি তো দেখছি, কাজে তো খুব মনোযোগী নন!
(কথোপকথন চলতে থাকে)
দেখা হবার আগেরদিন,
ডেটিং সাইটে দুজনের আলাপ। ভদ্রলোকের নাম খালেক। যে ছবিটা সাইটে দেয়া সেটাও খুব ভাল বোঝা যায় না। দেখে মনে হয় লোকটার মাথার সামনে চুল কিছুটা কম, তবে একেবারে টাক নয়। মুখে হালকা চাপ দাঁড়ি। তবে বেশ কথা জানে লোকটি। সাইটে সেই প্রথম এসে সুতপা কে নক দেয়। সুতপার নিজের ছবিও দেয়া ছিল না। রুপাঞ্জেলের এনিমে ছবিটা দেয়া। তা দেখে ই নাকি খালেকের প্রশংসা।
সুতপার স্বামী ডাক্তার। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে একটি কারণে ওরা দূরে দূরে আছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা সাময়িক মান-অভিমান। পরে জানা গেল, নিজেদের রাগারাগি টা একটু বেশী ই। কিন্তু দুজন দুজন কে প্রচন্ড ভালোবাসে। সেই ছোটবেলা থেকে দুজনের জানাশোনা। একই স্কুল, কলেজ। পরে এসে পড়াশোনার পাঠ আলাদা হয়ে পড়ে কিন্তু দুজনের মাঝে ভালোবাসা একটুও কমেনি। বিয়েও করেছে প্রায় বছর দুই। কিন্তু এখন দুজন দুজন কে দূরে রেখে কষ্ট পাচ্ছে শুধু শুধু! তাই জেলাস করতে সুতপার এই চাল। ডেটিং করে জেলাসী করে দেয়া।
ওরা রেস্তোরা তে এখন খুব ই ব্যস্ত। বেশ হাসাহাসি চলছে। সেখানে একটা টিভিও চলছিল। তাতে বিকেলের নিউজে দেখানো হলো একজন সদ্য বিবাহিত মহিলা খুন হয়েছেন। সম্ভবত দুপুরে ঘটনাটি ঘটে। তাই সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির আশেপাশে কাউকে দেখা যায় নি। মহিলাকে রেইপ করাও হয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করছে। পোষাক পরিচ্ছদের উপর রাফ চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তার থেকে বড় কথা গলায় নাইলনের দড়ি টেনে মহিলাকে খুন করা হয়েছে।
সুতপার চোখে গেল টিভিস্ক্রিণে।
নীচু গলায় বলল, " আপনার কাজ? "
ভদ্রলোক বা দিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, "হ্যাঁ, আর সেটা করে ই দ্বিতীয় ক্লায়েন্টের কাছে এলাম "।
রেইপ?
নাহ, অতো নীচু আমি নই! এটা সুপারির এক্সট্রা আবদার ছিল।
সুতপা একটু হাসল, ক্রুর হাসি। এরপর বলল, আমার কাজটা কি হবে?
নিশ্চই হবে কিন্তু ছবিটা?
আমার পেছনে সাদা শার্ট আর নেভী ব্লু প্যান্ট পড়ে যে লোকটি হাসছে সে। সাথের মেয়েটিকেও...
না না, ডবল করলেন এখন? খালেক আক্ষেপের সুরে বলল।
পেমেন্ট টাও ডবল হবে।
সুতপা উঠে চলে যাচ্ছিল। খালেক প্রশ্ন করল, "কিন্তু কেন করাচ্ছেন সেটা যদি?.."
আমাকে ফেলে ও এখন অন্য মৌচাকে উড়ে বেড়াচ্ছে তাই!
খালেক, নিঃশব্দে হাসল এরপর বলল,  " ইট ওয়াজ এ নাইস মিটিং বাই দ্যা ওয়ে "
অনেকটা এগিয়ে গিয়েও সুতপা আবার কয়েক পা পিছিয়ে এলো,
জিজ্ঞেস করল, "খালেক! এটা তো আপনার আসল নাম নয়! তাই কি?"
উত্তর এলো, " নো "।

গল্পঃ ডেটিং (একটি বিদেশী গল্প অবলম্বনে)

(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক, এর সাথে বাস্তবের কোন জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়)


মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০

গল্পঃ গোস্ট রাইটার

রাত আনুমানিক বারোটা, নতুন বছরে ম্যাগাজিনের কাজ সেরে কুষ্টিয়া যাবার টিকেট করেছি। লালনের মাজার দেখার ইচ্ছে অনেকদিন আগে থেকে। সাধক মানুষদের প্রতি আমার মন বেশ দূর্বল, তাদের কে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। লালনের মাজারে দিন তিনেক কাটিয়ে আবার ফিরে আসবো। 
শহরে শৈত্যপ্রবাহ চলছিল গত তিনদিন ধরে, আজ সূর্য নতুন বৌয়ের মতন দিনের ঠিক শেষভাগে এসে উঁকি দিয়ে গেছে পিচঢালা শহরের এঁটো দেয়ালে। তাই শীতের উপদ্রব খানিকটা কম। বাসস্ট্যান্ডে এখন কেবল আমি ই একা। দূর থেকে মাইকে গান বাজছে আর তার ই ক্ষীণ সুর ভেঙে ভেঙে শোনা যাচ্ছে মাঝেমাঝে। দুই একটা কুকুর দলবল নিয়ে ঘুরে চলেছে আমারি ঠিক আশেপাশে।
কপাল ভাল, ঠিক যেখানে বসে আছি সেটা একটা টঙ দোকান। দোকানি জুবুথুবু হয়ে হাঁটু মুড়ে দিব্যি একটা বিড়ি ফুঁকছে। কেটলি টা তার ধোঁয়া তুলছে। খদ্দের না থাকলেও এখন শীত থেকে বাঁচতে এটা ই একমাত্র উপায় এই লোকটির কাছে। 
" আপনার কাছে কি চা হবে? " জিজ্ঞেস করতে ই দোকানি চাচাজান মাথা নাড়িয়ে জানাল হবে।
" ভাইজান, কই যাবেন? " পাল্টা একটা প্রশ্নও করলো সে
বললাম, " কুষ্টিয়া! "
প্রত্ত্যুত্তরে মৃদ্যু হাসল তারপর চিনি আর দুধ মিশিয়ে চা চামচের টিংটিং শব্দে কাঁচের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে দ্রুত বসে গেলো আগের জায়গায়। চা হাতে নিতে ই বুঝলাম এখন শীত বাড়ছে। টঙের ছাউনিতে বসে ও এখন শীত কানের ভেতর ঢুঁকে মগজে সুতীব্র আঘাত করছে। 
চায়ে চুমুক দিচ্ছি। দুজনে ই বেশ চুপচাপ। চা দোকানি কে দেখলাম হাতের স্মার্টফোনে ব্যস্ত। বাসের সুপারভাইজার এর মাঝে এসে বার কয়েক আমার খোঁজখবর নিলেন। পথে কোথাও এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই বাস আসতে লেইট। তবে আর বেশীক্ষণ হয়ত লাগবে না। কাপ টা শেষ করে বসেছি। শরীরে চাঁদর টা টেনে বসলাম। মনে হলো কাউন্টারে বসে থাকলে ই বেশ হতো। তবে সেখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না।
" আপনি বিভূতি? " আচমকা নির্জন এক বাসস্ট্যান্ডে এমন কেউ নাম ধরে ডেকে উঠতে অবাক এবং একইসাথে বিস্মিত হলাম।
" আপনি আমাকে চেনেন? " প্রশ্নটা করে ফেললাম
লুঙ্গী এবং রঙচটা একটা সোয়েটার গায়ে একজন মানুষ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমার। বয়েস আন্দাজ ত্রিশ। হালকা পাতলা গরণ। মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ। ইশারায় হাত দেখিয়ে পাশের ফাঁকা বেঞ্চি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলো বসবে কিনা?
আমি "হ্যাঁ" সূচক মাথা নাড়লাম।
সে বসে ই বলল, " আপনার লেখা আমি পড়েছি। আপনার লেখার ভক্ত আমি। বেশ কয়েকটি লেখা আসলে অনেকগুলো লেখা ই আমার পড়া। কয়েকটি গল্পের নাম ও সে বলে দিলো ঝটপট করে। আমি ততক্ষণে খুশীতে গদগদ দশা। এই নির্জন স্ট্যান্ডে, এই মাঝরাতে, ঠিক এভাবে কোন লেখক ভক্ত খুঁজে পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। আমি চা অফার করতে ই সে অবশ্য মানা করল। দোকানি কে এক পলকে দেখলাম কানে হেডফোন গুঁজে ভিডিও দেখতে ব্যস্ত। তাই আবার কথায় ডুবলাম দুজনে।
কথায় কথায় পরিচিতি বাড়ল। জানলাম সে ও আগে টুকটাক লিখতো। তবে সাহস করে বই বের করেনি। তাতে নাকি মেলা ঝামেলা। সে একটা গল্প বলতে চাইল তখন। আমি একবার শরীরে চাদরটা ভালোমতোন জড়িয়ে ঘড়ি দেখলাম রাত ১ টা বাজতে দুই মিনিট বাকী। এর মাঝে বাস এলে উঠে পড়বো ততক্ষণ এই ভদ্রলোকের গল্প শোনা যাক।
তখন প্রায় নব্বই দশক, বাড়িভাড়া পাওয়া ব্যাচেলরদের জন্য প্রায় একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মতন। তবে সে ছেলেটি বাড়ি ভাড়া পেয়েও গেলো।
"ছেলেটি? " -প্রশ্ন করলাম
সে বলল, " হ্যাঁ, সদ্য অনার্সে পা দেয়া। তখন সে বাংলা সাহিত্যে পড়ছে। পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ এসব লেখাতে ও মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক। তবে মজার ব্যাপার হলো তার লেখা সে নিজেই পড়ে, কোথাও ছাপানোর নাম করে নি।
"কেন? " 
এর কারন অবশ্য তার সহপাঠীরা। ওরা লেখালেখি পড়ে ই হাসাহাসি করতো। তাই নিজের নামে যেখানে কলেজ ম্যাগাজিন কিংবা অন্যত্র লেখা জমা দিয়েছে বন্ধুরা নাম দেখে ই রিজেক্ট করে দিয়েছে। তাই একেবারে ওর নাম হয়ে গেলো মিস্টার রিজেকশন। এই নামটি আরো প্রকট হলো ঠিক যখন একটি পত্রিকায় ওর নিজের পাঠানো একটি লেখা রিজেক্ট হলো। রুম শেয়ার করে থাকা ছেলেটি নাকি এটি ছড়িয়ে দিয়েছে। 
আমি জিহ্বা ' চুকচুক ' শব্দ করে বললাম, " ডি মোটিভেশন " অনেক বাজে একটা কাজ। তারপর?
ছেলেটি লেখালেখি ছেড়ে দিলো কিন্তু সহপাঠীরা খোঁচা দিতে ই থাকল। তারপর অনার্সের মাঝামাঝি সে ফেইল করে বসল। পড়াশোনায় সে ভাল ছিল কিন্তু ডিপ্রেশন তাকে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে দিলো না। যেখানেসেখানে তাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাসা বাড়তে লাগল, এমনকি জুনিয়র স্টুডেন্টগুলোও হাসাহাসি তে মেতে উঠল। 
এই বলে ভদ্রলোক দম নিলেন। আমি অবশ্য তলেতলে গল্পটায় যেমন বিরক্ত বোধ করছিলাম তেমনি এসব বিষয়ে রাগ ও হচ্ছিল। 
ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন, " একদিন রুমমেট বাড়ি যাওয়ার পর ঘর ফাঁকা পেয়ে ছেলেটি আত্মহত্যা করে বসল। "
আমি অবাক! ডিপ্রেশন একজন মানুষ কে কোথায় টেনে নিয়ে যায় বুঝতে পারলাম। 
" তারপর? "
রুমমেট যখন ফিরে এলো। ততদিনে ছয়দিন কেটে গেছে। দড়িতে ছেলেটি তখনো ঝুলছিল। দরজা ভেঙে পুলিশ ঢুকল এবং ছেলেটিকে পাওয়া গেলো সিলিঙ ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়। মাসের মাঝামাঝি সময় আর শীতের দিন থাকায় গন্ধ বেশী ছড়ায় নি আর কেউ এসে দরজায় নক ও করেনি। কেবল সাথের ছেলেটি এসে প্রথমে এই অবস্থা দেখতে পায়। পুলিশ সিলগালা করে দেয় রুমটি। কিন্তু আগে ই বলেছি ব্যাচেলরদের জন্য বাড়িভাড়া পাওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। তাই অন্য ছেলেটি কন্সটেবল কে ঘুষ দিয়ে রুমের চাবিটা ম্যানেজ করে ফেলল। কিন্তু রাতে তার হলো অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সুইসাইড করা ঘর এমনিতে সাহস না থাকলে কেউ থাকতে চায় না যদি না ভূতে ভয় থাকে। তবে মাঝরাতে মৃদ্যু কান্নাজড়িত হাসি শুনে এবং টেবিল চেয়ারের অবিশ্বাস্য নড়াচড়া দেখতে পেয়ে ঐ ছেলেটি মাঝরাতে ই ছুটে বেড়িয়ে গেলো।
আমি মনে মনে ভাবছি এই রাতে আমাকে স্ট্যান্ডে একা পেয়ে ভূতের আজগুবি গল্প শোনানোর ইচ্ছে টা এই লোকটির ভাল ই ছিল তবে হিন্দী ভূতুরে মুভির মতন এই গল্পটিও আমার কাছে অখাদ্য ই লাগল। আমি উঠে পড়ছিলাম ঠিক তখনি সে বলল,
" এতে আসল অংশ টা শুনে নিন। ভাববেন না গল্পটি শেষ "
আমার অবশ্য উঠে পড়তে ইচ্ছে করছিল। এই গল্প এখন বিরক্তিকর লাগছে।
ডিসেম্বর ২২, পত্রিকার পাতায় একটা লেখা বেড়িয়ে এলো। লেখকের নাম জানা গেলো না তবে লেখাটি চমৎকার। একটি ছোট গল্প। পত্রিকা অফিসে এসেছিল আরো কয়েকশ লেখার মতন করে ই। কিন্তু লেখা পাওয়া যাচ্ছিল না বলে এই লেখাটি বিভাগীয় সম্পাদক তার অংশে ছাপিয়ে দেন। সাড়াও পেলেন। এই লেখকের নাম এবং একইসাথে লেখার আবদার এলো। তবে লেখাটির প্রেরকের কোন ঠিকানা থাকতো না। কৌতূহলী হয়ে বিভাগীয় সম্পাদক একবার সিলমোহর দেখে চিঠি জমা পড়া সে ডাকবিভাগের অফিসে গেলেন কিন্তু তারা ও সেখানে উপযুক্ত কোন তথ্য দিতে পারলেন না। তবে মজার ব্যাপার হলো এই লেখা মাসে কেবল একবার ই আসতো। পাঠকের যেমন অপেক্ষা বাড়তো তেমনিভাবে পত্রিকার সেই বিভাগীয় সম্পাদকের। তারা আর না পেরে এবার লেখকের নাম দিলেন, " গোস্ট রাইটার।"
আমি এবার মনে হলো মজা পেলাম তবে নিতান্ত গাঁজাখুরি গল্প হলেও বেশ মুখরোচক লাগছে।
সে বলতে লাগল, এখন সে গোস্ট রাইটারের নাম ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। বেশ কয়েকজন নামকরা প্রকাশন থেকে পত্রিকা অফিসে লোক এলো বই ছাপানোর অনুরোধ করে। কিন্তু গোস্ট রাইটারের ঠিকানা তো দূর! তার টিকিও খুঁজে পায়নি পত্রিকা অফিস। এর মাঝে কিছু উটকো লেখক নাম কামানোর ধান্ধায় নিজেদের " গোস্ট রাইটার " বলে পরিচয় দিতে শুরু করলো। পত্রিকার সম্পাদক পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। এত হাঙ্গামার মাঝে অদ্ভুত আরেকটি ঘটনা ঘটল, মাসে মাসে লেখা আসতো সেটিও মাস দুয়েকের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। যদিও তৃতীয় মাসে গোস্ট রাইটারের ছদ্মবেশে একটি লেখা সেই পত্রিকা অফিস ছেপেছিল তবুও পাঠকের চোখে ধূলো তারা দিতে পারল না। 
" এরপর? মানে গোস্ট রাইটার এসব জানতে পারেনি?" - প্রশ্নটা করলাম আমি
হ্যাঁ, এরপর ই ঘটনাটা ঘটল। বিভাগীয় সম্পাদক বেশ মোটা বকশিশের লোভ দেখিয়ে বেশ কয়েকজন ডাকপিয়ন কে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে এলাকা থেকে চিঠিগুলো আসতো ঠিক সে এলাকার ঠিক কোথায় সে চিঠিগুলো ড্রপ হয় দেখতে। পাওয়া ও গেলো। মাস ছয়েক পরে একটা চিঠি পাওয়া গেলো। তাতে সে লিখেছে গোস্ট রাইটার নামটি ওর পছন্দ হয়েছিল কিন্তু এতসব নকল গোস্ট রাইটারের প্রতাপে আর তার লেখার ইচ্ছে নেই। সে যা চেয়েছিল তা নাকি সে পেয়ে গেছে। বিভাগীয় সম্পাদক চিঠি নিয়ে ছুটলেন সেই এলাকায় ডাকপিয়ন যারা ছিল তাদের কাছে। পাওয়া গেলো সেই ডাকবাক্স আর বাড়ি তবে সে বাড়ির দোতলা এখন ফাঁকা কেউ থাকে না তবে নীচতলাতে একজন কে দেখা গেলো। তিনি গামছা পড়ে দাঁত মাজছিল। তাকে পেয়ে ই সে সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি লেখেন? মানে লেখালেখি করেন?
" না! লিখি না - আমি আঁকি, রিক্সার পেছনে "
সম্পাদকের মুখে তখন জয়ের হাসি সম্ভবত তিনি গোস্ট রাইটার কে পেয়ে গেছেন। লেখা ছাপানোর প্রাইজ মানি বের করে লোকটির হাতে দিয়ে তিনি বললেন এই নিন আপনার পাওয়া। টাকা হাতে পেয়ে ফেনাসুদ্ধ মুখে হেসে বলল, টাকা দিসেন ভাল হইসে কিন্তু আসলে ই আমি গোস্ট রাইটার না!
আপনি একা ই থাকেন? অন্য কেউ কি লেখে? 
ঐ লোক জানালো আরেকজন আছে সে অফিসে চাকরী করে তাকে কোনদিন সে লিখতে দেখেনি সে নিজেও। 
কিন্তু ভাই লেখাটা দেখা যায়?  যদি সাথে এনে থাকেন?
সম্পাদকের পকেটে পুরনো একটা সংখ্যা ছিল ভাঁজ করে রাখা, সেটা বের করে হাতে দিতে ই ঐ ভদ্রলোক চোখ বড়বড় করে বলল, " এইটা তো অসম্ভব! "
"মানে?"  বিভাগীয় সম্পাদক অবাক।
এইটা তো আমাদের উপরে যে আত্মহত্যা করছিল তার ই লেখা!
বিস্ময় সম্ভবত তখনো কাটেনি ঐ দুজনের।
হঠাৎ পেছন থেকে দোকানি আমাকে ডাক দিয়ে বলল, " ভাই! কার লগে কথা কন?"
আমি পাশ ফিরে দেখি সেখানে কেউ নেই।
বিস্ময়ভাব টা আমার যাচ্ছে না, দোকানি বলছে, " আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনারে ডাকতাছি ভাই। আপনি দেখি একলা একলা কথা কইতাছেন। আমি ভাই বাড়ি যামু দোকান বন্ধ করে ফেলছি আপনি মনে হয় খেয়াল করেন নাই!"
আমি হাতের ব্যাগ চেপে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বাসের আলো স্ট্যান্ডে এসে পড়েছে। দ্রুত বাসে উঠলাম। বাস সাথে সাথে ছেড়েও দিলো। অস্বস্তি হচ্ছিল। ব্যাগের সাইড চেইন খুলে পানির বোতল বের করতে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা কাগজ। তাতে লেখা, লেখাটি কোথাও যায়নি ছাপানোর জন্য। সুইসাইডের ঠিক আগের রাতে লেখা। পছন্দ হয়ে থাকলে ছাপিয়ে দেবেন।
" with love গোস্ট রাইটার। "

(সমাপ্ত)


(গল্পের সমগ্র চরিত্র এবং ঘটনা সম্পূর্ন কাল্পনিক এর সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। যদি মিলে থাকে তা একান্ত কাকতালীয়)  

বুধবার, ২৭ মে, ২০২০

অনুগল্পঃ শোধ

মে মাসের সকালবেলা।
একটি ফ্ল্যাটে ঢুকছিল একজন আগন্তুক। সিঁড়িটা ধরে উঠে গেলো বিল্ডিং এর তিন তলায়। বেল বাজালো একটানা কয়েকবার।
-তুমি! (বিস্ময়ান্বিত গলা, যেন আশা করেনি এমন)
দরজা খুলে ই মেয়েটি চোখ বড়বড় করে চাইল। বাইরে আপাদমস্তক কালো পোষাকে ঢাকা একজন পুরুষ। চেহারা দেখে আঁতকে উঠতে হয়। গালে আড়াআড়ি কাটা দাগ, চোখে মুখে রুক্ষতা।
কেমন আছো ইভা? (গলার স্বর যথেষ্ট নরম)
দরজা আগলে এখনো মেয়েটি দাঁড়িয়ে।
- কি চাও তুমি? প্রশ্ন করল সে।
- ভেতরে আসতে দেবে না?
কথোপকথনরত সময়ে সিঁড়িটা ধরে উপড়ে উঠছিলেন পাশের ফ্লাটের ভদ্রমহিলা। এদের দুজন কে ক্রস করতে করতে সন্দেহের চোখে তাকালেন তিনি। অবাক দৃষ্টি ফেললেন আগন্তুক আর ইভার দিকে।
ভদ্রমহিলা কে দেখে কিছুটা সম্ভিত ফিরে পেলো ইভা। ইভার স্বামী রোকন, হরহামেশা ই বাড়ি ফেরে। কিন্তু এভাবে ওদের দুজন কে দেখে যদি রোকন কে বলে দেয়। রোকন সেটা ভাল ভাববে না। অশান্তি হবে। তাই সামলে নিয়ে বলল,
-এসো! ভেতরে এসো! বাইরে দাঁড়িয়ে কথা কেন?
আগন্তুক মৃদ্যু হাসল, পেছনে ঘুরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে শুকনো হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানালো। ভদ্রমহিলাও একটু হেসে চলে গেলেন।
আগন্তুক ঘরে ঢুকল। অন্য সময় হলে ইভা ওকে সদর দরজার বাইরে থেকে ই তাড়িয়ে দিতো। আগন্তুক এদিকওদিক ঘুরে দেখতে লাগল।
ড্রয়িংরুম টা সাজানো উদ্যানের মতন। একদিন রঙিন ঝাড়বাতি, দেয়ালে পেইন্টিং, খাবার টেবিলে সাজানো খাবার। একেবারে যেমনটা দুজনে আগে ভাবতো। আগন্তুক বলল,
-কি সুন্দর সাজানো!
-কি চাও? (ইভার গলা পাল্টে গেল) রুদ্র, তুমি জানো আমি বিবাহিত তাই এমন সময়ে হুটহাট আমার বাসায় চলে আসা মোটেই পছন্দ নয় আমার। জানি আমাদের আগে সম্পর্ক ছিল এখন.. (কথা শেষ হলো না)
আগন্তুক ইভাকে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। কথার মাঝে ই আগন্তুক দ্রুত পায়ে ইভার বেডরুমে চলে এলো, বাহারি রঙিন পর্দা টানানো। দেয়ালে এসি টা হাওয়া দিচ্ছে। একটা টিভি চলছে। এই ঘরটা বেশ ঠান্ডা লাগলো।
ইভা দ্রুত এসেছে পিছুপিছু। চেঁচিয়ে বলল,
- থামো! কি চাও?
আগন্তুক হেসে নিলো সজোরে, রুমে ওর হাসি ফাটা কাঠের মতন প্রতিধ্বনিত হলো। এখানে তো আমাদের থাকার কথা ছিল ইভা! তাইনা!
আগন্তুক ইভার কাছাকাছি এগিয়ে এলো। ইভা ভয়ে পিছু হটল! ভয়ার্ত গলায় ইভা বলল,
-কি চাও তুমি?
আগন্তুক শান্ত গলায় উত্তর দিলো
-আমার আংটি!
ইভার কপাল ঘামছে,
-ওহ! সেটা আমি কোথায় রেখেছি মনে নেই!
-কিন্তু সেটা আমার প্রয়োজন। খুব দরকার!
-তাই নাকি? (ইভার গলায় বিদ্রুপের সুর) তো এবার কাকে দেবে শুনি?
-সেটা নিশ্চই তোমার জানার দরকার নেই!
-বলতে হবে না আর, আমি বুঝেছি কে সে!
-হ্যাঁ, ইরা আমাকে ভালোবাসে আর ও চায় আমার সে আংটিটা যেন আমি নিজের ওর হাতে পড়িয়ে দেই।
-আংটি নেই! চলে যাও।
প্লিজ! ইভা! আমার কথা শোনো। আমার খুব দরকার। এটা আমার পরিবারের শেষ চিহ্ন।
ইভা কপালের ঘাম মুছে নিলো। এসির বাটল চেপে অনেকটা বাড়িয়ে দিলো। শোন! তুমি এসো। আমার অনেক কাজ। যেকোন সময়ে রোকন কাজ থেকে ফিরে আসবে। আর সে জানে তোমার সাথে আমার আর দেখা হয় না। তুমিও নিশ্চই চাওনা যে আমাদের কোন সমস্যা হোক!
রুদ্র আক্রোশ চেপে ইভা কে ঠেলে দেয়ালে চেপে ধরলো! গলায় চাপ দিয়ে বলল, আংটি টা দাও! ভালোয় ভালোয়!
ইভা বিচলিত নয়, সে বলল, যদি চাও তাহলে আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে তবে ই কেবলমাত্র আংটি টা ফেরত পাবে।
রুদ্র রাগে ক্ষোভে ইভার গলায় আঙুলের চাপ বাড়িয়ে দিলো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল ইভার। কিন্তু কি মনে করে ই দ্রুত গলা ছেড়ে হনহন করে জুতার আওয়াজ তুলে স্বশব্দে দরজা বন্ধ করে বেড়িয়ে গেলো রুদ্র। ইভা হাফ ছেড়ে বাঁচল!
বিকেলের আগে আরেকবার ইভার ফ্ল্যাটে ফিরে এলো রুদ্র। খবরের কাগজের মোড়কে দশহাজার টাকা নিয়ে। আংটিটা ফেরত দিলো ইভা। মুখে বিদ্রুপ। শুধু জিজ্ঞেস করলো, " নতুন মেয়েটি ভবিষ্যৎ এ তোমাকে সুখী করতে পারবে তো?"
রুদ্র দরজা পর্যন্ত গিয়ে সামান্য থামল তারপর, পিছু ফিরে ঈর্ষান্বিত ইভার দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসল তারপর বলল, " স্টে ওয়েল ইভা! "

সন্ধ্যেবেলায় ইভার স্বামী রোকন ফিরল। বেল বাজতে ই লুকিং গ্লাসে দেখে এবার দরজা খুলল ইভা। হ্যাঁ রোকন ই সাথে আর কেউ নেই।
হ্যালো বিউটিফুল! রোকন হাসিমুখে অভিবাদন জানালো ইভাকে।
হাতে ফুলের বাকেট, সেটা ইভা কে দিয়ে জুতোর ফিতে ফিতে খুলতে খুলতে বলল, " রুদ্র এসেছিলো নাকি?"
ইভার গলা ভয়ে ধরে এলো। ও! অ্যাঁ! হ্যাঁ! তুমি জানলে কি করে? (ধরা পড়ে যাওয়া ইতস্তত ভাব ইভার, যেন অন্যায় ধরতে পেরেছে রোকন)
নাহ! ও কি টাকা দিয়ে গেছে?
ইভার শঙ্কা বাড়ছে। ইতস্ততভাবে জানতে চাইল,  টাকা? কিসের টাকা?
হ্যাঁ, রুদ্র আজ আমার অফিসে এসেছিলো। বলল জরুরি একটা কাজ, না হলেই নয়। তো, আমি জানতে চাইলাম কাজটা কি? সে নিয়ে কিছু বলল না তবে, দশ হাজার টাকা চাইল। আর বলল  কাজ হয়ে গেলে ই বিকেলের আগে আমার বাসায় এসে তোমার হাতে তুলে দিয়ে যাবে পুরো টাকাটা।
আচ্ছা, দিয়েছে কি?
রুদ্র এত্ত বড় চালাকি করে গেলো! মনে মনে ভেবে ই - ইভা স্তম্ভিত হয়ে সোফায় বসে পড়ল।


(একটি বিদেশি গল্পের আদলে) 

শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

ছোটগল্পঃ গুজব

ভারী সুটকেস টেনে হিঁচড়ে লোকাল বাসের সিঁড়ি ধরে আধেক উঠিয়ে ফেলেছে যুবক। বিকেলের দিকে এদিকে জ্যাম কম। শহরের বুকে রৌদ এখনো তার রাজত্ব পুরোপুরি কায়েম করতে পারেনি। শীতের একটা হালকা আমেজ রয়ে গেছে।
ওই মিয়াঁ! নামান এইটা! এত্ত ভারী মাল রাখবেন কই?
(গলা খাঁকড়ি দেয় বাসের হেল্পার)
সাবধান!!  হাত দিবেন না ব্যাগে। যুবক চঞ্চল, তড়িঘড়ি করে ব্যাগ একটা সাইডে টেনে বসে গেলো বাম দিকের সারিতে একটা ফাঁকা সিটে।
পাশে বসা আরেকজন মাঝবয়েসী লোকের সাথে হালকা চোখাচোখি হলো তার। বাসে ভীড় কম তবে, প্রতিটি সিটে ই লোক বসা। অন্য সময় হলে এত্ত ভারী সুটকেস হয়তোবা বাসে উঠাতে ই দিতো না হেল্পার।
রাস্তা ফাঁকা থাকায় সিগন্যালে আটকাতে হলো না। অপেক্ষাকৃত দ্রুত সময়ে যে যার মতন নেমে গেলেন বাস থেকে।
কৌতূহল কিন্তু থেকে গেলো বাকী যাত্রীদের মাঝে। অনেকে পেছনে বসে বারবার ব্যাগের দিকে খেয়াল করছিলেন সেইসাথে যুবকের দিকে। গুজবের শহর ঢাকা। এই ব্যাগে অনেককিছু থাকতে পারে। সন্দেহ দানা বাঁধায় পেছনে বসা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণ তার স্যোশাল একাউন্ট থেকে আড়ালে ব্যাগসহ ঐ অচেনা যুবকের ছবি তুলে শেয়ার করে দিল এই বলে, গতিবিধি সন্দেহজনক! লোকেশন...
মুহূর্তে লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারে ভরে গেলো তরুণের স্যোশাল কমেন্ট বক্স।
কেউ বলছে ধরেন ভাই! বাইন্ধা রাখেন!
অন্যজন বলছে, ভাই! লোকশন টা ভাল করেন বলেন। আমরা কাছাকাছি আছি!
বইমেলা চলছে শহরের বুকে, আজ ফেব্রুয়ারি!
ভাষায় দিবস। যে ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল সালামা, বরকত,  জব্বার! সেই বাংলা তে গালী ও দিলেন অনেকে।
যুবক কে নিয়ে বাস অনেকদূর চলে এসেছে। বাস বেশীদূর হয়ত যাবে না। কারণ, পথে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বইমেলা চলছে। চুলচেরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
জনৈক যুবক কে নামতে দেয়া হলো না। তাকে ধরা হলো কলার খামচে। কেউ একজন বেশ রুঢ় গলায় বলল, " শালা! ব্যাগে কি আছে? খুইল্ল্যা ক' নাইলে আইজকা তুই শ্যাষ!"
লোকেশন পেয়ে আরো লোক এসেছে।
ভীড় জমে গেলো। কেউ একজন অতিউৎসাহী হয়ে ঘুষি মেরে বসলো যুবকের মাথায়। এরপর কিল, ঘুষি চলল কিছুক্ষণ! যুবকের শরীর হ্যাংলা। সামান্য মারে ই সে অনেকটা অচেতন হয়ে পড়ল।
পাশ দিয়ে বাজার করে ফেরা কয়েকজন নারী ফিরছিলেন। তারা পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকা কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করতে তারা বললেন, আপা পকেটমার!! পকেটমার!!
হেল্পার সমিতি তে সম্প্রীতি যোগ দেয়া একজন পাতি নেতা মোটা স্টিল হাতে ছুটে এলো বাহাদুরি দেখাতে। আসার সময় একজন সাগ্রেদ কে বলল, "পিটাইতাছি এইটা ফেইস টু ফেইস আসা চাই! নাইলে নেতা চিনবো না, ভাল কইরা ভিডিও করবি! "
স্টিলের ঘা একটা ও পড়ল না, যুবকের কপাল ভাল বললে হয়ত ভুল হবে কিন্তু এই মুহুর্তে এটা না বলে থাকা গেলো না। পুলিশ এসেছে। ওয়ারলেসে খবর যেতে ই পুলিশ চলে আসে দলবলে। উদ্ধার হলো যুবক। তার ব্যাগ ও পাওয়া গেলো।
যুবক অজ্ঞান।
তাকে তুলে নিকটবর্তী পুলিশ ফাঁড়ি তে নেয়া হলো। রাস্তা ফাঁকা করতে উদ্যোগ নিলো ট্রাফিক পুলিশ।
জ্ঞান ফিরলো। তাকে জুস খেতে দিয়েছেন পুলিশের এরিয়া ইনচার্জ। " এভ্রিথিং আন্ডার কন্ট্রোল, ইয়েস স্যার " ওয়ালেসে খবর গেলো। পুলিশের এক্সপ্লোসিভ ইউনিট থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসেছে তারা ব্যাগ স্ক্যান করছে। নাথিং ফাউন্ড স্যার! একজন স্যালুট ঠুকে জানিয়ে গেলো।
যুবকের নাকে মুখে রক্ত, কপাল ফেটে গেছে। স্থানীয় একজন ডাক্তার কে ফাঁড়িতে আনা হয়েছে তিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন।
ওসি এবার প্রশ্ন করলেন, আপনার ব্যাগে কি?
যুবক চেয়ার ছেড়ে কোনরকমে উঠে ব্যাগের তালা খুলল, চেইন খুলতে যাবে এসময় আশেপাশে সবাই নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলো।
কিন্তু ব্যাগ খোলার পর ই সবার মুখ " হা " হয়ে গেলো।
ওসি স্বাভাবিক হয়ে বললেন, একি! এতো বই! বই নিয়ে?
যুবকের উত্তর, বইমেলাতে যাচ্ছিলাম। সস্তায় যদি বিক্রি করা যায়। অনেক বই জমেছিল ঘরে। ভাবছিলাম বিক্রি করে পকেটে পয়সার টানাটানি টা আয়ত্ত্বে আনবো খানিকটা, সে আর হলো কই? আপনারা সামান্য গুজবে আমাকে তো আজ মেরে ই ফেলছিলেন।
টিভি তে যুবক তখন লাইভে। ব্যাগে নাকি বোমা পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক দলের পাল্টাপাল্টি কথা চালাচালি, দোষারোপ চলছে তখনো।
ঐদিন রাতে, শহরের কোন এক ফ্ল্যাট বাসায়। স্কুল এবং ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া দুই বোনের আলাপ হচ্ছে।
আপা!  আপা!! দ্যাখ! যে ছেলেটা আজ ব্যাগ নিয়ে মার খেয়েছে ওর প্রোফাইল ঘেটে ছবি দেখলাম, জানিস কি কিউট!!
লোকগুলো কি ভাবে মেরেছে দেখেছিস! দাঁড়া হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে বিচার চাই। ছেলেটার নাম কি রে?


(সমাপ্ত)

শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

ছোটগল্পঃ লাশ

(১)
কেউ এদিকে খুব একটা আসে না। দুইটি বহুতল বিল্ডিং এর মাঝে সরু গলি। এখানে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলতে আসে মহল্লার কিছু বাচ্চাকাচ্চা।
তাই প্রথমে বোটকা গন্ধ টা কেউ টের পায়নি। বারেকের ছোট ছেলেটা ভোঁ.. শব্দ তুলে ঢুকে গেছিলো এই সরু গলিতে। পলিথিনে মোড়ানো একটা উঁচু মতন ঢিবির উপর পা ফসকে পড়ে যেতে ই পলিথিন আংশিক খুলে বিকৃত লাশের মুখটা বেড়িয়ে পড়ে আর তখনি ভয়ার্ত চিৎকার!
লোকজন জমে গেলো। যেখানে কেউ কোনদিন আসে নি আজ সেখানে লোকের পায়ে পা ফেলে চলতে হচ্ছে।
পুলিশ এলো। লাশ দড়ি বেঁধে বের করা হলো টেনে হিঁচড়ে। একজন পূর্ণবয়স্ক লোক সে গলিতে যেতে হিমশিম খায়। পুলিশকে সাহায্য করলো কয়েকজন সাহসী ছেলে। ওরা ই লাশের পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে বের করে আনলো ধীরেধীরে।
মহিলার লাশ। মুখ ভারী কিছু দিয়ে থেতলে দেয়া হয়েছে। দেখে মনে হয় কমপক্ষে দশ দিন এভাবে পড়েছিল কিন্তু সেটা আনুমানিকভাবে পুলিশের ধারণা।
লাশ নেয়া হলো ময়নাতদন্ত করতে সরকারি হাসপাতালে।


(২)
দেখ! মুখের ভেতরে কি একটা যেন?
সদ্য থার্ড ইয়ারে উঠা মেডিকেলে দুই স্টুডেন্ট একে অপরকে ফিসফিস করে কানাকানি করতে দেখা গেলো।
সাইলেন্স!! ধমক দিলেন ফরেনসিকের প্রভাষক মোক্তার। তারপর বললেন, " আজ আমরা যে লাশ পেয়েছি তা ডিকম্পোজড। মানে পঁচনে অনেকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে লাশের চেহারা।
অপু একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়ে কথা বলল, " স্যার, আমরা তো ডি এন এ টেস্ট করতে পারি "
তা পারি, কিন্তু এক্ষেত্রে অনুমোদন দরকার। পুলিশ চাইলে হাসপাতাল অবশ্যই করবে। যদি খুনের মোটিভ প্রমাণে অপরাধী সনাক্তকরণ দরকার হয়। এখন লেকচারে মন দাও।
স্যার তার ক্লাস শুরু করলেন। লাশের ভারী পঁচা গন্ধে দুজন শিক্ষার্থী বাইরে চলে গেলো। তাদের ভীষণ বমি পেয়েছে। ওরা হয়ত ক্লাসে নাও ফিরতে পারে।

(৩)
লোকাল বাসে ভীরে মোমেনার বাম হাত টা শক্ত করে চেপে ধরেছে পরিচিত বড় ভাই ছোটকু। একই গার্মেন্টস এ ছোটকু হেল্পার। মোমেনা তার ই আন্ডারে সেলাই কাজ করে। মোমেনা দেখতে সুন্দরি নয় কিন্তু চোখদুটো টানা হরিণের মতন। ছোটকুর সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ। সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে আলাপের গভীরতা বেড়ে যায় অনেকদূর। ফোনের আলাপ, অতিরিক্ত সখ্যতা সবার আড়ালে জল ঘোলা করে ফেলে যা ঘুণাক্ষরে গার্মেন্টস এর কেউ জানতে পারেনি।
মোমেনা গরীবের মেয়ে। বড় মেয়ে, বিয়ে হয়নি। সংসারে হাল ধরার কেউ ছিল না। বোনের পড়াশোনা খরচ, বাড়ির কর্য এসব তো মুখেমুখে চুকিয়ে দেয়া যায় না। চাই টাকা! সেই টাকার খোঁজে শহরের চাকরি। সেও এলাকায় এক বড় আপা বলে কয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন এই গার্মেন্টস এ। গ্রামের মেয়ে শহরে বাতাস গায়েও লাগেনি কিন্তু হাসিমুখ আর আশ্রয়ের অসামান্য প্রত্যাশায় কাঙালি হয়ে ছোটকুর হাতে হাত রাখতে, ওর চাহিদায় " হ্যাঁ " বলতে মেয়েটি সময় নেয় নি।
ছোটকু ভাই! আমরা কই যাইতাছি?
সবুর কর মোমেনা। আমার বাসায় যাবি। আমি তোরে আইজ বিয়া করলাম না কাজি অফিস গিয়া।
মোমেনা ভীরের মাঝেও মুখে উড়না টেনে একটু হাসে। এটাই মোমেনার শেষ হাসি। এরপর মোমেনা কে ছোটকুর সামনে আর হাসতে দেখেনি কেউ।


(৪)
স্যার! লাশের আগামাথা তো ডাক্তারি পরীক্ষায় কিছু বোঝা গেলো না। কথাটা বলল থানার হাবিলদার।
স্যার স্মার্টফোনে ব্যস্ত। কোথায় যেন প্রটোকল সংক্রান্ত কাজে যেতে মেসেজ এসেছে।
কিসের লাশ! মুখ না ফিরিয়ে ই জানতে চাইলেন তিনি।
ঐ যে বিল্ডিং এর চিপার লাশ টা স্যার!
ওহ! সেইটার খবর কি? নাম ধাম কিছু জানা গেলো নাকি?
না স্যার। তবে রেইপ কেইস!
এবার ওসি তাকালেন। রেইপ!! আবার সাংবাদিক!!  হাউকাউ!! এই *ল রেগুলার ই আইজকাল। শোন, এক কাজ করো। ডিটেইলস নিয়া রাখো। কেউ লাশ দেখতে আসলে হাসপাতাল মর্গে পাঠাই দিও। বেশী দেরী করা যাইবো না। সাংবাদিক *য়োর গুলা জানতে পারলে সমস্যা। দাফন কইরা দিও। দায়িত্ব কিন্তু তোমারে দিলাম পুরাটা। মতিন রে দিলে প্রমোশন কিন্তু ওর হইবো। তুমি আমার দেশী মানুষ তাই কাজ তোমারে দিলাম। তোমারে নিয়ে পত্রিকায় ছবিও আসতে পারে যদি কাজ ভাল করো।
জ্বে স্যার আপনার দয়া।
আমি চললাম এম পির বাড়ি কাজ আছে।

(৫)
লাশের ময়নাতদন্ত চলছে। ডোমের চোখে নেশার আগুন। লাশ কাটা চাট্টেখানি কাজ না। একটা মানুষ কে গরুর চামড়া ছাড়ানোর মতন ছিলতে হয় দয়ামায়াহীন ভাবে। যে মানুষ টি কিছুক্ষণ আগেও চলে ফিরেছে। হেসেছিল, কেঁদেছিল!
মাইয়ার লাশ!
সদ্য ডোমে যোগ দেয়া নুরুর চোখ চকচক করে উঠে। ভেটেরান সাথী বৃদ্ধ আব্দুলের কোন হুশ নেই। লাশের পোষাক খুলে ফেলেছে সে। হাতের ধারালো হাতুড়ি আর বাটালের দৃঢ় ঠকঠক শব্দ শোনা যেতে লাগল ময়নাতদন্ত ঘরের নীরবতা ভেদ করে। ময়নাতদন্ত শুরু।

(৬)
কলিং বেল, সেগুন কাঠের দরজা।
আয়!  পাগলি ভেতরে আয়। ভেতরে ঢুকেই মোমেনার চোখ ছানাবড়া। এত বড় বাড়িতে ছোটকু থাকে! কই কোনদিন তো ওকে ভুলেও বলেনি।
একটা মখমলের গদিতে বসতে বলে ছোটকু কোল্ড ড্রিংকস আনতে চলে গেলো অন্য একটা ঘরে।
ঘরটা ঠান্ডা। ভেতরে ফ্যান নেই। প্রচণ্ড রোদে শরীরটা ঘেমে উঠেছিল মোমেনার। মাথায়, গায়ে উড়না টেনে নিলো দ্রুত। এত বড়, দামী ফ্ল্যাটে বেশ বেখাপ্পা লাগছে এই পোষাকে। সংযত হবার জন্য তাই সামান্য প্রচেষ্টা।
ছোটকু ফিরে এলো কাঁচের একটা গ্লাসে কোক ঢেলে। এটা অনেকবার ই ছোটকুর সাথে খেয়েছে মোমেনা। ওর পার্কে ঘুরতে যেতো ছুটির দিনে। মোমেনা হাসিমুখে গ্লাস নেই।
ছোটকু বলে, আরে! দেরী করিস না! নে খা! জলদি খা।
মোমেনা ইতস্ততভাবে মুখে দেয় কোক। মিনিট পাঁচ পরে আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরলে মোমেনা বুঝতে পারে। কোনকিছু আর স্বাভাবিক নেই এখানে। ঘরে অন্ততপক্ষে পাঁচজন লোক। সিগারেট আর মদের বোতন দেখা যাচ্ছে ঘোলা চোখে।
মোমেনা উঠতে না উঠতে আরেকজন ওর উপর চড়ে বসে। মোমেনার চিৎকার করে উঠে!
ছোটকু ছুটে আসে, এই চোপ শালী!! কথা কইবি না!!
মোমেনা হাত পা ছোঁড়ে।
ছোটকু মোমেনার হাত চেপে ধরে।
ছোটকু সুন্দরবনের আগ্রাসী বাঘ। একটিমাত্র হরিণ তার ক্ষুধা মেটাতে পারেনি কোনদিন আর পারবেও না।

(৭)
লাশের শরীর থেকে অধিকাংশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রেখে দেয়া হলো মেডিকেলের এনাটমি ক্লাসের কথা মাথায় রেখে। বেওয়ারিশ লাশ! পুলিশ তুলে দিলো হাসপাতালের মর্গে। পড়াশোনার খাতিরে ঢুকে গেলো মোমেনা। সুন্দর হাসিমাখা মুখখানায় এখন মাংসটুকু নেই, বেড়িয়ে আছে ভয়ংকর দু-পাটি দাঁত, নাকের জায়গায় সরু গর্ত। ব্রেইনের অংশ পুরোপুরিভাবে ফাঁকা যেন একটি মগ বসানো হয়েছে মোমেনার মাথার উপর। শরীর শুকিয়ে কালশিটে হয়ে গেছে।
এইটা ক্লাসে দিয়া লাভ নাই! বুঝলি!
ক্যান?
রাইতে এনাটমি ল্যাবে আইসা নিয়া যামু, হাড্ডি গুলান ভাল। কোন ডিফেক্ট নাই। পুরা সেট জানুয়ারি তে বেঁচা যাইবো।
পুলিশ যদি ফিরা আসে।
ধূর *ল!! আইবো না। বুঝলি আমি কি কইলাম?
আইচ্ছা।

(৮)
মোমেনার খোঁজে আর কেউ আসে না। ওর বোন টা কোন এক বিবাহিত পুরুষের হাতে হাত রেখে পালিয়ে গেছে। মোমেনার মা এখন পাগল।
মাঝেমাঝে গ্রামের দুয়ারে তাকে থলি হাতে দেয়া যায়। কেউ খেতে দিলে সে খায় নয়তো ধূলোয় মাখামাখি করে পড়ে থাকে।
হুশ ফিরলে " মোমেনা!! আমেনা!!  তোরা কই গেলি বলে ডাকতে থাকে।
গার্মেন্টস এ নতুন লোক আসে মোমেনার জায়গায়। তার নাম শেফালি। নাক বেশ লম্বা তবে কথা বেশী বলে। হেল্পার ছোটকুর মনে ধরেছে এই মেয়েটিকে। আগামীকাল ওর সাথে আইসক্রিম খাবার কথা হয়েছে।


(সমাপ্ত)


(এই গল্পের সমস্ত চরিত্র, ঘটনা, সময় কাল্পনিক। এর সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই, উল্লেখিত সমস্ত কথোপকথন কাল্পনিক এবং নিছক গল্পের খাতিরে লেখা)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...