বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

গল্পঃ বাবাজীর পাল্লায়


(এক)
যখন আমি নিরুদ্দেশ হতে চাই, ঠিক তখনি আমার ফোন বন্ধ করে রাখি। এতে দুটো সুবিধে হয়। এক. অকারণে কোন ফোন এটেন্ড করতে হয় না এবং দুই. উটকো আবদার আসে না।
অনেকদিন থেকে ই ভাবছিলাম কোথায় যাবো! সত্যি বলতে গ্রামে যেতে আমার বড্ড মন টানে। গ্রামের ছেলে আমি, আজ ঠিক এখন হয়ত আর বয়েসের বেড়াজালে ছেলে বয়েসে আটকে নই তবুও মনের ছেলেমি টা এখনো কাটেনি। জোর করেই সেটা প্রকাশ পায় যখন একটু সময় পেলে বিকেলে বেড়িবাঁধের দিকটায় যাই।
আসলে ঢাকায় চলাফেরা, আসাযাওয়া বলতে কেবল হাতিলঝিল আর ঐ বেড়িবাঁধ। এর বাইরে খুব যেতে ইচ্ছে হয় এমন জায়গা নেই। তাই গ্রামের পথে আমার হুটহাট বেড়িয়ে পড়া। অবশ্য এমন ভাবার কারণ নেই যে, একেবারে অচেনা জায়গায় না জেনে রওনা করি। আমার বন্ধুভাগ্য বরাবরি ভালো, সে বয়েসে ছোট কিংবা বড়!
তাদের চেনাপরিচিত গ্রাম, শহর, বাড়ি, লোকজন এসব না জেনে আমি কিন্তু বেড়িয়ে পড়ি না।  বড্ড বাজে বকি আমি!
আজ যাচ্ছি সৈয়দপুর।
আমার চেনা নয়। আমার পরিচিত এক লেখকের শশুরবাড়ি। আমাকে রেকমেন্ড করতে চাইছিলেন তার শশুরবাড়ি থাকতে কিন্তু আমি ই রাজী হলাম না। ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি হলে ভাবা যেত, একে তিনি ই সে বাড়ির জামাই তারপরে আমার যাওয়া টা খুব ভাল দেখাতো না। তবে ভদ্রলোকের শ্যালক জাহাঙ্গীর আমাকে সেখানে সাহায্য করতে রাজী, এমনকি সৈয়দপুরের কয়েকটা গ্রামে ঘুরে বেড়াতে সে তার নিজস্ব বাইকে আমাকে নিয়েও যাবে। আমার এতে ই ষোলআনা পূর্ণ।
ঢাকায় আজ ৩৯ ডিগ্রী, বাতাসের আর্দ্রতা এত্ত বেশী যে শরীরের গেঞ্জি থেকে পাঞ্জাবি ভিজে সপসপ করছে। ডান পকেটে থেকে রুমাল টা বের করে কপাল, ঘাড় মুছে নিলাম। বোতল খুলে পানি খেলাম ঢকঢক করে।
আহ! এই গরমে বেঁচে থাকা অসহ্য।
ট্রেন এখনো ছাড়েনি। লোক উঠছে। আমার পাশে এদিকওদিক লোকের গলার আওয়াজে গমগম করছে।
বাইরে হকারের চিৎকার, চা গ্রম লাগবো চা? ফানি.. ফানি.ফানির বোতল! ১০ ট্যাকা ১০ ট্যাকা!
আমি হকারকে ডেকে এক প্যাক সিগারেট নিলাম, সাথে একটা মশলার কৌটো। এই পান মশলা খাওয়া টা আজকাল বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারপর জানালা বরাবর হেলান দিয়ে পত্রিকা মুখের সামনে তুলে সেটায় মনোযোগী হলাম।
লোকজন ট্রেনে উঠবার সাথে সাথে গরম টাও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।


(দুই)

ট্রেন ছাড়ল আরো আধাঘণ্টা পর। ঘেমে যাওয়া শরীর চামড়ার টান ধরিয়ে শুকিয়ে যেতে লাগল জানলা দিয়ে আসা বাতাসে। পত্রিকা ব্যাগে পুরে বোতল বের করে পানি খাবো ঠিক তখনি চোখ গেল পাশের সিটে।
রে ব্বাব্বা!
এমন আওয়াজ আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে পড়ার কারণ যথেষ্ট আছে। মাথায় পাগড়ী, চুলে জটা, পরণে লাল কাপড়। সাধুর সাথে ট্রাভেল? হাহা..
মৃদ্যু হাসি দিতে না দিতেই পাগলের সাথে আমার চোখাচোখি। চোখ ভালোরকম লাল, ভাবলাম কড়া গঞ্জিকা সেবনের ফল। আমি মুচকি হাসছিলাম।
হঠাৎ দেখলাম,
লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে বড়বড় করে। তাকে দেখে যে আমি হেসেছি এটা মনে হয় সে বুঝে গেছে। তর্জনী আমার দিকে সোজা কোরে তুলে কয়েকবার এদিকওদিক নাড়িয়ে বোঝাল আমি যাতে না হাসি। অবশ্য আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে উপর-নিচে, ডানে-বামে তাকিয়ে দেখলাম আমার এই কামরায় কেবল আমরা দুজন! আর তর্জনী আমাকে ই দেখানো হয়েছে।
আমি স্বাভাবিক ভাবে বসে আগের মত পড়ে রইলাম। একবার ভাবলাম, "চোর-টোর না তো?, এমনভাবে ট্রেনে ডাকাত ও হতে পারে। পরে নিজেই মনে মনে হাসলাম আমারো তেলেসমাতি ভাবনা। " আমি পড়ে রইলাম আমার মত। কোথাকার কোন পাগল এসে জুটেছে আমার সহযাত্রী হয়ে।

(তিন)

ট্রেন টা ধাতব ক্যাঁচক্যাঁচে শব্দে থেমেছে কোন স্টেশনে। আমি চমকে উঠেছিলাম তবে কনুই দিয়ে আবার চোখ ঢেকে ফের শুয়ে যাচ্ছি, চমকে গেলাম হইহই শব্দে। অনেক লোকের হট্টগোলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনি শব্দ হলো। আমার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ই ছিল পাশের সিটে চোখ রাখা। সেটাই করলাম ভাবলাম পাগল আবার ডাকাতি করে পালালো নাকি?
আমার অমন চাহনি দেখে পাগল ভ্রু কুঁচকে চাইল আমার দিকে। সে এখন জোড়াসনে বসে। মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। দেখে মনে হয় ধ্যানে বসেছে। পাগলের সাথে অস্ত্র? এবার মনে সন্দেহ জাগল।
পাগল এই প্রথম মুচকি হাসল আমার দিকে চেয়ে। আমি কামরা থেকে বেড়িয়ে পড়ব ভাবছি ঠিক তখনি কামরার দরজা ঠেলে একপাল লোক ঢুকল। কেউ করজোড়ে, কেউ কাঁদোকাঁদো গলায় " বাবা.. বাবা.. " বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমিও এই আদিখ্যেতা দেখে বলিহারি যাই! বাবারে?  কোন জন্মের বাবা এ তোদের? আসল বাবাও (জন্মদাতা) এমন ভালবাসা পায় কিনা সন্দেহ! (কথাটা অবশ্য মনে মনে, এই কথা মুখে বলে পিঠের ছালচামড়া আলাদা করার সময় এখন না)
তবে একটা কথা!
আমিও কিন্তু বাবা ভক্ত তবে এমন অন্ধভক্ত নই। একসময় যখন আমার লেখা কোন কাগজে ছাপানো হতো না, তখন আমার এক সমবয়সী বন্ধুর অনুরোধে গিয়েছিলাম এক বাবার কাছে। সেও প্রায় একইধরনের ছিল। আমার হাতে একটা বাতাসা ধরিয়ে বলেছিলেন " নে খা "। হাত খুলে দেখি সেটা পিঁপড়ে খাওয়া এক বাতাসা, কিছুটা হলদে হয়ে গেছে। নির্ঘাত ফুড পয়জনিং হয়ে যাবে খেলে!
তবুও বন্ধু আর আধ্যাত্মিক বাবার ভয়ে মুখে পুড়েছিলাম। এখন সেটা অতীত।
আমার নাম রীতিমত কাগুজে পাড়ায় ভাল লেখক পদবীসহ জুটে যায় তার ই দিন পনেরো পর। তবে এরপর আর সে বাবার কাছে যাইনি। আজকালকার বাবাদের যে কেচ্ছা কাহিনী দেখি টিভি আর পত্রিকায় তাতে বাবাজী সমাজের প্রতি আর শ্রদ্ধা থাকে না বলা চলে। বিশেষত, সত্যজিৎ রায়ের " মহাপুরুষ " টা দেখলে বুজরুকি টা কিছুটা ধরা যায়। আমরাও এমনি। তাবৎ কোন কাজ নিজে করতে না পারলে বাবার কাছে যাই, পায়ে পড়ি। যদি কোনভাবে দৈববলে কাজ হয়ে যায় তাহলে তো বাবাজীর কেল্লাফতে! ভক্তের আদরে ফুলো বেলুন। যাই হোক, আমি কিন্তু নাস্তিক নই। ধর্মে বিশ্বাস আছে। তবে বাবাজীদের ব্যাপার টা বরঞ্চ আলাদা।
লোকের ভীড় কমেছে এতক্ষণে। ট্রেন ছাড়ার শব্দে লোক নেমে গেছে। যে দুই একজন আছে এরাও ঝটপট বাবাজীর পায়ের ধূলো নিয়ে দ্রুত নেমে গেল। কয়েকজন যারা নামছিল না তাদের টিকিটচেকার ঘেঁটি ধরে নামিয়ে দিল। এরা কিভাবে যেন জানতে পেয়েছে এই মহান বাবা এই ট্রেনে ই যাচ্ছে তখনি দেখা করার সুযোগ না পেয়ে তখন হইচই বাঁধিয়েছিল। ট্রেন এখন শান্ত। তবে খেয়াল করলাম, ট্রেনের বাবাজীর পা চকচকে পরিস্কার। বুঝলাম, সব ধূলো ভক্তরা সাথে নিয়ে স্টেশনে নেম গেছে।

(চার)
আমাদের ট্রেন টা ভালো ই ছুটেছে মৃদ্যুমন্দ গতিতে। কতক্ষণ আর শুয়ে কাটানো যায়। লম্বা ভ্রমণে এই একটা সমস্যা। বিলেতে বুলেট ট্রেনের কথা মনে পড়ল। আহা! কত সময় ই বা লাগত! কবে হবে বুলেট ট্রেন ভাবতে ভাবতে সিগারেট জ্বালাচ্ছি। তখনি বাবাজী পাগলা বেঁকে বসল, তাও রীতিমত তুই তোকারি করে।
" বিড়ি জ্বালাবি না "
আমিও তখন রেগে, মামাবাড়ির আবদার নাকি?
পাগল আমার দিকে আবার তর্জনী দেখিয়ে হিন্দী মুভির ভিলেন চেহারায়।
আমিও তেড়েফুঁড়ে গেছি!
কামরায় ঢুঁকল টিকিটচেকার। আমি চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে লাগলাম। চেকার আমার টিকিট চেক করল। তারপর পাগলের দিকে ফিরে ফিরে তার টিকিটখানাও দেখে চলে গেল। চেকিং করতে করতে আমার বিড়ি খাওয়া প্রায় শেষ। ফিল্টার ফেলে বোতল থেকে পানি খেয়ে ফের পত্রিকা হাতে নিলাম, আর আড়চোখে পাগলের দিকে দেখতে লাগলাম।
পাগল দুধ-মুড়ি খাচ্ছে, পাঁকা আম দিয়ে। কয়েকটা মুড়ি আবার আটকে গেছে তার মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফে।

(পাঁচ)
আমার ফোন বন্ধ। কি মনে হতেই সেটা অন করে বসলাম। দু-চারটে মেসেজ এসেছে।
বন্ধু তুই কই?
কয়েকটা মিসড কল এলার্ট। কলের সংখ্যা কম নয়। ত্রিশের বেশী। মেসেজ ও কম সে কম বিশ টা।
তবে সবকয়টা তে একই কথা। তুই কোন ট্রেনে?  কোথায় দাদা? সুস্থ আছিস?
ফোন বন্ধ কেন করিস?
আমার বন্ধু, প্রেস অফিসের কলিগ, কর্মচারী সবাই বেশ আতঙ্কিত!
পাগল এখন হাসছে। এই প্রথম পাগলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এক পা সিটের নীচে, আরেক পা হাঁটু ভাজ করে কোলের কাছে। দুহাতে তালি দিচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পাগলের গলায় থাকা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতের আংটি সবকিছুতে আমি কেমন যেন ঝঙ্কার ধ্বনি পাচ্ছি। তবে হাসি থামিয়ে সে যা বলল তাতে আমি আরো অবাক হলাম।
" যাবি, যাবি আমার সাথে?"
আমি আরো অবাক, একদিকে এইসব মেসেজের মানে তখনো মাথায় ঢুকছে না তারপরে আবার পাগলের পাগলামি!
সহ্য হল না। কড়া গলায় বললাম, " কই যাবো রে পাগলু?"
পাগল মনে হয় এতে খুশী হলো না। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, " থেকে যাবি ট্রেনে? তাহলে থাক! আমি নেমে যাচ্ছি। "
আমি আরো অবাক, ঘন্টায় প্রায় ৮০ কিঃমিঃ গতিতে ছুটছে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক্সপ্রেস ট্রেন। এখান থেকে পাগল কি এখন লাফ দেবে?
ফোন টা হাতে বেজে উঠল। পাগল তার ঝোলা, জিনিসপত্র গোটাচ্ছে। সম্ভবত পাগল সত্যি সত্যি ট্রেন থেকে নেমে যাবে।
আমি ফোন রিসিভ করলাম। আমার পরিচিত সেই লেখক ফোনের অন্যপাশে।
দাদা! আপনি কোথায়?
আমি তো..! (পাগল তার নিজের তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে আমাকে কথা না বলার নির্দেশ দিল) তাই আমি কোথায় আর বলা হলো না।
অন্যপ্রান্তে সে ভদ্রলোক বললেন, কপাল ভাল!  আপনি বেঁচে আছেন। আপনার সে ট্রেন টা তো দুপুরে এক্সিডেন্ট করেছে। শ' এর উপরে লোক আহত। নিহত কতজন এখনো জানা যায় নি।
আমি পরে ফোন করছি বলে ফোন কাটলাম। নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। ট্রেনও চলছে। তাহলে কোনটা সত্যি? ফোন কল টাও তো ভুল না। দিব্যি কথা বলছি। সব বাস্তব, তাহলে হচ্ছে টা কি!
পাগল এবার কথা বললেন, " নেমে যাবি আমার সাথে, তাহলে বেঁচে যাবি "
ঘোরে ছিলাম।
হ্যাঁ বলতে না বলতে পাগল আমার হাত ধরল। হাত টা ভীষণ শক্তিশালী। এমন হাত ব্যায়ামবীরের ও হয়না মনে হয়।
এরপর কেবল বুঝলাম আমরা ট্রেনের বাইরে যাচ্ছি। শরীরটা বাতাসের মত হালকা হয়ে গেছে। ঠিক যেন, আমি সুতো কাঁটা ঘুড়ি।

(ছয়)
জ্ঞান ফিরতে বুঝলাম। আমি হাসপাতালে। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কপালে পট্টি, গালে ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। এদিকে ওষুধপত্র, আর ভারী গন্ধ নাকে আসছে। পাশের কেবিনে থাকা একজন নার্স আমার বেডের দিকে এসে আমার পালস চেক করলেন।
চোখের সামনে আঙুল ধরে বললেন, " শুনতে পাচ্ছেন? দেখতে পাচ্ছেন?"
আমি শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
নার্স বাইরে সবাইকে ডাকলেন। আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করুন তবে কেউ হট্টগোল করবেন না।
দেখলাম, আমার চেনাজানা সবাই এসেছে। সবাই বেশ চিন্তিত। তবে আমার জ্ঞান ফেরা দেখে প্রথম ই কথা বললেন আমার পরিচিত সেই লেখক।
সরি! আপনি এভাবে ট্রেন এক্সিডেন্ট করবেন জানলে আপনাকে আমার গাড়ি করে ই পাঠাতাম।
ট্রেন এক্সিডেন্ট!  আমি বিষ্মিত তবে মনে আছে আমি আর পাগল সেই ট্রেন থেকে আগেই বেড়িয়ে পড়ি। তাহলে সেই পাগল? (কাউকে পাগলের কথা বললাম না এতে আমাকে এরা কি ভেবে বসে, হয়ত মাথায় বিকৃতি হয়েছে এমন ভাবতে পারে)
দিন দুয়েক পর সুস্থ হতেই পত্রিকা হাতে নিতে পারলাম। আমি তখনো হাসপাতালে। বেডে শুয়ে ফলমূল খাচ্ছি। তবে পত্রিকা খুঁজে কোন পাগল ট্রেন দূর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহত হবার খবর পেলাম না। আমিও এটা অবাস্তব ভেবে ভুলে গেলাম। তবে সৈয়দপুর যাবার লোভ কাটেনি। সুস্থ হবার মাস দুয়েক পর আবার সৈয়দপুর যাবো বলে ঠিক করলাম। তবে এবার ভাড়াটে প্রাইভেটকারে।

(সাত)

আমি এবার একা যাচ্ছি না। সাথে আমার লেখক বন্ধু ও তার পরিবারবর্গ ও সাথে। সবাই মিলে ছয়জন। চাপাচাপি করে ই চলছিলাম। মাঝপথে একটু ফ্রেশ হতে সবাই ব্রেক নিতে নামলাম। কাছাকাছি একটা বাজারে আমি একাই গেলাম। কিছু ঠান্ডা পানীয়, বিস্কুট এইসব কেনাও যাবে।
একটা খাবার হোটেলে ঢুকে পানি খাচ্ছি হঠাৎ চোখ গেল হোটেলের দেয়ালে। সাদাকালো এক পোস্টারে চোখ আটকাল আমার, সেখানে একজন পাগলের ছবি। তার নাকি মাজারে উৎসব! এই নিয়ে পোস্টার। আরে, এই তো সেই ট্রেনের পাগল।
আমি খুশীমনে দোকানদার কে টাকা দিয়ে জিনিসপত্র হাতে নিতে নিতে বললাম, " ভাই? উনি খুবই ভাল। আমার সাথে একবার ট্রেনে দেখা হয়েছে অনেক আগে। আচ্ছা! এই পাগল বাবার দর্শন পাওয়া যাবে আজকে?"
দোকানি তো বটে, পাশের আর যারা সেখানে ছিল সবাই আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকাল।
হে হে! কি যে বলেন! দোকানি বলে উঠল, " ঐ পাগল বাবা! - সে তো সেই কবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মারা গেছে। একাত্তর সাল, কে কই যায় তার দিশা নানাই তখন! গ্রামের ভেতর পাকবাহিনী ঢুকে পড়সে। যারে পায় তার কাছে জানতে চায় মুক্তি কিধার হ্যায়? গ্রামে তখন কিছু লোক সেই বাবাজীর ডেরায় আশ্রয় নেয়, তার মধ্যে ছিল কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। বাবা ছিল দয়াল মানুষ, হানাহানি তে তার কোন সায় ছিল না। তারে যারা মানতো, তিনি কেবল তাদের বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেন। তাও সবার বাড়িতে না। উনি যাদের বাড়ি যেতেন তাদের ই কপাল খুলে যেত! তাই বাবাজীর প্রতি অনেকের যেমন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ছিল তেমনি কিছু লোকের আতিথেয়তা না পাওয়ায় ক্ষোভ ও ছিল। আর তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের হুকুম তলব করার মত লোকের অভাব হয় নাই। এদের কিছু লোক বাবাজীর নামে মুক্তিসেনাদের সহযোগীতার তথ্য দেয়। পাক সেনারা তখন পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায়।
পাকবাহিনী পাগলের আস্তানায় এক রাতে আসে। এলাকার এক রাজাকার পাগলের ডেরার সন্ধান দেয়। তারপর পাগল রে মাইরা তার আস্তানায় ই মাটিচাপা দেয়। সেইখানেই তার ভক্তরা বার্ষিকী করে ফের বছর।"
কথা শোনার সময়ে আমার মাথায় অনেককিছু এনালগ ঘড়ির কাটার মত ঘুরছিল।
আমার বলার ভাষা ছিল না। তবে এর বেশী কথা বলাও বোকামি। কেউ বিশ্বাস করুক বা নাই করুক। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি নিজে যা দেখেছি, যা হয়েছে তা কেবল আমার মাঝে থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
কাউকে বিশ্বাস করানো টা আমার দ্বারা হবে না। সে লোকটি যেই হোক না কেন, কেন তিনি সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন জানি না। তবে আরেকদিন দেখা হলে সেটা অবশ্যই জেনে নেবো সেই পাগলাটে বাবাজী মশায়ের কাছে। আমার কপাল হয়তো বেশ চওয়া, ভাগ্য মন্দ নয় অনায়াসে ই বলা যায়।
দোকানী বলল, "তা ভাই! চা খাইবেন তো এক কাপ? আরেক টা গল্প ও শুনলেন খাইতে খাইতে.. "



(গল্পের সমস্ত ঘটনা এবং চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো সাথে কোন মিল নেই, মিলে গেলে তা একান্ত কাকতালীয়)

গল্পঃ নখ

(এক)

নোংরা নোংরা !!
ছিঃ ছিঃ বলে চেঁচিয়ে উঠল নীরার মা। মেয়েটি নীরার সমবয়সী। কতই বা বয়েস! ওই হয়ত নয় বা দশ। এমন বাচ্চা মেয়েকে কেউ কাজে দেয়! কিছু যদি অঘটন ঘটায় তাহলে তার দায় কে নেবে?
মেয়েটির কোন নাম জানা ছিল না নীরার মায়ের। মেয়েটির মা খুব গরীব। সে নিজেও বাড়ি বাড়ি কাজ করে। স্বামী পরিত্যক্তা তাই মেয়েটিকে সারাদিনে দেখভাল করার মত কেউ নেই। একাকী মেয়ের উপর বস্তির লোকের কু-নজর। সে নজর কোন বয়েস, রঙ, মনুষ্যত্ব বোঝে না।
আপা! (হাত দুটো জোড় করে ধরে)  আমার মাইয়া টা খুব চুপচাপ। এমনি কোন কামকাজ পারে না তয় ছোটখাটো কাজে সব ই পারে। এই যেমন, দোকানে কেনাকাটা, এইটা সেইটা হাতে হাতে আগাই দেওয়া। আপনে হাজার এক দুই যাই দেন আপা দিয়েন। মাইয়া টা সেইফ থাকবো আপনার কাছে।
নীরার মায়ের তখন তাড়াতাড়ি। সানগ্লাস চোখে হ্যান্ডব্যাগ ঠিক করছেন।
নীরা! তাড়াতাড়ি!
স্কুলে লেইট হচ্ছে!
নীরার গলা শোনা যায়, আসছি মাম্মি।
আমার আবার একটা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে মিটিং আছে প্রেসের সাথে। আর তুমিও! বিকেলে আসতে পারো না!
আপা বিকালে কয়দিন ধইরা আইছি কিন্তু দারোয়ান কয় আপনে নাকি বাড়িতে নাই, ফিরা গেছি।
আচ্ছা আচ্ছা.. এখন যাও তুমি। কাল মেয়েকে এসে দিয়ে যেও। ঠিকাছে। এখন এসো।
নীরা...রা.. এলি?
নীরার মা এখন আর কথা বলতে পারছেন না। ডাক্তার বলছেন তিনি নাকি মানসিকভাবে সুস্থ নন। হাসপাতালের বাইরে হট্টগোল।
বিচার চাই! বিচার চাই!
স্লোগান দিচ্ছে ভদ্রমহিলার নিজের সংগঠনের কিছু কর্মী। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কর্তব্যরত ডাক্তার এসে স্টোথোস্কোপ দিয়ে নীরার মায়ের হৃদস্পন্দন চেক করলেন। পালস দূর্বল, তাছাড়া ব্লাড প্রেসার ও লো। মুখে কিছু খেতে চাইছেন না। এমনি চলতে থাকলে আরো দূর্বল হয়ে যাবেন তো!
স্যালাইন চালু করা হল। আপাতত নল দিয়ে খাবার খাওয়ানো হবে। তিনি রেস্পন্স ও খুব একটা করছেন না।
ভদ্রমহিলার স্বামীকে ডাক্তার ডেকে নিলেন রুমে, প্লিজ ফলো মি!
ডাক্তারের রুমে এসে ই ভদ্রলোক কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, "আমার ওয়াইফ বাঁচবে তো "
ডাক্তার বললেন, দেখুন আপাতত চিন্তার কিছু নেই। শরীর অনেক দূর্বল। আমি ওষুধ দিয়েছি। উনার পর্যাপ্ত ঘুমের দরকার। আমি ঘুমের ইঞ্জেকশান দিতে বলেছি নার্স কে। সম্ভবত উনি ভাল শক পেয়েছেন। কি করে পেলেন?
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে, আসলে..
(রুমে হইহই করে হাসপাতালের দারোয়ান এসে বলল স্যার, বাইরে ঢেইলাইতাছে)
হোয়াট!! কল দ্যা কপস!! ইমিডিয়েটলি।
ভদ্রলোকের সাথে আর কথা হলো না। ডাক্তার উঠে পড়লেন। বাইরে বস্তির লোকজন, সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ! তাড়া ঢিল ছুঁড়ে হাসপাতালের করিডোর ভরে ফেলেছে। এক দুই জন আহত। তাদের মাথা ফেটে রক্তাক্ত।
পুলিশ এসে যাবার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলো কিন্তু স্লোগান বাড়ল।
খুনীর সাজা চাই! রক্ষা নাই! রক্ষা নাই!
ডাক্তার তার রুমে ফিরলেন। মাঝের সময়ে কয়েকজন ইমারজেন্সী পেশেন্ট কেও দেখতে হলো। ডিউটিরত ডাক্তার আজ আসেন নি তাই। এম ও হয়েও ইমারজেন্সী দেখতে হলো।
কফি খাবেন? (ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে)
ডাক্তার এপ্রন খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে দিলেন। এই লাইফে ব্যস্ততা একটা শব্দ না। এখনি ডাক পড়লে ঈ আমাকে ছুটে যেতে হবে। একটা সেকেন্ড নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি না গেলে তো আরো সমস্যা। আগামীকাল আমাকে হেডলাইনে পাবেন, "ডাক্তারের অবহেলা এবং রোগীর মৃত্যু "।
ভদ্রলোক ডাক্তারের কথায় কেবল ঈষৎ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। কফি এসে গেলো। কম্পাউন্ডার কফির ট্রে রেখে গেল।
কফিতে চুমুক রেখে ডাক্তার বললেন, এবার বলুন ঘটনা কি? উনি কি থেকে এত্ত শক পেলেন?
ভদ্রলোক কফির মগ ট্রে তে রেখে বললেন। আমাদের বাসায় কাজের মেয়েটিকে প্রায় অনেক অনুরোধের পর রাখা হলো। আসলে আমার স্ত্রী শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করেন তবুও তিনি রাজী হলেন। ওরা খুব গরীব, আমাদেরও ছোটখাটো কাজে এই বই আনা, টেবিল মোছা, এটা ওটা আনা-নেয়ার জন্য লোক লাগে। তাই রাখা হলো।
কিন্তু আমার স্ত্রী একটা কারণে খুব বেশী অবসেসড হয়ে পড়ল। মেয়েটির হাতের নখ। এই নখে কালো কালো ময়লা জমে থাকতো। বারবার নখ কাটার কথা বললেও মেয়েটি শুনতো না!
আমার স্ত্রীও একরোখা। জোর করে নখ কেটে দিতো। এভাবে কয়েকদিন কাটল। হঠাৎ একদিন একই সমস্যা দেখা দিলো। এমনিতে মেয়েটি সব কথা ঠিকঠাক শুনতো, কাজও করতো কিন্তু সে কিছুতেই হাতের নখ কাটবে না।
আমার স্ত্রী মেয়েটির মা কে ডেকে পাঠালো এভাবে অপরিষ্কার থাকলে আমাদের বাসায় একে আর রাখবো না। মেয়েটির মা বুঝিয়ে শুনিয়ে মেয়েটির হাতের নখ নিজে কেটে দিয়ে গেল।
তারপর ঈ ঘটল ঘটনা। আমার স্ত্রী রোজ ঈ স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। যেখানে কেবল সে আর আমাদের কাজের মেয়েটি। মেয়েটি, হাতে নখ দুহাত খামচি দেয়ার ছল করে তাকে দেখাচ্ছে।
আমাকে এটা বলতে ই আমি হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলাম। বললাম, একই জিনিস বারবার ঘুরেফিরে তোমার মাথায় ঘুরছে। আমি ই ওকে ডাক্তারের কাছে নেবো বলে ঠিক করি কিন্তু তার ই আগের দিন ঘটে গেল।
(বলে মুখ ঢেকে টেবিলের উপর মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক, তারপর মুখ তুলে বললেন)
কাজের মেয়েটাকে সকালে মৃত পাওয়া গেল আমাদের ছাদে। গলায় স্পষ্ট হাতের দাগ। কেউ গলাটিপে হত্যা করেছে। সবার ধারণা আমার স্ত্রী। আসলে প্রথমে ও নিজেই দেখতে পায় আর ওর চিৎকার চেঁচামেচি তে আমরা সবাই গিয়ে দেখতে পাই। সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। আমি নিজে ছাদের দরজায় তালা লাগিয়ে এসেছিলাম। চাবিও ড্রয়ারে থাকে সেটাও আমার মাথার কাছে। কেউ নিলে আমি আগে টের পাবো। ও যে চাবি আমার সামনে থেকে নিয়েছে আমি নিজে ই দেখেছি ঘুম থেকে উঠে। আমি শুয়েই ছিলাম। আমার সামনে থেকে চাবি নিয়ে ও ছাদে গেল এক্সারসাইজ করবে বলে। আর তখনি..
স্যার! ১০০৩ এ পেশেন্ট এর অবস্থা ভাল না! জলদি আসেন!
নার্স ডাক দিতে না দিতেই দ্রুত বেড়িয়ে গেলেন ডাক্তার। উপরওয়ালা ভুল করলেও ডাক্তারের ভুল ক্ষমা করে না মানুষ। বাতাসের বেগে ছুটে গেলেন তিনি।

(দুই)

 ডাক্তার ফিরলেন আরো মিনিট বিশ পরে। কপাল ঘেমে জুলফি পর্যন্ত ভিজে গেছে তার। কাঁচাপাকা চুল তার, বয়েস খুব বেশী হবে না। কারণ তার চামড়া তে বার্ধক্যের ছোঁয়া নেই।
বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন তিনি। বললেন, পেশেন্টের অবস্থা খুব একটা ভাল না। ব্লিডিং হচ্ছে। চব্বিশঘন্টা ফলোআপে রাখা হয়েছে।
আপনি কিছু খাবেন তো! (প্রশ্ন না অনুরোধ সেটা ঠিক বোঝা গেল না)
ক্ষিধে ছিল তাই ভদ্রলোক আর না করলেন না।
ডাক্তার তার কম্পাউন্ডার কে পাঠালেন চিজ বার্গার আর কোক আনতে।
আপনার স্ত্রীর কি ঘুম ভেঙেছে?
নাহ!
বেটার। উনার রেস্ট দরকার। মাইন্ড টা অস্থির হয়ে আছে। তারপর? কি হলো? আমি দ্রুত ছুটে গেলাম তো তাই আর শোনা হলো না!
ভদ্রলোক রগড়ে কপাল থেকে ঘাম মুছে নিলেন। এবার তিনি ঘেমে যাচ্ছেন। খুব গরম পড়েছে।
ডাক্তার এসি বাড়িয়ে দিলেন।
ভদ্রলোক বললেন, " আমি ভাবছিলাম আপনি এসব উদ্ভট গল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।"
না না.. পেশেন্ট দেখা টা তখন জরুরি ছিল, আপনি এখন বলতে পারেন। ডাক্তার টেবিলের গ্লাস উল্টে পানি খেলেন মাঝখানে।
ভদ্রলোক শুরু করলেন আবার,
আমি ভেবেছিলাম আমার স্ত্রী প্রচন্ড শক পেয়েছে তাই হয়ত এমন দূঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ও যখন রেগুলার দেখতে থাকল ঠিক তখনি বুঝলাম এটা মোটেও দূঃস্বপ্ন না!
ও প্রায় রাতে দেখতো মেয়েটি ময়লা নখ ভর্তি হাতে আঁকড়ে ধরার মত এসে আমার স্ত্রীর গলা টিপতে চাইছে।
স্ট্রেঞ্জ! (ডাক্তার বিস্মিত)
তবে মেয়েটির সাথে আমার স্ত্রীর দেখা হতো আমাদের বাড়ির নানা জায়গায়। এই ধরুন, কোনদিন আমাদের ড্রয়িংরুম, কোনোদিন ছাদে, কোনোদিন গেটের বাইরে।
-আপনার স্ত্রী কি?
ভদ্রলোক চমকে গেলেন। বললেন, না না.. একদম ই না। আমার স্ত্রী এই খুন করতে পারে না। আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।
-পুলিশ কি বলছে?
পুলিশ বলছে যে লোকটি গলা টিপেছে তার হাতের আঙুল খুব বড়। এত্ত সহজে এমন আঙুল কারো হয় না। মানুষের অন্তত না! না না! (ভদ্রলোক না- সুলভ মাথা কয়েকবার ডানে-বামে ঝাঁকালেন) পুলিশ আমাদের সবার আঙুলের ছাপ নিয়েছে। সবকিছু সার্চ করেছে। যা ছিল সব। তারপরেও জানেন কিচ্ছু পায় নি। তাই আমাদের কে ওরা দোষারোপ ও করেনি। আমার মনে হয় আধিভৌতিক কিছু হতে পারে।
ডাক্তার বেশ জোরেশোরে হেসে উঠলেন।
আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন। আমি.. (কথা শেষ হলো না)
কম্পাউন্ডার বার্গার, কোক নিয়ে হাজির।
ডাক্তার বললেন, " নিন শুরু করুন।"
ভদ্রলোকের খিদে পেয়েছিল ডাক্তারের সামনে খাবারগুলো যেভাবে খেলেন তাতে গোটা পরিবার কে ই সাইকোসিসে আক্রান্ত মনে হল তার কাছে।
খাবার শেষ করলেন দুজনে বেশ দ্রুত ই।
আপনি কি আরো কিছু বলবেন? ডাক্তারের পেশেন্ট দেখতে হবে তাই তিনি চেয়ার ছেড়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করলেন।
ভদ্রলোক কি একটা বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলেন। বললেন, " না থাক।"
ডাক্তারের তাড়া আছে এখন আর আধিভৌতিক বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।

(তিন)

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশসাহেব এসে অনেকবার টাকা পয়সার জন্য বলে গেছেন। তাদের চারজন কন্সটেবল বাইরে আধাভেজা হয়ে ডিউটিরত। তাদের চা-জলখাবার টা তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেবে তো নাকি?
সরকারি পুলিশ ভাই আমরা, বলতে গেলে চাকর! অর্ডার না মানলে চাকরি থাকবে না। অনেক মানুষ লাইন ধরে আছে পুলিশ হইতে। হাজার পুলিশ মরলেও সরকারের চার পয়সা ক্ষতি নাই। আমরা নাই তো কি! পুলিশ থাকবে।
হাসপাতাল টা বেসরকারি। পুলিশ পাহারা আছে গতরাত থেকে। ঐ মহিলা ভর্তি হবার পর তার বিরুদ্ধ্বে যারা ছিল তারা এখনো বাইরে পলিথিন মোড়া হয়ে বসে আছে। সেখানে আছে নিহত মেয়েটির মা, সঙ্গে আরো বস্তিবাসী।
ডাক্তার একা হাসপাতাল সামলাচ্ছেন। হাসপাতালের মালিক এর মাঝে গেছেন আরব আমিরাত। সেখানেও তার নাকি বিজনেস আছে।
সিনিয়র হিসেবে হাসপাতালের দ্বায়িত্ব এখন কেবল তার। কয়েকবার ফোনে মালিক কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে জানা গেলো এবারে নাকি তিনি আগের হোটেলে উঠেন নি। তাছাড়া রোমিং সুবিধা তিনি নেন না। তাই ব্যক্তিগত ফোন এখন অচল। তবে তার শ্যালক এসেছেন একটু আগে। ফিনান্সিয়াল কিছু ঝামেলা এখন মালিকের পক্ষে তিনি ই মেটাবেন।
ডাক্তার এবার একটু যা স্বস্তি পেলেন। চেম্বারে এসে হেলান দিয়ে পড়ে গেলেন নিজের চেয়ারে। এমন ক্লান্তির পরেও লোকে ডাক্তারের নামে যা তা বলে বেড়ায়। ডাক্তারি তো আর মাঠে বসে ঘাস কাটা নয়!
এর মাঝে আবার হট্টগোল শোনা গেল বাইরে। বিক্ষুব্ধ হয়ে আবার হামলা করেছে সেই বস্তিবাসী। তারা মহিলার দৃষ্টান্তমূলক সাজা চায়। কম্পাউন্ডার এসে ডাক্তার কে নিয়ে গেলেন আবার।
মালিকের শ্যালক এবং ডাক্তার রোগীর কথা খুলে বুঝিয়ে বললেন। ভিড় থেকে মেয়েটির মা এগিয়ে এলো, বলল, " আব্বাজান, আমার মেয়েরে ওরা মারছে, আমি এই খুনের বিচার চাই!" আবার বিক্ষুব্ধ হলো সবাই।
শ্যালক এবার পুলিশ কে অনুরোধ করল, " দ্যাখেন। মালসামাল তো শ্যাষ কইরা দিব। টাকা পয়সা যা নিবেন লন, মাগার হাসপাতাল বাঁচান! "
পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করল। বিক্ষুব্ধ জনতা মনে হয় বেড়ে গেল আরো। পুলিশ কয়েকজন কে গ্রেফতার করতে ই আবার পরিস্থিতি শান্ত হলো কিছূটা।

(চার)

ডাক্তার আর মালিকের শ্যালক তর্কাতর্কি করছে মিনিট দশ। প্রথমে আস্তে শোনা গেলেও এবার জোরে শোনা গেল কথোপকথন। শ্যালক চাইছে টিয়ার শেল দিয়ে তাড়ানো হোক। ডাক্তার বলছে একটা মীমাংসা করা হোক।
এদের মাঝে এসে গেলেন সেই ভদ্রলোক।
তাকে দেখে শ্যালক আরো উত্তেজিত, আপনে কেঠা?
আমি পেশেন্টের স্বামী।
শোনেন, ক্যাচাল বহুত হইছে। আমরা আপনারে এহনি এম্বুলেন্স দিতাছি ওইটা অন্য হাসপাতালে লইয়া যাইব। ট্রিটমেন্ট হ্যানে করবেন। আমার হাসপাতাল তো সামনে থিকা খাইয়া দিসে মাইনষে!
বলে উত্তেজিত হয়ে হাত-পা নেড়ে রুমের বাইরে চলে গেল সে।
ডাক্তার অসহায়, তবুও ভদ্রলোকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, " আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি দেখছি কি করা যায়। "
পুলিশ এসে হাজার দুইয়ের উপর ক্যাশ নিয়ে গেছে। সাথে চা নাস্তা চলছে। বাইরে থেকে কেবল নিহত মেয়েটির মা কে এনে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করার কথা ভাবছেন ডাক্তার। মালিকের শ্যালক এতে রাজী না।
ভদ্রলোক রাজী যদিও তবে মহিলাকে আনা টা ঝামেলার কাজ আবার যদি এরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। হাসপাতালের সামনের দিকে যা ছিল তা ভেঙেচুড়ে একাকার।
পুলিশ কে এনে আলোচনার ব্যাপার টা খুলে বলা হলো। সব শুনে সে বলল, " তা তো বুঝলাম ভাই! আমার ভাগ টা! "
মহিলা কে আনা হলো। তিনি একটা চেয়ারে বসলেন। পাশের চেয়ারে পুলিশ, ঠিক তার পাশে মালিকের শ্যালক। ডাক্তার এবং ভদ্রলোক বসলেন কাছাকাছি আর মহিলার হাতের নাগাল থেকে দূরে।
মহিলা বললেন, " তার উয়াইফ আমার মাইয়ারে মারছে গলা টিপা!"
ভদ্রলোক না-সূচক মাথা নাড়লেন।
মহিলা রেগেমেগে একবার মারমুখী হলেন। তাকে পুলিশ থামাল।
ডাক্তার বললেন, " আপনার মেয়ে মারা গেছে আমরা সবাই সে শোক টা বুঝি কিন্তু আপনি কি চান উনার স্ত্রী যিনি মৃত্যুমুখে পড়ে আছেন তাকে ও মেরে ফেলতে?"
মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, "হ চাই!"
ভদ্রলোক হাতজোড় করে বললেন, "বোন আমাদের কেউ ই তোমার মেয়েকে খুন করে নাই" তার গলায় যথেষ্ট আকুতি।
মহিলা মুখে আচঁল চেপে ঢুঁকরে কেঁদে উঠলেন। আমার ময়না রে! ও মা!...
মহিলা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
ডাক্তার তার পালস দেখে দ্রুত একটা বেডে পাঠালেন। পুলিশ বলল, " কাম সারা! বাইরে যদি কেউ জানে যে মহিলা ভিত্রে অজ্ঞান হয়ে গেছে তাইলে তো হাসপাতাল ভাইঙ্গা গুড়া করে দিবে"
শ্যালক চেঁচিয়ে বলল, "শালা! আমার ভাগ কই? এই কথা কওনের সোম মাথায় এইটা আছিল না? এহন জলদি সামাল দে নাইলে তোর চাকরি খাইছি আইজকা"
"শোনেন ভাই! গালি দিবেন না কইতাছি। আমরা এইখানে না থাকলে কি হইতে পারে আগে বুইঝা লন।" পুলিশ হুঙ্কার দিল।
ডাক্তার এসে দুপক্ষকে শান্ত করলেন।

(পাঁচ)

বৃষ্টি থেমেছে। ইলশেগুঁড়ি চলছে। দুই মহিলার ই জ্ঞান ফিরেছে। একজন চা খাচ্ছেন আরেকজন হালকা পাতলা কথা বলছেন।
ডাক্তার তার চেম্বারে মাথা টেবিলে ঠেকিয়ে আধশোয়া। তার জীবনে এই ঘটনা প্রথম নয়। ডাক্তারি জীবনের শুরুতে এমন একবার ঘটেছিল। তখন তিনি ছিলেন শিক্ষানবিশ। তার সময়ে তিনি এমন বিপদে পড়তে দেখেছিলেন তার স্যার কে। তিনি যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার মানুষ। সবকিছু স্যার একা সামলেছিলেন। তার ছাত্র হয়ে আজকে ডাক্তার নিজে কি শিখলেন!
কম্পাউন্ডার রুমে এলো, " স্যার! আপনের কফি"
শোন! ঐ ৩৯ নম্বর বেডের ভদ্রলোক কে ডেকে পাঠাও আমার রুমে। কফি নেড়েচেড়ে তাতে চুমুক দিলেন ছোট করে। ডাক্তার একাকী। তাই হাসপাতাল টা তার পরিবারের মত। এখানে কোন ভুল হোক তা তিনি চান না।
ভদ্রলোক এলেন।
তার চোখমুখ দেখে বোঝা গেল তিনি কিছুটা গোলমেলে হয়ে আছেন।
আপনার আদিভৌতিক গল্পটা শুনতে ডেকেছি। কোথায় যেন ছিলেন? ও হ্যাঁ!
তেমন কিছু শুরু করেন নি। কিন্ত..
সত্যি জানেন, চেয়ার টেনে ভদ্রলোক বসে ই বলতে শুরু করলেন। স্বপ্নটা আমিও দেখতে শুরু করলাম।
ডাক্তার এবার নড়েচড়ে বসলেন। অদ্ভুত!
প্রথমে ভেবেছিলাম আমার স্ত্রী যা বলছে আমিও তাই স্বপ্নে দেখছি। পরে বুঝলাম নাহ! দুটো আলাদা কিছু।
ডাক্তার বললেন, " আপনি কি দেখতেন?"
আমি দেখতাম মেয়েটি আমার কাছে আসছে, আমার কাছে এসে হাসছে। বলছে এই দ্যাখো আমার নখ নেই! কেটে ফেলেছি।
ডাক্তার কফিতে চুমুক দিয়ে মনে মনে বললেন, " গোটা পাগলের পরিবার "।
নাহ! পাগল নই।
ডাক্তার চমকে গেলেন; তার হাত থেকে কফির মগ জোরে শব্দ করে পড়ে ভেঙে গেল। এটা তো আমি আপনাকে মুখে বলিনি! আপনি জানলেন কি করে?
ও বলেছে! (ভদ্রলোকের মুখে মিটিমিটি হাসি) ক্রুর হেসে ভদ্রলোক তার হাত দেখালেন ডাক্তার কে। তার নখ ময়লা।
পুলিশ! পুলিশ! নার্স! কম্পাউন্ডার! না আ আর্স..

(ছয়)

শ্যালক এদিকে খুন হওয়া মেয়েটির মায়ের সাথে বোঝাপড়া করে ফেলেছে। দুই লাখ টাকা পেলে সে এখন আর মামলা করবে না। মিউচুয়াল ভাবে কেস মিটিয়ে নেবে। ক্যাশ আপাতত না থাকলে সমস্যা নেই। শ্যালক আপাতত নিজে টাকা ম্যানেজ করে দেবে। পরে টাকা তারা ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করে টাকা পরিশোধ করে দেব।
তাই হলো। মহিলা টাকা নিলেন। বললেন, " আমার মাইয়ার দাম দুই লাখ! গরীব দেইখা দাম হইল দুই লাখ তয় আমার মাইয়া আমার কাছে কোটি টাকার বেশী আছিল"
হাসপাতাল শান্ত হয়ে গেলো।
ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী অন্য হাসপাতালে চলে গেলেন।
ডাক্তার তখনো অজ্ঞান। তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। মালিকের শ্যালকের হাসিমুখ, সব ভাল ভালয় মিটা গ্যাছে। দুলাভাই রে কয়া এওবার একটা ২০০ সিসি বাইকে লমু গিফট হিসাবে। হাসপাতালের বাইরে গাড়িতে উঠে সে সিগারেট ধরালো। পুলিশ ভ্যান চলে গেছে। তাদের নাস্তায় দেয়া পাউরুটির কিছু অংশ, কলার খোসা, চায়ের কাপ পড়ে আছে করিডোরে।
ডাক্তার তখনো অজ্ঞান। কেউ তাকে নখ দেখাচ্ছে স্বপ্নে। এই যে!  এই যে! দ্যাখো আমার নখে কত্ত ময়লা।

(সমাপ্ত)

(গল্পের ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক, এর সাথে জীবিত, মৃত, কিংবা অর্ধমৃত কারো মিল নেই। মিল থাকলে তা একান্ত কাকতালীয়)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...