বুধবার, ২১ জুন, ২০১৭

গল্পঃ কে সে?



(এক)
ঝিরঝির শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে রাত থেকে।
ঘরের বৈদ্যুতিক হলদে আলো টা নেভানো আছে। কপালে হাত তুলে এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন বিভূতিভূষণ। বিছানায় বালিশের পাশে পড়ে আছে প্রিয় মালব্রো প্যাকেট আর লাইটার টা। মাঝে জানালা ভেদ করে আসা হঠাৎ হঠাৎ বৈদ্যুতিক ঝলকানি লাইটারের অবস্থান আরো সুস্পষ্ট করে তুলেছে। ঘরের বাতাসে গুমোট ভ্যাপসা একটা গরম ভাব তবুও দেয়ালের ঘুলঘুলি গুমোট ভাব টা তেমন গায়ে লাগতে দিচ্ছে না।
  প্রেসের কাজ আজকাল তাকে দম ফেলবার মত ফুসরত দিচ্ছে না। এখন রোজা চলছে সামনে ঈদ, এই সময়ে আর দশ বারোজন জামাকাপড় বিক্রেতার মত কাগুজে প্রেস ব্যবসায়ীদের জন্যও এটি উপার্জনের ভাল একটি মৌসুম। অর্ডার যত বারবে পকেটে তত লাভ। তাই সারাদিন কাজ আর কাজ। অবসর মেলে না। অবশ্য আজ কোন এক সৌভাগ্য কপালে ভর করায় এ সময়ে বিছানায় শুয়ে থাকা এ আলসেমি টা দেখার মত হয়েছে। উপভোগ ই এখন যদিও পুরোপুরি মূখ্য বিভূতিভূষণের কাছে।
তাই সিগারেট জ্বালিয়ে একটা গানের কলি গুনগুন করতে করতে স্মার্টফোনে রবীন্দ্রসংগীত প্লে করে মনঃসংযোগ জানালার বাইরে নিয়ে বৃষ্টি কণার জানালায় আছড়ে পড়বার দৃশ্য দেখা ছাড়া আর কোন উত্তম কাজ থাকতে পারে না। নীরবতা কে সংহার করে রবিন্দ্রসংগীত বাজতে শুরু করল, "এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়.." সাথে চলল বিভূতিভূষণের মৃদ্যু গুনগুন। ফ্যানের গতি কম হলেও চলছিল কিন্তু বেশী সুখ এর স্থায়িত্ব বরাবরের মত কম আর হলো ও তাই। কড়কড় বাজ পড়বার সাথে সাথে বিদ্যুৎ সালাম ঠুকল।
 তারপর আর ভ্যাপসা গরম টা কে আর গায়ে মাখানো গেল না। বিদ্যুৎ অফিসের কর্মচারীদের শাপ শাপান্ত করে বিভূতি উঠে এলেন বিছানা ছেড়ে। হাতের পাশে থাকা টি টেবিলের অ্যাশ ট্রে তে সিগারেট নেভালেন সেই সাথে বন্ধ করলেন রবীন্দ্রসংগীত। নাহ! ঘরে আর টেকা যাচ্ছে না। বারান্দায় হাওয়া আছে কিনা দেখে আসি এই ভেবে এবার অন্ধকার ঘরে গুনে গুনে পা ফেললেন তিনি।
ঘরটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মাঝে নড়াচড়া একেবারে অসম্ভব! পা টিপে চলে এবার দেয়াল ধরে ধরে বাইরে এলেন বিভূতি। নাহ, এখানে আঁধার হলেও বাতাস ট গা জুড়িয়ে দেবার মত। বাসা টা বিভূতির অচেনা। মানুষ চেনা ঘরে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে নিজের জায়গাটা খুব ধীরে জানতে শেখে। কারণ অবশ্য অতি সুস্পষ্ট, এই বাসায় ফ্ল্যাটে উঠেছেন মাত্র সপ্তাহখানেক।
 আগের বাসা জোর করে ছাড়তে হয়েছে। সে বাড়ির ভঙ্গুর দশা দেখে সিটি কর্পোরেশন নোটিশ পাঠিয়েছিল বাড়ির বাড়িওয়ালাকে। তাছাড়া বাড়িতে নাকি খুব রিস্কে ছিল। তাই প্রায় একদিনের নোটিশে এই বাসায় উঠেছেন বিভূতিভূষণ। এখান থেকে প্রেস টাও কাছে।
 তবে পাঁচতলা এই বাড়ির ছোট একটা সমস্যা আছে মানে, খাবার জলের বড্ড অভাব। দিনে একবার জল আসে সেটা ড্রামে ভরে রাখতে হয় আর আসে ভোররাতে অল্প সময়ের জন্য। এছাড়া বাকী আর কোন সমস্যা আপাতত চোখে পড়েনি। বড় কথা ভাড়াটা বেশ সহজলভ্য হওয়াতে আর জলদি জলদি শিফটের চাপ কমাতে এর থেকে আর ভালো কোন সুযোগ বিভূতি বাবুর জন্য ছিল না।
বিদ্যুৎ এখনো আসে নি। ঘেমে শরীর একাকার। বারান্দায় ঝুলতে থাকা তোয়ালে দিয়ে গায়ের ঘাম টা রগড়ে মুছে নিলেন। বাসায় পুব দিকে এই বারান্দা। পাশাপাশি অনেক বাড়ী, বলতে গেলে একেবারে দেয়াল ঘেঁষা। একেবারে ঘেঁষাঘেঁষি করা আরেকটা বাড়ি যেন পারলে এই বাড়ীর দেয়ালে এসে লেগে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ও বাড়ির মালিক ইচ্ছে করেই এই বাড়ির উপর নিজের বিল্ডিং তুলে দিতে চাইছেন।
বারান্দায় শুকাতে দেয়া কাপড় একদিকে সরিয়ে মোড়া টেনে বসে গেলেন বারান্দায়, এখানে বিদ্যুৎ কখন আসবে কে জানে! এখানে বসে একটু গায়ে বাতাস লাগানো যাক।
এখনো বৃষ্টি আর বজ্রপাত চলছে। আনমনে বৃষ্টির ফোঁটা ধরতে বারান্দার বাইরে হাত বাড়ালেন বিভূতি হাত বাড়ানো তে পাশাপাশি ও ফ্ল্যাট থেকে কোন একটা অদ্ভুত ছায়ামূর্তি মনে হলো বসা থেকে হঠাৎ করে উঠে একেবারে দেয়ালে মিশে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘরের ভেতরে চলে গেল।
বিভুতি ভয় মেশানো লজ্জা পেলেন। কে না কে এই অন্ধকারের মাঝে বসে ছিল আর এই হাত বাড়ানো তে সে কি আবার ভাবল! এক হাত দূরত্বে বাড়ী, ভুল ভাবতে ই পারে যে কেউ এই হাত বাড়ানো দেখে। তিনি আরো ভাবলেন, খারাপ কোন চিন্তা করে তো সে ছায়ামূর্তি ফেরে নি তো!
 যাই হোক, কেউ আবার এলে কথা বলে নিজেকে শুধরে দেবেন তাদের কাছে।
গরম আর কথা বলে ভুল শুধরে নেয়ার অপেক্ষায় প্রায় এক ঘন্টা ঠায় বসে বিভূতি কিন্তু কেউ এলো না। স্মার্টফোনের আলো জ্বালিয়ে দেখলেন রাত ১ টা ৭ মিনিট। আড়মোড়া ভেঙেছেন এর মাঝে বেশ কয়েক বার, বাইরের ঠান্ডা বাতাসে চোখ অনেকবার লেগে এসেছিল। এবার আর বসে থাকা হলো না তার।
বারান্দার দরজা লাগিয়ে ঘরের ভ্যাপসা গরম অগ্রাহ্য করে ঘুমিয়ে গেলেন তিনি। এই তল্লায় বিদ্যুৎ এখনো আসেনি।

(দুই)
রেগুলার অ্যালার্ম দেওয়া থাকে সকাল সাত টায়। আজো তাই ছিল, অফিস থেকে ফোন এসেছিল। পত্রিকায় দেবার জন্য কয়েকজন বিজ্ঞাপন দাতা দেখা করতে এসেছেন। বিদ্যুৎ এখনো আসে নি। কলে জল নেই!
বোতলের জল দিয়ে বার কয়েক চোখে মুখে ঝাপটা দিলেন বিভূতি। অফিস ব্যাগে তোয়ালে, দাঁতের ব্রাশ, আর একটা এক্সট্রা শার্ট ভরে রওনা দিলেন অফিসেত উদ্দেশ্য। অফিসে তার স্নান করতে হবে।
বাড়ির নীচে আসতে দারোয়ান আদাব দিল বেশ উঁচু করে। " আদাব স্যার!"
বিভূতিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, " কি বিবাহিত? "
দারোয়ান, একটু সলজ্জিত চোখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মানে সে বিবাহিত। রিক্সা ডেকে বিভূতিভূষণ প্রেসের পথে চললেন। ভাবলেন, বিবাহিত হলে সবাই অসুখী হয় না। সবকিছু মনের ব্যাকরণ। " ই" আর "আ" প্রত্যয়। একটা ভালোই আরেকটা ভালো না।
গেটের বাইরে নেমে রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে  অফিসে পা রেখে হাঁক দিলেন, "মতি, জলদি এক কাপ চা পাঠা আমার টেবিলে আর উনাদের কেও দে সাথে বল মিনিট দশের জন্য বসতে"।
মতি বলল, " আচ্ছা, বস! বলতাছি "
বিভূতি চটজলদি ব্যাগপত্র নিয়ে অফিসের বাথরুমে গেলেন ফ্রেশ হতে।
বিজ্ঞাপনদাতা এবার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এগ্রিমেন্ট হবার পর তারা চলে গেলেন হ্যান্ডশেক করে। মতির দেয়া তিন কাপ চা এখন আধ খাওয়া হয়ে তাদের রেখে যাওয়া উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
অফিসে সিগারেট ধরানো মানা।
তাই সিগারেট ঠোঁটে অফিসের বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে এলেন। পায়ের তলায় অনেক ফুল অনাদরে চাপা পড়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে গোটা রাস্তা টা দেখা যায়। বাস, বাইক, আর মোটরগাড়ির ধোঁয়ানো ছোটাছুটি। এপাশে রিক্সার বেল বাজার শব্দ। পথচারীর অস্ফুট কথোপকথন।
সিগারেট শেষ করা গেল না, মতির ডাক, " স্যার, দেশের বাইরে থেকে বসের ফোন, আপনারে চায়"।
ফোন তুলে হ্যালো বলতে, শোনা গেল গলা।
বিভূতি! কেমন আছো?
ভালো আছি স্যার, অনেকদিন পর আপনার ফোন পেলাম। কেমন কাটছে সেখানে?
লাইফ ইজ ওয়ান্ডারফুল!  হা হা.. বুঝলে বিভূতিভূষণ?
কিছুটা স্যার, আপনার গলার টোনে।
( ফোনের ওপাশে স্যারের অট্টহাসি..)
(তিন)
বাড়ি ফিরে হাফ ছাড়ার মত অবস্থা। কারেন্ট এসেছে। কপাল ভাল বলতে হয়। পাশের ফ্ল্যাটের কানাকানি হইচই শুনে বোঝা গেল ট্রান্সমিটার টা ইস্তফা দিয়েছিল কাল। আজ সেটা বদলে দিয়েছে বিদ্যুৎ অফিস থেকে লোক এসে। নয়ত আধাঁরে কাটাতে হতো আজকেও।
ফ্যান ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিলেন বিভূতি, ফোনের চার্জ শেষ। সেটাকে প্লাগ ইন করে আবার চার্জে দিতে চেয়ার টা ছাড়তে হলো।
চার্জের প্লাগ লাগাতে গিয়ে বিভূতিবাবুর চোখ গেল পাশের বিল্ডিং এর বারান্দায়।কাল রাতে এক ছায়ামূর্তি, তাকে দেখে যে আঁতকে ভেতরে চলে গেল। প্লান ইন করে এবার বারান্দায় এলেন তিনি। গোলাপী দেয়াল, বারান্দার গ্রিলে মরচে ধরেছে, ভেন্টিলেটর এ এক জোড়া চড়ুইপাখির বসবাস। ওরা এখন এই মূহুর্তে বিভূতিবাবুর উপস্থিতিতে বিরক্তি জানিয়ে চেঁচামেচি করে চলেছে। বাইরের দিকে একটা ফিউজ বক্স। কয়েকটা এলোমেলো আসবাবপত্র পড়ে আছে আনাচেকানাচে। একটা অনেক পুরনো কালো পাতিল দেখা গেল। বারান্দা আর বিভুতি'র দূরত্ব মোটে একহাত। বড় কথা বারান্দার দরজাটা এমন ভাবে লাগানো যেন সে বাসায় কেউ থাকে না।
বিভূতিভূষণ বিকেল পর্যন্ত উঁকি দিয়ে গেলেন কাউকে ও বাড়ির বারান্দায় আসতে দেখা যায় কি না। নাহ! কেউ এলো না। বিকেলবেলা গা এলিয়ে শুয়ে গেলেন, কাল দেখা যাবে। হয়ত ও বাসার কেউ এখন ফ্ল্যাটে নেই, বাইরে গেছে নয়ত ঘুমোচ্ছে।
ঘুম ভাঙল, রাত সাড়ে আটটায়।
ঘরেআগুন লেগে গেছে এমন গরম। জানলাটা টেনে পুরোটা আধশোয়া হয়ে থেকে খুলে দিলেন বিভূতি। সেই সমস্যা, বিদ্যুৎ নেই! ঘেমে গায়ে পড়ে থাকা গেঞ্জিটা ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে।
ওহ! গেলাম! এত্ত গরম। এই গরমে বোঝা যায় বৈশাখমাস না আষাঢ়মাস!
হাতে সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে বাইরে এলেন। গেঞ্জি টা পাল্টে নিয়ে মনের সুখে সিগারেট নেশায় ডুবে গেলেন এবার। এবার চোখ গেল পাশের বারান্দায়। সেখানে কোন একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। বিভূতিবাবুর দৃষ্টি সে ছায়ামূর্তির পছন্দ হলো না। সেটা এমনভাবে ঘরে চলে গেল যেন ভেসে গেল প্রায়।
কে কে?  বলে চেঁচিয়ে উঠলেন বিভূতি,
তার চেঁচানো শুনে, নীচের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধা মহিলা কড়কড়ে গলায় বলে উঠল, " আরে মরণ! কে কে বলে চেঁচাচ্ছিস কেন রে? "
বিভূতি ভয়ে ঘরে এসে কাঁপাকাঁপা হাতে মোম জ্বালালেন। ভয় তিনি পান না, অন্তত ভূতে। আর ভূত প্রেতিনী যাই হোক, এমন কিছু থাকলে নিশ্চই কেউ না কেউ এতদিনে তাকে জানিয়ে দিতো।
তাহলে কি এটা? একটু তো দেখতে ই হচ্ছে আবার।
স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশলাইট একবার সাহস করে পাশের বারান্দায় আলো ফেললেন তিনি। নাহ, বিকেলবেলা পর্যন্ত যেভাবে ছিল সেভাবে ই তো আছে। তাহলে?
কোন সদুত্তর নিজেও জানেন না বিভূতি।
আধাঘণ্টা পর বিদ্যুৎ এল, আজ সারারাত বিভূতিবাবুর বারান্দার আলো জ্বলবে। জানালা গুলো ডবল চেক করে লক করে শুয়ে পড়লেন তিনি।
(চার)
 ঘুম ভাঙল জল পড়ার শব্দে। ধড়ফড় করে উঠলেন, আচমকা জানলার ফাঁক গলিয়ে চোখ রাখলেন পাশের বারান্দায়। কেউ নেই সেখানে, রয়েছে সেই চড়ুইপাখি জোড়া, ওরা ডাকাডাকি করছে। বিছানা ছেড়ে উঠলেন বিভূতি আজ ও অফিস। নিজের প্রেস বলে ছুটি নেয়া হয় না।
বাথরুমে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন, হাতে দাঁতের ব্রাশ নিয়ে চোখ কচলে ফ্রেশ হতে হতে মনে পড়ল গতকাল রাতে কলে জল ছিল না। কল খোলা ছিল,
নিজেই কখন সেটা ছেড়ে রেখেছিলেন মনে নেই। ভোরে জল আসতে ই সেটা থেকে জল পড়েছে।
রেডী হয়ে বেড়িয়ে পড়তে হলো অফিসের উদ্দেশ্য। ঈদের আগে প্রেসে প্রচুর চাপ।
আজো যথারীতি, দারোয়ান সালাম দিল। বলল, স্যার আমি বিবাহিত।
বিভুতি মুচকি হাসলেন, গেট থেকে বেরিয়ে রিক্সা ডাকতে যাচ্ছিলেন আবার ফিরে এলেন।
ওহে? ( দারোয়ান কে ডাকলেন)
জ্বী স্যার..
বলতো, এই পাশের বাড়িতে লোকজন থাকে?
থাকে তো স্যার!
থাকে? কই! আমি তো কাউকে বের হতে, নয়ত ঢুকতে দেখি না!
স্যার, এই বাড়ির মালিক প্রবাসী। দেশের বাইরে থাকে। একজন কেয়ারটেকার আছে। সে ভাড়া দেয় আর বছর শেষে টাকা ব্যাংকে জমা দেয়। ওই টাকা ট্রান্সফার হয় সেই প্রবাসী মালিকের কাছে।
আচ্ছা, আমি যে পাশে আছি, তার উল্টা দিকে কেউ থাকে? জানো?
ক্যান?  কি হইছে স্যার?
কিছু হয় নাই! জানো কিনা বলো!
দারোয়ান মাথা চুলকে এদিকওদিক তাকিয়ে অনেকবার ভাবল। এরপর বলল, না স্যার। এখন তো কেউ থাকে না!
আগে থাকত?
স্যার, এই ফ্ল্যটে ব্যাচেলর বেশী থাকে। তাও ধরেন একমাস, দুইমাস। কেউ ছয়মাসের বেশী থাকে ই না।
কেন?
ঐ যে কইলাম না স্যার, ব্যাচেলর!
মেয়ে ব্যাচেলর থাকে? ( জিজ্ঞেস করতে দারোয়ান গলাটা নীচু করে আনল)
এরপর বলল, হা স্যার!  মানে থাকে না। অনেকের বাজে অভ্যাস তো থাকে ই!
হুম।
দারোয়ানের সাথে কথা শেষ বিভূতিবাবুর অফিসে দেরী হচ্ছে।
বিকেল হয়েছে অনেক আগে।
আজ ফিরতে বেশ দেরী হলো। আসার পথে জ্যাম, ব্রেড আর জেলী নিয়ে ফিরলেন। রাতে কাজ আছে, পিসিতে এডিটের কাজ। পেনড্রাইভ করে শখানেক লেখা নিয়ে এসেছেন।
ফ্রেশ হয়ে পিসি অন করে যখন লেখা নিয়ে বসলেন ঘড়িতে তখন পৌঁনে এগারোটা। ফোন চার্জে দিয়ে আবার যখন লেখায় মনোযোগী হবেন। ঠিক তখনি বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো বেশ জোরেশোরে। তারপর সাথে সাথে গগনবিদারী বজ্রপাত!
বিদ্যুৎ ইস্তফা দিল মুহুর্তে।
সিগারেট জ্বালিয়ে বারান্দায় এলেন বিভূতি। আজ কেন জানি ভয় কাজ করছে না।
সিগারেট শেষ করে এনেছেন, গুনগুন গান করছিলেন সাথে সাথে।  বাদল ঘনায় দু নয়নে...
গান শুরু করে এক লাইন গেয়েছেন কি গান নি, একটা চাপা মেয়েলী গলার স্বরে গান থামাতে বাধ্য হলেন।
কেউ এর মাঝে বলেছে, " গানটা আমার প্রিয় "।
এবার ঝুম বৃষ্টির শব্দ, আর কারো কথার কোন আওয়াজ নেই! বজ্রপাত হলো দু'বার।
বিভূতিবাবু আর সাহস পাচ্ছেন না। তিনি নিশ্চিত আশপাশ থেকে কেউ কথাটা বলেছে। ভয় পাচ্ছেন না পাচ্ছেন না নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না।
গান থামাত্ব এবার স্পষ্টত শুনতে পেলেন কথাটা, " ভালো ই তো গাইছিলেন! থেমে গেলেন!"
পাশের বারান্দায় ঠিক দরজার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে একজন। একটা ছায়ামূর্তি। কিছু বোঝা যাচ্ছে না, বজ্রপাত হলে কিছুটা বোঝা যায় যে কেউ আছে। আধাঁরে কোন অস্তিত্ব নেই।
বিভূতিভূষণ সহজে ভয় পান না, কিন্তু আজ পাচ্ছেন। যে বাসায় দরজাজানালা কোনদিন ই খুলতে দেখেন নি কাউকে সেখানে মেয়েলী কেউ এত রাতে কথা বলছে এটা তো অকল্পনীয়!
গাইছেন না যে! তাড়া এলো আবার।
কে?  কে আপনি?
আমি? এই বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা।
কিন্তু এখানে তো কেউ দুইমাস, ছয়মাস..
কি? এর বেশী থাকে না!  এই বলছেন? তা থাকে না কিন্তু আমি থাকি।
কিন্তু ব্যাচেলর! কোন মেয়েতো!
থাকে না বলেছে ওই দারোয়ান!  ওতো একটা প্রতারক! শয়তান!
বিভূতি এবার রেগে গেলেন, " না জেনে কাউকে প্রতারক কেন বলছেন!"
পাল্টা প্রশ্ন করল মেয়েলী গলা, "আপনি চেনেন?"
নাহ কিন্তু সে প্রতারক কেন হবে?
মেয়েলী গলা এবার কর্কশ স্বরে লম্বা হাসি দিল।
হাসবেন না!  হাসবেন না!  প্লিজ, কে আপনি বলুন?
বজ্রপাতের শব্দ পাওয়া গেল। তারপর সব ঠান্ডা।
কোথায়? এই যে!
নীচের তলা থেকে সেই ষাটোর্ধ বৃদ্ধার বিরক্তিকর তিরিক্কি গলা শোনা গেল, "কে রে?  তুই? মাঝারাতে চেঁচাচ্ছিস? "
বিভূতি বিরক্ত হয়ে ঘরে এসে গেলেন। মাত্র পনেরো মিনিটে কতকিছু হয়ে গেল। তার কপাল ঘেমে ঘাম ঝরে পড়ছে।
(পাঁচ)
 পরদিন অফিস সেরে আগে ভাগে বাসায় ফিরলেন। দারোয়ান আদাব দিলে ও তাতে কোন তোয়াক্কা করলেন না বিভূতি। একটা মেয়েলী গলার কিছু কথা দারোয়ান কে নিয়ে বিভূতিভূষণের সব ভাল ধারণা রাতারাতি পাল্টে গেল। দারোয়ান ও কিছু টা অবাক, কাল ও তো সব ঠিকি লাগছিল ওর কাছেও।
আজ ফিরে এসেই বারান্দায় বসে আছেন বিভূতি। পাশের বাড়িতে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে "ঢিংকা চিকা " গানটা ফুল ভলিউমে বেজে গেল। এই নিয়ে নীচের তলার বুড়ি চেঁচামেচি করে গেলেন।
সন্ধ্যে নামল, ইচ্ছে করে ঘরে আলো জ্বালেন নি তিনি।
অনেকক্ষণ বসে থেকেও যখন কাজ হলো না, ফিরে ঘরে যাবেন ভাবছেন। ঠিক তখনি সেই মেয়েলী গলা, "আমার প্রেমে পড়েছেন বাবু? এরপর অট্টহাসি.. "
বিভূতিভূষণ আগ্রহী তবে প্রেমে তিনি পড়েন নি।
তাই সেটা জোর গলাতেই বললেন, " না, প্রেমে পড়িনি"
মেয়েলী গলা বলল, নতুন প্রেমে পড়া প্রেমিক কিন্তু এভাবেই অপেক্ষা করে জানেন তো লেখক?
আমি লিখি, সেটা আপনি কি করে জানলেন?
হা হা.. ঐ যে, আপনাকে দেখছি গত এক সপ্তাহ ধরে।
তাহলে তো বলতে হয় আপনি উল্টো আমার প্রেমে পড়েছেন। মেয়েলী গলা অস্বীকার করল একটু দেরীতে।
আমি আসি বলে চলে যাচ্ছিল ছায়ামূর্তি।
বিভূতি থামালেন, যাবেন না সুপ্তি!  কথা শুনুন?
মেয়েলী গলা এবার হেসে উঠল,  ওটা আমার নাম নয়। ইচ্ছে হলে নামটা জিজ্ঞেস করতেন। ভুল নামে ডাকলেন তাই বলে! হা হা...
আপনার নাম?
বলবো না। অদৃশ্য হয়ে গেল ছায়ামূর্তি।
বিভূতি অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলেন। ভুল নামে ডাকলে হয়ত মেয়েলী গলা তার নাম বলবে কিন্তু সেটা হলো না।
রাতে খাবার পর বিভূতি আরো বেশ কয়েকবার বারান্দা ঘুরে গেলেন। কাউকে দেখা গেল না। সেখানে।
ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
আ আ আ....একটা ভয়ার্ত চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙল বিভূতির, ঘড়ির এনালগ কাটা খটখট শব্দে সেকেন্ডের হিসেব দিচ্ছে। উঠে বিছানায় বসবার পর আবার স্পষ্ট শোনা গেল চিৎকার। কোন এক যুবক চেঁচাচ্ছে।
গায়ে একটা জামা চাপিয়ে বারান্দায় ছুটে এলেন বিভূতি। পাশের বাড়ির দোতলায় কিছু একটা হয়েছে। বাড়ির গেইট খোলার শব্দ শোনা গেল।
ঘড়িতে ভোর চারটা, একটা এম্বুলেন্স ঢুকল কিছুক্ষণ পর। নীচে লোকে লোকারণ্য। হইচই আওয়াজ।
বিভূতি এবার নীচে এলেন, বছর পঁচিশের এক যুবক মুখে ফেনা তুলে চোখ বড়বড় করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে এসবে যা হয়, লোকজন যুবকের ঘরে দেখতে পেল সে কোন এক অশ্লীল কর্মে লিপ্ত ছিল। হঠাৎ করে কেন এমন ভয়ে নাকমুখ সিঁটকে পড়ে গেল কেউ বুঝতে পারছে না।
ভোর হতে না হতে পুলিশ এলো সবকয়টা ফ্ল্যাট সার্চ করল। কিন্তু বিভূতিভূষণের পাশাপাশি ফ্ল্যাটের চাবি পাওয়া গেল না। পুলিশ কয়েকজন যুবক কে মাদক আইনে ধরে নিয়ে গেল। অসামাজিক কাজে সাহায্য করায় কেয়ারটেকার কে গ্রেপ্তার করা হলো।
এদিকে চাবি না পাওয়ায় সে ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙা হল বাইরে থেকে সম্পূর্ণ পুলিশ তদারকি তে।
সে ফ্ল্যাটের রুমে তখনো এসি চলছিল, বিকট পঁচা দূর্গন্ধ ঘরের ভেতর। কেউ আসেনি সে রুমে। ঘরে এখানে সেখানে ধূলোবালি।
ড্রয়িংরুম পার হয়ে বেডরুমে এসে আঁতকে উঠলেন পুলিশ সুপার নিজে। আস্ত কঙ্কাল ঝুলছে সিলিঙ থেকে, গলার কাপড় টা সম্ভবত ভিক্টিমের শাড়ি।
পুলিশসুপার সি আইডি কে ফোন করলেন। খুন না আত্মহত্যা!
কিছু কাগজপত্র ছিল সেখানে।
কেয়ারটেকার কে উত্তমমধ্যম দেয়াতে সে মুখ খুলল, সে নিজেও নাকি এ নিয়ে কিছু জানত না। ওর ভাষ্যমতে,
বেশ ক'মাস আগে এক ভার্সিটি পড়ুয়া এক ছেলে এই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। তার এই ফ্ল্যাটে প্রায়শই বান্ধবী আসত।
বিভূতিবাবুর বাড়িতে এখন যে দারোয়ানি করে সে তখন চাকরী করতে এই বাড়িতে। ওকে মোটা টাকা দিলেই যে কাউকে আসতে দিত। এই নিয়ে কেয়ারটেকার নিজে যে জানত না তা নয়, উপরি কে না কামাতে চায়। তারপর হাজার টাকা।
এরপর একদিন এক বান্ধবী আসে এই ছেলেটির, মেয়েটি এসেছিল বিকেলবেলা। তারপর আর মেয়েটিকে কেউ বের হতে দেখেনি। আসলে ফ্ল্যাটের বাইরে তালা মেরে ছেলেটি অগ্রিম ছ'মাসের ভাড়া দিয়ে চলে গেছে। তাই আমাদের কেউ এই চারমাসে খোঁজ নেয় নি সে ছেলেটার ব্যাপারে।
পুলিশ দারোয়ান কে ধরে ক' ঘা দিয়ে ছেড়ে দিল, থানায় নেয়া হলো কেয়ারটেকার কে। ফোন করা হলো বাড়ির মালিক কে। খোঁজ পড়ল সে ছেলের।
বিভূতিভূষণ এতকিছু জানার পর থ' মেরে নিজের ঘরে বসে আছেন।
ফোনে মতি নামে রিং বেজে উঠল,
হ্যালো বলে কানে ফোন নিলেন বিভূতি
স্যার, কালকে আমার ছুটি চাই। একটু বাড়ি যামু স্যার, বৌয়ের শরীর ভাল না।
আচ্ছা, ঠিকাছে। ( বলে ফোন কেটে দিলেন বিভূতি, এখনো ঘোর কাটেনি তার)
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো, আলো জ্বেলে আজ বসে আছেন বিভূতি। একের পর এক সিগারেট ফুঁকছেন।
আজ আর ঘরের বাইরে নয় উহু, কোনভাবেই নয়!
কিন্তু মেয়েলী গলায় লেখক, এই যে!  শুনছেন? বলে ডাক শোনা গেল। আকুল হয়ে আবার ডাকল মেয়েলী স্বর। বলল, শুনছেন?
আমি আজ চলে যাচ্ছি। আপনি খুব ভাল, আমার সাথে সেদিন কথা হলো আপনাকে বেশ ভালো লেগেছে।
বিভূতিভূষণ পেতনীর প্রেমে পড়বেন এটা নিজেও ভাবেন নি।
সাহস করে তবুও বারান্দায় এলেন, ছায়ামূর্তি সেখানে আলোছায়াতে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে।
ওহ! শেষ পর্যন্ত এলেন আপনি।
এলাম, কিন্তু ভয় পাচ্ছি খুব!
ভয় পাবেন না, আজ আমার লাশ এ ঘর থেকে নিয়ে গেছে। আত্মা টা আমার মুক্ত, তাই যেখানে খুশী যেতে পারি তবে এখানে আজকের পর আর আসছি না। কি হয়েছে আমার সাথে আপনি আন্দাজ করে নিন। তবে চলে যাবার আগে একটা সত্যি বলতে চাই! তবে একটা কথা প্লিজ বলবেন?
কি কথা?
আপনার নাম?
আমি বিভূতি। এবার সত্যি টা?
সেদিন অনুমানে যে নামে ডেকেছিলেন, সেটাই আমার আসল নাম।
আমি সুপ্তি।
(ছায়ামূর্তি এবার কোথায় যেন মিলিয়ে গেল)
(সমাপ্ত)

শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭

ছোটগল্পঃ স্বপ্ন


(এক)
ভোর হবে হবে করছে,
আমি এখনও কিবোর্ডের কি খটখট শব্দ তুলে টাইপ করে চলেছি। অফিসের একটা জরুরি ফাইল সপ্তাহ ধরে পড়ে আছে। আমিও হেলাফেলা করে হাতে তুলি না। আলসে নই, তবুও এটা আমার অভ্যাগত রোগ। বস আজকে হুমকি দিয়েছেন অফিসে। না করে উপায় নেই!
আসলে যেটা করবো না সেটা পড়ে ই থাকে। শুধু এই অফিসের কাজ টা নয় আরো আছে। এমনকি মাঝরাতে পানি খাবার মত ব্যাপার টাও। যেমন, পানির বোতল পাশের পায়ের কাছে নয়ত কম্পিউটার ডেস্কে রাখা অথচ মুখে তুলবো না!
কটমট করে টাইপ টা প্রায় শেষ করে এনেছি।
এদিকে শেষ হতে না হতে ই তিয়াশার ফোন। এই ভোররাত ৫ টায় ফোন?
টেলিপ্যাথি! জেগে আছি জানলো কি করে? মাথা চুলকে ফোন রিসিভ করে বললাম,
-হ্যালো
-হ্যালো মানে? ঘুমাও নি?
-হ্যাঁ ওইত!
-তুমি জেগে জেগে কি করছিলে?
-অফিসের একটা ফাইল পড়ে ছিল, সেটাই কমপ্লিট করা।
-নাও এবার ঘুম দিয়ো না।
-ঘুম দেবো না!
-না, ফ্রেশ হয়ে বাইরে হেঁটে আসো।
হাসি দিয়ে বললাম, আচ্ছা।
এই আচ্ছা মানে আমি ৮ টা পর্যন্ত ঘুমাবো। এটা তিয়াশা বোঝে। তাই জোর গলায় বলল, শোন! আমি ইউনিভারসিটি যাবার আগে বাসার বারান্দায় কফির মগ হাতে যেন তোমাকে দেখতে পাই।
আমি ওকে বলে, বিছানায় পড়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙল, অ্যালার্মের জোর প্রচার প্রচারণার শব্দে।  চোখ কচলে দেখি ৮ টা ১০। ফোনে দুটো মিসড কল!
দৌড়ে কিচেন থেকে কফির মগ নিয়ে সোজা বারান্দায় ছুট দিলাম।
সোজা খোঁজাখুঁজি ঘুমভাঙা ঝাপসা চোখ জোড়ার। ইউরেকা!  পেয়েছি বলেই কফির খালি মগ ঠোঁটে ছোঁয়ানোর ভান করলাম। বোঝাতে হবে তো সকালে উঠেছি।
নীল লালে মোড়ানো পোষাকে মেয়েটা আগের দিনের সন্ন্যাসীর মত বড়বড় রাগী চোখ করে আমার বাসার বারান্দার দিকে তাকিয়ে।
ইশারা করে দেখালো ফোন কই? আর আমি যাতে ফোন ধরি।
ফোন বিছানায় পড়ে আছে। দৌড়ে এলাম আবার ঘরে, ফোন নিয়ে আবার বারান্দায়।
-হ্যালো
-কি? ঘুমিয়েছিলে?
-আরে না না!  আমার ঘুম পায় ই না!
-তাহলে খালি কফির মগ ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছ কেন? মগে ধোঁয়া কই?
-খালি? হাহা কি যে বলো তুমি, হা হা খালি!
-তাহলে কফির মগ টা উলটে ফেলো।
-উলটে, এই না না ছিঃ ছিঃ লোকের মাথায় পড়ে যাবে।
-পড়ুক!  যা বলছি করো। নয়ত আমি উপরে আসছি।
-না না করছি ( বলে মগ টা উল্টে দিলাম, কফি ছিল না সে তো আমি জানি, এবার ও জেনে গেল)
ও রক্তচক্ষু দিয়ে একবার উপরে তাকাল তারপর রেগে গজগজ করতে করতে রিক্সা ডাকল।
এই রিক্সা?
হ্যালো তিয়াশা? তিয়াশা?
ফোনের অপারেটর আমাকে লাস্ট কল ডিউরেশন টা দেখালো। তিয়াশা ফোন রেখে দিয়েছে।
ধ্যাত! গেল সকাল।

(দুই)
বিকেলবেলা অনেকবার কল করেও তিয়াশা কে ফোনে পেলাম না। মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ কোথাও নেই। রাগ করলে মেয়েটা ইচ্ছে করেই এমন সাজা দেয়। হুট করেই উধাও হয়ে যায়। তবে সব সমস্যার একটা না একটা সমাধান থাকে, সেটা খুব সহজ নয়ত খুব কঠিন। এই সমস্যার ও সমাধান আছে সেটা খুব কঠিন।
আমি জানি তিয়াশা কই আছে। কি করছে সেও জানি।
একমাত্র সমাধান এখন সোজাসুজি তিয়াশার বাসায় যাওয়া। তিয়াশার আব্বু রিটায়ার্ড কর্নেল জহির উদ্দিন। লোকটাকে কে বলেছিল, বাবা তোমার গোঁফ টা বেশ!
বোঁচা নাকের উপর একগাঁদা পুরু গোঁফ। দেখলে ভয় লাগে। গলার আওয়াজ, সে আর না বলি। আর ওর আম্মু, আমাকে দেখে একদিন খুশী তো অন্যদিন চেনে না।
তাই ইচ্ছেও করে না যেয়ে একবার দেখা করি।
আর এই বিকেলে জহির সাহেব তার আর্মি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ক্যান্টমেন্টে যান। সুযোগ টা ভালো ই অন্ততপক্ষে কড়া কথা শোনা লাগে না।
তারপরেও মন মানানো বলে কথা। উপরওয়ালার নাম নিয়ে বুকে তিনটা ফুঁ দিয়ে বললাম, হে উপরওয়ালা, আজকে যেন কোন গ্যাঞ্জাম না হয়।
ছুটি নিতে গেলাম বসের রুমে।
এসি রুমে স্যার ফ্যান ছেড়ে টেবিলে পা তুলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচ দেখছেন।
-স্যার, একটু! আসবো?
-ও হ্যাঁ সীমান্ত!  এসো, খুব হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ। ৩০ বলে ৩৫ রান। ইচ্ছে করছে অফিসের বস না হলে একদিন ক্রিকেটার হতাম। ইস! কত স্বপ্ন যে অধরা থেকে গেল।
-স্যার!
-কি?  বলে ফেলো সেই কতক্ষণ ধরে স্যার স্যার করে যাচ্ছো? ম্যাচের টেনশন আর তোমার ইতিউতি। বি কুইক!
-স্যার আমি একটু.. ( বলতে গিয়ে থামতে হলো, অফিসের হাবিব ভাই এক ফাইল নিয়ে স্যারের রুমে)
বস হাবিব কে দেখেই, এসো হাবিব! কি হয়েছে?
-স্যার, এই ফাইল টা লাস্ট চেক করতে দেয়া হয়েছিল সীমান্ত কে। আজ চেক করে দেখি তাতে গোটা পাঁচেক ভুল, আমি চেক না করলে একাউন্টস থেকে হাজার বিশেক টাকা এদিকওদিক হয়ে যেত স্যার!
-স্যার, কড়াত করে উঠে দাঁড়ালেন। সীমান্ত? হোয়াট ইজ দিস?
-জ্বী স্যার (নীচু গলায়)
-যাও জলদি এই ফাইল মেলাও।
-স্যার ছুটি
-নিকুচি করলাম ছুটি
-আমার আজ আগে। কাজ শেষ তারপর ছুটি, যাও।
হঠাৎ টিভি স্ক্রিনে ছয় হতে দেখে ই স্যার চেঁচালেন ছয়....য়য়য়..
একেই বলে পোড়াকপালে, উপরওয়ালা আজ আমাকে কোন চান্স দিলেন না। সেই
ফাইল গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যে ৬ টা। ব্যাগ নিয়ে ঝট করে বেড়িয়ে পড়লাম। বৃষ্টি হচ্ছে, আমাকে রাস্তায় দেখে হয়ত তার পরিমাণ এবার দ্বিগুন হলো।
 একটা সিএনজি হাতের ইশারায় থামালাম
-যাবে?
-যামু স্যার, তয় একশ ট্যাকা বাড়াই দিয়েন। বৃষ্টির দিন! নাইলে যামু না।
-আচ্ছা দিব। স্টার্ট দাও জলদি।
ভাবছি, তিয়াশার কর্নেল আব্বু এখনো ফেরেনি, উনি ফিরে আসেন সাত টা কি আট টা। আজ দেরী ই করবেন। বৃষ্টির শুভকামনা করতে করতে পৌঁছে গেলাম তিয়াশার বাসায়।
বেল দিতে ই আন্টি এসে খুলে দিল দরজা।
-সীমান্ত? কেমন আছো? ভেতরে এসো, বসো।
-আন্টি তিয়াশা?
-তুমি বসো, আমি ওকে ডাকছি। তিয়াশা...তিয়াশা.... ডাকতে ডাকতে উনি ড্রয়িংরুম ছেড়ে ভেতরে গেলেন।
আমি বোকাটে হাসি দিয়ে চুপচাপ সোফায় বসে গেলাম। রুমে আর কেউ নেই খুব নিস্তব্ধতা ঘর জুড়ে। হঠাৎ বা'দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আংকেল সোফায় পত্রিকা পড়ছেন।
-কি?
-জ্বী (ভয়ে গলা চেঁপে গেছে আমার)
-কোথা থেকে আসা হলো?
-অফিস! ওই অফিস।
-এতো লেইট!
-কাজ বাকী না মানে ওই চাপ! (মনে মনে বলছি বাপরে বাপ!)
-চা খাও? মানে অভ্যাস আছে।
-জ্বী না।
-আজ আড্ডা দিলেন না? (সাহস করে বললাম)
-আড্ডা শেষ! (চোখ পাঁকিয়ে উত্তর দিলেন, আমিও চুপ করে গেলাম)
হাঁক দিলেন মোটা বাঁজখাই গলায়, সিদ্দিক... চা আন এক কাপ!
তিয়াশা এলো আরো মিনিট পাঁচ পর।
বলল, এসো আমার সাথে।
( এসো আমার সাথে বলবার পর আংকেল একবার আমার দিকে একবার তিয়াশার দিকে তাকালেন, তারপর চোখ যথারীতি পত্রিকায়)
 আমরা দুজন বাড়ির ছাদে এলাম।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে বেশ আগে। এখন রাতের আকাশে অসংখ্য তারা যেন একটার পিঠে একটা বসে আছে। কিন্তু কোন বিবাদ নেই।
তিয়াশা বলল,
-কফি খাবে?
-না থাক! আগে বলো ফোন অফ করে রাখলে তো কারো বেশী খারাপ লাগে এটা তো একজনের জানা উচিত।
-লাগুক!
-সে একজনের খারাপ লাগে না?
-না লাগলে রাগ দেখানো ই বা কেন সে কেউ জানে না!
-আচ্ছা সরি। আর লেইট হবে না।
-প্রমিস?
-না প্রমিস না।
আবার তিয়াশার মুখ ভার।
শোন, কুমড়োপটাশ!  ভারী মুখ করো না বুঝেছো। কাল আমার অফিস ছুটি কাল চলো না ঘুরতে বের হই!
তিয়াশা মুখ ভার কমে নি, ব্যাগ থেকে খচমচে শব্দে গিফটা হাতে তুলে বললাম। এটা তোমার।
কাল রেডী থেকো। এবার একটু হাত টা প্লিজ ধরতে পারি ম্যাডাম?
ওকে কিন্তু কাল লেইট নয়।
ওকে ডান।
(তিন)
সকাল বেলা একজন ব্যাচেলরের জন্য কতটা কষ্টের আর ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার সেটা ব্যাচেলর ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
ডিম মামলেট, সেদ্ধ ভাত তাতে কাঁচা মরিচ। এই হলো সকালের নাস্তা।
আমার রুমে আরো এক বন্ধু আছে। ইশতিয়াক।
শুকনো করে ছেলেটা এখন আইটি জিনিয়াস।
আমার পাশের রুম টা ওর। দিন চারেকের জন্য গেছে কক্সবাজার। অফিস ট্যুর। ও থাকলে মামলেট খাবার মত একটু উপযোগী হয়।
আমি জলদি খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম একটা পাঞ্জাবি'র সন্ধানে। অ্যাশ কালারের একটা পাঞ্জাবি।
তিয়াশা কে দিয়েছি হালকা সাদা আর অ্যাশের শেইড দেয়া শাড়ি। বিকেলবেলা আজ দেরী করা আমার মোটেই চলবে না।
গিফট টা পেয়ে গতকাল রাতে মুঠোফোনে মেয়েটা " ভালোবাসি '' লিখে পাঠিয়েছে।
ভয় করছিল তিয়াশার বাসা থেকে যখন ফিরছিলাম। আমাকে মোটেই পছন্দ করেন না কর্নেল সাহেব। উনার ইচ্ছে কোন এক মেজরের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন। আমার কারনে তার মেয়ের মাথা বিগড়ে গেছে।  আমি অবশ্য লোকটাকে ভয় ই পাই, এমন একজন কেউ ভবিষ্যৎ এ আমার শ্বশুর হবে। ভাবতে ই গলার গলি টা শুকিয়ে যায়।
পাঞ্জাবি টা শেষতক পেলাম একটা ব্রান্ডের শপে। পছন্দের জিনিস পাওয়া আজকাল বেজায় সমস্যা। আর অনলাইনে কিনতে গেলেও ট্রাস্ট ইস্যু। দেখাবে ময়ূর আর পাঠাবে কাকের ছানা!
শপিং শেষ করে ফিরলাম বাসায়। আজ রেডিমেড খাবার এনেছি। কাচ্চিবিরিয়ানি টা ছুটিরদিনে বেশ ভালো লাগে।  জম্পেশ একটা গোসল দিয়ে কাচ্চিবিরিয়ানি টা দিয়ে লাঞ্চ করে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর দিলাম। চিকেন টা ভালো জমেছিল। এরপর তিনটে বরাবর অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে গেলাম।
 (চার)
ঘুম ভাঙল অ্যালার্ম ছাড়া, দেখি ২ টা ৫৭ মিনিট।
অ্যালার্ম টা অফ করে জলদি উপরওয়ালা কে ধন্যবাদ দিলাম, আজ দেরী হলে গেছিলাম! 
পাঞ্জাবি টা গায়ে দিয়ে, জিন্স পড়ে পারফিউম দিয়ে তিয়াশাকে ফোন দিলাম।
হ্যালো?
কোথায় তুমি?
আরেব্বাস! আজ দেখি সাহেব ঠিক টাইমে। এই বের হলাম।
শোন তুমি বাসায় না এসে একেবারে স্ট্যান্ডে যাও। ওখানে কফি শপ, ঠিক দোতলায় সেটা সেখানে বসো। আমি এই লক করে বের হচ্ছি।
আচ্ছা, দেরী করো না কিন্তু!
না!  এই আসছি।
ফুল কিনব ভাবছিলাম, হঠাৎ মাথায় এলো এক দুষ্ট বুদ্ধি। নিজেকে এখন মহা আইডিয়াধারী মনে হচ্ছে। প্লান মত কাজ করলাম।
রিক্সা করে পৌঁছে গেলাম কফি শপে।
শাড়িপরিহিতা আমার চেনা, আমার আজকের টাইম টেবিল তিয়াশাকে মুগ্ধ করেছে। তিয়াশা আমাকে জিজ্ঞেস করল,
-কফি খাবে?
-এই গরমে?
-কোল্ড কফি গাঁধা!
-হুম, হোক।
দুজনে কফির মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে এবার বের হলাম পথে, বললাম নে চল। আমরা আজ আমার সেই ইউনিভার্সিটি তে। তুই আমার জুনিয়র আর আমি তোর সিনিয়র। কেমন হবে বলতো?
ফালতু!
হা হা।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের সুতোবাঁধা তোড়া টা তিয়াশার হাতে দিয়ে বললাম। " তোর প্রিয় ফুল, আসার সময় মনে পড়ল তোকে দেব। তাই সিএনজি করে ইউনিভার্সিটি গিয়ে সিএনজিওয়ালা কে মোটা বখশিশ দিয়ে পাড়িয়ে এনেছি "।
তিয়াশা একটা নীচু হাসিমাখা নজরে আমার দিকে তাকালো। এই নজর টা আমার চেনা, ইউনিভার্সিটি লাইফের সেই প্রথমদিককার কথা।
বললাম, নাও তুই তোকারি শেষ এবার চলো রাস্তাটা পার হই।
তিয়াশা কি একটা ভাবছিল আমিও মোহে ছিলাম তিয়াশার হাত ধরে টান দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে বেপরোয়া একটা মিনিবাস আমাকে ধাক্কা দিল। আমি ছিটকে গেলাম রোডের পাশে। শেষ ঝাপসা চোখে দেখলাম তিয়াশা ছুটে এসে আমার মাথাটা কোলে নিল।
ঘুম ভাঙল পিঠে জোরদার একটা চাপর খেয়ে।
-কি রে?  পড়ে আছিস! গেইট খুলে! চোর এলে?
-কে রে?
স্বপ্ন দেখছিলাম! কে রে?
আরে উঠ! আমি ইশতিয়াক। সেই কখন রুমে এসেছি। এসে দেখি তোর ফোনে অ্যালার্ম বাজছে। তুই ঘুমে তো নিরুদ্দেশ। আমি এদিকে নক করতে করতে টায়ার্ড। বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে, পরে লক ঘুরিয়ে দেখি দরজা খোলা! দরজা খুলে ঘুমাচ্ছিলি কেন হতভাগা? ভূতে ধরেছে নাকি?
ওর কথার গুরুত্ব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, " কয়টা বাজে দোস্ত? "
এই তো! ৩ টে ৫৫ মিনিট!
-কেন? কোন কাজ আছে তোর?
-কাজ মানে!  মহা এসাইনমেন্ট!
-তাহলে পড়ে পড়ে ঘুম কেন? এই বিকেলে কাজ? নিশ্চই তিয়াশা আপি?
আমি চোখটা রগরে নিয়ে মুচকি হেসে বললাম, হুম! বন্ধু। আজ কথা দিয়েছি বাইরে ঘুরবো আমরা দুজন। মাঝ থেকে কি সব আজেবাজে স্বপ্ন দেখছিলাম!
-নে বেড়িয়ে যা, স্বপ্ন দেখা টা এবার ছেড়ে দে।
ভুলভাল স্বপ্নে ডূবে মরিস পরে, আগে সুসময়ে ফিরে আয়। বলতে বলতে টাওয়েল নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল ইশতিয়াক।
আমি ফোন হাতে নিলাম, মুচকি হাসি দেয়া ছবির মেয়েটাকে একটা ফোন দিতে হবে।
মেয়েটি সেই যে বসে আছে আমার অপেক্ষায়।
হ্যালো তিয়াশা?
তুমি রেডী?
উত্তর আসে চটজলদি, "ইয়েস "।
(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...