বুধবার, ১ মে, ২০২৪

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

 

সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google)


পৃথিবী কেন গরমঃ

                      ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ্রিজের কোক আছে। দুটোতেই দুই হাতের দুটো আঙুল অল্প সময়ের জন্য ডুবিয়ে দেখা যেতে পারে। এতে বোঝা যাবে চা গরম এবং কোক ঠান্ডা। এবার দুটো কাপই টেবিলে রেখে দেওয়া যাক কিছুক্ষণের জন্য। কয়েক ঘণ্টা পর আবার আঙুল ডোবালে দেখা যাবে চা আর গরম নেই এবং কোকও আর ঠান্ডা নেই। দুটোই একই তাপমাত্রায় চলে এসেছে, যাকে আমরা ঘরের তাপমাত্রা বলি। ঘরের তাপমাত্রা বলতে আমরা পরিবেশের তাপমাত্রাকে বোঝাই।

গরম চা কীভাবে ঠান্ডা হলো? শুরুতে চায়ের ভেতর এমন একটা কিছু ছিল, যা এখন নেই, একে আমরা তাপ বলি। তাপ একধরনের শক্তি, অন্যভাবে বলা যায় শক্তির একটি রূপ হলো তাপ। আর ঠান্ডা বা গরমের যে অনুভূতি, তাকে বলি তাপমাত্রা। একটি বস্তু শূন্য কেলভিনের (প্রায় মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ওপর থাকলেই তাপ বিকিরণ করতে থাকে। এই বিকিরণের মাত্রা নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার ওপর, বস্তুর তাপের ওপর নয়। বিকিরণ করার মানে হলো, তাপ হারানো। কাপের চা তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে গেছে।

এবার প্রশ্ন হলো ঠান্ডা কোক কীভাবে ঠান্ডা থেকে ঘরের তাপমাত্রায় এল? কোকের তাপমাত্রা কম থাকলেও তা শূন্য কেলভিন নয়। সুতরাং কোকও তাপ বিকিরণ করেছে। তারপরও কোক কীভাবে আগের চেয়ে গরম হলো? কারণ, বস্তু একই সঙ্গে তাপ বিকিরণ করে (এখানে শুধু বিকিরণ অংশটা ধরছি। বিকিরণ ছাড়াও একটি বস্তু আরও দুটি উপায়ে তাপ হারাতে পারে, যেগুলোকে পরিচলন এবং পরিবহন বলে। পৃথিবী কেন গরম, এর ব্যাখ্যার জন্য মূলত বিকিরণই প্রয়োজন) এবং তাপ গ্রহণ করে বা শোষণ করে। কোথা থেকে তাপ গ্রহণ করে? বস্তুর পরিবেশ থেকে। যেমন কোক তাপ গ্রহণ করেছে আশপাশের বাতাস থেকে, আসলে পুরো পরিবেশ থেকেই, যে পরিবেশে আছে টেবিল–চেয়ার, ঘরের দেয়াল। তার মানে কোকভর্তি কাপের আশপাশে যা কিছু আছে এর সব কিছু থেকেই কোক তাপ গ্রহণ করেছে। কোক তাপ হারিয়েছে এবং কোক তাপ গ্রহণ করেছে; কিন্তু কোক বেশি তাপ গ্রহণ করেছে এবং তাপ অল্প হারিয়েছে। সে জন্যই কোকের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চা তাপ বেশি হারিয়েছে এবং অল্প তাপ গ্রহণ করেছে। তাপ বেশি গ্রহণ করবে, না তাপ বেশি হারাবে, তা নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রা এবং পরিবেশের তাপমাত্রার পার্থক্যের ওপর। সারাক্ষণই একটি বস্তু এবং এর পরিবেশের মধ্যে তাপের আদান-প্রদান চলছে। এমনকি যখন বস্তু এবং পরিবেশ দুটোই একই তাপমাত্রায় তখনো তাপের আদান–প্রদান চলছে। এ অবস্থায় বস্তু যে হারে তাপ হারাচ্ছে ঠিকই একই হারে তাপ গ্রহণ করছে। ফলে বস্তুর তাপমাত্রার কোনো হেরফের হচ্ছে না। এর মানে হলো প্রতিটি বস্তুই একই সঙ্গে তাপ হারাচ্ছে এবং তাপ গ্রহণ করছে (তাপ হারাতে হলে বস্তুর তাপমাত্রা অবশ্যই শূন্য কেলভিনের বেশি হতে হবে)।

সূর্যের তাপ বিকিরণ (ছবিঃ Google)


এবার চলে যাই বিকিরণে। বিকিরণ হলো তরঙ্গের মাধ্যমে তাপ নির্গত করা। আলো যেমন তরঙ্গ, ঠিক তেমনি তরঙ্গ দিয়ে একটি বস্তু তাপ বিকিরণ করে। একটি তরঙ্গের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে, একটি হলো এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং অন্যটি কম্পাঙ্ক। বিকিরিত তাপের বেগ আলোর বেগের সমান। তার মানে তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে কম্পনসংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই আমরা তরঙ্গ বা আলোর বেগ বের করতে পারি। শূন্য মাধ্যমে আলো ১ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার যায়।

যেহেতু তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্কের গুণফল একটি নির্দিষ্ট রাশি, যা কিনা আলোর বেগ, শুধু তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা শুধু কম্পাঙ্ক নিয়ে কথা বললেই চলে। আমরা এখানে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে কথা বলব। এখন ইলেকট্রিক হিটারের কয়েলকে গরম করতে থাকলে কয়েল থেকে তাপ বেরিয়ে আসতে থাকবে এবং এর রংও বদলাতে থাকবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। হিটারের কয়েল যত বেশি গরম হতে থাকবে, তত কম দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ বিকিরণ করবে। আমাদের চোখে নির্দিষ্ট সব ধরনের তরঙ্গ দেখা যায় না। সে জন্য অল্প তাপমাত্রায় থাকলে আমরা হাত দিয়ে ধরলে গরম বুঝি, কিন্তু চোখে কোনো আলো দেখতে পাই না। কিন্তু বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে এই আলো ঠিকই দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হলো পৃথিবী গরম কেন?

মজার বিষয় হচ্ছে, কাচের ভেতর দিয়ে সব ধরনের তরঙ্গ যাতায়াত করতে পারে না। সূর্যের আলোর মধ্যে অনেক অনেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ থাকে। এর একটি অংশ আমাদের দেখার কাজে লাগে। সূর্যের আলোর বড় অংশটি সহজেই কাচের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। যার ফলে কাচের জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর আলো ঢুকে পড়ে। এখন ধরি জানালা বন্ধ আছে এবং জানালায় কোনো পর্দা নেই। কাচের জানালা দিয়ে ঘরে আলো ঢুকে পড়েছে। আলোর কারণে ঘরের ভেতরের জিনিস সব গরম হয়ে গেল বা তাপমাত্রা বেড়ে গেল। এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ওরাও বেশি হারে তাপ বিকিরণ করতে থাকে। কিন্তু ওগুলোর তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়তে পারে না। ফলে ওদের বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়, যা কাচের জানালা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে না। তার মানে হলো ঘরে তাপ ঢুকছে (আলো হিসেবে) কিন্তু ঘর থেকে তাপ বেরিয়ে যেতে পারছে না, যদিও তাপের সামান্য অংশ বের হতে পারে। ফলে ঘরের ভেতরটা বাইরের চেয়ে গরম থাকে। ঠিক একইভাবে গরমের দিনে গাড়ি অনেকক্ষণ রোদে থাকলে, গাড়ির ভেতরটা বাইরের চেয়ে অনেক গরম হয়ে যায়। শীতপ্রধান দেশে কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘর বানিয়ে ওর ভেতর সবজি চাষ করা হয়। এগুলোকে গ্রিনহাউস বলে। এ ধরনের ঘরগুলো কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা থাকে বলে বাইরের সঙ্গে বাতাসের আদান–প্রদান হয় না। এতে করে ভেতরে যদি কোনো তাপের উৎস থাকে, যেমন হিটার, তাহলে তাপ সহজে বাইরে যেতে পারে না। যার ফলে ঘরের ভেতরটা বাইরের থেকে গরম থাকে এবং গ্রিনহাউসগুলোকে সবজি চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রায় রাখা হয়। বড় তরঙ্গের আলো যে কাচ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না, এটাও গ্রিনহাউস গরম রাখতে সামান্য একটা ভূমিকা রাখে বটে!

পৃথিবীর চারদিকে যে বায়ুমণ্ডল, তা অনেকটাই কাচের মতো কাজ করে। পৃথিবীর চারদিক বায়ুমণ্ডল প্রায় এক শ কিলোমিটার বিস্তৃত বলে ধরা হয়। কিন্তু এর বেশির ভাগই (ভর অনুপাতে প্রায় ৯০ শতাংশ) আছে ১৬ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে। এর ভেতর দিয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ যাতায়াত করতে পারে, কিন্তু বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ অত সহজে যাতায়াত করতে পারে না। বায়ুমণ্ডলের কারণে সূর্যের আলোর বড় একটি অংশ প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। কিছু অংশ বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে আসে। এতে পৃথিবী (মাটি, নদী, গাছ ইত্যাদি) তাপ গ্রহণ করে গরম হয়। গরম হলেই তাপ বিকিরণ শুরু করে, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়, এদের বেশির ভাগই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবী গরম থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে বায়ুমণ্ডল হলো পৃথিবীর কম্বল, যা পৃথিবীর তাপ ধরে রাখে। এ কারণেই পৃথিবী বেশ গরম, যা আমাদের জন্য সহনীয়। পৃথিবীর চারপাশে যদি বায়ুমণ্ডল না থাকত, তাহলে দিনের বেলায় সরাসরি সূর্যের আলোতে তাপমাত্রা এমন হতো যে আমরা পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম, আর রাতের বেলায় তাপমাত্রা এত কম হতো যে আমরা সবাই শক্ত বরফ হয়ে যেতাম।

বায়ুমণ্ডলে অনেক ধরনের মৌল এবং যৌগ আছে। যেগুলো তাপ চলাচলে ভূমিকা রাখে। এদের মধ্যে একটি হলো কার্বন ডাই অক্সাইড। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে তাপ সহজে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যে যেতে পারে না। ফলে তাপ পৃথিবীতেই আটকা পড়ে থাকে এবং পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের জোগান দেয় প্রাণিজগৎ (নিশ্বাস) এবং কলকারখানা। কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। যেটুকু বাড়বে তা আমাদের সহ্যক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর পানির একটা অংশ জমাট বরফ হয়ে আছে (পর্বতগুলোতে এবং মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ)। সামান্য তাপমাত্রা বাড়তেই জমাট বরফ একটু বেশি হারে গলতে থাকবে এবং নদীপথে এসে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। ধারণা করা হয়, এর ফলে পৃথিবীর নিচু অঞ্চলগুলো ডুবে যাবে। তখন নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। পৃথিবী (আসলে মহাবিশ্বই) চমৎকার একটি তাপীয় সাম্যাবস্থায় আছে, এর সাম্যতা সামান্য নষ্ট হলেই বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে এবং অনেক অনেক দিন পর নতুন করে ভিন্ন একটি সাম্যাবস্থা তৈরি হতে পারে। যে সাম্যাবস্থায় মানুষের অস্তিত্ব না–ও থাকতে পারে।

এখন তীব্র গরম। সারা দেশ জ্বলছে। তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরী। দিনের বেলা বের হলেই প্রচণ্ড গরমের আঁচ লাগছে গায়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদের তীব্রতা যত বাড়ে, গরমে নগরবাসীকে ততটাই গলদঘর্ম হতে দেখা গেছে। পরিত্রাণ কোথায়? কেনই বা বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা?

কেন এবং কিভাবে বেড়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রাঃ

তাপমাত্রার উঠানামা (ছবিঃ Google)


                    উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয় বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড আর অন্য কয়েকটি গ্যাস। প্রায় একশ বছর আগে বিজ্ঞানী স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চলেছে দ্রুত। গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যত পৃথিবীর বড় বিপদ ডেকে আনছে। অতএব সাবধান।”

আরহেনিয়াস ছিলেন একজন সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি ১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯০৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আরহেনিয়াসই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে বাতাসে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সরাসরি সম্পর্ক আছে। বাতাসে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন আছে ৯৯ ভাগ, বাকি এক ভাগের মধ্যে আছে অল্প পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড। ভূপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ নিঃসরণ হয় তা শুষে নেয় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প, পৃথিবীর তাপমাত্রা তাই বেড়ে যায়। এ কারণেই পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে পৃথিবীতে প্রাণ-প্রকৃতির উদ্ভব হয়।

আরহেনিয়াস হিসাবপত্র করে দেখিয়েছেন যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যদি হ্রাস পেয়ে অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি হ্রাস পেতে পারে। এতে পৃথিবীতে আবার বরফযুগ শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে কী হবে? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাবে, জলবায়ুর বড় পরিবর্তন আসবে।

আরহেনিয়াস প্রায় একশ বছর আগেই আমাদের সাবধান করেছিলেন, কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। তাই আজ বিশ্ব উষ্ণায়ন। দেশে দেশে ভয়ংকর ঝড়-বাদল-তুফান-খরা-বন্যা ঘটে চলেছে। অনেক দেশ জলে ডুবে গেছে, ডুবতে বসেছে বহু দ্বীপরাষ্ট্র। পরিত্রাণ কোথায়? তার আগে অন্য প্রশ্ন। কোন কৌশলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল বা সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়? গ্যাসটি তাপ শোষণ করে রাখে বলেই এমনটা ঘটে। কেমন করে?

উত্তর লুকিয়ে আছে গ্যাসটির রাসায়নিক গঠনে। তিনটি মাত্র পরমাণু, একটা কার্বন আর দুটো অক্সিজেন দিয়ে তৈরি রাসায়নিক যৌগ কার্বন ডাই-অক্সাইড। গ্যাসটি শুষে নেয় অবলোহিত আলো বা ইনফ্রারেড লাইট। সূর্যের সাত রঙের বর্ণালিতে দীর্ঘতম তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর। কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। ফলে বাতাস উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না গিয়ে মাটিতে ফিরে আসে, যাকে আমরা গ্রিনহাউস ইফেক্ট বলি। গ্রিনহাউস গ্যাসের অন্য সদস্যও করে এমন কাজ। তবে ভূপৃষ্ঠে তাপ ফিরিয়ে আনার কাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইড আর জলীয় বাষ্পের।

তীব্র দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত (ছবিঃ Google)


আশ্চর্য ঘটনা! নেপথ্যের কারণটাও জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস। বলছেন, বাতাস দুভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হওয়ার সময়- যাকে বলা হয় ‘সিলেক্টিভ ডিফিউশন’ এবং তাপ শোষণ বা অ্যাবজর্পশনের মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদানগুলোয় যেমন দুই পরমাণুর নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনে তাপের প্রভাবে কম্পন ঘটে। অর্থাৎ দুই পরমাণুর মধ্যকার বন্ধনীর কম্পন। ফলে প্রচুর পরিমাণ তাপ শোষণ করতে পারে তারা।
কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প তাপ গ্রহণ করে শোষণ প্রক্রিয়া বা অ্যাবজর্পশনে। এদের (CO2) পরমাণুগুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত বা হিট ইনফ্রারেড অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা একটি অণু তাপমোচন বা ইমিশন করলে আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে। অর্থাৎ তাপ ধরে রাখতে পারে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড অনু (CO2)
তাহলে তাপ থেকে পরিত্রাণ পাবো কীভাবে? পরিত্রাণ গাছের কাজকর্মে। বৃক্ষই পারে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কমিয়ে রাখতে। কেমন করে? বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে নিজের খাদ্য বানায় গাছ, যাকে ফটোসিন্থেসিস বলে। এ প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় অক্সিজেন। বায়ুমণ্ডল শুদ্ধ করার প্রাকৃতিক সম্পদ গাছ, বৃক্ষসমৃদ্ধ অরণ্য।

পরিত্রাণের উপায়ঃ

        এমন জেনেও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, অরণ্য ধ্বংস করছি আমরা। আমাদের দরকার গাছ লাগানো, বৃক্ষ সম্পদ নষ্ট না করা। গাছ লাগানো মানে যে কোনও গাছ। বড় বৃক্ষ না হোক, বাঁশ-ঘাস-লতা হলেও নিজ গুণে সেই উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেবে। অর্থাৎ আমাদের অক্সিজেন জোগাবে, ধরণী শীতল হবে।

পানি পান অত্যন্ত জরুরি (ছবিঃ Google)


গাছ লাগানোর সুযোগ না থাকলে আমাদের অন্য উপায়ও আছে। ফল খেয়ে তার বীজ নষ্ট না করা। বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে মাঠে প্রান্তরে, বাসে বা রেলপথে যেতে যেতে। কিছু পড়বে পাথরে, রুক্ষ মাটিতে। কিছু পড়বে সঠিক মৃত্তিকায়, জন্ম নেবে গাছ।
শহরে নিশ্চিতভাবেই অনেক গাছপালা দেখা যায় না। ফুটপাত, রাস্তা আর উঁচু ভবন শহরের স্বাভাবিক দৃশ্য। এগুলো ইট, সিমেন্ট, কাচ, ইস্পাতের মতো উপকরণ দিয়ে তৈরি। সাধারণত খুব গাঢ় রঙের হয়। কালো, বাদামি আর ধূসর রং দেখা যায়। কালো বস্তু আলোক শক্তির সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে তাপে রূপান্তরিত করে। বিপরীতে সাদা বস্তু আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। আলো তাপে রূপান্তরিত হয় না এবং সাদা বস্তুর তাপমাত্রা তেমন বাড়ে না। শহরের রাস্তা কালো পিচের তৈরি। ছাদগুলো ধূসর আবরণ দেওয়া। উত্তাপের বড় অংশ আসে এসব স্থাপনা থেকে। বিল্ডিংয়ের উপকরণ শহর এলাকায় তাপ আটকানোর আরেকটি কারণ। অনেক আধুনিক বিল্ডিং উপকরণের কারণে পৃষ্ঠতল থেকে পানি ইট বা সিমেন্টের প্যাঁচে পড়ে ওপর থেকেই বাষ্প হয়ে যায়। ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হতে পারে না। গ্রামে উদ্ভিদের মাধ্যমে যেমন এলাকা ঠান্ডা হয়, শহরে বড় জলাধার তৈরি আর মাটি দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে তাপমাত্রা কমতে পারে। তাছাড়া,  বৃক্ষরোপণ ব্যতীত আর কোন দ্বিতীয় এবং কার্যকরী উপায় আপাতত আর নেই।


উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...