সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৩

ছোটগল্পঃ শালা ভূত

 নিপেন বাবু গণিতের শিক্ষক। গ্রামের পরিচিত অতি পুরানো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি সেই যুবা বয়েস থেকে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে চলেছেন। অবশ্য, একটু ঘুরেফিরে দেখলে দেখা যায়, এই স্কুলে গেলো চল্লিশ বছরে বহু শিক্ষক এসেছেন আবার চাকরি ছেড়ে কিংবা বদলি হয়ে চলেও গেছেন তবে বহাল তবিয়ত রয়ে গেছেন নিপেন বাবু। তিনি এই গ্রামের ছেলে। তাই গ্রামের প্রতি তার নাড়ীর টান অসামান্য। সুযোগ থাকার পরেও তাই বদলী নেন নি।



নিপেন বাবু বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান, স্ত্রী ছিল। তিনিও গত হয়েছেন বছর দশেক। ছেলেপেলে নেই, একাকী থাকেন। গ্রামে তিনি বেশ পরিচিত, এক নামে অনেকে ই তাকে চেনে। 

চোখের দেখায় দেখতে গেলে নিপেন বাবুর মুখটা গোলগাল, চোখ জোড়া কুতকুতে ছোট। চোখের সমস্যায় ভুগে এখন চশমা পড়ছেন। মাথার চুল সবিস্তারে পেকে গেছে। বয়েস হলেও যথেষ্ট নিয়ম মেনে চলেন তিনি।

রোজ নিয়ম করে সকালে স্নান করে স্কুলে যান এবং বিকেলবেলা ছুটির পর সোজা বাড়ি ফেরেন। নিজের রান্নাও নিজে ই করেন। আশেপাশে কয়েক ঘর আছে তারা ব্যতীত গ্রামের অন্য লোকজন খুব একটা নিপেন বাবুর কাছাকাছি আসেন না। 

পাশের ঘরের লবন ব্যবসায়ী নগেনের দুই ছেলে। ওরা একবেলা এসে অংক শেখে। বিনিময়ে নিপেন পারিশ্রমিক নেন না। আগে স্ত্রী বেঁচে থাকতে একবেলা ব্যাচ পড়াতেন এখন সেটা নিপেন বাবুর ভাল লাগে না। এদেরকেও পড়ানোর ইচ্ছে ছিল না কিন্তু নগেনের অনুরোধ ফেলতে পারেন নি।

বাড়ির পেছনে সবজি বাগান করেছেন। তাতে বেগুন, পেঁপে তো প্রায়শই হয়। তাছাড়া শীত গ্রীষ্ম বুঝে হালকা আবাদ ও করছেন রীতিমত। রোজকার বাজার খরচা বেঁচে যাচ্ছে। তবে বাজার একদিন করতে ই হয় আমিষের চাহিদা মেটাতে।

গ্রামে একদিন হাট বসে সেখানে ই তিনি তার বাজার-সদাই করেন। এমনি একদিন হাট থেকে সদাই শেষে বাড়ি ফিরছিলেন নিপেন বাবু। তখন প্রায় সন্ধ্যা। মাছের নেশা ধরেছিলো কিছুদিন ধরে। ইলিশ মাছের দাম প্রায় সস্তা। এদিকে দুইদিন আগে বেতন তুলেছেন তাই মাছ কেনার সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছে করলো না। দশাসই একটা ইলিশ কিনে হেঁটে ফিরছেন আজ আর তার হাতে ধরা সাদা চটের থলি থেকে ইলিশের লেজ টা উঁকি দিচ্ছে। এদিকে লেবুর গন্ধে বেলতলা আসার পথ টা ম ম করছে। মন টাও সে গন্ধে ভীষণ খুশী খুশী নিপেন বাবুর। বাড়ি গিয়ে লেবুর সাথে ইলিশের ঝোল! আহা! 

" মাছের রাজা যাচ্ছে বাড়ি

ভেজে খাবো ভাত, হাড়ি হাড়ি " 

মনে মনে ছন্দ বেঁধে আরো উদ্বেলিত নিপেন বাবু।

শ্মশানের পাশের অন্ধকার রাস্তাটা ধরে কিছুটা আসার কিছুটা পরে ই পুরনো কাঁকড় গাছে একটা ডাল ঝাঁকির শব্দ শুনলেন তিনি। 

যা বাবা! বাতাস নেই! মানুষ নেই! ডাল টা ঝাঁকালো কে?

নিপেন বাবুর মন টা একটুপরে ই ছ্যাৎ করে উঠলো। মেছো ভূত নয়তো! ওই বুড়ো বয়েসে ভূতের ভয়! নিজে ই মুচকি হাসলেন একবার। 

মনে মনে বললেন, " না, আর দেরী করা যাবে না।"  ইলিশের ঝোল খাওয়ার তর সইছে না নিপেন বাবুর!

বাড়ি ফিরে ই হাত পা ধুয়ে রান্নাঘরে ছাউনির নীচে মাছ কাটতে বসলেন নিপেন বাবু। একলা মানুষের কাজের সঙ্গী আপাতদৃষ্টিতে কেউ নেই। মাছ কেটেকুটে প্রায় শেষ, তখনি বেড়ার ফাঁকে মাথা গলিয়ে মিউ মিউ.. শব্দে পাড়ার মেনি বিড়াল হাজির। অন্ধকারে সাদা বিড়াল দেখে প্রথমে ভড়কে গেছিলেন তাই বিড়াল টাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "ধুর! ছুঁচা বিড়াল! " 

মেনি বিড়াল রোজ রাতে আসে নিপেন বাবুর খাবার সময়ে। একা সময়ে মেনি বিড়াল টা তার সঙ্গী হয়।

 মাছের কাটাকুটি শেষ করে মাছের আঁশ আর কাটাকুটি বিড়াল কে খেতে দিয়ে মাছ ভাজতে শুরু করলেন এবার। ইলিশের গন্ধে ছোট পাকের ঘরটা ম ম করতে লাগল। জেলের কথায় দম আছে, "বাবু! নিয়ে যান। ভাল মাছ " 

গ্রামের লোক, অবিশ্বাস হয়না কাউকে। মাস্টার মানুষের দাম দিতে জানে এরা। ঠকাবে না এই বিশ্বাস আছে।

মাছে লবণ হয়েছে কিনা একটু চেখে দেখতে যাবেন ঠিক তখনি কণ্ঠস্বর টা শোনা গেলো।  নাকি সুরে কেউ বলছে,

" জামাইবাবু!  একটু দেবেন! অনেকদিন এমন ইলিশ খাইনি।" 

জামাইবাবু ডাক শুনে চমকে নিপেন বাবু এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলেন কাউকে ই দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার গলার আওয়াজ তিনি শুনছেন। 

কে? - জিজ্ঞাসা করে, হাতের কাছে কূপীটা তুলে সলতে বাড়িয়ে চারিদিকে একবার ঘুরিয়ে দেখলেন কেউ আছে কিনা। 

নাহ! কেউ নেই!

খামোখা ভুল শুনেছেন। হয়ত ভুল শুনেছেন ভেবে আবার মাছ ভাজায় মন দিলেন।

মাছ ভাজা প্রায় শেষ তখন আবার অনুরোধ টা এলো। 

" জামাইবাবু!  ও জামাইবাবু!  অবহেলা করেছেন তাইনা! আপন শালা নই বলে এভাবে অগ্রাহ্য করছেন!"

নিপেন বাবু এবার রেগে ই গেলেন, 

"কে রে তুই! আমার শালা ছিল না কোনদিন, শালী আছে, বিয়েও হয়েছে। তুই কে রে? দেখা দে আমাকে!"

আড়াল থেকে জিভ কেটে চুকচুক করার শব্দ এলো। তারপর কেউ  বলল, " না না.. এমন টি ভুলেও বলবেন না, আঁতকে উঠলে অক্কা পাবেন "

নিপেন বাবু বললেন, " আয় না! দেখি! কে তুই! আমার সঙ্গে মশকরা? ঘাড়ে মাথা কয়টা দেখি আয়!"

অন্ধকার ঠেলে যে চেহারা কূপীর আলোয় এলো তা রীতিমত আঁতকে উঠার মত ই। কালো কুচকুচে একটা চেহারা তাতে লাল জোড়া চোখ। কানে মাদুলি, নাকে নথ! 

সেই বিচ্ছিরি চেহারা দেখে আঁতকে উঠে নিপেন বাবু বললেন, " এই!  এই! কে রে তুই? মুখে কালি মেখেছিস কেন? তোর বাড়ি কই? বাবার নাম কি? নিজেকে শালা বলে দাবী করছিস কেন রে?" পেন্নাম স্যার! আমি মেছো ভূত, আগের জন্মের নামটা এখন ভুলে গেছি। সে যাক!  তারপর ফুঁপিয়ে হালকা কেঁদে অভিমান মিশিয়ে বলল, 

" জানেন না তো!  আমার মায়ের। স্বর্গীয় দিপালী দেবীর ইচ্ছে ছিলো তার একটা মেয়ে হবে। কিন্তু মেয়ে আর হলো কই! হলাম আমি। মা তাই শখ করে নাকে কানে অলংকার পড়িয়ে দিতেন মাঝেমধ্যে। আর কি কপাল এই অলংকার নিয়ে ই মরতে হলো। পাড়ার ছেলেগুলো তক্কেতক্কে থাকতো আমার নাম ব্যঙ্গ করতো। দূঃখের কথা কি জানেন স্যার? এই ভূত সমাজেও আমায় কেউ ছেলে বলে মানে না। সেদিনকার ছেলে!  আমার নিয়ে মশকরা পর্যন্ত করে। ব্যাটাছেলে কে এমন ভয় দেখিয়েছি তারপর..(নাকি সুরে হেসে ফেলল মেছো ভূত)

নিপেন বাবু বললেন, 

-তো এবার আমার কাছে কি? 

আপনার কাছে সে আর কি চাইবো স্যার বলুন, ওই ইলিশ মাছের পেটির একটা টুকরা! 

-ওহ, আচ্ছা! মাছ খাবি!

" মশাই! শুনুন! দয়া করে তুই তোকারি করবেন না। মাছ দেন কিংবা না ই দেন। তুই তোকারি করবেন না। আমি কিন্তু গ্রাজুয়েট! "

ভীষণ বিরক্তির সুরে বলল মেছো ভূত।

নিপেন বাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। স্কুলের ৩০০ খাতা দেখা বাকী। মেছো ভূত যদি সে কাজে সাহায্য করে তাহলে মাছের অর্ধেক তাকে খাওয়াতেও রাজী তিনি। যেই ভাবা সেই কাজ।

একটু ভারিক্কি চালে নিপেন বাবু বললেন, গ্রাজুয়েট তার প্রমাণ কই? 

দেখুন মশাই আমি গ্রাজুয়েট সে আপনি যাই বলুন!

নিপেন বাবু বললেন, "মাছ অবশ্যই দেবো! তবে শর্ত একটা আছে "

মেছো ভূত বিরক্ত হয়ে বলল, " মানুষের যা স্বভাব! একটু যদি সৎ হতে পারতো! আরেহ খাওয়াবে যদি সোজাসাপ্টা খাইয়ে দাও বাবা! চলে যাই! তা না! শর্ত দিয়ে খাওয়ানো!"

" আচ্ছা! তাহলে যাও!"- নির্বিকার ভাবে বললেন নিপেন বাবু। 

মেছো ভূত দেখলো মাছের গন্ধটা এসব শর্তের কাছে টিকছে না তখন নিজে থেকে ই বলল, " আচ্ছা বলুন মশাই বলুন! মাটিকাটা, জলভরে আনা, কাপড়কাচা এসব কায়িক পরিশ্রম করতে পারবো না আগেভাগে ই বলে দিচ্ছি! " 

নিপেন বাবু তার শর্ত দিলেন ৩০০ খাতা দেখে দিতে হবে। মেছো ভূত এতে বরং খুশী ই হলো। একরাতে সব খাতা দেখা শেষ করে ফেলল সে। নিপেন বাবুও কথা রাখলেন ইলিশের দুটো পেটির টুকরো তুলে দিলেন মেছো ভূতের হাতে।

পরদিন স্কুলে খাতা জমা দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন নিপেন বাবু। তাকে বদনজরে দেখা বেশ কয়েকজন শিক্ষক ভ্রুকুটি টেনে বললেন, " এও সম্ভব!"

নিপেন বাবু মুচকি হেসে মনে মনে তখন ভাবছেন, যে অংকগুলো আগে করতে অসুবিধে হতো সেসব তিনি নতুন শালাবাবু কে দিয়ে ই করাবেন। তাছাড়া পরীক্ষার খাতা দেখার শ্রম টাও তো লাঘব হতে চলছে। ওরে আমার শালাবাবু জয়তুঃ তারপর কপালে জোড় হাত করে ঠেকালেন দুইবার। 



(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...