রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সায়েন্স ফিকশন গল্পঃ নাবিল ও মঙ্গলের আজব প্রাণী

 



(১)

সন্ধ্যা থেকে ই মাথাব্যথা! এস্পিরিন জাতীয় ওষুধ খেয়েও কূল পাচ্ছেনা নাবিল। রাতের পর রাত জেগে এসাইনমেন্ট করতে হচ্ছে।  বছরের প্রায় শেষ। কিভাবে দেড়টা বছর ভার্চুয়াল ক্লাসে ই কেটে গেলো মহামারি সময়ে, এখনো সেসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে অবাক হচ্ছে নাবিল। এখন স্কুল খুলেছে, সেই সাথে বেড়েছে নানাবিধ ব্যস্ততা। পড়াশোনা এবং কাজ, কোনটা কিভাবে এগিয়ে নেবে সেটা বুঝতে গিয়ে ই বারবার হিমশিম খেতে হচ্ছে নাবিল কে। 

দোতলার জানালার পর্দা ভেদ করে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে ঘরের ভেতর উঁকি দিচ্ছে।

দেয়ালে ঝুলছে ডিজিটাল ওয়াচ। নাবিল একবার ঘড়ির লাল চলমান রেখা গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। রাত ১ টা বেজে ৩৯ মিনিট। যখনি ঘড়ির দিকে নাবিল তাকায়, মিনিটের ঘরে সর্বদা বিজোড় সংখ্য ই মেলে। ব্যাপারটা একেবারে ই কাকতালীয়। 

এতক্ষণ একনাগাড়ে টেবিলে বসে লিখতে লিখতে, সময়ের কাটা চেক করতে ভুলে গেছে নাবিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বইয়ের তাকে সাজানো সায়েন্স ফিকশন বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে কয়েক পাতা পড়তে লাগল নাবিল। নাবিল সায়েন্স ফিকশনের পোকা। ব্যস্ততা না থাকলে বইয়ের তাকে ধূলো জমার সাহস করেনা কোনদিন। তাছাড়া প্রতিদিন কোন না কোন বই নাবিলের হাতে মেলে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়।

নতুন বইটা এবার খুলতে পারেনি এসাইনমেন্টের চাপে। একটা গল্পে চোখ আটকে গেলো নাবিলের। " ইভেগা " নামের এক ভিনদেশী প্রানী'র গল্প। সে নাকি অনেক অনেক দূরের লাল গ্রহ মঙ্গলে থাকে। বিজ্ঞানীরা নাকি তাকে খুঁজে বেড়াছে বছরের পর বছর কিন্তু এই ইভেগা এতটা ই চালাক যে, সে পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত রেখে যায় না মঙ্গলের মাটিতে। সুতরাং সে কিভাবে মঙ্গলে পা ফেলে চলছে সেটা ই আরেক রহস্য। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ইভেগার নয়টা হাত, শরীরের রঙ পাল্টে যেতে পারে চারটে প্রধান রঙে। এমনকি সে অনেকটা গিরগিটির মতন রঙ পরিবর্তনে সক্ষম। চেহারা অক্টোপাসের মতন অখণ্ডিত। এছাড়া, তার আচরণ ও অত্যন্ত রহস্যঘন।

নাবিল আক্ষেপের করুণ সুরে খানিকক্ষণ হাসে। নাবিলের আজ যদি নয়টা হাত থাকতো তাহলে হয়ত এসাইনমেন্ট গুলো দ্রুত শেষ করে পরেরদিন ই স্কুলের ম্যামের হাতে জমা দিয়ে বলতো, " ম্যাম! সব এসাইনমেন্ট শেষ। "

ম্যাগাজিন পড়তে সময় চলে গেলো। ঘড়িতে রাত ১ টা ৫৯ মিনিট।নাবিল ভাবলো, এখন বরং শুয়ে পড়া যাক। রুমের আলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ফ্রেশ হতে গেলো নাবিল।


(২)

নাবিলের রুম খুব একটা বড় নয়। হোস্টেলের রুম। নাবিলের মা বাবা একসাথে থাকে না। দুজনে ই চাকরী করছেন দেশের দুই প্রান্তে তাই ছেলেকে রেখেছেন এখানে। কেবল ঈদ কিংবা পূজার ছুটিতে নাবিল এবং তার পরিবারের মানুষ গুলো একে অন্যের সাথে দেখা করে। হোস্টেলে পাশাপাশি ওর সমবয়সী আরো ছেলে আছে, তাদের রুম গুলোও একেবারে আলাদা। প্রত্যেকটি রুমে একজন করে ছাত্র থাকে। সবার রুমেও আসবাবপত্র সংখ্যা একই।

নাবিলের রুমের ভেতর আসবাবপত্র বলতে আছে একটি মাঝারি উচ্চতার আলনা, একটি টেবিল, একটি চেয়ার, একটি খাট আর টুকিটাকি জিনিসপত্র। এটা তিন তলা বিশিষ্ট একটি হোস্টেল। যেখানে শুধুমাত্র স্কুলের ছেলেরা ই থাকে। একটি রুমের সাথে অন্য রুমের তেমন একটা যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ই এমন ব্যবস্থা।

হোস্টেলে একজন সুপার আছেন তিনি নিয়মিত দেখভাল করেন ছাত্রদের। সকাল- দুপুর- রাত খাবারের ব্যবস্থা করেন। বেশ ভালো ই চলে যায় সবার। ছুটির দিনে কেবলমাত্র ব্যতিক্রম। সেদিন সবার জন্য টিভি, খেলাধুলা করার সুযোগ দেয়া হয়। নাবিল সেদিন টিভি দেখে। তাছাড়া নাবিলের রাতঘুমের সঙ্গী রঙিল মলাট দেয়া সায়েন্স ফিকশন তো আছে ই। পৃথিবীর কোথায় স্বর্ণের খনি, সিঙ্কহোল কি, আফ্রিকা মহাদেশ কি আবার জুড়ে বড় হচ্ছে, সমুদ্রের তলায় কতটা নীচে গেলে মানুষের কিছু হবেনা, কোথায় গেলে হীরে জহরথের দেখা মেলে, কোন নভোচারী স্পেস স্টেশনে গিয়ে বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন কিংবা সাম্প্রতিকতম সময়ে পাওয়া মনোলিথ রহস্য! এসব গল্প পড়তে ওর ভীষণ ভালো লাগে।


(৩)

রুমে ঢুকে ই অদ্ভুতুড়ে এক আলো দেয়ালে দেখতে পেয়ে ভয়ে দেয়ালের একদিকে সটকে পড়ল নাবিল। একটা লালচে বেগুনি আলো। ক্রমশ পুঞ্জীভূত মেঘের মতন ধীরেধীরে বড় হতে হতে সারা ঘরটা সেই আলো দিয়ে রঙিন করে ফেলছে।নাবিল রুদ্ধশ্বাসে সে দৃশ্য গিলে চলছে চুপচাপ কিন্তু চিৎকার করছে না। 

- হ্যালো ফ্রেন্ড, অ্যাই এম ইভেগা, ডোন্ট ইউ রিমেম্বার? ইউ রিড এবাউট মি এ ফিউ মোমেন্টস এগো। 

নাবিল কাঁপা গলায় বলল, 

- তুমি? ইভেগা! যাকে মঙ্গলগ্রহ তে বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছে? আর তুমি এখানে! অবিশ্বাস্য!

- ইয়েস, অ্যাম হেয়ার টু হেল্প ইউ আউট!

নাবিল কয়েক আরো কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা  শক্ত করে দাঁড়ালো। তারপর ধীর গলায় বলল,

- তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছো?

ভীনগ্রহের প্রানী ইভেগা অনেকটা ঘোড়ার ডাকের মতন চিঁহি স্বরে শব্দ করলো। 

নাবিল বলল, 

- এমন শব্দ করছো কেন?

ইভেগা বলল, 

- আমার হাসিতে এমন শব্দ হয়। তোমরা মানুষ, নিশ্চয় তোমরাও আনন্দ পেলে হাসো। আমিও হাসি। তখন এমন শব্দ হয়।

নাবিল অবাক! বলল, 

- সে কি এখন যে বাংলায় কথা বলছো?

- আমি প্রায় ৯০ কোটি ভাষা পারি যার মাঝে বাংলাও আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ইংরেজি তে ই বলবো কিন্তু তুমি বাংলায় বলছো। একে অন্যের সাথে মনের ভাব আদানপ্রদান খুব জরুরি। এজন্য ভাষা একইরকম হওয়া উচিত। 

নাবিলের ভয় অনেকটা কাটল। বলল,

- ম্যাগাজিন এ পড়লাম তুমি অনেক মেধাবী।

ইভেগা চিঁহি শব্দ করলো। তারপর বলল,

- আমাদের কমিউনিটি তে কাউকে মেধাবী বলা হয় না, বলে ইবিউ!

নাবিল একটু হেসে বলল, 

- ইবিউ ইভেগা! ডাবল -ই। আচ্ছা, আমাকে এখন বলতো- তুমি কেন আমার দেশে? আবার এসে ঠিক আমার ঘরে যখন তোমাকে বিজ্ঞানীরা ট্রেস করে পাচ্ছেনা তাহলে আমাকে কেন তুমি ধরা দিচ্ছো?যদি আমি সবাইকে বলে দেই?

ইভেগা বলল, 

- কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কারণ তোমাদের পৃথিবীর প্রায় সবাই অবিশ্বাসী। এক অন্যকে ঠকিয়ে চলেছে দিনের পর দিন। তোমাদের সব কাজের দলিল অথবা প্রমাণ প্রয়োজনীয়। এজন্য কাগজ লাগছে প্রতিদিন, তোমরা গাছ কেটে ফেলছো। জানো ই তো গাছ কাগজ উৎপাদনের একটি প্রধান উপাদান। পরিবেশ বিপর্যয়। কিন্তু আমাদের দেখো। আমাদের দেশে কথা দিলে আমরা কথা রাখি, ডাটা সংরক্ষণ করতে ব্রেইন ইউজ করি। সেগুলো ট্রান্সফার করতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা মিথ্যেবাদী নই। তাই প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। কেউ কাউকে ঠকায় না, আমরা অবিশ্বাস করিনা কেউ কাউকে।

নাবিল কিছুক্ষণ ভাবল তারপর বলল, 

- তোমার কথায় বেশ যুক্তি আছে। আমরা তোমাদের মতন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে সত্যি অনেক এগিয়ে যেতাম।

ইভেগা ক্রস চিহ্ন দেখালো। মানে সে নাবিলের সাথে একমত। তারপর বলল, 

- আজ অনেক দেরী হয়ে গেলো। এবার তোমায় সাহায্য করা যাক।

ইভেগা এগিয়ে এসে নাবিলের টেবিলের দিকে গেলো তারপর অক্টোপাসের মতন নয়টা হাত বের করে নয়টা এসাইনমেন্ট একসাথে দ্রুত লিখে ফেলল মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। যেগুলো আগে ই সমাধান করে রেখেছিলো নাবিল।

নাবিল বলল,

- একি! এসব তো আমার কাজ! 

ইভেগা বলল,

- কাল সব জমা দেয়ার তারিখ তাইতো? লেখা কিন্তু শেষ হয়নি। করোনার কারণে তোমাদের স্কুল বন্ধ ছিলো। এখন খুলেছে।

নাবিল মাথা নাড়ালো।

ইভেগা বলতে লাগল,

- কাল তোমার মা আসবে তোমাকে নিয়ে যেতে। তোমাকে নিয়ে উনি বেড়াতে যাবেন সমুদ্রে। (সম্ভবত ভবিষৎবাণী) 

নাবিলের চোখ চকচক করে উঠলো। 

- সত্যি? 

ইভেগা বলল, 

- হ্যাঁ। আজ আসি। ভোরের আলো আসার দুই ঘন্টা আগে আমাকে মঙ্গলে ফিরতে হবে। ওয়াদার ব্যালেন্স হওয়া জরুরি। 

নাবিল কে ধন্যবাদ দেবার সুযোগ টুকুও দিলো না ইভেগা। জানালা গলে চলে গেল বাইরে তারপর তারা খসে পড়ার মতন ধীর গতিতে চলে গেলো উত্তর দিকের আকাশে। নাবিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আসমানে।

অ্যালার্ম শব্দে নয়, নাবিলের ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, 

- কেমন আছিস নাবিল? 

- মা! নাবিল অবাক। 

তারপর অবাক চোখে বলল, ইভেগা! 

মা প্রশ্ন করলেন, ইভেগা?

বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে পড়ল নাবিল। দ্রুত টেবিলে ঝুঁকে এসাইনমেন্ট গুলো খুলে ফেলল পাতার পর পাতা। সেখানে সব কমপ্লিট। তাহলে, রাতে কি স্বপ্ন দেখেনি নাবিল? হয়ত না আবার হয়ত হ্যাঁ। 



(সমাপ্ত) 


উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...