সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গল্পঃ পয়সা

 (১)

নিশুতি রাত। শো শো শব্দে বাতাস বইছে। হালকা বাতাসে বাতাবি লেবু গাছের ডালটা একটু দূরে ই নড়ে আলোছায়া খেলা খেলছে।

চারিপাশ ফাঁকা। মাঝেমধ্যে মাটির গর্ত থেকে বেড়িয়ে ঝিঝি পোকারা একনাগাড়ে ডাকছে। এমন মৃদ্যুমন্দ আবহাওয়া তে মন উদাসী হয়। আর রাত হলে নানারকম কথা মানুষের মাথায় ঘুরতে থাকে। ঠিক এখন- যেমনটা সগীরের মাথায় খেলা করে চলছে। কথার একটা অংশ দখল করে স্মৃতিময় অতীত।

মানুষের জীবনে এই স্মৃতিকাতরতা -এক অদ্ভুত অসুখ। অতীতের সেইসব কথা ভাবতে ভাবতে আনন্দে -কখনো মুখের চামড়া উদার হয়ে হাসে, আবার কখনোবা চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ে। গ্রামের নাম জনমশীলা। এ গ্রামের বাসিন্দা সগীর উদ্দিন। এখন বন্ধুর সাথে নানান ব্যাপারে কথার আদানপ্রদান করছে সে। বন্ধুর নাম আলমগির, দুজনের বয়েসের ব্যবধান কম। 

সগীর উদ্দিন বলল, " এইখানে এতদিন ধরে পড়ে আছি অথচ আমার ছেলেটা এদ্দিন পর দেশে ফিরেও একবার আমাকে দেখতে আসলো না। " 

অভিযোগের বিপরীতে বন্ধুবর আলমগির নীরব। 

এখানে -পাশাপাশি দুজন। বাসিন্দা আরো আছে, তবে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব বলতে এই দুজনের ই, সগীর এবং আলমগির। 

একসময় দূর্দান্ত প্রতাপ ছিল দুই বন্ধুর। গ্রামে দুজনের দস্যিপনার কথা লোকেরমুখে মুখে ঘুরে ফিরতো। আজ সেসব অবশ্য অতীত। নতুন গাছে সবুজ পাতা দেখলে যেমন মানুষের মনে খুশীর ভাব জাগে, সেই পাতা ই হলুদ হয়ে ঝরে পড়লে আর তার কোন খবর থাকে না। 

সগীর বলতে লাগলো, জীবনের দাম আজ আর নাই আলমগির। দাম থাকতো যদি কিছু করতে পারতা। দুনিয়াদারী তে পরিশ্রম, টাকা এগুলার দাম মানুষের থেকে বেশি। আলমগির কিছু বলে না। সে এখানে আসার প্রথম দিন থেকে ই চুপচাপ। এখনো কিছু ঘটনা তার নিজের ই বিশ্বাস হয় না। পূর্ণিমারাত আসলে সে উদাসীন হয়, নতুন দেয়া বাঁশের বেড়া ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ো কাঁদে। আলমগির এভাবে ই কাঁদতো পৌষের মেলা ফেরত আসার পর। গরীবের ছাওয়াল আলমগির। মেলার সব খেলনা কিভাবে সে একা কিনবে? এত পয়সা তার ছিল না। সগীর বলতো, আমি নাহয় বাঁশি কিনি, তুই আরেকটা খেলনা কিনে নে। দুজনে ভাগাভাগি করে খেলমু!

আলমগিরের সাথে ঠিক এভাবে ই সগীরের বন্ধুত্ব জমাট বাঁধে। কথায় আছে, আত্মার বন্ধু টিকে যায়-হলোও তাই। 

একটা সময় ছোট থেকে বড়, বিয়েশাদি সব ই জীবনের নিয়মে পালন করলো দুজনে। বন্ধুতা টিকে ও রইল দুজনের মাঝে। এরপর বুড়ো হলো, নিজের ছেলেমেয়ে কে বিয়ে দিয়ে হলো নিশ্চিন্ত। সেসব কতদিন -কতশত ঘটনা। 


(২)

রাত বাড়ছে। কুয়াশা হানা দিতে শুরু করেছে গাছের পাতায়। কুয়াশা পানির মতন টপটপ করে ঝরে পড়ছে মাটিতে। ওদের ঠান্ডা লাগছে কি?কথায় আছে- " মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। "

আলমগির আচমকা বলে উঠলো, ওরে! সগীর। সেই যে- বিহানবেলা তে মাছ ধরার কথা তোর মনে আছে রে?

 সগীর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ! এতবড় একটা বোয়ালমাছ ধরার পর দুইটা দিন বাড়িতে মাছের কত প্রশংসা করসে। মাছ ধরাটা একপ্রকার নেশা হয়ে গেছিলো। আহারে দিন ছিল। সগীরের চোখে পানি। দুজনের নীরবতা। 

কিছুক্ষণ পর একদল লোকের গলা আর পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। আগের মতন ই নিশ্চুপ হয়ে গেলো দুই বন্ধু। 

একদল লোক অনেকক্ষণ কান্নাকাটি, হাটাহাটি তারপর দোয়া পড়ে যে যার মতন বাড়ি ফিরলো। এখন রাত নয়টা। ধীরেধীরে রাত বেড়ে চলেছে গ্রামে। তাছাড়া, গ্রামের দিকে রাত নয়টা মানে অনেক। রাত বাড়লে গ্রামের দিকে শিয়াল আসে, ঝিঝি পোকার ডাক বাড়ে। কুকুরগুলো কুঁকিয়ে উঠে শীতের কাঁপনে। ঝোপঝাড় থেকে জোনাকিপোকা দল আলো জ্বেলে দলে দলে বেড়িয়ে আসে। কুকুরগুলো দূরের বাড়িগুলো থেকে থমকে থমকে ঘেউ ঘেউ করে জানান দিকে থাকে ওদের অস্তিত্বের। 

হঠাৎ ভারী গলার আওয়াজে চমকে উঠে সগীর আর আলমগির। 

-স্লামালেকুম! (গলার আওয়াজ নতুন) 

সগীর প্রশ্ন করে, আপনার পরিচয়?

-আমি মোস্তফা! চেয়ারম্যান নূরে মোস্তফা!

আলমগির পাল্টা প্রশ্ন করে, আপনি তো শুনছি প্রায় যুবক!কিন্তু আপনে এইখানে কেন?

-আরেহ মিঁয়া!  এত প্রশ্ন করেন ক্যান? আপনারা কি একলা থাকবেন এক জায়গায় এমন তো কথা নাই। এই জায়গা টাও আমার ছিল। গ্রামের বিরোধী পক্ষ কাইড়া নিছে আমার থেকে, হু!

সগীর মৃদ্যু হাসলো। মনে মনে ভাবলো- এখনো দেমাক কমে নাই চেয়ারম্যান সাবের।

 কথায় আছে ক্ষমতা এক অদ্ভুত জিনিস। 

আচমকা ই একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল সগীর। বলল, আপনে আমারে চিনেন? 

-কে তুমি?

-সগীর! 

-ওহ! চিনছি! তাতে কি?

-চিনলে তো অবশ্যই মনে পড়ার কথা পুকুরপাড় এর জমিটা আপনার ভাই জোর কইরা আমার হাতে টিপসই দিয়া নিয়া নিলেন।

-হ! এগুলা কানাঘুষা! সব বিরোধী পক্ষের কামকাজ! আমার দ্বারা এগুলা হয় না।

আলমগির বাঁধা দিয়ে বলল, " থাম সগীর থাম! এখন একটু শান্তি দে। কি করসে এগুলা কইয়া খামাখা ঝামেলার কি দরকার।"


(৩)


শীতের রাত। হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে পাহারাদার কয়েকবার আলো ফেলে পুরো এলাকা একবার চক্কর দিলো। 

সগীর শুনলো নয়নের মা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রোজ রাতে ই মহিলা একলা একলা কাঁদে। কাজের ধান্ধায় ছেলেটা বিদেশে গেছিলো ওর। সম্ভবত দুবাই, বিয়েও দিয়েছিলো ভাল ঘর দেখে, মেয়েটি সুন্দরি। বিদেশ যাওয়ার মাস খানেক মোটা টাকা বৌয়ের নামে পাঠাতে লাগল নয়ন। সব ই ঠিকঠাক চলছিলো। 

একদিন বৃদ্ধ মা দেখলো বাড়ির বৌ, দুই বাড়ি পরে বাড়ির দুই বাচ্চার বাপের সাথে পালিয়ে গেছে। এতদিন ছেলেটা যত টাকা পাঠাইসে সব নিয়ে ভেগে গেছে। বৃদ্ধা মা একদিন পরে ই শুনলো আরেক খারাপ খবর। নয়ন ছেলেটা উঁচুতলায় কাজ করার সময় অসাবধানতা বশত পড়ে মারা গেছে। খবর শুনে বুড়া মায়ের সেই যে হুশ গেলো। তারপর এখন সে কাঁদে। নয়নের নামে কাঁদে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। 

আচমকা -পায়ের মৃদ্যু আওয়াজ শোনা গেলো। টর্চের আলো হাতে পাহারাদার জয়নাল হাজির। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা! জয়নালের দেখা মিলবে ই এখানে। সে লোকটা ভয়ে কাঁপে তবুও প্রচণ্ড সাহস ওর। টাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে। এখন সে ভয় কে জয় করতে শিখে ফেলেছে।

নয়নের মায়ের কান্নার আওয়াজ কমে যায় কিন্তু থামে না। কান্নার আওয়াজ তীক্ষ্ণ হয়। ভয় পেয়েছে জয়নাল।

কাঁপা হাতে গলায় বাঁধা তাবিজ টা কয়েকবার চুমু দিয়ে বলল, ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! বাঁচাও। তারপর আয়াতুল কুরসি পড়লো। তারপর চাদর টা ভাল করে জড়িয়ে টর্চের আলো ফেলে ঘাসের উপর খসখসে পা ফেলে চলে গেলো অন্যদিকে।

একরাশ নীরবতায় ঢেকে পড়লো চারপাশ। কেউ কোন কথা বলছে না। নয়নের মা এখন নিশ্চুপ। মনে হয় ক্লান্ত হয়ে গেছে। ক্লান্ত হলে সে চুপ হয়ে যায়।


(৪) 

ভোররাত, আলো উঁকি দিবে আরো কিছুক্ষণ পর। ঘুম ভাঙে আওয়াজে।কারো পায়ের শব্দে কেঁপে উঠে আলমগির। ওর কবরের উপরে কেউ এসেছে। হাটাহাটি করছে। চেয়ারম্যান মোস্তাফা ঘুমাচ্ছে। প্রথমদিন এসে ই সবাই কবরে গভীর ঘুমে ঘুমায়। একে বলে " মরার ঘুম! " 

আলমগির মৃদ্যু কাতরোক্তি করে সগীর কে ডাকে। সগীর বুঝতে পারে, সেও ভীতসন্ত্রস্ত। চাপা গলায় বলে, "কে? কারা?"

আলমগির মাথা নাড়ায় ঠিক যেন- সেও জানেনা কিছুই। সগীর বুঝতে পারে। কারা যেন শাবল দিয়ে কবর খুঁড়ছে। মরার পরেও শান্তি নাই। দ্রুত খুঁড়ে ফেলেছে এরা। আলমগিরের কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বের করছে চারজন। আলমগির এখন পুরনো কঙ্কাল। সগীর দেখতে পেলো আলমগিরের ছেলে এসেছে- সাথে নিয়েছে আরো তিনজন কে। ওরা কবর খুঁড়ে বের করে নিচ্ছে আলমগিরের কঙ্কাল।

 বিস্মিত দুই বন্ধু সগীর এবং আলমগির। ওদের লাশ তুলতে এসেছে ওরা। 

চটের ছালায় হাড়গোড় ভরে নিতে নিতে ওরা আলাপ করলো। " আব্বায় বাইঁচা থাকতে এক পয়সা সম্পত্তি দিবার পারে নাই। মইরা গিয়াও কবরের দাম খরচা করাইসে। এখন এই হাড্ডি বেঁইচা যদি কিছু আয় হয়।"

সগীরের মনটা কাতর। বন্ধুর শেষ অস্তিত্ব টা কাটা হয়ে গেছে। এখন ওর কবর খোঁড়া চলছে। আলমগিরের ছেলেটা হয়েছে বেঈমান। কীটনাশক খাইয়ে তার বাবাকে ই কে এই ছেলে মেরে ফেলেছিলো দুই বছর আগে। 



(সমাপ্ত) 

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...