মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০

গল্পঃ গোস্ট রাইটার

রাত আনুমানিক বারোটা, নতুন বছরে ম্যাগাজিনের কাজ সেরে কুষ্টিয়া যাবার টিকেট করেছি। লালনের মাজার দেখার ইচ্ছে অনেকদিন আগে থেকে। সাধক মানুষদের প্রতি আমার মন বেশ দূর্বল, তাদের কে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। লালনের মাজারে দিন তিনেক কাটিয়ে আবার ফিরে আসবো। 
শহরে শৈত্যপ্রবাহ চলছিল গত তিনদিন ধরে, আজ সূর্য নতুন বৌয়ের মতন দিনের ঠিক শেষভাগে এসে উঁকি দিয়ে গেছে পিচঢালা শহরের এঁটো দেয়ালে। তাই শীতের উপদ্রব খানিকটা কম। বাসস্ট্যান্ডে এখন কেবল আমি ই একা। দূর থেকে মাইকে গান বাজছে আর তার ই ক্ষীণ সুর ভেঙে ভেঙে শোনা যাচ্ছে মাঝেমাঝে। দুই একটা কুকুর দলবল নিয়ে ঘুরে চলেছে আমারি ঠিক আশেপাশে।
কপাল ভাল, ঠিক যেখানে বসে আছি সেটা একটা টঙ দোকান। দোকানি জুবুথুবু হয়ে হাঁটু মুড়ে দিব্যি একটা বিড়ি ফুঁকছে। কেটলি টা তার ধোঁয়া তুলছে। খদ্দের না থাকলেও এখন শীত থেকে বাঁচতে এটা ই একমাত্র উপায় এই লোকটির কাছে। 
" আপনার কাছে কি চা হবে? " জিজ্ঞেস করতে ই দোকানি চাচাজান মাথা নাড়িয়ে জানাল হবে।
" ভাইজান, কই যাবেন? " পাল্টা একটা প্রশ্নও করলো সে
বললাম, " কুষ্টিয়া! "
প্রত্ত্যুত্তরে মৃদ্যু হাসল তারপর চিনি আর দুধ মিশিয়ে চা চামচের টিংটিং শব্দে কাঁচের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে দ্রুত বসে গেলো আগের জায়গায়। চা হাতে নিতে ই বুঝলাম এখন শীত বাড়ছে। টঙের ছাউনিতে বসে ও এখন শীত কানের ভেতর ঢুঁকে মগজে সুতীব্র আঘাত করছে। 
চায়ে চুমুক দিচ্ছি। দুজনে ই বেশ চুপচাপ। চা দোকানি কে দেখলাম হাতের স্মার্টফোনে ব্যস্ত। বাসের সুপারভাইজার এর মাঝে এসে বার কয়েক আমার খোঁজখবর নিলেন। পথে কোথাও এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই বাস আসতে লেইট। তবে আর বেশীক্ষণ হয়ত লাগবে না। কাপ টা শেষ করে বসেছি। শরীরে চাঁদর টা টেনে বসলাম। মনে হলো কাউন্টারে বসে থাকলে ই বেশ হতো। তবে সেখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না।
" আপনি বিভূতি? " আচমকা নির্জন এক বাসস্ট্যান্ডে এমন কেউ নাম ধরে ডেকে উঠতে অবাক এবং একইসাথে বিস্মিত হলাম।
" আপনি আমাকে চেনেন? " প্রশ্নটা করে ফেললাম
লুঙ্গী এবং রঙচটা একটা সোয়েটার গায়ে একজন মানুষ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমার। বয়েস আন্দাজ ত্রিশ। হালকা পাতলা গরণ। মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ। ইশারায় হাত দেখিয়ে পাশের ফাঁকা বেঞ্চি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলো বসবে কিনা?
আমি "হ্যাঁ" সূচক মাথা নাড়লাম।
সে বসে ই বলল, " আপনার লেখা আমি পড়েছি। আপনার লেখার ভক্ত আমি। বেশ কয়েকটি লেখা আসলে অনেকগুলো লেখা ই আমার পড়া। কয়েকটি গল্পের নাম ও সে বলে দিলো ঝটপট করে। আমি ততক্ষণে খুশীতে গদগদ দশা। এই নির্জন স্ট্যান্ডে, এই মাঝরাতে, ঠিক এভাবে কোন লেখক ভক্ত খুঁজে পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। আমি চা অফার করতে ই সে অবশ্য মানা করল। দোকানি কে এক পলকে দেখলাম কানে হেডফোন গুঁজে ভিডিও দেখতে ব্যস্ত। তাই আবার কথায় ডুবলাম দুজনে।
কথায় কথায় পরিচিতি বাড়ল। জানলাম সে ও আগে টুকটাক লিখতো। তবে সাহস করে বই বের করেনি। তাতে নাকি মেলা ঝামেলা। সে একটা গল্প বলতে চাইল তখন। আমি একবার শরীরে চাদরটা ভালোমতোন জড়িয়ে ঘড়ি দেখলাম রাত ১ টা বাজতে দুই মিনিট বাকী। এর মাঝে বাস এলে উঠে পড়বো ততক্ষণ এই ভদ্রলোকের গল্প শোনা যাক।
তখন প্রায় নব্বই দশক, বাড়িভাড়া পাওয়া ব্যাচেলরদের জন্য প্রায় একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মতন। তবে সে ছেলেটি বাড়ি ভাড়া পেয়েও গেলো।
"ছেলেটি? " -প্রশ্ন করলাম
সে বলল, " হ্যাঁ, সদ্য অনার্সে পা দেয়া। তখন সে বাংলা সাহিত্যে পড়ছে। পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ এসব লেখাতে ও মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক। তবে মজার ব্যাপার হলো তার লেখা সে নিজেই পড়ে, কোথাও ছাপানোর নাম করে নি।
"কেন? " 
এর কারন অবশ্য তার সহপাঠীরা। ওরা লেখালেখি পড়ে ই হাসাহাসি করতো। তাই নিজের নামে যেখানে কলেজ ম্যাগাজিন কিংবা অন্যত্র লেখা জমা দিয়েছে বন্ধুরা নাম দেখে ই রিজেক্ট করে দিয়েছে। তাই একেবারে ওর নাম হয়ে গেলো মিস্টার রিজেকশন। এই নামটি আরো প্রকট হলো ঠিক যখন একটি পত্রিকায় ওর নিজের পাঠানো একটি লেখা রিজেক্ট হলো। রুম শেয়ার করে থাকা ছেলেটি নাকি এটি ছড়িয়ে দিয়েছে। 
আমি জিহ্বা ' চুকচুক ' শব্দ করে বললাম, " ডি মোটিভেশন " অনেক বাজে একটা কাজ। তারপর?
ছেলেটি লেখালেখি ছেড়ে দিলো কিন্তু সহপাঠীরা খোঁচা দিতে ই থাকল। তারপর অনার্সের মাঝামাঝি সে ফেইল করে বসল। পড়াশোনায় সে ভাল ছিল কিন্তু ডিপ্রেশন তাকে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে দিলো না। যেখানেসেখানে তাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাসা বাড়তে লাগল, এমনকি জুনিয়র স্টুডেন্টগুলোও হাসাহাসি তে মেতে উঠল। 
এই বলে ভদ্রলোক দম নিলেন। আমি অবশ্য তলেতলে গল্পটায় যেমন বিরক্ত বোধ করছিলাম তেমনি এসব বিষয়ে রাগ ও হচ্ছিল। 
ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন, " একদিন রুমমেট বাড়ি যাওয়ার পর ঘর ফাঁকা পেয়ে ছেলেটি আত্মহত্যা করে বসল। "
আমি অবাক! ডিপ্রেশন একজন মানুষ কে কোথায় টেনে নিয়ে যায় বুঝতে পারলাম। 
" তারপর? "
রুমমেট যখন ফিরে এলো। ততদিনে ছয়দিন কেটে গেছে। দড়িতে ছেলেটি তখনো ঝুলছিল। দরজা ভেঙে পুলিশ ঢুকল এবং ছেলেটিকে পাওয়া গেলো সিলিঙ ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়। মাসের মাঝামাঝি সময় আর শীতের দিন থাকায় গন্ধ বেশী ছড়ায় নি আর কেউ এসে দরজায় নক ও করেনি। কেবল সাথের ছেলেটি এসে প্রথমে এই অবস্থা দেখতে পায়। পুলিশ সিলগালা করে দেয় রুমটি। কিন্তু আগে ই বলেছি ব্যাচেলরদের জন্য বাড়িভাড়া পাওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। তাই অন্য ছেলেটি কন্সটেবল কে ঘুষ দিয়ে রুমের চাবিটা ম্যানেজ করে ফেলল। কিন্তু রাতে তার হলো অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সুইসাইড করা ঘর এমনিতে সাহস না থাকলে কেউ থাকতে চায় না যদি না ভূতে ভয় থাকে। তবে মাঝরাতে মৃদ্যু কান্নাজড়িত হাসি শুনে এবং টেবিল চেয়ারের অবিশ্বাস্য নড়াচড়া দেখতে পেয়ে ঐ ছেলেটি মাঝরাতে ই ছুটে বেড়িয়ে গেলো।
আমি মনে মনে ভাবছি এই রাতে আমাকে স্ট্যান্ডে একা পেয়ে ভূতের আজগুবি গল্প শোনানোর ইচ্ছে টা এই লোকটির ভাল ই ছিল তবে হিন্দী ভূতুরে মুভির মতন এই গল্পটিও আমার কাছে অখাদ্য ই লাগল। আমি উঠে পড়ছিলাম ঠিক তখনি সে বলল,
" এতে আসল অংশ টা শুনে নিন। ভাববেন না গল্পটি শেষ "
আমার অবশ্য উঠে পড়তে ইচ্ছে করছিল। এই গল্প এখন বিরক্তিকর লাগছে।
ডিসেম্বর ২২, পত্রিকার পাতায় একটা লেখা বেড়িয়ে এলো। লেখকের নাম জানা গেলো না তবে লেখাটি চমৎকার। একটি ছোট গল্প। পত্রিকা অফিসে এসেছিল আরো কয়েকশ লেখার মতন করে ই। কিন্তু লেখা পাওয়া যাচ্ছিল না বলে এই লেখাটি বিভাগীয় সম্পাদক তার অংশে ছাপিয়ে দেন। সাড়াও পেলেন। এই লেখকের নাম এবং একইসাথে লেখার আবদার এলো। তবে লেখাটির প্রেরকের কোন ঠিকানা থাকতো না। কৌতূহলী হয়ে বিভাগীয় সম্পাদক একবার সিলমোহর দেখে চিঠি জমা পড়া সে ডাকবিভাগের অফিসে গেলেন কিন্তু তারা ও সেখানে উপযুক্ত কোন তথ্য দিতে পারলেন না। তবে মজার ব্যাপার হলো এই লেখা মাসে কেবল একবার ই আসতো। পাঠকের যেমন অপেক্ষা বাড়তো তেমনিভাবে পত্রিকার সেই বিভাগীয় সম্পাদকের। তারা আর না পেরে এবার লেখকের নাম দিলেন, " গোস্ট রাইটার।"
আমি এবার মনে হলো মজা পেলাম তবে নিতান্ত গাঁজাখুরি গল্প হলেও বেশ মুখরোচক লাগছে।
সে বলতে লাগল, এখন সে গোস্ট রাইটারের নাম ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। বেশ কয়েকজন নামকরা প্রকাশন থেকে পত্রিকা অফিসে লোক এলো বই ছাপানোর অনুরোধ করে। কিন্তু গোস্ট রাইটারের ঠিকানা তো দূর! তার টিকিও খুঁজে পায়নি পত্রিকা অফিস। এর মাঝে কিছু উটকো লেখক নাম কামানোর ধান্ধায় নিজেদের " গোস্ট রাইটার " বলে পরিচয় দিতে শুরু করলো। পত্রিকার সম্পাদক পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। এত হাঙ্গামার মাঝে অদ্ভুত আরেকটি ঘটনা ঘটল, মাসে মাসে লেখা আসতো সেটিও মাস দুয়েকের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। যদিও তৃতীয় মাসে গোস্ট রাইটারের ছদ্মবেশে একটি লেখা সেই পত্রিকা অফিস ছেপেছিল তবুও পাঠকের চোখে ধূলো তারা দিতে পারল না। 
" এরপর? মানে গোস্ট রাইটার এসব জানতে পারেনি?" - প্রশ্নটা করলাম আমি
হ্যাঁ, এরপর ই ঘটনাটা ঘটল। বিভাগীয় সম্পাদক বেশ মোটা বকশিশের লোভ দেখিয়ে বেশ কয়েকজন ডাকপিয়ন কে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে এলাকা থেকে চিঠিগুলো আসতো ঠিক সে এলাকার ঠিক কোথায় সে চিঠিগুলো ড্রপ হয় দেখতে। পাওয়া ও গেলো। মাস ছয়েক পরে একটা চিঠি পাওয়া গেলো। তাতে সে লিখেছে গোস্ট রাইটার নামটি ওর পছন্দ হয়েছিল কিন্তু এতসব নকল গোস্ট রাইটারের প্রতাপে আর তার লেখার ইচ্ছে নেই। সে যা চেয়েছিল তা নাকি সে পেয়ে গেছে। বিভাগীয় সম্পাদক চিঠি নিয়ে ছুটলেন সেই এলাকায় ডাকপিয়ন যারা ছিল তাদের কাছে। পাওয়া গেলো সেই ডাকবাক্স আর বাড়ি তবে সে বাড়ির দোতলা এখন ফাঁকা কেউ থাকে না তবে নীচতলাতে একজন কে দেখা গেলো। তিনি গামছা পড়ে দাঁত মাজছিল। তাকে পেয়ে ই সে সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি লেখেন? মানে লেখালেখি করেন?
" না! লিখি না - আমি আঁকি, রিক্সার পেছনে "
সম্পাদকের মুখে তখন জয়ের হাসি সম্ভবত তিনি গোস্ট রাইটার কে পেয়ে গেছেন। লেখা ছাপানোর প্রাইজ মানি বের করে লোকটির হাতে দিয়ে তিনি বললেন এই নিন আপনার পাওয়া। টাকা হাতে পেয়ে ফেনাসুদ্ধ মুখে হেসে বলল, টাকা দিসেন ভাল হইসে কিন্তু আসলে ই আমি গোস্ট রাইটার না!
আপনি একা ই থাকেন? অন্য কেউ কি লেখে? 
ঐ লোক জানালো আরেকজন আছে সে অফিসে চাকরী করে তাকে কোনদিন সে লিখতে দেখেনি সে নিজেও। 
কিন্তু ভাই লেখাটা দেখা যায়?  যদি সাথে এনে থাকেন?
সম্পাদকের পকেটে পুরনো একটা সংখ্যা ছিল ভাঁজ করে রাখা, সেটা বের করে হাতে দিতে ই ঐ ভদ্রলোক চোখ বড়বড় করে বলল, " এইটা তো অসম্ভব! "
"মানে?"  বিভাগীয় সম্পাদক অবাক।
এইটা তো আমাদের উপরে যে আত্মহত্যা করছিল তার ই লেখা!
বিস্ময় সম্ভবত তখনো কাটেনি ঐ দুজনের।
হঠাৎ পেছন থেকে দোকানি আমাকে ডাক দিয়ে বলল, " ভাই! কার লগে কথা কন?"
আমি পাশ ফিরে দেখি সেখানে কেউ নেই।
বিস্ময়ভাব টা আমার যাচ্ছে না, দোকানি বলছে, " আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনারে ডাকতাছি ভাই। আপনি দেখি একলা একলা কথা কইতাছেন। আমি ভাই বাড়ি যামু দোকান বন্ধ করে ফেলছি আপনি মনে হয় খেয়াল করেন নাই!"
আমি হাতের ব্যাগ চেপে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বাসের আলো স্ট্যান্ডে এসে পড়েছে। দ্রুত বাসে উঠলাম। বাস সাথে সাথে ছেড়েও দিলো। অস্বস্তি হচ্ছিল। ব্যাগের সাইড চেইন খুলে পানির বোতল বের করতে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা কাগজ। তাতে লেখা, লেখাটি কোথাও যায়নি ছাপানোর জন্য। সুইসাইডের ঠিক আগের রাতে লেখা। পছন্দ হয়ে থাকলে ছাপিয়ে দেবেন।
" with love গোস্ট রাইটার। "

(সমাপ্ত)


(গল্পের সমগ্র চরিত্র এবং ঘটনা সম্পূর্ন কাল্পনিক এর সাথে জীবিত, মৃত, অর্ধমৃত কারো কোন মিল নেই। যদি মিলে থাকে তা একান্ত কাকতালীয়)  

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...