(এক)
মিস অর্পার আজ শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে দ্বিতীয় দিন।
প্রথমদিনটি একটু ভিন্নভাবে ই কেটেছে। সেদিন ছিল শুধু টিচার্স পরিবারের সাথে পরিচয়পর্ব।
ক্লাস নিতে হয়নি।
আজ তাই, আনুষ্ঠানিকভাবে
মিস অর্পার শিক্ষকতা জীবন শুরু।
বেশ পরিপাটি। কালো শাড়ি,
কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগ, কপালে কালো টিপ। কালো আজ বেশীমাত্রায় অগ্রাধিকার পেয়েছে অর্পার
কাছে।
ঢাকা শহরের হাতে গোনা
কয়েকটিমাত্র স্কুলের এটি একটি। শহরের নামকরা প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অর্পার
দায়িত্ব, তিনি আজ থেকে এই ক্লাসের ক্লাস টিচার।
স্টিলের ফটক টা পায়ে
হেঁটে ক্রস করতে ই চোখে পড়ে মেইন ভবন। স্কুল টা তিনতলা, বাইরে সাদা রঙের দেয়াল আর ভেতরে
হালকা একটা গোলাপী রঙ দেয়া। পাশে দু'সারি ধরে রকমারি ফুলের গাছ। ছোট একটা প্লে-গ্রাউন্ড
আছে স্কুল করিডোরে। সেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। বেশ সাজানো।
' গুড মর্নিং ম্যাম!
' সমস্বরে বলে উঠল খেলাধুলায় মেতে থাকা কিছু ছেলেমেয়ে। অর্পা হাসিমুখে সবাইকে হাত নেড়ে
মর্নিং বলে দিলেন।
এরপর,
টিচার্স রুমে সবাইকে
' গুড মর্নিং ' জানিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের রুম হয়ে নিজের ক্লাসের উদ্দেশ্য চলল অর্পা।
প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন,
" গুড লাক অর্পা, অ্যাই হোপ ইউ উইল এঞ্জয় "
' থ্যাংকইউ ম্যাম ' ছোট
হাসি।
লম্বাটে করিডোর ক্রস
করে ছোট হিল দেয়া জুতোর শব্দ তুলে ক্লাসে এসে ঢুকল অর্পা। সাথে সাথে আবারো সব কয়টা
বাচ্চা বলে উঠল " গুড মর্নিং ম্যাম "। ছোট করে হাসি দিয়ে দুহাতের ইশারায়
সবাইকে বসতে বলে নিজেও চেয়ার টেনে বসে গেল অর্পা।
ছোট রুমের ভেতর সারিসারি
বেঞ্চে মিষ্টিমিষ্টি একগাদা মুখ। কেউ মুখে আঙুল দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে, কেউ মুখ টিপে
হাসছে আবার কেউ কেউ অবাক হয়ে তাদের নতুম ম্যাম কে দেখছে। তাই খুব বড় কিংবা খুব ছোটদের
ক্লাস এটি সেটাও বলা প্রায় ঠিক না, এটা আসলে প্লে-ওয়ান। খুব ছোট ছোট কোমলমতি বাচ্চারা
আজ তার ছাত্র-ছাত্রী।
ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করার পর অর্পা যখন জবের বাজারে
একেবারে হতাশ, ঠিক তখনি বেসরকারি এই স্কুলের চাকরী। মন্দ কপালিনী হবার আগে অন্তত বেঁচে
থাকার জন্য একটু যুদ্ধ অর্পার জন্য। যদিও মা-বাবার একমাত্র কন্যা অর্পা। তবুও নিজের
খরচ নিজে চালাতে স্বাধীনতা আছে।
বাচ্চারা কেউ ম্যাডামের
দিকে তাকিয়ে, কেউ খেলছে, কেউ মারামারি!
ম্যাডাম অর্পা প্রথমে
খুশী হলেও এবার কিন্তু বাচ্চাদের হট্টগোলে তার মাথা নড়ে গেল। জোর গলায় বলে উঠলেন,
' সবাই চুপ, মুখে আঙুল! '
থেমে গেল সবাই।
আজ তোমাদের কে পড়ানো
নয়, সবার সাথে গল্প! কিন্তু চুপ করে, ঠিকাছে?
সমস্বরে চেঁচিয়ে, ' ইয়েস
ম্যাম!'
অর্পা ম্যাম কে তাই আবারো
হাত নেড়ে ইশারায় চুপ করতে বলতে হলো।
শোন সবাই, তার আগে রোল
ডাকা হবে ওকে?
ওকে ম্যাম, বলে কয়েকটা
দুষ্টু হিহি করে হেসে উঠল।
অর্পা মেজাজি হয়ে, '
এই চুপ! নো ফিসফাস '।
রোল ডাকতে শুরু করলেন
অর্পা। ওয়ান, টু....
ক্লাসের ভেতরটা বেশ সাজানো, দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেইন্টিং।
বাংলা, ইংরেজী অক্ষরের চার্ট। একটা হোয়াইট বোর্ড। এসি দেয়া রুম তাই বাড়তি কোন জানালা
নেই।
মেয়েদের বেঞ্চিগুলো ক্লাসের
ঠিক ঢুকতে বা'দিকে আর ছেলেদের সারি টা ডানে। খোলা চোখে আর কতই বা ছাত্রছাত্রী আছে মনে
হবে? চোখের আন্দাজে হবে এই পচিঁশ-ছাব্বিশ!
নাহ। কাছাকাছি ধারণা!
মিলল না!
রোল ডাকা শেষে দেখা গেল
পাক্কা ৩১ জন।
অর্পার মনে হুট করে অবান্তর
এই প্রশ্নটা তাড়া দিল, কেন জোড় সংখ্যা নয়? ৩১! ৩০ কেন নয়! ক্লাসে ৩১ জন ছাত্রছাত্রী।
সে যাই হোক,
রোল ডাকার খাতাটা বন্ধ
করে অর্পা ডাকল,
রোল ১!
' ইয়েস ম্যাম ' বলে সামনের
সারির একটা বাচ্চা মেয়ে হাত তুলে তার ম্যাডামের দিকে মিষ্টি করে হেসে দিল। ম্যাডাম
ওর দিকে তাকিয়েও একটু খুশী চোখে হেসে ফেললেন।
ইউর নেইম?
মাই নেইম ইজ অকৃতি প্রধান।
মেয়েটি যে খুব একটা ক্লাস মিস করে না রোল ডাকার খাতাটা
কয়েক পাতা উলটে সেটাও এক মুহুর্তে দেখে নিলেন অর্পা।
ফিরতি একটা হাসি দিয়ে
তাই ছোট করে বললেন, ' তুমি আমাদের একটা রাইম শোনাও '
মুখ টিপে একটু হেসে ঝট
করে,
" জনি জনি ইয়েস পাপা
টেলিং লাই, নো পাপা "
রাইম টা এক নিঃশ্বাসে
শুনিয়ে দিল মেয়েটি।
অর্পা বলল, ভেরী গুড।
হাততালি দিয়ে উঠল সবাই।
অর্পা বলল, ' এবার র্যান্ডমলি
রোল ডাকব আর যার রোল আসবে সে কিছু না কিছু শোনাবে, ঠিকাছে? '
সবাই একসাথে বলে উঠল,
' ইয়েস ম্যাম! '
নাউ রোল নাম্বার ৩১
শেষ রোলের ছেলেটি একেবারে
পেছনে বসা। বেশ ক'বার ডাকার পরেও সে সহজে তাতে সাড়া দিচ্ছিল না। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল সে টেবিলে নীচু হয়ে কিছু
একটা পেন্সিল দিয়ে লিখছে।
পেছনের সারিতে বসে একটা
ছেলে এতটা অমনোযোগী হতে পারে, অর্পা নিজেও সেটা ভাবতে পারেনি। দুই তিনবার ডাকার পরেও
যখন সে উত্তর দিচ্ছিল না, তখন অর্পা খুব রেগে চেয়ার ছেড়ে পেছনে চলে এলেন। ক্লাসের আর
সব বাচ্চারা ম্যাডামের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
অর্পা রাগী চোখে দেখল,
খুব মনোযোগ দিয়ে স্কুলের খাতায় পাখির ছবি আকঁছে সে। ম্যাডাম পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তবুও
ওর ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই ছেলে! শুনছো?
এই! এইদিকে তাকাও!
ছেলেটি নাক চুলকাতে চুলকাতে
একেবারে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে ম্যাডামের দিকে ফিরল। যেন সে কিছুই শুনতে পায় নি, সে ক্লাসেও
নেই এমন হাভভাব তার।
ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস
করল, ' নাম কি তোমার? '
ম্যাডামের দিকে একবার
তাকিয়ে সাথে সাথে মাথানিচু করে আবার বেঞ্চে ছবি আকাঁয় মন দিল সে।
নাম কি? বলে আবার জিজ্ঞেস
করতে ই ছেলেটি আলতো ভাবলেশহীন গলায় বলল, অন্তু!
অর্পা এবার ধীর গলায়
বলল, ' রোল ধরে ডাকলে, উত্তর দিতে হয় তাইনা?'
দিয়েছি তো ম্যাম!
দিয়েছো! মিথ্যে বলছো!
ছেলেটি এবার বসা থেকে
উঠে দাঁড়াল। মাথা নীচু।
আচ্ছা, এরপর গলা উঁচু
করে দেবে, ঠিকাছে?
ছেলেটি মুখে আর কথা বলল
না, শুধু মাথাটা খুব বাধ্য একটা বাচ্চার মত একদিকে কাঁত করে বুঝালো সে এরপর থেকে ম্যামের
কথা শুনবে।
অর্পা ফিরে এল তার চেয়ারে।
ক্লাসের কিছু মেয়ে মুখে হাত চেপে ম্যাডামের দিকে ফিরে ফিরে অবাক চোখে তাকিয়ে হাসছে
আর ফিসফিস করে নিজেদের মাঝে কথা বলছে।
অর্পা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে
বলল, ' সাইলেন্স! প্লিজ! ' ক্লাশ টা শান্ত হয়ে গেল মুহুর্তে।
ত্রিশ মিনিটের ক্লাসে
রোল ডাকতে গিয়ে চলে যায় মিনিট দশের বেশী তার ওপর অমনোযোগী ছাত্রছাত্রী থাকলে তো কথাই
নেই। সামনে আরো কি কি হবে কে জানে!
এই রাইম টা সবাই বই খুলে
বের করো, পেইজ নম্বর ফোর। রাইমের লাইন চারেক
পড়াতে না পড়াতে ক্লাসের শেষ ঘন্টা বাজল।
রোল ডাকার খাতা আর নিজের
ব্যাগপত্র তুলে অর্পা বলল, ' শোন, কেউ আর হইচই করবে না। সবাই একে একে লাইন করে ধীরেধীরে
চলে যাবে, ঠিকাছে?'
সবাই সমস্বরে ' ইয়েস
ম্যাম!! ' বলে উঠলেও কাজে তার বিন্দুমাত্র প্রমাণ পাওয়া গেল না। সেই হইহই করেই সবাই
ক্লাস ছাড়ল। সবাই চলে গেলেও অর্পা দেখল সেই রোল ৩১ এখনো বসে। ওর চেহারায় কোন চাঞ্চল্য
নেই! সে আগের মত বসে। অর্পার মনে মায়া হল। হাতের ব্যাগ, রোলের খাতা টেবিলে রেখে আবার
মৃদ্যু পায়ে হেটে পেছনের বেঞ্চটার কাছে এলেন। পাশের বেঞ্চে বসে বলল, ' কি ব্যাপার?
অন্তু! তুমি যাচ্ছো না? যে, সবাই তো চলে গেল! '
ছেলেটি বলল, ' আমার মা
আসবে, আমায় নিতে '
বাহ, আচ্ছা ঠিকাছে বলেই
অর্পা আবার চলে এল, বাড়ি যাবার আগে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে যাবার তাড়া আছে। সে
আর পেছনে ফিরল না।
অর্পা রুম থেকে বেড়িয়ে
পড়তেই দারোয়ান এসে রুমে তালা মেরে গেল। রুমটা কালো অন্ধকার হয়ে গেল আলোর অভাবে।
(দুই)
অর্পার আর নতুন চাকুরী হচ্ছে না। সিভি ছেড়ে যাচ্ছে
একের পর এক কোম্পানি তে। এই সেদিনও একটা ইন্টার্ভিউ দিয়ে এল।
কোন পাত্তা নেই সেখান
থেকে, অথচ বেশ ভালো হয়েছে ইন্টার্ভিউ।
অর্পার বান্ধবী অর্হি,
এই দুদিন আগেও চাকরী করব! চাকরী করব! বলে চেঁচাল
অথচ বাসায় তার জন্য ছেলে দেখা হয়েছে শুনে কি খুশী!
বিকেলবেলা দেখা হতেই
উচ্ছ্বাসিত গলায় অর্পাকে বলল, ' নে, যাহ! চাকরী এবার বিয়ের পর করবো '
অর্পা বলল,
-এমন বর আজকাল আছে? তোর
হবু বরের বাড়ি? তারা রাজী হবে তো?
-সিউর থাক, হবে!
-দেখিস, ফেঁসে যাস না
আবার!
-আরে রাখ! না করলে, শুয়ে
বসে কাটাবো! বর, একটা টেক-কোম্পানীর চীফ ইঞ্জিনিয়ার। এত্ত টেনশন লাগে? বল!
অর্পা, অর্থির কথার যুক্তি
মেনে নেয় তবুও মনে মনে একমত হয় না। অর্পা স্বাধীনচেতা, সম্পর্কের খামারে নিজেকে পোষা
কোন প্রাণী ভাবতে অন্তত পারে না। সেটা হয়ত অর্হি পারে। তাই পরিবারের সবচেয়ে আদুরে একমাত্র
মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একটা স্কুলে চাকরী করে চলেছে।
' শোন! আরো ফুচকা খাবি
তুই? ' অর্হি বলে উঠল।
নাহ, আজ থাক। যা খেয়েছি,
এটা একটু কম ই লাগছে যদিও! বলে মুচকি হাসল অর্পা।
দুই বান্ধবী ফিরল সারা
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুরেফিরে। আরো দেরী হতো যদি হবু বর অর্হিকে
ফোনকল না করত। অর্পার রাগ লাগে, এতদিনের প্রিয় এক বান্ধবী আচমকা কোন এক লোকের কাছে
চট জলদি হারিয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সবজায়গা তে ওরা কিভাবে কিভাবে যেন একসাথে
ছিল। খুব ভাগ্যবতী কিংবা ভাগ্যবান না হলে এমনটা সচরাচর হয় না।
বাসায় ফিরে অর্পার মনে
পড়ল আজকের ক্লাস টেস্টের একগাদা খাতা দেখতে হবে। বাচ্চাকাচ্চাদের ইংরেজী পড়ানোটা কত
বেশী কঠিন কে জানতো!
ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে
হিটারে কফি দানা আর চিনি ছেড়ে দিল। রাতে আর খাবারের দরকার নেই। ফুচকা খেয়ে পেট একেবারে
ভর্তি।
বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হলো।
ফ্রেশ হয়ে আর দেরী করা গেল না। ক্লাসের খাতা দেখতে হবে।
চুলগুলো হালকা নেড়ে নিয়ে
কফির মগ হাতে অর্পা বসল এক্সামের খাতা দেখতে। ২০ মার্কের খাতায় একেক বাচ্চার একেকরকম
ভুল। কেউ Tiger স্পেলিং লিখেছে Iger কেউ রাইমে মাঝের লাইন ফেলে দিয়েছে। তবুও মানা যাচ্ছিলো
কিন্তু শেষ খাতাটা আর মানা গেল না। একটা মহিলার ছবি আকাঁ তাতে। মহিলার ছবিতে দেখা যাচ্ছে
মহিলার এলোচুল, নাকে নোজপিন, কপালে ছোট করে টিপ। কিন্তু ছবি আকাঁতে আনাড়িপনা থাকলেও
বেশ সুস্পষ্টভাবে একেঁছে ছবিটা। অর্পার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। খাতার উপরে লেখা রোল ৩১,
নাম অন্তু। এই সেই গোবেচারা!
কোন ছাত্রছাত্রী ক্লাসে
খারাপ করলে ক্লাস টিচার হিসেবে অর্পাকে জবাবদিহি করতে হয় প্রিন্সিপালের কাছে। এখানেও
তাই। বাচ্চাটি কেন অমনোযোগী সেটার কারণ অর্পার কাধেঁ।
অর্পা রাগে খাতাটা ছুঁড়ে
দিল টেবিল থেকে নীচে। সেটা উড়ে গিয়ে পড়ল বাইরের দরজার কাছে। অর্পা কফির মগে আর চুমুক
দিল না। ছোটবেলা থেকেই যেকোন কাজের ব্যাপারে ও একশভাগ সচেতন। তাই এমন ছোটখাটো ভুল নিজেও
করেনা, আর কেউ করলে ওদের কে ও নিজেও খুব একটা পছন্দ করে না।
(তিন)
পরদিন ক্লাসে এসে অর্পা
সব ছাত্রছাত্রী কে খাতা দিল। অন্তুকেও দিল। বলল, ' শোন, তোমার মা কে আমার সাথে কথা
বলতে বলবে। ঠিকাছে?'
অন্তু ঘাড় কাত করল। নীচু
গলায় বলল, ' আচ্ছা, বলবো '
এভাবে আরো মাস চারেক
কেটে গেল। অর্পার প্রিয় বান্ধবী অর্হিটা আজকাল বেঈমান হয়ে গেছে, ফোন করাটাও আজকাল ভুলে
যায় যেখানে দু-তিনদিনে একবার হলেও ফোন করতো। এজন্য বলি বিয়ে করিস না।
একাএকা এক প্লেটে ফুচকা
খেয়ে বাড়ি ফিরল অর্পা। ফেরার পথে আরেক ববান্ধবী রিদ্ধিতার সাথে দেখা। ওর বেবী নিয়ে
বাড়ি ফিরছিল। বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতু ছিল ও। একবার ইউনিভার্সিটি হলে ওর পড়ার
বইয়ের ভেতর একটা হিউম্যান স্কেলেটনের ছবি চুপ করে লুকিয়ে রেখেছিল রুমের সবাই মিলে।
সেটা এই মোটা চশমাপড়া মেয়েটা মাঝরাতে দেখে সে কি হইচই!
হলের প্রভোস্ট পর্যন্ত
এসে হাজির।
দুই বান্ধবী শুধু সময়ের
স্বল্পতায় ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা টুকে নিল। হয়ে গেল আংশিক কোলাকুলি।
অক্টোবর ২০১৬,
ক্লাসে পিনপতন নীরবতা।
এক্সামের খাতা দিচ্ছে অর্পা। আজ তার মেজাজ প্রচন্ড গরম। গলায় মেরুন রঙের একটা স্কার্ফ
জড়ানো ছিল শীতের সকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে। সেটাও খুলে টেবিলে রেখেছে সে। কোনভাবেই
নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না।
উঠে গিয়ে খটাশ করে চড়
বসিয়ে দিলেন অন্তুর গালে। সে বরাবরের মত একজন মহিলার ছবি এক্সামের খাতায় একেঁ রেখেছে।
' তোমার মা কে আজ ই ক্লাসের
পরে দেখতে চাই! ঠিকাছে? এর আগেও বলেছি আনোনি ডেকে!'
ছেলেটি আবার মাথা নাড়ল
হ্যাঁ মতন। তারপর ভারী পায়ে পেছনে গিয়ে ধপ করে বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।
ক্লাসের সবাই তখন অবাক
হয়ে ওদের ম্যাম কে নিষ্পলক দেখছে।
অর্পা নিজেও অসহায়। নিজেও
ভাবেনি এমন কিছু হোক। তবে আজ নিজে থেকে ছেলেটির ব্যাপারে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে
কথা বলবে। এভাবে চুপচাপ থাকা যাচ্ছে না।
ক্লাস শেষ হলো, অর্পা
নিজেকে মানাতে পারছিল না। রাগ করে ই হয়ত অন্তুকে চড় টা মেরেছে। তাই সবাই যখন চলে যাচ্ছিল
তখন সে অন্তুর কাছে এসে বলল, ' তুমি পড়াশোনা করো না কেন?'
অন্তু ম্যাম কে অবাক
করে ব্যাগ কাঁধে ক্লাসে বাইরে চলে গেল। অর্পা কি ভেবে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে আর অন্তুকে
পেল না।
বাইরে দারোয়ান ছিল, তাকে
জিজ্ঞেস করতে সে বলল। সব বাচ্চারা চলে গেছে, কেউ স্কুল ভ্যানে আর কেউ কেউ তার বাবা-মায়ের
হাত ধরে।
কেন ম্যাডাম?
নাহ, এমনি! আচ্ছা ঠিকাছে।
অর্পা প্রিন্সিপালের
রুমে এল।
' আসুন, মিস অর্পা! কেমন
আছেন?'
-ম্যাম, আছি ভাল।
-নিন, বসুন।
চেয়ারে বসতে না বসতে
প্রিন্সিপাল ম্যামের ফোন এল। উনি ইশারায় আঙুল উঁচিয়ে এক মিনিট বুঝিয়ে ফোন ধরলেন। ফোনের
এপাশে একবার আচ্ছা, তারপর দেখছি, তারপর ঠিকাছে বলে ফোন রেখে দিলেন।
এরপর দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে
চোখের চশমা খুলে বললেন, ' হ্যাঁ, কি ব্যাপারে যেন বলছিলেন অর্পা?'
অর্পা ততক্ষণে ক্লাসের
রোল ৩১ এর অমনোযোগীতার কথা ম্যাম কে খুলে বলল।
সব শুনে ম্যাম, অবাক
হয়ে এবার দ্রুত চশমা চোখে দিলেন। আচমকা, শুধু একটা লাইন ই বললেন, ' সে কি! আবারো?'
অর্পা এই " আবারো"
মানে টা তখনো বোঝে নি। তবুও বলল, ' আগেও ওর মায়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছি। স্কুলে আসতে
বলেছি। কোন রেসপন্স ই নেই!
প্রিন্সিপাল বললেন, শুনুন!
অর্পা। আপনি এখানে এসেছেন প্রায় ১০ মাসের উপর। অনেকদিন, তাই এটা আপনার জানা উচিত ছিল।
দেখুন ম্যাম, আমি ইচ্ছে
করে চড় মারিনি! বেশ কাতর কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন অর্পা।
আমি আপনার কথা বলিনি।
আপনি চড় মেরেছেন? কিন্তু!
কিন্তু কি ম্যাম?
আপনি শোনেন নি?
অর্পার মুখ কৌতুহলী হয়ে
উঠল। নাহ!
আমাদের প্রতি ক্লাসে
সীট সংখ্যা ৩০, এখানে ৩১ রোল কোথাও নেই! আর আপনি যার কথা বলছেন সে নামে কোন ছাত্র আমাদের
এখানে আর নেই!
আর নেই! কি বলছেন ম্যাম!
আজকেও এই একটু আগে সে ছেলেটি ক্লাসে ছিল। ছুটির পর সে চলে গেল।
প্রিন্সিপাল চেয়ার ছেড়ে
উঠে অর্পার কাছে এলেন। তারপর হাত ধরে টেনে স্কুলের পুরোনো আলমারি খুলে একটা স্টুডেন্ট
আইডি ফর্ম দেখালেন। তারপর বললেন, 'হি ইজ ডেড! '
অর্পা ছবি আর ফর্ম মেলাল।
চোখ বড়বড় করে বলল, '
এতো অসম্ভব! একটু আগেও যাকে ক্লাস করতে দেখলাম সে কি করে?'
প্রিন্সিপাল বিমর্ষ কণ্ঠে
বললেন, ' ছেলেটি, বেশ ভালো আঁকতো কিন্তু ক্লাসেও তাই করতো। পড়াশোনা তে ভাল ছিল কিন্তু
সে তা করবে না উল্টো সবসময় আকাঁ! আমরা ছেলেটির
মা কে একদিন ডাকলাম। উনি বলেও গেলেন এরপর থেকে খেয়াল রাখবেন। উনার স্বামী পাইলট ছিলেন।
একটা প্লেন ক্রাশে মারা যান। একটা ছেলে। তাই তাকে ই দেখভাল করতেন। ছেলেটি কারো সাথে
কথা বলতো না খুব একটা। যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন আমি স্কুলে ছিলাম না। যেহেতু, ছেলেটি
চুপচাপ থাকত। তাই কেউ ওর সাথে কথা বলত না, ও নিজেও বলত না।
স্কুল ছুটির পর ও নিজের
ক্লাসে ই ছিল ওর মা আসবে বলে। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যাও ছিল ছেলেটির। এটা আমাদেরও জানা
ছিল না।
আর একা ক্লাসে চুপচাপ
বসে থাকায় দারোয়ানের নজরে আসেনি। আমার কাজে তাড়া ছিল, দারোয়ান আমার অনুপস্থিতি তে দ্রুত স্কুলে তালা দিয়ে বাড়ি
চলে যায়। কিন্তু ছেলেটি থেকে যায় ক্লাসে। শ্বাসকষ্ট পেয়ে সেখানেই মারা যায়।
ওর মা এসেছিল ওকে নিতে
কিন্তু স্কুলের বাইরে তালা পড়ে গেছে। আমাকে ফোন ও করেছিল ওর মা কিন্তু সেদিন আমি তার
ফোন তুলতে পারিনি। পরদিন ছেলেটির মৃতদেহ প্রথমে পায় সুইপার ক্লাস ঝাড়ু দিতে এসে। জানাজানি
হবার বেশ আগে ওর মা আসে। আমি নিজেও প্রচন্ড চাপে পড়ে যাই। স্কুলের সুনামের কথা ভেবে
ক্ষতিপূরণ দিতে চাই। স্কুলের ম্যানেজমেন্ট থেকেও তাই বলতে বলা হলো আমাকে। কিন্তু সব
বলার আগে ওর মা আমাদের তিনতলা থেকে লাফ দিলেন নীচে।'
একনিঃশ্বাসে করুণ ট্রাজেডি পুরোটা বললেন প্রিন্সিপাল ম্যাম।
অর্পা কাঁদছে অনুশোচনায়।
না জেনে কেন সে চড় মারল! ভুল তো তার। ছেলেটি এখনো তার মা কে ঘিরে বেঁচে আছে এক ভিন্ন
জগতে।
অর্পা ধীর পায়ে প্রিন্সপাল
ম্যামের ঘর থেকে বের হয়। রুমের বাইরে বেড়িয়ে তার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। অন্তু এবং একজন
মহিলা। যার চুল এলোমেলো, কপালে ছোট টিপ, অসহায় চোখে অর্পার দিকে তাকিয়ে।
অন্তু আঙুল দিয়ে অর্পাকে
দেখিয়ে বলল, 'ম্যাম, এই যে আমার আম্মু '
অন্তুর মা, বড় চোখে অর্পার
দিকে তাকিয়ে।
অর্পা একবার শুধু চিৎকার
করল, ' অন্তু! ' এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল স্কুলের করিডোরে।
(সমাপ্ত)