সোমবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৬

গল্পঃ সারপ্রাইজ




(এক)

তূর্না এক্সপ্রেসের ঠিক বামের সারিতে বসে সিগারেট জ্বালাচ্ছি কিন্তু চোখ গেল ডানে।
আমি একা বলে কখনও কেবিন ভাড়া নেই না। আগ্র নিতাম, এখন অবশ্য পকেটে মৃদ্যু টান। তাই আগের মত টাকা-পয়সা খরচ করি না।
কিন্তু ডানে, ঐ যে বলছিলাম। যাকে দেখতে পেলাম তার উপস্থিতি যদি আমার চিন্তার সাথে মিলে যায় তাহলে ভালো কিংবা খারাপ জানি না।
স্রেফ অবাক হব। কেননা, এতদিন পর অচেনা পথে চেনা এক মানুষের সাথে দেখা হওয়া অবাক হবার মতই ঘটনা!
এক যুবক বয়সী ছেলে, আনুমানিক ১৮ থেকে ২০সিফনের শাড়ি পড়া এক মহিলাকে নির্দেশ করছে,
মা, তুমি গিয়েই ফোন করবে, 'ওকে?
আর রাস্তায় খাবার টা দয়া করে খেয়ে নিও।
আচ্ছা বাবা, তুই মন দিয়ে পড়ালেখা করিস।
ঠিকাছে মা, তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।
আমি পূজোর ছুটিতে বাড়ি আসছি।
আর টুকটুকিকে মন দিয়ে পড়তে বলো।
আচ্ছা বাবা।
অন্যর কথোপকথন শোনা পাপ কিনা জানি না, তবে আড়ি পাতা উচিত নয়। ইচ্ছে করেও শুনতে চাইনি কিন্তু তাদের কথোপকথন কানে না আসলে লোকে আমায় কানে কালা বলত। সে যাই হোক! ট্রেনের হুইসেল বাজছে।
মনে পড়ল আজ সিলেটের পথে যখন যাচ্ছি ঠিক ১৮ বছর আগে ঠিক এপথেই ঢাকায় এসেছিলাম পড়াশোনার খাতিরে।
ইচ্ছে ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এ পা রাখব। ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল, তবে সে ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে হয়ত কারও কথা রাখতে... এই যে ভাই, টিকিট দেখান! (আমার চিন্তাজগতে হানা দিল টিটি)
পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টিকিট টা হাতে তুলে দিলাম।
কি একটা লেখালেখি করে ফেরত দিল লোকটা।
টিকিয়া টা ফের জায়গামত রেখে ভাবতে থাকলাম পুরোনো স্মৃতি
ঐ যে কথা দেবার কথা ছিল সেটা রাখা আর হয়নি।
অনেক কেঁদেকেটে একাকার করেছিল সে। আম- ছালাহীন কাউকে পাত্রী তুলে দেবার মত বোকামী কোন পিতা-মাতা কোনোদিন করেননি, আর আমার জন্য ভিন্নতা সেদিনও হয়নি।
কথায় আছে, "লুকোনো জিনিস পোক্ত হয় বেশী "
আমিও লুকিয়ে রেখেছিলাম সবার থেকে। সেটা লুকোনোই থেকে গেল।
ট্রেনে তখনও ছেলেটি তার মা কে বুঝিয়ে যাচ্ছে। ঠিক করে যেও, খেয়ে নিও
পাশ থেকে বৃদ্ধ এক লোক ছেলেটি কে বলল, মা কে নিয়ে টেনশন করো না! বাবা! তোমার মা, ভালোমতো ই যাবেন।
খানিকটা হাত তুলে আবার হাত নামিয়ে মুখ ঢেকে ট্রেন থেকে নীচে নেমে গেল ছেলেটি। বা'হাতে মুখ ঢাকছিল অনেকবার আমিও আমার চোখ সরাইনি। নীচে নেমে দু'হাতে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগল ছেলেটি।
'মা কে ছেড়ে থাকতে, কেমন লাগে বিভূতি? "
আমার নিজের কথা মনে পড়ে গেল। নিজের মা গত হয়েছেন বছর পাঁ'চেক। এখনো মনে হয়না, আমার মা নেই!
ট্রেন চলতে শুরু করেছে, ঝমঝম... ঝমঝম...
মায়ের চোখে জল দেখতে পেলাম। তিনিও কাঁদছেন তার ছেলেটিরর জন্য। মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে চলেছেন।

(দুই)
ট্রেনের বগিতে হেলান দিয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। বয়স হয়ে যাচ্ছে, শরীরের মাঝে ক্লান্তি এসে জমা হচ্ছে, ঠিক যেমন মানুষের ভূরিতে মেদ জমা হয়।
যে স্টেশনে ট্রেন থেমেছে সেটা আসলে স্টেশন নয় একটা জাংশন।
আগের ট্রেন ক্রস করছে দেখে আমাদের ট্রেন থেমেছে।
চায়ের অর্ডার করছি হঠাৎ এক মহিলার কন্ঠে চমকিত হলাম।
আমার আশংকা ছিল এধরনের কিছু হবে না। কিন্তু না হয়ে মনে হয় থাকল না!
বিভূতি?
মুখটা জানালা থেকে ঘুরিয়ে দেখলাম সেই মহিলা যাকে তার ছেলেটি বিদায় বলল ট্রেন ছাড়ার সময়ে তিনি।
জ্বী বলুন!
তুমি? এখানে?
......... (মনে পড়ল পুরোনো কথা)
অভিনয়ে আমি বরাবরই ফেইল করি, মনে আছে মদনমোহন কলেজের শেষ ফাংশনে আমার অভিনয় করার কথা ছিল। সব ঠিক ঠাক। মেকাপ নেয়া হয়েছে, ডায়লগ কড়া মুখস্ত।
স্টেজে উঠেছি, কিন্তু আমাকে দেখে লোকজনের অট্টহাসি!
ব্যাপারটা বুঝলাম আমি ডায়লগে প্যাঁচ দিয়ে ফেলেছি। অতি উৎসাহী হয়ে ভুল ডায়লগ ডেলিভারি দিয়েছি!
মুখ চুন করে নেমে গেছিলাম স্টেজ থেকে, অভিনয়! আমার দ্বারা নয়!
আজও সেই কথাটা মনে পড়ে গেল মুখ লুকিয়ে আর অলকার কাছে পার পাওয়া গেল না।
আর কি কপাল! অভিনয়ের পর সেদিন মন খারাপের মাঝে বসে আছি
একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল, মেয়ে মানুষ এগিয়ে আসতে দেখে নিজের চোখ মুছলাম।
কাঁদতে দেখলে সম্মান থাকবে?
কি বিভূতি কাঁদছো কেন? ভুল সবার ই হয়। ভেবে দেখো তোমার ভুলে কত লোক ই না আনন্দ পেয়েছে!
অট্টহাসি দিয়েছে তার মানে তুমি সবার থেকে বেস্ট!
ভেজা চোখের মুখে মৃদ্যু হাসি এলো।
মেয়েটি আমার ক্লাসমেট অলকা।
দেখতে আট-দশটা সুন্দরী মেয়েদের মত নয়, যার গায়ের বর্ণ গোর চাঁদের মত! কিংবা সোনালী আলতা!
বলতে গেলে, ওর চোখ দুটো অসম্ভব মায়াবী। চুলের ঢেউ যেন সমুদ্রের মত। লাজুক হাসি মুখে সব সময়।
এত মায়া মেয়েটি কোথায় খুঁজে পায় তখনও জানি না!
মেয়েটির সাথে এক দুই কথা, এক সপ্তাহ, এক মাস করে এক বছরে পা দিল।
আমরা কেন জানি শুধু বন্ধু নই সেদিন।
কলেজ জীবনের শেষ ভাগে প্রেমে পড়ব! কাউকে ভালোবাসবো এটা ভেবে উঠা হয়নি।
ঈশ্বর হয়ত এমন নি, যারা বেশী ভাবে তাদেরকে সারপ্রাইজ করেন।
আমার সারপ্রাইজ বেশী দিন থাকেনি। ঈশ্বর সারপ্রাইজ বেশী দিন দিতে ভালোবাসেন না। আমার রেজাল্টের পর ইউনিভার্সিটি ভর্তির তাগিদে ঢাকায় আসতে হলো।
অলকার রেজাল্টের পর তার মা-বাবা ব্যাবসায়ী পাত্র ঠিক করলেন।
অলকা আমাকে কিছু করতে বারবার চাপ দিল, কি করব? ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। কি বা করার ছিল কলেজ পাস যুবকের?
চুপচাপ করে ছিলাম একটা বছর! সবার মত অলকাও হয়ত আমাকে ভীরু কাপুরুষ দের কাতারে ফেলে দেবে। দেয়ার উপযুক্ততা ছিল বেশী।
বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র আমার হলের ঠিকানায় এসেছিল।
প্রেরকঃ অলকা
(বাকী ঠিকানা না বলাই শ্রেয়, থাক না কিছু ব্যাক্তিগত)
অলকা এদিকে আমাকে ডেকে চলেছে,
জবাব দিলাম, গলা নামিয়ে, বাড়ি যাচ্ছি, তুমি?
হুম, আমিও।
-অনেকদিন পর দেখা, তাইনা? (প্রশ্ন করতে ইতস্তত ভাব হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি বিভূতি নই অন্যকেউ, কোন চোর! চুরি করার পর অনুভূতি)
-অলকা বলল, হ্যা। কি করছো আজকাল? শুনেছি লেখালেখি?
(অবাক না হয়ে পারলাম না, মেয়েটি আজো আমার খোঁজ রাখে?)
-হ্যা, খুব সামান্য। একটা প্রেসের এডিটর। সাথে হালকা কলম চালাচালি।
-বিয়েথা?
(মেয়েটা আজো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রশ্ন করে যাচ্ছে)
-না! হয়নি।
-হয়নি না করোনি?
-দুটোই বলতে পারো।
-কেন? ইচ্ছে নেই!
এ প্রশ্নের উত্তর অলকা জানে। তবুও এ উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না। তাই অন্য প্রসংগ টেনে বললাম, 'চা খাবে? ' ফ্লাক্সে আছে।
ঠিকাছে।
ফ্লাক্সে চা ঢেলে ওর হাতে তুলে দিলাম। চিনি কম, আমার ডায়াবেটিকস কি না!
-বাহ রে! এই অল্প বয়সে ডায়াবেটিকস!
এক দমকা হাসি গলা পর্যন্ত এসে আটকে গেল আর মুখে এলো না। বললাম, আমাকএ কি এখনো তোমার ২৫ বছরের যুবক মনে হয়?
অলকা এবার হাসল, বলল "তোমার চায়ে চিনি বড্ড কম "
-কিছু মনে না করলে একটা সিগারেট জ্বালাবো?
-হ্যা ঠিকাছে।
সিগারেট জ্বালিয়ে জানতে চাইলাম, তোমার স্বামীজি কি করেন?
চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, এখন সিলেটে একটা মার্কেটের মালিক। বাড়িতে থাকেন, মাঝেমাঝে টাকার হিসেব করতে মার্কেটে যান।
-ছেলেমেয়ে?
-এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে ঢাকায় এসে এবার, ছেলেকে একটা বেসরকারি ভার্সিটি তে ভর্তি করলাম। মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ছে সিলেটে।
-বাহ, বেশ ভালো আছো তাহলে।
শুকনো মুখে হাসল অলকা।
আমি সিগারেট হাতে জানালার বাইরে মুখ রাখলাম।

অনেক্ষন হয়েছে কেউ কোন কথা বলিনি। অলকা আমার পাশে এসে বসে আছে সেই অনেক আগে থেকে এরপর আমিও কিছু বলিনি ও কিছু বলিনি।
দুজনে চুপচাপ। মাঝে ট্রেনের হুইসেল আর ছুটে চলা ধাতব শব্দের ঝিকঝিকে আওয়াজ!
অলকা এবার কথা বলল, তোমার কিন্তু বিয়েতে আসা উচিত ছিল!
কার বিয়েতে? (বুঝেও না বোঝার ভান করলাম, আসলে এ নিয়ে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই)
অলকাও চুপ করে গেল।
বললাম, মেয়ের বিয়ে অন্তত কলেজের পর দিও না। জিজ্ঞেস করে নিও কাউকে ভালোবাসে কিনা। নয়ত আফসোস থেকে যাবে!
অলকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, 'আফসোস! ' তুমি ভাব এ নিয়ে?
বললাম, আসলে ভাববার মত আরো কিছু হয়ত আছে, ছিল তাই....!
(থেমে গেলাম দুজনেই)
অলকা বলল,
শুনেছি তুমি ইদানিং এখানে -সেখানে ঘুরে বেড়াও, তো সিলেটে আমাদের বাসায় একদিন এসো, তমার সাথে পরমের দেখা করিয়ে দিতাম। (অলকা আমার খবর রাখে!)
ফিল্টার টা জানালার বাইরে ছুঁড়ে বললাম, পরম! তোমার স্বামীজির নাম? কি পরম সৌভাগ্য!
কেন? খুব বাজে বুঝি?
নাহ! তেমন তো কিছু বলিনি।
মানুষ হিসেবে অনেক ভাল পরম। পরিবারের সবার প্রতি যত্নশীল।
বিভূতিবাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন। তুমি বোস, আমি একটু আসছি!
কম্পার্টমেন্টের বাইরে এসে ২য় সিগারেট জ্বালালেন বিভূতিবাবু।
মেয়েরা প্রচন্ড স্বার্থপর! আজ নিজের স্বামীর গুনগান করছে তাও আবার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে!
মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত বদলে যায় এরা।
আমার গায়ে জ্বালা ধরানো ছাড়া আর কি বা হতে পারে এর মানে?
ট্রেনের দরজা দিয়ে বাইরে ধু-ধু বাতাসে মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছিলাম কিন্তু টিটি এসে বলল, এই যে ভাই!
এভাবে বাইরে যাবেন না, পড়ে গেলে মারা পড়বেন তো!
ভেবে দেখলাম, আমি প্রকৃতভাবে এক মৃত ব্যাক্তি যার কেউ নেই, নেই পিতা-মাতা কিংবা কাছের কেউ। দূরসম্পর্কের আত্বীয়-সজন হয়ত আছে কিন্তু তেমন কেউ!
সিগারেট পুরোটা শেষ করতে পারলাম না। সিটে ফিরে এলাম। দেখলাম, অলকা নিজের সিটে গিয়ে শুয়ে আছে।
যাক, বাঁচলাম! অস্বস্থি লাগছিল। এর কোন উত্তর নেই।
আমি ইচ্ছে করেও চাইনা দ্বিতীয়বার তোমার সাথে দেখা হোক।
এক ঘন্টা পর সিলেটে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।
নিজে হাতে একটা সি এন জি তে তুলে দিলাম অলকা কে।
আমার ফোন নম্বর চাইল, বললাম এখন না একদিন বাসায় গিয়ে সারপ্রাইজ দেব।
অলকা মৃদ্যু হাসল। সিএনজি ধোয়া তুলে চলে গেল। যাবার আগে চোখে পড়ল, বাম কপালের চুলে পাঁক ধরেছে ওর ও।

(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...