রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬

গল্পঃ সাইকো




(এক)
জেলা সদরে আসবার পর আমার বেশ ভালো লাগছিল বলতে হবে এখানে রোগী একদম কম নয় যখন সাইকিয়েট্রি পড়ার ডিসিশন নিয়েছিলাম আমার ডাক্তার বন্ধুরা মুচকি হেসেছিল বলত, পাগলের চিকিৎসক হয়ে কি করবি? সার্জন হতে ট্রাই কর!
ট্রাই আর করিনি নিজের ইচ্ছের গুরুত্ব দিতে শিখেছি তাই সাইকিয়েট্রি বেছে নিয়েছিলাম
সরকারী কোয়ার্টারে জায়গা হয়েছে আমার রেসিড্যান্ট ডক্টর হয়ে এখানে এসেছি আজ- জয়েন করবার কথা অবশ্য আজ- ছিল কিন্তু ট্রেনের টিকিট না পাওয়াতে বেশ দেরী করে ফেলেছি তাই শেষ বেলাতে হসপিটালে না ঢুকে সোজা কোয়ার্টারে ঢুকলাম সরকারী মেস আর কোয়ার্টার একই কথা
সেই কবে কে বানিয়েছিল ওই দিয়েই চলে যাচ্ছে যুগের পর যুগ আমার রুম টা হলো দোতলায় একদম ডানদিকে ঘরের সাথে একটা কিচেন, একটা বাথরুম আর ছোট মতন একটা ব্যালকনি আছে মন্দ না!
আমাকে চাবি দিয়েই সবটা নিজ দ্বায়িত্বে ঘুরে দেখাল সাইফুল এখানকার কেয়ারটেকার তাগড়া বয়েস, মুখে নিরন্তর হাসি আমাকে দেখেই বলল, ‘স্যার, আপনেরে দেইখ্যা অনেক ভাল্লাগতেছে আপনি লোক ভাল এইটা আপনারে দেইখ্যাই বুঝা যায়
সাইফুলের অভিজ্ঞতা থাকতেই পারে চেহারা দেখে গুন বিচার করার ক্ষমতা কিন্তু আমি লোকটা বেশ সুবিধার নই, বেশী পরিমান স্বার্থপর
রাতের বন্দোবস্ত করে সাইফুল চলে গেল আমি রাতের খাবার শেষ করে সিগারেট ফুঁকতে গেলাম ব্যালকনি তে কোয়ার্টার টা প্রায় ইংরেজিএলশেইপড সামনের দিকে একটা বড় বকুল গাছ আছে পাশের বিল্ডিং থেকে ইশারা করে কেউ ডাকছিল এটা খেয়াল করিনি এতক্ষণ এবার দেখলাম ভদ্রলোক আলো টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বালিয়ে আমাকে ইশারা করছেন
শুনছেন?...
হ্যাঁবলুন!
আপনি কি ঢাকা ফেরত রেসিড্যান্ট সাইকোলজিস্ট? মানে ডাক্তার আবীর?
ডান হাতের সিগারেট লুকিয়ে হাতের বৃদ্ধাগুল দেখিয়ে বললাম, হ্যাঁ
সিগারেট দিয়ে প্রথমদিন কোয়ার্টারে ইম্প্রেশান খারাপ করতে চাই না
ব্যালকনি থেকে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দ্যাখার পর মেসেজ করলাম, অদিতি কে এতক্ষণ ওর কথা মনেই পড়েনি আমি নাকি প্রচন্ড আত্মভোলা এই নিয়ে তার অভিমানের সীমা নেই!
ঘুম ভাঙল মোবাইলের যান্ত্রিক অ্যালার্মে
ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম আজকে দেরী কোন ভাবে করা যাবে না
জেলা সদরে পাগলা গারদ, সোজা বাংলা ভাষায় পাগলা গারদ বললে লোকে ভাল বুঝে যায়আমি অবশ্য পাগল বলি না। ডাক্তার পেশা হিসেবে মেন্টাল পেশেন্টের সাথে জীবন কাটানোর প্লান কিন্তু মন্দ না এটা অবশ্য অদিতি বলে ওর ভাষায় আমি নাকি আধ পাগল আধ পাগল লোকেরা সরল হয় তবে আমি সরল কি না সেটা নিজেও জানি না
রিক্সা নিয়ে সোজা হাসপাতালের প্রধান ফটক হয়ে সোজা সাইকিয়েট্রি বিভাগ তিন তলায়। সিড়ি ধরে এক পা দু পা করে উপরে উঠে এলাম। এসেই দেখি আমার জন্য একজন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সিঁড়ির শেষ মাথায়। আমাকে দেখে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো।
হ্যালো ডক্টর! আবীর? অ্যাম আই রাইট?
ইয়াপ, আমি আবীরহাত মেলালাম দুজন।
প্লিজ ফলো মি
(ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি একজন ইন্টার্ন ডাক্তার। হাইট মাঝারি, চোখে কালো ফ্রেমের মোটা পাওয়ারের চশমা। চেলেটি সরাসরি আমাকে নিয়ে গেল প্রফেসরের রুমে )
হ্যালো, আবীর! (প্রফেসর হাত এগুলেন) আমি প্রফেসর সাত্তার। মানে লেট প্রফেসর হা হা…
আমিও তার সাথে হাত মেলালাম।
একটু বসুন আমি কাজটা দেখেই আপনাকে নিয়ে বের হচ্ছি রাউন্ডে।
দাপ্তরিক কাজ শেষে প্রফেসর আমাকে রাউন্ডে নিয়ে এলেন মুভির অ্যাসাইলামের চেয়ে খুব একটা বেশী চোখে পড়া ভিন্নতা নেই এখানে, তবে দেখায় অনেক পার্থক্য আছে
আমি এবং প্রফেসর সাত্তার সাহেব- দুজনে হসপিটাল ঘুরেফিরে পেশেন্ট, রিসার্চ রুম এসব দেখতে দেখতে শেষপর্যন্ত আমার জন্য বরাদ্দ করা চেম্বারে এলাম ছোটখাট রুম তার সেলিঙে একটা ফ্যান, একটা টেবিল সাথে হাতল দেয়া কাঠের চেয়ারএসি টা চলছে। টেবিলে অসংখ্য ফাইল
বুঝলেন? এসি টা অটো। সরাকারী জিনিস, তাই কেয়ার কম। তবে গরমে আফসোস লাগবে না।
চা খাবেন?
আমি না করলাম। তবুও তিনি দুটো ঠান্ডা পানীয় আনতে দিলেন।
আমরা দুজনে দুটো চেয়ারে বসে গেলাম।
নতুন পরিবেশ, নতুন মুখ। সব কিছুই বেশ ভালো লাগছিলতবে যেটা আমার খুঁতখুঁতে চোখে আটকাল সেটা হচ্ছে প্রফেসর স্যার এবং এখানে কাজ করা কিছু ইন্টার্নের আমার প্রতি উৎসুক দৃষ্টি
হতেই পারে, আমি এখানে নতুন প্রফেসর সাত্তারের ট্রান্সফার হচ্ছে, তার স্থলে আমি এসেছি আমি কেমন স্বভাবের এ নিয়র বাকীদের কৌতুহল তো থাকতেই পারে! সেটা একেবারে স্বাভাবিক বলে ভেবে নিলাম
সাত্তার সাহেব বলতে শুরু করলেন,
দেখুন, আপনি কাল এলে আমার আজ চলে যাবার কথা ছিল বয়েস হয়েছে আমার মেয়ে আমেরিকা থেকে গতকাল ফিরেছে অনেক বছর ওর সাথে দেখা হয় না একটা দিন কমে গেল বলুন?”
আমি মৃদ্যু হেসে বললাম, ‘আমি খুবই দুঃখিত, আসলে কাল ট্রেনের টিকিট টা ম্যানেজ করতে পারিনি
তিনি বললেন, “নো, প্রবলেম! আপনি এসে গেছেন এতেই যথেষ্ট তবে রোগীদের ব্যাপারে একটু কেয়ারফুল থাকবেন এরা সবাই দেখতে ইনোসেন্ট হলেও অনেকে মোটেই কিন্তু ইনোসেন্ট শব্দটার ধারেকাছেও থাকেন না
আমি আবার মৃদ্যু হাসলাম প্রফেসরের কথায়
আমার এখানে প্রথম দিন। খুব চাপ নেয়ার কিচ্ছু নেই। তাই সব বুঝে নিয়ে ধীরেসুস্থে আমি রাউন্ডে গেলাম আরো পরেসেসময়, কথা হলো এখানে কাজ করা কিছু ইন্টার্ণ ডাক্তারের শেষে কেউ কেউ তো স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল
এদের কাছ থেকে বাকী অভিজ্ঞতা টা তুলে নিলাম। শুনলাম এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের নানা ধরনের সমস্যাপাগলাটে রোগীদের কিছু কমন সমস্যা! যা হয় আর কি!
 কেউ একা একা কথা বলে, কেউ এক দৃষ্টিতে শুধু একদিকে- তাকিয়ে থাকে কেউ ডাকলে কথা বলে নয়ত চুপচাপ পড়ে থাকে
তাদের কে রাখার সেল গুলোও আলাদা করা আছে যেসব রোগী খুবই বিপদজনক, তাদের শেকলে বাঁধা হয়েছে মহিলা-পুরুষ কেউ বাদ নেই শিশুদের জন্য আলাদা সেল আছে
এত্ত ছোট জেলা শহরে সাইকিয়েট্রি বিভাগ এত্তো বড় হবে সেটা ভাবতে পারিনি রোগী দেখা শেষ করে রঙচটাসাইকিয়েট্রিলেখা দরজা দিয়েই বের হচ্ছিলাম সাথে ছিল ইন্টার্ণ অপুছেলেটা মাত্রাতিরিক্ত ভদ্র এবং বিনয়ী। আমাকে দেখে বলল, “স্যার, আসল পেশেন্ট তো এখনো দেখলেন না!”
আমিও উৎসুক চোখে বললাম, “আসল পেশেন্ট মানে?”
আসুন আমার সাথে, অপু আমাকে নিয়ে গেল আলাদা একটা রুমে বাইরে দুজন কনস্টেবল বন্দুক নিয়ে বসে ছিল আমাদের আসতে দেখেই এদের একজন আমার আইডি দেখতে চাইল অপু বাঁধা দিয়ে বলল, ইনি আমাদের নতুন প্রফেসর ডক্টর আবীর আজকে জয়েন করেছেন
সরি, ভেতরে আসুন বলে হাতের ইংগিতে একজন কনস্টেবল আমাকে আসতে দিল ভেতরে ঢুকেই দেখলাম দেয়ালের ঠিক কাছ ঘেষে একজন দাঁড়ি চুলে মুখ আড়াল করা লোক মাথা নিচু করে বসে আছে
তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমার হাত টেনে ধরল অপু, “আর এগুবেন না স্যার, এটা নিষেধ আছে হি ইজ ভেরী ডেঞ্জারাস!”
আমি থেমে গেলাম
অপু বলতে লাগল, “মার্ডার কেসের আসামী নাম আরমান, বয়েস ৩৯ আগে পেশা ছিল রাজমিস্ত্রি কিন্তু একবার ঠিকাদারের সাথে দেনা-পাওনা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় সেদিন খুব বেশী ঝামেলা হয়েছিল কেস ফাইল মতে, সে পেরেক গাঁথার হাতুড়ি দিয়ে ঠিকাদারের মাথা থেতলে দেয়
৩০২ ধারায় ফাঁসি হবার আদেশ হয় যেদিন, সেদিন কাঠগড়া থেকে অজ্ঞান হয়ে পুরো পাগল হয়ে সোজা এখানে আদালতের নিয়মে নাকি পাগল কে ফাঁসি দেয়া যায় না সুস্থ হলেই ফাঁসি নিশ্চিত! বলে থামল অপু
আমি এই সুযোগে লোকটার কেস হিস্ট্রি টা বেড থেকে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে নিলাম কিচ্ছু মনে নেই লোকটির! স্ট্রেঞ্জ!
আসুন স্যার, আমরা বাইরে বসে চা খেতে খেতে বাকীটা আলোচনা করি
হ্যাঁ, চলো
আমরা ক্যান্টিনে বসে গল্পে মেতে গেলাম চায়ের কাপ হাতে তুলে ভিজিটিং আওয়ারের বাইরে আমি ভুলেও এদের দেখতে যাই না পাগল কে ভয় লাগে স্যার! আসলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না তো তাই
আরে, ডক্টর হয়ে এসব বলছো?
সত্যি কথাই বলেছি স্যার!
প্রফেসর সাত্তার নিজেও খুব একটা যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না, তিনি নিজেও যে খুব গেছেন এমন না আমাদেরকে যেতে হতো, এখনো হবে
আরে না নাআমি এমন নই! পেশেন্ট মানে পেশেণ্ট আর বেশী কিছু নয় নাও চা ঠান্ডা হয়ে গেল
আমার বাইক ঢাকায় পড়ে ছিল সেটা আপাতত লাগছে না মন হচ্ছে কারন, অপু ওর বাইকে বিকেলে ফিরলাম কোয়ার্টারে
ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে মসজিদে আযান পড়েছে চাবি পকেট থেকে বের করে জোর পায়ে আমার রুমে দিকে ফিরতে চোখে গেল আমার রুমের সামনে সেখানে স্পষ্ট বুঝলাম কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে
-কে? কে?...ওখানে?
-এসে গেছেন? আমি মাহবুব চিনতে পারেন নি! কাল বিল্ডিং থেকে আপনাকে ডাকলাম
এগিয়ে এসে হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করলাম
-আমি আবীর
-শুনেছি, সাত্তার স্যারের কাছ থেকে, আজ কথা হয়েছে আমি নিজে স্টেশনে এগিয়ে দিলাম দুপুরের দিকে
-আসুনভেতরে আসুন… (আমি রুমের তালা খুলতে খুলতে তাকে বললাম)
বাপাশের দেয়ালে সুইচ জ্বালিয়ে আমরা দুজন ঘরে ঢুকলাম একসাথে
এরপরের প্রশ্নটা উনি করলেন, “আপনি একা?”
আরে না বিয়ে করেছি দুবছর আমার স্ত্রী অদিতি, খন ঢাকায় আছে সাথে আসেনি বললে ভুল হবে আসলে আমি নিজে থেকে আনি নি
-আচ্ছা আচ্ছা
আমি কিছু বলার আগে মাহবুব সাহেব আমার বেডের পাশে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসলেন নিজে থেকে
বললাম, “চা খাবেন?”
-নাহ! এখন থাক
(তাকে কিছু নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল)
একটা কথা ছিল বলে, ইতস্তত শব্দ করে আবার নিজেই থেমে গেলেন মাহবুব সাহেব
-কথা? কি কথা? (জিজ্ঞেস করলাম)
-না, তেমন কিছু না আপনাকে আরো এখন বিরক্ত করছি আমি পরে আবার আসবো এখন আসি আর দরকার হলে আমাকে একটা ফোন দেবেন (খসখস করে একটা কাগজে নিজের নম্বর লিখে আমার হাতে এগিয়ে দিল সে)
-আচ্ছা, অবশ্যই (নম্বরটা ভাঁজ করে আমার শার্টের পকেটে রাখলাম)
লোকটি চলে যেতে আমি ফ্রেশ হয়ে টিভির সামনে বসলাম কয়েকটা বই নিয়ে অনেকদিন ঘাটাঘাটি হয়নি মগজে মরচে পড়ে যাচ্ছে

হাসপাতালে রোগী দেখার চাপে সাধারণ জীবনের কোন খোঁজ থাকে না নিজের অবস্থান টা কাছের মানুষজনের কাছে বুঝিয়েও বলা যায় না এক না বলা জটিলতার সামগ্রিক পাঁচফোড়ন যাকে বলে রুটিন বাঁধা একঘেয়ে জীবন
সব ভালোমত যাচ্ছিল কিন্তু ঝামেলা হলো প্রায় সপ্তাহ খানেক পর আরমান মিয়াঁ, মানে পুলিশ পাহারায় থাকা পেশেন্ট হঠাত মারাত্বক বমি করা শুরু করেছে তার হিস্র আচরণের কারনে ওয়ার্ড বয় ছাড়া কেউ তার কাছে যেতে সাহস পায় না আমি সাথে সাথে কয়েকজন ইন্টার্ন কে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলাম তাতে কাজ হচ্ছিল না
অবশেষে, কিছুটা আয়ত্তে এনে দ্রুত ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে লোকটাকে ঘুম পাড়ানো হল
আমার ইউনিটের প্রায় সবাই ক্লান্ত, এভাবে হঠাত সবকিছু নিয়ে এত ঝামেলা হবে মাথায় কাজ করেনি
দু-দিন কেটে যা যেতেই বুঝলাম। সাধে প্রফেসর চলে গেছেন এখান থেকে।
আমি আরমান মিয়াঁ কে দেখাশোনার জন্য একজন দুজন ইন্টার্ন আর ওয়ার্ড বয় সেলিম কে রেখে গেলাম।
আমার কোয়ার্টারে ফেরা জরুরী ছিল।
আমাকে বাইকে নিয়ে নিজে নামিয়ে দিল অপু আমি রুমে এসেই ক্লান্তিতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না
তবে আসার পথে আজকে অপু আমাকে কথাটা না বললে অনেক কিছুই ঝাপসা থেকে যেত আমার কাছে স্যার, দেখেছেন আজকে?
কি?
আরমান মিয়াঁ সাথে আপনার মিল?
মিল! (অবাক হয়ে গেলাম অপুর কথায়)
ওর দাঁড়ি-গোঁফ না থাকলে কিন্তু দেখতে হুবহু আপনার মত
আমি কথায় পাত্তা দিলাম না অপু ইদানীং বেশী ফ্রি হয়ে যাচ্ছে আমার সাথে।
লোকটির সাথে আজ চোখাচোখি হয়েছে ইঞ্জেকশান পুশ করবার সময়ে আমার দিকে ফিরে কেমন একটা নিঃশব্দের হাসি হাসছিল সে


(দুই)
রুমে ফিরে জামা টা বদলানোর সুযোগ পাই নি। এলিয়ে পড়ে গেছি বেডে।
মনে পড়ল আমি বিছানায় শুয়ে আছিঘুম ভাঙা আড়চোখে ঘরের চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমার ঘরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক কিচেনের কাছাকাছি কালো একটা ছায়া আরো কাছে এগিয়ে আসছে আমার দিকে দরজা তো লাগিয়ে শুয়েছিলাম। এর মাঝে কে এসেছে ঘরে? চোর ডাকার নয়ত?
তবুও সাহস সঞ্চয় করে জোর গলায় বললাম, “কে? কে ওখানে?”
কালো ছায়াটা কাছে আসতেই দেখলাম একি! আরমান মিয়াঁ! তুমি?
লোকটির হাতে একটা হাতুড়ি, সেটা নিয়ে আমার মাথার কাছে এসে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে
কি চাই? জিজ্ঞেস করতেই
হাতুড়ি তুলে সজোরে বসিয়ে দিল আমার মাথায়
আমি চিৎকার করে উঠলাম
উফ!! স্বপ্ন দেখছিলাম, রুমে আলো জ্বলছে তাড়াতাড়ি উঠে বেসিনে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিলাম মনে হলো আরমান মিয়াঁ কি অবস্থায় আছে একটা খবর নিই ঘড়িতে দেখলাম রাত ১১ টা
ফোন হাতে নিয়েই দেখি ১৫ টা মিসড কল হসপিটালের অফিসের নম্বর থেকে এসেছে আমি ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম তাই বুঝতে পারিনি ফোন করেই শুনলাম দুঃসংবাদ!
আরমান মিয়াঁ পালিয়ে গেছে হসপিটাল থেকে থানা থেকে পুলিশ এসেছে আমাকে ফোন করা হয়েছিল কিন্তু আমি তখন ঘুমে ছিলাম হসপিটালে সিকিউরিটি বাড়ানো হয়েছে জোর খোঁজ লাগানো হয়েছে; সেইসাথে ঠহল চলছে পুলিশের
আমি রেডি হয়ে দ্রুত বের হতে যাবো হঠাত কিচেনে জোরে ধাতব কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেলামএবার তো স্বপ্ন দেখছি না!
নিজের হাতে নিজে চিমটি কাটলাম। না! সব ঠিকাছে এবার। দিব্যি জেগে আছি কিন্তু কিচেনে কে?
জোরে বললাম, কে?... কে ওখানে?
একটা লোক আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে একজন আগন্তুক! হাতে ধাতব লম্বা কিছু।
আমাকে দেখে আঁধারের আগন্তুক আমার মুখ টর্চের আলো ফেলল
আমি কায়দা করে জলদি করে কিচেনের আলো জ্বালিয়ে দিলাম। একি! অপু! তুমি এখানে? এতো রাতে? কি করে এলে?
দেখলাম অপু, একটা লোহার রড হাতে দাঁড়িয়ে আছে
অপু! তুমি এখানে?
তৃতীয় কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমার মাথায় ধাতব লোহার আঘাত পড়ল আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম

(তিন)
যখন ঘুম ভাঙ্গল, দেখলাম আমি সাইকিয়েট্রি সেই ওয়ার্ডে যেখানে আরমান মিয়াঁ ছিল আমার হাতে শেকল, পায়ে শেকল থানার সাব-ইন্সপেক্টর আমাকে দেখিয়ে বলল, “আবার যদি পালাস তাইলে তোরে আমিই ঝুলাই দিমু, বুঝলি?”
আমি কথা বলতে পারছি না
অপু কে দেখলাম ভেতরে এসেই দ্রুত সাব-ইন্সপেক্টর কে নিয়ে বাইরে চলে গেল আমার কথা কেন যেন কেউ শুনছে না! সবচেয়ে বড় কথা আমি আরমানের কেবিনে কেন?
ভুল ভাঙল অপুর সাথে যিনি প্রফেসর হয়ে আধা ঘন্টা পর আমার কেবিনে এলেন একি! আরমান মিয়াঁ?
সে দিব্যি প্রফেসরের পোশাক পড়ে ঘুরছে অপুর সাথে সাথে।
পুলিশ চলে যেতে ফাঁকা কেবিনে অপু একা এলো। বিদঘুটে হাসিমুখে বলল,
সরি স্যার! আসলে আপনাকে সেদিনের বলা গল্পটা বানানো ছিল এখানে আমি ছাড়া আর কেউ জানত না আরমান আমার বড় ভাই যেদিন সদ্য প্রফেসর হওয়া কয়েকজন নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারের তালিকা দেখছিলাম সেদিন আপনার সাথে আমার ভাইয়ের চেহারায় একটা মিল পেয়েছিলাম ব্যাপারটা সত্যি কাকতালীয় তবে চেষ্টা করলে কি না হয়! আপনার নিয়োগ যাতে এখানে হয় তার জন্য উপরমহলে টাকা দিয়ে সে ব্যবস্থা করলাম আপনাকে যাতে কেউ চালাকি করে কিছু লে দিতে না পারে সেটাও করেছি”।
শুধু শেষ কারিশমা টা দেখানো বাকী ছিল আরমান মিয়াঁর আসল নাম ইমরান কবির ইমু ইমু আর অপু দুভাই বেশ সিনেমা সিনেমা লাগছে? তাই না স্যার!
অপু চলে গেলযাবার আগে বলল, এভাবে থেকে যান না স্যার! পাগল হয়ে বেঁচে থাকলেন।
অপুর পুনঃরায় নিঃশব্দ হাসি…
আমি শুধু বুঝলাম আমাকে বাঁচতে হবে, এখান থেকে পালাতে হবে আমার জামার পকেটে মাহবুব ভাইয়ের ফোন নম্বর ছিল আমি সেটা খুঁজতে লাগলাম শার্টের পকেটে সেটা এখনো আছে কিন্তু ফোন করব কার ফোন থেকে?
ওয়ার্ড বয় সেলিম পান খেতে খেতে বলল, “কিরে আবার পলাইবি পাগলা?”
আমি পাগল না, আমি প্রফেসর আবীর
হু মামু! আমিও জেলার অখন ঘুমা, নাইলে পিটামু!
সেলিম কে যে করেই হোক বিশ্বাস করাতে হবে আমি আরমান পাগল নই! আমি হাসপাতালে গতকাল আরমান মিয়াঁকে দেয়া কয়েকটা ওষুধের নাম আর কখন দিয়েছিলাম সেটা ওকে খুলে বললাম সেলিম বিশ্বাস করতে পারছিল না পরে ওকে বললাম, আমার নিজের ফোন নম্বরে ফোন দিতে প্রায় এক ঘন্টা বোঝানোর পর সেলিম আমাকে বিশ্বাস করল তবে তাকে মোটা টাকা দিতে হবে আমি রাজী হলাম, ওর ফোন থেকে মাহবুব ভাইকে ফোন করলাম
মাহবুব ভাইয়ের সাথে সেদিনের দশ মিনিটের পরিচয় আমাকে এই ফাঁড়া থেকে টেনে তুললতিনি জেলার কে বুঝাতে সমর্থ হলেন যে, পাগল বানিয়ে বেঁধে রাখা আমি আবীর। জেলার পুলিশ ফোর্স এনে কালপ্রিট অপু এবং তার ভাই ইমু কে গ্রেপ্তার করল। আমাকে বলল, সরি! আসলে পেশাগত জীবনে ভুল তো হয়। আর সমস্যা বেঁধেছে দুজনের চেহারা অনেক কাছাকাছি হবার কারনে।
অপু আর ইমুকে আটক করে থানায় নেয়া হলো। আমাকে ছেড়ে দেয়া হলো। আমার জন্য প্রটেকশনের ব্যবস্থাও করা হলো।
ধকল গেল, সাক্ষ্য দেবার পর থানা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। ভাবলাম অনেক হয়েছে। আর না!
সাইকিয়েট্রি বিভাগ থেকে সেদিন- রিজাইন দিলামকেস মিটিয়ে আজকের ট্রেনে ঢাকায় যাচ্ছি তবে হতবাক হলাম আসার সময় মাহবুব ভাইয়ের কথায় তিনি নাকি এটা আগেই জেনেছিলেন তিনি নাকি আগের দিন হসপিটালে এনেস্থেশিয়া ডিপার্টমেন্টের আড়ালে আমাকে ফাঁসানোর সব প্লান গোপনে শুনতে পানকিন্তু সেটা ঐদিন সন্ধ্যায় বলতে এসেও সাহস করে আমাকে কিছু বলতে পারেন নি, যদি তাকে ভুল বুঝি
তবে মাহবুব ভাইয়ের ফোন নম্বর না থাকলে আমাকে এখন পাগলা আরমান সেজে সাইকিয়েট্রি বিভাগে পড়ে থাকতে হতো ট্রেনের হুইসেল দিচ্ছেএক মুঠো দমকা বাতাস আমার মুখে শান্তির ছোঁয়া দিল। পকেট থেকে বেনসন সুইচ টা ধরিয়ে উদাস হয়ে গেলাম অদিতি কে ভীষণ মিস করছি কথা ওকে বলা যাবে না, নয়ত আমাকে আর চাকরি করতে দেবে না

(সমাপ্ত)

উত্তপ্ত পৃথিবী এবং চল্লিশ ডিগ্রি

  সাম্প্রতিক সময়ে হিট ওয়েভ এর প্রভাব (ছবিঃ Google) পৃথিবী কেন গরমঃ                       ধরা যাক, একটি কাপে বেশ গরম চা এবং অন্য একটি কাপে ফ...